তার শহরের মায়া পর্ব-২৭

0
870

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_২৭
#Writer_Liza_moni

তূর্যর সামনে থম মেরে বসে আছে অনু। চোখ তার বিছানার চাদরের দিকে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তূর্য মুখটা কে মলিন করে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে।

রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে। তূর্য আর অনুর চোখে ঘুম নেই।অনু হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

আমার তখন মজা টা করা ঠিক হয়নি। প্রেগন্যান্সি নিয়ে মজা করাটা একদম ঠিক হয়নি।

তূর্য দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।
তার পর ভেঙ্গে যাওয়া কন্ঠে বললো,,
কিছু জিনিস আছে অনুমেঘা।যা নিয়ে মজা করা উচিত নয়।জিবন বড় কঠিন। অনেক নিয়ম মেনে নিতে হয়।

অনুর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
অনু একবার তূর্যর দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল।

মিনিট দশেক আগে,,,

একটা দুঃস্বপ্ন দেখে দরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে অনু,,,
পাশ ফিরে অস্থির হয়ে তূর্য কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে।

তূর্য ভিতী কন্ঠে অনুর ভয় পাওয়ার কারন জানতে চাইলো।

অনু কী বলবে বুঝতে না পেরে কান্না করে দিল।

তূর্য অভয় দিয়ে জিজ্ঞেস করাতেই অনু গড়গড় করে বললো,,
আমি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্ন ভীষণ খারাপ।
আমি, আমি নাকি কোনো দিন ও মা হতে পারবো না।

বলেই অনু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

.
.
তূর্য অনুর কাঁধে হাত রেখে অনুকে বিছানায় শুয়ে দিল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,, তুমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবা। তিনি নিশ্চয় তোমাকে ফেরাবেন না।

অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনু কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে তূর্য। কান্না করতে করতে অনুও শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে।

কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে অযথা মিথ্যা মজা করা উচিত নয়। একদমই না।
.
.
সকালে আযান দেওয়ার ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় অনুর। নড়েচড়ে পাশ‌ ফিরে দেখে তূর্য তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।অনু তূর্যর হাতটা সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।মাথার এলোমেলো চুল গুলো কে খোঁপা করতে করতে ওয়াস রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে,অযু করে এসে তূর্যর দিকে তাকাতেই দেখে তূর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে।

অনু তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে বললো,,
ফ্রেশ হয়ে অযু করে আসুন।

তূর্য শোয়া থেকে উঠে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে দেখে অনু নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। তূর্য কাভার্ড থেকে একটা পাঞ্জাবী বের করে সেটা গায়ে দিয়ে মসজিদের পথে হাটা ধরলো।

অনু নামাজে বসে মোনাজাতে কান্না করতে করতে শেষ। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এমনটা না করলেই হতো। আল্লাহ যোনো তাকে মাফ করে দেয়।

নামাজ পড়ে উঠে জায়নামাজ গুছিয়ে অনু রান্না ঘরে চলে গেল।আজ থেকে তূর্যর অফিস শুরু।

তূর্য মসজিদ থেকে এসে অনু কে রান্না ঘরে দেখলো। মুচকি হেসে রুমে গিয়ে পাঞ্জাবি খুলে টি শার্ট গায়ে দিয়ে অনুর কাছে গেলো। তার বউটা একা একা রান্না করছে,,সে ও একটু কাজে সাহায্য করলে ক্ষতি কী?

রান্না ঘরে এসে তূর্যর চোখ আটকে গেল
অনুর পেটের মাঝে
কালো কুচকুচে একটা তিল দেখে।শাড়ির আঁচল উপরে তুলে কোমরে গোঁজার ফলে অনুর পেট স্পষ্ট।

তূর্য থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। এগিয়ে গেল না। নিজের রুমে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালো।

সে চাইলেই অনু কে ছুঁয়ে দেখতে পারে।অনু তার জন্য হালাল। তার বউ হয় অনু। তবু ও মাঝে অনেক বারন।অনুর তৈরি করা প্রাচীর। তূর্য চায় না অনুর অনুমতি ছাড়া কিছু করতে। না হলে সারা জীবন সে দোষী হয়ে থাকবে।
তূর্য মনে মনে বললো,,
ও যদি এমন করে অসচেতন হয়ে চলে তাহলে আমার নিজেকে সামলে রাখা কঠিন হবে।যত তাই হোক,, আমি একজন ছেলে।সে যতই ভালো হইনা কেন?

তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

অনু সকালের নাস্তা বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে তূর্য কে ডাক দিল।

তূর্য মুচকি হেসে ডাইনিং টেবিলে এসে দেখে নুডুলুস
, পরোটা,ডিম ভাজি সাজিয়ে রাখা। তূর্য চেয়ারে বসে পড়লো।অনু তূর্য কে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজে ও বসে পড়লো।অনুর মনটা তেমন ভালো নেই। রাতের স্বপ্নটার এখন ও রেশ কাটেনি তার।

তাই শুধু নুডুলুস খেলো। তূর্য কিছু বললো না। চুপ চাপ নিজের খাবার শেষ করে উঠে আবার ও বেলকনিতে চলে গেল।

অনু সব গুছিয়ে রেখে ধোঁয়া উঠা দুই কাপ চা বানিয়ে রুমে গেল। রুমে কোথাও তূর্য কে দেখতে না পেয়ে অনুর চোখ গেলো বেলকনির দিকে।অনু সেখানে গিয়ে তূর্যর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললো,,
নিন,,চা খান।

তূর্য অনুর মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে মুচকি হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলো। বেলকনিতে রাখা দুটো মোড়ায় বসলো দুজনে।অনু চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে একটু একটু করে চা খাচ্ছে।আর তূর্য গরম গরম চা ফুঁ দেওয়া ছাড়াই গিলছে।

এতো গরম চা কি ভাবে খাচ্ছেন আপনি?

তূর্য মুচকি হেসে বললো,,,
অভ্যেস আছে। আমি এমন গরম খেতে পারি। ভাল্লাগে আমার।

অনু নিচের ঠোঁট টা বাঁকিয়ে বললো,, বুঝতে হবে জামাইটা কার,,?
কথা টা বলে অনু নিজে নিজেই হাসতে লাগলো।তা দেখে তুর্য তাচ্ছিল্য হাসলো। চায়ের কাপ টা অনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তূর্য রুমে চলে গেল।

তূর্যর চলে যাওয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

অনু চায়ের কাপ গুলো ধুয়ে রেখে রুমে আসলো। রুমে এসে দেখে তূর্য অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।

অনু বিছানায় এসে বসে বললো,,
ফিরবেন কখন?

রাত হবে,,,এত দিন পর অফিসে যাচ্ছি,,কাজ জমা হয়ে আছে অনেক।

ওহ।মন খারাপ করে বললো অনু।
আমাকে তাহলে সারাদিন এক থাকতে হবে!

তূর্য অনুর দিকে এক নজর তাকিয়ে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললো,,
কেন,,? মাহির আছে না,,? ওকে জ্বালাবে সারাদিন। তাহলে আমার কথা আর মনে পড়বে না।
তূর্যর কন্ঠে অভিমান।

অনু বুঝলো না তার প্রতি তূর্যর অভিমানের বিষয়টা।
ওরে তো জ্বালামু,, কিন্তু আপনাকে ছাড়া একা একা জ্বালাতে ভালো লাগবে না,,,

তূর্য কিছু বললো না।অনুর হাত ধরে টান মেরে বসা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।অনুর গালে হাত রেখে,,,

আসছি,,টেক কেয়ার বলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।অনুও তূর্যর পিছু পিছু মেন দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
.
.
তূর্য চলে যেতেই অনু দরজা বন্ধ করে দুপুরে জন্য রান্না করার কাজে লেগে যায়।
১২টার দিকে রান্না শেষ করে ক্লান্ত,ঘামান্ত অনু কাভার্ড থেকে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল গোসলের জন্য। বিয়ের পর সব সময় শাড়ি পরবে এই ইচ্ছে ছিল তার। শাড়ি পরতে অনুর খুব ভালো লাগে।
.
.
কি ইয়াং ম্যান,,,
নতুন বউকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করে না নাকি?

জামাল সাহেবের কথা শুনে তূর্য মনে মনে বললো,,আর বউ,,, তার তো আমার দিকে কোনো খেয়ালই নেই।সে তার প্রাক্তন কে জ্বালানো নিয়ে ব্যস্ত।

নতুন নতুন বিয়ে করলে কারইবা বউ রেখে অন্যের হারিয়ে যাওয়া বউকে খুজতে ইচ্ছে করে বলেন তো স্যার?

সেটাই তো।

স্যার আপনি কিন্তু আপনার কথা রাখেননি। মুখ মলিন করে বললো তূর্য।

জামাল সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,,
কী কথা রাখিনি?

তূর্য দাঁত কেলিয়ে বললো,,
আপনি বলে ছিলেন আমি বিয়ে করলে আমি আলাদা কিছু দিন ছুটি পাবো,,,

ও হো,,,জামাল সাহেব হেসে উঠলো।পাবে তূর্য পাবে,,, এই কেসটা মিটে গেলেই পাবে,,,

তূর্য বিড়বিড় করে বললো,, পাইলে ও আর কী হবে স্যার?বউয়ের সাথে তো আর রোমান্স করতে পারবো না।আর না হানিমুনে যেতে পারবো,,,?
.
.
অনু গোসল করে এসে চুল গুলো কে এক পাশে এনে তোয়ালে দিয়ে মুছতে লাগলো।

যোহরের আযান দিতেই অনু অযু করে এসে নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ পড়ে উঠে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। পাশে তাকাতেই মোবাইল চোখে পড়লো তার।অনু হাত দিয়ে মোবাইলটা নিলো। তূর্য কে মিস করছে সে।

এখন থাকলে কথা বলা যেতো।অনু তূর্যর নাম্বারে ডায়াল করলো।

তূর্যর ফোন বেজে উঠায় ভ্রু কুঁচকে পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রিনে অনুর নাম্বার দেখে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

দুই বার রিং হতেই তূর্য কল রিসিভ করে কানে ধরলো।অনু চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। তূর্য ও সেম। নিরবতা ভেঙ্গে তূর্য বললো,,
খেয়েছো?

এমন সময় অনু ও বলে উঠলো খেয়েছেন?

তূর্য বললো না খাইনি,,অনু ও বলে উঠলো খাইনি,,, দুইজনের কথাই একসাথে হয়ে গেছে।দুজনেই হেসে ফেললো।

খাওনি কেন?

খাবো একটু পরেই,,,

খেয়ে নাও,, আমি ও খেতে যাচ্ছি। এসে কল দিবো কেমন?

অনু কিছু বললো না।
তূর্য আবারো বলে উঠলো,,
বস খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে। আমার বিয়ের উপলক্ষে তিনি সবাই কে ট্রিট দিয়েছেন।

অনু হাসলো। আপনার বস নিশ্চয় অনেক ভালো?

হুম। খুব ভালো। আমাকে তিনি তার ছেলের মতোই মনে করেন।

ভালোই। আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনি যান। রাখছি,,

এই শুনো,,,

হুম বলুন,,,

খেয়ে নাও,, এখনই। একদম দেরি করবা না। কেমন?

অনু থমকালো। এমন একটা লোক কে সে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে? মলিন কন্ঠে বললো,,খাবো, এখনই,,

গুড গার্ল,,, রাখছি।
হুম।
তূর্য কল কেটে দিল।
অনু পাশের বালিশটা টেনে এনে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ভাবতে লাগলো,,
শুধু শুধু তূর্য কে এমন কষ্ট না দিলে ও হয়।সব মেয়েদের মতো ছেলেদের ও তো ইচ্ছে করে,,যে তার কাছের মানুষটা,, তার জীবন সঙ্গী টা তাকে ও একটু বুঝোক।সব সময় কি নিজের স্বার্থের কথা ভাবলে হবে?যার জন্য আজ হাসছো তুমি, তার কথা ও একটু ভাবো।তাকে ও একটু বুঝো।সে ও তো মানুষ।ধর্য্য আর কত দিনই বা থাকবে,,,,?

চলবে,,,,,, 🍁