#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪ [সারপ্রাইজ]
কাঁদতে কাঁদতে চোখের নিচে কালচে দাগ পড়েছে। টলটলে চোখজোড়া বড্ড অবাধ্য। টিস্যুর বক্স ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। কান্না কেন থামছে না যেন। এবার জামা দিয়ে মুছতে আরম্ভ করলাম। অপূর্ব ভাই কোথায় আপনি?
টিভি এখনও চলছে। একটু আগে শেষ হয়েছে সুইটহার্ট সিনেমাটি। বাপ্পি, মীম, রিয়াজ অভিনীত ছবিটি অসাধারণ। মীম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাপ্পির জন্য খুব খা’রাপ লাগছে। আমি আড়চোখে ফোনের দৃষ্টি তাকালাম। ক্রমাগত ঝংকার তুলে বেজে চলেছে। নাক টেনে দ্রুত রিসিভ করে নিলাম। আদো আদো স্বরে বললাম, “কে বলছেন?”
ধমকে উঠল, “রিসিভ করলে প্রথমে সালাম দিতে হয় জানিস না? আশ্চর্য!”
কাঁদতে কাঁদতে ভুলেই গিয়েছিলাম। কণ্ঠ বেশ পরিচিত ঠেকল। ফোন নামিয়ে নাম্বারের দিকে তাকাতেই থমকে গেলাম। অপূর্ব ভাই ফোন করেছেন? তিনি আবার বলেন, “কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে আরু?”
“মন ভালো নেই।”
“বারান্দার দরজা খুলে দে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?”
বারান্দায় দরজার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলে দিতেই মৃদু আলো চোখে লাগল। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখা গেল আবছা। আজ কতদিন পর দেখছি তাকে? শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। এগিয়ে গেলাম। ফোন তখনও লাইনে। তিনি লাইন বিচ্ছিন্ন করে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি বুকে হাত দিয়ে তার পিছুপিছু ঘরে এলাম। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, “এতরাতে আপনি এই বাড়িতে কেন অপূর্ব ভাই? সবাই ঘুমিয়ে আছে। আপনাকে দেখলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।”
খাবারের প্যাকেট বিছানায় রেখে শুয়ে পড়লেন টানটান হয়ে। আমি হাঁ করে চেয়ে থাকলাম মুখশ্রীর দিকে। শুয়ে থেকেই বললেন, “কাঁদছিলি কেন? এটা আগে বল।”
হতবুদ্ধি হলাম তৎক্ষণাৎ। আমি তো কাঁদছিলাম। থামলাম কীভাবে? ভ্রু কুঁচকে পুনরায় কান্নায় মনযোগী হলাম। বিছানায় বসে বললাম, “সিনেমা দেখছিলাম অপূর্ব ভাই। নায়িকা মা’রা যায়। নায়ক অনেক কষ্ট পায়। সুইটহার্ট। খুব কষ্ট লাগছে জিসানের জন্য।”
অপূর্ব ভাই হাত টেনে বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “শুনলাম এক্স-রে করেছিস। রিপোর্ট দিয়েছে। কিছু মেডিসিন দিয়েছে। সামনেই না-কি তোর অপারেশন?”
“আমি তো অপারেশন করব না অপূর্ব ভাই। আপনাদের সবাইকে শাস্তি দিবো। মেডিসিন না খেয়ে ফুলের টবে ফেলে দেই। আপনারা ঠিক বুঝবেন?”
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। আমার হাতের ছোটো ছোটো নখগুলো তার হাতের নখ দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বললেন, “সুইটহার্ট সিনেমায় তোর কার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে?”
আমি ফট করে বললাম, “জিসানের জন্য। ভালোবাসার মানুষটার জন্য নে’শাখো’র হল। দেহটা দাফন দিল। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
অপূর্ব ভাই না তাকিয়ে বললেন, “জিসান যদি বিয়ে করে নে তখন কেমন লাগবে তোর?”
মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ছবি শেষ। জিসান বিয়ে করেনি। তাঁরা দুজনে আলাদা ঠিকই কিন্তু ভালোবাসা রয়েছে। কপাল কুঁচকে বললাম, “অপূর্ব ভাই, জিসান বিয়ে করেনি। সে প্রেলিনাকে ভালোবাসে।”
আমার হাত মুঠো করে ধরলেন। তালুতে আঁকিবুঁকি করতে করতে বললেন, “ধরে নে বিয়ে করছে, তখন তোর কেমন লাগবে?”
মুখ ফুলিয়ে বললাম, “একদম ভালো না। ম’রে গেছে অমনি ভালোবাসা শেষ। সে-তো ইচ্ছে করে ম’রেনি।”
এবার চোখে চোখ রেখে বললেন, “ধর জিসান আমি আর প্রেলিনা তুই। তোদের রোগটা প্রায় সেম। তার ব্লাড ক্যান্সার আর তোর পাকস্থলীর টিউমার। সব ক্যান্সার প্রথমে টিউমারের রুপ নেয়। ধীরে ধীরে ক্যান্সার হয়ে উঠে। পাকস্থলীর টিউমারে বাঁচার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে ব্লাড ক্যান্সারে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। এখন তুই যদি নিজে নিজে ইচ্ছে করে ম’রে যাস, আমি কেন বিয়ে না করে একা একা সারাজীবন পার করব? দোষ তুই করেছিস। তাছাড়া জীবনটা সিনেমা নয় আরু।
আমি বিয়ে করবই। কিছুদিন তোর শোক পালন করে বিয়ে করে নিবো। ছোটো একটা পরী আসবে বউ হয়ে। বুকে নিয়ে ঘুমাব তাকে রোজ রাতে। আমার ফেরার অপেক্ষা করে থাকবে সে। প্রতিদিন কাজে বের হওয়ার আগে কপালে চুমু খাবে সে। আমি কাজ থেকে ফিরে তার ঠোঁটের উপর আলতো করে ছুঁয়ে দিবো ঠোঁট। মাঝরাতে হাঁটব। চাঁদের জ্যোৎস্না উপভোগ করব। তার কিছুদিন পর আরও একটা পরী আসবে। আমাদের ছোটো সংসার বড়ো হতে থাকবে।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। অপূর্ব ভাই থেমে গেলেন। আমি না থাকলে এইসব করবেন তিনি। এখনই করে নিক। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “মামুনি কিছুতেই আপনাকে বিয়ে করতে দিবে না, অপূর্ব ভাই।”
অট্টহাসি দিয়ে বললেন, “তোর মামুনি আমাকে এখনই বিয়ে করতে বলছে। আমি ভাবছি তন্বির কথা। মেয়েটা আমাকে কত ভালোবাসে। আমাদের বিয়ে পর তোর মৃত্যুবার্ষিকীতে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে আসব।”
ফট করে বললাম, “মৃত্যুবার্ষিকীতে মানে? বছরে মাত্র একবার?”
“হম। আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই। বছরে একবার যাবো সেটাই অনেক। প্রতিবছর যেতে পারব কি-না জানিনা।”
অপূর্ব ভাইয়ের শার্ট টেনে নিলাম। নাক মুছে বললাম, “এটা হতে পারে না অপূর্ব ভাই। মামুনি কখনো আপনাকে বিয়ে করতে দেবে না। আপনি মিথ্যা বলছেন।”
“ওকে, তাহলে তোর মামুনির কাছেই জেনে নে।” বলেই উঠে গেলেন বিছানা ছেড়ে। নাক কুঁচকে শার্ট খুলে হাতে দিয়ে গেলেন। আমি ক্রমাগত নাক মুছে যাচ্ছি তার শার্টে। অপূর্ব ভাই, আপনি বিয়ে করবেন না প্লীজ। কিছুক্ষণ পর কানে ফোন নিয়ে ঘরে এলেন। এগিয়ে দিয়ে বললেন, “কথা বলে, জেনে নে।”
এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বললাম, “মামুনি, তুমি কি অপূর্ব ভাই-কে বিয়ে করাবে আবার?”
ওপাশ থেকে বলে, “করাবই তো! মেয়ে দেখেছি। অনেক সুন্দর-সুন্দর। অপূর্ব-র ঘরের নাতি দেওয়া অনেক শখ। কতদিন বাঁচব আর। তুই বল? তুই একটু অপূর্ব-কে বুঝিয়ে বল, যাতে ছেলেটা রাজি হয়ে যায়।”
খট করে ফোন রেখে দিলাম। চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে বললাম, “আপনি বিয়ে করবেন না অপূর্ব ভাই। একদম করবেন না। আমি বেঁচে থাকতে আপনাকে বিয়ে করতে দিবো না।”
“তুই ম’রে গেলে বিয়ে করব চিন্তা করিস না।”
“বলেছি না আমি বেঁচে থাকব। কালকেই ডাক্তারের কাছে যাবো ফুপিকে নিয়ে।”
আমি হন্তদন্ত হয়ে ওষুধ খুঁজতে ব্যস্ত হলাম। খোসা ছিঁড়েও খেতে পারলাম না। অপূর্ব ভাই প্যাকেট খুলে এগিয়ে দিলেন নুডুলস।
__
রাতে অপূর্ব ভাই বাড়িতে ফিরলেন না। আমার ঘরে থেকে গেলেই। খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে তার শরীরের উপর উঠে ভর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে থাকলাম। নট নরন-চরন। সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে দৃঢ় করে ধরে রইলাম। মাথা রাখলাম তার বুকে। তার হাতজোড়া পিঠে রেখে বললাম, “এবার অন্তত আলতো করে চুমু খান।”
গাল চেপে গভীর ভাবে চুমু খেলেন ঠোঁটে। গাল ঘষতে ঘষতে বললাম, “গাল দু’টো চ্যাপ্টা করে দিলেন তো অপূর্ব ভাই। আপনি একদম। হ্যাঁ একদম বিরক্তিকর মানুষ।”
পিঠে স্পর্শ পেলাম। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। মধ্যমা আর তর্জনী আঙুল দূরত্ব রেখে হেঁটে চলেছে। খিলখিল করে হেসে উঠলাম পরক্ষণে। হাত সরিয়ে উঠে বসলাম। তার কাতুকুতু থামতে না। হাসতে হাসতে আমার অবস্থা শৌচনীয়। মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলাম। কাছে টেনে নিলেন। তার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। একটাও কথা নয়। ঘুমিয়ে গেলাম একসময়ে। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে। সবকিছু ঠিক থাকলেও অপূর্ব ভাই ছিলনা। তিনি চলে গেছেন। মন খা’রা’পের ভর করে এলো। না বলে চলে গেলেন কেন তিনি? বিছানায় ছেড়ে উঠতে দৃষ্টি গেল বালিশের তলায়। একটা ছোটো চিরকুট। কি কিউট। লেখাগুলো পড়ে মন ছোটো হয়ে গেল। অপূর্ব ভাই লিখছেন, “আরুপাখি, খাওয়াদাওয়া আর ওষুধে অনিয়ম করোনা, কেমন! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ছোটো ঘরে চলে এলো। তোমার-আমার সব ঠিক আছে। মা-তো জানে না? কখন নতুন বউ ঘরে তোলা তাও বলা যায়নি।
শার্ট ধুয়ে রেখো।”
মেঝেতে শার্ট পড়ে আছে। শার্টের উপর রাগ ঝেড়ে নিলাম কিছুক্ষণ। ফলস্রুতিস্বরুপ, ছিঁড়ে গেছে। ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিলাম। কাল রাতে অভিমান করে ঘুমিয়ে ছিলাম তাই বলছে অপূর্ব ভাই এমন বলেছেন। আমার বোঝার বাকি নেই। আমি থাকব না এখানে, অপূর্ব ভাইয়ের ঘরের গিয়ে দখল করব। হুম। কীভাবে বিয়ে হয় দেখব।
চলবে।