টুকরো স্মৃতির অতলে পর্ব-১৪

0
670

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃআহানিতা

হালকা গুড়গুড়ে বৃষ্টি।আকাশ কিছু সময় পরপরই নিজের থমকানো রুপ দেখাচ্ছে।ভার্সিটিতে আসার সময় বৃষ্টি থেমে যাবে এমনটা ভেবেই বেরিয়েছিলাম।কে জানত ফেরার পথে বৃষ্টি হবে।তবে বৃষ্টি হলেও ভালোই।বৃষ্টিতে ভেজা যাবে।তারপর না হয় জ্বর বাঁধলে বাঁধুক।আমার কি?আমি ফিক করে হেসেই আকাশের দিকে তাকালাম।মেঘাকে তাড়াহুড়ো করে একটা রিক্সা ডেকে উঠিয়ে দিলাম।এই সময় বৃষ্টিতে ভেজা ওর জন্য রিস্কি হয়ে যাবে। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি গুলো হাত মেলে ধরার চেষ্টা চালালাম।মুখে হাসি ঝুলিয়ে এলেমেলো পায়ে রাস্তার জমানো পানি গুলোতে পা ফেললাম।সঙ্গে সঙ্গে কাঁদাযুক্ত পানিগুলোয় ভিজে বসল আমার পায়জামা।তাতে অবশ্য আমি বিরক্ত হলাম নাহ।বরং পা জোড়া লাফিয়ে ফেললাম রাস্তার পাশের পানিগুলোতে আরো কয়েকবার।তারপরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আরম্ভ হলো।আমার সমস্ত শরীর মুহুর্তেই ভিজে চুপসে উঠল।কয়েক মিনিট সেই বৃষ্টিতে বেশ ভালোমতো আনন্দে মেতে থাকলেও এবার বোধ উদয় হলো আমার।ভেজা জামা যে শরীরের সাথে চুপসে মিশে আছে তা আর বুঝতে বাকি রইল নাহ।এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত পা ফেলে হাঁটা লাগালাম আমি।কয়েক পা ফেলে এগিয়ে যেতেই কেউ একজন পেঁছন থেকে হেচকা টানে আমার বাম হাতটা টেনে ধরল।আমি অবাক হয়ে পেঁছন ফিরে চাইলাম।অর্কভাই ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে।কপাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কপালে।মুখে খোঁচা দাড়িতেও পানির ছিটেফুটে।মাথা থেকে বয়ে আসা পানিগুলো কপাল বেয়ে নাকের উপর দিয়ে ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে।আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।উনার লালচোখ জোড়ায় ভয়ে আৎকে না উঠে নেশাতুর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি।উনি পরনে থাকা ব্লেইজারটা খুলে নিয়েই এগিয়ে দিলেন আমায়।গম্ভীর কন্ঠেই বলে উঠলেন,

‘ পরে নে।’

আমি বুঝতে পারলাম উনি কেন এগিয়ে দিলেন ওটা।মুখ কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে ব্লেইজারটা হাতে নিয়ে দ্রুত পরলাম।তারপরই উনি গটগট করে বলে উঠলেন,

‘ বৃষ্টিতে ভেজার খুব বেশি শখ তোর না?যার জন্য মাথায় কিছুই থাকে না।’

আমি উনার দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নিচু করে নিলাম।কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।উনাকে বলার মতো তেমন কোন কথা খুঁজে না পেয়েই উল্টো পথে হাঁটতে লাগলাম।উনি দ্রুত আমার সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালেন।আমি মাথা উঁচু করে তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,

‘ এভাবে ছুটছিস কেন তুই?’

‘ ছুটলাম কোথায়? হাঁটছি।’

উনি সেভাবে দাঁড়িয়েই বললেন,

‘ হাঁটবি ও কেন?আমার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকবি।আমি বলব তুই শুনবি।’

আমি ভ্রু কুঁচকে নিয়েই বললাম,

‘ কি শুনব অর্কভাই?’

উনি ভ্রু নাচিয়েই বলে উঠলেন,

‘ কিছুই কি শোনার নেই তোর আমার থেকে?’

আমি অদ্ভুতভাবে চাইলাম উনার দিকে।ভেজা চুল গুলো কপালে ঝুকে কপালের চামড়ায় লেপ্টে আছে।আমি একনজর তাকিয়েই হাত বাড়ালাম উনার কপালে।উনার ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়েই হালকা হাসলাম।তারপর পরই আবার হাত সরিয়ে জিহ্বা কাঁমড়ালাম।নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে উনার দিকে তাকিয়েই বললাম,

‘ স্যরি। আপনার চুলে ময়লা ছিল অর্কভাই।তাই। ‘

উনি বাঁকা হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে।হাত বাড়িয়ে আমার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিলেন।হালকা হেসেই কানের কাছে নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ ভেজা চুলে, ভিজে যাওয়া কেঁপে উঠা ঠোঁটজোড়া, ভেজা পাপড়িতে তোর চোখ।বুকের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়ে চলেছেই অনবরত।কিছু তো ভিন্নতা ঘটছেই আমার মাঝে।কিছুতো ঘটছেই।আই কান্ট কন্ট্রো……’

উনি বাকিটা বলার আগেই আমি বলে উঠলাম দ্রুত,

‘ স্ স্ সরুন। সরে কথা বলুন।’

অর্কভাই হাসলেন।আমি তার হাসির দিকে তাকিয়েই অন্যদিকে ফিরলাম।বুক ডিপডিপ করছে। অদ্ভুত ভাবে শিতরিত হচ্ছে শরীরের লোমকূপ।চোখ নামিয়ে নিচু হয়ে রইলাম।উনার চোখে তাকানোর সাহস পেলাম নাহ ঠিক।অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে আমার হাত। কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলেই আবার ও বললাম,

‘ আ্ আপ্ আপনি এভাবে কাছে আসতে পারেন না। ‘

অর্কভাই হেসেই আবারও আমার দিকে ঝুকলেন।আমার কথা না মেনেই কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

‘ কিছু কথা শুনবি?তোকে অনেক কথা বলার আছে?শুনবি?’

আমি অবাক চাহনিতে উনার দিকে তাকালাম।তারপরই বললাম,

‘ বলুন। ‘

উনি ফিসফিসে কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ তোকে ভালোবাসি।’

আমি চোখজোড়া বড়বড় করেই উনার দিকে তাকালাম কথাটা শুনেই।উনি কথাটা বলেই সরে দাঁড়ালেন আমার থেকে।মুচকি হেসেই বলে উঠলেন আমার দিকে তাকিয়ে,

‘ সেইবার বিয়েটা আমি সত্যিই করতে চাই নি।তোর প্রতি কোন ফিলিংসই জম্মে নি তখন।ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তোর সাথে হয়তো কিন্তু এতগুলো দিন পর হঠাৎ ঐ যখন তোর সাথে বিয়ের বিষয়টা জানতে পারলাম আমি মানতে পারিনি।এক্চুয়েলি মানতে চাই নি আমি। তোকে কখনো সেই নজরে দেখিই নি আমি।তার মধ্যে বিয়ে? ভাবা যায়?তখন বিষয়টক ভাবতেই হাস্যকর লাগত আমার কাছে। বিয়ের বিষয়টা জেনেছি পর্যন্ত কেবল কিভাবে বিয়েটা ভাঙ্গা যায় সেইটাই ভেবেছি আমি।সেই হিসেবেই ইশাকে তোর সামনে বারবার আমার প্রেমিকা রূপে সাঁজিয়েছি আমি।যাতে করে তুই এই বিষয়টা বাসায় জানাস আর বিয়েটা ভেঙ্গে যাক।কিন্তু তুই শেষ পর্যন্ত আমার আশাটা পূরণ করলি নাহ মেহুল।তুই কিছুই বললি নাহ পরিবারে ইশার সম্পর্কে।তারপর অবশেষে কোন পথ খুঁজে না পেয়েই বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য বিয়ের দিন সকালের ফ্লাইটে আমি পালিয়েছিলামই বলতে পারিস।সেইদিন হয়তো তোর কথাটা একবার আমার ভাবার ছিল মেহুল।কিন্তু আমি তোর কথা সেইদিন একবারও ভাবিনি। এটা আমার অন্যায় ছিল।আর আমি সেটা বুঝতেও পেরেছি। প্লিজ সেইদিনের জন্য ক্ষমা করবি আমায়?’

আমি আড়চোখে তাকালাম।শুকনো ঢোক গিলে ছোট ছোট চোখে তাকাতেই উনি আবারও বললেন,

‘তারপর যখন দেশে ফিরি আমি?তখনই জানতে পেরেছিলাম রিহানরা তোর সাথে খারাপ কিছু করেছে।আমি ঘটনাটা ক্লিয়ারলি জানতে পারিনি।তবে যেটুকু বুঝতে পেরেছিলাম সেটা হলো তোর সাথে খারাপ কিছু হয়েছে কিংবা হতে হতেও হয়নি।তবে সেটা যে রেপের মতো কোন বিষয় হতে পারে আমার মাথাতে একবারের জন্যও আসে নি মেহুল।একবারও নাহ।তোকে বিয়েতে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুশোচনা আর আমার সাথে শত্রুতা বজায় রাখতেই রিহান তোর সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছে এ দুটো ঘটনা থেকেই তোর প্রতি জম্মেছিল টুকরো টুকরো অনুভূতি।তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য তোকে বারবার লুকিয়ে দূর থেকে দেখেই পরে বলার সাহস না পেয়ে আবার ফিরে এসেছি।ঐ যে দূর থেকে দেখতাম?তোর বাচ্চামো গুলো, খুনসুটি গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতাম।প্রথম প্রথম মনে হতো, মেয়েটক পাগল নাকি?পরে সেইগুলো দেখার জন্যই বারবার ছুটে গিয়েছি তোর কাছে।লুকিয়ে একনজর দেখেই আবারও ফিরেছি বাসায়।এভাবেই চলেছে সব।

তারপর হঠাৎ ঐ জানতে পারলাম রিহান দেশে ফিরবে। আমার মাঝে নিজের অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়াটা একটু সহজ হয়ে
উঠেছিল হয়তো।কিন্তু ঐ যে ক্ষমা চাইতে পারিনি আমি।সেইবার ও তোর সামনে বেশ কঠিন রূপ নিয়েই উপস্থিত হলাম। কিন্তু সেইবার তোর চোখে মুখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখেই নিজের প্রতি রাগ আর ক্ষোভ জম্মেছিল।যখনই তোর মুখে ধর্ষিতা কথাটা শুনেছিলাম আমার কান গরম হয়ে গিয়েছিল।রিহানকে খুন করার ইচ্ছা জেগেছিল। কিন্তু রিহান তখনও দেশে ফেরেনি।তার থেকে বছর এক পরই ও দেশে ফিরল।’

আমি শান্ত কন্ঠেই বললাম,

‘ আর রিহান ভাই দেশে ফেরার পরই উনাকে হাতে পায়ে কেলিয়েছেন?অদ্ভুত!’

অর্কভাই মৃদু হাসলেন।আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বললেন,

‘ জানিস তোকে সেইবার স্বার্থের জন্য বিয়ে করব কেন বলেছিলাম?আসলেই আমি তোকে স্বার্থের জন্যই বিয়ে করতে চেয়েছি।আর এখনও আমি তোকে নিজের স্বার্থের জন্যই বিয়ে করতে চাই মেহুল।’

আমি অবাক হয়ে তাকাতেই উনি হু হা করে হেসে উঠলেন।তারপরই বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললেন,

‘ তোকে ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত।তোর প্রেমে নতুন করে বারংবার পরছি।হুটহাটই অদ্ভুত ইচ্ছা জাগছে।হুট করে ঘুম ভাঙ্গলেই তোর মুখ ভেসে আসছে চোখে।ঐ ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে কখনো, কখনো বা তোকে জড়িয়ে ধরার, কখনো বা কপালে উষ্ণ আবেশের পরশ ছুঁয়ে দেওয়ার।এখানে তোকে বিয়ে করায় আমার কি কোনই স্বার্থ নেই বল?স্বার্থটা তো আমারই।তোকে পাওয়ার স্বার্থ।নিজের বেঁচে থাকার জন্য তোকে আপন করে পাওয়ার স্বার্থ ।’

আমি কাঁপা চাহনিতে তাকালাম।কিসব অদ্ভুত ইচ্ছে! আমি লজ্জ্বায় অন্যদিকে তাকিয়েই হালকা কাঁশলাম।মৃদু কন্ঠেই বললাম,

‘ বাসায় যাব।’

উনি হেসেই আমার পথ আগলিয়ে দাঁড়ালেন।আবারও বলে উঠলেন,

‘ তুই ভার্সিটি লাইফ থেকেই আমায় ভালোবাসতি। জানতাম।তখন চেয়েছিলাম তুই আমায় ভালো না বাসিস, তাই বারবার ইশাকে তোর সামনে প্রেমিকা রূপে তোর সামনে সাঁজিয়েছি। অনেকদিন হয়তো এর জন্য কাঁদিয়েছিও আমি তোকে।টলমলে চোখে বহুবার তোকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি ইশা আর আমার দিকে।তখনও তো বুঝেই উঠতে পারিনি এই মেয়েটাকে ছাড়াই একটা দিন আমি এমন দিশেহারা হয়ে যাব।এই মেয়েটাকে আমি নামক মানুষটা ভালোবেসে বসবে বুঝতেই পারিনি।সেসব দিনগুলোর জন্য ক্ষমা করে দিবি?কথা দিচ্ছি, আর কখনো তোকে কষ্ট পেতে দেব নাহ।কখনোই নাহ।সবসময় তোকে আগলে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।নিজের সবটুকু দিয়ে তোকে সবটুকু সুখের ঠিকানা এনে দেব। ভালোবাসায় রাঙ্গিয়ে দেব তোকে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোর পাশে থাকব।কথা দিচ্ছি।সুযোগ দিবি আমায় তোকে ভালোবাসার?আপন করার?দিবি সুযোগ? একটিবার?’

আমি ড্যাবড্যাব চোখে তাকালাম।কি বলা উচিত, বা কি বলব কিছুই মাথায় আসছে নাহ। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সেভাবেই তাকিয়ে থাকলাম আমি।উনি মাথার চুল পেছনে ঠেলে বলল,

‘আপন হবি না?প্লিজ!প্লিজ হ্যা বলে দে।প্লিজ।একবার।তোকে নিয়ে ভালোবাসার সংসার বুনার বিশাল স্বপ্ন আমার। ‘

আমি সরু চাহনিতে তাকিয়েই জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেললাম।তারপরই উশখুশ করে বললাম,

‘ আসছি। বৃষ্টিতে বেশি ভিজলে আম্মু বকবে।’

কথাটা বলেই উল্টোদিকে পা বাড়াতেই অর্কভাই বাম হাত টেনে ধরলেন।আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই ভ্রু নাচিয়েই বললেন,

‘আমার উত্তর?’

আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসল দ্রুত।বুকের ভেতর হৃৎপিন্ড দ্রুত বেগে লাফাতেই কোনরকমে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম।মৃদু কন্ঠেই বললাম,

‘ সু সু সুযোগ পাবেন অর্কভাই।এবার হাত ছাড়ুন।’

উনি হাসলেন।হাত ছাড়া মাত্রই আমি দ্রুত পায়ে পা বাড়ালাম।লজ্জ্বায় মাথা নিচু হয়ে আসছে বারংবার!

#চলবে……..