#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৩
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
মারুফ সাহেবের রুমে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে সজীব। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। সজীবের মুখোমুখি বসে আছেন মারুফ সাহেব। পাশেই বসে আছেন কামরুল রহমান। নিরবতা ভেঙে কামরুল সাহেব প্রথম মুখ খোলেন। প্রশ্ন বোধক কন্ঠে সজীবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—“এই বিষয়ে তুমি কি বলো দাদু ভাই? তুমি এই বাড়ির বড় জামাই। তাই তোমার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
মাথা তুলে তাকায় সজীব। কামরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বলে,
—“দাদু, জানি না কেনো! কিন্তু বিষয়টা মানতে পারছি না। প্রাপ্তির বিয়ের বিষয়টা নিয়ে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ প্রাপ্তি তো আর পাঁচ জন সাধারণ মেয়ের মতো না। তাই বুঝতে পারছি না কি বলবো।”
এই পর্যায়ে মুখ খোলেন মারুফ সাহেব। কিছুটা অভয় সুরে বলেন,
—“আমার মেয়েকে নিয়ে আমিও চিন্তা করি বাবা। আমিও চাই আমার মেয়ে ভালো থাকুক। তাছাড়া ছেলে পক্ষ সবটা জানে। সব জেনেই তারা প্রস্তাব দিয়েছে।”
—“কিন্তু বাবা, ছেলে আমেরিকা থাকে। প্রাপ্তিকে নিয়ে যদি আমেরিকা চলে যায়? সেখানে গিয়ে যদি প্রাপ্তি তাদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারে? তখন কি হবে?”
সজীবের কথা শুনে চিন্তিত ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকান কামরুল সাহেব। মারুফ সাহেবও কিছুটা চিন্তায় আছেন। তারপর কিছু একটা ভেবে মারুফ সাহেব বলেন,
—“আমি না হয় বলে নেবো যে নতুন পরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে না নেয়া পর্যন্ত প্রাপ্তি আমার কাছেই থাকবে। আর তাছাড়া এখন তো সবে দেখতে আসছে। বিয়ে তো আর এখনই হয়ে যাচ্ছে না।”
আর কোনো কথা বলে না সজীব। মারুফ সাহেব প্রাপ্তির বাবা। তিনি যা করবেন প্রাপ্তির ভালোর কথা চিন্তা করেই করবেন। কামরুল সাহেবও আর কথা বাড়ান না। তারা দেখতে আসতে চাইছে, আসুক। ভালো মন্দ যাচাই বাছাই করারও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?
দড়জার সামনে থেকে সবার কথা শুনে রান্নাঘরে চলে যায় দীপ্তি। সজীবের সাথে দীপ্তিও এসেছে। রুমের আলোচনা শুনে চিন্তা মগ্ন হয়ে মায়ের পাশে এসে দাড়ায়। দিলারা বেগম মেহমানদের জন্য খাবার বানাচ্ছেন। দুপুর পরেই তারা চলে আসবে তাই তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করতে হবে। দীপ্তি মায়ের পাশে দাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
—“বিষয়টা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না মা? চেনা নেই জানা নেই এমন একটা ছেলের সাথে প্রাপ্তির বিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে। তাও আবার ছেলে বিদেশে থাকে।”
মেয়ের দিকে ঘুরে তাকান দিলারা বেগম। ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেন,
—“ছেলে যদি ভালো হয় তাহলে সমস্যা কোথায়? তোর বাবা তো তার মেয়েদের ভালোই চায়। দেখা যাক কি হয়।”
—“হ্যা, সত্যি ভালো চায়। এতোটাই ভালো চায় যে ভালো করতে গিয়ে আরো খারাপ করে ফেলে। মেয়েদের এতো সুখের মধ্যে এগিয়ে দেয় যে সুখ তার মেয়ের কপালে সয্যই হয় না।”
কথাগুলো বলেই দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায় দীপ্তি। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিছুতেই কান্না আটকে রাখতে পারছে না। সাথে বাবার ওপর অভিমান আরো বেড়ে যাচ্ছে। মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে আবার প্রাপ্তির কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়।
__________________
গাড়ি থামিয়ে মুহুর্তেই দড়জা খুলে বাহিরে বের হয় অর্পন। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসেছে সে। উদ্দেশ্য একটাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বকুলের কাছে পৌছাতে হবে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় গার্লস স্কুলের ভেতরে। ক্লাস চলছে সবার। একটু পরেই ছুটি হয়ে যাবে। সময় মতো আসতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় প্রধান শিক্ষকের রুমে।
অর্পন প্রধান শিক্ষকের রুমে যাওয়ার একটু পরেই স্কুলের আয়া বকুলকে নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে প্রধান শিক্ষককে সবটা জানিয়েছে অর্পন। স্কুল কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অর্পন বকুলকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কথাটা শুনতেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায় বকুল। একজন অচেনা লোকের সাথে যেতে হবে সেটা ভাবতেই অস্বস্তি হচ্ছে তার।
বকুলের অস্বস্তি বুঝতে পেরে হাতের ইশারায় নিজের পাশে বসতে বলে অর্পন। বকুল বসতেই নরম কন্ঠে অর্পন বলে,
—“তোমার ভাইয়া আমাকে বলেছে তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে। সে আমার পরিচিত।”
ভাইয়ের কথা শুনতেই মনের সব সংকোচ দূর হয়ে যায় বকুলের। এক বাক্যে অর্পনের সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বকুলকে নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়ে অর্পন।
________________
প্রাপ্তিকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে দীপ্তি। সুপ্তি পাশেই দাড়িয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আচল ঠিক করার এক ফাঁকে দীপ্তির নজর যায় সুপ্তির দিকে। তার হাসিখুশি চঞ্চল বোনের এমন উদাসীন চেহারা দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় দীপ্তির। এক হাত দিয়ে সুপ্তির থুঁতনি ধরে দীপ্তি বলে,
—“আমার ছুটকির মন খারাপ কেনো? কি এতো ভাবছিস?”
বোনের কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে সুপ্তি। মনটা ভারি করে বলে,
—“আমার কাছের মানুষ গুলো এভাবে দূরে চলে যাচ্ছে কেনো আপি? সেই ছোট বেলায় তুমি চলে গেলে। এখন ছোট আপিও চলে যাবে। আমি যে একা হয়ে যাবো। ছোট আপিকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে?”
বোনের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় প্রাপ্তির। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। এদিকে মন খারাপ দীপ্তিরও। তবে সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে কথা ঘুরিয়ে ফেলে। সুপ্তির থুতনিতে আবার হাত রেখে বলে,
—“এতে মন খারাপ করার কি আছে? সবসময় তো বলতি, ছোট আপির দেবরকে বিয়ে করে আপির সাথেই তার শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবো। দেখি আসুক ছেলে পক্ষ। ছেলের যে ছোট ভাই থাকবে তার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেবো। হিসাব বরাবর।”
—” হ্যা তাই করো। ছেলের ছোট ভাই না থাকলে বিয়ে ক্যান্সেল বলে দিলাম।”
সুপ্তির কথা শুনে হেসে ফেলে দীপ্তি। কিন্তু হাসি নেই প্রাপ্তির মুখে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে মেয়েটার। বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। যেনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এরই মাঝে সেখানে চলে আসেন দিলারা বেগম। মেয়েদের তাড়া দিয়ে বলেন,
—“অতিথিরা চলে এসেছে। তারাতাড়ি প্রাপ্তিকে তৈরি করে নিচে নিয়ে আয়।”
মায়ের কথা শুনে কাজে লেগে পড়ে দীপ্তি। ঝটপট সাজগোজ শেষ করে প্রাপ্তিকে নিয়ে দুই বোন নিচে নেমে আসে। নিচে আসতেই চোখ পড়ে সোফায় বসে থাকা অতিথিদের দিকে। ঘটক সহ মোট চারজন এসেছে। সোফার মাঝে বসে আছে ছেলে আর দুই পাশে তার বাবা মা। ছেলেটা দেখতে মোটামুটি ভালোই। এক দেখাতেই এটুকুই অনুমান করতে পেরেছে দীপ্তি।
পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকায় সজীব। তিন বোনকে একসাথে আসতে দেখে প্রাপ্তিকে নিজের পাশের সোফায় বসানোর ইশারা করে আবার সামনে তাকায়। সজীবের ইশারা অনুযায়ী দীপ্তি সেখানেই বসায় প্রাপ্তিকে। মেয়ের দিকে একনজর তাকান মারুফ সাহেব। গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পড়েছে প্রাপ্তি। মেয়েকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে মারুফ সাহেবের। মুচকি হেসে অতিথিদের দিকে তাকান। তারা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
তাদের কিছু বলবেন তার আগেই পাত্রের মা সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—“একি, মেয়ে এমন সালোয়ার কামিজ পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেনো? শাড়ি পড়ে আসা উচিত ছিলো।”
ভদ্র মহিলার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় সবাই। তার কথার মানে কেউ বুঝতে পারছে না। ধৈর্য রাখতে না পেরে সজীব বলেই ফেলে,
—“বুঝতে পারলাম না আন্টি, সুপ্তি শাড়ি পড়বে কেনো? পাত্রী তো শাড়ি পড়েই এসেছে। এই যে আমার পাশে বসে আছে প্রাপ্তি।”
সজীবের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তিনজনই। একবার সুপ্তি আর একবার প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে ভদ্র মহিলা আবার বলেন,
—“কিন্তু ঘটক তো এই মেয়ের ছবি আমাদের দেখায়নি। কি ঘটক সাহেব। কিছু বলছেন না কেনো?”
শেষের কথাটা তিনি ঘটককে উদ্দেশ্য করে বলেন। এবার মুখ খোলে ঘটক। তিনি মারুফ সাহেবকে বলেন,
—“মারুফ ভাই! আপনার কোথাও একটা ভূল হচ্ছে। আমি তো আপনার ছোট মেয়ে সুপ্তির বিয়ের কথা বলেছিলাম। আপনার মেজো মেয়ে প্রাপ্তির নয়।”
মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে যায় শান্তশিষ্ট পরিবেশ। বদলে যায় সবার মুখের ভাব। চিন্তিত হয়ে পড়েন মারুফ সাহেব। অবাক কন্ঠে বলেন,
—“এসব কি বলছেন আপনি? প্রাপ্তি সুপ্তির থেকে বড়। আমার বড় মেয়ে থাকতে ছেটো মেয়েকে আগেই বিয়ে দেবো কেনো? তাছাড়া আপনি সুপ্তির নাম উল্লেখ করেন নি কেনো?”
সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসে ঘটক। কিছুটা ব্যাঙ্ক সুরে বলে,
—“তা আপনার মাথায় কি কোনো বুদ্ধি নেই? আপনি তো জানেনই আপনার মেজো মেয়ে অন্ধ। তাহলে এই আশা করেন কিভাবে যে তার জন্য কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে। কে বিয়ে করবে এমন অন্ধ একটা মেয়েকে?”
ঘটক কথা শেষ করতে না করতেই তার কলার চেপে ধরে দাঁড় করায় সজীব। রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে সজীব বলে,
—“আমার বোনকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। তোর সাহস কি করে হয় এই বাড়িতে বসে আমার বোনের নামে কটু কথা বলিস।”
সজীবের সাথে ঘটকের হাতাহাতি দেখে উঠে দাড়িয়ে পড়ে সবাই। দীপ্তি দৌড়ে এসে সজীবকে টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। সজীব ছাড়তেই পাত্রের মা সবার উদ্দেশ্যে বলেন,
—“দেখুন, আমরা ভদ্র ফ্যামিলির লোক। এমন গুন্ডা দের মতো হুমকি মারামারি এসব আমরা পছন্দ করি না। আমার একমাত্র ছেলে, তার জন্য বেস্ট মেয়ে চাই আমাদের। ঘটক আপনার ছোট মেয়ের ছবি দেখালে আমাদের পছন্দ হয় তাই রাজি হয়ে যাই। ঘটক বলেছিলো পাত্রীর মেজো বোন অন্ধ আর সে এখনো অবিবাহিত। আমরা তাতে কোনো আপত্তি করিনি কারণ মেয়ে আমাদের পছন্দ। আপনারা চাইলে আপনার ছোট মেয়েকে আমাদের বাড়ির বৌ করে নিয়ে যেতে পারি কিন্তু আপনার মেজো মেয়েকে নয়। জেনে শুনে কে বিয়ে করবে এমন অন্ধ মেয়েকে।”
হাতের লাঠিটা শক্ত করে চেপে ধরে দাড়ান কামরুল সাহেব। অতিথিদের উদ্দেশ্যে বলেন,
—“আপনারা আসতে পারেন। আমার প্রাপ্তি দিদি ভাইয়ের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সুপ্তি দিদি ভাইকে বিয়ে দেবো না।”
পাত্রের মা কামরুল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—“তাহলে আর নাতনির বিয়ে দেয়ার আশাও রাখবেন না। কারণ জেনে বুঝে কেউ এই অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করবে না। মানলাম মেয়েটা দেখতে সুন্দরী। কিন্তু সুন্দর দিয়ে কি হবে, যদি সে সংসারই করতে না পারে। তার স্বামী যখন সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরবে তখন এই মেয়ে তো তাকে এক গ্লাস শরবতও বানিয়ে দিতে পারবে না। স্বামীর জন্য রান্না করতে পারবে না। বরং এই মেয়ের দেখাশোনা করার জন্য আলাদা একজন লোক প্রয়োজন। যে নিজের ক্ষমতায় হাঁটতেও পারবে না এমন মেয়ে বিয়ে করবে কে?”
সোফায় ওপর চুপচাপ বসে আছে প্রাপ্তি। রুমে উপস্থিত সবাই বিচলিত হলেও প্রাপ্তি একদম নির্বিকার। এমন কিছুই যে হবে সেটা যেনো প্রাপ্তি আগে থেকেই জানতো। এমন ভঙ্গিতেই বসে আছে। প্রাপ্তিকে ধরে তার পাশে বসে আছে সুপ্তি। বোনের এতো অপমান কিছুতেই সয্য করতে পারছে না, চোখ দুটো ছলছল করছে তার।
এদিকে সজীবকে এতোক্ষণ ধরে আটকে রাখলেও এবার দীপ্তির ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেছে। ভদ্র মহিলার কথার প্রতিবাদ জানিয়ে দীপ্তি বলে,
—“অনেক বলে ফেলেছেন আন্টি। আপনি আমাদের অতিথি তাই এখনো সম্মান দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ হয়তো দিতে পারবো না। আর আপনি কি বললেন, আমার বোনকে কেউ বিয়ে করবে না? তাহলে শুনুন, আমার বোনেরও বিয়ে হবে আর অনেক ভালো ছেলের সাথেই হবে। সেই বিয়েতে আপনাদের অবশ্যই দাওয়াত দেবো। সেই দিন আসবেই। কারণ পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে। যারা ভালোবাসাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়। তারা আপনাদের মতো নিচু মনের মানুষ নয়। আমার ধৈর্যের বাধ পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার আগে আপনারা বিদায় হন। জাস্ট আউট!”
অপমানের গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যান ভদ্র মহিলা তার স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে। ঘটকও ব্যাঙ্গাত্বক চোখে তাকিয়ে চলে যায়। সবাই যেতেই রুমের পরিবেশ একদম শান্ত হয়ে যায়। নিরবতা ছড়িয়ে পড়ে রুম জুড়ে। শুধু শোনা যায় পরিবারের এক-একটা সদস্যের দীর্ঘশ্বাস।
নিরবতা ভেঙে সবার আগে মুখ খোলে প্রাপ্তি। এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এখন আর চুপ থাকতে পারছে না। সোফায় বসেই মাটির দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
—“এবার খুশি তো সবাই? শিক্ষা হয়েছে নাকি আরো বাকি আছে? সখ মিটেছে নিজের অন্ধ মেয়েকে বিয়ে দেয়ার?”
শেষের কথাটা প্রাপ্তি মারুফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে। চোখ ভরে আসে মারুফ সাহেবের। তিনি তো এমনটা চান নি। তিনি তো নিজের মেয়ের ভালোই চেয়েছিলেন। মেয়ের সুখের একটা সংসার হোক সেটা চেয়েছিলেন। কিন্তু এমন কেনো হলো? সবার নিরবতা দেখে প্রাপ্তি আবার বলে,
—“তোমরা মানো আর না মানো, তোমাদের মেয়ে অক্ষম। আর এটাই সত্যি। কেউ জেনে বুঝে কোনো অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে না। আমি বাবাকে তখনই মানা করতে পারতাম কিন্তু করিনি। কারণ বাবার একটা শিক্ষা পাওয়া দরকার ছিলো। আমার মানা শুনে আজ হয়তে চুপ হয়ে যেতো কিন্তু কাল আবার একই পাগলামি করতো। তাই এই শিক্ষাটা জরুরি ছিলো। আশা করি আমার বিয়ের ভূত সবার মাথা থেকে নেমে গেছে।”
কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে মারুফ সাহেব বলেন,
—“আম্মু আমি তো……….
—“তুমি আমার মুখের হাসিটাই দেখেছো আব্বু। কিন্তু সেটা আনন্দের হাসি নাকি তাচ্ছিল্যের হাসি সেটা বোঝোনি। আগে সন্তানের মন বুঝতে শেখো। একই ভূল আর কতবার করবে?”
কথাগুলো বলেই উল্টো ঘুরে রুমের দিকে পা বাড়ায় প্রাপ্তি। সুপ্তি এগিয়ে এসে হাত ধরতেই থেমে যায় প্রাপ্তির পা। সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
—“আমি জানি আমি অন্ধ। বারে বারে সেটা মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই সুপ্তি। আমি একা চলতে পারি।”
কথা শেষ হতেই একা একা হাতড়ে এগোতে থাকে প্রাপ্তি। পা গুনে গুনে রুমে গিয়ে খট করে দড়জা বন্ধ করে দেয়। প্রাপ্তি চলে যেতেই নিজের বাবার দিকে অভিমানী চোখে তাকায় দীপ্তি। বাবার প্রতি রাগটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। মুখে কিছু না বলে ধুপধাপ পা ফেলে সেখান থেকে চলে যায় দীপ্তি। বাবার প্রতি অভিযোগ গুলো সে সজীবের সামনে প্রকাশ করতে চায় না। তাই নিজেই সেখান থেকে চলে যায়।
______________
স্কুলের সব কাজ শেষ করে অর্পনের বের হতে হতে দুপুর পেরিয়ে গেছে। এখন প্রায় সন্ধ্যা। মাত্রই সিলেটের সীমানা পেরিয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে অর্পন ফোনটা হাতে নেয় সময় দেখতে। ফোনের স্ক্রিনে সুজনের বারো বার মিসড কল দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অর্পন। পরোক্ষনেই ফোনটা আবার যথাস্থানে রেখে দেয়। প্রাপ্তির বাসার কেউ টয়লেটে গেলেও সেই খবর জানাতে ফোন দেয় বোকা। এখন হয়তো কেউ ছাঁদে গেছে তাই ফোন দিয়েছে।
ফোনটা রেখে সামনে রাস্তার দিকে তাকায় অর্পন। যা হয়েছে বাসায় গিয়ে কাল দেখে নেবে। একবার পাশ ফিরে বকুলের দিকে তাকায়। মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। মুখে তার একরাশ খুশি। ভাইয়া ভাবির সাথে দেখা করতে যাচ্ছে ভেবেই আনন্দের বাঁধ মানছে না বকুলের।
বকুলের হাসি খুশি মুখটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে অর্পন। মেয়েটা যখন সত্যি জানবে তখন কিভাবে রিয়্যেক্ট করবে কে জানে? ভাবতে ভাবতে অর্পন রাস্তার চারিদিকে নজর বুলায়। হঠাৎ সামনের আয়নায় খেয়াল করে একটা গাড়ি ওদের পেছন পেছন আসছে। যদিও রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি চলাফেরা করে, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়টাও অস্বাভাবিক লাগছে অর্পনের কাছে। কারণ গাড়িটা অনেক্ষণ আগে অর্পনের গাড়ির পেছনে ছিলো। এখনো অর্পনের গাড়ির পেছনেই আছে।
সতর্ক চোখে চারিদিকে নজর বুলায় অর্পন। অর্পনের কেনো যেনো মনে হচ্ছে গাড়িটা ওদের ফলো করছে। নিশ্চিত হতে অর্পন একটু পরিক্ষা করে। রাস্তার মোড় আসতেই অর্পন সোজা না গিয়ে গাড়ি বাম দিকের রাস্তায় ঘুরিয়ে নেয়।
পেছনের গাড়িটাও তখন বাম দিকের রাস্তায় গাড়ি ঢোকায়। এবার অর্পন শতভাগ নিশ্চিত কেউ ওদের পিছু নিয়েছে। আর পেছনের গাড়িতে যারা আছে তারা যে বকুলকে নিয়ে যেতে এসেছে সেটাও অর্পন বেশ বুঝতে পারছে। হিসাব মিলতেই শক্ত হয়ে বসে অর্পন। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে। দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ধরে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করে। যা কিছুই হয়ে যাক বকুলকে বাঁচাতেই হবে। তাতে নিজের প্রাণ গেলে যাক।
চলবে?