#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃআহানিতা
বিকেলের দিকে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার একধারে এমনিই হাঁটছিলাম আমি।বেশ কিছুদূর পা চালিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই অর্কভাইকে দেখেই চোখ আটকে গেল আমার।পরনে চেইকের শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স।হাতা গুলো কনুই পর্যন্তই গুঁটানো আছে।বাম হাতে লাগানো ঘড়িটার দিকে একনজর তাকিয়েই উনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকালেন।আমি এপাশ থেকে তার দিকে চেয়ে তাকে ভালোভাবে দেখছিলাম।উনার কুঞ্চিত ভ্রু, চোখজোড়ার এদিক ওদিক ঘোরানো ,কুঁচকানো কপাল সবটাই পর্যবেক্ষন করছিলাম।এক পর্যায়ে উনি পকেট থেকে মোবাইল বের করেই কাউকে কল লাগালেন।বোধ হয় অপর পাশের মানুষটি কল ধরে নি।উনি তীব্র বিরক্ত নিয়ে এপাশ ওপাশ ফিরে আবারও কল দিলেন।হয়তো এবারও কেউ কল ধরল নাহ।পরমুহুর্তেই মোবাইলটা বিরক্ত নিয়ে পকেটে পুরে নিলেন উনি।তার পরপর দুই তিনটে রিক্সাকে ডাকলেন উনি।যখন রিক্সাগুলো যেতে রাজি হলো নাহ তখনই তীব্র রাগে সামনের ফুটপাতে ডান পা দিয়ে লাথি দিলেন উনি।আমি সূক্ষ চাহনি নিক্ষেপ করে উনাকে পর্যবেক্ষন করে চলেছিলাম।হঠাৎ ঐ পেঁছন থেকে একটা রিক্সার সামনের লোহার সাথে লেগে বসল ডান হাতটা।আমি কপাল কুঁচকে হাত চেপে ধরে সামনের দিকে তাকাতে তাকাতেই রিক্সাটা এগিয়ে চলে গেল। ব্যাথায় দাঁত মুখ খিচে চোখ বন্ধ করেই অস্ফুট আওয়াজে উহ বলে উঠলাম।তার কয়েক সেকেন্ড পর চোখ মেলেই দেখলাম জামার হাতাটা ছিড়ে গিয়ে হাতের বেশ খানিকটা কেঁটে বসেছে।ব্যাথায় চোখ টলমলিয়ে উঠল পরমুহুর্তেই।কেটে যাওয়া স্থান থেকে রক্ত বের হয়ে রক্ত লেগে পরনের গোলাপি রংয়ের জামার হাতাটা লাল হয়ে উঠল বোধ হয়।আমি বাম হাত দিয়ে হাতটা চেপে ধরে কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই অর্কভাইকে আমার দিকেই তাকাতেই দেখলাম।ব্যাথায় শিরশির করা হাতটা সেভাবে চেপে রেখেই মিনমিনে চোখে উনার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেললাম আমি।উল্টোদিকে ঘুরে দ্রুত উনার থেকে দূরে সরে আসার জন্যই পা বাড়ালাম।কিন্তু আমার ইচ্ছাটা পূরণ হলো নাহ।অর্কভাই পা জোড়া দিয়ে জোরে জোরে পা ফেলেই সামনে এসে দাঁড়ালেন আমার।আমার দিকে চোখজোড়া দিয়ে এক নজর তাকিয়েই চোখ রাখলেন আমার ডান হাতে।আমি তখনও বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কাঁটা জায়গাটা চেপে রেখে কপাল কুঁচকে রইলাম।উনি বিরক্ত নিয়েই বলে উঠলেন,
‘ নিজে নিজে চলতে ফিরতেও পারিস নাহ নাকি?এখনও কি তোর আব্বু হাত ধরিয়ে রাস্তায় হাঁটা চলা করে তোকে নিয়ে? ‘
এমনিতেই ব্যাথায় চিনচিন করছিল হাতটা।তার উপর উনার কথাটা শুনেই বিরক্তে দাঁত মুখ খিচে নিলাম।সরু চোখে একবার তাকিয়েই বললাম,
‘ সরুন, বাসায় যাব আমি।’
উনি আমার থেকেও দ্বিগুণ বিরক্ত নিয়েই বলে উঠলেন,
‘ এসেছিলি কেন? আমি বলেছিলাম আসতে?আর আসলিই যখন আমার চোখের সামনে এসেই হাজির হলি কেন?যখন নিজে নিজে চলাফেরা করতেই পারিস নাহ।’
আমি উনার কথার উত্তরে কোন কথা না বলেই চুপ করে রইলাম।ব্যাথায় টলমলে চোখ নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়েই উনাকে পাশ কাঁটিয়ে চলে আসতে নিলেই উনি পথ আগলে দাঁড়ালেন আমার।হাতজোড়া বুকে গুঁজে নিয়ে শান্তি চাহনি ফেলেই বললেন,
‘ কি সমস্যা তোর?’
‘ মানে?’
হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুড়তেই উনি কপাল কুঁচকে নিলেন।হাতের ঘড়িটার দিকে উনার সুন্দর চোখজোড়ার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই মৃদু কন্ঠে বললেন,
‘ ওহ শিট!লেইট!’
আমি উনার দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ালাম।তারপরই শান্ত গলায় বললাম,
‘ অর্কভাই, আপনার হয়তো মিটিংয়ে পৌঁছোতে লেট হচ্ছে। আমার পথ আগলে না থেকে শীঘ্রই অফিস পৌঁছালেই ভালো হবে। গাড়ি নেই আজ?রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলেন দেখছিলাম।’
উনি পুরো কথাটা বিরক্ত নিয়ে শুনলেও শেষের কথাটায় বোধ হয় খুশি হলেন।ভ্রু নচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আমি রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি দেখছিলি?বল তো কতক্ষন অপেক্ষা করেছি?’
আমি উনার প্রশ্নের উদ্দেশ্য বা কারণ কিছু না বুঝেই বলে উঠলাম,
‘ আমি প্রায় দশ পনেরো মিনিট এখানে ছিলাম।ততক্ষনই দেখেছি।কেন?’
উনি এবার বাঁকা হাসলেন।পাশ থেকে একটা রিক্সা ডেকে নিয়েই উঠতে ইশারা করলেন।আমি ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাতেই উনি ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলে উঠলেন,
‘ আমার প্রেমে পড়ে এতো আনমনা মিস মেহুলতা?’
আমি অবাক চোখে তাকালাম। উনার কথায় অদ্ভুত ভয় চেপে বসল মনে।নিজের সত্যিটা প্রকাশের ভয় হয়তো।উনি বাঁকা হেসেই বলে উঠলেন,
‘ আমাকে দেখতে গিয়েই যখন এই দশা তখন এর নিরাময় ও তো আমাকেই করতে হয় তাহলে তাই না?দশ পনেরো মিনিট আমাকে দেখার জন্যই এইখানে দাঁড়িয়ে থেকে আহত অবস্থায় বাসায় ফিরে আমায় দোষারোপ করে বসিস যদি?’
আমি ছোটছোট চোখে চেয়ে থেকেই লম্বা শ্বাস ফেললাম।রিক্সায় উঠেই নিজের দিকে চেপে বসলাম।সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলেন উনিও।মাঝখানে কিছুটা জায়গা খালি রেখেই সরে বসলেন উনিও। আমার দিকে তাকিয়েই বললেন,
‘ সমস্যা নেই।সরে বসেছি আমি।তুই আরো এদিকে চেপে বসতে পারিস।নয়তো পরে দেখা গেল ধপাস করে রিক্সা থেকে পড়ে আরো বড় আঘাত ফেলি।’
‘ নাহ, পড়ব নাহ।অভ্যাস আছে আমার।’
উনি ভ্রু নাচিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
‘ অভ্যাস আছে মানে? ‘
আমি স্পষ্ট ভাবে বললাম,
‘ রিক্সায় চড়ার অভ্যাস ছোটকাল থেকে।কোনদিন পড়িনি যেহেতু এখনও পড়ব নাহ।’
উনি হাসলেন।তারপর বললেন,
‘ ওহ। তাই বল। আমি ভাবলাম এভাবে রিক্সার কিনারায় গিয়ে বসার অভ্যাস আছে বললি কিনা?অন্য কোন ছেলের সাথে রিক্সায় চড়তে গিয়ে এভাবে কিনারায় গিয়ে বসেছিস কিনা তাও তো ভাবনার বিষয়! এখন নিশ্চিন্ত।’
আমি বাঁকা চোখে তাকালাম।উনার প্রতিটা কথায় এই মুহুর্তে কেন জানি বিরক্ত লাগছে।চিনচিনে ব্যাথায় হাত টনটন করে উঠতেই বিরক্তটা আরো বাড়ল।উনার কথার প্রতিউত্তরে আর একটা কথাও না বলে বেশ চুপ রইলাম বাকিটা পথ।হসপিটালের সামনে এসেই রিক্সাটা থামল।তারপর রিক্সা থেকে নেমেই হসপিটালে গিয়ে হাতটা ব্যান্ডেজ করেই অর্কভাই আবারও রিক্সায় উঠিয়ে দিলেন।রিক্সায় উঠার আগ মুহুর্তেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ আমি জানি তুই আমায় ভালোবাসিস।সেই প্রথম থেকেই তোর অনুভূতি আমার চোখে ধরা দিয়ে দিয়েছিল।লুকোচুরি খেলা কি এতো সহজ?তবে কেন প্রকাশ করছিস নাহ?একবার কেন বলছিস নাহ ভালোবাসিস?একবারই তো!একবারই।একবারই শুনতে চাইছি কেবল।বলবি না?অপেক্ষা যে আর সম্ভব নয়, সম্ভব হয়ে উঠছে না আমার পক্ষে এতটা অপেক্ষা করার।তিন তিনটে বছর!কম কি সময়?এতগুলো দিন অপেক্ষা করিয়ে একটা যুবককে তিলে তিলে মেরে ফেলছিস নাহ কি তুই?’
আমি তখন উনার দিকে একবারও চেয়ে দেখিনি। বোধ হয় উনার দিকে তাকানোর সাহসই হলো নাহ আমার। ধড়পড় করে রিক্সায় উঠে বসেছিলাম।আর সেই কথাগুলো বারংবার বাঁজতে লাগল আমার কানে।বারংবার!
.
মাঝখানের দশ কি বারোদিন আমার সাথে অর্কভাইয়ের আর দেখা হলে নাহ।বোধ হয় উনিই আমার সামনে আসলেন নাহ।কে জানে।আহি আর রায়হানের জন্য এর মাঝেও দুই তিনবার যাওয়া হয়েছে উনাদের বাসায়।কিন্তু অর্কভাইকে কোথাও দেখিনি আমি।ওসব ভেবেই ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি।আকাশ ভাঙ্গা বজ্রপাত আর বৃষ্টির শীতলতায় মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছি আমি।জানালার দিকে তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম বৃষ্টির ফোটা ফোটা পানিগুলো।এরই মাঝে রাস্তার একধারে এসে থামল একটা গাড়ি।গাড়ি থেকে তৎক্ষনাৎ নেমে পড়ল ব্লেইজার পরিহিত ফর্মাল ড্রেসাপে একটা মানুষ।আমি তার দিকে তাকিয়েই স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম।পরনের ব্লেইজারটা অর্ধেক ভিজে যেতেই সেটা খুলে গাড়ির ভেতরে রাখলেন উনি। সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম বৃষ্টির পানিতে উনার ইন করা সাদা শার্টটা আর প্যন্টটা ভিজে গেল।মাথার চুলগুলোও ভিজে কপালে লেপ্টে বসল মুহুর্তেই।ভেজা চুল বেয়ে টপাটপ পানি গড়িয়ে পড়ল কপাল বেয়ে মুখে।আমি উনার ঘন পাপড়িতে ডাকা চোখজোড়ার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল দৃষ্টি।উনার চাহনিটা অদ্ভুত লাগল আমার।কেমন নির্লিপ্ত শান্ত চাহনি।আমি উনার চাহনি দেখেই আর চোখ রাখতে পারলাম না তার চোখে।নিঃশ্বাস যেন ঘন হয়ে আসল তার সেই চাহনিতেই।টগবগ করা রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠতেই লজ্জ্বারাঙ্গা মুখ নিয়ে জানালার পর্দা টেনে বসলাম আমি।পর্দার এককোণে উঁকি দিয়ে উনাকে দেখেই ছোট্ট শ্বাস ফেলে জানালা থেকে সরে আসলাম পরমুহুর্তেই।তার কয়েক সেকেন্ড পরই মোবইলে ম্যাসেজ টোন বাঁজল।আমি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে ম্যাসেজটা পড়তে ব্যস্ত হলাম,
” বারবার সেই লজ্জ্বারাঙ্গা মুখ আমার সামনে হাজির করে হৃদয়ের ভেতরটা এভাবে মুঁছড়ে না দিলেই কি নয়?দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ক্ষনিকের এই দেখা দেওয়া কি অমানবিক কার্যকলাপ নয় তোর?”
আমি চুপচাপ ম্যাসেজটা পড়েই জানালার পর্দাটা আরেকটু সরিয়ে উঁকি দিয়ে তাকালাম উনার দিকে।উনি বাঁকা হাসলেন।কপালে পড়ে বসা ভেজা চুলগুলো এক হাত দিয়ে সরিয়ে পেছনে ঠেলেই বাঁকা হাসলেন উনি।তারপরই ডান চোখটা টিপে আবারও বাঁকা হাসলেন।আমি বোকা বোকা চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম কেবল।এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে অদ্ভুত কার্যকলাপ করার মানেই বা কি?আমাকে ভালোবাসেন বলে?আমাকে চোখের দৃষ্টি ফেলে দেখার জন্য? বৃষ্টির পানিতে এভাবে ভিজে কি অসুস্থ হবেন নাহ উনি?এটুকু জ্ঞান ও নেই উনার?ভালোবাসায় কি বাচ্চামোর লক্ষন প্রকাশ পায়?
#চলবে…