#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৪)
নুসরাত জাহান লিজা
রাত তখন সাড়ে তিনটা। নিলয়, আফনান তখন দাঁড়িয়ে আছে প্রগাঢ় অন্ধকারে। ব্যাকআপ প্ল্যানও রেডি করে এসেছে। তবুও অজানা আশঙ্কায় আফনানের বুক কাঁপছে। মা তাহাজ্জুদের নামাজে বসেছিলেন। ওদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করে দিয়েছেন। এতসব পরিকল্পনার কিছুই শায়লাকে বলা হয়নি। ডাক্তার ওর ডেলিভারির যে ডেট দিয়েছে তা আগামী পরশু। এমনিতেই রবিনের শোকে কাতর, তার মধ্যে আফনাম নিজের জন্যও স্ট্রেস দিতে চায়নি এই মুহূর্তে।
নীরার মুখ থমথমে হলেও মৃদু হেসে বলেছিল, “ফিরে এসো সফল হয়ে। আল্লাহ সহায় হউন।”
আফনান ম্লান গলায় মা’কে বলেছিল, “আমার ভয় লাগছে মা।”
“ভয় সবারই করে বাবু। যারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে, অন্যায়ের সাথে আপোষ করে তারা ভীতু। তুমি বুক চিতিয়ে লড়ছিস। ভয়কে জয় করে মাথা উঁচু রেখেছিস। তুই সাহসী। ভাগ্য সবসময় সাহসীদের সঙ্গ দেয়৷ দেখিস, আল্লাহ তোদের সাথে থাকবে।”
এরপর দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দিলেন তিনি। মাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব হয় আফনানের। পরিস্থিতি যা-ই হোক, তিনি কখনো সাহস হারান না। অসম সাহস আর দৃঢ়তা দিয়ে তিনি পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। কখনো বা জেতেন, কখনো হারেন৷ কিন্তু মাথা কখনো নীচু হয় না তার। ছেলেবেলায় আফনান আর শায়লা কখনো অন্যের কটুক্তিতে কেঁদে বাড়িতে ফিরলে তিনি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে স্মিত হাসিমুখে বলতেন,
“আল্লাহ ছাড়া কারোর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে নিবি না। অন্যকে খুঁচিয়ে যারা সুখ পায়, তারা অনেক নিম্নস্তরের মানুষ। তাদের কথায় কিছু হয় না। তাদের নিজেদের গায়ে কাদা, তাই অন্যের গায়ে কাদা ছেটাতে চায়। ওদের স্তরে নামাতে চায়। তাদের পাত্তা দিতে গেলে নিজের মনে আর গায়েও কাদা মাখতে হয়। গায়ের কাদা ধুলেই যায়, মনে কাদা লাগলে তা সরে না। তাই কী দরকার!”
কথাটা আফনান চিরজীবন বুকে লালন করে এসেছে। শায়লার কান্নাভেজা ম্লান মুখটা মনে পড়তেই ভেতরটা টগবগিয়ে উঠল। আজ হয় রবিনকে নিয়ে ফিরবে, নয় এখানেই ওর নিজেরও ইতি। নিলয়কে বলেছিল ব্যাকআপ টিমের সাথে থাকতে, কারণ এই লড়াইটা আসলে তার একার। অন্যের বিপদ সে আনতে পারে না। কিন্তু ওর ঘাড়ত্যাড়া বন্ধু সেটা কানে তুলল না।
জায়গা পরিবর্তন করা হয়েছে। ওরা যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবে। ভাবতেই ফোনটা ভাইব্রেট করল। হাতেই ছিল মোবাইলটা। মনিরের কল। লাউডস্পিকার অন করল, নিলয়কে শোনানোর জন্য।
“পাঁচ কদম পিছিয়ে যান।”
ওরা কথা মেনে ঠিক পাঁচ পা পিছিয়ে গেল।
এবার কথা বলল আরিফ, “কোনো চালাকি না। ডকুমেন্ট নিচে রেখে আরও পিছিয়ে যা।”
“আগে রবিনকে আমাদের সামনে নিয়ে এসো। নইলে জিনিস পাবে না।”
মিনিট খানেক অতিবাহিত হলো। সময় যেন থমকে আছে অনন্তকাল ধরে। এরপর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা রবিন এলো দৃশ্যপটে। মনিরের হাতের পি স্ত ল রবিনের মাথায় তাক করা। একে একে আঁধার ফুঁড়ে সামনে এলো আরিফসহ আরও কয়েকজন। আফনান হিসেব করল বারো জন। পাঁচজনের হাতে আ গ্নে য়া স্ত্র। ওদের দিকেও কয়েকটা চোখ রাঙাচ্ছে।
রবিন কিছু একটা যেন চোখের ইশারায় বলতে চাইল। আফনানের ঠিক বোধগম্য হলো না। তবে মুখে বলল,
“বাহ্! আপনারা মশা মারতে কা মা ন দাগান। ভালো। এত সাহস আপনাদের! মশারা লজ্জা পাবে।”
“বেশি বেগড় বাই করবি না। আগে জিনিস দে।”
তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল আফনান, “তোমাদের বিশ্বাসের নমুনা তো দেখলামই। এরপরেও যদি আগে তুরুপের তাস ছেড়ে দিই, আমাকে লোকে একটা বিশেষণই দেবে। গ আকার, ধ আকার, একটা নিতান্ত নিরীহ প্রাণীর নামে ডাকবে। যদিও বেচারা প্রাণীর দোষ নেই। তবুও আমি মানতে পারব না।”
আফনানের কথায় আরিফ চটে গেল, “ওই শু* বা*, একবার খালি ট্রিগার টানতে বলমু। তুই তোর ওই জার্নালিস্ট বন্ধু আর এই শালা, ফিনিশ।”
“তোমরা অতি বিশ্বাসী তো। তাই ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি তোমাদের। তাই সব ডকুমেন্টস, কল রেকর্ডস, ভিডিও ক্লিপ, সব একজনের কাছে দিয়ে এসেছি। বলা আছে, ফজরের আজানের মধ্যে যদি আমরা না ফিরি তোমাদের কীর্তিকলাপ যেন দেশবাসীর সামনে চলে যায়। তাই যত সময় নষ্ট করবে ততই বিপদ তোমাদের।” আফনানের মুখভঙ্গিতে আশ্চর্য ভাবলেশহীন কঠোরতা, নিলয় পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছে।
“আমাদের কথা যদি ফাঁসই করবি, তাইলে আর তোদের যাইতে দিয়ে কী লাভ। ম র।”
“এতগুলো লা শ গুম করতে পারবে আলো ফোঁটার আগে? আরও জনবল দরকার ছিল তো।”
“সেটা পরে ভাবা যাবে। আগের কাজ আগে।”
“তোমার বাবা কিন্তু এসব করতেন না। তিনি শয়তান হলেও অনেক বুদ্ধিমান। ওমন বুদ্ধিমান একটা লোক, কী করে এমন গবেট জন্ম দিতে পারে তাই ভেবে আফসোস হচ্ছে। এই তুমি কি ব্রেইন অপারেশন করে বুদ্ধিশুদ্ধি সব ফেলে গোবর ঢুকিয়ে নিয়েছ? গোবর প্ল্যান্টেশন করিয়েছ? যুগান্তকারী কিন্তু। ডাক্তারের নামটা বলো তো আমাকে, আমার যত শত্রু আছে, তাদের ধরে ধরে নিয়ে যাব।”
আফনান চাইছে উদ্ভট কথা বলে ওদের চটিয়ে দিতে। অতিরিক্ত রাগ থেকে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের একটা ভুল যেমন আফনানদের আপার হ্যান্ডে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে নো রিস্ক নো গেইন ছাড়া এই মুহূর্তে অন্যকিছু মাথায় আসছে না।
খুবই অশ্রাব্য গালি বেরিয়ে এলো আরিফের মুখ দিয়ে। আফনান নিজের হৃদপিণ্ডের ধ্বকধ্বক শুনতে পাচ্ছে। তবে কোনোভাবেই সেটা প্রকাশ করছে না।
“তোরা আমাদের কাছে নিতান্তই শিশু। কত মহা ধূর্ত খেলুড়ে মাত হয়ে গেল। এই হাত আর কাঁপে না, অনেকগুলো মানুষের রক্ত এই হাতে লেগে আছে৷”
এই স্বীকারোক্তিটাই এতক্ষণ ধরে বের করতে চাইছিল আফনান। নিলয়ের চ্যানেলের এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট হবে এটা৷ সব সেট করা আছে। এবার আর দেরি করা সম্ভব নয়।
“ওই মনির, প্রথমে ওই দোকানীরে মা র।”
বাকিরা পজিশন নিয়েছে। নিলয়ও সিগনাল পাঠিয়েছে। আরিফের আর বাকিদের নজর আফনান আর নিলয়ের উপরে নিবন্ধ।
রবিনের হাত ছেড়ে দিয়েছে মনির। কানেকানে ফিস ফিস করে কিছু একটা বলল, এরপর ধাক্কা দিয়ে রবিনকে আফনানের দিকে ঠেলে দিয়ে নিশানা স্থির করল নিজের দলের দিকে। শুরু হলো ফা য়া রিং।
আরিফ চিৎকার করে তিক্ত গলায় বলল, “বেঈমান।”
রবিন প্রস্তুত ছিল, তবে এতদিন বন্দী দশায় থেকে পা গুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে। তবুও প্রাণপণে কয়েক পা এগিয়ে এলো। আফনান ওকে টেনে শুইয়ে দিল। ততক্ষণে পুলিশ ফোর্স চলে এসেছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে আরিফ পেছন থেকে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেল। যাবার আগে দূর থেকে মনিরকে উদ্দেশ্য করে গু লি চালিয়ে দিল নিশানা ঠিক করে। আফনানকেও নিশানা করতে চাইল, কিন্তু তাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
দল নে তা যখন পাশটান দেয়, তখন বাকিরাও আসলে হেরে যায়। একটা যু দ্ধে নেতৃত্বের ভূমিকা সর্বাগ্রে। সে নড়বড়ে হলে সেই যু দ্ধ বড্ড একপেশে হয়।
রবিনকে নিলয় সরিয়ে নিয়ে গেল নিরাপদ জায়গায়।। মনিরের দিকে এগিয়ে গেল আফনান। কাতরাচ্ছে ভীষণভাবে। অদ্ভুত মায়া হলো মানুষটার জন্য।
***
আজ নার্স ছুটি নিয়েছে হুট করে। তার ছেলে বাসায় সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে। আয়েশা না করতে পারলেন না। সন্তান সবার আগে।
আয়েশা নামাজের ফাঁকে এসে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। নীরাও আজ তাহাজ্জুদ পড়েছে। এরপর এসে শায়লার পাশে এসে বসেছে। শায়লার আজ ব্যথাটা বেশি হচ্ছে। আচমকা অসহ্য ব্যাথায় কাতরে উঠল।
নীরা ওর হাত ধরে অভয় দেবার চেষ্টা করে আয়েশাকে ডেকে আনলেন। আয়েশা অভিজ্ঞ মানুষ। বললেন, “মা, ওকে হসপিটালে নেয়া দরকার।”
নীরারও তাই মনে হচ্ছিল। ঘড়িতে তখন পৌনে চারটা। নিলয় বা আফনানকে এখন কোনোভাবেই কল করা যাবে না। সবার আগে এম্বুলেন্স বা গাড়ি দরকার। কিন্তু এত রাতে, ওর কাছে কারোর নাম্বার নেই। মনে পড়ল, বাইরে সিকিউরিটি আছে। সে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। তাদের গেটের ভেতরে আর বাইরে ছিল। দুইজন।
তাদের জানাতেই তারা বিশ মিনিটের আগেই ব্যবস্থা করল। এম্বুল্যান্স রওনা হলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তবে পেছনে যে কেউ অনুসরণ করছে সেটা খেয়াল করেনি।
***
মনিরকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। রবিনও আছে। চিকিৎসা তারও দরকার।
মনিরের মাথা আফনানের কাঁধে। পুলিশের জিপে করেই যাচ্ছে ওরা।
“এতবড় রিস্ক কেন নিলে মনির?”
মনিরের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও অস্ফুটস্বরে কথা বলছে। ওর মুখের খুব কাছাকাছি আফনানের কান থাকায় সব শুনতে পেল সে।
“ওদের সাথে থাকলেও দুইদিন আগে আর পরে ম র তা মই। তখন তাতে শান্তি থাকত না। আমার মেয়ে আর বউরে সারাজীবন মাথা নামিয়ে থাকতে হইত। একটা ভালো কাজে, অন্তত একজন মানুষের উপকারেও যদি আমার জীবনটা যায়, সারাজীবন যত পাপ করসি, সব কিছু হইলেও ক্ষয় হয় যদি। শান্তিতে মরতে পারি। আমার মতো পাপীর এরচাইতে ভালো মরণ আর কী হইতে পারে।”
থেমে থেমে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বলল মনির। এরপর আবার বলল, “আমার ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। ওর সাথে আমার কোনো স্মৃতি থাকব না হয়তো। ওরে বলবেন, ‘ওর বাবা ওরে খুব ভালোবাসত।’ আমার বউরে একটু বইলেন, আমি ভালো হইতে চাইছিলাম৷ তার আর আক্ষেপ থাকব না। একবার দেখতে ইচ্ছে করতেসে তাদের। পাবো কিনা জানি না। কিন্তু আমি তাও খুশি। কাপুরুষের মতো মরি নাই। মাথা উঁচু করে মানুষের মতো মরতেসি। একবার হইলেও নিজেরে সত্যিকারের মানুষ মনে হইতেসে।”
“মনির, সব কথা পরে বোলো, এখন এত কথা বলা ঠিক না। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। সব মানুষ কমবেশি ভুল করে। যে নিজের ভুল বুঝতে পারে, সেটা খণ্ডাতে চায়, সে সত্যিকারের মানুষ। তুমি সত্যিকার বীরের মতো লড়েছো। তুমি বাঁচবে মনির।”
মনির যেন আফনানের কথায় পরম শান্তি পেল। এতক্ষণের যন্ত্রণা যেন লাঘব হলো। চোখ দুটো ধীরে ধীরে বুজে এলো।
হাসপাতালে আসতে ডাক্তার মনিরকে চেক করে জানালো, “হি ইজ নো মোর।”
আফনানের বোবা কান্নারা বাঁধন হারালো। কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল একেবারে অনাত্মীয় সম্পর্কের একজনের জন্য। নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগে যে হয়ে কয়েক মুহূর্তেই উঠেছিল ওর পরমাত্মীয়। আকাশ বাতাস সমস্ত যেন ভারি হয়ে এলো। এভাবেই হয়তো মনিরের মুক্তি লেখা ছিল অন্ধকার জগত থেকে। দূর থেকে ভেসে এলো ফজরের আজান।
***
সেই একই হাসপাতালে একই সময়ে একটা সুখবর এলো। সুস্থভাবে জন্ম হয়েছে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। সুখবর পাবার সাথে সাথে সুললিত আজান ভেসে এলো৷ আয়েশা আর নীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
একই সময়ে জন্ম আর মৃত্যু যেন একই সুতোয় বাঁধা পড়ল। দুটোই জীবনের সবচাইতে চিরন্তন সত্য। স্রষ্টা উপরে বসে এই নিয়তি লিখেছেন মানুষের জন্য।
একদিকে জন্মের মিষ্টি সুবাস, অন্যদিকে মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ৷ জন্ম মৃত্যু যেন একসূত্রে গাঁথা।
…………..
(ক্রমশ)
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৫)
নুসরাত জাহান লিজা
রবিনের কাছে এখনো পুরো বিষয়টা ঘোর মনে হচ্ছে। আর কোনোদিন মুক্ত বাতাসে শ্বাস টানতে পারবে কি-না সেটা নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েছিল। একসময় মেনেও নিতে শুরু করেছিল, হাল ছেড়ে দিয়েছিল নিরাশায়। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার খুশি তাই এখনো আত্মস্থ করে উঠতে পারছে না।
ওর মনে পড়ে যখন ভয়াবহ অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন সেই ছেলেবেলায় হারিয়ে ফেলা মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ত। আর মনে পড়ত শায়লাকে। এই জীবনে ওর একমাত্র পিছুটান। যার গর্ভে তার অনাগত সন্তান। সেই সন্তানকে একবার বুকে জড়িয়ে নেবার ইচ্ছা, শায়লার ভালোবাসার টান ওর প্রাণশক্তি হয়ে উঠত সেইসব দুঃসহ মুহূর্তে। একটা নিষ্পাপ তুলতুলে অবয়বকে কে যেন ওর হাতে তুলে দিল। সে কতক্ষণ শিশুর মুখপানে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে যেন যেন রবিনের বিহ্বলতা কাটল। শায়লার সামনে বসে নিজের সন্তানকে পরম মমতায় জড়িয়ে সে হু হু করে কেঁদে ফেলল।
রবিনের কান্নার তোড়ে সদ্যোজাত শিশুও সশব্দে কেঁদে উঠল। তার মানে সে সত্যিই ফিরেছে! তার সন্তান পৃথিবীর আলোয় এসেছে, ওই তো সামনের বেডে শায়লা অশ্রুসজল চোখে ওকে দেখছে। এক হাতে সন্তানকে আঁকড়ে অন্য হাত বাড়িয়ে শায়লায় একটা হাত ছুঁয়ে দিল। কান্না প্রগাঢ় হলো রবিনের।
শায়লা চোখ মেলে এই অপার্থিব, অভূতপূর্ব মুহূর্তের স্বাক্ষী হলো। বাবা, মেয়ে একসাথে আকুল হয়ে কাঁদছে। এই কান্নায় যে সুখ আছে, তা সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল। এতদিনের অনন্ত প্রতীক্ষা যেন আজ সত্যি হয়ে ধরা দিল।
দরজার কাছে আফনানকে দেখল, একরাশ কৃতজ্ঞতায় নিজের ভাইয়ের প্রতি সমস্ত অন্তর আচ্ছন্ন হলো। শায়লাকে সবকিছু থেকে দূরে রাখা হলেও সে জানে কী ভয়ানক ঝুঁকি সে নিয়েছিল। এখন কী চমৎকার করে হেসে ওকে যেন বলতে চাইছে, “আমি আছি তো, ভয় কীসের!”
আফনানের হাসিটা এত সুন্দর সরলতা ভরা যে মন ভালো হয়ে যায়। শায়লার ভীষণ প্রিয় ভাইয়ের এই হাসিটা। ওরা যখন ছোট ছিল, তখন বাইরে প্রায়শই ওদের অনেককিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেক সহপাঠীর সাথেও ঝগড়া, মারপিট হয়েছে। কিন্তু মা কোনোদিন এসবের মধ্যে আসেননি। আয়েশা চাইতেন তার সন্তানরা যেন নিজের লড়াই নিজে করতে শেখে। জীবনটা ফুলে সাজানো নয়, প্রতি পদে পদে পঙ্কিলতা ভরা, কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ। সেই পথে তিনি ওদের ছায়া হলে যখন তিনি থাকবেন না, তখন ওরা বারবার হোঁচট খাবে, উঠে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি তাদের ভঙ্গুর হতে শেখাননি। তিনি চেয়েছেন, তারা সেই কাঁটা মারিয়ে, নিজের গন্তব্যের পথ মসৃণ করে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাক। তবে এটাও তিনি ওদের সবসময় বুঝতে দিয়েছেন যে যা কিছুই হোক, তার স্নেহময় ছায়া ওদের উপরে সবসময় আছে।
বাইরের দুনিয়ায় তাই দুই ভাইবোন হয়ে উঠেছিল একে অপরের ঢাল। তখনও ভুল কিছু করে ফেললে আফনান এভাবেই হেসে শায়লাকে অভয় দিত। যেন কিচ্ছু হয়নি, কিছু হবে না। ভরসার হাসিটা বড্ড শান্তির, বড্ড মায়ার। তেমন শায়লার দিক থেকেও তাই৷ একে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওরা কোনোদিন পিছপা হয় না, দ্বিতীয় চিন্তা করে না।
প্রেমময় জীবনসঙ্গী, সদ্য পরিচিত হওয়া মাতৃত্ব, দৃঢ় অথচ স্নেহময়ী মা আর ওমন একটা ভাই থাকতে জীবনের ছোটখাটো অপ্রাপ্তিগুলোকে অবলীলায় ঝেড়ে ফেলা যায়। নিজেকে শায়লার ভীষণ পরিপূর্ণ মনে হলো আজ। এই পূর্ণতা সবসময় ওকে ঘিরে রাখুক, মনে মনে পরম করুণাময়ের কাছে এটা চাইল সে।
***
নীরা এমন আনন্দের মুহূর্তে আর নিজের কথা তুলল না৷ তবে চমৎকার এই পরিবারের অংশ হতে ভীষণ ইচ্ছে আরও প্রগাঢ় হলো। মা এদের জানেন না বলেই মিছিমিছি ভয় পান। একবার মন দিয়ে দেখলে তিনি নিজেই উপলব্ধি করবেন আফনানকে, তার পরিবারকে। এটা নীরার বিশ্বাস। সেজন্যই পুরনো কথা ভুলে, মায়ের সমস্ত নিষেধাজ্ঞা পায়ে দলে সে এসেছিল তার কাছেই।
কিন্তু… একটা দীর্ঘশ্বাস সন্তর্পণে চাপা দিল নীরা। নিলয় এসে বলল, “নীরা, আজ আমাকে একবার অফিসে না গেলেই না। ফুটেজ পাঠিয়ে দিয়েছি, কিন্তু আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট টকশো তে থাকতে হবে। সিরিয়াস ইস্যু, তাই আজকের এই ঘটনার সমস্ত প্রেক্ষাপট জানাতে হবে দেশকে। তুই যাবি?”
নীরা এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। এরপর ভাবল, এখন এখানে ওর প্রয়োজনীয়তা তো ফুরিয়েছে। এই সুখী পরিবারের অমানিশা কেটে গেছে। তবুও চলে যাবে মনে হতেই ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। সে নিলয়কে বলল,
“একটু অপেক্ষা করো ভাইয়া। আমি বিদায় নিয়ে আসি।”
সে কেবিনে আসতেই আফনান একবার চোখ তুলে তাকাল। চোখাচোখিতে যেন কত না বলা কথা, তবুও যেন অবোধ্যই রইল।
নীরা চোখ সরিয়ে আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি, আমি ভাইয়ার সাথে চলে যাচ্ছি। দোয়া করবেন।”
“সে কী! আজই চলে যাবে? না না, অন্তত আর একটা দিন থেকে যাও মা। এমন এক অবস্থায় ছিলাম, যে তোমার তেমন খোঁজ রাখতে পারলাম না।”
“আন্টি, ভাইয়াকে যেতেই হবে। পরে আমার জন্য যাওয়াটা… ”
“ওসব বললে শুনছি না মা। আর একটা দিন থেকে যাও। নিলয় তো আবার আসবে। তখন যাবে।” তিনি ভীষণ আন্তরিক দৃঢ়তা নিয়ে কথাটা বললেন।
এবার শায়লাও বলল, “আজ থেকে যাও নীলা। তোমার সাথে তেমন করে কথাই হয়নি। তুমি আমাদের ভীষণ দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য এসেছিলে। এভাবে হুট করে যেও না, প্লিজ।”
নীরা একটু অপেক্ষা করল, সে আশা করছিল আফনানও যেন কিছু বলে। কিন্তু সেখান থেকে কোনো শব্দ এলো না। নীরা বলল,
“আপনাদের আজ আনন্দের দিন। আপনারা নিজেদের মতো এনজয় করুন। আমি বাইরের মানুষ।”
“আমাদের এই মনে হলো তোমার মা?”
এবার আফনান বলল, “সবাই যখন বলছে, থেকে যা।”
নীরার মনে হলো যেন খুব দায়সারাভাবে বলা হলো কথাটা। তবুও আয়েশা আর শায়লার আবারও আন্তরিক আহ্বান সে প্রত্যাখ্যান করতে পারল না। অগত্যা থেকে গেল। কিন্তু নিজেকে কেমন অনভিপ্রেত বলে মনে হলো।
***
মা আর শায়লাকে মনে মনে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দিল আফনান। ওর নিজেরও প্রবল ইচ্ছে ছিল বলতে যে, “নীরা, থাক প্লিজ। সারাজীবনের জন্য আমাদের সাথে থেকে যা।”
কিন্তু সে ওই দুর্লভ মেয়েটার যোগ্য নয়। কী করে সে বলবে! আরিফ পালিয়েছে। মাথার উপরে এখনো ফাঁড়া ঝুলছে৷
নিলয়ের চ্যানেলে ঘটনার বিস্তারিত বলতে হয়েছে ক্যামেরার সামনে। সারারাত এসব নির্ঘুম ছুটোছুটি, কতরাত সে ঠিকঠাক ঘুমায়নি! ভীষণ অবসন্ন লাগছে আজ। তবুও নীরা থেকে যাবে সম্মতি হতেই কেন যে স্বস্তিতে মন ছেয়ে গেল! ওর জন্য ভালোবাসা নয়, নীরাও তো নয়! জেনেও কেন যে দুর্বল হয় বারবার!
***
আজমল খান অসম্ভব রাগে ফুঁসছেন সেই রাতের শেষ প্রহর থেকেই। একজন খবর দিল, মিশন ফেইল করেছে, পাখি উড়ে গেছে, তখন থেকে নিজের উপরে অসম্ভব ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তখন সন্তান বাৎসল্যে গলে গিয়ে আরিফকে অনুমতি দিয়েছিলেন।
তার এত বছরের অর্জন, এত সুনাম সব কেমন ভূলুণ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তিনি একসময় ভুলে গিয়েছিলেন জন্মের মতো মৃত্যুও ধ্রুব সত্য। বয়স যখন আটষট্টি, তখন এসে কথাটা মনে পড়ল। তার অর্জিত এত শান-শওনক সব এভাবে অরক্ষিত রেখে যেতে তার বড্ড কষ্ট হবে। তাই আরিফকে তিনি যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরি করে রেখে যেতে চান। যাতে সব ভেসে না যায়।
আবার আরিফ এখন অব্দি কোথাও তেমন বুদ্ধির স্বাক্ষর রাখতে পারেনি তেমন। মনে করে গায়ের জোরে সব হয়। কিন্তু দশজনের গায়ের জোরও কখনো কখনো শুধুমাত্র তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে মাত হয়ে যায়, এটা তিনি নিজে খুব ভালো জানলেও ছেলেকে উপলব্ধি করাতে পারেননি। বাবা হিসেবে এটা তার চরম ব্যর্থতা বলে মনে হলো।
সারাজীবন বুদ্ধির খেলায় জয়ী হয়ে এসে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে কি-না বাৎসাল্যের মতো সামান্য আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে ভুল চাল দিয়ে বসলেন! কপাল চাপড়ানো ছাড়া আপাতত তার হাতে আর কিছুই করার নেই। সব হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে। বাইরে সাংবাদিকরা আনাগোনায় ভরে যাচ্ছে। টিভি চ্যানেলে এক্সক্লুসিভ সংবাদ চলছে, তার বাড়ির সামনে থেকে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। যদিও পুলিশ ব্যারিকেড দেয়া। তারা ভেতরে এখন অব্দি আসতে পারবে না। আগামীকাল নির্বাচন।
আরিফ নিজে থেকেই এসে বলেছিল, “বাবা, আমি যেতে চাই।”
আজমল খানের ডান হাত হাসান আলী। তাকে এই অপারেশনের দায়িত্ব দিতে চাইছিলেন তিনি। বয়স ছত্রিশ, মাথা ভীষণ ঠান্ডা। চরম মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে। ভীষণ করিৎকর্মা ছেলে। তাই ছেলের আবেদনে বলেছিলেন,
“তুমি পারবে?”
“একবার ভরসা করতে পারেন। আমি তো আপনার নিজের রক্ত।” এই কথাতেই তিনি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে চরম ভুল করেছেন৷ বয়স হচ্ছে বলেই কি আবেগকে প্রশ্রয় দেবার মতিভ্রম চেপেছিল!
“আচ্ছা, কিন্তু হাসান তোমাদের সাথে থাকবে।”
হাসানের প্রতি আরিফের ঈর্ষা আছে, সে সন্তান হয়েও আজমলের ভরসার পাত্র হতে পারেনি, অথচ ওই হাসানকে ছাড়া এক পা হাঁটেন না। সূক্ষ্মভাবে যেন ওর অক্ষমতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবার প্রয়াস। আর হাসান মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই ওকে জ্ঞান দিতে আসে, বিষয়টা ততোধিক বিরক্তিকর।
“না, বাবা, প্লিজ, আমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার শেষ সুযোগ চাই। আমি নিজেকে প্রমাণ করবই।”
ছেলের আত্মবিশ্বাসী বাচনভঙ্গিতে তিনি নিজেও খানিকটা যেন প্রীত হয়েছিলেন মনে মনে। হাসান যতই বিশ্বস্ত হোক, নিজের রক্ত তো নয়! তাই তিনি সম্মতি দিলেন। তবে হাসানকে দিলেন অন্য দায়িত্ব। রবিনদের বাড়ির বাইরে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে। কে যায়, কে কখন বেরোয়। সব জানতে হবে তার। এটা তার প্ল্যানের পরবর্তী অংশ। হাসান অবশ্য এখনো ফোন করেনি। একবার শুধু বলেছে হাসপাতালে যাচ্ছে।
আজমল আফনানকে কল করেছিলেন আরও ঘণ্টাখানেক আগে৷
“গা দ্দা রে র বাচ্চা, কথা রাখলে ভিডিও ডিলিট দিবি বলছিলি। এখন টিভি চ্যানেলে দিয়ে দিছস!” আরও অকথ্য কিছু গালিগালাজ বেরিয়ে এলো একসাথে। স্নায়ুবিক অস্থিরতায় তিনি নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। এটাও বয়সের জন্যই বোধহয়।
“আপনি খুব বিশ্বাস রেখেছিলেন? একজন নিরীহ লোককে আরেকজন সাধারণ মানুষের কাছে ছাড়তে ভালো করেই যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছিলেন, সাথে এক দঙ্গল মানুষ। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি স্যার। যেই ক্লিপ ফেরত দেবার কথা ছিল সেটা প্রকাশ করিনি। আজকের ঘটনা আর আপনার থ্রেট কল এগুলোই দিয়েছি প্রেস আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।”
এই ছেলের ঔদ্ধত্যে তার রাগ হলেও একটা জিনিস অস্বীকার করতে পারলেন না, তা হলো এই ছেলের অপরিসীম সাহস আর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বুদ্ধিও আছে। খুব সাধারণ তবুও যেন একে উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য ছেলেটা তা বিপরীতে দাঁড়িয়ে। আরিফের সাথে তুলনা করে আফসোস হলো, কেন যে তার ছেলে ওমন দৃঢ় হলো না। তবে আফনানের মধ্যে কেন যেন নিজের তারুণ্যকে খুঁজে পান। তিনি যখন শুরু করেছিলেন, তখন দেশ সেবা করার ব্রত নিয়েই তো এসবে জড়িয়েছিলেন। কখন যে স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে পাকে নেমেছেন! রিপু ভারি ভয়ংকর। কখন যে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে প্রলোভনে, বোঝা দায়।
চারদিক থেকে খারাপ বাতাস যেন তার চারপাশের পরিবেশ বিষিয়ে তুলছে। দলের জরুরি সভায় তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আরিফ পলাতক, ওকে গা ঢাকা দিতে বলেছেন তিনি।
আচমকা তার বুকে ব্যথা হলো। প্রচণ্ড বুকে ব্যথা নিয়ে তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে।
তার বাড়িতে রেখে আসা ব্যক্তিগত মোবাইলে ভীষণ জরুরি কল আসছে বারবার। হাসানের কল। কিন্তু আজমল তখন হাসপাতালে অচেতন।
………
(ক্রমশ)