তরঙ্গিনী পর্ব-৩৫

0
448

#তরঙ্গিনী পর্ব-৩৫

#আরশিয়া_জান্নাত

তেলের বাটি নিয়ে আরাফ বসলো রেবার পেছনে। আঙুলের ডগায় তেল নিয়ে রেবার স্ক্যাল্পে ম্যাসাজ করতে লাগলো। রেবা চোখ বন্ধ করে বলল, কি যে আরাম লাগছে! মনে হচ্ছে মায়ের কাছে আছি,

তাই বুঝি?

জ্বি জনাব। আচ্ছা বলুন তো এতো যত্ন করতে শিখলেন কোথায়?

আগে অনেক বৌ ছিল তো, সবার থেকে একটু একটু করে শিখেছি। অভিজ্ঞতার ফল সব,

তাই নাকি? তা উনারা সব কোথায় এখন?

একেকজন একেক দেশে,

ওহ এই ব্যাপার?

আরাফ রেবাকে কাছে টেনে বলল, যত্ন করা শিখতে হয় না, যখন আপনি কাউকে অনেক ভালোবাসেন, তখন তার প্রতি আপনার কনসার্ন থাকবে। সবসময় চিন্তা থাকবে- কি করলে সে ভালো থাকবে, মন খারাপ করবেনা। এভাবেই যত্ন এসেই যায়। অভিজ্ঞতা লাগেনা।

আপনি আমায় এতো ভালোবাসেন কেন বলুন তো?

আমার হাত নেই এখানে, প্রথমে চোখে আটকেছেন, তারপর মনে গেঁথে রাজ্যের রাণী হয়েছেন। জানেন একসময় আমি ভাবতাম আমার রাগের জন্য কোনো মেয়ে আমায় ভালোবাসতে পারবেনা। কিন্তু আপনি আসার পর থেকে আমার সব বদলে গেছে,,,,

রেবা আরাফের হাতের আঙুলে আঙুল নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, রাগী হলেও আপনার জন্য অনেকেই পাগল ছিল। আমিতো একটাকে দেখেই হতবাক। বাকিগুলোকে দেখলে কি হবে কে জানে?

আরাফ রেবার হাত মুঠোয় পুরে বলল, কিছুই হবেনা ম্যাম, আপনাকে বুঝতে হবে আমার মনে আপনার অবস্থান কতখানি জায়গা জুড়ে। অন্য কে কি করছে ঐসব ভাবার কিছু নেই।

আচ্ছা,

আরাফ উঠে ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে চাকু দিয়ে কেটে রেবার সামনে রেখে বলল, আপনি এগুলো শেষ করুন। আমি একটা মেইল পাঠিয়ে আসছি।

ইরফাজের জ্ঞান ফেরে ৪৮ ঘন্টা পর। ওর জ্ঞান ফিরতেই সামনে তাকিয়ে দেখে ওর কলিগ মোরশেদ সোফায় বসে পেপার পড়ছে। ইরফাজকে হুশে ফিরতে দেখে সে উঠে এসে বলল, যাক বাবা তোর জ্ঞান ফিরলো অবশেষে!

কয়দিন বেহুশ ছিলাম?

বেশি না ২দিন!

ওহ। বাড়িতে খবর দিস নি তো?

নাহ। তোর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাধ্য কার আছে?

থ্যাঙ্কস দোস্ত।

এখন কেমন লাগছে?

Much better..

মোরশেদ বেলে ক্লিক করে ওর পাশের চেয়ারে বসে বলল, ভালো হলেই ভালো। তুই তো হাসপাতালকে শ্বশুড়বাড়ি বানিয়ে ফেলছিস। দুইদিন পর পর এখানে চলে আসিস! স্যার বলেছে তোর জ্ঞান ফিরলে উনাকে খবর দিতে। এবার তোকে আচ্ছামতো ঝাড়বে!

আচ্ছা আমাকে যে মেয়েটা হেল্প করেছিল,

মিস রুহি চৌধুরী। ধানমন্ডিতে থাকে।

উনাকে একটা থ্যাঙ্কস দেওয়া উচিত।

এই পর্যন্ত নার্সকে কয়বার কল করেছে জানিস? এতক্ষণে খবর চলে গেছে হয়তো। দেখবি বান্দা নিজেই হাজির হবে!

ইরফাজ দম ছেড়ে বলল, মেয়েটা সেদিন আমার হেল্প না করলে আমি বোধহয় মরেই যেতাম।

মোটেও না। ও হেল্প না করলেও তুই বাঁচতি। রাখে আল্লাহ মারে কে? ও জাস্ট একটা উছিলা,,

তুই না কেমন যেন অকৃতজ্ঞ টাইপ!

আমি সত্যিটা বলছি।

সত্যি বলছিস মানছি, তাই বলে যে সাহায্য করে তার সাহায্যকে স্বীকার করবোনা?

ইয়াং মেয়েদের সাহায্য মনে রাখা ঠিক না। এদের একেকটা স্টেপ আমাদের ছেলেদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

তোর এই নারীবিদ্বেষ চিন্তাভাবনা কবে যাবে বলতো?

যাওয়ার মতো মিরাক্যাল ঘটলে। এন্ড আই নো সেটা কখনোই ঘটবেনা।

ইরফাজ চোখ বন্ধ করে বলল, একজনকে দিয়ে পুরো জাতিকে জাজ করা ঠিক না।

দরজায় নক করে ডক্টর আর নার্স প্রবেশ করলো। ইরফাজের চেকাপ করে বলল, চিন্তার কোনো কারণ নেই অফিসার। কিছুদিন রেস্ট করলেই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। বাট বি কেয়ারফুল, আপনার কন্ডিশন যথেষ্ট খারাপ ছিল।

থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর

ডক্টর নার্সকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে চলে গেল।

সিস্টার, মিস রুহিকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?

জ্বি। উনি বলেছেন উনি বিকালে আসবেন। আপনি এখন রেস্ট করুন।

মোরশেদ বলল, একটা সত্যি কথা বলতো, তুই কি ঐ মেয়ের উপর ক্র্যাশড?

তোর কেন এমন মনে হচ্ছে?

তুই তো কখনো এভাবে কারো কথা জিজ্ঞাসা করোস না। কতজনই তো তোকে হাসপাতালে দিয়ে যায়,,,

আমি ওনাদের সবাইকে ধন্যবাদ উপহার পাঠাই ভুলে যাচ্ছিস।

নাহ পাঠাস জানি।

তুই আসলে এবার মেয়ে শুনেই এমন রিয়েক্ট করছিস। এসব খুবই সাধারণ ভদ্রতা,,,

হতে পারে। আচ্ছা যাই হোক। তোর কিছু লাগলে কল দিস। আমি এখন যাচ্ছি। বাইরে দুজন আছে তোর সিকিউরিটির জন্য। তবুও চোখকান খুলে রাখিস।

হুম।

আর আন্টিকে কল দিস। আমি বলেছি তুই ডিউটিতে আছিস বলে কল করতে পারিসনি। কথা বলে নে নয়তো টেনশন করবে।

তোকে অনেক ধন্যবাদ দোস্ত। তুই আমার জন্য কত মিথ্যা বলোস!

কবরে যাইয়া বলিস, যাতে বাঁশধুনা কম দেয়।নাটক!

ইরফাজ হাসতে লাগলো।

রুহি হসপিটালে এসে ইরফাজের কেবিনে ঢুকল।
ইরফাজ তখন ফোনে কিছু ডকুমেন্টস চেক করছিল। রুহিকে দেখে সে ভীষণ চমকে যায় যেন। সেদিন ভালোমতো খেয়াল না করলেও আজ মন দিয়ে দেখল মেয়েটাকে। রেশমী ঝরঝরে চুল, মায়াবি চোখ, ফর্সামতোন গোলগাল মুখ। কালো টপস আর জিন্স পড়া মেয়েটাকে দেখলে যে কারোই হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়ার মতোই সৌন্দর্যের অধিকারী সে। ইরফাজ অস্বস্তিতে এসির নীচে থেকেও তরতর করে ঘামতে লাগল। রুহি হাত নাড়িয়ে বলল, হ্যালো অফিসার? কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন?

জ্বি না চেনার কি আছে!

কি জানি আমার তো মনে হয়েছে আপনি হয়তো চেহারা মনে রাখেননি। যাই হোক এখন কেমন লাগছে আপনার? ডাক্তার কি বলল?

আমি একদম সুস্থ আছি, কিছুদিন রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ!

দ্যাটস গ্রেট। তা আপনার সাথে কেউ নেই যে? আপনার ফ্যামিলি মেম্বার কেউ আসেনি?

নাহ আমি খবর দিতে মানা করেছি। আসলে জবটাই এমন কত বিপদ আপদই আসে, সব খবর দিলে উনারা বাঁচতে পারবেন না!

ওহ এই ব্যাপার! আসলেই আপনার জবটা ভীষণ রিস্কি। কেন যে বেছে বেছে এটাতেই এলেন!

সবাই যদি এমন ভাবে ডিফেন্স করবে কে?

তাও ঠিক। আপনার সম্পর্কে আমি অনেক আর্টিকেল পড়েছি। আপনিতো বলতে গেলে সুপার কপ! আপনার দুঃসাহসিক মিশনের কথা বেশ ফলাও করে লেখা হয়। বাব্বাহ এতো সাহস আপনার আমি তো শুনেই শিহরিত!

আপনি আমায় লজ্জা দিচ্ছেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টে এমন অনেকেই আছেন যাদের গল্প শুনলে আমারটা ফিকেই মনে হবে। উনারা আরো বেশি ডেডিকেটেড আর এক্সট্রিম ব্রেইব।

আমিতো ভাবতাম আমাদের দেশে তেমন নেই। আপনার কথা শুনে ভুল ভাঙলো।

ধন্য হলাম কোনো একজনকে তো কনভিন্স করতে পেরেছি! হাহাহা

রুহি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, অফিসার আপনার হাসি তো মাশাআল্লাহ!

ইরফাজ নিজের কান টেনে বলল, তেমন না আসলে,,,

রুহি অন্যদিকে ফিরে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।


রেবার হলো যতো জ্বালা, একেকজন একেক আইটেম এনে রেবার সামনে রাখে। রেবাও ভদ্রতার খাতিরে সব খেতে থাকে। ওর তিন চাচীর রান্নার খ্যাতি অনেক। সবাই যে যার বেস্টটা রেধে আনছেন। রেবার অবশ্য খেতে মন্দ লাগছেনা। মুখ ফুটে কিছু বলতে দেরী সামনে এসে হাজির হতে দেরী নেই। রেবার ইচ্ছে হলো বোম্বে মরিচ দিয়ে খুদে ভাতের বিরিয়ানী খেতে,২ ঘন্টার মধ্যেই হাজির করা হলো। আরাফের মতো‌ ওর পরিবারের সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে বলা বাহুল্য। প্রথম ছেলের ঘরের বলে ওর প্রতি সবার আগ্রহের শেষ‌ নেই।

হ্যালো মা আস্সালামু আলাইকুম কেমন আছ?

ওয়ালাইকুমুস্সালাম, ভালো আছি তুই কেমন আছিস?

ভালো আছি।

তোর শরীরের কি অবস্থা? খেতে পারিস তো ঠিকঠাক?

ভালোই। খেতে পারি মানে! বলো যে খাদক হয়ে গেছি। এতো ক্ষিদে পায় আমার, যে আসতে চলেছে সে বোধহয় আমায় মোটা বানিয়েই দম নিবে!

এভাবে বলিস না বোকা মেয়ে। একেকজনের একেক রকম হয়। কারো খাওয়া বাড়ে তো কেউ মুখেই তুলতে পারেনা।

হুম।

তোর ভাইয়া বলছিল তোকে আনতে যাবে, প্রথম সন্তান বাপের বাড়িতে হয় এমনটাই তো নিয়ম। তুই আসবি?

মনে তো হচ্ছেনা ওরা দিবে, সারাক্ষণ আমায় নিয়ে যা করে! দেখলে না ওরা কেমন চোখে হারায় আমাকে, আমার শ্বশুড় কি করে জানো, ভোরে উঠে নেহাড়ি আর নান রুটি নিয়ে আসে। আর তোমাদের জামাইয়ের কথা কি বলবো, রাতে একশোবার উঠবে, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা চেক করবে। জানো মা আমার অনেক পা ব্যথা করে, উনি যত্ন করে মালিশ করে দেয়। নিষেধ করলেও শুনেনা। তোমার মতো করে চুলে তেল লাগিয়ে দেয়। আমার অনেক যত্ন করে সবাই। তুমি চিন্তা করো না।

আল্লাহুম্মা বারিকলাহু! আল্লাহ সকল বদনজর থেকে তোকে হেফাজত করুক। ওনারা সবাই তোর এতো যত্ন করছে শুনে আমি নিশ্চিন্ত হলাম রে মা। যদিও জানতাম ওরা তোর যত্নে ত্রুটি রাখবেনা। তাও মায়ের মন তো,,, এখন শুনে মনে হচ্ছে এতো যত্ন আমিও করতে পারবোনা। তুই বরং ওখানেই থাক। আমি শেষ দিকে আসবো।

তুমি দোআ করিও মা।

পাগলী মেয়ে মায়ের কাছ থেকে দোআ চাইতে হয়? আমিতো সবসময় আল্লাহর কাছে বলি, আমার ছেলেমেয়েদের সুখে রাখুক। সহীহ সালামতে রাখুক। আমার আর কিছু চাই না।

মা শুনো,

হুম বল?

আমি তোমার কষ্ট অনুভব করছি মা,, তাই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেছে, তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিল তাই না মা!

যখন সন্তানের মুখ দেখবি এইসব কষ্ট পানি হয়ে যাবে। মনে হবে কোনো কষ্টই হয়নি। ওহ রেবা ভালো কথা, সবসময় সূরা মারিয়াম, আর আর রাহমান শুনিস। একটা রুকাইয়া আছে। ঐটা শুনে ঘুমাবি। পারলে নিজে তেলোয়াত করবি। আমি তোদের বেলা সবসময় এসব পড়তাম। এতে মন শান্ত থাকে।

আচ্ছা। ভাবিরা সবাই ভালো আছে তো? আমার মিমি কোথায়?

সবাই ভালো আছে। মিমি টিচারের কাছে পড়ছে। উঠলে বলবো কল দিতে।

আচ্ছা মা, রাখি এখন। পরে কথা হবে।

আচ্ছা নিজের খেয়াল রাখিস। আল্লাহর হাউলা আল্লাহর কাছে আমানত।

রেবা ফোন রেখে পেটে হাত দিয়ে বলল, দেখলি মনা তোর নানী কি বলল? সবাই তোর আসার অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে রে, জলদি করে মায়ের বুকে চলে আয় তো।

চলবে,,,,