তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-১৭+১৮

0
95

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৭
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

অল্প আলোতে পরিপূর্ণ একটা ঘর। ঘরের মাঝ বরাবর অবস্থান করছে একটা বড়সড় রাজকীয় খাট। শুভ্র চাদরে ঢেকে রাখা খাটের ওপর শুয়ে আছে একজন যুবক। বয়সটা আনুমানিক চব্বিশ কি পঁচিশ হবে। জীর্ণশীর্ণ রোগাক্রান্ত মুখটা বেরিয়ে আছে চাদরের ফাঁকে। বাকি শরীর শুভ্র চাদর দিয়ে ঢাকা। ডান হাতটা চাদরের ফাঁক দিয়ে বের করে রাখা। সেখানে ক্যানুলা লাগানো রয়েছে। অবিরাম ভাবে স্যালাইন চলছে সেই হাতে। পাশেই একজন অল্প বয়সী নার্স বসে আছে। নজর তার বিছানায় শয়নরত সেই যুবকটির দিকে। চোখ বন্ধ করে নিথর হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। শুধু শ্বাস প্রশ্বাস চলছে এই যা। কখনো চোখ খুলে তাকায় না।

বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ নার্সটা খেয়াল করে ছেলেটার ক্যানুলা লাগানো হাতটা নড়ছে। হাতের তর্জনি আঙ্গুল একটু একটু করে নড়ছে। চোখে পড়তেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় নার্স। মনের ভূল কি না যাচাই করতে হাত দিয়ে চোখ ডলে আবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

এবারেও আঙ্গুলের মৃদু নড়াচড়া দেখতে পায়। এটা যে তার চোখের ভূল নয় সেটা বুঝতেই হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ঘরের জানালার দিকে এগিয়ে যায়। ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করে কারো নাম্বারে। রিং বাজতেই সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ হয়ে যায় ফোন। রিসিভ হতেই নার্সটা তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলে,

—“ম্যাম, পেসেন্ট রেসপন্স করছে। তার হাতের আঙুল নড়ছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”

সাথে সাথে খট করে ফোনটা কেটে যায়। নার্স বুঝতে পারছে যে অপর পাশের ব্যাক্তি দিন দুনিয়ায় ভূলে ছুটে আসছে এখানে।

———————–

নিজের রুমে খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে দীপ্তি। গত রাত থেকে এভাবেই বসে আছে। সজীব রেগে ওই নিষিদ্ধ ঘরের সামনে থেকে নিজের ঘরে এনে আর একটা কথাও বলেনি দীপ্তির সাথে। ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দড়জা বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেছে। সেই যে গেছে আর ঘরে আসেনি। রাত পেরিয়ে সকাল, সকাল পেরিয়ে দুপুর, এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো তবুও সজীবের খবর নেই। না দড়জা খুলে দিয়েছে, আর না খাবার দিয়েছে। আজকাল সজীব বড্ড অদ্ভুত আচরণ করে। কেনো এমন করে সেটা দীপ্তি বোঝে না। আগে তো এমন করতো না। তবে কি বাচ্চা না হওয়ার জন্য সজীব দীপ্তির প্রতি অসন্তুষ্ট? সে কি দিপ্তিকে আর চাইছে না? বাচ্চার জন্য কি সজীব অন্য কাউকে জীবনে আনতে চাইছে? এজন্য এই অদ্ভুত আচরণ?

কথাগুলো ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে দীপ্তির। এতো বছর ধরে সংসার করার পরও আজ মানুষটাকে বড্ড অচেনা লাগছে। চোখের সামনে তার সাজানো সংসার ভেঙে যাচ্ছে। তবে কি এবার সম্পর্কটাও ভেঙে যাবে?

ভাবনার মাঝেই খট করে দড়জা খোলার আওয়াজ পায় দীপ্তি। কে আসতে পারে সেটা দীপ্তি খুব ভালো করেই জানে। তাই কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের পাতা এক করতেই অবাধ্য অশ্রু কণা টপটপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

দড়জা খুলে ঘরে প্রবেশ করে সজীব। আবার একই ভঙ্গিতে দড়জা আটকে ধীর পায়ে দীপ্তির দিকে এগিয়ে আসে। কাছে আসতেই দীপ্তির কান্নারত মুখটা চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়। দীপ্তির চুপসানো মুখটা দেখে বুকের ভেতর সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে সজীব। ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করছে, বড্ড অস্থির লাগছে। কিন্তু চেহারায় তা প্রকাশ করছে না। যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় আছে সে।

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে দীপ্তর মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখতেই চোখের নিয়ে চিকচিক করতে থাকা অশ্রু কণা দেখতে পায় সজীব। মুখে এটে রাখা গম্ভীর ভাব, সব কঠোরতা এক নিমেষেই উবে যায়। ধপ করে হাঁটু মুড়ে দীপ্তির পায়ের কাছে বসে পড়ে সজীব। আহত চোখে তাকায় দীপ্তির দিকে।

সামনে কিছু পড়ার শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকায় দীপ্তি। তাকাতেই হাঁটু মুড়ে বসে থাকা সজীবের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে সোজা হয়ে বসে বলে,

—“কি হয়েছে তোমার? চোখ এতো লাল কেনো?”

সজীব এক দৃষ্টিতে দীপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের কোথাও একটা অপরাধবোধ সজীবকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডান হাতটা এগিয়ে নিয়ে যায় দীপ্তির দিকে। খুবই সপ্তপর্ণে দীপ্তির বাম গালে নিজের ডান হাত রেখে সচ্ছ চোখে তাকায়। সজীবের ঠোঁট কাঁপছে। কিছু যেনো বলতে চাইছে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই চুপ হয়ে যায় সজীব। তড়িৎ গতিতে হাতটা নামিয়ে নেয়। তৎক্ষনাৎ দাড়িয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,

—“কাল তুমি যে ভূলটা করেছো তার জন্য এবার বাড়িতে ঝড় উঠবে। সেই ঝড় সামলানো হয়তো আমার সাধ্যের বাইরে। শত নিষেধ করার পরেও তুমি আমার কথা শুনলে না। সেই বাড়াবাড়ি করেই বসলে। এবার একটা মেহেরবানি করো, তুমি এক্ষুনি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। আমি না বলা পর্যন্ত এখানে আসার দরকার নেই।”

অবাক চোখে তাকিয়ে সজীবকে দেখছে দীপ্ত। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক সজীব কখনো দিপ্তিকে নিজের কাছ থেকে দূরে যেতে দেয় না। তাহলে আজ একটা সামান্য বিষয় নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে বলছে। কত সহজেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা কে? এই সজীব তো তার চেনা নয়। তার সজীব তো এমন না। এ কোন মুখোশধারী মানুষ দাড়িয়ে আছে দীপ্তির সামনে? ভাবতে ভাবতেই চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নাক টেনে ধরা গলায় দীপ্তি বলে,

—“একটা সামান্য দোষে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছো সজীব! অথচ কোনো একটা সময় বলতে আমাকে বুকে না নিলে তোমার ঘুম আসে না। এখন ঘুম আসবে তো সজীব? আমি জানি না আমার কি অপরাধ। কোন অপরাধের শাস্তি তুমি দিচ্ছো! কিন্তু শাস্তি ঘোষণা যখন দিয়েই ফেলেছো তাহলে আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবো না। আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।”

সজীব উল্টো দিকে মুখ দিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। একবারের জন্যও দীপ্তির দিকে তাকাচ্ছে না। সজীবের এমন অদ্ভুত ব্যবহার দেখে ক্ষনে ক্ষনে আশ্চর্য হচ্ছে দীপ্তি। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ড্রয়ার থেকে পার্সটা নিয়ে সোজা বেরিয়ে যায়। সাথে আর কিচ্ছু নেয়ার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই তার শরীরে।

দীপ্তি চলে যেতেই দড়জার দিকে ঘুরে তাকায় সজীব। চোখ দুটো তার লাল হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত করে নিজেকে শান্ত করছে। ধীর পায়ে এগিয়ে বড় জানালার কাছে দাঁড়ায় সজীব। রুমের জানালা দিয়ে বাড়ির গেট স্পষ্ট দেখা যায়। মিনিটের মধ্যেই দীপ্ত গেটের কাছে চলে গেছে। সেদিকে দৃষ্টি রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে কারো নাম্বারে ডায়াল করে সজীব। রিসিভ হতেই শান্ত কন্ঠে সজীব বলে,

—“খেয়াল রাখিস। সাবধানে বাসায় পৌঁছে দিবি। বাসার গেটে ঢোকার পর ফোন করে জানিয়ে দিস। আর হ্যা, গাড়ির স্পিড যেনো না বাড়ে। ওর গায়ে একটা আঁচড়ও লাগলে তোকে জ্যান্ত পু*তে ফেলবো।”

কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে পকেটে রাখে সজীব। দীপ্ত অটোতে উঠে চলে যেতেই জানালা থেকে সরে আসে সজীব। খাটের ওপর বসে মাথা নিচু করে কিছু ভাবতে থাকে। তারপর হুট করে উঠেই, হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

—————————

ঘড়িতে এখন পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। নুহাশের বাসায় সোফার ওপর অঙ্কন, সাগর, রুবিয়া আর নুহাশ বসে আছে। তাদের সাথে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বকুলও বসে আছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অর্পনের জন্য। নিজের সাথে ঘটা সেই হামলার দৃশ্য বকুলের মস্তিষ্কে বেশ বাজে প্রভাব ফেলেছে। মেয়েটা এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। তাই চুপচাপ বসে আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্পন সেখানে উপস্থিত হয়। অর্পনকে দেখে নড়েচড়ে বসে সবাই। বকুল কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এতোগুলা অচেনা মানুষের ভীড়ে এক অর্পনকেই সে চেনে। অর্পন এসেই সোফাতে গা এলিয়ে দেয়। গরমের খুবই ক্লান্ত লাগছে। মাথার দুই পাশে ঘেমে শ্বেত কণা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে রুবিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“রুবিয়া কাকি! এক গ্লাস ঠান্ডা পানি প্লিজ।”

রুবিয়া তৎক্ষনাৎ উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে। এক নিশ্বাসের পানিটা শেষ করে লম্বা করে দম ছাড়ে অর্পন। এরপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় বকুলের দিকে। মেয়েটা আগ্রহ চোখে তাকিয়ে আছে। বকুলের দিকে চোখ রেখেই অর্পন বলে,

—“এখন শরীর কেমন বকুল?”

—“এখন ভালো। কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আমাকে ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাবেন। তাহলে এখানে কেনো রেখেছেন আমাকে?”

বকুলের কথা শেষ হতেই ছোট্ট করে দম নেয় অর্পন। উপস্থিত সবাই নিরব স্রোতা হয়ে বসে আছে। সবার দিকে একনজর তাকিয়ে অর্পন বলে,

—“তোমার ভাইয়ার বিষয়ে বলতেই এখানে এসেছি। যদিও কথাগুলো আগেই তোমাকে জানানো উচিত ছিলো কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক ছিলো না, সাথে তোমার মানসিক অবস্থাও ভালো ছিলো না। তাই সময় নিয়েছি। আমি এখন যে কথাগুলো বলবো তা মন দিয়ে শুনবে। একদম হাইপার হবে না।”

অর্পনের কথা শুনে বুকের ভেতর টিপটিপ করছে বকুলের। কোনো অশনিসংকেত পাচ্ছে চারিদিক থেকে। কোনো খারাপ খবর শুনতে হবে না তো? ভয় ভয় চোখে অর্পনের দিকে তাকায় বকুল। একটু থেমে অর্পন ফের বলতে শুরু করে,

—“তোমার ভাইয়াকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বকুল। আমরা তাকেই খুঁজে চলেছি।”

অর্পনের কথা শুনে চমকে ওঠে বকুল। হুট করে দাড়িয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,

—“কি বলছেন এসব? খুঁজছেন মানে? আপনি তো বলেছিলেন আমাকে ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাবেন। তার মানে আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন? কোথায় আমার ভাইয়া? বলুন বলছি। কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন তাকে। আমি ভাইয়ার কাছে যাবো।”

বলেই কাঁদতে শুরু করে বকুল। অজানা ভয়ে তার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। রুবিয়া দৌড়ে এসে বকুলকে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। অনেক বুঝিয়ে আবার সোফায় বসিয়ে দেয়। বকুল কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকায়। অর্পনের একটা হাত ধরে ঝাকিয়ে বলে,

—“ভাবি? ভাবি কোথায়? আমি ভাবির কাছে যাবো। আমাকে ভাবির কাছে নিয়ে চলুন প্লিজ। আমি আর ভাবি দুজন মিলে ভাইয়াকে খুঁজে বের করবো। ঠিক খুঁজে বের করবো।”

অর্পন দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে বসে আছে। কথা বলার জন্য কোনো শব্দ খুজে পাচ্ছে না। বাচ্চা মেয়েটার কান্না দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে। কয়েক দফা হাতে টান পড়তেই চেহারা গম্ভীর করে ফেলে অর্পন। শক্ত কন্ঠে বলে,

—“তোমার ভাবির কাছেও যাওয়া সম্ভব নয় বকুল। কারণ ইভা মা*রা গেছে।”

অর্পনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় বকুল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য জমে বরফ হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় অর্পনের দিকে। পাগলের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,

—“না না না, মিথ্যে কথা। আপনি মিথ্যে বলছেন। এই সব মিথ্যে। ভাবি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না। সে বলেছিলো, সে সারাজীবন আমার পাশে থাকবে। তাহলে মরবে কেনো? মিথ্যে কথা এসব।”

একটা ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে অর্পন। গ্যালারিতে ঢুকে ইভার ডে*ড*ব*ডি*র একটা ছবি বের করে বকুলের সামনে সেটা ধরে বলে,

—“এটাই সত্যি বকুল। এই হলো তার প্রমান। তোমাকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।”

ফোনের দিকে তাকিয়ে ফের চোখ ভরে আসে বকুলের। ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বকুল। জীবনে এতো কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হবে সেটা কোনোদিন ভাবেনি বকুল। যেই ভাবির কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমিয়েছে। যেই ভাবির হাত মায়ের মতো স্নেহ নিয়ে মাথায় রেখেছে। আজ সেই ভাবি এই পৃথিবীতে নেই। যেই ভাইয়া বটগাছের ছাড়ার মতো বকুলকে আগলে রেখেছে। বাবার আদর, ভাইয়ের আদর একাই পূরণ করেছে। সেই ভাইয়াও নিখোঁজ। জীবনটা এমন কেনো হলো? একটা দমকা বাতাস যেনো সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেলো। এখন কোথায় পাবে বকুল তার ভাইয়া ভাবিকে? কোথায় পাবে সেই আদর, ভালোবাসা? বাকি জীবনটা কিভাবে বাঁচবে বকুল? কাকে নিয়ে বাঁচবে?

বকুলের কান্না দেখে রুবিয়া নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটা এতো কম বয়সেই এতোকিছু হারালো। এই শোক সামাল দেবে কিভাবে? উপস্থিত সবাই ব্যাথিত চোখে তাকিয়ে আছে বকুলের দিকে। অর্পন একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,

—“ইভা যেদিন খু*ন হয় সেদিন থেকেই রুহুল নিখোঁজ। অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তার কোনো হদিস মেলেনি। আমার টিম এখনো রুহুলকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ ইভার খু*ন, রুহুলের নিখোঁজ হওয়া। এর পেছনের কোনো শক্ত পোক্ত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।”

কান্না মাঝে হঠাৎ চোখ তুলে অর্পনের দিকে তাকায় বকুল। তার কান্না থেমে গেছে। শুধু একটু পর পর হিচকি দিচ্ছে। বকুল কান্না থামিয়ে ভাঙা গলায় বলে,

—“রুহুল কে? তার সাথে ভাইয়া ভাবির কি সম্পর্ক?”

বকুলের কথাটা অর্পনের কাছে বজ্রপাতের মতো ঠেকলো। ভ্রু কুঁচকে বকুলের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“রুহুল কে মানে? আমি তো তোমার ভাইয়ার কথা বলছি।”

—“কিন্তু আমার ভাইয়ার নাম তো রুহুল না।”

আরেক দফা অবাক হয়ে যায় অর্পন। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। সাজানো জিনিস যেনো অগোছালো হয়ে গেছে। রুহুল ইভার স্বামী। আর ইভা যদি বকুলের ভাবি হয় তাহলে হিসাব মতো রুহুল তো বকুলের ভাই হবে। কিন্তু বকুল রুহুলকে চিনছে না কেনো? অর্পন কিছু বলবে তার আগেই বকুল “এক মিনিট” বলে দৌড়ে পাশের ঘরে চলে যায়। এখানে আসার পর থেকে বকুল এই ঘরেই থাকছে।

মিনিটের মধ্যেই কিছু একটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে বকুল। দৌড়ে অর্পনের সামনে বসে হাতে থাকা মাঝারি সাইজের ছবির ফ্রেমটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

—” এই হলো আমার ভাইয়া। আর এটা ভাবি।”

ছবির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় অর্পন। চোখ দুটো স্থীর হয়ে যায় ছবির ফ্রেমের ওপর। চেহারায় তার বিস্ময়ের ভাব। অবাকের চুড়ান্তে পৌঁছে গেছে অর্পন। এই মুহূর্তে এমন সত্যির মুখোমুখি হবে সেটা অর্পন কল্পনাও করেনি। চারিদিকে যেনো ঝড়ো বাতাস বইছে। পুরো শরীরে যেনো শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ছবির দিকে এক আঙুল তাক করে অর্পন অবাক কন্ঠে অস্ফুট স্বরে বলে,

—“রনি।”

—“হ্যা রনি। এটা আমার ভাইয়া। আমার ভাইয়ার নাম রুহুল নয়, তার নাম তো রনি।”

হঠাৎ করেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় অর্পন। রুবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

—“রুবিয়া কাকি, বকুলের খেয়াল রেখো। আমাকে এক্ষুনি থানায় যেতে হবে।”

বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় অর্পন। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারো মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। কে এই রনি? অর্পন এভাবে চলে গেলো কেনো? কি ঘটছে এসব তাদের সাথে?”

———————-

থানায় এসে হন্তদন্ত পায়ে বাম দিকের স্টোর রুমে ঢোকে অর্পন। পিছু পিছু ছুটে আসছে কনস্টেবল রহিম। অর্পনকে হন্য হয়ে কিছু খুজতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

—“কি খুঁজছেন স্যার? আমাকে বলুন, আমি খুঁজে দিচ্ছি।”

অর্পন কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মতো কাজ করতে থাকে। কয়েকটা আলমারি খুলে একটা পুরনো ফাইল নিয়ে ছোট্ট করে দম ছাড়ে। সেটা হাতে নিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে যায়। চেয়ারে বসে ফাইলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। পুরো ফাইলে চোখ বুলিয়ে সেটা বন্ধ করে পেছন দিকে হেলে যায় অর্পন। চেয়ারে সম্পূর্ণ শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে দেয়। মুখটা উপরের দিকে রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ রেখে আবার চোখ খুলে তাকায়। পূর্ণ দৃষ্টিতে রহিমের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“আজ একটা বড়ো সত্যি জানতে পেরেছি রহিম সাহেব। অনেকটা রহস্য সমাধানও হয়ে গেছে। আপনি কি জানেন, রুহুল আসলে কে?”

রহিম প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে বলে,

—“কে স্যার?”

—“রুহুলই হলো অফিসার রনি। যাকে আমরা এতোদিন ধরে খুঁজে যাচ্ছি। “অপারেশন মতিঝিল” তার আন্ডারেই লিড হচ্ছিল। সে নিজের নাম বদলে ছদ্মনাম নিয়ে ছদ্মবেশ ধরে অপরাধীদের সাথেই ছিলো। অপরাধীদের হাতেনাতে ধরতে সে এতোবড় একটা রিস্ক নিয়েছিলো। কিন্তু ছদ্মবেশ অপরাধীদের সাথে মিশে যাওয়ার পর থেকেই তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ডিপার্টমেন্ট তাকে হন্য হয়ে খুঁজে যাচ্ছে সেটা তো আপনি জানেন। অফিসার রনিকে না পেয়ে দিদার স্যার আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। সেই সুবাদে “অপারেশন মতিঝিল” এখন আমার আন্ডারে লিড হচ্ছে।”

কথাগুলো বলেই একটু বিরতি নেয় অর্পন। রহিম সামনে দাড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রুহুলই হলো রনি কথাটা শ্রবণ হতেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে রহিম। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অর্পন ফের বলতে শুরু করে,

—“আমি এটা বুঝতে পারিনি যে রনিই রুহুলের ছদ্মনাম নিয়ে এখানে ছিলো। ইভার মা*র্ডা*র নিয়ে আমি রুহুলকে সন্দেহ করছিলাম। কিন্তু সত্য তো এটাই যে রনিকে বন্দী করে তারপর ইভাকে খু*ন করা হয়েছে। রনি কিছু ইনফরমেশন পেয়েছিল অপরাধীদের বিরুদ্ধে যা এই ফাইলে আছে। আর বাকি ইনফরমেশন রনির কাছে আছে। এর মানে রনি এমন কিছু জানতে পেরেছে যার জন্য ওকে বন্দী করে রেখেছে। ইভার খু*ন টা ছিলো রনিকে ভয় দেখানো। হয়তো রনির থেকে তারা কিছু জানতে চাইছে যা রনি বলছে না। এজন্য ইভাকে মে*রে ফেলেছে। যাতে রনি মুখ খোলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রনি কি এমন জেনেছে যার জন্য তার অস্তিত্ব গায়েব হয়ে গেছে। ইভাকে ম*র*তে হয়েছে। আসল ঘটনা কি?”

একদমে কথাগুলো বলে ডান হাত দিয়ে কপালে স্লাইড করতে থাকে অর্পন। অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে কিন্তু সব প্রশ্নের না। বাকি সব উত্তর একমাত্র রনিই দিতে পারে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন হচ্ছে, রনি এখন কোথায়? সে কি আদৌ বেঁচে আছে? নাকি ইভার মতো তাকেও মে*রে ফেলা হয়েছে?

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৮
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

মারুফ সাহেব সবে মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছেন। ঘর্মাক্ত মুখটা রুমালে মুছে সোফায় গা এলিয়ে দেন। ড্রয়িং রুমে আপাতত কেউ নেই। সবাই যে যার ঘরে আছে। দিলারা বেগম রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। তার সাথে সাহায্য করতে আছে বাড়ির কাজের মেয়ে।

রান্নার মাঝেই মারুফ সাহেবকে আসতে দেখে কাজের মেয়েকে রান্নার দিকে খেয়াল রাখতে বলে এক গ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে আসেন দিলারা বেগম। মারুফ সাহেবের দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলেন,

—“পানিটা খেয়ে নাও।”

মারুফ সাহেব চোখ তুলে তাকিয়ে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি শেষ করেন। স্বামীর ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দিলারা বেগম বলেন,

—“আজ একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছে যে।”

—“কাজের চাপ খুব বেশি। ব্যবসাটা বোধহয় আর টিকিয়ে রাখতে পারবো না দিপ্তির মা। সব পরিশ্রম বিফলে যাচ্ছে। জানি না কেনো, কিন্তু কেউ আমাকে সর্বশান্ত করতে আদাজল খেয়ে নেমেছে।”

স্বামীর কথায় চিন্তার ভাজ পড়ে দিলারা বেগমের কপালে। কে জানে এতো কিসের শত্রু তাদের। কেনো তাদের সাথে সবার এতো শত্রুতা। এই কোনোর পাকাপোক্ত উত্তর তিনি খুঁজে পান না। এরই মধ্যে দড়জা দিয়ে ধীর পায়ে প্রবেশ করে দীপ্তি। চোখ মুখ একদম শুকিয়ে গেছে। চুলগুলো কিঞ্চিৎ এলোমেলো। চেহারায় একটা উদাসীন ভাব।

এই ভর সন্ধ্যায় মেয়েকে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় মারুফ সাহেব আর দিলারা বেগমের। তবে মেয়েকে দেখে তারা খুশিও হয়ে যায়। দিলারা বেগম ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলেন,

—“দীপ্তি! তুই হঠাৎ এই সময়।”

—“এসে কি ভূল করেছি?”

দীপ্তির মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে যান দিলারা বেগম। মারুফ সাহেব উঠে এসে বলেন,

—“ভূল কেনো করবে আম্মু! তোমার নিজের বাড়ি, তুমি যখন খুশি আসবে। তা সজীব কোথায়? সে আসেনি?”

মারুফ সাহেবর কন্ঠ শুনে উদাসীন চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় দীপ্তির। শক্ত কন্ঠে বলে,

—“আমি একাই এসেছি এখানে।”

এবার মারুফ সাহেব অবাক হয়ে তাকান। দীপ্তির চেহারা তার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। কেনো যেনো এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে। তবে কি সজীবের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে? দীপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে মারুফ সাহেব বলেন,

—“একা এসেছো মানে? জামাই কেনো আসেনি আম্মু?”

এবার যেনো দীপ্তি রাগে ফেটে পড়ে। পাহাড় সমান রাগ নিয়ে ফুঁসে উঠে বলে,

—“তো! আমার আসাতে কি তোমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে? বারে বারে প্রশ্ন করে বিরক্ত করছো কেনো? যদি খুব সমস্যা হয় তাহলে বলে দাও, আমি চলে যাচ্ছি।”

দীপ্তির চেচামেচি শুনে ঘর থেকে সুপ্তি আর প্রাপ্তি বেরিয়ে আসে। পরপর কামরুল রহমানও বেরিয়ে আসেন। বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এসে চিন্তিত স্বরে বলেন,

—“কি হয়েছে এখানে? দিদিভাই, তুমি কখন এলে? আর এতো রেগে আছো কেনো?”

—“সেটা তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো দাদু। আমি আসাতে কি তার খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে? আসতে না আসতেই প্রশ্নের ঝুলি খুলে নিয়ে বসেছে। বিরক্ত লাগছে আমার।”

কামরুল সাহেব বুঝতে পারছেন না ঠিক কি হচ্ছে। উত্তরের আশায় ছেলে আর ছেলের বৌয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তারা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কামরুল রহমান দিপ্তিকে শান্ত সুরে বলেন,

—“তোমার বাড়িতে তুমি আসবে এতে কার কি সমস্যা হতে পারে দিদিভাই? তোমার বাবা কেনো, তোমার বাবার বাবারও সমস্যা হবে না। তুমি ঘরে যাও, একটু বিশ্রাম নাও। আমরা না হয় পরে কথা বলবো।”

কামরুল সাহেবের বলতে দেরি কিন্তু দীপ্তির পা বাড়াতে দেরি হয় না। ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে ধাম করে দড়জা আটকে দেয়। সমস্ত রাগ ক্ষোভ যেনো দড়জার ওপরেই মেটাচ্ছে।

দীপ্তির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশর নিঃশ্বাস ছাড়েন মারুফ সাহেব। মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক বেশ কয়েকবছর আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু দীপ্তির আজকের আচরণটা ছিলো অন্যান্য দিনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীপ্তি মারুফ সাহেবের সাথে খারাপ আচরণ করলেও এতটা খারাপ আচরণ আগে করেনি। তাহলে আজ কেনো? কিছু কি হয়েছে মেয়েটার? মেয়েকে নিয়ে এই পর্যায়ে চিন্তায় পড়ে যান মারুফ সাহেব।

————————

রাতে বেলকনিতে রাখা ছোট সোফায় বসে কিছু ফাইল ঘাটাঘাটি করছে অর্পন। বাহির থেকে আসা মৃদু বাতাসে তার অবাধ্য চুলগুলো উড়ছে। এলোমেলো হয়ে কখনো কপালে ছড়িয়ে পড়ছে, তো কখনো ডানে বামে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর জ্বলতে থাকা লাইটের আলোতে উজ্জ্বল মুখটা আরো উজ্জ্বল লাগছে। একটা ফাইল হাতে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছে অর্পন। এমন সময় পাশ থেকে তার ফোনটা বেজে ওঠে। চোখ ফাইলে আবদ্ধ রেখেই বাম হাত দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে অর্পন। বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। একদম চুপচাপ হয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। চোখ ফাইলের দিকে রেখেই ফের গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,

—“কে বলছেন? কথা না বললে ফোন দিয়েছেন কেনো?”

মুহুর্তেই অর্পনের কর্ণকুহরে পৌঁছায় একটা চিকন মিষ্টি মেয়েলী আওয়াজ। অপর পাশের ব্যক্তি ধীরে সুস্থে বলে,

—“কেমন আছেন অফিসার? আপনি কি ব্যস্ত?”

চকিত ভঙ্গিতে ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকায় অর্পন। কন্ঠটা তার কাছে বেশ পরিচিত। যদিও এই কন্ঠের অধিকারীর সাথে অর্পনের ফোনালাপ হয়নি। তবুও কন্ঠটা চিনতে অর্পনের বেগ পেতে হলো না। নিশ্চিত হতে অর্পন তড়িৎ গতিতে ফোনটা সামনে নিয়ে আসে। দেখে ম্যসেন্জার থেকে ফোন এসেছে। আইডিটা প্রাপ্তির। কয়েক সেকেন্ড ফোনের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে অর্পন। এটা কি সত্যি নাকি নিজের মনের ভূল সেটা ভাবতে থাকে। যেনো, নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নেয় অর্পন। মনে পড়ে যায় সকালের কথা। সারাদিন কাজের চাপে ভূলে যাওয়া রাগটা আবার মাথায় চেপে বসে। কন্ঠে চাপা রাগ নিয়ে অর্পন বলে,

—“ফোন করার কারণ?”

প্রাপ্তির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তিতে হাত মোচড়ামুচড়ি করছে। আগে সে কখনো কোনো ছেলের সাথে ফোনে কথা বলেনি। তার দাদাভাই আর বাবা ছাড়া কারো সাথে ফোনে কথা হয়না। আজ নতুন কিছু ট্রাই করতে গিয়ে অস্বস্তিটা বেশি হচ্ছে। এখন সুপ্তির ওপর বেশ রাগ হচ্ছে। ওই তো পন্ডিতি করে আইডি সার্চ দিয়ে ফোন দিয়েছে। প্রাপ্তিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বিচ্ছুটা পাশেই দাড়িয়ে মজা নিচ্ছে। মূল্যবান কথোপকথন শোনার জন্য কান পেতে দাড়িয়ে আছে।

প্রাপ্তি ধীরে ধীরে বাম দিকে পা বাড়ায়। কদম গুনে বেলকনিতে দড়জার সামনে দাড়িয়ে ধাম করে দড়জা আটকে দেয়। সুপ্তি কথা শোনার জন্য ফোনের কাছে কান এগিয়ে এনে দাড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ ধাম করে দড়জা আটকানোর শব্দে ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ভাবতে থাকে হঠাৎ হলো টা কি?

দড়জা আটকে ব্যলকনির রেলিং ধরে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। মনে সঙ্কোচ নিয়ে বলে,

—“আপনি কি আমার সকালের কথায় রাগ করেছেন?”

—“না!”

অর্পনের ছোট্ট জবাব শুনে হালকা হাসে প্রাপ্তি। রাগ করে আবার না বলছে। কি মিথ্যুকরে বাবা। প্রাপ্তির মনের সব সংকোচ যেনো এক নিমেষে গায়েব হয়ে গেছে। প্রাপ্তি স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

—“রাগ না করলে ভালো। আর করলেও তাতে আমার কিচ্ছু করার নেই। কারণ আমি শুধু আমার মনোভাব প্রকাশ করেছি। এতে রাগ করলে আমি কি করবো বলুন? তবে এখন এসব নিয়ে গবেষণা করতে ফোন দেইনি।”

অর্পন গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“তাহলে ফোন দেয়ার কারণ?”

—“আপনার হালচাল জানতে ফোন দিয়েছি। সকালে আপনি জখম অবস্থায় আমার পাশে বসে ছিলেন। শুরুতে না জানলেও শেষে জানতে পেরেছি। আর একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার সুবাদে অন্য একজন মানুষের ভালো মন্দ খোঁজ নিতে ফোন করেছি। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে?”

প্রাপ্তির কথায় একবার নিজের ব্যন্ডেজ করা হাতের দিকে তাকায় অর্পন। টিশার্টের ওপর দিয়েই জখম হওয়া পেশিবহুল হাত দেখা যাচ্ছে। ব্যান্ডেজটা রক্ত লাল রঙ ধারণ করেছে। তবে রক্ত এখন আর বের হচ্ছে না।

অর্পনকে চুপ থাকতে দেখে প্রাপ্তি বলে,

—“এখন কি উত্তরও দেবেন না বলে ঠিক করেছেন?”

প্রাপ্তির কথায় সোজা হয়ে বসে অর্পন। মনের কোণে জমিয়ে রাখা সব রাগ কর্পূরের ন্যায়ে উড়ে গেছে প্রাপ্তির ফোন পেয়ে। এ যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে অর্পন। ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়েছে মৃদু হাসি। সরে গেছে চেহারার গম্ভীরতা। হালকা হেসে নরম কন্ঠে অর্পন বলে,

—“এখন ঠিক আছি। চিন্তা নেই।”

এই পর্যায়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রাপ্তি। একটু দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করে,

—“ব্যান্ডেজ পাল্টেছেন?”

—“সময় পাইনি।”

—“তাহলে এখন পাল্টে নিন। এখন তো সময় আছে।”

হালকা হাসে অর্পন। সোফায় গা এলিয়ে আয়েশ করে বসে বলে,

—“সে না হয় করবো কিন্তু একটা ব্যপার বুঝতে পারছি না। আমাকে নিয়ে তোমার এতো চিন্তা কেনো? ব্যপারটা বেশ রহস্য জনক মনে হচ্ছে।”

—“আপনি জটিল ভাবে নিচ্ছেন তাই এমন মনে হচ্ছে। আমি আপনার জন্য না বরং আমার জন্য আপনার চিন্তা করছি। আমার জন্য আপনার সুস্থ থাকা জরুরি।”

এই পর্যায়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অর্পন। প্রাপ্তির কথাগুলোর অর্থ তার কাছে ভীষণ ভারি লাগছে। তবে কি অর্পন যা ভাবছে তাই? খুশি হয়ে যায় অর্পন। নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করে,

—“তোমার জন্য আমার সুস্থ থাকা জরুরি মানে?”

—“মানে হলো, আমার পেছনে কোনো অজানা শত্রু লেগেছে। সে বা তারা আমার ক্ষতি করতে চাইছে। আর আপনি তো একজন পুলিশ অফিসার। সেই সাথে আমার সুরক্ষার দায়িত্ব আপনি নিয়েছেন। তাহলে আপনার কিছু হলে আমার শত্রুরা আমাকে খুব সহজেই হাতের নাগালে পেয়ে যাবে। ফলাফল, আমার প্রাণ নাশ। তাই আমার সুরক্ষার জন্য আপনার সুস্থ থাকা জরুরি। আর এই কারণেই আপনার হালচাল জানতে ফোন দিয়েছি। উল্টো পাল্টা কিছু ভাববেন না আবার। ব্যন্ডেজটা পাল্টে নিন, ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

বলেই ফোনটা কেটে দেয় প্রাপ্তি। অর্পন হতভম্ব হয়ে বসে আছে। কিসের সাথে কি মিলিয়ে দিলো প্রাপ্তি? অর্পনের আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে ফোন কেটে দিলো। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই স্ট্যাচু হয়ে বসে থেকে হঠাৎ করেই হো হো করে হেসে ফেলে অর্পন। হাসির সাথে তার পুরো শরীর কাঁপছে। নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণে এনে ফোন করে অঙ্কনকে। ফোন রিসিভ হতেই অর্পন শান্ত কন্ঠে বলে,

—“আমার রুমে আয়তো। ব্যন্ডেজটা পাল্টে দিয়ে যা।”

এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দেয় অর্পন। তারপর বাহিরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আবার হাসতে থাকে।
এদিকে অঙ্কন যেনো ভূত দেখার মতো চমকে তাকিয়ে আছে। ভাইয়ের মুখে এমন কথা কখনো শুনবে সেটা অঙ্কনের কল্পনার বাইরে ছিলো। তার ভাই নিজেকে নিয়ে ভাবছে। ব্যান্ডেজ পাল্টে দিতে বলছে। এই অসাধ্য সাধন হলো কিভাবে?

মুহুর্তেই ফাস্টএইড বক্স নিয়ে দ্রুত পায়ে ভাইয়ের রুমে যায় অঙ্কন। বেলকনিতে আলো দেখে সোজা সেখানে উপস্থিত হয়। দেখে অর্পন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। ভাইয়ের পাশে বসে ভ্রু কুচকে অঙ্কন বলে,

—“হয়েছে কি তোমার ভাই? আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে? তুমি নিজে থেকে ব্যন্ডেজ পাল্টাতে বলছো।”

অঙ্কনের কন্ঠে পাশে ফিরে তাকায় অর্পন। চেহারার হাসি ভাব মুহুর্তেই হারিয়ে যায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“হেড অফিস থেকে অর্ডার এসেছে। নিজের খেয়াল এবার রাখতেই হবে। উত্তর পেয়েছি? ব্যন্ডেজটা পাল্টে দে এবার।”

অঙ্কন আর কিছু না বলে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।

———————————

গায়ে কালো হুডি পড়ে আর মুখে কালো মাস্ক পড়ে প্যন্টের পকেটে দুই হাত গুজে দাড়িয়ে আছে বস। তার সামনেই দাঁড়িয়ে মৃদু কাপছে চারজন লোক। মাস্ক আর হুডি দিয়ে চেহারা পুরো ঢেকে রাখায় মুখের ভাব ভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না। ফাঁক দিকে শুধু তার রক্ত লাল চোখ দেখা যাচ্ছে। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ রেগে আছে। সেই আগুন লাল চোখ দেখেই ভয়ে মৃদু কাপছে সামনে দাঁড়ানো চারজন। ওরা বুঝতে পারছে না তাদের বস আজ আগে থেকেই রেগে আছে কেনো? এখনো তো দুঃসংবাদ দেয়নি। তাহলে যখন খবরটা শুনবে তখন কিরূপ ভয়ানক হয়ে যাবে? সামনের চারজনকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে বস রাগে হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে,

—“পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকার জন্য আমাকে ডেকে এনেছিস? কি বলার জন্য ডেকেছিস বলে ফেল। আমার আরো অনেক কাজ আছে।”

বসের এমন হুঙ্কার শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে চারজন। মাথার ওপর ফ্যান চললেও সবাই কুলকুল করে ঘামছে। ঘাম মুছে একজন সাহস করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

—“বস, ড্রা*গ*সে*র দু কোটির ডিল ক্যন্সেল হয়ে গেছে। সেদিন ভার্সিটিতে পুলিশ অফিসারটা এসে কাজটা ভেস্তে দিয়েছিলো। তারপর আর সুযোগ হয়ে ওঠেনি মালাগুলো ডেলিভারি দেয়ার। তাই তারা ডিলটা ক্যন্সেল করে দিয়েছে।”

রাগে হাত মুঠো করে ধরে বস। অত্যাধিক রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছে মস্তিষ্ক। এরই মধ্যে আর একজন বলে,

—“বস, ওই বারোজন মেয়েকে এই মাসের মধ্যেই চালান করতে হবে। তারা আর সময় দেবে না বলেছে। এক মাসের মধ্যে বারোজন মেয়েকে না পেলে ওরা অন্যদের দিয়ে কাজ করাবে বলে দিয়েছে।”

এমনিতেই রাগের শরীরে আগুন জ্বলছে, তারওপর একের পর এক অসফলতার কথা শুনে এবার আর রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারে না বস। ঝড়ের গতিতে পেছন থেকে হাত সামনে আনতেই বিকট শব্দে দুইটা আওয়াজ হয়। বুলেটের আওয়াজে কেঁপে ওঠে চারিদিক। এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে চলে যায়। সামনে দাড়িয়ে থাকা চারজনের মধ্যে এইমাত্র কথা বলা দুজন মুহুর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দুজনের মাথার মাঝ বরাবর বুলেটের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। রক্তে পুরো মুখমন্ডল লাল হয়ে গেছে। গুলি লাগার সাথে সাথেই প্রাণটা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

এমন গা হিম করা লোমহর্ষক ঘটনা স্বচক্ষে দেখে থরথর করে কাঁপছে বাকি দুইজন। এই কাজে জড়িত হওয়ার জন্য প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে তাদের। কেনো যে প্রণঘাতী এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে গেছে। এখন দল ছাড়তেও পারবে না। দল ছাড়তে চাইলে নিশ্চিত মৃত্যু। ভয়ে কাচুমাচু করে দাড়িয়ে দেখছে সদ্য মৃত্যুবরন করা নিজেদের দুজন সঙ্গীকে।

সেকেন্ডের মধ্যেই বড় বড় পা ফেলে পাশের রুমে চলে যায় বস। চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছে রুহুল। মারের কারণে পুরো শরীরে কালচে দাগ বসে গেছে। ঝড়ের গতিতে বস এসেই রুহুলের গাল চেপে ধরে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে,

—“আজ আমার রাগ সপ্তম আসমানে উঠে আছে রুহুল। ত্যাড়ামি করে আমার রাগ আর বাড়াবি না। তাহলে এবার সত্যি তোর মৃত্যু হবে। সত্যি করে বল, কে তুই? তোর আসল উদ্দেশ্য কি? মেয়েগুলোকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? তোর জন্য অনেক ক্ষতি হয়েছে আমার। কোটি কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। এবার হয় তুই মুখ খুলবি। না হলে মরবি।”

বসের কথা শুনে নিভু নিভু চোখে তাকায় রুহুল। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও গলায় জোর দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

—“তোর মতো চুনোপুঁটির হুমকিতে আমি ভয় পাই না। আর মরেন ভয় তো একদমই না। যা, গিয়ে তোর আসল বসকে নিয়ে আয়। আমি আসল নাটের গুরুকে আমার সামনে দেখতে চাই। না হলে আমার পেট থেকে একটা কথাও বের করতে পারবি না। লুকিয়ে কেনো আছে সে?”

চলবে?