#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৪০]
পাঁচদিনের দিন হাসপাতালের পাট চুকিয়ে বাচ্চাসহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে রিনিতাকে। টানা দেড় মাসের মতো বিশ্রামের পরামর্শ দিয়ে তারপরই ডাক্তার তাকে মুক্তি দিয়েছে সেখান থেকে। চুমকি সেই কখন থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দোলনার উপর মাথা ঝুঁকে তাকিয়ে আছে বাচ্চাটির পানে। তনি তার জামা ধরে টানলো। মুখ ভার করে বললো,“আমিও দেখবো।”
কেয়া বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে ফেললেন তাদের কান্ড।সতর্ক কণ্ঠে বললেন,“ওখানে কী করছিস তোরা? মাত্র খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ল বাচ্চাটা। এখন তোদের ফিসফিস শব্দে যদি ঘুম ভেঙে যায় ওর? কে সামলাবে তখন? ওর জন্য সেই ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বউমার। সেও এখন একটু ঘুমিয়েছে। তোরা বাইরে চলে আয়।”
আদেশ মোতাবেক তনির হাত ধরে ড্রয়িং রুমে চলে এলো চুমকি। দাঁত কপাটি বের করে জিজ্ঞেস করল, “পোলার নাম কী রাখছেন খালাম্মা?”
“রিক্ত।”
“এইডা আবার কেমন নাম রাখলেন?”
“কেনো? নামটা তো বেশ সুন্দর। তবে আমি রাখিনি, রেখেছে ওদের বাবা।”
“ওহ যাক, তয় এই পিচ্চির মতন দুষ্ট না হইলেই হয়। এর লাইগা তো বাড়িত টিকাই যায় না।”
তনি কথাটা শুনে ফেললো। তৎক্ষণাৎ চোখমুখ কুঁচকে চুমকির দিকে তাকালো। চোখাচোখি হলো দুজনার। দু হাত কোমরে গুঁজে রাগান্বিত স্বরে বললো,“আমি দুস্তু না, তুমি দুস্তু।”
“হায় আল্লাহ! এই মাইয়ায় কয় কী! আমি কী তোমার মতো কামড়াকামড়ি করি? দৌড়াদৌড়ি করি? জিনিস নষ্ট করি? তাইলে আমি দুষ্ট হই কেমনে?”
রাগ নিয়েই তার দিকে এগিয়ে আসা ধরলো তনি। কেয়া বেগম তৎক্ষণাৎ নাতনির হাত টেনে ধরে তাকে থামিয়ে দিলেন। কোলে তুলে পাশ সোফায় বসিয়ে দিয়ে চুমকিকে চোখ রাঙালেন,“আহা থাম তো তুই। এইটুকু বাচ্চার সাথে কেউ ঝগড়া করে? যা গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আয়।”
চুমকি চুপচাপ চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তখনি কিছু একটা মনে পড়ায় কেয়া বেগম পেছন থেকে বলে উঠলেন,“সামনের বছর আবার নতুন আরেকজন সদস্য আমাদের মধ্যে আসতে চলেছে বুঝলি? তখন আর ফুফু না একেবারে খালা হয়ে যাবি তুই। আর আমি হবো নানী।”
পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ালো চুমকি। উৎসুক দৃষ্টিতে পিছু ফিরে শুধালো,“কী কন খালাম্মা! কেমনে?”
“তোর উথমী আপা সন্তানসম্ভবা।”
“হায় আল্লাহ! কবে কবে হইলো?”
“এইতো মাস দুয়েক হয়েছে। কাল রাতেই ফোন করে জানালো। এবার খুশিমনে ভালো করে দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয় যা।”
“হ যাইতাছি।”—-উচ্ছ্বসিত হয়ে চলে গেলো চুমকি।
তনির আশেপাশে কোনো খেয়াল নেই।আইসক্রিম এসে তার গা ঘেঁষে ম্যাও ম্যাও করে উঠতেই সে মগ্ন হয়ে গেলো খেলায়।
সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কোমরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া হাড় ভেঙে গিয়েছে শাহানার। এটা নিয়েই বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড বাঁধলো। অফিস থেকে ছুটে এসে দুই ভাই মিলে মাকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালো। চললো বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এক্সরের রিপোর্ট এলেই ডাক্তার জানালো,“একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের ঘনত্ব কমে আসে, হাড় হতে থাকে দুর্বল। তাই উনার একটু দেখে শুনে চলাফেরা করা উচিত ছিলো। কিন্তু যা অঘটন ঘটার তা তো ঘটেই গেলো।”
তৈমূর প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আম্মা আর চলাফেরা করতে পারবেন না?”
“না, কোমরের হাড় একেবারে ভেঙে গিয়েছে। হাঁটুর জয়েন্টও খুলে গিয়েছে। আমাদের হাতে যতটুকু ছিলো তা আমরা করেছি কিন্তু আশা রাখা যাচ্ছে না।”
তুরাগ ডাক্তারের থেকে বিদায় নিয়ে তৈমূরের সাথে বাইরে এসে দাঁড়ালো। মলিন মুখে বললো,“শেষ বয়সে এসে কিনা পঙ্গু হয়ে যেতে হলো আম্মাকে? আমি বারবার উনাকে বলেছি, বয়স বাড়ছে আপনার। মাঝেমধ্যেই প্রেশার হাই হয়ে যায়, মাথা ঘুরায়। আপনি বরং নিচ তলার একটি ঘরে শিফট হয়ে যান। কিন্তু না, আম্মা কিছুতেই তা শুনলেন না! বাবার স্মৃতি আগলে বসে রইলেন। এখন কীভাবে কী করবেন?”
উত্তর দিলো না তৈমূর। মায়ের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে তার। আজ সকালেও কত ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন তিনি! উথমীর প্রেগন্যান্সির খবর শুনেই গত কয়েকদিন ধরে ছিলেন ভীষণ আনন্দিত। অথচ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই এতো বড়ো অঘটন ঘটে গেলো?
শাহানা হাসপাতালের বিছানায় মলিন মুখে শুয়ে আছেন। বড়ো পুত্রকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখেই মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করলেন,“বাড়ি ফিরবো কখন? এখানকার গন্ধ আমার একদম ভালো লাগছে না।”
তুরাগ হতাশ কণ্ঠে বললো,“তৈমূর আপনার জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছে। ও এলেই বাড়ি ফিরবো।”
“ডাক্তার কী বললো? হাঁটাচলা করতে পারবো?”
“না, আজকের পর থেকে বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারবেন কিনা তাও সন্দেহ।”
“বলিস কী? তাহলে নিচে নামবো কী করে? গোসল করা, বাথরুমে যাওয়াই বা কীভাবে হবে?”
“খাবার আপনার বিছানা পর্যন্ত চলে যাবে। আর গোসল! সেটারও আপাতত প্রয়োজন নেই আম্মা। শীত চলে আসছে। আপনাকে বরং একটা ভালো দেখে পারফিউম কিনে দিবো। বাথরুমের সমস্যাটা উমমম, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। বাচ্চাদের জন্য আধুনিক অনেক কমোড বের হয়েছে! সেগুলোই না হয় কাস্টোমাইজড করে….”
পুত্রকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রাগত স্বরে ধমকে উঠলেন শাহানা,“থাপড়ে তোর চোপার দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব। মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও জানিস না? দূর হ সামনে থেকে। অপদার্থ!”
মায়ের ধমকে আত্মা কেঁপে উঠলো তুরাগের। শুকনো ঢোক গিলে লাজুক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, কেউ শুনেছে কিনা। তারপর চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো সে। মায়ের সামনে থাকা মানেই বিপদ। কখন যে যা তা বলে মান সম্মান খুইয়ে দিবে তার ঠিক নেই।
_____________
কলেজ থেকে হাফ বেলার ছুটি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে উথমী। জেবা তখন জোহানকে নিয়ে অন্দরমহলে বসা। ঘর গিয়ে বাইরের পোশাক বদলে নিচে নামতে নামতে মঈনুদ্দিন, করবীও এসে হাজির হয়েছে বাড়িতে। আসল ঘটনা কেউই সঠিক জানে না। শুধু জানে শাহানা সিঁড়ি থেকে পড়ে কোমর ভেঙেছেন।
তিথিয়া বাড়িতে প্রবেশ করেই শুরু করে দিলো হাউকাউ,“মালতী ফুফু ফোন করে জানালো আম্মা নাকি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছেন? কথাটা কী সত্যি?”
করবী প্রত্যুত্তর করলেন,“তাই তো শুনলাম। আমরা পৌঁছানোর আগেই তুরাগ আর তৈমূর মিলে মেজো ভাবীকে নিয়ে নাকি হাসপাতাল গিয়েছে। তোর চাচা ফোন করতেই জানালো, এখন উনাকে নিয়ে তারা ফিরছে।”
চাচীর কথায় গুরুত্ব দিলো না তিথিয়া। উথমীর দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, “তুমি বাড়িতে থাকাকালীনও আমার আম্মা পড়ল কীভাবে? উত্তর দাও। সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকার জন্য তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে? আমার ভাইয়েরটা তিনবেলা গিলছো আর আমাদের আম্মাকেই দেখে রাখতে পারলে না?”
ভদ্রমহিলার কথায় ভীষণ আশ্চর্য হলো উথমী। রাগ সংবরণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে বললো,“আমি সকালে কলেজে চলে গিয়েছিলাম। আপনার ভাইয়ের ফোন পেয়েই সবে এসেছি।”
“এসব আমাকে বুঝাতে এসো না। তুমি ইচ্ছে করে আমার আম্মাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছো। আম্মাকে তুমি দুচোখে দেখতে পারো না, সহ্য করতে পারো না। তাই নিচে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছো। খারাপ মেয়ে মানুষ।”
সেদিনের পর থেকে স্বামীর প্রতি সন্দেহটা যেনো ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে তিথিয়ার মনে। কিন্তু সামনাসামনি কোনো প্রমাণ না পেয়ে শামীমের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে পারছে না। যদি নিজে ভুল প্রমাণিত হয়? তখন তো এতো বছরের সম্পর্কে ফাটল ধরবে! সেই রাগটাই এখন ভাই বউয়ের উপর উগড়ে দিচ্ছে সে। কিন্তু উথমী এসব মিথ্যে অভিযোগ মেনে নেওয়ার পাত্রী নয়। কড়া গলায় সাবধান করে বললো, “মুখ সামলে কথা বলুন আপা!”
তেতে উঠলো তিথিয়া। মঈনুদ্দিন ধমক দিলেন ভাইঝিকে,“বয়স বাড়লেও দিনদিন তোর আচরণ বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছে তিথি! মুখে লাগাম দে। সবকিছুতে অন্যকে দোষারোপ না করলে যেনো হয় না।”
চাচার কথায় সোফায় চোখমুখ কুঁচকে বসে পড়ল তিথিয়া। তার মিনিট পাঁচেক পর হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো অসুস্থ শাহানাকে। কপালের এক জায়গায় বেশ খানিকটা থেঁতলে গিয়ে উঁচু হয়ে রয়েছে। মুখশ্রীও উনার মলিন।
মাকে দেখে দৌড়ে এলো তিথিয়া। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, “আম্মা! এ কি অবস্থা হয়েছে আপনার?”
দৃষ্টি ঘুরিয়ে সবাইকে একবার দেখে নিলেন শাহানা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রত্যুত্তর করলেন,“বুড়ো বয়সে কপালে দুর্ভোগ নেমে এসেছে।”
করবী মুখ ভার করে বললেন,“আপনি সাবধানে হাঁটা চলা করবেন না ভাবী? কী একটা অঘটন ঘটে গেলো বলুন তো?”
“সাবধানই তো ছিলাম। এতকাল কিছু হয়নি অথচ আজ কিনা! এসবই আমার কপাল। এখন কীভাবে যে চলাফেরা করবো আল্লাহ ভালো জানেন। বুড়ো বয়সে অন্যের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে হবে।”
মায়ের এসব কথায় বিরক্ত হলো তৈমূর। বিরক্তি প্রকাশ করেই বললো,“এখন আর হায় হুতাশ করে লাভ নেই আম্মা। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। চলুন আপনাকে ঘরে দিয়ে আসি। বিশ্রাম নিতে হবে।”
তুরাগ তাদের পরে বাড়িতে প্রবেশ করল। ওষুধের প্যাকেট জেবার হাতে তুলে দিয়ে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। তিথিয়া অভিযোগের সুরে বললো,“সব দোষ তৈমূর বউয়ের। এতকাল আমার আম্মার কিছু হয়নি তাহলে আজ কেনো হলো? ও ইচ্ছে করে আম্মাকে ফেলে দিয়েছে। আম্মা আপনি নির্ভয়ে সত্যিটা সবার সামনে বলে দিন।”
বড়ো বোনের এসব কথায় আশ্চর্য হলো তৈমূর। প্রতিবাদ স্বরূপ কিছু বলার আগেই শাহানা মেয়ের উদ্দেশ্যে শক্ত গলায় বললেন,“ও আমায় ফেলতে যাবে কেনো? ও তো তৈমূরের সাথেই সকালে বাড়ি থেকে বের হলো। দুপুরে গোসল শেষে নিচে নামার সময় হঠাৎ করেই আমার পা মচকে গেলো। মাথাটাও চক্কর দিয়ে উঠলো। ঠিক তখনি রেলিং ধরার আগেই সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে গেলাম।”
“কিন্তু আম্মা!”
“কীসের আবার কিন্তু? এখানে কোমর ভেঙে আমি হাঁটতে পারছি না, হুইল চেয়ারে বসে আছি। সেসবের জন্য তুই চিন্তা না করে অন্যের দোষ ধরায় ব্যস্ত হয়ে গেছিস? সর, ভালো লাগছে না। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আমায় ঘরে নিয়ে চল তৈমূর।”
মায়ের ব্যবহারে অবাক হলো তিথিয়া। সেই যে রাগ করে জয়নবের মৃত্যুর পর সে চলে গিয়েছিল তারপর আজই এলো বাড়িতে। এ ক মাসে মায়ের এতোটা রদ বদল হলো? ভাবতেই অবাক লাগছে তার। তৈমূর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“আজ থেকে আপনি নিচের ঘরে থাকবেন আম্মা।”
“অসম্ভব! আমাকে আমার ঘরে দিয়ে আয়।”–দ্বিমত পোষণ করলেন তিনি।
বিপরীতে তুরাগ বললো,“এই হুইল চেয়ার ঠেলে আপনাকে উপরে কীভাবে নিয়ে যাবো আম্মা? আপনি এবার কিন্তু বাচ্চাদের মতো করছেন।”
“যেভাবে পারিস দিয়ে আয়। আমি কিচ্ছু জানি না।”
“যদি উপরে দিয়েও আসি তাহলে আপনি উপর থেকে নিচে নামবেন কীভাবে? বরং নিচে থাকলে নিজের মর্জি মাফিক যখন তখন হুইল চেয়ারে করে আপনি অন্দরমহলে চলে আসতে পারবেন। প্রয়োজন হলে দু তলা থেকে আমি আর উথমীও নিচতলায় শিফট হয়ে যাবো। উপরের ঘর থেকে আপনার সব জিনিসপত্র এনে নিচের ঘরে সাজিয়ে দিবো। তবুও বায়না ধরবেন না তো আম্মা।”—-আকুল হয়ে বললো তৈমূর।
পুত্রদের কথার পৃষ্ঠে হার মেনে নিলেন শাহানা। ভেবে দেখলেন, কথাগুলো সত্য। এ কথা শুরুতেই মেনে নিলে আজ হয়তো এই হুইল চেয়ারে বসে থাকতে হতো না উনাকে। মুখ ভার করে বললেন,“যা ইচ্ছে কর। আমি আর কী বলবো? এখন তো আর নিজ ক্ষমতায় চলাফেরাও করতে পারবো না।”
মায়ের কণ্ঠে অভিমানের ছাপ স্পষ্ট বুঝতে পেরেও কিছু বললো না তৈমূর। এখন আবার উপর থেকে সব আসবাবপত্র নিচে এনে ঘর সাজাতে হবে। তার জন্য লোক ভাড়া করে আনতে হবে। উফ কত ঝামেলা!
_________
ধরণীতে রাত নেমেছে। অন্দরমহলে যে যার মতো বসে নাস্তা করতে করতে কথা বলছে। শাহানাকে বিছানায় ঠিক মতো বসিয়ে তুরাগ, তৈমূর গিয়েছে যে যার ঘরে। তিথিয়া মায়ের পাশে চায়ের কাপ হাতে বসে আছে। কিয়ৎ রাগ দেখিয়ে বললো,“আপনি তখন আমার কথায় সায় জানালেন না কেনো আম্মা? ওই মেয়ে যদি আজ সংসার ফেলে বাইরে বাইরে না ঘুরে বেড়াতো তাহলে কী আপনার এই অবস্থা হতো? কষ্ট করে নিচে নামতে হতো?”
আবারো একই প্রসঙ্গ টেনে আনায় সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহানা। কন্যাকে বোঝানোর ভঙিতে বললেন,“আহা! এতে ওর কী দোষ? ও যখন ছিলো না তখন কী আমি চলাফেরা করিনি? আসলে এটা আমার ভাগ্যেই ছিলো। বাদ দে।”
“হয়েছে, আপনি পুরোপুরি ওই মেয়ের পক্ষ নিচ্ছেন আম্মা। তাই ওর কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। ভাইদের মতো আপনিও ভীষণ পর হয়ে যাচ্ছেন।”
“পক্ষ নেওয়ার কী আছে? যা সত্যি তাই বলেছি। মেয়েটা সারাদিন কত খাটাখাটনি করে জানিস?আমার খেয়াল রাখে, সংসার সামলায়, অফিস যাওয়ার আগে সেই ভোরে ওঠে রান্না করে, বিকেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই নাস্তা বানায়, রাতের রান্না করে। তার উপর এখন আবার সে পোয়াতি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। সকালে খেতে বসে দেখি, একটা রুটির অর্ধেক খেয়েই আফিস চলে গিয়েছে। কাল সাথে করে টিফিন নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেটাও অল্প খেয়ে বাকিটা ফেরত নিয়ে এসেছে। মালতী আমায় সব জানিয়েছে। এ সময়ে মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করতে নেই। তুই পেটে থাকতে তোর দাদী আমায় কম অত্যাচার কিন্তু করেনি। এই জন্যই তোর দাদীকে আমি বেশি ঘৃণা করতাম। তোর সময় কী হয়েছিল মনে নেই? তোর শাশুড়ি তোকে একটা ধমক দেওয়ায় আমার কাছে এসে কত কেঁদেছিলি? তাকে অভিশাপ পর্যন্ত দিয়েছিলি? কী দরকার অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে অভিশাপ আদায়ের? কিছু বলিস না। মেয়েটা কিন্তু খারাপ না।”
“তৈমূরের বউ প্রেগন্যান্ট? কই জানালেন না তো।”
“কীভাবে জানাবো? সেই যে তুই রাগ করে ফিরে গেলি তারপর তো আর এলিও না। আর ফোনেও দু মিনিটের বেশি আমার সাথে কথা বলিস না।”
প্রত্যুত্তর করল না তিথিয়া। ফ্রেশ হয়ে মায়ের ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো তৈমূর। অনুমতি চাইলো, “আসবো আম্মা?”
শাহানা অনুমতি দিলেন,“হ্যাঁ, আয়।”
তৈমূর ভেতরে প্রবেশ করল। তার পিছুপিছু প্রবেশ করল তুরাগও। চেয়ার টেনে বসলো তুরাগ। আর তৈমূর রইলো দাঁড়িয়ে। মায়ের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জেনে বড়ো বোনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “ওরি, মিলি কী বাড়িতে একা নাকি দুলাভাইও সঙ্গে আছে?”
তৈমূরের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করল তিথিয়া,“তোর দুলাভাই খুব ব্যস্ত। তিনদিন আগে শহরের বাইরে থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরলো। অথচ আজ সকালেই আবার কোথায় যেনো চলে গেলো। বললো, জরুরি কাজ আছে। ফিরতে দু তিনদিন লাগবে। আর ওরি, মিলি বাড়িতে একাই। ওরা দুবোন একসঙ্গে থাকলে আর কাউকে ওদের লাগে না।”
কথাটি শেষ হতে না হতেই তুরাগ বলে উঠলো,“আমি বুঝি না, দুলাভাই দুদিন পরপর কীসের এতো ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে যায়? ওইতো রেস্তোরাঁর ব্যবসা তার। সব কয়টা রেস্তোরাঁ, ক্যাফে তো ঢাকার ভিতরেই তাহলে শহরের বাইরে যেতে হবে কেনো? কয়েকদিন আগেই খিলগাঁও এর এক কলেজের সামনে দেখে এলাম। সম্ভবত কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন।”
তুরাগের কথায় হকচকিয়ে গেলো তিথিয়া। চঞ্চল কণ্ঠে শুধালো,“কলেজের সামনে? কী বলছিস? কবে দেখেছিস? আমায় তো ও সব বলে কিন্তু এ বিষয়ে তো কিছু বললো না?”
“দেখেছি পাঁচ ছয়দিন আগে। আমি ছিলাম রাস্তার এ পাড়ে গাড়িতে আর দুলাভাই ছিলেন রাস্তার ওপাড়ে দাঁড়ানো। তাছাড়া এর আগেও অবশ্য অনেকবার ওই এলাকায় দেখেছি উনাকে। একবার জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ওখানে নাকি কোনো এক বন্ধুর বাড়ি।”
নড়েচড়ে উঠলো তিথিয়া। হঠাৎ করেই তার সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। পাঁচ ছয়দিন আগে শামীম শহরের বাইরে ছিলো। তাহলে ও কীভাবে খিলগাঁও আসতে পারে? ছটফটানি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার। খারাপ চিন্তা জেঁকে বসছে মস্তিষ্কে। তৈমূর প্রসঙ্গ বদলে শুধালো,“আজ তো তুমি থাকছো এখানে, তাই না? তাহলে বরং আম্মার সাথেই রাতটা থেকে যাও। কখন কী প্রয়োজন হয়?”
সকল ভাবনা একপাশে রেখে কিছুক্ষণ নিরব রইলো তিথিয়া। দ্বিমত পোষণ করে বললো,“না, তা কী করে হয়? আমি এখন বাড়ি ফিরবো।”
“এই রাতে?”
“হ্যাঁ, মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। এখন বের হলে নয়টা, সাড়ে নয়টার মধ্যে পৌঁছে যাবো।”
শাহানা মন খারাপ করে বললেন,“তুই চলে গেলে কী করে হবে? আজ আমার কাছে থেকে যা তিথি। এমনিতেই তো আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। কীভাবে সারারাত থাকবো? কাল সকালে না হয় তৈমূর গিয়ে ওরি, মিলিকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে।”
নতুন বাহানা দিলো তিথিয়া,“না আম্মা, সম্ভব না। বাড়িতে ফিরতেই হবে। তাছাড়া আপনার দু দুটো ছেলের বউ থাকতে চিন্তা কীসের? ওরাই সেবা করবে।”
“মেয়ে যা করতে পারবে ছেলের বউরা কী আর তা পারবে? নাকি ওরা আমার সাথে রাতে থাকতে পারবে? বাথরুমে নিয়ে যেতে পারবে?”
ভেতরে ভেতরে চরম বিরক্ত হলো তিথিয়া। এখন বসে বসে মায়ের সেবা করা কী তার পক্ষে সম্ভব? নাকি এতো বড়ো মহিলার সাথে বাথরুমে গিয়ে বসে থাকা সম্ভব? কিন্তু বাহ্যিকভাবে সেই বিরক্তি প্রকাশ করতে পারলো না সে। মেয়ের কথায় অবাক হলেন শাহানা। যেই মেয়ে উনাকে ছাড়া থাকতে পারতো না, নিজ সংসার ফেলে দিনের পর দিন এ বাড়িতে পড়ে থাকতো সেই কিনা আজ মায়ের এমন দুঃসময়ে তাড়া দেখাচ্ছে? এও বিশ্বাস যোগ্য?
চলবে __________
#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৪১]
অগ্ৰহায়নের শেষার্ধ চলছে। ভোর কিংবা সন্ধ্যা হলেই চারিদিক এখন কুয়াশার দখলে। আর শেষ রাতে চলে শীতের তান্ডব। বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই উথমী খেয়াল করল তার পেটের উচ্চতা যেনো কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তা নিয়েই ভেতরে ভেতরে তার উত্তেজনার শেষ নেই। বাইরে মাগরিবের আজান হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। হুইল চেয়ারে করে মালতী ফুফুর সাহায্যে অযু করে এসে বিছানায় বসেই নামাজটা সেরে নিলেন শাহানা। এখন তিনি গভীর ধ্যানে তসবিহ জপছেন। উথমী আচারের বয়াম হাতে শাশুড়ির ঘরে প্রবেশ করল। গত এক সপ্তাহ ধরে শাশুড়ির যাবতীয় সেবা শুশ্রূষা তারই করতে হচ্ছে। তিথিয়া তো সেদিন রাতেই ফিরে গেলো বাসায়। আর জেবা তুরাগরা ছেলে নিয়ে চলে গেলো ঠিক তার পরেরদিন সকালে। যে যার মতো দায়িত্ব এড়িয়ে গেলেও উথমী তো আর তা পারে না। তার উপর তৈমূরের আবদার! তার মাকে সে আর তার স্ত্রী মিলেই দেখবে। তাই এ কদিন এ ঘরে যাওয়া আসা করায় ভেতরে প্রবেশের আর অনুমতি নিতে হয় না তার।
চামচ দিয়ে বয়াম থেকে আচার বের করে খেতে খেতে বিছানায় এসে বসলো উথমী। কয়েকদিন আগেই স্ত্রীর জন্য এসব কিনে এনে ফ্রিজ ভরতি করেছে তৈমূর। পুত্রবধূর উপস্থিতিতে চোখ মেলে তাকালেন শাহানা। হাতের তসবিহর পাক শেষ করে সাইড টেবিলে রেখে দিলেন তা। তার কার্যকলাপ দেখে বললেন,“এই অসময়ে আচার খাচ্ছো কেনো? মালতী কোথায়? ওকে না বলে দিয়েছি ডিম সিদ্ধ করতে?”
“আমি করতে নিষেধ করেছি।”
“কেনো? শুনেছি খাওয়া-দাওয়ায় তুমি খুব অনিয়ম করছো? সারাদিন এমন ছোটাছুটির পরেও ঠিকমতো না খেলে তো বাচ্চা বিভিন্ন রোগ নিয়ে জন্মাবে।”
প্রত্যুত্তর করল না উথমী। প্রেগন্যান্সির সংবাদ পাওয়ার পর থেকে শাশুড়ির আচরণটা তার প্রতি বেশ উন্নত হয়েছে। ইদানিং তার খুব খেয়াল রাখেন ভদ্রমহিলা। বাড়ির বাইরে থাকাকালীন সারাক্ষণ চিন্তায় থাকেন। তা অবশ্য উথমীর কাছে খুব ভালোই লাগে। কেউ তাকে নিয়ে ভাবলে, তার যত্ন নিলে প্রশান্তি অনুভব করে উথমী। বেঁচে থাকার ইচ্ছে বেড়ে যায়। মাঝেমধ্যে নিজেকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে হয়। শেষমেশ তৈমূরের কথাই তবে সত্য হলো। একটা বাচ্চা এলে বদলে যাবে শাহানার আচরণ।
পুত্রবধূর নিরুত্তর ভাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহানা। বললেন,“আমাদের সময় খিদে পেলেও শাশুড়ি আমাদের খেতে দেয়নি। দিন-রাত বাড়ির সব কাজকর্ম করার পর হাঁড়ির তলায় গিয়ে পেতাম এক মুঠো ভাত আর তরকারির ঝোল। কিন্তু তোমরা তো খুব সুখে আছো, হাঁড়ি কড়াই ভর্তি খাবার সামনে পাচ্ছো। তাই খাওয়ার প্রতি এতো অবহেলা।”
হাত থেমে গেলো উথমীর। সরু দৃষ্টিতে শাশুড়ির পানে তাকালো। বিছানায় পা তুলে আরাম করে বসে সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“বলেন কী? ঠিকমতো খেতে দেয়নি? গর্ভে বাচ্চা থাকাকালীনও না?”
“না।”
“এ কেমন জালেম মহিলা!”
“সবার আগে বাড়ির পুরুষরা খেতেন। তারপর খেতেন গুরুজন মহিলারা। এদিকে আমি আর বড়ো ভাবী খেতাম সবার শেষে। যদিও ভাইজান সবার অগোচরে বড়ো ভাবীর জন্য আলাদা করে বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি এনে রেখে দিতেন ঘরে! উনি আবার খিদে সহ্য করতে পারতেন না।”
“আর আপনার স্বামী? মানে আমার শ্বশুরমশাই? উনি আনতেন না?”
“না, তিনি তো শহরে থাকতেন। আর আমি থাকতাম গ্ৰামের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর-জা, দেবরের সাথে ভরা পরিবারে। উনি মাসে একবার আসতেন। দুদিন থেকে আবার চলে যেতেন। তারপর তিথির যখন বয়স ছয় তখন এই বাড়ি বানানো শেষে একসাথে থাকা শুরু।”
“কখনো জানাননি?”
“কাকে জানাবো? ওদের বাবা তো সব জানতেন।”
“তাও এর সমাধান করেননি?”
“একবার আম্মাকে বুঝাতে গিয়েছিলেন কিন্তু তার বিনিময়ে আমার শাশুড়ি ছেলেকে যা না তাই তো বলেছিলোই সাথে আমার গায়ে হাতও পর্যন্ত তুলেছিল। এরপর আর কখনো কিছু বলেনি। আমি নিষেধ করে দিয়েছিলাম।”
“চোখের সামনে স্ত্রীকে উনার মা অযথা মারলো আর উনি কিছু বলেননি? কেমন স্বামী এটা?”
“এ তোমার স্বামীর মতো অতো বুদ্ধিমান ছিলো না যে কীভাবে মা আর বউ আলাদাভাবে সামলাতে হয় তা জানবে। সারাজীবন তো শুধু টাকা রোজগারের দিকেই মগ্ন ছিলেন। আর শেষ বয়সে এসে হতে পেরেছিলেন আদর্শ বাবা। তোমার শ্বশুর ছেলে, ভাই, বাবা হিসেবে খুব ভালো মানুষ হলেও কখনো আদর্শ স্বামী হতে পারেননি। তবুও উনার প্রতি কখনো আমার কোনো অভিযোগ ছিলো না।”
“কখনো রাগ হয়নি?”
“না।”
“একটুও না?”
নিঃশব্দে হাসলেন শাহানা। ঘোলাটে হয়ে উঠলো উনার আঁখি পল্লব। তা দৃষ্টি এড়ালো না উথমীর। খুব মায়া হলো শাশুড়ির জন্য। আহারে! ভদ্রমহিলার যৌবন কত কষ্টেই না কেটেছে? যা খুব সহজেই অনুভব করতে পারে উথমী। নারী তার জীবনে সব সহ্য করতে পারলেও স্বামীর অবহেলা, দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা আর খাবারের খোঁটা কখনোই সহ্য করতে পারে না। গুমোট পরিবেশ স্বাভাবিক করতে মুখ ভার করল উথমী। বললো,“আজ রাতে আর ওসব ভাত তরকারি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
”ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে।”—-কড়া কণ্ঠে কথাটা বললেন শাহানা।
“বিরিয়ানি খাবেন? অনেকদিন খাই না।”
“এখন? কে রান্না করবে?”
“দোকানদার।”
“হ্যাঁ?”
“আপনার ছেলেকে কল দেই। ফেরার পথে না হয় নিয়ে আসবে।”—-বলেই চমৎকার হাসলো সে।
নিষেধ করতে গিয়েও নিষেধ করলেন না শাহানা। উথমী জিজ্ঞেস করল,“গরু নাকি খাসিরটা খাবেন?”
“তোমার যেটা ইচ্ছে। তবে সাথে একটা শরবত দেয় না? কী শরবত যেনো? নামটা মনে পড়ছে না। তৈমূর আমায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলে মাঝেমধ্যেই হোটেলে নিয়ে খাওয়াতো। এতো স্বাদ না!”
“বাদামের শরবত? নাকি বোরহানি?”
“কী জানি? তবে খেতে অনেক মিষ্টি। রং কিছুটা হলুদ।”
“তাহলে বাদামের শরবত। আপনি বরং বসুন। আমার মোবাইলটা ঘরে রেখে এসেছি।”
আচারের বয়ামটা শাশুড়ির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো উথমী। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে বলে উঠলেন শাহানা,“আমাদের শাশুড়ি যাই করুক না কেনো আমরা কিন্তু ঠিকই উনাকে তিনবেলা আম্মা আম্মা বলে পিছুপিছু ঘুরেছি আর উনাকে যথেষ্ট সম্মান করেছি। আম্মা ছাড়া কথাই বলিনি। এই যে জোহানের মা! ওরও মুখ দিয়ে আম্মা ছাড়া কোনো কথা নেই। কিন্তু তোমাদের মতো বেশি শিক্ষিত মানুষদের তো আবার স্বামীর মাকে মা ডাকতে গায়ে বিঁধে। নইলে বিয়ের এতদিনেও তোমার মুখে মা, আম্মা কোনো ডাকই তো শুনলাম না।”
পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ালো উথমী। কথাটা শুনে ভড়কে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। শাহানার দৃষ্টি তখন নিজের পায়ের দিকে। শাড়ির উপর দিয়েই হাত বুলাচ্ছেন আঘাত প্রাপ্ত স্থানে। ভদ্রমহিলার কথা ভুল নয়। বিয়ের পর আগ বাড়িয়ে বা সদিচ্ছায় শাশুড়ির সাথে তেমন একটা কথা বলেনি উথমী। বিয়ের প্রথমদিন বাড়িতে পা রেখে লোক মুখে নানান কথা শুনে শাশুড়িকে নিয়ে মনের ভেতরে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল তার। আর সেই বিরূপ ধারণা সে হাতেনাতে প্রমাণও পেয়েছিল বিয়ের তৃতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে দেরিতে ওঠার কারণে। এরপর রোজ রোজ বিশেষ করে বাপের বাড়ি যাওয়ার পর মিথ্যে অসুস্থতার নাটক সাজিয়ে ছেলেকে বাড়িতে আনা থেকে শুরু করে আরো কত কি!
উথমী নিরবে প্রস্থান করল। নিচতলা থেকে ধীর পায়ে চলে এলো দ্বিতীয় তলায়। মায়ের জন্য তৈমূর নিচ তলায় চলে আসতে চাইলেও শাহানা নিজেই নিষেধ করে দিয়েছেন তাকে। আলাদা ডেকে হয়তো কিছু বলেছেন। উথমী সেসব বিষয়ে সঠিক জানে না। মা- ছেলের মধ্যে যা ইচ্ছে কথা হোক এতে তার কী? তৈমূর সবার আগে শাহানার ছেলে। সে অনুযায়ী ছেলের প্রতি মায়ের অধিকারই তো বেশি! উথমী সেসব খুব ভালো করেই বোঝে। তার চিন্তাধারা বরাবরই পজেটিভ দিক বহন করে। কিন্তু কেউ তার সাথে খারাপ আচরণ করলে কিংবা প্রথমেই কারো সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলে তাকে আর চাইলেও মনে জায়গা দিতে পারে না উথমী। শাহানাকেও পারেনি। উনাকে মায়ের মতো অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ নামে সম্বোধন করতে তার বিবেকে বাঁধে।
কিন্তু হঠাৎ করেই উথমীর সমীকরণ মিললো না। ঘরে এসে বিছানায় বসলো সে। শাহানার বলা কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সত্যিই তো, বিয়ের পর সে কখনো শাহানাকে সম্বোধন করে ডাকেনি। কেনো ডাকেনি? উনার এতদিনের এই খারাপ আচরণের কারণে? তাহলে কেয়া বেগম অর্থাৎ তার নিজের মা তো এর চেয়েও বেশি অপরাধী। কারণ তিনি নিজ কন্যার শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে যৌবনে পদার্পণ করার সময়টা কত অবলীলায় নষ্ট করেছেন! একাকিত্বে ঠেলে দিয়েছেন মেয়েকে। তারপরেও ঊষার মৃত্যু কষ্ট ভুলাতে মাকে সে ক্ষমা করে দিলো। তাহলে শাহানাকে কেনো নয়? উথমীর সাথে কী তিনি বেশি অন্যায় করেছেন? কই না তো।
মন থেকে না হোক, অন্তত স্বামীর জন্য তো উনাকে সম্মান করাই যায়। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল হাতে নিলো উথমী। স্বামীর নাম্বারে কল দিয়ে মোবাইল কানে ধরে বসে রইলো। আজ আর কল রিসিভ করতে বিলম্ব করল না তৈমূর। কোমল স্বরে শুধালো,“বলুন কী চাই?”
মুচকি হাসলো উথমী। শুধালো,“জানলেন কীভাবে?”
“এই সময়ে এমনি এমনি ফোন দেওয়ার মানুষ আপনি নন, তাই।”
“কোথায় আপনি?”
“একটা পার্কে।”
“কী করেন ওখানে?”
“আপনার ভবিষ্যৎ সতীন নিয়ে বাদাম খাই।”
“ঘাড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দিবো বদমাইশ পুরুষ।”
ফোনের অপরপাশে বসে মুচকি হাসলো তৈমূর। টেবিলের উপরে রাখা ফাইলগুলো বাম হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে চাপা স্বরে বললো,“আমার বাচ্চা তো এতিম হয়ে যাবে।”
“হলে হোক। আমি ব্যতীত অন্য কোনো নারীর দিকে তাকানোর আগে আপনার চোখ যেনো নষ্ট হয়ে যায়।”
“আচ্ছা।”
“শুনুন!”
“বলুন ম্যাডাম।”
“মনটা খুব বিরিয়ানি বিরিয়ানি করছে। বিফ বিরিয়ানি উইথ চিকেন চাপ এন্ড সাথে আমার শাশুড়ির জন্য বাদামের শরবত নিয়ে আসবেন।”
“শাশুড়ি? আম্মার নাম করে নিজের জন্য চাইছেন? বাইরের খাবার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।”
“উহুম, আমাদের তিনজনেরই খুব খেতে ইচ্ছে করছে।”
“তিনজন! কে কে?”
“আমি, শাশুড়ি আম্মা আর তৈমূরের বাচ্চা।”
কৌশলে নিজের মুখ চেপে ধরলো তৈমূর। এবার আর কিছুতেই সে নিজের হাসি আটকে রাখতে পারছে না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বললো, “আমার বাচ্চাটাকেও ছাড়লেন না উথমী?”
“শুধু বাচ্চা কেনো? বাচ্চার বাপকেও ছাড়ছি না। বিরিয়ানি ছাড়া বাড়িতে ফেরা আপনার জন্য নিষিদ্ধ।”
“আচ্ছা, নিয়ে আসবো। আর কিছু?”
“আজকের জন্য এনাফ। এখন রাখি। মন দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করুন। পরনারীর থেকে দশ হাত দূরে থাকবেন।”
বলেই কল কেটে দিলো উথমী। তৈমূর কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে দিলো টেবিলের উপর। প্রেগন্যান্সির পর থেকে শান্তশিষ্ট মেয়েটা বড়োই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। যার সবকিছুই তৈমূর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
__________
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ভাই পেয়ে তনির দুষ্টুমি বেশ কমে এসেছে। সারাক্ষণ আইসক্রিমকে নিয়ে বসে থাকে তার শিয়রে। আইসক্রিম এখন আর ছোট্ট ছানাটি নেই। বড়ো হয়েছে কিছুটা। এইটুকু বিড়ালও যেনো কি সুন্দর সবকিছু বুঝে যায়! তাই তো তনির মতো সেও বসে থাকে রিক্তর আশেপাশে। কিন্তু ভুলেও কাছে গিয়ে স্পর্শ পর্যন্ত করে না। মেয়ের এমন শান্তশিষ্ট স্বভাবের সাথে পরিচিত হয়ে বাড়ির সকলেই ভীষণ অবাক! রিনিতা খাবার নিয়ে ঘরে এলো। ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মেয়ের মুখের সামনে ধরে বললো,“দেখি হা করো। ভালো মেয়ের মতো খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ঠিক আছে?”
উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে খাবার মুখে তুলে নিলো তনি। ললাটে ভাঁজ পড়ল রিনিতার। সারাদিন যে মেয়ের পেছনে খাবার নিয়ে দৌড়াতে হয় সে এমন সোনামুখ করে খেয়ে নিচ্ছে? মুখের খাবার শেষ করে তনি প্রশ্ন ছুঁড়লো,“ভাই কবে দৌড়াতে পারবে আম্মু?”
“এই তো আর এক বছর পর।”
“এক বছর কবে শেষ হবে?”
“৩৬৫ দিন পর।”
“এত্তগুলো দিন?”
“হুম সোনা, কথা বলো না। গলায় খাবার আটকে যাবে।”
মালতী ফুফু খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন। এতক্ষণে হয়তো ঘুমের রাজ্যে পাড়িও জমিয়েছেন। উনি ভীষণ ঘুম কাতুরে মানুষ। বালিশে মাথা রাখলেই ঘুমিয়ে পড়েন। তৈমূর আজ সঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে এলো। কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিলো উথমী। তৈমূর চমকালো। হাতের ব্যাগগুলো স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজা আটকালো। শুধালো,“আজ এতো দ্রুত দরজা খুলে দিলো উথমী! ব্যাপার কী? আমার জন্য অপেক্ষায় বসে ছিলেন নাকি?”
“মোটেও না, আমি তো নিচেই ছিলাম। শাশুড়ি আম্মার ঘরে।”
“আচ্ছা।”
“দ্রুত গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। একসঙ্গে খাবো।” —বলেই রন্ধনশালায় ছুটলো উথমী।
তৈমূর পেছন থেকে সাবধান করে বললো, “লাফালাফি করতে নিষেধ করেছি না? আস্তে চলুন নইলে পড়ে যাবেন।”
কিন্তু উথমী সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তৈমূর চলে গেলো উপরে। আগে নিজের পোশাক বদলাবে তারপর যাবে মায়ের কাছে। তৈমূরের আনা খাবারগুলো বেড়ে ফেললো উথমী। শাশুড়ির জন্য বাড়া খাবারগুলো একটা ট্রে তে সাজিয়ে ডাইনিং থেকে সোজা অন্দরমহল পেরিয়ে চলে এলো ঘরে।
শাহানা অর্ধশোয়া। এই অল্প কয়েকদিনেই তিনি নিজের জীবন নিয়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন। এভাবে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে, বসে থাকতে কারো ভালো লাগে? শেষ বয়সে এসে এতো ঝামেলা! উথমী বিছানায় এনে ট্রে রাখলো। পানির বড়ো মগ সামনে ধরে বললো,“হাত ধুয়ে নিন আম্মা।”
শেষ সম্বোধনে চমকালেন শাহানা। মুখভঙ্গি বদলালো। ফ্যালফ্যাল নয়নে পুত্রবধূর পানে তাকাতেই মুচকি হাসলো উথমী। তাড়া দিয়ে বললো,“কী হলো? হাত ধুয়ে নিন। আপনার ছেলে ফিরেছে। ঘরে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন নইলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
নিরবে হাত ধুয়ে নিলেন শাহানা। এতো সহজে যে এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে উনাকে আম্মা বলে ডাকবেন কখনোই তা ভাবতে পারেননি শাহানা। ভেতরে হঠাৎ করেই বেশ প্রশান্তি অনুভব করলেন তিনি। মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো তৃপ্তির ছাপ। উথমী সেসব খেয়াল করল কিনা বুঝা যাচ্ছে না। ট্রে এর মধ্যে একটি প্লেটে বিরিয়ানি যার উপরে কিলিবিলি করছে ছোটো ছোটো গোশতের টুকরো। পাশেই আবার একটি কাবাব। আরেকটি পিরিচে লাল লাল চিকেন চাপ আর গ্লাসে বাদামের শরবত। শাহানা সর্বপ্রথম বাদামের শরবতে চুমুক দিলেন। বললেন,“যাও গিয়ে তৈমূকে নিয়ে তুমিও খেয়ে নাও। রাত কম হয়নি।”
“আচ্ছা, আমি নিচেই আছি। কিছু প্রয়োজন হলে ডাক দিবেন।”—-প্রস্থান করল উথমী।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এদিকেই আসছিল তৈমূর। পথিমধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। উথমী তাকে আটকে দিয়ে বললো,“আম্মা খাচ্ছেন। আপনিও খেতে চলুন। খাওয়া শেষে না হয় দেখা করে আসবেন।”
প্রত্যুত্তর করল না তৈমূর। শুধু পথ তার বদলে গেলো। টেবিলে এসে বসতেই উথমী পুনরায় বললো,“এক প্যাকেট কম কেনো? খাবেন না আপনি?”
“না, ভাত বাড়ুন।”
বাধ্য মেয়ের মতো তার জন্য ভাতই বাড়লো উথমী। সম্মুখে সবকিছু সাজিয়ে দিয়ে আফসোস করে বললো,“হায়রে তৈমূর সাহেব! ভালো খাবার চিনলেন না।”
তার মুখভঙ্গি দেখে হাসলো তৈমূর। ফিসফিস করে বললো,“না চিনলে আপনাকে আনলাম কীভাবে?”
“খাবারের কথা বলেছি, বউয়ের কথা নয়।”
“বউ খাবারের চেয়ে কম কীসে? এই যে রেখে রেখে রোজজ খাচ্ছিইই!”—কথাটা টেনে বললো তৈমূর।
থতমত খেয়ে গেলো উথমী। লাজুক দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে। তৈমূরের অধরে হাসি বিদ্যমান। আমতা আমতা করে বললো,“ছেলেটা দিনকে দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মুখে কিছু আটকায় না।”
“বউয়ের সামনে সব নষ্টামি, সুশীল, অশ্লীল কথা জায়েজ।”
“এই মুহূর্তে আপনি ইগ্নোর।”
বিপরীতে হাসি চওড়া হলো তৈমূরের। খাওয়া শেষে স্ত্রীর হাতে হাতে সব গোছাতে সাহায্য করে তারপর চলে এলো মায়ের ঘরে। শাহানার খাওয়া তখন শেষ হয়েছে। উথমী এটো প্লেটগুলো নিয়ে চলে এলো। সব ধুয়ে রেখে ক্ষান্ত হয়ে চলে গেলো নিজ কক্ষে।
___________
মধ্যরাত। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ চিরে বেরিয়ে আসছে মেঘের গর্জন। শরীরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তৈমূর। তার দু হাতের আলিঙ্গনে উথমীও ঘুমে কুপোকাত। কিন্তু তাদের এই শান্তির ঘুম সহ্য হলো না কারো। শব্দ করে বেজে উঠলো তৈমূরের মোবাইল। ঘুম হালকা হলো তৈমূরের। মুখশ্রীতে একঝাঁক বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরলো। শুধালো,“কে?”
অপরপাশ থেকে ভেসে এলো ক্রন্দনরত অতি পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর,“তৈমূ! কোথায় তুই? আমার যে সব শেষ হয়ে গেলো রে… সব শেষ! তুই এখানে আয় একবার ভাই। নইলে আমি যে মরে যাবো।”
চলবে ___________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)