#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৪
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
অর্পন যখন বাড়ি ফেরে তখন ঘড়িতে রাত নয়টা পঞ্চাশ বাজে। তখন হাইস্পিডে বাইক ছুটিয়ে বাড়ির রাস্তার উল্টো দিকে গিয়েছিলো অর্পন। সেখানে থেকে আবার বাড়ি ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ওদের আসতে দেরি হওয়ায় প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে যায় বাড়ির সকলে। অতঃপর দুজনকে সুস্থভাবে ফিরতে দেখে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রাপ্তির ডান হাতটা নিজের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় পুরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে অর্পন। পুরো ড্রয়িংরুম আত্মীয় স্বজনে ভর্তি। নতুন বৌকে দেখার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে অর্পনের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে বাসায় প্রবেশ করে প্রাপ্তি। সোফার একপাশে প্রাপ্তিকে বসিয়ে দিয়ে নিজের গা ঘেঁষে বসে পড়ে। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। বিয়ে তো নয় যেনো যুদ্ধ করে ফিরেছে।
বাচ্চাদের ক্লান্ত মুখশ্রি দেখে কিছুটা আন্দাজ করে নেন সুভাষ সাহেব। অর্পনের উদ্দেশ্যে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
—“নিচের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে নাও। আর সন্ধ্যা, তুমি বৌমাকে ঘরে নিয়ে যাও। রাত হয়ে গেছে অনেক। দেখাদেখির বাকি পর্ব কালকে সেরে নিও। বাচ্চাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।”
স্বামীর গম্ভীর কন্ঠে আদেশ শুনে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান সন্ধ্যা বেগম। আলতো করে প্রাপ্তির হাতটা ধরে দোতলায় অর্পনের ঘরে নিয়ে যান। পা গুনে গুনে অর্পনের ঘরে প্রবেশ করে প্রাপ্তি। সন্ধ্যা বেগম তাকে খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। মিনিট খানেক সময় চুপচাপ বসে থাকে প্রাপ্তি। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুভূতি ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। জানান দিচ্ছে প্রাপ্তির জীবনের নতুন সূচনার। এই ঘরটা প্রাপ্তির। এই পরিবার প্রাপ্তির। এই পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য প্রাপ্তির। অর্পন প্রাপ্তির। একান্তই প্রাপ্তির নিজের। কথাগুলো মাথাচাড়া দিতেই ঠোঁট প্রসস্ত করে হাসে প্রাপ্তি। অর্পন এখনো আসেনি। এর মানে তার আসতে একটু দেরি হবে। এই সুযোগে একটু ঘরটা চিনে নেয়া যাক।
ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। প্রথমে বিছানাটা ছুয়ে ছুয়ে দেখে। উপরের দিক থেকে ঝুলন্ত কিছু প্রাপ্তির মুখ ছুয়ে যায়। ঝুলন্ত জিনিসটা ধরে ফেলে প্রাপ্তি। দুই হাতে আলতো স্পর্শ করে বুঝতে পারে এগুলো ফুল। মালা গেঁথে লম্বা করে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ফুলগুলো কাছে এনে সুবাস টেনে নেয় নসিকাপথে। বুঝতে পারে, এটা গাঁদা আর গোলাপ দিয়ে তৈরি মালা। বিছানা হাতড়ে মাঝ বরাবর ফুলের পাপড়ি অনুভব করে। হয়তো মাঝে ফুলের পাপড়ি দিয়ে লাল শেপ এঁকেছে। অথবা নাম। বেশি হাতরায় না প্রাপ্তি। পরে যদি ডিজাইনটা নষ্ট হয়ে যায়!
ধীরে ধীরে পা গুনে খাটের মাথার দিকে এগিয়ে যায় প্রাপ্তি। গুনে গুনে ছয় কদম এগিয়ে ঘরের দেয়ালে হাত পড়ে। দেয়াল ধরে বাম পাশে এগিয়ে যায় প্রাপ্তি। ঠিক এগারো কদম পরে একটা দড়জা। ভ্রু কুঁচকে যায় প্রাপ্তির। মনে মনে ভাবে “এটা কি বেলকনির দড়জা?” দড়জার থেকে বামদিকে আবারও এগিয়ে যায়। তিন কদম পরেই একটা আলমারি। আশ্চর্য হয়ে যায় প্রাপ্তি। এবার পায়ের গতি বাড়ায়। আলমারি পার করতেই হাতে ওয়ারড্রব। এরপর আরও একটা দড়জা। এটা যে ওয়াশরুমের দরজা সেটা না দেখেও বেশ বুঝতে পারছে প্রাপ্তি।
এবার প্রাপ্তি উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। ঘরের ডানদিকে পা বাড়ায়। বাইশ কদম গিয়ে সামনে হাত বাড়ায় প্রাপ্তি। এখানে নিশ্চয়ই স্টাডি টেবিল আছে। কিছু হাতের সামনে ফাঁকা। কোনোকিছুই স্পর্শে পায় না। ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রাপ্তি। তবে কি তার মনের ভুল? চিন্তা ভাবনা করতে করতে আরও দুই কদম এগিয়ে যায়। আশ্চর্যজনক ভাবে স্টাডি টেবিলে হাত পড়ে প্রাপ্তির। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। একরাশ ভালোলাগা ছুয়ে দিয়ে যায় প্রাপ্তির হৃদয়। অর্পনের প্রাতি ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা আরও এক ধাপ বেড়ে যায়। কোনো সংশয় বিহীন নিশ্চিন্ত মনে স্টাডি টেবিলের ডান দিকে চার কদম এগিয়ে যায় প্রাপ্তি। কোনো প্রকার হাতরানো ছাড়াই ধুপ করে বসে পড়ে। হ্যা এটা সোফা। প্রাপ্তির আন্দাজ একদম ঠিক। পুলকিত মনে সেখানেই বসে অপেক্ষা করে অর্পনের জন্য।
—————————
ছাঁদে আড্ডার আসর বসিয়েছে ছেলেরা। স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে এখানে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্যচেলর পর্টি হচ্ছে আর কি। হাসি, মজা, আড্ডা, শোরগোল, উচ্চ কন্ঠের আওয়াজে মুখরিত ছাঁদের আঙিনা। মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে গাছের পাতা। ছাঁদের ফ্লোরে বেছানো পাতলা চাদর যেনো উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সকলে চাদর জুড়ে বসে থাকায় নিজের উদ্দেশ্যে সফল হতে পারছে না।
হাতের স্পিডের ক্যান থেকে এক চুমুক পানীয় দিয়ে গলা ভেজায় অঙ্কন। মনটা বড় আনচান করছে। কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না। অবাধ্য মন এক মুহুর্তের জন্য ঘরে যেতে উস্কানি দিচ্ছে। মনের কোনে উকি দিচ্ছে একাধিক প্রশ্ন ” সুপ্তি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? মাথা ব্যথা কমেছে কি? অন্য কোনো ঘরে ঘুমাতে যায়নি তো? যদি সেখানে কোনো ছেলে থাকে!” হাজারো প্রশ্নের বিভীষিকাময় মন নিয়ে শান্তি পাচ্ছে না অঙ্কন। আবার এখান থেকে উঠে যাওয়ার মতো সুযোগও পাচ্ছে না।
প্রকৃতি এবার অঙ্কনের সঙ্গ দেয়। অঙ্কনের মনের আকুতি হয়তো বুঝতে পেরে যায় তারা। সহসা মৃদু সুরে গর্জন করে ওঠে আকাশ। শঙ্কিত নজরে তাকায় সবাই আকাশ পানে। বৃষ্টি হবে মনে হয়। চিন্তিত স্বরে সাগর অঙ্কনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“স্টোর রুমে সামিয়ানা আছে না অঙ্কন? মামা মামির গত বিবাহবার্ষিকীতে বাগানে টানানো হয়েছিলো। গিয়ে দেখে তো আছে কি না। বৃষ্টি আসলে সকলে ভিজে যাবো।”
খুশিতে অঙ্কনের চোখ চকচক করে ওঠে। এখান থেকে উঠে যাওয়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলো এত সময় ধরে। সুযোগটা পেতেই লুফে নেয় যেনো। সহসা দাড়িয়ে পড়ে বসা থেকে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে ব্যস্ত পায়ে নিচে নেমে আসে। এক প্রকার দৌড়েই নিজের ঘরের সামনে এসে দাড়ায়। দড়জাটা খোলা। খাটের ওপর সুপ্তিকে দেখা যাচ্ছে। ঘুমে বিভোর হয়ে আছে সে। বাচ্চাদের মতো হাত পা এলোমেলো করে ঘুমিয়ে আছে।
রাগ লাগে অঙ্কনের। এভাবে দড়জা খুলে ঘুমানোর মানে কি? বাড়িতে এতো লোকজন। যদি কেউ সকলের অগোচরে এই ঘরে চলে আসতো তখন? এক প্রকার শব্দ করেই ধুপধাপ পা ফেলে ঘরের ভেতরে চলে যায় অঙ্কন। দাড়িয়ে পড়ে ঠিক খাট থেকে এক হাত দূরে। সুপ্তির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রাগটা হঠাৎ করেই উবে যায় অঙ্কনের। সহসা হেসে ফেলে অঙ্কন। কেমন বাচ্চাদের মতো হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। আবার মাঝে মাঝে ঠোঁট ফুলচ্ছে। বিড়বিড় করে কিছু বলছেও।
সুপ্তিকে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করতে দেখে কৌতুহল জাগে অঙ্কনের মনে। ঘুমের মধ্যেও আবার অঙ্কনকে গালি দিচ্ছে না তো? জানার অদম্য ইচ্ছা দমন করতে পারে না অঙ্কন। সুপ্তির মুখের কাছে ঝুঁকে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। সুপ্তি চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্তিতে “চ” এর মতো উচ্চারণ করে বলে,
—“চ” উফ.. ব্যথা।”
সুপ্তির ঘুম জড়ানো কন্ঠে আধো আধো কথা শুনে চট করে মাথা তুলে সোজা হয় অঙ্কন। চিন্তায় কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ে। “ব্যথা মানে? এখনো মাথা ব্যথা করছে নাকি?” উল্টো ঘুরে আলমারির দিকে চলে যায়। আস্তে করে আলমারির দড়জা খুলে মাথা ব্যথার মলম খুঁজে বের করে। আলমারির দড়জা আটকে ধীর পায়ে সুপ্তির মাথার কাছে এসে বসে। নিজের শক্ত পোক্ত বলিষ্ঠ হাতের দুই আঙুলে মলম নিয়ে সুপ্তির কপালে ঘষে দিতে থাকে। চেষ্টা করে যথা সম্ভব আলতো হাতে কাজটা সম্পন্ন করার। তবে আশানুরূপ ফলাফল সে পাচ্ছে না। নিজের হাতটা আজ লোহা বরাবর মনে হচ্ছে অঙ্কনের। ব্যপারটা নিয়ে সে বেজায় বিরক্ত। কি এমন ক্ষতি হতো, হাতটা এমন কঠোর না হয়ে একটু নরম হলে? দুনিয়ার নিয়ম পাল্টে যেনো কি?
এমন আকাশ কুসুম কল্পনা করতে করতে প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় পার হয়ে যায়। সুপ্তির মাথা থেকে আলতো করে হাতটা সরিয়ে নেয় অঙ্কন। মলমটা টেবিলের ওপর রেখে দড়জার দিকে হাঁটা দেয়। কয়েক কদম গিয়ে, পেছন ফিরে তাকায়। মুহুর্তেই হনহন করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। যাওয়ার আগে দড়জা ভালো ভাবে চাপিয়ে দিয়ে যায়।
———————-
ঘড়িতে এখন সময়, রাত এগারোটা। এতো সময় পর অর্পন নিজের রুমে ফিরে আসে। পাক্কা এক ঘন্টা তাকে ছাঁদে কাটাতে হয়েছে। কিছুতেই ছাড়া পাচ্ছিলো না বন্ধুদের থেকে। বহু কষ্টে সেখান থেকে আসতে পেরেছে।
রুমে ঢুকতেই সবার আগে নজর যায় প্রাপ্তির দিকে। সে সোফার ওপর গুটিশুটি মেরে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। আপন মনে কথাগুলো ভেবেই লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। সে আসতে আসতেই তার বৌ ঘুমিয়ে পড়েছে! কি আজব!
আলতো হেসে সোফার দিয়ে এগিয়ে যায় অর্পন। কোলে তোলার জন্য হাত বাড়াতেই চোখ মেলে তাকায় প্রাপ্তি। আকস্মিক প্রাপ্তিকে চোখ খুলতে দেখে ভড়কে যায় অর্পন। কিছু বলবে তার পূর্বেই প্রাপ্তি ঝাপিয়ে পড়ে অর্পনের বুকে। তাল সামলাতে না পেরে দুকদম পিছিয়ে যায় অর্পন। তবে কিছু বলে না। প্রাপ্তি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
—“কেনো করছেন এমন পাগলামি? আপনাকে ঠিক কি বলা উচিত? পাগল, নাকি বোকা?”
প্রাপ্তির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। প্রাপ্তি ঠিক কিসের কথা বলছে সেটা বুঝতে পারছে না সে। কৌতুহলী কন্ঠে অর্পন প্রশ্ন করে,
—“তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না। ঠিক কোন বিষয়ের কথা বলছো?”
এই পর্যায়ে অর্পনকে ছেড়ে দেয় প্রাপ্তি। এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে,
—“এই ঘরটা পুরো আমার ঘরের মতো করে সাজানো। আমার ঘরে যে জিনিস যেখানে আছে, এই ঘরেও ঠিক তাই। এর কারণ?”
—“আসলে তোমার ঘর সাজানোর আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়েছে। তাই সেভাবেই আমার ঘর সাজিয়েছিলাম।”
মাথা চুলকে জবাব দেয় অর্পন। তার এমন ভিত্তিহীন জবাব শুনে আলতো হাসে প্রাপ্তি। মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে বলে,
—“একদম না। আমি আমার সেই ঘরে থেকে অভ্যস্ত। সেখানকার পুরো নকশা আমার ঠোটস্ত। কারো সাহায্য ছাড়া অনায়াসেই সেখানে চলাফেরা করতে পারি আমি। নতুন বাড়ি এবং নতুন ঘরে আমি কারোর সাহায্য ছাড়া চলতে পারবোনা। অন্যের ওপর নির্ভর করে এক এক কদম চলতে হবে আমাকে। তাই আপনি এই ঘরটা আমার ঘরের মতো করে সাজিয়েছেন। যাতে নিজের ঘরে আমি নিজের মতো করে চলাচল করতে পারি। কোনো সাহায্য ছাড়াই। তাই না অফিসার?”
অর্পন শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে প্রাপ্তির দিকে। কোনো জবাব দেয় না। বরং এটা ভেবে খুশি হয় যে, প্রাপ্তি তার মন পড়তে শিখে গেছে। এটাই বা কম কিসে? অর্পনকে চুপ থাকতে দেখে প্রাপ্তি ফের প্রশ্ন করে,
—“কিছু বলছেন না যে।”
—“সবটা তো তুমি বলেই দিলে। বলার জন্য তো একটা পয়েন্টও বাদ রাখোনি।”
অর্পনের জবাবে হালকা হাসে প্রাপ্তি। দু-চোখে অশ্রুকণা ভীড় জমায়। ধরা গলায় বলে,
—“আপনার মতো মানুষ পাওয়া খুব কঠিন অফিসার। আপনি জেনে শুনে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন যে কিনা চোখে দেখে না। যে কোনো দিন আপনার সৌন্দর্যের বর্ননা দিতে পারবে না। আপনি কখনো সেজে সামনে আসলে আপনাকে দেখে প্রশংসা করতে পারবে না। আপনার কোনোকিছুরই কমতি নেই। টাকা, সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি এমনকি বোনের মুখে শোনা আপনার চেহারাও নিখুঁত সুন্দর। আপনি চাইলে অনেক ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। যে মেয়ে সবদিক থেকেই বেষ্ট হবে। কিন্তু তাদের ছেড়ে আপনি আমার মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করলেন। যে কিনা চোখেই দেখে না। আপনাকে কি বলে আখ্যা দেবো আমি?”
প্রাপ্তির সমস্ত কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে অর্পন। কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে প্রাপ্তির মুখের দিকে। অর্পনের দিক থেকে কোনো জবাব না পেয়ে প্রাপ্তি ফের বলে,
—“এমন শুনশান নীরবতা কেনো অফিসার? প্রতিউত্তরে কি কোনো জবাব পাবো না?”
অর্পন তবুও চুপ। কয়েক পল নিরবতায় অতিবাহিত করে দু’জনেই। নিরবতা ভেঙে এক কদম এগিয়ে আসে অর্পন। প্রাপ্তির ডান হাতটা আলতো করে মুঠোয় পুরে নিয়ে বলে,
—“আমার সাথে এসো।”
প্রাপ্তি বিনা বাক্যে অর্পনের সঙ্গে যায়। বেলকনিতে এসে থামে অর্পন। রেলিং ঘেষে দাড়িয়ে প্রাপ্তিকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। অতি সপ্তপর্ণে প্রাপ্তির ডান হাতটা অর্পন নিজের বুকের বাম পাশে রাখে। ঘোর লাগা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—“কিছু বুঝতে পারছো? জবাব এখানেই।”
প্রাপ্তি যেনো শুনতে পায় অর্পনের মনের কথা। তার বেগতিক হারে ধুকপুক করা হৃৎস্পন্দন প্রতিটা উত্তর বলে দিচ্ছে। তবুও যেনো প্রাপ্তির মন মানে না। জেদ ধরে বলে,
—“আমি আপনার মুখে শুনতে চাই।”
আলতো হাসে অর্পন। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলে,
—“আমি কোনো পুরস্কারের আশায় তো তোমাকে বিয়ে করিনি। ভালোবেসেছি তাই বিয়ে করেছি। বিনিময়ে আমার কোনো পুরস্কার, কোনো মেডেল, ট্রফি বা কোনো আখ্যা, কিছুই দিতে হবে না। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো। তাহলেই হবে।”
—“আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
—“আমি কখন বললাম এ কথা?”
রাগ লাগে প্রাপ্তির। লোকটা কি মশকরা করছে তার সাথে। এই মাত্র বলে আবার না করছে। কন্ঠে কিছুটা রাগ মিশিয়ে প্রাপ্তি বলে,
—“মজা করছেন আমার সাথে?”
—“তোমার সাথে কি আমার মজার সম্পর্ক?”
—“তাহলে মিথ্যে বলছেন কেনো?”
—“কোথায় মিথ্যে বললাম?”
হার মেনে নেয় প্রাপ্তি। তর্কে সে বরাবরই দুর্বল। তাই আর কথা বাড়ায় না। প্রাপ্তির এমন হেরে যাওয়া অসহায় মুখ দেখে হেসে ফেলে অর্পন। এমন সময় বিকট শব্দে অর্পনের ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয় অর্পন। ফোনটাকে নিজের চরম শত্রু মনে হয়। আজকেও তার বাজতে হবে। একদিন ছুটি দিলে কি হয়? বিরক্তি নিয়েই পকেট থেকে ফোন বের করে। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই অর্পনের হাসিখুশি মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। চুপচাপ অপর পাশের কথা শুনে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“তুমি জানো তো তোমাকে কি করতে হবে?”
অপর পাশ থেকে কি জবাব আসে শুনতে পায়না প্রাপ্তি। অর্পন এক মিনিটের মতো ফোন কানে ধরে রেখে “আসছি আমি” এটুকু বলেই ফোন কেটে দেয়। ফোনটা পকেটে রেখে প্রাপ্তির দিকে তাকায়। প্রাপ্তি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। হয়তো অর্পনের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। প্রাপ্তির কৌতুহলী মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“আমাকে যেতে হবে প্রাপ্তি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”
হঠাৎ করেই প্রাপ্তির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এতো রাতে অর্পনের যাওয়া প্রাপ্তি সহজ ভাবে নিতে পারছে না। মনে জেঁকে বসে হাজারো প্রশ্ন। কে ফোন করেছিলো? এতো রাতে কোথায় যাবে অর্পন? প্রাপ্তি হতাশ কন্ঠে বলে,
—“রাত কয়টা বাজে এখন?”
অর্পন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
—“বারোটা পয়ত্রিশ।”
—“এতো রাতে কোথায় যাবেন আপনি?”
—“কোথায় যাচ্ছি সেটা বলতে পারবো না। তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
কথাগুলো বলেই রুমের দিকে হাঁটা দেয় অর্পন। এক কদম এগোতেই হাতে টান অনুভব করে। প্রাপ্তি অর্পনের হাত টেনে ধরেছে। অর্পন ঘাড় ঘুরাইতে প্রাপ্তি অসহায় কন্ঠে বলে,
—“আজ কোথাও না গেলে হয়না? আমার খুব ভয় লাগছে অফিসার।”
প্রাপ্তির দিকে সম্পুর্ন ঘুরে দাড়ায় অর্পন। দুই হাতের আঁজলায় প্রাপ্তির মুখটা নিয়ে বলে,
—“ভয় নেই! আমি তোমার কাছে আবার ফিরে আসবো। ক্ষত বিক্ষত ভাবে হোক বা অক্ষত অবস্থায়। যে কোনো অবস্থায় আমি ফিরে আসবো। কথা দিলাম। এখন আমাকে যেতে হবে প্রাপ্তি। অপেক্ষা করবে তো আমার জন্য?”
চলবে?