#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
রাগে থরথর করে কাঁপছে বস। নিস্তব্ধ কক্ষ বসের রাগের আগুনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রুহুলের এমন বেপরোয়া আচরণ আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে। রেগে রুহুলের বুক বরাবর একটা লাথি মারে বস। তাল সামলাতে না পেরে চেয়ার সহ উল্টে পড়ে যায় রুহুল। ফ্লোরের সাথে মাথায় বারি লেগে প্রচন্ড ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেলে রুহুল। মাথার পেছনে কেটে গেছে মনে হয়। তবুও চোখে মুখে ব্যথার আভাস ফুটে উঠতে দেয় না। দাঁত খিঁচে ব্যথা সয্য করে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তোলে।
বস দু পা এগিয়ে এসে নিচে ঝুঁকে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রুহুলের গলা চেপে ধরে। মুহুর্তেই চোখ মুখ লাল হয়ে যায় রুহুলের। দম আটকে হাসফাস করতে থাকে। বস দাঁতে দাঁত চেপে রাগী কন্ঠে বলে,
—“মুখ যখন খুলবি না তাহলে তোকে বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ? তোকে বরং মেরেই ফেলি। এমনিতেও তোকে মরতে হতো। যেটা কাল করার ছিলো সেটা আজই করে ফেলি।”
এদিকে গলা চেপে ধরায় দম আটকে চোখ মুখ নীল রঙ ধারণ করেছে রুহুলের। আর কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই ধরে থাকলে ওর মৃত্যু নিশ্চিত। তখন পেছন থেকে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে একজন দৌড়ে এসে বসের পাশে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
—“বস ম্যাডামের ফোন। আপনাকে চাইছে।”
ম্যডাম নামটা শুনতেই হাত আলগা হয়ে যায় বসের। হুট করে উঠে দাড়িয়ে ফোনটা হাতে নেয়। কানে রাখতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে ধমকের আওয়াজ,
—“পাগল হয়ে গেছিস তুই? কি করতে যাচ্ছিলি এসব? ছেলেটা যদি মরে যেতো।”
—“তো কি করবো? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো?”
বসের ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুনে হেসে ফেলে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি। বেশ আয়েসি কন্ঠে বলে,
—“শুধু বসে কেনো থাকবো? খেলা এখনো অনেক বাকি আছে। আমি কাটা দিয়ে কাটা তুলবো। আর তার জন্য ওই ছেলের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। তবেই না খেলা জমবে। আর তাছাড়া, ছেলেটার কাছে আমাদের বিরুদ্ধে সব প্রমান আছে সেটা কি ভূলে গেছিস? একবার যদি সেগুলো পুলিশের হাতে যায় তাহলে আমরা বরবাদ হয়ে যাবো। ম্যমোরি কার্ডটা এখনো আমরা হাতে পাইনি। তাই ওই ছেলের বেঁচে থাকা খুব জরুরি।”
এই পর্যায়ে বস একদম চুপ হয়ে যায়। তবে রাগ কমেছে কি না সেটা বোঝা যাচ্ছে না। মাক্সের আড়ালে লুকিয়ে আছে তার চেহারা। তাই চেহারার ভাব গতি বুঝতে অক্ষম সেখানে উপস্থিত সবাই। ফোনটা কেটে পাশে দাড়ানো সোহেলের হাতে ফিরিয়ে দেয়। ফোনটা সোহেলের। সেই মূলত ম্যডাম নামক ব্যক্তির কাছে ফোন দিয়েছিলো।
সোহেলের হাতে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে রাগী চোখে তাকায় মাটিতে পড়ে থাকা রুহুলের দিকে। যে এখন ফ্লোরে শুয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। সেদিকে চোখ রেখেই বস সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“ওর ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা কর সোহেল। খেয়াল রাখিস, ও মরলে কিন্তু চলবে না।”
কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় বস। পেছন পেছন বাকিরাও বেরিয়ে যায়। সবাই যেতেই ছোট্ট করে একটা দম ছাড়ে সোহেল, যেনো বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। আস্তে করে দড়জাটা আটকে দিয়ে ঘুরে তাকায় রুহুলের দিকে। বুকের ভেতর হঠাৎ করেই মোচড় দিয়ে ওঠে সোহেলের। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে হাটুমুড়ে বসে নিচে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
—“রনি স্যার!”
ফ্লোরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করছিলো রুহুল। হঠাৎ রনি নাম কানে আসতেই চমকে চোখ মেলে তাকায়। নিজের সামনে সোহেলকে দেখে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করে। সোহেল খুব সপ্তপর্ণে রুহুলকে উঠিয়ে বসায়। আস্তে আস্তে হাতের বাঁধন খুলে দেয়।
রুহুল সতর্ক চোখে চারিদিকে নজর বুলিয়ে নেয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত হতেই হালকা ধমকের সুরে বলে,
—“তোকে বলেছি না, আমাকে রনি নামে ডাকবি না। আর স্যার বলতেও বারন করেছি। বারে বারে একই ভূল কেনো করিস? কেউ শুনে ফেললে বিপদ হয়ে যাবে।”
হালকা করে জিভ কামর দেয় সোহেল। ধীর কন্ঠে বলে,
—“ভূল হয়ে গেছে ভাই। আর হবে না।”
এরপর সোহেল হাত থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা খুলে নিচে রাখে। এটা সে আগেই এনে লুকিয়ে রেখেছে এই ঘরে। বক্স থেকে তুলো আর স্যভলন বের করে ক্ষত স্থান হালকা হাতে পরিস্কার করতে থাকে। রনি অত্যন্ত সতর্ক কন্ঠে বলে,
—“মেয়েগুলো কোথায় সোহেল? ওদের জায়গা মতো পৌঁছে দিতে পেরেছিস?”
সোহেল হতাশ কন্ঠে বলে,
—“এখনো পারিনি ভাই। এখান থেকে বের করার সুযোগই পাচ্ছি না। তাহলে অর্পন স্যরের কাছে পৌঁছে দেবো কিভাবে? জানি না আদৌ এখন থেকে বের করতে পারবো কি না। একবার ধরা পড়লে ঐ মুহুর্তে মৃত্যু নিশ্চিত।”
চিন্তায় পড়ে যায় রনি। কিভাবে বাচাবে মেয়েগুলোকে? কিভাবে বের করবে এখান থেকে? এতোদিন নিজের আত্মবিশ্বাস আর কথা দিয়ে বসকে এটা বিশ্বাস করিয়েছে যে মেয়েগুলো রুহুলের আয়ত্তে আছে। কিন্তু সত্যি তো এটাই যে মেয়েগুলোকে এখনো এই জাহান্নাম থেকে বের করতে পারেনি। এখানকারই একটা গুপ্ত ঘরে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আর কতদিন? কখনো না কখনো ধরা তো পড়েই যাবে। কিছু একটা করতে হবে, তাও খুব তাড়াতাড়ি।
কথাগুলো ভাবতেই সোহেলের দিকে তাকায় রনি। আপন মনে নিজের কাজ করছে সোহেল। চেহারায় তার বিষাদের ছায়া নেমেছে। আর এই বিষাদ যে রনির অবস্থা দেখে সেটাও রনি জানে। সোহেলের সাথে রনির পরিচয় হয় এখানে বন্দী হওয়ার পর। ছেলেটা খারাপ নয়, আর না কোনো খারাপ কাজ করতে এই অপরাধীদের দলে যোগ দিয়েছে। বরং সমাজ থেকে দুর্নিতি দূর করতে, এই অপরাধীদের ধ্বংস করতে সে এদের সাথে থাকছে। ছলেবলে কৌশলে বসের কাছে কেউ হয়ে উঠেছে। যাতে সুযোগ পেলেই বসকে আক্রমণ করতে পারে। সোহেল চায় এই পাপের রাজত্ব ধ্বংস করতে। তাই নিজের জীবনের পরোয়া না করে এই দলে জোগ দিয়েছে। কারণ দূর থেকে যতটা ক্ষতি করা সম্ভব, কাছ থেকে তারচেয়ে বেশি ক্ষতি করা যায়।
রনি প্রথমে যখন সোহেলের উদ্দেশ্যের কথা শোনে তখন ভীষণ অবাক হয়েছিলো। এতটুকু একটা ছেলে। কিইবা বয়স তার? বড়ো জোর বিশ কি বাইশ হবে। তবুও সে দেশের জন্য কাজ করছে। সমাজকে অপরাধ মুক্ত করতে চাইছে। আইনের লোক না হয়েও আইনকে সহায়তা করছে। অথচ ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা দিনের পর দিন অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে। এসব ভেবে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে রনি। সোহেল নিজের কাজ শেষ করে রনির দিকে তাকায়। রনির পায়ের কাছে বসে আহত কন্ঠে বলে,
—“আপনি পালিয়ে কেনো যাচ্ছেন না ভাই? কেনো জেদ করছেন? সেদিন আপনার হাতে মোক্ষম সুযোগ ছিলো পালিয়ে যাওয়ার। তাহলে কেনো গেলেন না? ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।”
—“মরতে আমি ভয় পাইনা সোহেল।”
—“কিন্তু আপনার বেঁচে থাকা জরুরি। দেশের জন্য আপনি খুবই মূল্যবান। আপনি এখান থেকে গিয়ে অর্পন স্যারের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনারা দুজন মিলে এই শয়তানদের আটক করুন। অর্পন স্যার তো এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। তার সামনে এখনো কোনো সত্য আসেনি।”
একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে রনি। স্বচ্ছ চোখে তাকায় সোহেলের দিকে। ছেলেটা ওকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রনি স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
—“আমি চলে গেলে ওই মেয়েগুলোর কি হবে সোহেল? ওদের যে সর্বনাশ নিশ্চিত। শয়তান গুলো বেছে বেছে অনাথ মেয়েগুলোকেই টার্গেট করেছে। ওই মেয়েগুলোর জন্য প্রতিবাদ করার কেউ নেই। আর না আছে ওদের বাঁচানোর কেউ। আমি ওদের বিপদে ফেলে চলে যেতে পারি না। তাছাড়া আমি চলে গেলে তোর কি হবে? তোকে আমি ওদের কাছে ফেলে রেখে যাবো না।”
—“কারো সাহায্য বা কোনো ক্লু না পেলে অর্পন স্যার এই জায়গার খোঁজ পাবে না ভাই। সে কাউকে উদ্ধার করতে পারবে না।”
—“অর্পন বুদ্ধিমান ছেলে। ও ঠিক সব সামলে নেবে।”
—“যদি এর মধ্যে ওরা আপনাকে মেরে ফেলে?”
হালকা হাসে রনি। সেই হাসিতে মিলে আছে একরাশ বিষাদ। এক আকাশ সমান কষ্ট। ঘোলা দৃষ্টিতে উপরের লাইটের দিকে তাকায় রনি। ভেজা কন্ঠে বলে,
—“আর বেচে থাকতে ইচ্ছে করে না সোহেল। বাঁচার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। আর কার জন্য বাঁচবো?”
রনির উদাসীন চেহারা দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায় সোহেলের। মনে পরে যায় সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা। ইভার ভয়ংকর পরিণতি সোহেল নিজের চোখে দেখেছে। নিজের কানে শুনেছে ইভার এক একটা আত্ম চিৎকার। দেখেছে রনিকে ছটফট করতে। সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো সোহেলের শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। তার চোখের সামনে ঘটেছিলো সেই ঘটনা। কিন্তু সোহেল কিচ্ছু করতে পারেনি। ইভাকে বাঁচাতে গেলে তো সে ধরা পড়ে যেতো। তাহলে তার উদ্দেশ্য সফল হতো কিভাবে? তাই চুপচাপ অসহায় চোখে দেখে গেছে সব।
———————————-
সকাল সকাল তিনবোন হসপিটালে এসেছে। কাল রাত থেকে প্রাপ্তির চোখে হঠাৎ ব্যথা করছিলো। রাতে অতটাও পাত্তা দেয়নি। কিন্তু ভোর রাতে ব্যথা বেড়ে সেটা অতিরিক্ত মাত্রায় হতেই আর সয্য করতে পারে না প্রাপ্তি। বোনকে চোখ চেপে ধরে আর্তনাদ করতে দেখে তৎক্ষনাৎ হসপিটালে নিয়ে এসেছে দীপ্তি। সাথে সুপ্তিও এসেছে।
প্রাপ্তিকে নিয়ে সোজা সাগরের কাছে এসেছে দীপ্তি। সজীবকে ছাড়া কখনো একা কোথাও যায়নি দীপ্তি। তাই লোকজনের সাথে পরিচয় খুব কম। বাবার বাড়ি আসার পর থেকে সজীব একবারও ফোন করেনি দীপ্তিকে। তাই অভিমান করে প্রাপ্তির কথাও জানায়নি। একাই হসপিটালে নিয়ে এসেছে প্রাপ্তিকে। দীপ্তির পরিচিত বলতে সাগর ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। তাই সোজা সাগরের কাছে চলে এসেছে।
প্রাপ্তিকে ব্যথায় আর্তনাদ করতে দেখে তাড়াহুড়ো করে একটা পেইন কিলার খাইয়ে দেয় সাগর। এতে ক্ষনিকের জন্য ব্যথা কমবে। প্রাপ্তি একটু স্বাভাবিক হতেই সুপ্তির সাথে পাঠিয়ে দেয় কিছু টেস্ট করতে।
সাগরের মুখোমুখি হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে দীপ্তি। এতোক্ষণে দীপ্তির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সাগর। তাকাতেই কিছুটা চমকে ওঠে। স্থীর হয়ে যায় দৃষ্টি জোড়া। দীপ্তির মলিন মুখটা দেখে বুকের ভেতর ব্যথার সৃষ্টি হয় সাগরের। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কত জন্মের অভুক্ত। মুখটা পুরো শুকিয়ে গেছে। ভেতরে হাসফাস করতে থাকে সাগরের। খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে যে দীপ্তির কি হয়েছে? মুখটা মলিন কেনো তার? কিন্তু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেকে দমিয়ে নেয় সাগর। দীপ্তির প্রতি দুর্বলতা আনা অন্যায়। তাই অন্য দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা দম নেয়। পাশেই অঙ্কন দাড়িয়ে আছে। অঙ্কনকে চোখের ইশারায় প্রাপ্তিদের কাছে যেতে বলে। ভাইয়ের ইশারা বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে চলে যায় অঙ্কন। এবার দীপ্তির দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে সাগর জিজ্ঞেস করে,
—“ঠিক আছো?”
চমকে মাথা তুলে তাকায় দীপ্তি। সাগর এটা জিজ্ঞেস করলো কেনো? এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—“ঠিক আছি। আমার কি হবে? প্রাপ্তির হঠাৎ চোখে ব্যথা করছে কেনো? কি হয়েছে ওর?”
—“কারণ তো টেস্টের রিপোর্ট দেখলে বলতে পারবো।”
একটু থেমে যায় সাগর। কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে বলে,
—“আচ্ছা প্রাপ্তি কি জন্মগত ভাবে অন্ধ?”
—“না, প্রাপ্তি আগে চোখে দেখতে পেতো। ছয় বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে ও চোখের দৃষ্টি শক্তি হারায়।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় সাগর। ব্যপারটা কেমন জানি সন্দেহ জনক লাগছে। কৌতুহলী কন্ঠে সাগর জিজ্ঞেস করে,
—“তোমরা ডক্টর দেখাওনি? ওই মুহুর্তে ট্রিটমেন্ট করলে তো দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসার কথা।”
—“আপনার মনে হয় আমরা ওর চিকিৎসায় অবহেলা করবো? আমার পরিবার ওর জন্য জান দিতে প্রস্তুত। সজীব শহরের সবচেয়ে বড় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডক্টর দিয়ে ট্রটিটমেন্ট করায় প্রাপ্তির। কিন্তু ডক্টর ওকে ঠিক করতে পারেনি। ডক্টর বলে দিয়েছে যে প্রাপ্তি আর কোনোদিন চোখে দেখতে পারবে না।”
—“এর আগে কি চোখে ব্যথা করতো?”
—“এর আগে এমন হয়নি। আজই প্রথম।”
দীপ্তির কথাগুলো সাগরকে ভাবাচ্ছে খুব। সাধারণ ব্যপারটা হঠাৎ করেই সন্দেহ জনক লাগছে। প্রাপ্তির দৃষ্টি শক্তি হারানো কি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা? নাকি কারো সুক্ষ্ম কোনো পরিকল্পনা?
————————-
প্রাপ্তিকে নিয়ে দোতলায় এসেছে সুপ্তি। একজন নার্স প্রাপ্তিকে টেস্ট করানোর জন্য নিয়ে গেছে। সুপ্তি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুঃখী দুঃখী মুখ করে সেলফি উঠছে। ফেসবুকে পোস্ট করে সবাইকে আপডেট জানাতে হবে তো। ইতিমধ্যে প্রায় শ-খানিক সেলফি ওঠা শেষ। কিন্তু একটা ছবিও সুপ্তির পছন্দ হচ্ছে না। ফোনের ক্যমেরা অন করে আবার সেটা উচু করে ধরে। মুখটাকে জনমদুখিনী বানিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই ক্যমেরায় দেখতে পায় পেছনে অঙ্কন দাড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার একরাশ বিরক্তি।
অঙ্কনকে দেখেই সেলফি তোমার জন্য উপরে ওঠানো হাতটা নিচে নামিয়ে নেয় সুপ্তি। রোবটের মতো পেছনে ঘুরে তাকায়। অঙ্কন প্যন্টের পকেটে হাত গুজে কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,
—“মাথার গোবর গুলো পঁচে কি গ্যস্টিক হয়ে গেছে?”
সুপ্তি অবুঝের মতো প্রশ্ন করে,
—“মানো?”
—“মানে ঘিলু চেনো, ঘিলু? আছে মাথায়?”
—“কিসের ঘিলু? কার ঘিলু?”
অঙ্কন দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বলে,
—“আমিই বা কাকে কি বলছি। মাথায় ঘিলু থাকলে তো চিনবে।”
—“কি বলছেন আপনি এসব? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
—“বোঝার জন্য মাথায় বুদ্ধি থাকতে হয়। সেটা তো তোমার নেই। মানে, একটা মানুষ এতটা গাধা হয় কিভাবে? একজন অসুস্থ মানুষকে হসপিটালে নিয়ে এসে মনের সুখে সেলফি তুলছে। হাউ?”
এবার সুপ্তি বুঝতে পারে অঙ্কন ওকে অপমান করছে। ব্যপারটা বুঝতেই রেগে যায় সুপ্তি। রাগে ফুঁসে উঠে চেচিয়ে বলে,
—“আবার, আপনি আবার আমাকে অপমান করছেন। এই সমস্যাটা কি আপনার? সবসময় আমার পেছনে লাগেন কেনো? বাজে লোক।”
অঙ্কন হাত পটেকে গুঁজেই দুইপা এগিয়ে আসে। কিছুটা ফিসফিস করে বলে,
—“গাধার সাথে সাথে তুমি যে একটা ম্যনারলেসও, সেটাও প্রমান করে দিলে। হসপিটালে দাড়িয়ে এতো জোরে কথা বলে কি প্রমাণ করতে চাইছো, যে তোমার গলার আওয়াজ ফাটা বাশের মতো?”
এই পর্যায়ে টনক নড়ে সুপ্তির। কথা থামিয়ে চারিদিকে নজর বুলিয়ে দেখে সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সুপ্তির আর বুঝতে বাকি নেই যে সবাই ওর কথাই শুনেছে শুধু, অঙ্কনের কথা কারো কানে পৌঁছায়নি। সবার দিকে একনজর তাকিয়ে সুপ্তি অঙ্কনের দিকে তাকায়। অঙ্কনের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি। অঙ্কন যে ইচ্ছে করে সুপ্তির পেছনে লাগছে সেটা সুপ্তি বেশ বুঝতে পারছে। তাই দুই কদম এগিয়ে অঙ্কনের কাছাকাছি এসে দাড়ায়। অঙ্কনের দিকে তর্জনি আঙুল তাক করে বলে,
—“আপনাকে তো আমি দেখে নেবো কলিজা কাটা ডাক্তার।”
বলেই হনহন করে সেখান থেকে চলে যায় সুপ্তি। ক্ষনিকের জন্য ভূলেই গেছে যে এখানে প্রাপ্তি আছে।
———————–
প্রায় দুই ঘন্টা পর সব টেস্ট শেষ করে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তি। একজন নার্স প্রাপ্তির হাত ধরে আছে। বাইরে এসেই হালকা আওয়াজে সুপ্তিকে ডাকতে থাকে। কিন্তু সুপ্তির কোনো উত্তর নেই। গেলো কোথায় মেয়েটা? হঠাৎ করেই কথা থেমে যায় প্রাপ্তি। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার তা ছেড়ে দেয়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রাপ্তি। কৌতুহলী কন্ঠে বলে,
—“অফিসার আপনি এখানে?”
প্রাপ্তির মুখে অফিসার সম্বোধন শুনে হালকা হাসে অর্পন। ও জানতো যে প্রাপ্তি ঠিক ওর অস্তিত্ব অনুভব করবে। তাই চুপ করে ছিলো। প্রাপ্তির কথা শেষ হতেই চোখের ইশারায় নার্সকে চলে যেতে বলে অর্পন। নার্স বিনা বাক্যে চলে যায়। অর্পন এবার এগিয়ে এসে বলে,
—“চেক-আপ করাতে এসেছিলাম। এসেই কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেলো।”
মনে মনে হাসে প্রাপ্তি। এটা কাকতালীয় নাকি ইচ্ছাকৃত সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে না। থাকনা কিছু না কথা মনের ভেতরে, গোপনে। অর্পন কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলে,
—“ঠিক আছো তুমি?”
—“জ্বি।”
—“তোমার বোনরা নিচে আছে। আমার সাথে চলো আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
একটু ভাবনায় পড়ে যায় প্রাপ্তি। ইচ্ছে করছে সরাসরি সাহায্যের জন্য না করে দিতে। কিন্তু সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। আর কারো সাহায্য ছাড়া সিড়ি পার হওয়া সম্ভব নয়। তাই অগত্যাই রাজি হয়ে যায় প্রাপ্তি। নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“চলুন।”
প্রাপ্তির হাতের দিকে অবাক চোখে তাকায় অর্পন। এতো সহজে যে প্রাপ্তি নিজের হাত বাড়িয়ে দেবে সেটা অর্পন ভাবেনি। মনে মনে খুশি হয়ে যায়। প্রাপ্তির এগিয়ে দেয়া হাতটা হালকা করে ধরে সামনের দিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই অর্পন সতর্ক কন্ঠে বলে,
—“সামনে সিঁড়ি আছে, সাবধানে।”
অর্পনের হাতটা শক্ত করে ধরে এক-এক পা ফেলতে থাকে প্রাপ্তি। প্রাপ্তির মুখে স্পষ্ট বিশ্বাসের ছাপ দেখতে পাচ্ছে অর্পন। কিছুটা অবাক কন্ঠে অর্পন বলে,
—“আমার এক বলাতেই সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলে যে? যদি আমি খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকি। তোমাকে যদি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই?”
—“আমি জানি আপনি এমন কিছুই করবেন না। আপনাকে আমি বিশ্বাস করি।”
অর্পনের মনে শীতল স্রোত বয়ে যায়। নিজের প্রতি প্রাপ্তির বিশ্বাস দেখে বুকটা খুশিতে ভরে উঠেছে। তবুও আরো একটু বাজিয়ে দেখতে অর্পন বলে,
—“আজ এতো বিশ্বাস দেখাচ্ছো! অথচ কাল তোমার মধ্যে বিশ্বাসের ছিটে ফোটাও ছিলো না। আমার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলে।”
—“ভূল বুঝেছেন অফিসার। আমি আপনার চরিত্র নিয়ে মোটেও প্রশ্ন তুলিনি। আমি আমার মনের ভয়টা প্রকাশ করেছি মাত্র। আর সত্যি বলতে বিয়ের আগের প্রেম ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না। ঐ সম্পর্কটা খুবই ঠুনকো। অপবিত্রতায় ভরা। এক ঝটকায় ভেঙে যায়। বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যে ভালোবাসা তৈরি হয়, আমি সেটায় বিশ্বাসী। ওই সম্পর্কটা সম্পূর্ণ পবিত্র। একটা অদৃশ্য বন্ধন বেধে রাখে দুজনকে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি অন্ধ। আর একজন অন্ধ মেয়ের সাথে কেউ ক্ষনিকের ভালোবাসায় জড়াতে পারে কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইবে না। তাই নিজেকে এসব থেকে রক্ষা করছি। যদি কেউ ভালোবাসার আবদার নিয়ে আসে, তাকে বলবো বিয়ে করে নিতে। প্রেম ভালোবাসার জন্য তো সারাজীবন পড়ে রয়েছে।”
চলবে?
#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২০
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
প্রাপ্তির দিকে শীতল চোখে তাকায় অর্পন। তাকিয়েই থাকে ওই মায়াভরা মুখের দিকে। প্রাপ্তির বলা এক একটা কথা অর্পনের মনে ফুলের মতো বর্ষন হচ্ছে। কথাগুলোর মর্মার্থ কাল না বুঝলেও আজ বেশ বুঝতে পারছে। হালকা হাসে অর্পন।
এরই মাঝে ওরা নিচে চলে এসেছে। সাগরের কেবিনে ঢুকতেই দেখতে পায় সেখানে সবাই আছে। প্রাপ্তিকে দেখে উঠে দাঁড়ায় দীপ্তি। এগিয়ে গিয়ে প্রাপ্তিকে আগলে নেয়। চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
—“বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
দীপ্তির কথা শুনে অস্থির চোখে তাকায় অর্পন। যেনো প্রাপ্তির মুখ দেখেই ওর কষ্টটা অনুভব করতে চাইছে।
এতোক্ষণে যেনো প্রাপ্তি ব্যথাটা আবার অনুভব করে। অর্পনের সাথে কথা বলতে বলতে ব্যথার কথা ভুলেই বসেছিলো। তবে পেইন কিলার খেয়ে কিছুটা কমেছে, কিন্তু পুরোপুরি না। সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে বলে,
—“একদম কষ্ট হচ্ছে না আপি। ব্যথা কমে গেছে। চিন্তা করো না।”
প্রাপ্তির কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে দীপ্তি। সাগরের দিকে তাকাতেই সাগর চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে দিপ্তিকে। এরপর একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“আমি কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছি, আপাতত এগুলো চলবে। রিপোর্ট পেলে আমি আমার পরিচিত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডক্টরের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করবো। চিন্তা নেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মাথা নাড়িয়ে প্রাপ্তিকে নিয়ে চলে যায় দীপ্তি। এতোক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো অর্পন। দীপ্তি সবাইকে নিয়ে চলে যেতেই সাগরের সামনের চেয়ারে ধুপ করে বসে পড়ে অর্পন। চেহারার ব্যকুলতা এবার ফুটে উঠেছে। চিন্তিত কন্ঠে বলে,
—“প্রাপ্তির কি হয়েছে ভাই? অঙ্কন ফোন করে বললো ওর চোখে প্রচন্ড ব্যথা করছে। কিন্তু কেনো?”
অর্পনের কথা শেষ হতেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে সাগর। ভাবনার সুরে বলে,
—“কিছু একটা গন্ডগোল আছে অর্পন। প্রাপ্তি জন্ম থেকে অন্ধ নয়। ছয় বছর আগে এক্সিডেন্টে সে চোখের দৃষ্টি হারায়। আবার দীপ্তির কথা অনুযায়ী শহরের সবচেয়ে ভালো ডক্টরকে দিয়ে ট্রিটমেন্ট করিয়েছে প্রাপ্তির। কিন্তু খটকাটা এখানে লাগছে যে, জন্মগত অন্ধ না হলে তো ভালো ভাবে চিকিৎসা করলে চোখের দৃষ্টি ফিরে আসার কথা। তাহলে সেটা হলো না কেনো? চোখের ব্যথাও এই ছয় বছরে আজ প্রথম হয়েছে। কিন্তু কেনো? এক্সিডেন্টটা কি স্বাভাবিক ছিলো? নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে? রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত ক্লিয়ার হতে পারছি না।”
সাগরের কথা শুনে দৃষ্টি শীতল হয়ে গেছে অর্পনের। মাথায় জেঁকে বসেছে এক ঝাঁক চিন্তা। আসলেই তো। এই ব্যপারটা অর্পন আগে খেয়াল করেনি কেনো? প্রাপ্তির অন্ধ হওয়ার পেছনের কারণ কেনো আগে জানতে চায়নি? অর্পনের আগেই জেনে নেয়া উচিত ছিলো। এতোদিন যেটা স্বাভাবিক ভাবছিলো, সেটা কি আদৌ স্বাভাবিক বিষয়? সাগরের সন্দেহ যদি সত্যি হয় তাহলে প্রাপ্তির খুব কাছের কেউ ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে?
—————————
প্রাপ্তিকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই ড্রয়িংরুমের সোফায় সজীবকে বসে থাকতে দেখে থমকে যায় দীপ্তি। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মুখের দাড়ি গুলো বড় হয়ে অদ্ভুত লাগছে দেখতে। চোখটা হালকা লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি। সজীবের এমন এলোমেলো বিধ্বস্ত চেহারা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে যায় দীপ্তি। পরক্ষনেই মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অভিমান গুলো ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিনা বাক্যে পা চালিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় দীপ্তি। একটা কথাও বলে না সজীবের সাথে।
দীপ্তির চলে যাওয়ার দিকে আহত চোখে তাকায় সজীব। মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে প্রাপ্তির মুখোমুখি দাড়ায়। চিন্তিত কন্ঠে বলে,
—“এখন কেমন আছিস? হঠাৎ কি হয়েছিলো? আমাকে জানাসনি কেনো?”
সজীবের পরপর এতগুলো প্রশ্ন শুনে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রাপ্তি। হাতড়ে সজীবের হাতটা ধরে আস্বস্ত সুরে বলে,
—“আমি ঠিক আছি দাদাভাই। চোখে হঠাৎ ব্যথা করছিলো কিন্তু এখন আর ব্যথা নেই। পেইন কিলার খেয়ে এখন আরাম পেয়েছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা, তুমি আপির কাছে যাও। আপি কোনো কারণে তোমার ওপর অভিমান করে আছে।”
প্রাপ্তির কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে সজীব। কিভাবে দীপ্তির অভিমান ভাঙাবে সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে। দীপ্তি কি আদৌ সজীবের কথা বুঝবে? সজীব কি পারবে দীপ্তিকে মানাতে? ভাবনা চিন্তার মাঝেই হাতে টান অনুভব করে সজীব। ভাবনার ছেদ ঘটে তার। প্রাপ্তি ব্যকুল কন্ঠে বলে,
—“দাড়িয়ে আছো কেনো দাদাভাই? কি হয়েছে?”
—“তোর আপিকে মানাবো কিভাবে সেটাই ভাবছি।”
—“সবসময় যেভাবে মানাও সেভাবেই মানাবে। তুমি তো আমার সুপার হিরো। তুমি সব সামলে নিতে পারবে। আর দেরি করো না যাও।”
সজীব আর কোনো কথা ব্যায় করে না। সুপ্তির হাতে প্রাপ্তির হাতটা দিয়ে পা চালায় দোতলার দিকে। বৌকে মানাতে এবার বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে।
সজীব যেতেই সুপ্তি প্রাপ্তিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দড়জা হালকা চাপিয়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
—“দাদাভাই আর বড় আপির মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে ছোট আপি?”
—“হয়তো!”
—“এতো বছরে আজ প্রথম দুজনের মধ্যে মান অভিমান দেখলাম। আমি তো ভাবতাম বড় আপি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। ওদের হয়তো কখনো ঝগড়া হয় না।”
কথার মাঝেই বিছানার কাছে চলে আসে দুজন। নরম বিছানায় আরাম করে বসে প্রাপ্তি নিজের পাশে বসতে ইশারা করে সুপ্তিকে। বোনের ইশারা বুঝে প্রাপ্তির কাছ ঘেঁষে বসে সুপ্তি। প্রাপ্তি সময় নিয়ে বলে,
—“এই পৃথিবীতে কেউ সুখী নয় সুপ্তি। সবারই কোনো না কোনো দিক থেকে কমতি আছে। সবার জীবনেই কোনো না কোনোদিক থেকে কষ্ট আছে। মানুষ ভেদে তাদের কষ্টের ধরনও ভিন্ন। আমাদের সবটা মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়। জীবনের একটা কষ্টদায়ক দিক থাকলে আর পাঁচটা সুখময় দিক থাকে। কষ্টটাকে উপেক্ষা করে সুখটাকে আপন করে নিতে হয়। আর যে এমনটা করতে পারে, সেই এই পৃথিবীতে একমাত্র সুখী ব্যক্তি। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?”
প্রাপ্তির কথা শুনে হালকা হাসে সুপ্তি। তার ছোট আপি জীবন সম্পর্কে অনেক ভালো ভাবে বর্ণনা দেয়। বয়সে দীপ্তির ছোটো হলেও বুদ্ধি যেনো সবার চেয়ে বেশি। প্রাপ্তির কথা গুলো সুপ্তির কাছে বেশ ভারি মনে হয়। এক একটা কথার ওজন যেনো কয়েক টন ভারি। সব পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার একটা চমৎকার গুণ আছে প্রাপ্তির। আর এই গুণটাই সুপ্তিকে বারে বারে বিমোহিত করে।
————————-
বিকালে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছে রুবিয়া। তাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে বকুল। এই কয়েকদিনে বকুল একদম মিশে গেছে রুবিয়া আর নুহাশের সাথে। ওদের পরিবারের একটা অংশ হয়ে গেছে যেনো।
রুবিয়া যখন চুলায় গরম গরম পিয়াজু ভাজতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ করেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। বাসায় নুহাশ নেই। কোনো জরুরি কাজে বেরিয়েছে। রুবিয়া চুলার আচ কমিয়ে দিয়ে দড়জা খুলতে যায়। দড়জা খুলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অর্পনের হাস্যজ্জল চেহারা। অর্পনকে দেখে রুবিয়াও মুচকি হাসে। অর্পন ভেতরে আসতে আসতে বলে,
—“কেমন আছো রুবিয়া কাকি?”
—“এই তো, বেশ ভালো। তা হঠাৎ এই সময়ে যে?”
—“একটু দরকারে আসলাম। নুহাশ কাকু কোথায়?”
—“বেরিয়েছে একটু কাজে। তুই বস, আমি ফোন করে আসতে বলছি।”
এরই মাঝে বকুল বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। অর্পনকে দেখেই হাসি মুখে অর্পনের পাশে বসে। বকুলের মধ্যেকার সেই সংকোচবোধ একেবারে শেষ হয়ে গেছে। অর্পনের পাশে বসে হাসি মুখে তাকায়। পরক্ষনেই মুখের হাসি মিলিয়ে যায় বকুলের। আশাভরা চোখে তাকিয়ে বলে,
—“আমার ভাইয়ার কোনো খবর পেয়েছেন পুলিশ ভাইয়া? কোথায় আছে সে?”
বকুলের কথা শুনে অর্পনের মুখের হাসিটাও চলে যায়। প্রচন্ড খারাপ লাগে বকুলের জন্য। বাচ্চা মেয়েটা কতটা আশা নিয়ে বেঁচে আছে। তার ভাইকে কবে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবে সেটা জানে না অর্পন। বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—“পেয়ে যাবো, তাও খুব তাড়াতাড়ি। তোমার ভাইয়াকে ঠিক তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো। কথা দিলাম।”
বকুল আর কিছু বলে না। বুকে এই আশা পুষে রেখেছে যে একদিন তার ভাইয়া ঠিক ফিরে আসবে। দৌড়ে এসে বকুলকে জড়িয়ে ধরবে। কপালে চুমু দিয়ে বলবে” বকুল ফুল, তোকে অনেক মিস করেছি”।
কথাগুলো ভাবতেই চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে বকুলের। এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় নুহাশ। রুবিয়া একটু আগে নাস্তা নিয়ে এসে বসেছে। সবাই নাস্তা খেতে খেতে টুকটাক কথা বলছে। শেষে নুহাশের উদ্দেশ্যে অর্পন বলে,
—“আমি বকুলকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি নুহাশ কাকু।”
অর্পনের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নুহাশ। একই অবস্থা রুবিয়ারও। নুহাশ আশ্চর্য কন্ঠে বলে,
—“কিন্তু কেনো? ও কি এখানে ভালো নেই? আমরা কি কোনোভাবে ওকে কষ্ট দিয়েছি?”
বলেই আশাভরা চোখে বকুলের দিকে তাকায়। বকুল নিজেই প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে। অর্পন সবার দিকে একনজর তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
—“বকুলকে এখানে এতোদিন রেখেছিলাম কারণ ও শারীরিক দিক থেকে অসুস্থ ছিলো। রুবিয়া কাকি যেহেতু নার্স তাই তার কাছে রেখেছিলাম। কিন্তু তোমরা তো জানো বকুলের ব্যপারটা। ওর প্রাণের ঝুঁকি আছে। বকুলের ভাইকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ওকে নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে। বিষয়টা খুব জটিল। তাই আমি ওকে হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করেছি। ওখানেই লেখাপড়া করবে। সেখানকার সিকিউরিটি সিস্টেম অনেক ভালো। বকুলের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা থাকবে না।”
রুবিয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। যেকোনো সময় চোখ থেকে বর্ষন শুরু হবে। মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে একটা অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে গেছে। বকুল চলে যাবে ভাবতেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
নুহাশ রুবিয়া দিকে শান্ত চোখে তাকায়। মুখ দেখেই নিজের স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে পেরেছে যেনো। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বকুলের দিকে তাকায়। মেয়েটা কেমন স্থীর চোখে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। নুহাশ বকুলের ছোট্ট হাতটা আলতো করে ধরে বলে,
—“আমাদের কোনো সন্তান নেই রে মা। এই এতো বড় বাড়িতে দুজন একাই থাকি। বিয়ের এতগুলো বছর পরও কোনো সন্তানের মুখ দেখতে পারিনি। তুই আসার পর থেকে তোকে নিজের সন্তান ভেবেছি। আপন মনে করে কাছে টেনে নিয়েছি।”
কথাগুলো বলেই চুপ হয়ে যায় নুহাশ। কয়েক সেকেন্ড পর আবার বলতে শুরু করে,
—“একটা সন্তানের অভাব খুব করে অনুভব করি। এই অভাবটা মিটিয়ে দিবি মা? হবি আমার সন্তান? আমি কথা দিচ্ছি তোকে সবসময় নিজের কাছেই রাখবো। কোনো বিপদ তোকে ছুঁতে পারবে না। দিবি একটা সুযোগ?”
রুবিয়ার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রুবিয়া নাক টেনে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
—“বাবা মা হিসেবে কি আমরা খুব খারাপ হয়ে যাবো বকুল?”
বকুলের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নুহাশের করুন মুখ, রুবিয়ার কান্না এসব যেনো দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আর সয্য করতে না পেরে বকুল অর্পনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“আমি নিজের পরিবার হারিয়ে আরো একটা পরিবার পেয়েছি পুলিশ ভাইয়া। আমি আমার নতুন পরিবারের সাথে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন না।”
সবার করুন চাহনি এবার অর্পনের দিকে। অর্পন যেনো এবার দোটানায় পড়ে গেলো। বকুল সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব। এই সময়ে একটা পরিবার পাওয়া বকুলের জন্য একটা উজ্জ্বল দিক। কিন্তু ওর সেফটির জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে অর্পনের। রনিকে না পাওয়া পর্যন্ত বকুল তো অর্পনের দায়িত্ব।
অর্পনকে ভাবতে দেখে নুহাশ বলে,
—“তুই কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিস না অর্পন?”
শান্ত চোখে তাকায় অর্পন। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“তোমাকে আমি বিশ্বাস করি নুহাশ কাকু। তুমি আমার ঠিক কতটা কাছের সেটাও কি এখন প্রমান করতে হবে? রক্তের সম্পর্কের বাইরে তুমি আমার সবচেয়ে আপন।”
—“তাহলে বকুলকে আমার কাছে রাখতে এতো কিসের ভাবনা?”
—“আসলে ওর সেফটি নিয়ে ভাবছিলাম। আচ্ছা, তোমরা যখন চাইছো ওকে নিজেদের কাছে রাখতে আর বকুল নিজেও চাইছে তোমাদের সাথে থাকতে তাহলে আমি আর কি বলবো। তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে তোমাদের।”
নুহাশ হেসে বলে,
—“চিন্তা করিস না। আমি সবটা সামলে নেবো।”
——————————
রাতে খাবার খেয়ে দীপ্তির রুমে এসেছে সজীব। এখানে আসার পর থেকে দীপ্তি সজীবের সাথে একটা কথাও বলেনি। যতবার সজীব কথা বলতে গেছে দীপ্তি তাকে এড়িয়ে গেছে। সেগুলো ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে সজীব। দড়জাটা আস্তে করে আটকে দিয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হয়। দীপ্তি বিছানায় বসে ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে আছে। সজীব কিছু বলতে যাবে ওই মুহুর্তে তার ফোন বেজে ওঠে। কথা বলার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে সজীব। তার মায়ের ফোন। অনিচ্ছার সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপর থেকে ভেসে আসে মোটা গম্ভীর সুর,
—“বৌকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ফিরবি। বাড়ির বৌদের বাবার বাড়ি থাকা মানায় না।”
সজীব আড়চোখে একবার দীপ্তির দিকে তাকায়। দীপ্তি এখনো তার হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সাগর ধীর কন্ঠে বলে,
—“দীপ্তি আপাতত বাড়ি ফিরবে না আম্মা।”
—“তুই কি আমার আদেশ অমান্য করছিস?”
—“বাধ্য হচ্ছি এবার অমান্য করতে। একটু বোঝার চেষ্টা করুন আম্মা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। এই মুহূর্তে দীপ্তির বাবার বাড়ি থাকাই শ্রেয়। ওর মন মেজাজ ঠিক হলে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।”
এই পর্যায়ে একটু দমে যান রাবেয়া বেগম। কন্ঠে রাগের মাত্র কমিয়ে এনে বলেন,
—“তুই এখন কোথায়?”
—“গোডাউনে ছিলাম। মাত্রই বের হয়েছি। এখন ক্লাবে যাবো। আজ রাতে বাড়ি ফিরবো না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
কথা শেষ হতেই ফোন কেটে দেয় সজীব। পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে দীপ্তি শুয়ে পড়েছে। দীপ্তি যে ঘুমায়নি সেটা সজীব বেশ বুঝতে পারছে। তবুও কথা বাড়ায় না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
সজীব যেতেই উঠে বসে দীপ্তি। অভিমানেরা চোখ থেকে অশ্রু আকারে ঝরে পড়ছে। সজীবের প্রতি অভিমান কমার বদলে আরো একধাপ বেড়ে গেলো। এতো কিসের লুকোচুরি তার? এতো কেনো মিথ্যে বলতে হয় তার আম্মাকে? সে দীপ্তির কাছে আছে এটুকু বলার সাহস হলোনা তার। রেগে ফের শুয়ে পড়ে দীপ্তি। বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ওঠে। অঝোরে কাঁদতে থাকে। সেই সাথে করতে থাকে র্স্ফুটস্বরে আর্তনাদ। সজীবের এই পরিবর্তনের কারণ দীপ্তি বেশ বুঝতে পারছে। সবাই তো বাচ্চা না হওয়ার জন্য। আজ একটা বাচ্চার অভাব বড্ড বেশি অনুভব করছে দীপ্তি। একটা বাচ্চা থাকলে সজীব এমন করতে পারতো না। তার সাজানো সংসার এভাবে এলোমেলো হয়ে যেতো না। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে উঠে বসে দীপ্তি। মাথায় জেঁকে বসে বিশাল বড় চিন্তার পাহাড়। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কৌতুহল। ঘুরে ফিরে সন্দেহের তীর সেই নিষিদ্ধ ঘরের সামনে গিয়ে থামছে। কি এমন আছে ওই নিষিদ্ধ ঘরে? কেনো সেখানে কাউকে যেতে দেয় না তার শ্বাশুড়ি? এতো কঠোর নিষেধাজ্ঞা কেনো ওই ঘরের জন্য? দিপ্তিকে জানতে হবে। সব কেনোর উত্তর বের করতে হবে। আর তার জন্য ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। এবার দীপ্তি সব জেনেই ছাড়বে। সজীবকে আর অজুহাত দেখানোর সুযোগ দিবে না।
চলবে?