জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-১৩

0
519

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩

“কারো সাথে কথা বলবি না। খাবার দিলে খাবি না। মনে থাকবে? আসার সময় খাবার নিয়ে আসব। আমার জীবনটা শেষ করে দিল। বাচ্চাটা হোক, যেদিকে চোখ যায় চলে যাবো, বিরক্তিকর। শাড়িটা সরিয়ে রাখবি, আমার চোখের সামনে পেলে পু’ড়িয়ে ফেলব।”

ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বলছি, অপূর্ব ভাইয়ের নিজস্ব বিখ্যাত উক্তিগুলো। আমার সামনে বসে আছে তুর। বিগত ঘটনাগুলো জানতে চাইলে তাকে তার ভাইয়ের কাহিনী শুনাচ্ছি। সে হেসে কু’টিকু’টি হচ্ছে। এক পর্যায়ে তুর আমাকে থামতে বলে‌। আমি ওকে চুপ করতে বলে নিজের মতো বলে যাচ্ছি। এর মাঝে চোখ গিয়ে আটকে গেল ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে। অপূর্ব ভাই বুকে হাত গুঁজে পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার প্রতিটা কথায় মাথা ঝাঁকাচ্ছে। এজন্য এতক্ষণ তুর আমাকে থামতে বলেছে। আমি সৌজন্য হাসি দিলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “আপনি এসেছেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আরও আগে আসতেন।”

দেয়ালে হেলান দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমার গুষ্টি উদ্ধার করছিলি। সেগুলো শুনতে পেতাম আর-কি।”

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললাম, “কীসব বলছেন। আপনি আমার স্বামী। আপনার গুষ্টি উদ্ধার মানে আমার বাচ্চাদের গুষ্টি উদ্ধার। আমি এইসব করতে পারি?”

ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তাহলে এভাবে অভিনয় করে কী দেখাচ্ছিলি?”

“আসলে ট্রাউজার আর আপনার টি শার্ট পড়ার পর থেকে শরীরের ভেতরে ভিশন চুলকাচ্ছে।”

“আর কথাগুলো?”

‘এইরে এবার কী বলে মেনেজ দিবো।’ সৌজন্য হাসি দিয়ে বললাম, “আপনার জামা কাপড় পরিধান করার পর থেকে নিজেকে অপূর্ব আহসান লাগছে। তাই তেমন ব্যবহার করছি।”

অপূর্ব ভাই বাজারের থলে এগিয়ে দিলেন। তুর একপাশে সেঁটে আছে। অপূর্ব ভাইয়ের দৃষ্টিতে তা এড়ালো না। মাথা নিচু করে বলে, “আসলে আরু একা ছিল। তাই সঙ্গ দিতে এসেছিলাম।”

অপূর্ব ভাই কঠিন গলায় বললেন, “আরুকে সঙ্গ দিতে এসেছিস, ভালো কথা। তবে আমার বোন হিসেবে নয়, আরুর বন্ধু হিসেবে। বস!
তোর জন্য একটা টপস্ এনেছি। দেখ পছন্দ হয় কি-না?”

তুর আনন্দের মাত্রা আকাশ স্পর্শ করল। ব্যাগ কেড়ে নিয়ে টপস্ ভালো করে দেখল। তার মুখে হাসি। আমার জন্যও নতুন কয়েকটা টপস্ এনেছে। বাজার এনেছে। কিছু বাসনকোসন এনেছে। কাঁচা বাজার এনেছে। গরম গরম মোগলাই পরোটা এনেছে। হুট করে তলপেটে মোচড় দিয়ে উঠল। আমি ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে এগোলাম। অপূর্ব ভাই হাত ধরে ফেললেন। কঠিন গলায় বললেন, “যাওয়ার আগে তোকে ওয়াশরুমে সারাদিন থাকতে বলেছিলাম। থাকা শেষ। এবার আমি এসেছি অতএব আমি যাবো। তুই বরং মাদার হরলেক্স খা।”

মেঝেতে কাঁচের বোতল দেখা যাচ্ছে। গায়ে ইংরেজিতে ‘মাদার হরলেক্স’ লেখা। মা হচ্ছি বলে মাদার হরলেক্স। তিনি তো বাবা হচ্ছে। ফাদার হরলেক্সে নিশ্চয় নিয়ে আসবেন। মেঝেতে ভালোভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম। ফাদার হরলেক্স নেই। কেন নেই? সব কিছু শুধু আমার বেলায়? নিজের বেলায় ষোলো আনা আমার বেলায় এক আনাও নয়, আশ্চর্য! আমি কোমরে হাত গুঁজে বললাম, “ফাদার হরলেক্সে কোথায়?”

ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কী ‘ফাদার হরলেক্স’ সেটা আবার কী?”

“আমি মাদার হরলেক্স খাবো আপনি ফাদার হরলেক্স খাবেন না?”

“ফাদার হরলেক্স আছে, আমার জানা নেই।তুই গিয়ে হরলেক্স কোম্পানি-কে বল‌, ফাদার হরলেক্স আবিষ্কার করছে। তোর বোকা মনে এটা অসম্ভব কিছু নয়।”

আমি কোমরে হাত দিয়ে বললাম, ফাদার হরলেক্স দরকার ছিল। বাবারা বঞ্চিত হল না?”

কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, “কারণ বাচ্চা মায়ের গর্ভে থাকে, বাবার গর্ভে নয়। মায়ের মাধ্যমে সন্তানের পুষ্টিকর হয়। বুঝেছিস। এবার সর সামনে থেকে।

অপূর্ব ভাই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। আমি বিছানায় বসে কথাগুলো ভাবতে আরম্ভ করলাম। ভুল কিছু বলেনি। আচ্ছা এক্ষেত্রে বঞ্চিত হল কারা? ছেলেরা না-কি মেয়েরা?
_
মাঝরাতে বালিশ পড়ল নিচে। ঘুমের ঘোরে হাতরে পেলাম না। অন্ধকার তখন ঘরের অভ্যন্তরীণ আচ্ছন্ন। নিভু নিভু চোখে দেখলাম চেয়ে। সাদা টাইলসের উপর চতুর্ভুজের আকৃতির স্তূপ। বোঝা গেল এটা আমার বালিশ। তোলার স্পৃহা খুঁজে পেলাম না। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি ঘুমের আছেন। হুট করেই তার নগ্ন বুকে মাথা রাখলাম। গরমের কারণে শার্ট খুলে রেখেছেন। ‘কখন খুলেছেন এই শার্ট?’ এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ঝুড়ি নিয়ে বসলাম না। সব চিন্তা ভাবনাকে পাশে স্তূপ করে রেখে ঘুমাতে মন দিলাম। আনুমানিক দশ মিনিট ভালোই ঘুম হল। ঠিক এগারো মিনিটের মাথায় অপূর্ব ভাইয়ের সেই বাঁশ গলা নিয়ে মাঝরাতে চ্যাঁচিয়ে উঠলেন, “আরু, এই আরু। সর বলছি। গরমে আমি সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, তার ভেতরে মহারানী শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে, সর।”

আমি একবিন্দু নড়লাম না। একটু শরীর টানটান করে দৃঢ় করে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি আমার ভাবাবেগে অসন্তুষ্ট। পুনরায় বললেন, “আরু, আমি উঠলে তোকে ছাদে রেখে আসব বলে দিচ্ছি।”

ঘুমু ঘুমু গলায় বললাম, “অপূর্ব ভাই বালিশটা নিচে পড়েছে। আপনার যেমন ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করছে না, আমারও করছে না। একবার ঘুম ভাঙলে, ঘুম আসেনা। আপনি বালিশটা তুলে দিন। তাহলে আর ধরব না।”

অপূর্ব ভাই হাত সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, “ঠিক আছে, বুকেই মাথা রাখবি। এই রাতে তোর বালিশ তুলতে পারব না। জড়িয়ে টড়িয়ে ধরবি না, গরম লাগে।

আমি হাতের বন্ধন আলগা করে শুধু মাথা রাখলাম। সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আজ অপূর্ব ভাই আমার জন্য রসমালাই এনেছে। দেখেই জিভে জল চলে এসেছে। কতদিন হয়েছে খাওয়া হয় না। ওষ্ঠদ্বয়ের দু’পাশে থেকে জল গড়াচ্ছে। আমি বাটি সমেত রসমালাই খেতে বসলাম। চামচ না নিয়েই হাত দিয়ে মুখে দিলাম। কেমন নোনতা নোনতা স্বাদ। মনে হচ্ছে লবণ। ‘আই লাভ ইউ’ ফ্লিমের মতো দোকানদার চিনির বদলে লবণ দেয়নি তো! একটু দেখে বানাবে না। আমি রসমালাই তুলে নিলাম। চেখে দেখলাম। অপূর্ব ভাইকে বললেই বলবে, ‘তুই নোনতা তাই তোর স্বাদও নোনতা।’ আমার কাছে মিষ্টিই লাগছে। উপায় নেই, আমি মালাই মুখে দিয়ে কামড় দিলাম সর্বশক্তি দিয়ে। অপূর্ব ভাই চিৎকার করে উঠলেন। কর্ণপথে হানা দিল সেই শব্দ। আমাকে সাথে নিয়ে বসলেন তিনি। ব্যাঘাত ঘটল ঘুমের। টলমলে ঘুম মিশ্রিত দৃষ্টিতে সবকিছু দেখছি। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচল হল। অনুভব করলাম আমি অপূর্ব ভাইয়ের বুকের বেশ কিছুটা অংশ কামড়ে ধরে আছি। ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে বসলাম। অপূর্ব ভাই বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতরে হাতে নিলেন। আলো জ্বেলে বুকের উপর ফেললেন। হাত বুলাতে লাগলেন। মাঝে মাঝে আড়চোখে রক্তচক্ষু করে তাকাচ্ছে। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “তোকে আমি শুয়ে থাকার অনুমতি দিয়েছি, কামড়ানোর নয়। দেখ কামড়ে কী করেছিস। একদম রক্ত টকটক করছে। ইচ্ছে করছে তোকেও কামড়ে দেই।”

আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, “আসলে স্বপ্ন দেখছিলাম। ভুল করে হয়ে গেছে।”

“স্বপ্নে কী দেখছিলি, আমার মাথাটা খাচ্ছিলি চিবিয়ে?”

“সত্যি বলছি, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম তুমি রসমালাই এনেছ। সেটা খেতে গিয়েই।”

অপূর্ব ভাই বুকের বামপাশে ইঙ্গিত করে বললেন, “এটা দেখতে পাচ্ছিস? এটা? এই জায়গাটা তোর লালা দিয়ে ভিজিয়ে ফেলেছিস।”

“আমি কখন ভিজিয়ে দিলাম? মিথ্যা কথা।”

তুই এই জায়গা বেশ কয়েকবার চেখেছিস। আমি বারবার বারণ করেছি, তুই শুনিস নি। আমার শরীরের ঘামটুকুও খেয়ে ফেলেছিস। ওয়াক্ থুথু।”

আমার মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করা গেল তৎক্ষণাৎ। চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেল। স্বপ্নে রসমালাইয়ের রসটুকুও তাহলে এই কারণে নোনতা লাগছিল। রসমালাইয়ের মালাই তার বুকের ঠিক ঐ জায়গাটা। কী লজ্জা। ছিঃ! আরু, ছিঃ! হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমার বুঝার দরকার ছিল। রসমালাই মিষ্টি হয়, নোনতা নয়।

অপূর্ব ভাই বললেন, “তোর রসমালাই খাওয়ার শখ মিটেছে। তুই আমার ঘুম ভেঙেছিস, এবার তুই বিদ্যুৎ আসার আগ পর্যন্ত হাওয়া করবি। দ্যাটস্ ফাইনাল।”

কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “কী দিয়ে বাতাস করব? পাখা তো নেই।”

অপূর্ব ভাই আঙুলের ইশারায় বললেন, “ড্রেসিং টেবিলের ঠিক নিচের ড্রয়ারে একটা মোটা কাগজ আছে। ওটা দিয়ে হাওয়া করবি। গো ফাস্ট।”

আমি উঠে গেলাম কাগজ নিতে। নিজেই নিজের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে হাওয়া করতে শুরু করলাম। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আর সময় পেল না? ঘণ্টা খানেক তো হয়ে গেল, এবার অন্তত আয়। প্রতিদিন নিয়ম করে চার ঘণ্টা এই ভোগান্তি পোহাতে হয়।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]