জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-১৬

0
504

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬

“এভাবে না কেঁদে চেন লাগানোর চেষ্টা করলেই তো হয়।”

আমি দ্রুত চেন লাগাতে ব্যস্ত হলাম। এলোমেলো চুল বাঁধা দিল কাজে। তাদের ভাষ্যমতে, ‘না আরু, চেন লাগানো যাবে না’ পেঁচিয়ে গেল। আমার দোটানা ঘুচে দিতে অপূর্ব ভাই এগিয়ে এলেন। প্রতিটা পায়ের ফেলা কদম হৃৎপিণ্ডে ধুকপুকানি শতগুণ করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পুরুষালি হাতটা পিঠে স্পর্শ পেতেই মিইরে গেল আমি। অজানা কারণে চোখের পাতা ভারী হয়ে গেল। লোমকূপ শিথিল হয়ে গেল। আমি জামা আঁকড়ে ধরলাম। অপূর্ব ভাই চেন লাগিয়ে সরে গেলেন। বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন, “তুই নিজেই একটা বাচ্চা, আবার তুই কি-না বাচ্চা সামলাবি। হাউ ফানি।”
__
ডেক্সিতে পানি টগবগ করে ফুটছে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে চায়ের পাতা দিলাম। অপূর্ব ভাই ফিরেছেন বাড়িতে। তখন চলে গেছেন আর এখন ফিরলেন। চা খেতে চেয়েছে।‌বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল। চা হয়ে গেছে। কাপে ঢেলে নিলাম। পা বাড়ালাম ঘরের দিকে। ঘর ফাঁকা অপূর্ব ভাই নেই। আগে রাত বিরেতে ছাদে দেখা যেতো তাকে। নিশ্চয় ছাদে তার অবস্থান। ছাদের উদ্দেশ্যে এগোলাম। চা যদি কখনো ঠান্ডা না হতো, তাহলে যেতাম না। তার মুখোমুখি হতে ভয় হয়। অপূর্ব ভাই ছাদের এক কোনায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি পশ্চিম দিকের আকাশে নিবদ্ধ। শব্দহীন পায়ে তার কাছাকাছি গেলাম। কাপটা রেলিংয়ের ওপর রেখে মৃদু স্বরে বললাম, “আপনার চা। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

অপূর্ব ভাই চায়ের কাপ নিলেন না। বিষণ্নতার আভাস ছাড়াচ্ছে তার অন্তর জুড়ে। অসহায় আমি উল্টো দিকে পা দিলাম। অপূর্ব ভাই স্বাভাবিক গলায় বললেন, “একটু দাঁড়া। কথা আছে।”

অপূর্ব ভাইয়ের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললাম, “কী কথা?”

“বলছি, একটু দাঁড়া।”

“ঠিক আছে, আগে চা’টুকু শেষ করুন।”

চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলেন। এক চুমুকে চা’টুকু শেষ করে পূর্বের স্থানে রাখলেন কাপ। ফুটন্ত গরম চা’কুটু এত তাড়াতাড়ি খাওয়াটা অস্বাভাবিক ব্যবহার। দহনে প্রজ্বলিত সে। অপূর্ব ভাই বললেন, “আরু, আমি কিছু কথা বলব। আগে ভেবে দেখবি। তারপরে আমাকে বলবি। কেমন?”

“ঠিক আছে‌।” সংক্ষিপ্ত জবাব।

বলতে শুরু করেন, “দেখ আরু, তুই ছোটো। বয়স মাত্র চৌদ্দ কি পনেরো। কিশোরী তুই, বাচ্চা। নিজেকেই সামলাতে পারিস না, বাচ্চা আরও সামলাতে পারবি না। এই ছোটো বয়সে বিয়েটাই রিক্সের বিষয়, সেখানে তুই অন্তঃসত্ত্বা। তোর জীবন-মরণ সমস্যা। আজকাল কত নারী অপরিপক্ক বয়সে সন্তান ধারণ করে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। তুই একবার ভেবে দেখ।”

২০-৩৫ বছর বয়স সন্তান ধারণের জন্য উপযুক্ত সময়। এর সময়ের আগে কিংবা পরে সন্তান ধারণের ফলে মা ও শিশু উভয়েই ঝুঁকিতে থাকে। কিন্তু আমার যে কিছু করার নেই, এই ঝুঁকিটা আমাকে নিতে হবে। নত গলায় বললাম, “অপূর্ব ভাই, আমি ঠিক পারব। নিজেকে এই মাসগুলোতে সামালে বাচ্চাকেও সামলাবো।”

অপূর্ব ভাই কঠিন গলায় বলেন, “যদি তোর কিছু হয়ে যায়, তখন সবার কাছে আমাকে জবাবদিহিতা করতে হবে। তুই কি সেটা চাস?”

‘কিছু হয়ে যাওয়া’ বলতে আমার বেঁচে না থাকাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো অমর নয়। ‘জন্মিলে মরিতে হইছে, অমর কে কোথা কবে?’ আজকাল আমার কথা তিনি ভাবছেন, ভালো লাগল। আমি হেসে বললাম,
“এছাড়া কোনো উপায় নেই।”

“আছে, তুই অ্যাবশর্ন করিয়ে নে। এতে তুই আর বাচ্চা দু’জনেই ভালো থাকবি।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। আমরা ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তিনি আমার নয়, নিজের কথা ভাবছেন।‌ দূরে গাছের ডালে চড়ইপাখি চিউচিউ ডাকছে। হয়তো বাসার করেছে নতুন। আগে এই ডাক শুনতে পাইনি। আমার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছু হয়ে গেছে। দু’দিন পর ডিম দিবে, বাচ্চা ফুটবে। তারা আবার বড় হবে, ডিম দিবে। এভাবে চলতে থাকবে তাদের প্রজনন। রেলিংয়ে ভর দিয়ে বললাম, “অ্যাবশর্ন করালে দু’জন নয়, একজন ভালো থাকবে। সেটা আপনি। এই বাচ্চাটা আমার অস্তিত্ব। এরজন্য আমাকে সহ্য করতে হয়েছে লাঞ্ছনা-বঞ্ছনা, অবহেলা, এই মিথ্যা বিয়েটা। যদি অ্যাবশর্ন করানোর হতো, তখনই করত মা। এখন আর পারব না।”

অবিলম্বে তার হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম দু’কাঁধে। ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, “আরু, হুট করে সিদ্ধান্ত নিস না। বুঝার চেষ্টা কর। এই বাচ্চাটা আমার নয়, এটা আমি সিউরিটি দিতে পারি। আমি তখন তোকে গ্ৰহণ করব না। পারবি একা একা বাচ্চা-কে পালন করতে, পারবি না। বাবা ছাড়া সন্তানদের কি উপাধি দেওয়া হয় জানিস? এখনও সময় আছে, আমার কথা শোন।”

অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনার যদি এখনও কোনো সমস্যা থাকে তাহলে বলে দিন। বাচ্চা পৃথিবীতে আসার অপেক্ষা করতে হবেনা। আমিও সহ্য করে নিবো শত যন্ত্রণা। বহুদূরে চলে যাবো। খু- নি হয়ে থাকতে পারব না।”

অপূর্ব ভাই আমাকে ছেড়ে দাঁড়ালেন। বিরাজ করছে নিরবতা। এক পর্যায়ে আমাকে একা রেখে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমার সাথে সংসার করতে চায় না, ভালো কথা। তখন বিয়েতে রাজি কেন হয়েছিল। চলে যেত দূরে, বহুদূরে। এখন কেন বলে, বাচ্চা হওয়ার পরে চলে যাবে। তখন কেন যাবে? দয়া দেখাচ্ছে? মেঝেতে বসে পড়লাম। কী এমন দোষ করেছি, যার শাস্তি প্রতি পদক্ষেপে ভোগ করতে হচ্ছে। উঠে ঘরে যাওয়ার মতো শক্তিটুকু নেই শরীরে। আমি রেলিং মাথা রেখে চোখজোড়া বুজে নিলাম। সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। চাঁদের আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে। বিষাদের ভরছে আমার মন। চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুমের রাজত্ব। শুধু দেহখানা নামে আমার, মন, প্রাণ, চোখ দেহটা দাসত্ব করতে ব্যস্ত অন্য কেউ।
কতক্ষণ ঘুমের রাজত্ব চলে চোখের পাতায়, জানা নেই। নিজেকে যখন ঘুমের রাজত্ব থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হই, তখন ভোরের সূচনা হয়েছে। কাক ডাকা ভোর। অন্ধকার চারিদিকে। চাঁদের তেজ হালকা হয়ে এসেছে। চাঁদও খানিকক্ষণের ভেতরে বিদায় নিবে। প্রস্তুতি চলছে। আমি হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। সারারাত এখানেই ছিলাম। এতটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য যে, আমার খোঁজ করার মতো নেই কেউ। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনাজল। ঠোঁট প্রশস্ত করে এক চিলতে হাসি উপহার দিলাম। যেই হাসিতে নেই মাধুর্য। ওড়না ঠিক করতে করতে ঘরের দিকে অগ্ৰসর হলাম। অপূর্ব ভাই বিছানার একপাশে সেঁটে ঘুমিয়ে আছেন। অন্যপাশটা আমার জন্য বরাদ্দ রেখে শুয়েছেন। কিন্তু আমি ছিলামই না। প্রায় রাতেই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে আজ কেন ঘটন না? হয়ত ভেঙেছিল, ইচ্ছে করেই আমার খোঁজ নেইনি। আমিও না! চোখজোড়া কেন বারবার সমুদ্রে পরিণত হয়। আমি কাবার্ড হাতরে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম। ধুলোকণায় চুলকাচ্ছে শরীর। শাওয়ার না নেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই।
শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এলাম। চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে নিলাম। নামাজ আদায় করলাম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মন খা’রা-পেরা জড়োসড়ো হয়েছে। নিচে নেমে গেলাম। এখন ঘুম হবেনা। কিংবা এখন শুলে সকাল ফুরিয়ে যাবে। সকালের নাস্তা বানানো হবেনা। বাগানে হাঁটাহাঁটির ফলে সময় ফুরিয়ে যাবে নিশ্চিন্তে। আধঘণ্টার মতো হাঁটাহাঁটি করে ফিরত এলাম ঘরে। সাতসকালে শাওয়ার নেওয়ার ফলে চোখ আপনাআপনি বুজে আসছে। প্রয়োজনে অপূর্ব ভাইয়ের ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রাখব। এখন একটু না-ঘুমালে চলছে না।

অপূর্ব ভাই এখন বিছানার মাঝামাঝি। এগিয়ে গিয়ে একপাশে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। অপূর্ব ভাই ঘুম ঘুম গলায় না তাকিয়ে বললেন, “সকাল-সকাল কোথায় গিয়েছিলি আরু? কতবার ডাকলাম, সাড়া-ও দিলি না।”

‘বাহ্! তিনি আমার খবর নিয়েছে’ – একটু শান্তি পেলাম। কিন্তু পরক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আমার আনন্দটুকু। মন ভার হল তার কথায়।
“হুট করে মাথা ধরেছে। তাকিয়ে দেখলাম, নামাজ পড়ছিস। কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে রইলাম। পরেরবার আর দেখলাম না। কোথায় গিয়েছিলি?”

ছোট করে বললাম, “বাগানে।”

“ওহ্। এবার তাড়াতাড়ি আয়। চুলগুলো টেনে দে। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।”

তার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। প্রয়োজনে আমাকে খুঁজেছেন, মাথার চুল টেনে দিতে। এছাড়া কেন খুঁজবেন? আরু, কারো থেকে কিছু আশা করিস না। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। অপূর্ব ভাই ধমকে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি কাছে আয়। আমি বিছানা থেকে উঠলে তোর খবর আছে কিন্তু আরু।”

নড়াচড়া করলাম না। কর্ণপথে শব্দরা পৌঁছাতে নারাজ। তারা যে আমার কথা শোনে না। অপূর্ব ভাই আমার ভাবাবেগ না পেয়ে বললেন, “আরুর বাচ্চা, তুই কি আসবি? না-কি উঠব?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]