তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৩২+৩৩

0
177

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩২
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

আজকের সকালটা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই প্রাণোচ্ছল। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিয়ের মিষ্টি সুবাস। সাজ সাজ আমেজে মেতে উঠেছে বাড়ির প্রতিটি সদস্য। অতি নিকটস্থ আত্মীয় স্বজন ইতিমধ্যে চলে এসেছে বিয়ের দাওয়াত রক্ষার্থে। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সকলে। কামরুল সাহেব হাতে লাঠি নিয়ে পুরো কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে বিচরণ করছেন। তার প্রধান কাজ হলো সকল কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেটা তদারকি করা। অর্পনের কথামতো বিয়ে বাড়িতে না হয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছে। এর পেছনে নাকি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে কিন্তু সেই কারণ এখনো কাউকে জানায়নি। এতে অমত করতে পারেনি কেউ। সাগর আর অঙ্কন আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। বাড়ির পুরুষদের দায়িত্ব শুধু হেঁটে হেঁটে কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কি না সেটা তদারকি করা।

প্রাপ্তিকে সাজানো হচ্ছে একটা ঘরে। পার্লার থেকে চারজন মেয়েকে নিয়ে এসেছে অর্পন। বিয়ের সকল কাজ কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরেই হবে। বাইরে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। গেটের সামনে দুইজন পুলিশ কনস্টেবলকে পাহারায় রাখা হয়েছে। কোনো অপরিচিত ব্যক্তি যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেই জন্য। আজকের দিনে অর্পন কোনো প্রকার ঝামেলা চায় না।

গেটের সামনে দাড়িয়ে কনস্টেবল দুজনকে সিকিউরিটি সিস্টেম ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো অর্পন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় নুহাশ। পেছন পেছন আসে রুবিয়া আর বকুল। অর্পনকে দেখে বকুল, নুহাশ রুবিয়াকে রেখে দৌড়ে চলে আসে গেটের সামনে। অর্পনের সামনাসামনি দাড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে,

—“কনগ্রাচুলেশন পুলিশ ভাইয়া!”

কথায় মাঝেই পেছন থেকে কারোর গলার আওয়াজ শুনে পেছন ঘুরে তাকায় অর্পন। নিজের পেছনে বকুলকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেলে। আলতো করে নাক টেনে দিয়ে বলে,

—“ধন্যবাদ বকুল ফুল। আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে।”

—“আজ আপনার বিয়ে তাই। বাবা মা আর পুলিশ ভাইয়া তো আগেই পেয়ে গেছি। এবার আমি ভাবি পাবো। তাই এতো খুশি।”

—“আমি কিন্তু তোমার খুশি আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিতে পারি।”

—“তাই? কিভাবে?”

অর্পন নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ায়। বকুলের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

—“রনির খবর পেয়ে গেছি আমি। খুব তাড়াতাড়ি তাকে তোমার সামনে হাজির করবো। তবে এটা কিন্তু সিক্রেট। কাউকে বলা যাবে না।”

অর্পনের কথা শুনে পাথর হয়ে জমে যায় বকুল। ছলছল চোখে তাকায় অর্পনের মুখের দিকে। বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মানুষ অতিরিক্ত কষ্টে হাসে, পাগলের মতো হাসে। আবার অতিরিক্ত খুশিতে কাঁদে। বকুলের অবস্থাও ঠিক তাই। অতিরিক্ত খুশিতে চোখ থেকে নোনা জলের বর্ষন শুরু হয়েছে। ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশা বুকে শীতলতা ছড়িয়ে দিয়েছে। ঠোঁটে একরাশ খুশি নিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

—“সত্যি?”

—“তিন সত্যি। তবে বললাম তো কাউকে বলা যাবে না। না হলে ওকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারবো না।”

বকুল ছোট হলেও এতোটাও ছোটো নয়। ভালো মন্দ বোঝার মতো বুদ্ধি আছে তার। এই কথা ফাঁস হলে অর্পন তার কাজে অসফল হবে। তার ভাইয়ের বিপদ হবে। সেটা বকুল বেশ বুঝতে পারছে। তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, জীবন চলে গেলেও এই কথা কাউকে বলবে না। ততক্ষণে নুহাশ আর রুবিয়া অর্পনের কাছাকাছি চলে এসেছে। নুহাশের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে চলে যায় অর্পন।

বাগান সাইডে হলুদের জন্য স্টেজ সাজানো হয়েছে। অর্পন নুহাশ, রুবিয়া আর বকুলকে নিয়ে সোজা সেখানে চলে যায়। সুভাষ সাহেব আর মারুফ সাহেব স্টেজের পাশে দাড়িয়ে কথা বলছিলেন। নুহাশের সাথে বকুলকে দেখে প্রশ্ন করেন,

—“এটাই কি বকুল?”

নুহাশ হাসিমুখে জবাব দেয়,

—“হ্যা ভাইয়া। এতো বছরের শূন্য কোল মেয়েটা এসে পূর্ণ করে দিয়েছে। তাই একেবারে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি।”

মারুফ সাহেব অতিথিদের চিনতে না পেরে সুভাষ সাহেবের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকান। তার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে সুভাষ সাহেব বলেন,

—“ওর নাম নুহাশ। আমার ফুপির ছেলে। ওর সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তার চেয়ে বেশি আপন। আর এটা ওর ওয়াইফ রুবিয়া। আর ওদের মেয়ে বকুল।”

শেষের বাক্যটা রুবিয়া আর বকুলের উদ্দেশ্যে বলেন। হেসে কুশল বিনিময় করেন মারুফ সাহেব। প্রাপ্তিকে তখন স্টেজে নিয়ে আসা হয়। হলুদ, বিয়ে দু’টোই একদিনে সম্পন্ন হবে তাই ব্যস্ততা একটু বেশি।

সকলের হৈচৈ শুনে পেছন ফিরে তাকায় অর্পন। সহসা চোখ জোড়া শীতল হয়ে যায় তার। চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ মুগ্ধতা। প্রাপ্তিকে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচা গাঁদা ফুলের গহনা। মুখে কোনো প্রকার কৃত্রিম মেকআপ নেই। ফর্সা শরীরে হলুদ রঙটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। বাগানের মৃদুমন্দ বাতাসে প্রাপ্তির কোমরা পর্যন্ত খোলা চুল গুলো দোল খাচ্ছে। কিছু অবাধ্য চুল বাতাসের দাপটে চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। বেশ বিরক্ত হয় অর্পন। কিছুটা হিংসা জাগে মনে। সে নিজে এখনো প্রাপ্তির কোমল মুখটা ছুয়ে দেখলো না অথচ এই অবাধ্য চুল গুলো অনায়াসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হাসে অর্পন। এখন সে সামান্য চুলের ওপরও হিংসা বোধ করছে। আশ্চর্য!

প্রাপ্তি আর অর্পন বাদে সব মেয়েরা সবুজ শাড়ি আর ছেলেরা সবুজ পাঞ্জাবি পড়েছে। প্রাপ্তির দুই পাশে দুই হাত ধরে আছে সুপ্তি আর দীপ্তি। প্রাপ্তির হাত ধরে স্টেজের দিকে নিয়ে আসছে। দুই বোনের সাহায্য নিয়ে স্টেজে উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। বর কনের জন্য বরাদ্দকৃত সোফায় প্রাপ্তিকে বসিয়ে দিয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় দীপ্তি। বাবা মাকে ডাকতে সুপ্তিকে নিচে পাঠিয়ে দেয়। বড় বোনের আদেশে নিচে নেমে মা বাবাকে খুজতে চলে যায় সুপ্তি।

একটু সময় নিয়ে অর্পন সোফায় গিয়ে বসে। প্রাপ্তির থেকে ইঞ্চি খানিক দুরত্ব রেখে বসেছে। সকলের অগোচরে প্রাপ্তির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

—“সুন্দর লাগছে মিসেস অর্পন।”

অর্পন ফিসফিস আওয়াজ শুনে শরীর জমে হিম হয়ে যায় প্রাপ্তির। বক্ষ জুড়ে বয়ে যায় শীতল স্রোত। লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নেয়। লজ্জা মিশ্রতি কন্ঠে বলে,

—“এখনো মিসেস হইনি অফিসার।”

—“হয়ে যাবে। ব্যাস কয়েক ঘন্টার ব্যবধান মাত্র। আজ মহাপ্রলয় হলেও তোমাকে আমার মিসেস হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না।”

মুচকি হেসে জবাব দেয় অর্পন। প্রাপ্তি লজ্জায় পুরো লাল হয়ে গেছে। পূর্বের তুলনায় আরো খানিকটা মাথা ঝুকিয়ে ফেলে। এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয় বাড়ির সকল সদস্য। কামরুল সাহেব সকলের বড়, তাই তাকে দিয়েই হলুদের কার্যক্রম শুরু করা হবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো হলুদ না পেয়ে। সেটা তো ঘর থেকে আনাই হয়নি। হলুদ আনতে সুপ্তিকে পাঠানো হয় কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে। বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে সুপ্তি। তাকে কেউ শান্তিতে আনন্দই করতে দিচ্ছে না। একাজে ওকাজে চড়কির মতো ঘোরাচ্ছে। ছোট হওয়া মহা জ্বালার।

বিরক্তি নিয়ে হলুদের সন্ধানে ভেতরে চলে যায় সুপ্তি। মিনিট পাঁচেক পর হলুদের বাটি হাতে নিয়ে বাগানের দিকে হাটা দেয়। শাড়ি পড়ার অভ্যাস না থাকায় হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ক্রমে ক্রমে পায়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে শাড়ির নিচের অংশ। ভয় হচ্ছে সুপ্তির। সখের বসে শাড়ি পড়ে আবার সবার সামনে লজ্জায় না পড়তে হয়। পা টিপে টিপে হাঁটার সময় হঠাৎ সামনে এসে কেউ দাঁড়ায়। মাটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে তাকায় সুপ্তি। সামনে অঙ্কন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেই সাথে চোখে মুখে তার মহা বিরক্তি। রাগ আর বিরক্তি একসাথে মিলে মিশে চেহারার নকশা পাল্টে গেছে যেনো। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে অঙ্কন বলে,

—“না খেয়ে আছো? শরীরে জোর নেই? ভাই ভাবি হলুদের জন্য আজন্ম কাল অপেক্ষা করে বসে থাকবে?”

রাগ উঠে যায় সুপ্তির। অঙ্কনের খোঁচা মারা কথা সুপ্তির বেশ গায়ে লেগেছে। পাল্টা প্রতিউত্তর করতে যাবে তখন হঠাৎ করেই মনে হয় গতদিনের কথা। কিভাবে রাস্তায় সবার সামনে অপমান করেছিলো অঙ্কন। রাগে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় সুপ্তি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, আর কোনোদিনও অঙ্কনের সাথে কথা বলবে না। সেই অভিমানের রেশ ধরেই অঙ্কনকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যায়। এতে বেজায় রেগে যায় অঙ্কন। সুপ্তির হাত থেকে ছোঁ মেরে হলুদের বাটিটা নিয়ে বলে,

—“তুমি আর তোমার ব্যবহার, দুটোই বেকার। এখন যুগ যুগ ধরে হাঁটতে থাকো এমন কচ্ছপের গতিতে।”

বলেই সুপ্তিকে রেখে স্টেজের দিকে হাটা দেয় অঙ্কন। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে সুপ্তি। চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অঙ্কনের সেই রুষ্ট আচরণ মনে ভালোই দাগ কেটেছে। এতোটা খারাপ আচরণ সুপ্তির সাথে এর আগে কেউ করেনি। তাই অর্পনের সাথে কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। এটা অভিমান নাকি রাগ সেটা সুপ্তি জানে না। শুধু এটা জানে, সে আর অঙ্কনের সাথে কথা বলবে না। কক্ষনো না।

কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে থেমে যায় অঙ্কন। এতোগুলা কথা বলার পরেও সুপ্তি কোনো উত্তর দিলো না। বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে অঙ্কনকে। পেছনে সুপ্তির কোনো সাড়া শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। কৌতুহল বসত পেছনে ঘুরে তাকায় অঙ্কন। তাকাতেই রাগটা আবার সপ্তম আসমানে উঠে যায়। সুপ্তি আগে যেখানে দাড়িয়ে ছিলো ঠিক একই জায়গায় ঠাঁই দাড়িয়ে আছে। আর তার সামনে কালকে সেই ছেলেটাও দাড়িয়ে। কি যেনো কথা বলছে। এই ছেলেটাকে এখানে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না অঙ্কন। কোনো অজানা কারণে ছেলেটাকে নিজের শত্রু মনে হচ্ছে। হনহন করে সেদিকে এগিয়ে যায় অঙ্কন। শুনতে পায় ছেলেটার চিন্তিত কণ্ঠস্বর,

—“কি হয়েছে মিস? কোনো সমস্যা? আপনি কাঁদছেন কেনো?”

—“কোলে করে কান্না থামাবে নাকি?”

গম্ভীর স্বরে কথা শুনে পেছন ফিরে তাকায় ছেলেটা। অর্পনকে দেখে বলে,

—“জ্বি! মানে?”

অঙ্কনের ঠোঁটে তাচ্ছিল্য হাসি। ব্যাঙ্গ করে বলে,

—“সাধারণ কথা যে বুঝতে পারে না, সে বারে বারে আসে অন্যের সমস্যা সমাধান করতে। তা তুমি এখানে কেনো?”

—“আমি এখানকার ম্যনেজারের ভাই রবি। আর আপনি?”

—“আমি কে সেটা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। আমাকে নিয়ে না ভেবে তুমি বরং নিজের চর্কায় তেল দাও।”

কথাগুলো বলেই সুপ্তির দিকে আগুন চোখে তাকায় অঙ্কন। এক হাতে হলুদের বাটি নিয়ে অন্য হাতে সুপ্তির হাতের কব্জি চেপে ধরে। আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে টানতে টানতে নিয়ে যায় সুপ্তিকে। স্টেজের কাছাকাছি আসতেই ঝটকা মেরে হাত ছেড়ে দেয়। তারপর হনহন করে স্টেজে উঠে যায়।

হলুদের কাজ সম্পন্ন করে মেয়েরা ফের ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সাজগোজ করতে। হলুদ লাগানোর পর শুধু গোসলের সুযোগটা পেয়েছে প্রাপ্তি। তারপরই পার্লারের মেয়েগুলো চেপে ধরেছে তাকে। হলুদে কোনোরকমে ছাড় পেলেও এবার আর কেউ ছাড়ছে না। এক প্রকার জোর করেই দুনিয়ার সমস্ত মেকআপ মুখে দিতে শুরু করেছে। অতিথিরা খাওয়া দাওয়া করছে। এর মাঝেই সাজগোজ শেষ করতে হবে।

অর্পনের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে অর্পন। হলুদের পাঞ্জাবি খুলে একটা সোনালী রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। পাঞ্জাবির বুকের পাশে খয়েরী সুতার কাজ করা। চেঞ্জ করে আসতেই ফোন বেজে ওঠে তার। রিসিভ করতেই মুখটা গম্ভীর হয়ে যায় অর্পনের। ওপাশ থেকে একজন কনস্টেবলের সতর্ক কন্ঠ শোনা যায়,

—“স্যার, কিছু গন্ডগোল আছে। চার পাঁচজন অপরিচিত ছেলেদের দেখা যাচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারের আশেপাশে। একবার ঢুকতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি ঢুকতে দেই নি। তারপর থেকে আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ওদের মতলব বুঝতে পারছি না।”

অর্পনের মুখ শক্ত হয়ে আছে। চোখের চাহনি মারাত্মক সিরিয়াস। কনস্টেবলের সম্পূর্ণ কথা মন দিয়ে শুনে অর্পন। পরপরই গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“নজর রাখো ওদের ওপর। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”

কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দেয় অর্পন। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। চোখের লাল শীরা গুলো ফুটে উঠেছে। রেগে হাতের ফোনটা আছাড় মারতে গিয়েও থেমে যায়। চট করে ফোন পাশে রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখে। পরপরই অর্পনের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে ক্রুর হাসি। মুচকি হেসে আপন মনে বলে,

—“তাহলে এই ব্যপার! তোমাকে তো আমি চালাক ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো দেখছি কাঁচা খেলোয়াড়। এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি অর্পনকে হারাবে! তাহলে শুনে রাখো, এই খেলায় অর্পন তোমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছে। দেখি তুমি আমার কি করতে পারো। অর্পন সর্বদা প্রস্তুত।”

এরই মাঝে ঘরে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ করেন দিদার সাহেব। ব্যস্ত কন্ঠে বলেন,

—“অর্পন কিছু একটা গন্ডগোল আছে।”

—“গুরুতর কিছু নয় স্যার। ব্যস একটা ছোট্ট খেলা খেলতে চেয়েছে তারা।”

বলেই ল্যাপটপটা দিদার সাহেবের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। দিদার সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলে,

—“এটা! কিন্তু কিভাবে?”

—“পুরো কমিউনিটি সেন্টারে এমন অনেক ক্যামেরা লাগিয়েছি। অর্পন কাঁচা কাজ করে না স্যার।”

—“আমার চিন্তা হচ্ছে অর্পন। যদি প্রাপ্তির কোনো ক্ষতি হয়।”

—“অর্পন বেঁচে থাকতে সেটা হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

—“তুমি পারবে তো সব সামলাতে?”

ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রাপ্তির মুখ। চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“পারতেই হবে স্যার। বিষয়টা যখন প্রাপ্তিকে নিয়ে তখন অর্পন এতে একদম হেলা করবে না।”

দুজনের কথার মাঝেই সেখানে উপস্থিত হন সুভাষ সাহেব। অর্পনকে তাড়া দিয়ে বলেন,

—“এখানে বসে সময় নষ্ট করছো কেনো? ওদিকে কাজি সাহেব ডাকছে তোমাকে। চলো!”

বাবার ডাকে সহসা উঠে দাঁড়ায় অর্পন। দিদার সাহেবকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। প্রাপ্তিকে দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। বিয়ের সাজে কেমন লাগছে প্রাপ্তিকে, সেটা না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না অর্পন। স্টেজের কাছে এসে দেখে অলরেডি সেখানে প্রাপ্তি উপস্থিত। অর্পনই আসতে দেরি করে ফেলেছে। ব্যস্ত পায়ে স্টেজে উঠে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় বসে অর্পন। দুজন মুখোমুখি বসে আছে। তবে মাঝখানে বড়সড় লাল জর্জেট কাপড় টানানো হয়েছে। যার দরুন সামনে থেকেও প্রাপ্তির মুখ দেখা যাচ্ছে না। বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। এতো কাছে থেকেও প্রাপ্তির মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

পরিবারের সকালের উপস্থিতিতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। সকলে নব দম্পতিকে নতুন জীবনের শুভকামনা জানিয়ে একে একে বিদায় নেয়। বিদায়বেলায় অশ্রুশিক্ত হয় সকলের চোখ। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে দীপ্তি। প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। দীপ্তির এমন অস্বাভাবিক কান্নার কারণ বুঝতে পারে না প্রাপ্তি। সবকিছু কেমন যেনো অন্য রকম লাগছে। আজ প্রাপ্তির জীবনের একটা বিশেষ দিন। এই দিনে সজীব এখানে উপস্থিত নেই। জিজ্ঞেস করায় দীপ্তি কাজের বাহানা দেখিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রাপ্তির মন মানছে না। মনে হচ্ছে এর পেছনে বড় কোনো কারণ আছে। তার পরিবার কিছু একটা লুকাচ্ছে তার থেকে। কিন্তু কি?

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৩
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

দীপ্তির এই অদ্ভুত আচরণে মনে ভয় জেঁকে বসে প্রাপ্তির। সজীব প্রাপ্তি এবং তার পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে। নিজের বোনের মতো আদর করেছে প্রাপ্তি আর সুপ্তিকে। বিশেষ করে প্রাপ্তির প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাহলে আজ প্রাপ্তির এই বিশেষ দিনে সে কেনো নেই? কি এমন কাজ আছে তার যে আজকের দিনেও আসতে পারলো না।

প্রাপ্তির ভাবনার ছেদ ঘটে অর্পনের কথায়। অর্পন কিছুটা এগিয়ে এসে প্রাপ্তির হাতটা আলতো করে মুঠোয় পুরে নেয়। নরম কন্ঠে বলে,

—“আজকের এই দিনটায় আমি বিশেষ কিছু করতে চাই প্রাপ্তি। তুমি কি আমার সঙ্গ দেবে?”

—“কিভাবে?”

ভ্রু কুচকে জবাব দেয় প্রাপ্তি। সেদিকে তাকিয়ে আলতো হাসে অর্পন। প্রাপ্তির ধরে রাখা হাতটা সামনে এগিয়ে কিছু একটার ওপর হাতটা রাখে। ভ্রু কুঁচকে হাত বুলায় প্রাপ্তি। স্পর্শ করে বুঝতে পারে এটা একটা বাইক। মুহুর্তেই ঘুরে তাকায় প্রাপ্তি। অর্পনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“এটা তো বাইক!”

—“হ্যা, বাইক। সুপ্তির থেকে শুনেছিলাম তুমি বাইক অনেক পছন্দ করো। এমনকি তুমি একসময় নিজেও বাইক চালাতে। তাই ভাবলাম আজকের দিনটা একটু অন্য ভাবে সাজাই। প্রাইভেট কারে তো সবাই বৌ নিয়ে যায়। কিন্তু আমি আমার বৌকে বাইকে করে তার শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাবো৷ বিষয়টা ইন্টারেস্টিং তাই না?”

প্রাপ্তির চোখে মুখে বিস্ময়। অর্পন ওর বিষয়ে এতোকিছু খবর রাখে। প্রাপ্তি কি পছন্দ করে আর কি করে না এসব খুজে খুজে বের করছে। এটা ঠিক প্রাপ্তি এক সময় বাইক অনেক পছন্দ করতো। মেয়ের উৎসাহ দেখে মারুফ সাহেব একটা বাইক গিফট করেন প্রাপ্তিকে। সেটা নিয়ে প্রাপ্তি পুরো শহর ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু চোখের দৃষ্টি শক্তি হারানোর পর সেই বাইক জায়গায় পেয়েছে বাড়ির স্টোর রুমে। অনাদর অবহেলায় ধুলোবালি মেখে গড়াগড়ি খাচ্ছে ঘরের এক কোণে। এতোগুলা বছর পর বাইক ছুয়ে মনের মধ্যে আলাদা শিহরণ জেগে ওঠে প্রাপ্তির। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।

অর্পন দুকদম পিছনে গিয়ে সাগরের সামনে দাঁড়ায়। সাগর আর অঙ্কন একসাথেই ছিলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো অর্পনের দিকে। বিয়ের দিন বৌ গাড়িতে করে না নিয়ে বাইকে নিয়ে যাওয়ার লজিক ওদের মাথায় ঢুকছে না। অর্পনই হয়তো একমাত্র বর যে সাজানো গাড়ি রেখে বৌকে বাইকে নিয়ে যেতে চাইছে। ওদের দুজনের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে অর্পন ধীর কন্ঠে বলে,

—“অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই গাড়িটার ব্রেক ফেল করা আছে। বিস্তারিত সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলে জানতে পারবে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে তোমরা অন্য গাড়িতে বেরিয়ে পড়ো। ওটা ঠিক আছে, আমি চেক করে দেখেছি। প্রাপ্তিকে নিয়ে আমি বাইকে আসছি।”

অর্পনের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় সাগর। অঙ্কন পুরোই হতভম্ব। গাড়ি ব্রেকফেল কিভাবে হলো? গাড়ি তো একদম ঠিক ছিলো। তাহলে কে করলো এই কাজ? হাজারো চিন্তা মাথায় থাকলেও আর কোনো প্রশ্ন করে না কেউ। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে একটু আগে। এর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না।

বাড়ির সকল সদস্যদের নিয়ে বড় গাড়িতে করে চলে যায় সাগর। সবাই চলে যাওয়ার পরপরই অর্পন প্রাপ্তিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিয়ের ভারি লেহেঙ্গা পড়ে বাইকে বসতে বেজায় কষ্ট হয় প্রাপ্তির। তবে এই ভালোলাগার অনুভূতির কাছে এটুকু কষ্ট কিছুই না। এক হাতে লেহেঙ্গা গুছিয়ে ধরে অন্য হাতে অর্পনের কাঁধ চেপে ধরে। কেনো যেনো পাশাপাশি বসতে কোনো সংকোচ বোধ হচ্ছে না আজ। অদৃশ্য এক অধিকারবোধ কাজ করছে মনের মধ্যে। প্রাপ্তি ঠিক মতো বসতেই বাইক স্টার্ট দেয় অর্পন। কানে ব্লুটুথ ডিভাইস লাগিয়ে এক টানে বাইক নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে চলে যায়।

বাইক চলছে আপন গতিতে। গোধূলির শীতল হিমেল হাওয়া ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে চোখ মুখ। শীতলতায় ভরপুর চারিদিক। প্রিয় মানুষের সাথে বাইকে শহর ঘুরে বেড়ানো, এ যেনো এক আলাদা অনুভূতি। মিনিট দশেক চলার পরে অর্পন খেয়াল করে তাদের পেছনে আরো দুটো বাইক আসছে। হেলমেট না পড়ায় দুই বাইকে বসে থাকা চারজনের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরাই সারাদিন কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে ঘুরঘুর করছিলো। এমনকি এদের মধ্যে একজন অর্পনের গাড়ির ব্রেকফেল করে দিয়েছিলো। সিসিটিভি ফুটেজে সবটাই দেখেছে অর্পন। ওরা যে আবার অর্পনের পিছু নেবে সেটাও আন্দাজ করেছিলো অর্পন। সবকিছু ধারনা মাফিক ঠিকঠাকই হচ্ছে। বাইকের মিররে দৃষ্টি তাক করে তাচ্ছিল্য হাসে অর্পন। হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“আমার কোমর জড়িয়ে ধরো প্রাপ্তি, ফাস্ট।”

অর্পনের হঠাৎ কন্ঠে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাপ্তি। কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই অর্পন ফের বলে,

—“প্রাপ্তি, ফাস্ট!”

এই পর্যায়ে নিজের কৌতুহল দমিয়ে নেয় প্রাপ্তি। বাম হাতে লেহেঙ্গা গুছিয়ে ধরে ডান হাতে অর্পনের কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুহুর্তেই অর্পন বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দেয়। হাওয়ার বেগে বাইক ছুটিয়ে চলে হাইওয়ের রাস্তা ধরে। রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলো ক্রস করে এঁকে বেঁকে ছুটে চলে বাইক। পরপর স্পিড বাড়ায় পেছনের বাইক দুটোও। এ যেনো প্রতিযোগিতা চলছে। কার আগে কে যাবে সেই দন্দ। এদিকে প্রাপ্তি পুরো হতভম্ব। হঠাৎ করে এতো জোরে বাইক চালানোর কোনো কারণ সে খুজে পাচ্ছে না। বাতাসে উড়ে যাওয়ার উপক্রম। এভাবেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে হাইওয়ের রাস্তার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে সবাই। পেছনের বাইক দুটো অর্পনের বাইক প্রায় ছুঁই ছুঁই অবস্থা। পেছন থেকে একজন ছোট্ট চাকু বের করে হাতে নিয়েছে। হয়তো চলতে চলতেই আক্রমন করার পরিকল্পনা করেছে তারা। হাইওয়ের শেষ প্রান্তে রাস্তা দুই ভাগে বিভক্ত। পেছনের বাইক নিয়ে তারা আক্রমণ করতে প্রস্তুত। এমন সময় অর্পন মুচকি হেসে বলে,

—“রহিম সাহেব, এক্সন!”

সাথে সাথে রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলোর মধ্যে থেকে দু’টো গাড়ি এসে বাইক দুটোর পথ আটকে দাঁড়ায়। থেমে যায় বাইক দুটো। মুহুর্তেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে একদল পুলিশ। তারা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে বাইকে বসে থাকা চারজনকে।

কিছুদূর গিয়ে বাইক থামিয়ে দাঁড়ায় অর্পন। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। বাঁকা হেঁসে ব্লুটুথে একটা আঙুল রেখে বলে,

—“এদের শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাও রহিম। ভালোমতো খাতিরদারি করো। আমি কাল দেখা করছি ওদের সাথে।”

প্রাপ্তি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই মাঝরাস্তায় বাইকে বসে কার সাথে কথা বলছে অর্পন? কৌতুহল দমাতে না পেরে প্রশ্ন করেই ফেলে,

—“আপনি কি বলবেন কি হয়েছে? কাকে এক্সন নিতে বললেন? আর কার সাথে কথা বলছেন? বাইক এতো জোরে চালাচ্ছিলেন কেনো?”

অর্পনের ঠোঁটে এখনো বাঁকা হাসি। দুষ্টু হেসে বলে,

—“বাড়ি যাওয়ার তাড়ায় আছি তাই বাইক জোরে চালাচ্ছিলাম। বাসর কি এই রাস্তাতেই করবো নাকি? আর কথা বলছিলাম কনস্টেবল রহিমের সাথে। কানে ব্লুটুথ ডিভাইস কানেক্ট করা আছে। এখন কথা বলে সময় নষ্ট করা যাবে না। বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে।”

কথাগুলো বলেই বাইক স্টার্ট দেয় অর্পন।

—————————–

নিজের রুমে সোফায় বসে রাগে ফুঁসছে সজীব। যে ছেলেগুলোকে কমিউনিটি সেন্টারে পাঠিয়েছিলো তাদের মধ্যে চারজন ধরা পড়েছে। খবরটা শোনার পর থেকেই রেখে আগুন হয়ে আছে সজীব। অতিরিক্ত রাগে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। রাগ সামলাতে না পেরে ভাঙচুর শুরু করে ঘরের মধ্যে। ভাঙচুরের আওয়াজ শুনে দৌড়ে চলে আসেন রাবেয়া বেগম। সজীবের হাতে বড় কাচের ফুলদানি। আছাড় মারার জন্য উপরে তুলতেই রাবেয়া বেগম ছুটে এসে ফুলদানিটা সজীবের হাত থেকে কেড়ে নেন। ঝাড়ি মেরে বলেন,

—“পাগল হয়ে গেছিস তুই? এসব ভাঙচুর করছিস কেনো?”

—“হ্যা আমি পাগল হয়ে গেছি। প্রতিনিয়ত হার আমাকে পাগল করে দিয়েছে। প্রাপ্তি আবার বেঁচে গেলো, আবার।”

বলেই পাশের টি-টেবিল লাথি মেরে ফেলে দেয়। ফুঁসে উঠে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। রাবেয়া বেগম ধীরে সুস্থে গিয়ে সজীবের কাছে বসেন। কাঁধে এক হাত রেখে বলেন,

—“আমি তোকে আগেই বলেছিলাম দীপ্তিকে এতো ছাড় দিসনা। দয়া দেখাতি তুই ওর ওপর। এখন দেখলি তো। তোর পিঠ পেছনে বোনের বিয়ে দিয়ে দিলো। তোকে বুঝতেও দিলো না, কিভাবে কি হচ্ছে। কিন্তু আমি ভাবছি, তোর থেকে লুকিয়ে কাজটা কেনো করলো? কোনোভাবে দীপ্তি আমাদের সত্যিটা জেনে যায়নি তো?”

সজীবের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। শয়তানি কন্ঠে বলে,

—“তাহলে তো ভালোই হলো। লুকিয়ে লুকিয়ে খেলে মজা পাচ্ছি না। দুই জায়গায় দুই রুপ দেখাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি। আর অভিনয় করা সম্ভব হচ্ছে না। সব যখন সামনে এসেই গেছে তাহলে আর অভিনয় করার প্রয়োজন নেই। এবার খেলা হবে সামনাসামনি। কোনো লুকোচুরি থাকবে না।”

—“যা করবি সাবধানে! ওই অর্পন ছেলেটা সুবিধার নয়।”

সজীবের ঠোঁটে বাঁকা হাসি এখনো লেগে আছে। সত্যিটা সবার সামনে আসায় বেশ খুশিই হয়েছে। এবার যুদ্ধ হবে সামনাসামনি। হয় মা*র*বে, না হয় ম*র*বে।

————————–

অর্পনে আর প্রাপ্তির জন্য ঘর সাজানো হচ্ছে। পুরো দায়িত্ব এসে পড়েছে সাগরের ঘাড়ে। সাথে সাহায্য করছে অঙ্কন। বাড়ি ফিরেই কাজে লেগে পড়েছে দুই ভাই। কাজ করতে করতে ঘেমে নেয়ে একাকার অঙ্কন। সাগর ঝটপট গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে কিন্তু অঙ্কন সুযোগ পায়নি। শেষে বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,

—“ভাই ভাবি আসলে না হয় বাইরে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখবো। কিন্তু আমার এই মুহুর্তে ফ্রেশ হওয়া দরকার। ঘামে জীবানুগুলো সব কিলবিল কিলবিল করছে।”

নাক মুখ কুঁচকে কথাগুলো বলে অঙ্কন। ওর অস্বস্তিতে ভরপুর মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে সাগর গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। এর মাঝেই ফিরে আসা চাই।”

সাগরের কথা শুনে আঁকতে ওঠে অঙ্কন। পাঁচ মিনিট আবার কোনো সময় হলো নাকি? সে তো পাঞ্জাবি খুলতে আর নতুন পোশাক পড়তেই শেষ হয়ে যাবে। অঙ্কন অসহায় কন্ঠে বলে,

—“আমি গোসল করবো বড় ভাইয়া।”

—“বেশ ছয় মিনিট।”

—“আর একটু বেশি দেয়া যায় না?”

হাতের কাজ থামিয়ে শান্ত চোখে তাকায় সাগর। কিছুক্ষন সেভাবেই তাকিয়ে থেকে বলে,

—“সর্বোচ্চ দশ মিনিট। এর বেশি সময় পাবি না। যাওয়ার হলে যা, নাহলে কাজে লেগে পড়।”

অঙ্কন আর এক মুহুর্ত সময় দেরি না করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

——

প্রাপ্তির সাথে থাকার জন্য সুপ্তিও এই বাড়িতে এসেছে। মারুফ সাহেব, দিলারা বেগম, কামরুল সাহেব আর দীপ্তিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সুপ্তিকে নিয়ে সুভাষ সাহেব বাড়ি ফিরেছেন। অতিথিরা এখনো বাড়িতে অবস্থান করছে। আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীও উপস্থিত নতুন বৌকে দেখার জন্য। এতো এতো লোকের ভীড়ে বড্ড অস্বস্তি বোধ করছে সুপ্তি। চেনা জানা কেউ আশেপাশে নেই। প্রাপ্তি আর অর্পনও এখনো এসে পৌঁছায়নি। অস্বস্তি ভাব একটু কমে বকুলের জন্য। মেয়েটা ভীষণ অমায়িক। সুপ্তির সাথে এটা ওটা কথা বলে স্বাভাবিক করতে চাইছে। কাজের ফাঁকে সুপ্তির জন্য নাস্তা নিয়ে আসেন সন্ধ্যা বেগম। সুপ্তির শুকনো মুখটা দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করেন,

—“কি হয়েছে মামনি? কোনো সমস্যা?”

সুপ্তির চোখে মুখে অস্বস্তি বোধ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মেয়েটা একদম স্বস্তি পাচ্ছে না এখানে। ওড়নার কোণা দুই হাতে মোচড়াতে মোচড়াতে সুপ্তি বলে,

—“মাথা ব্যথা করছে আন্টি। একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হতো।”

সুপ্তির মুখে মাথাব্যথার কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়েন সন্ধ্যা বেগম। ব্যস্ত কন্ঠে বলেন,

—“বোকা মেয়ে, সেটা আগে বলবে না? আমারই ভুল। আমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। তুমি চলো আমার সাথে।”

কথাগুলো বলেই তিনি সুপ্তির হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। বকুলের দিকে তাকিয়ে বলেন,

—“তুমিও কি বিশ্রাম নিতে চাও বকুল?”

—“না, আমি মায়ের কাছে যাই।”

বলেই দৌড়ে চলে যায় বকুল। সন্ধ্যা বেগম সুপ্তিকে নিয়ে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে আসেন। হাত ধরে খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে বলেন,

—“আপাতত এই ঘরটা খালি আছে। তুমি এখানে বিশ্রাম নিতে পারো। কেউ বিরক্ত করবে না। আমি সাগরকে বলে মাথা ব্যথার ওষুধ নিয়ে আসছি।”

সুপ্তি বিনাবাক্যে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সন্ধ্যা বেগম মুচকি হেসে রুম থেকে প্রস্থান করেন। একটা ছোট্ট করে দম নিয়ে রুমের চারিদিকে নজর বুলায় সুপ্তি। রুমটা বেশ বড়সড়। চারিধারের দেয়ালে হালকা নীল রঙের পেইন্ট করা। কাঠের বড় একটা আলমারি। প্রয়োজনী সকল আসবাবপত্রই আছে ঘরে। ঘরটা বেশ গোছানো। একদম পরিপাটি করে রাখা। সুপ্তি মনে মনে ধারণা করেই নিলো এটা কোনো মেয়ের ঘর। কারণ কোনো মেয়ে ছাড়া কেউ নিজের ঘর এতো গুছিয়ে রাখবে না। নজর ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে চোখ আটকে যায় ঘরের এক কোণার টেবিলের দিকে। সেখানে কিছু ডাক্তারি সরঞ্জাম রাখা আছে। সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সুপ্তি। এই বাড়িতে কোনো মেয়ে তো ডাক্তার নেই। তাহলে এটা কার রুম?

সুপ্তির ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুমের দরজা খট করে খুলে যায়। কাঁধে টাওয়াল ঝুলিয়ে হাত দিয়ে মাথা ঝারতে ঝারতে বেরিয়ে আসে অঙ্কন। মাত্রই গোসল করেছে সে। ফর্সা শরীরে পানির কণা স্বচ্ছ কাঁচের মতো চিকচিক করছে। টাওয়াল টা নাভির নিচ থেকে হাটুর উপর পর্যন্ত। যার ফলে পায়ের নিম্ন ভাগের কালো লোমগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। অঙ্কনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সুপ্তি।

এদিকে নিজের খাটের ওপর সুপ্তিকে বসে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় অঙ্কন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। সুপ্তিকে এখানে দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। পরোক্ষনেই সুপ্তির বিস্ফোরিত চাহনি দেখে টনক নড়ে অঙ্কনের। তড়িঘড়ি করে আলমারি থেকে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে দৌড়ে ওয়াশের চলে যায়। সুপ্তি এখনো বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে পাথরের মতো বসে আছে। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই মস্তিষ্ক জ্বলে ওঠে যেনো। সাথে সাথে মাথা নিচু করে জিভে কামর দেয়।

মিনিট দুইয়েক পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে অঙ্কন। সুপ্তিকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে ধুপধাপ পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে আসে। সুপ্তির মুখোমুখি দাড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলে,

—“ইউ! তুমি আমার রুমে কি করছো? বাড়ির সাথে সাথে আমার রুমটাও দখল করে নিয়েছো?”

রাগ উঠে যায় সুপ্তির। মনের ভেতর চেপে রাখা সব রাগ একসাথে বেরিয়ে আসে যেনো। অঙ্কনের চেয়ে দ্বিগুণ রেগে সুপ্তি বলে,

—“এই দেখুন। একদম বাজে কথা বলবেন না। আমি নিজের ইচ্ছায় এখানে আসিনি। আন্টি আমাকে এখানে রেখে গেছে।”

—“ও আচ্ছা? মা রেখে গেলো আর তুমি সুরসুর করে থেকে গেলে। বোকা পেয়েছো আমাকে? তুমি ইচ্ছে করে আমার রুম দখল করতে এসেছো।”

প্রতিউত্তরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সুপ্তি। মাথা ব্যথাটা ধীরে ধীরে আরো বেশি হচ্ছে। যন্ত্রণায় মাথা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে খুব। এখন বেকার ঝগড়া না করে চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে দড়জার দিকে পা বাড়ায় সুপ্তি। উদ্দেশ্য, এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। যাই হয়ে যাক না কেনো, এখানে আর থাকবে না সুপ্তি। অন্তত অঙ্কনের ঘরে তো একদমই না। ভাবনা মোতাবেক ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় দড়জার দিকে।

সুপ্তিকে এমন শান্ত ভাবে চলে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অঙ্কন। মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়। অঙ্কন ভেবেছিলো সুপ্তি ওর কথা শুনে তেতে উঠবে। কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে। কিন্তু অঙ্কনের ধারণা উল্টে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, আশ্চর্য!

দড়জার কাছে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা বেগমের মুখোমুখি হয় সুপ্তি। তিনি খাবারের একটা প্লেট হাতে নিয়ে এই রুমেই আসছিলেন। সুপ্তিকে দড়জার সামনে দেখে জিজ্ঞেস করেন,

—“কোথায় যাচ্ছো মামনি?”

সন্ধ্যা বেগমকে দেখে দাড়িয়ে পড়ে সুপ্তি। আড়চোখে একবার তাকায় অঙ্কনের দিকে। অঙ্কন নির্বিকার ভঙ্গিতে ঠাঁই দাড়িয়ে আছে। কোনো হেলদোল নেই তার মাঝে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সুপ্তি মিনমিন করে বলে,

—“আন্টি আমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি?”

—“কেনো? আমি তো তোমাকে বললাম রেস্ট করতে। তাহলে নিচে যাবে কেনো?”

হঠাৎ করেই তার নজর যায় রুমের ভেতরে দাড়ানো অঙ্কনের দিকে। ছেলের ভাবলেশহীন ভাবভঙ্গি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলেন সন্ধ্যা বেগম। সন্দিহান কন্ঠে বলেন,

—“ও চলে কেনো যাচ্ছে অঙ্কন? তুই কিছু বলেছিস?”

অঙ্কন নিরুত্তর। চাহনি সোজা সুপ্তিতে স্থির। পরিস্থিতি সামাল দিতে সুপ্তি তড়িঘড়ি করে বলে,

—“না না আন্টি। কেউ কিছু বলেনি। আমি নিজে থেকেই যেতে চাইছিলাম।”

—“তাহলে তো কোনো কথাই নেই। চুপচাপ গিয়ে বসো। আমি খাবার এনেছি। খেয়ে নিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। দেখবে মাথা ব্যথা কমে যাবে।”

এই পর্যায়ে ভ্রু কুঁচকে যায় অঙ্কনের। সন্দিহান কন্ঠে সন্ধ্যা বেগমের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,

—“মাথা ব্যথা? কার মাথা ব্যথা?”

—“কার আবার, সুপ্তির। নিচে বসে ব্যথায় মেয়েটা ছটফট করছিলো। নিচের শোরগোলে সমস্যা হচ্ছিলো মনে হয়। তাই এই ঘরে নিয়ে আসলাম। অন্য ঘরগুলো তো খালি নেই। আপাতত এখানেই আরাম করুক। অর্পন আর প্রাপ্তি চলে আসলে ওকে নিয়ে যাবো।”

আপন মনে কথা বলেই যাচ্ছেন সন্ধ্যা বেগম। কিন্তু অঙ্কনের কানে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে কিনা তাতে বেশ সন্দেহ আছে। ভ্রু কুঁচকে গভীর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে সুপ্তির দিকে। এতোক্ষণে নজরে আসে সুপ্তির লাল চোখ জোড়া। চোখের চারিধারে লালচে রঙ ধারণ করেছে। হঠাৎ করেই অপরাধবোধ জাগে অঙ্কনের মনে। বুকের ভেতর সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে। মেয়েটা অসুস্থ আর, অঙ্কন কিনা ওকে শুধু শুধু রাগাচ্ছিলো। একবার ভাবে ক্ষমা চাইবে কিন্তু সন্ধ্যা বেগমের উপস্থিতির জন্য ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ফেলে অঙ্কন। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। আলমারি খুলে বক্সের ভেতর থেকে কয়েকটা ওষুধ বের করে সন্ধ্যা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,

—“খাবার খাওয়ার পর ওষুধগুলো খাইয়ে দিও। তারপর এখানেই ঘুমাতে বলো। অন্য কোনো ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি রাতে আর এই ঘরে আসবো না। ছাঁদে সবাই মিলে আড্ডা দেবো।”

কথাগুলো বলেই ধুপধাপ পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অঙ্কন। আর একবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকায় না। অঙ্কনের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুপ্তি। অঙ্কনের অবয়ব দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যেতেই সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।

চলবে?