তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-১৪

0
89

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৪
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে অর্পন। সেই সাথে বেড়েছে পেছনের গাড়ির গতিও। পেছনের গাড়িটাও অর্পনের সাথে তালে তাল মিলিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের আলো জ্বালিয়ে ছুটে চলেছে দুটো গাড়ি। ফাঁকা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ দাড়িয়ে আছে। একটু ভেতরের দিকের রাস্তা হওয়ায় মানুষের কোনো চিহ্নও নেই। চারিদিকে শুধু জঙ্গলে পরিপূর্ণ। অর্পন জেনে বুঝেই এই রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়েছে। যাতে তাদের সংঘর্ষে কোনো সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

এদিকে ভয়ে জমে গেছে বকুল। কি থেকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে গাড়ির এমন বেপরোয়া গতি দেখে ভয়ে তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। ভয়ে এক পর্যায়ে কেঁদেই ফেলে বকুল। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

—“পেছনের লোকটা কে? আমাদের পিছু নিয়েছে কেনো?”

বকুলের কথা শুনে অর্পনের মনোযোগ চলে যায় বকুলের দিকে। তাকিয়ে দেখে ভয়ে মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা। অর্পন অভয় দিয়ে বলে,

—“একদম ভয় পাবে না বকুল। যতক্ষণ আমি তোমার সাথে আছি তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। ওরা কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। কিন্তু সফল হতে পারবে না। তুমি চুপচাপ বসে থাকো।”

বকুলের সাথে কথা বলতে গিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য রাস্তা থেকে মনোযোগ সরে যায় অর্পনের। তখন পেছন থেকে হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজে অর্পনের গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। ঝনঝন শব্দে নিচে পড়ে যায় কাচগুলো। হঠাৎ আওয়াজ শুনে পেছনে তাকাতে গিয়ে গাড়িটা সামনের বড় একটা গাছের সাথে বেশ জোরেশোরে ধাক্কা খায়। তাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে যায় দু’জনেই। কপালে আঘাত লেগে রক্ত বের হতে শুরু করে দেয়।

ভয়ে বকুল থরথর করে কাপছে। অর্পন মুখে “ওহ্ শিট” বলেই স্টিয়ারিং ঘোরায়। দক্ষ হাতে গাড়ি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। কথা বলতে গিয়ে সব আয়ত্তের বাইরে চলে গেছিলো। চোয়াল শক্ত করে গাড়ি ছোটাতে থাকে অর্পন। বকুল যদি গাড়িতে না থাকতো তাহলে সবগুলোকে দেখে নিতো অর্পন। এসব ছোটখাটো চুনোপুঁটিদের অর্পন কখনো ভয় পায় না। আর এদের ভয়ে উচ্চ গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে পালানোর তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অর্পনের চিন্তা বকুলকে নিয়ে। এই মেয়েটার কোনো ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না। বকুলকে কোনো নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে পারলে তারপর দেখে নেবে এদের।

স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে দক্ষ হাতে গাড়ি চালাতে থাকে অর্পন। ডানে বামে গাড়ি ছুটিয়ে পেছনের লোকগুলোকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে পেছন থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। ওরা যে অর্পনের গাড়ির টায়ারকে টার্গেট করছে সেটা বুঝতে অর্পনের বাকি নেই। তাই গাড়ি এলোমেলো পথে চালাতে শুরু করে অর্পন।

বকুল এবার ভয়ে আরো গুটিয়ে গেছে। গুটিশুটি মেরে বসে থরথর করে কাপছে। আর কোনো উপায় না দেখে অর্পন নিজের রি*ভ*ল*বা*র*টা বের করে। এটা দেখে বকুলের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।

অর্পন বাম হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত বাহিরে বের করে। শু*ট করতেই ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায় পেছনের গাড়ির সামনের কাচ। কিছুটা গতি থেমে যায় তাদের। তাল সামলে তারা আবার গাড়ি ছোটায়। তবে কয়েক সেকেন্ড বিরতি নেয়ায় অর্পনের থেকে কিছুটা দূরে চলে গেছে।

তবে অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে তারা। গুলি গুলো লাগছে অর্পনের গাড়ির বডিতে। সামনেই রাস্তায় তিনটা মোড়। এখানে ওদের থামাতে হবে। কথাটা ভাবতেই হাত বের করে অর্পন। টার্গেট করে ওদের গাড়ির চাকা। কিন্তু গুলি চালানোর আগেই পেছনের গাড়ি থেকে ছোরা একটা গুলি এসে লাগে অর্পনের ডান হাতের বাহুতে।

ব্যাথায় ছিটকে যায় অর্পনের হাত। কেঁপে ওঠে স্টিয়ারিং ধরে রাখা হাত। বেতাল হয়ে যায় গাড়ির গতি। পরোক্ষনে আবার স্টিয়ারিং সামলে নেয় অর্পন। ব্যাথার পরোয়া না করে হাত বের করেই গুলি চালায়। গুলিটা গিয়ে লাগে সোজা পেছনের গাড়ির টায়ারে। কমে যায় তাদের গাড়ির গতি। ডান দিকে মোড় নিয়ে জঙ্গলের দিকে যেতে থাকে গাড়ি।

উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে দেখে হাত ভেতরে ঢোকাতে যায় অর্পন। তবে আরো একটা গুলি এসে লাগে অর্পনের ডান হাতের কব্জিতে। হাতে ধরে রাখা রি*ভ*ল*বা*র টা ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। ব্যথায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় অর্পন। সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ খুলে ফেলে। বকুল গোলাগুলির শব্দ শুনে দুই হাতে কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এক নজর বকুলকে দেখে নিয়ে বাম হাতেই গাড়ি চালাতে থাকে অর্পন। ইতিমধ্যে তিন রাস্তার মোড় এসে গেছে।

আগে পিছে না তাকিয়ে অর্পন গাড়িটা বাম পাশের রাস্তায় ঘুরিয়ে নেয়। গাড়ি ঘোরাতেই আবার সর্বোচ্চ গতিতে চালাতে শুরু করে। পেছনের লোকগুলো আসতে আসতে কিছুটা দেরি হয়ে যাবে। আসার পর এখানে তিনটা রাস্তা দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে যে অর্পন ঠিক কোন রাস্তায় গেছে। যদি বুঝেও যায়, ততোক্ষণে অর্পন বকুলকে নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে পৌঁছে যাবে। এটাই ছিলো অর্পনের পরিকল্পনা।

জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে মেইন রোডে উঠতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রাত সাড়ে নয়টা বাজে। ফোনটা নিয়ে লকটা খোলে। দু দুটো গুলি লাগায় ডান হাতটা অসার হয়ে গেছে অর্পনের। খুব তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। শেষে এসে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তাই ব্যথাকে উপেক্ষা করে ডায়াল করে অঙ্কনের নাম্বারে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অঙ্কন বলে,

—“ভাই তুমি কোথায়? না বলে চলে গেছো, ফোন তুলছো না। মা বারে বারে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছে।”

অর্পনের শরীরের শক্তি যেনো ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। ব্যথায় পুরো শরীর অসার হয়ে আসছে। কোনোমতে ফোনটা ধরে বলে,

—“নুহাশ কাকুর বাসায় চলে আয়। এক্ষুনি।”

নুহাশ কাকুর নাম শুনতেই ভ্রু কুচকে যায় অঙ্কনের। কপালে পড়ে চিন্তার ভাজ। অর্পন যখনই কোনো বিপদজনক কাজে গিয়ে আহত হয়ে ফেরে তখন সে নুহাশ কাকুর বাসায় গিয়ে ওঠে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তারপর বাড়ি ফেরে। চিন্তিত ভঙ্গিতে অঙ্কন বলে,

—“ভাই আবার! তুমি কোনোদিন শুধরাবে না তাই না। আচ্ছা আসছি।”

এটুকু বলেই ফোনটা পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অঙ্কন। ফোন কাটতেই অর্পন একবার তাকায় বকুলের দিকে। মেয়েটা এখনো গুটিশুটি মেরে বসে আছে। ভয়ে থরথর করে কাপছে পুরো শরীর। আচমকা আক্রমণ হওয়ায় ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। অর্পন কিছু না বলে গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগ দেয়। এক হাতে গাড়ি চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু হার মানলে চলবে না। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে নুহাশ কাকুর বাসায়। এখন হার মানার প্রশ্নই ওঠে না।

________________

জানালার কাছে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। তবে জানালার বাহিরে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতা তার নেই। সে তো চোখেই দেখে না। তাই জানালার কাছে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য বাহিরের দৃশ্য দেখা নয়। প্রকৃতিকে অনুভব করা। এই যে হালকা বাতাস এসে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তির চোখ, মুখ, শরীর। সিক্ত করছে প্রাপ্তিকে। এটা অনুভব করার মধ্যে আলাদা একটা তৃপ্তি আছে। ক’জন পারে, প্রকৃতিকে এভাবে অনুভব করতে।

প্রাপ্তির পাশে দাড়িয়ে আছে দীপ্তি আর সুপ্তি। দু’জনেরই মন খারাপ। প্রাপ্তিকে এমন চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওরাও কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। আজ এতো অপমান হওয়ার পর প্রাপ্তি নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। এটা ভেবেই ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে দুই বোনের। নিরবতা ভেঙে দীপ্তি আগে বলে,

—“মন খারাপ করে আছিস কেনো প্রাপ্তি? যার তার কথায় মন খারাপ করতে নেই। আরে ওই লোকগুলো গাধা ছিলো তাই হীরে চিনতে পারেনি। না হলে ঠিক চিনতো।”

বড় বোনের কথায় তাল মিলিয়ে সুপ্তি বলে,

—“মহিলাটা মনে হয় কানা। তাই চিনতে পারেনি।”

সুপ্তির কথা শুনে চুপ হয়ে যায় দীপ্তি। ভ্রু কুঁচকে পেছনে ঘুরে দাড়ায় প্রাপ্তি। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে প্রাপ্তি আর দীপ্তি একসাথে হেঁসে ওঠে। দুই বোনের হাসি দেখে লজ্জা পেয়ে যায় সুপ্তি। দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়।

সুপ্তি যেতেই হাসি থেমে যায় দুই বোনের। স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। বোনের দুই হাত মুঠো করে ধরে বলে,

—“দাদাভাই কোথায় আপি? তার কোনো আওয়াজ পাচ্ছি না যে!”

—“অফিসে কিছু গন্ডগোল হয়েছে তাই চলে গেলো। তবে মজার বিষয় হলো আজ আমি এখানে থাকবো। সারারাত দুই বোন খুব গল্প করবো।”

—“আরে বাহ্। এতো দারুণ ব্যপার। কিন্তু অফিসে কি গন্ডগোল হলো? বলেছে কিছু?”

একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে দীপ্তি। হতাশ কন্ঠে বলে,

—“কাজের বিষয়ে সে আমাকে কিছুই বিস্তারিত বলে না। তাছাড়া আমার কি? আমি বাড়ির বৌ, সংসার সামলানো আমার কাজ। ওসব দেখে আমার কাজ নেই।”

দীপ্তি হাসি খুশি আওয়াজেও বিষাদের ছোঁয়া পাচ্ছে প্রাপ্তি। বোনের হাত শক্ত করে মুঠো করে ধরে বলে,

—“তুমি ডাক্তারি পড়া কমপ্লিট করতে পারলে কত ভালো হতো আপি। তোমার তো স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়ার।”

এই পর্যায়ে মিলিয়ে যায় দীপ্তির মুখের হাসি। মুখে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ বিষাদ। জেগে ওঠে পুরনো কষ্ট। দীপ্তির স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু বিয়ে করে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলো। সেই সাথে তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নও মাটির নিচে চাপা পড়ে গেলো। মাথা নিচু করে দীপ্তি বলে,

—“জরুরি নয় সবার সব ইচ্ছে পূরণ হবে। ভালো একটা স্বামী পেয়েছি এটাও বা কম কি? সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। অনেক সুখে রেখেছে। আর কিছু চাই না আমার।”

বোনের মন খারাপ ঠিক করতে কথা ঘুরিয়ে ফেলে প্রাপ্তি। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,

—“ছাড়ো তো ওসব আপি। অন্য কথা বলি। সুপ্তি কোথায় গেলো? ডাকো তো ওকে। তিন বোন একসাথে বসে আড্ডা দেই।”

প্রাপ্তির কথা শুনে হেসে ফেলে দীপ্তি। প্রাপ্তিকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে,

—“ডেকে নিয়ে আসি বিচ্ছুটাকে। এসে গানের কলি খেলবো।”

কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় দীপ্তি। অনেকদিন পর বোনদের সাথে থাকার সুযোগ পেয়েছে। তাই একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না।

__________________

একটা দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামায় অর্পন। গাড়ি থেকে নেমে অপর পাশে এসে দড়জা খুলে দেয়। বকুল এখনো ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। অর্পন বাম হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে অভয় দিয়ে বলে,

—“ভয় নেই বকুল। তুমি এখানে নিরাপদ। চলো আমার সাথে।”

মনে একরাশ ভয় নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখে অর্পনের হাতে। গাড়ি থেকে নেমে অর্পনের সাথে এগিয়ে যায় দোতলা বাড়িটার দিকে। কলিং বেল বাজিয়ে একটু দাঁড়ায় অর্পন।

টিভির সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছিলো নুহাশ। এমন সময় কলিং বেল বাজায় কপাল কুঁচকে যায় তার। এতো রাতে আবার কে আসলো? এদিকে টিভিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ খবর দেখছে সে। তাই নিজে না উঠে নজর টিভির দিকে রেখেই বলে,

—“দরজাটা একটু খোলো তো।”

কথাটা বলা মাত্রই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে হুঙ্কার। সাথে বাসন পত্রের উপর দিয়ে বয়ে যায় টর্নেডো। রান্নাঘর থেকে হুঙ্কার দিয়ে তার স্ত্রী বলে ওঠে,

—“হ্যা হ্যা, জগতের সব কাজ তো আমি একাই করবো। বাহিরে কাজও করবো। বাসায় খাবারও বানাবো। বাসনও আমিই মাজবো। দরজাও আমিই খুলবো। আর তুমি পায়ের ওপর পা তুলে খালি আরাম করবে। একটা কাজ করো, একটা হাতুড়ি এনে দাও। বাড়িটা ভাঙার কাজ আমিই করি।”

রান্নাঘরের গর্জন শুনে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে নুহাশ। বিড়বিড় করে বলে,

—“বৌ তো নয় যেনো ভূমিকম্প।”

বিড়বিড় করতে করতে গিয়ে দড়জা খুলে দেন। দড়জার বাহিরে অর্পনকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় নুহাশ। হঠাৎ চোখ যায় অর্পনের কপালে। সেখান থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তারপর নজর পড়ে অর্পনের পেছনে গুটিশুটি মেরে দাড়িয়ে থাকা বকুলের দিকে। তার কপালেও রক্ত। ঠোটের কোণে রক্ত। এসব দেখে আঁতকে ওঠে নুহাশ। তাড়াহুড়ো করে কিছু জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিতে অর্পনের হাত ধরতেই অর্পন ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে।

চমকে ওঠে নুহাশ। আহাজারি কন্ঠে বলে,

—“হায় আল্লাহ্! এসব কিভাবে হলো? তাড়াতাড়ি ভেতরে আয়। রুবিয়া, তাড়াতাড়ি আসো। দেখো কি হয়ে গেছে।”

শেষের কথাটা নিজের স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে। নুহাশের এমন ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে রুবিয়া। ততোক্ষণে অর্পন বকুলকে নিয়ে সোফায় বসেছে। অর্পনের এমন রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় রুবিয়ার। অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে রুবিয়া বলে,

—“তোর এই স্বভাব কোনোদিন বদলাবে না তাই না অর্পন? মানে, যা কিছুই হয়ে যাক নিজেকে বিপদে ফেলা চাই।”

রুবিয়ার কথা শুনে হালকা হাসে অর্পন। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলে,

—“আমার চাকরিটাই তো এমন রুবিয়া কাকি। তুমি একটু বকুলকে দেখো প্লিজ। অনেক আঘাত পেয়েছে মেয়েটা।”

চিন্তিত ভঙ্গিতে বকুলের পাশে বসে রুবিয়া। সোফার পাশের টেবিল থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে তুলো দিয়ে বকুলের রক্ত পরিস্কার করতে থাকে। এদিকে অর্পনেরও কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে। হাতের রক্ত চুইয়ে চুইয়ে ফ্লোরে পড়ছে। রুবিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে নুহাশকে বলে,

—“ছেলেটার অনেক রক্ত বের হচ্ছে। এই ওষুধ তুলোতে নিয়ে লাগিয়ে দাও তো।”

রুবিয়ার কথা শুনে ভয়ে আঁকতে ওঠে নুহাশ। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,

—“না বাবা না, একদম না। আমার এসব রক্ত দেখলে মাথা চক্কর দেয়। আর তাছাড়া নার্স তুমি, তাই এটা তোমার কাজ। আমি পারবো না।”

নুহাশের দিকে কটমট চোখে তাকায় রুবিয়া। এই দুজনের মধ্যে কোনো মিল নেই। একজন উত্তর তো অন্যজন দক্ষিণ। কখনো কোনো কাজে বা কোনো কথায় মিল পড়ে না। দুজনের চোখে চোখে যুদ্ধ দেখে অর্পন বলে,

—“অঙ্কন আসছে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। রুবিয়া কাকি, তুমি বকুলকে দেখো।”

কথা শেষ হতেই অঙ্কন সেখানে চলে আসে। সাথে এসেছে সাগরও। অর্পনকে এই অবস্থায় দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে অঙ্কন। রীতিমতো হাত পা কাপছে অঙ্কনের। সাগর গিয়ে অর্পনের পাশে বসে দেখতে থাকে কোথায় কোথায় আঘাত পেয়েছে।

এরই মাঝে বকুলের সব আঘাত পাওয়া জায়গায় ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেছে। রুবিয়া বকুলকে একটা রুমে নিয়ে যায়। মেয়েটার বিশ্রামের প্রয়োজন।

রুবিয়া বকুলকে নিয়ে যেতেই সাগর নিজের ব্যাগ থেকে সরঞ্জাম বের করে। অঙ্কন কপালের রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দেয়। আর সাগর অর্পনের হাতের গুলি দুটো বের করতে থাকে। ব্যথায় হাত অবশ হয়ে গেছে অর্পনের। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ব্যথা সয্য করে যাচ্ছে।

গুলি দুটো বের করতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। ব্যথায় পুরো মুখ নীল হয়ে গেছে তার। সোফার ওপরেই ছেড়ে দেয় শরীর। ব্যান্ডেজ হয়ে যেতেই নুহাশ কিছুটা রেগেই বলে,

—“বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে অর্পন। এভাবে বারে বারে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়ার মানে কি? প্রতিবার একটা করে অঘটন ঘটাবি আর মাঝ রাতে নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীর টেনে নিয়ে এখানে চলে আসবি। আমাদের ইমোশনের কোনো দাম নেই তাই না। এবার আমি ভাইয়া ভাবিকে বলেই দেবো।”

নুহাশের কথায় হালকা হাসে অর্পন। কথা বলতে একটু কষ্টই হচ্ছে। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে একদম। কিছুটা জোর খাটিয়ে অর্পন বলে,

—“আমি একজন পুলিশ অফিসার নুহাশ কাকু। এতটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে।”

আর কিছু বলে না অর্পন। একটু বিশ্রমের প্রয়োজন। শরীর আর নিতে পারছে না। অর্পনের শরীরের অবস্থা বুঝতে পেরে নুহাশও আর তর্ক বাড়ায় না। সাগর আর অঙ্কনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“ওকে আমার রুমে নিয়ে যা। কিছুক্ষণ রেস্ট করুক। একটু সুস্থ হলে বাসায় নিয়ে যাস। এই অবস্থায় বাসায় গেলে ভাইয়া ভাবি চিন্তায় হার্টঅ্যাটাক করবে।”

নুহাশের কথার বিপরীতে সাগর বলে,

—“আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি নুহাশ কাকু। আজ রাত দুজন আমার কাছেই থাক। ভালো মন্দ কিছু হলে আমি দেখে নেবো। তোমরা ওই মেয়েটার খেয়াল রেখো। কাল শুনবো সব বিস্তারিত।”

নুহাশ আর অমত করে না। সাগরের কাছে থাকলে নুহাশ নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে। তাই যেতে দেয়।

_______________

এদিকে বকুলকে অর্পন নিয়ে গেছে কথাটা শোনার পর থেকে একাধারে সবকিছু ভাঙচুর করে যাচ্ছে বস। নিজের হার সে কিছুতেই মানতে পারছে না। পাশের রুমে বসের চিৎকার চেচামেচি আর ভাঙচুরের আওয়াজ শুনে বাঁকা হাসে রুহুল। বিড়বিড় করে বলে,

—“পারবি না, তুই কোনোদিন জিততে পারবি না। এভাবেই তোর সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। একবার শুধু অর্পনের সাথে আমার দেখা হতে দে। তারপর দেখ তোর কি অবস্থা হয়। অর্পন চোখের পলকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে তোর পাপের সম্রাজ্য। শুধু তোকে ওর চিনতে যতক্ষণ।”

চলবে?