তার শহরের মায়া পর্ব-২৮

0
870

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_২৮
#Writer_Liza_moni

অনু শোয়া থেকে উঠে খাবার খাওয়ার জন্য চলে গেল।প্লেটে ভাত,মাংস আর সালাদ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লো।আর তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে।

অনু বিরক্ত হয়ে বসা থেকে উঠে মেন দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখে দরজার সামনে তনু দাঁড়িয়ে আছে।
তনু কে দেখে অনু মুচকি হেসে বললো,,
কী রে আপু ,, এই সময় আসলি যে?

তনু ভেতরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লো।অনু দরজা বন্ধ করে এসে সেও বসলো।

কেউ নেই,,একা একা লাগছিলো তাই চলে আসছি।

ওহ,, তোর শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি আসেনি?আর মাহির,,সরি দুলাভাই কোথায়?

তোর দুলাভাই অফিসে।আর শ্বশুড় ,শ্বাশুড়ি আসেনি। আসবেন আর ও কিছু দিন পর।

ওহ।ভাত খাইছোস?

না। একা একা খাইতে ভাল্লাগে না।তাই তো চলে আসছি।

অনু মুচকি হেসে কিচেনে যেতে যেতে বললো,,ভালোই করছোস,, আমার ও একা একা খেতে ভালো লাগছিল না। আমি তোর জন্য ভাত আনছি বোস।

তনু কিছু বললো না।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তার পর অনুর রুম গুলো ঘুরে দেখতে লাগলো।সব গুছানো। এলোমেলো কিছুই নেই।আর আমার রুম টা দেখো,, আমি যত বার গুছিয়ে রাখবো তত বার মাহির অগোছালো করবে।এরা জামাই বউ দুটাই গোছগাছ।

অনু এক প্লেট খাবার এনে ডাইনিং টেবিলে রেখে তনু কে ডাক দিল।তনু এগিয়ে গেল সে দিকে। চেয়ারে বসতে বসতে বললো,,
তূর্য সাহেবের খোঁজ নিয়েছিস? খেয়েছে কিনা?

অনু ভাত মেখে এক লোকমা মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে বললো,, হুম নিয়েছি। খাচ্ছে মনে হয় এখন।

তনু ও খাওয়া শুরু করে দিল। খাবার খাওয়ার পর তনু এসে সোফায় বসলো।অনু সব গুছিয়ে রেখে এসে তনুর উদ্দেশ্যে বললো,, আমার রুমের বেলকনিতে চল। এখানে ভাল্লাগে না।

তনু ও চলে গেল অনুর সাথে। বেলকনিতে বসে আছে দুই বোন। হালকা বাতাসে বেলকনিতে লাগানো গাছ গুলোর পাতা নড়ছে।

তনু অনুর ডান হাত ধরে নিজের হাতে রাখতেই অনু মৃদু কুঁচকে তাকালো। চোখের ইশারায় বললো কি হয়েছে?

তনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,,
আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি অনু?

তনুর কন্ঠে কাতরতা। তনুর কথা শুনে অনুর বুকের মাঝে ধক করে উঠলো।কী সত্যি জানতে চায় আপু?মনে মনে কথা টা আওড়াচ্ছে সে।

কীরে বলবি?

হুম বল আগে।

তনু চোখ দুটো বন্ধ করে আবার খুলল। তার পর শান্ত কন্ঠে বললো,,
তুই কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট?যার সাথে তোর সর্ম্পক ছিল আমি জানি তুই তাকে ভীষণ ভালোবাসিস।
তুই তো এত তাড়াতাড়ি তূর্য কে মেনে নিতে পারবি না। তোর তো সময় লাগবে। তিন বছরের সম্পর্ক টাকে মন থেকে মুছতে। যদিও পুরো পুরি মোছা যায় না। কিন্তু সব কিছু মানিয়ে নিতে তো তোর সময় দরকার।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার পর বললো,,
সরি রে আপু। আমি প্রেগন্যান্ট না। তোর ধারনা ঠিক। আমি তূর্য কে এখন ও মেনে নিতে পারিনি। আমি পারছি না । চেষ্টা করছি ভীষণ। আমাদের বিয়ের আজ প্রায় অনেক দিন। এই কয়েক দিনে তূর্য আমাকে কোনো কিছুর জন্যই জোর করে নি।

বোন শুন,, তূর্য কে কষ্ট দিস না।ওর তো কোনো দোষ নেই।সবার জীবনেই একটা অতীত থাকে। কারো রঙিন তো কারো রঙহিন। তূর্য বলে আজ ও তোকে কিছু তে জোর করে নি।অন্য কেউ হলে বিয়ের রাতেই,,,
বুঝতে পারছিস তো আমার কথা?

হুম।বল,,

তূর্য তোকে এখন ও সময় দিচ্ছে।মানিয়ে নে।তনু অনুর হাতে আর একটু চাপ দিয়ে বললো,,
তূর্য একজন ছেলে। তুই তার জন্য হালাল। তার থেকে ও বড় কথা হলো তোরা দুজনে একসাথে থাকিস,,দিন রাত সব সময়। তুই তো সাইন্স এর স্টুডেন্ট তোর তো বোঝা উচিত। একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে সব সময় একা থাকলে তার মন মস্তিষ্ক কেমন থাকে। তূর্যকে কষ্ট দিস না বোন।

অনু কিছু বললো না। চুপ করে তনুর কথা শুনে রইলো।

আমার কথা বুঝতে পারছিস?

হুম। কিন্তু আমার যে সময় লাগবে। এই কয়েক দিন আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে।সে আমার কাছে আসেনি।আর না আমি এসেছি।সে আসতে চাইলেও আমার কেমন জানি লাগতো। এখন ও লাগে।তাকে বুঝার জন্য সব কিছু ভুলে নতুন করে আবার গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমার সময় চাই আপু।

তনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুই আর কিছু দিন সময় নে। কিন্তু মনে রাখিস, বেশি সময় নিতে গিয়ে কিন্তু দেরি করে ফেরিস না।
তনু অনুর হাত ধরে বললো দিন কাল ভালো না। তূর্য বাইরে, বাইরে থাকে। তুই যদি ওকে এই ভাবে দূরে সরিয়ে রাখিস,ওর ভেতরটা বুঝতে চেষ্টা না করিস তাহলে অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে যেতে পারে।

তনুর বলা কথাটা শুনে অনুর কলিজায় ছেত করে উঠলো।অনু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।কী বলবে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। চুপ করে মাথা নিচু করে পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এমন সময় তনুর কল আসে। তনু ফোনের স্ক্রিনে মাহিরের নাম্বার দেখে উঠে দাঁড়ালো। তার পর অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,, তোর দুলাভাই চলে আসছে। আমি যাচ্ছি।একা থাকতে ইচ্ছে না
করলে আয় আমার সাথে।

না। আমার কাজ আছে যাবো না।

তনু কল রিসিভ করে কানে ধরলো।

কই তুমি?

আমি তো আনুর কাছে। বাড়িতে একা ছিলাম তাই,,

বুঝছি।আসো,, আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চাবি তো তোমার কাছে?

হুম আসতেছি।একটু অপেক্ষা করো।

তনু কল কেটে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বললো,,
তূর্য খুব ভালো ছেলে।ওরে মেনে নে। দেরি করিস না। না হলে পরে আফসোস করবি।

তনুর পিছু পিছু অনু ও আসলো।তনু চলে গেলে অনু দরজা বন্ধ করে এলোমেলো পায়ে হেঁটে এসে বিছানায় বসলো।ভাল্লাগছে না তার।সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।সে চাইছে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে। কিন্তু মাহিরের দেওয়া আঘাতের ঘা এখন ও শুকায়নি।
.
.
.
বেলকনিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অনু আর তূর্য।রাত প্রায় দশটা বাজে। আটটার দিকে বাড়িতে আসে তূর্য। খাবার খাওয়ার পর একটু আগেই এসে দাঁড়িয়েছে বেলকনিতে।সব কিছু গুছিয়ে অনু ও এসে দাঁড়ায় তার পাশে।

আকাশে আজ ঘন কালো মেঘ। বৃষ্টি হবে হয় তো শেষ রাতের দিকে।

তূর্য মুখ মলিন করে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য কে এমন মন মরা হয়ে থাকতে দেখে অনুর ভালো লাগছে না। আসার পর থেকে তেমন কথা ও বলেনি।

তূর্য হঠাৎ মুচকি হেসে বললো,, আজকের ওয়েদার একটা বউ ডিজার্ভ করে।

অনু থমকালো। বিষন্ন কন্ঠে বললো,,
আপনার কী বউ নেই নাকি?

তূর্য হাসলো।বউ থেকে ও আর কী? সেতো তার প্রাক্তন প্রেমিক কে জ্বালানো নিয়ে ব্যস্ত।

আমি আজ তনু আপুদের ওখানে যাইনি।
শান্ত কন্ঠে বললো অনু।

তূর্য অবাক হলো।
কেন যাও নি?

এমনিতেই।কী দরকার? আমার সংসার আছে। আমি আমার সংসার নিয়েই ব্যস্ত।

জানো অনুমেঘা,,
কোনো স্বামীই চায়বে না বিয়ের পর তার বউ তার দিকে খেয়াল না করে তার প্রাক্তন প্রেমিক কে গুরুত্ব দিক। চাইবে না কেউ আমার মতো। আমি প্রথমে তোমাকে সাপোর্ট করলেও এখন বলবো তুমি তোমার নিজের সংসারে খেয়াল করো। মাহির কে প্রকৃতি শাস্তি দিবে। কাউকে ঠকিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকে না। জীবনের কোনো না কোনো এক সময় ঠিক তাঁরা তাঁদের কর্মের ফল ভোগ করবে।

অনুর মুখ মলিন। কিছু বলছে না।আসলে সে কী বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না।

আমি ভুল কিছু বলছি বলে আমার মনে হচ্ছে না অনু। তুমি নিজেই ভেবে দেখো,,, আমি যদি আজ তোমার বদলে অন্য কাউকে বিয়ে করতাম বা ধরো যদি তানিশার সাথে আমার বিয়ে হতো তাহলে আমাদের সম্পর্ক টা সহজ হতো। আমি চাই নি তুমি মাহির যে ফ্ল্যাটে থাকে সেখানে থাকো।মাহিরের চোখের সামনে থাকো।ভুলে যাওয়ার বদলে আরো দেখে তাকে মনে করো আমি চাই না এই সব। তুমি যেনো কষ্ট না পাও,, আমাকে ও যেন মাহিরের মতো মনে না করো তার জন্য আমি তোমার কোনো কথাতেই না করিনি।

তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আমি এসবের জন্য এখানে থাকতে চাইনি,, বিশ্বাস করুন। আপনি অফিসে চলে যাবেন,, আমাকে সারা দিন একা থাকতে হবে বলেই আমি তনু আপুর সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। তনু আপুও তো মাহির চলে গেলে একা থাকে।তাই তো আমি আর তনু আপু এই প্লেন করি।

অনুর কথা তূর্য বুঝলো।

থাকো সমস্যা নাই। তবে আমি বলবো মাহির থেকে দূরে থেকো।

একটা কথা বলি,,,?

হুম। অনুমতি নিতে বারন করেছিলাম,,,

সব কিছু ঠিক করতে আমার সময় লাগবে। আমাকে কিছু দিন সময় দিন। আমি চেষ্টা করবো খুব করে,,প্লিজ,,
অনুরোধি কন্ঠে বললো অনু।

তূর্য বিষন্ন গলায় বললো,,
নাও সময়। আমি তো আর তোমাকে জোর করছি না। তোমার মত সময় লাগবে নাও।

তূর্য রুমে চলে গেল। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারা দিন কাজ করায় অনেক ক্লান্ত সে।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।একটু পর সে এসে শুয়ে পড়লো। ঘুম আসছে অনুর।অনুর দিকে তূর্য ঘুমিয়ে গেছে।
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে অনু কে মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তূর্য জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?

আজ রেজাল্ট দিবে। জানি না কী হবে,,,? ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।যদি ফেল করি,,, তাহলে কী হবে?

ধুর বোকা।ফেল করবা না।দেইখো। কয়টায় ছাড়বে রেজাল্ট?

সকাল
১০টায়।

তূর্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ছয়টা বাজে মাত্র। এখন ও অনেক দেরি।

তূর্য বিছানা থেকে উঠে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।অনু চিন্তিত হয়ে রান্না ঘরে গেল। কিছু করতে ইচ্ছে করছে না তার। কেমন যেন ভয় হচ্ছে।কী যে হবে?

তূর্য ওয়াস রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে রান্না ঘরে গেল।অনু কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বললো,,
আজকের নাস্তা আমি বানাই?

আরে না। আমি বানাচ্ছি।

থাক তোমাকে আর বানাতে হবে না আজকে। এখন তাও বসো। এতো চিন্তার কিছু নেই।

অনু এলোমেলো পায়ে হেঁটে এসে সোফায় বসলো। হাতের নখ কামড়াচ্ছে বসে বসে।

তূর্য অনুর দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিলো।
অনু লাফিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

কি,কি হয়েছে? এই ভাবে ধমক দিচ্ছেন কেন?

আমার সামনে একদম হাতের নখ কামড়াবে না।খাবিস মাইয়া।আর যদি দেখছি হাতের নখ কামড়াইছো তাহলে তোমার হাতের আঙ্গুল সহ কেটে ফেলে দিবো।

হে হে,, কাটতে পারলে বলিয়েন। এমনিতেই চিন্তায় শেষ। তার উপর এই ধমক মেরে ফেলবে আমাকে।

আরেক বার হাত মুখে দিয়ে দেখো।হাতে গোড়া দিয়ে কেটে দিমু।

কাজ করেন তো।ক্ষিদা লাগছে।
.
.
১০টার সময় অনুর রেজাল্ট দিয়েছে।অনু আজ তূর্যর স্যারের সাথে কথা বলে ওর ছুটি নিয়েছে। একদিনের জন্য। বিছানায় কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে আছে অনু।
তূর্য মোবাইলে অনুর রেজাল্ট দেখতে ব্যস্ত।

তূর্য হঠাৎ মুখটাকে মলিন করে ফেললো।তা দেখে অনুর কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।

তূর্য অনুর দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভাবে বললো,,
মেঘু পাখি তুমি পরীক্ষায়,,

অনুর ভয়ে হার্ট বিট বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে এখনি বের হয়ে আসবে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,,
আমি পরিক্ষায় ?

তূর্য মুখটা কে মলিন করে বললো তুমি পরীক্ষায় সবার থেকে ভালো নাম্বার পেয়েছো।আই মিন সব সাবজেক্ট এ এ+।

অনুর চোখ কপালে। এতো ভালো রেজাল্ট করবে তা ভাবতেই পারেনি সে।অনু হঠাৎ করে তূর্য কে জাপটে ধরে কান্না করে দিল। আনন্দের কান্না। তূর্য অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,

আমার মেঘুপাখি এতো ভালো রেজাল্ট করেছে এখন তো সবাইকে আমার পক্ষ থেকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।

আমি ভাবতেও পারিনি এতো ভালো রেজাল্ট হবে। তূর্যর বুকের মাঝে কান্না করতে করতে টি শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে।

তূর্য মুচকি হেসে অনু কে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ছাড়লো না।

চলবে,,,,, 🍁