তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৩৯+৪০

0
92

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৯
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

রাতের প্রায় শেষ প্রহর। হসপিটালের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে নিকষ কালো অন্ধকার ব্যতিত আর কোনোকিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। অথচ হসপিটালের ভেতরটা দিনের মতো ঝকঝকে আলোয় আলোকিত। এ যেনো দিন আর রাতের নিখুঁত কেনো সংমিশ্রণ। নিজের কেবিনের বিশাল বড় জানলার সামনে দাড়িয়ে আলো আঁধারের এই অদ্ভুত খেলা দেখছে সাগর। পকেটে দুই হাত পুরে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ দড়জা খোলার শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকায়। দীপ্তি হন্তদন্ত ভঙ্গিতে এসে সাগরের পাশে দাঁড়ায়। কক্ষের মধ্যভাগে রাখা বড় টেবিলের অপর পাশে ডক্টর সোনালী বসে আছে। তার দিকে একবার নজর বুলিয়ে সোজা সাগরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দীপ্তি। চঞ্চল কন্ঠে বলে,

—“হঠাৎ জরুরি তলব? কিছু কি হয়েছে?”

ডক্টর সোনালীর দিকে একনজর তাকায় সাগর। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। হাতে একটা লাল রঙের ফাইল। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে সেই ফাইলে। সাগর নিজের চেয়ারের দিকে যেতে যেতে দীপ্তিকে ছোট্ট করে বলে,

—“বসো।”

বিনাবাক্যে বসে পড়ে দীপ্তি। তবে তার চোখে মুখের কৌতুহল এক ফোঁটাও কমেনি। পাশে দীপ্তির উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকায় সোনালী। হাতের ফাইলটা সাগরের দিকে ঠেলে দিয়ে দীপ্তির মুখোমুখি হয়ে বসে। আজ সোনালীর মুখে কোনো কঠোরতার নেই। নেই দীপ্তির প্রতি রাগ বা ক্রোধ। বরং তাকে অত্যন্ত নমনীয় দেখাচ্ছে আজ। সেই সাথে চিন্তিতও লাগছে। সে আলতো করে দীপ্তির দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে পুরে নেয়। দীপ্তির চোখের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

—“আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো দীপ্তি!”

দীপ্তির বুক ধুকপুক করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। সোনালীর হঠাৎ এমন পরিবর্তন তাকে ভাবাচ্ছে খুব। তাছাড়া ওদের চোখ অনেক কিছু বলতে চাইছে। বিনা বাক্যে কিছু অশনি ইঙ্গিত দিচ্ছে। অস্থির দীপ্তির ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ডক্টর সোনালী বলে,

—“তোমার স্বামী তোমার সাথে বেইমানি করেছে দীপ্তি।”

ধরাস করে ওঠে দীপ্তির বুক। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

—“এসব কেনো বলছেন আপনি?”

দীপ্তির গলা কাঁপছে। ভয় হচ্ছে ভিষণ। ভয়ার্ত চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সাগরের দিকে। তার চেহারা মলিন। কোনো কথা নেই তার মুখে। সোনালী ফের বলতে শুরু করে,

—“তোমার স্বামীকে বিশ্বাস করে অনেক বড় ভুল করেছো দীপ্তি। সে শুধু তোমার বোনেরই ক্ষতি করেনি৷ বরং তোমার ক্ষতি সবচেয়ে বেশি করেছে। এতোগুলা বছর ধরে তোমাকে ভুল চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে দীপ্তি। বাচ্চার জন্য তুমি এতোগুলা বছর ধরে ডক্টরের দুয়ারে দৌড়াচ্ছো। কিন্তু তুমি কি জানো? তোমার ট্রিটমেন্ট করছিলো যে ডক্টর সে তোমাকে এমন একটা ওষুধ দিচ্ছে যা বাচ্চা না হওয়ার জন্য দায়ী। এমনকি এতে বন্ধাত্বেরও ঝুঁকি আছে।”

—“এটা কিভাবে সম্ভব?”

—“অসম্ভব কিছুই নয়। এমনটাই হয়েছে তোমার সাথে। তাছাড়া আরও একটা বিষয় তোমাকে জানানোর ছিলো।”

দীপ্তি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোনালির দিকে৷ সোনালী কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বলে,

—“তোমার বিয়ের দুই বছরের মাথায় তুমি প্রেগনেন্ট হয়েছিলে। কিন্তু তোমার বাচ্চাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর এই কাজটা ডক্টর দাস করেছে, তোমার স্বামীর কথায়। কথাটা ডক্টর দাস নিজে স্বীকার করেছে।”

বিকট আওয়াজে বজ্রপাতের ন্যায়ে শব্দ বাজে দীপ্তির কানে। সে যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। সোনালীর এক একটা কথার আঘাত সোজা তার বুকে এসে লাগে। ক্ষত বিক্ষত করে দেয় দীপ্তির কোমল হৃদয়। যার সাথে এতগুলো বছর ধরে সংসার করছে। জীবনের দীর্ঘ সময় যার সাথে কাটিয়েছে। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে যার সাথে আবদ্ধ, সেই মানুষটা এতো বড় ধোঁকা দিলো? সজীবের প্রতি বিশ্বাসের শেষ সুতো টাও ছিড়ে গেলো আজ।

সেই সময় লাল রঙের সেই ফাইলটা দীপ্তির সামনে ধরে সাগর। দীপ্তি নির্বিকার চেয়ে রয় সেই দিকে। একটা ছোট্ট দম নিয়ে সাগর বলে,

—“তোমার পুরনো সকল টেস্টের রিপোর্ট এই ফাইলে আছে। এই রিপোর্ট গুলো থেকেই তোমার অ্যাবরশনের ব্যপারে জেনেছি। এরপর ডক্টর দাসকে চেপে ধরায় সেও সবটা স্বীকার করেছে। বেশি না, মাত্র দুই মাস চলছিলো তোমার। তুমি নিজেও জানতে না এই বিষয়ে। ট্রিটমেন্টের নাম করে তোমার স্বামী তোমার অনুমতি ছাড়াই কাজটা করিয়েছে। এবং ডক্টরকে টাকা খাইয়ে এটা নিশ্চিত করেছে যাতে তুমি এই বিষয়ে কিছু না জানতে পারো। এর পরেও কি তার প্রতি দয়া বা করুণা দেখাবে তুমি?”

দীপ্তির চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। যন্ত্রণা গুলো গলায় দলা পাকিয়ে আছে। কথা বলতে চেয়েও মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ভাঙা হৃদয় নিয়ে রোবটের মতো উঠে দাঁড়ায় দীপ্তি। অনুভুতিহীনের মতো এক পা, দুপা করে হাঁটতে থাকে দড়জার দিকে । ফাইলটা একবার দেখার মতোও শক্তি বেঁচে নেই তার শরীরে। এ যেনো এক প্রাণহীন পুতুল।

দীপ্তিকে এভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় চলে যেতে দেখে চিন্তায় পড়ে যায় সাগর। এই মুহুর্তে দীপ্তির মনের অবস্থা ঠিক নেই। এতো বড় ধোঁকা মেনে নেয়া কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেখানে দীপ্তি তো আরও কোমল হৃদয়ের মানুষ। যদি এই ধাক্কা সামলাতে না পারে। যদি নিজের কোনো ক্ষতি করে বসে! মনে ভয় জেঁকে বসে সাগরের। চিন্তিত ভঙ্গিতে হুট করেই উঠে দাঁড়ায় সাগর। তাড়াহুড়ো পায়ে দীপ্তির পিছু নেয়। তবে কয়েক কদম যেতেই হাতে টান অনুভব করে সাগর। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকায়। সোনালী আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরের মুখের দিকে। দুই চোখে তার অশ্রু কণা চিকচিক করছে। সাগরের নজর নিজের দিকে পড়তেই সোনালী কান্না ভেজা কন্ঠে বলে,

—“এখনও ওর পিছু নেবে সাগর?”

—“আমি ওকে একা ছাড়তে পারিনা সোনালী। ওর আমাকে প্রয়োজন।”

—“যখন তোমার ওকে প্রয়োজন ছিলো, তখন তো সে ফিরে আসেনি। তাহলে তুমি কেনো ওর প্রয়োজনে ওর পাশে থাকতে চাইছো? ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে সাগর!”

সাগরের বিরক্ত লাগে। প্রচন্ড রাগ হয়। এতোক্ষণে দীপ্তি কতদূর চলে গেছে কে জানে। কোথায় গেছে সেটাও তো বলে যায়নি। যদি দেরি হয়ে যায়। কোনো এক অজানা ভয় পুরোপুরি গ্রাস করে নেয় সাগরকে। এদিকে সময়ের কাটাও যেনো ঘোড়ার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। শেষে বিরক্ত হয়ে সাগর বলে,

—“আমি জানি ওর বিয়ে হয়েছে। সেই সাথে ওর স্বামী ওকে ধোঁকাও দিয়েছে। মেয়েটা মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত। এই সময় ওর পাশে কারোর থাকা প্রয়োজন।”

—“তো ওর পরিবার আছে তো। কারোর থাকা প্রয়োজন, তাহলে ওর বাসায় ফোন করে জানাও। ওদের মধ্যে কেউ দীপ্তিকে খুঁজে নেবে।”

সোনালীর মুখে এমন স্বার্থপরের মতো কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় সাগর। অবাক চোখে তাকায় সোনালীর দিকে। সাগরের রাগটা পূর্বের তুলনায় আরও একধাপ বেড়ে যায়। সোনালীর হাতটা ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলে,

—“দীপ্তির পাশে আমি আগেও ছিলাম। এখনও আছি। এবং সারাজীবন থাকবো। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেনো।”

কথাগুলো বলেই সাগর হনহন করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। দড়জা পেরিয়ে যেতেই চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়ে সোনালী। চোখ থেকে তার অবিরত অশ্রু ঝড়ছে। বড্ড একা অনুভব হচ্ছে। বুকের কষ্ট গুলো তীঘ্ন ধারালো ছুরির মতো ক্রমাগত বিদ্ধ হচ্ছে হৃদপিণ্ডে। ব্যথায় জর্জরিত হৃদয় নিয়ে সোনালী আহত কন্ঠে নিজে নিজেই বলে,

—“কতগুলো বছর তোমাকে এক তরফা ভালোবেসে গেছি সাগর। তুমি তো আমার ভালোবাসা বুঝলে না। দীপ্তির বিয়ে হওয়ার পর তোমাকে ফিরে পাওয়ার আশা আবারও জেগে উঠেছিলো মনে। ভেবেছিলাম, এবার আমার ভালোবাসা বুঝবে। সেই আশা বুকে নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তবে আজ কি সেই আশার আলো পুরোপুরি নিভে গেলো? তোমাকে পাওয়ার সব রাস্তা কি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো সাগর? তুমি কি কোনোদিন বুঝবে না আমাকে?”

তার আপন মনে করা আহাজারি দ্বিতীয় কারোর কানে পৌঁছায় না। চার দেয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে যায় এক ভগ্ন হৃদয়ের আর্তনাদ।

————————–

হসপিটাল থেকে ফিরে এসে বাসায় ভাঙচুর শুরু করেছে শান। প্রাপ্তির সাথে দেখা করতে গিয়ে সে প্রাপ্তি আর অর্পনের বিশেষ মুহুর্ত নিজের চোখে দেখেছে। সে ব্যতিত অন্য পুরুষের বুকে মাথা রেখেছে প্রাপ্তি। তার কোমল হাতে জড়িয়ে ধরেছে কোনো পুরুষকে। দৃশ্যটা শানের প্রেমিক সত্তাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। টুকরো টুকরো করে দিয়েছে প্রাপ্তিকে ঘিরে তার সাজানো হাজারো স্বপ্ন। রাগ সামাল দিতে না পেরে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ভেঙে চুরমার করছে।

ছেলের কর্মকান্ডে অতিষ্ট হয়ে আর ঘরে বসে থাকতে পারেন না রাবেয়া বেগম। ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে যান শানের ঘরের দিকে। দড়জার সামনে দাড়িয়ে ধমক দিয়ে বলেন,

—“কি তামাশা শুরু করেছিস?”

শান যেনো নিজের মায়ের অপেক্ষাতেই ছিলো। রাবেয়া বেগম আসতেই তেড়ে যায় তার দিকে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

—“তামাশা আমি নয়, তোমরা শুরু করেছো।”

—“কিসের কথা বলছিস?”

—“আমি প্রাপ্তির কথা বলছি। তোমরা তো বলেছিলে প্রাপ্তিকে আমার কাছে এনে দেবে। ভাইয়া বলেছিলো প্রাপ্তির সাথে যার বিয়ে হয়েছে সেই ছেলেটা ম*রে গেছে। তাহলে সে বেঁচে আছে কিভাবে? আমি নিজের চোখে তাকে জীবিত এবং সুস্থ অবস্থায় দেখে এসেছি।”

—“সেই হিসাব তোর ভাইয়ের থেকেই নিস। কিন্তু খবরদার, বাড়িতে একদম ভাঙচুর করবি না।”

—“হিসাব তো তোমাদের দিতেই হবে মা।”

দুই মা ছেলের তর্কাতর্কির মাঝে হঠাৎ দড়জার দিকে নজর যায় রাবেয়া বেগমের। দীপ্তিকে আসতে দেখে আশ্চর্য হয়ে যান তিনি। আরও আশ্চর্য হন দীপ্তির শক্ত মুখশ্রী দেখে। দীপ্তি আগে পিছে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়।

রাবেয়া বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করে শানও সেইদিকে তাকায়। দীপ্তিকে দেখে চিনতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। রাবেয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

—“এটা কে মা? চেনা চেনা লাগছে! কোথায় কি দেখেছি একে?”

—“ওটা সজীবের বৌ। তোর ভাবি। সাথে প্রাপ্তির বড় বোন।”

একদমে কথাগুলো বলেই দীপ্তির পেছন পেছন যায় রাবেয়া বেগম। এদিকে মায়ের কথা শুনে শয়তানি হাসি দেয় শান। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। দাবার গুটি নিজে পায়ে হেঁটে এসে ধরা দিয়েছে। এখন একে ব্যবহার করে প্রাপ্তিকে পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। ঠোঁট ছড়িয়ে প্রশস্ত হাসে শান।

হন্তদন্ত পায়ে হেঁটে সোজা নিজের ঘরে চলে আসে দীপ্তি। সজীব বাড়িতেই ছিলো। পায়ে গুলি লাগায় হাঁটা চলা করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই বাসায় থেকে রেস্ট নিচ্ছিলো। এমন সময় দীপ্তিকে আসতে দেখে আধশোয়া হয়ে বসে। চোখে মুখে তার বিস্ময়। ঘরে ঢুকেই দীপ্তি সোজা সজীবের কাছে এসে কলার চেপে ধরে দাঁড় করায়। পায়ে ব্যথা লাগলেও চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে সজীব। তবে দীপ্তির সেদিকে কোনো নজর নেই। চোখ মুখ শক্ত করে কঠিন কন্ঠে প্রশ্ন করে,

—“আমার বাচ্চাকে তুমি মেরেছো সজীব?”

দীপ্তির প্রশ্ন শুনে চমকে তাকায় সজীব। পুরো চেহারা জুড়ে তার অবাকের রেশ বিদ্যমান। এই মুহুর্তে এই প্রশ্নের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এর বিপরীতে কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সজীবকে চুপ থাকতে দেখে কলারটা আরও শক্ত করে ধরে দীপ্তি। চেঁচিয়ে বলে,

—“চুপ করে আছো কেনো? উত্তর দাও। আজ আমার উত্তর চাই সজীব।”

দীপ্তির নজর সজীবের চোখের দিকে থাকলেও, সজীবের নজর লুকোচুরি খেলছে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না যেনো। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ করেই সজীবের চেহারার ভাব পাল্টে যায়। শক্ত হাতে দীপ্তির হাত ধরে কলার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখ মুখ শক্ত করে জবাব দেয়,

—“হ্যা, আমিই করেছি। সবকিছু আমার সাজানো নাটক ছিলো। বোকা বানিয়েছি তোমাকে।”

দীপ্তির মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। দুই পা অনবরত কাঁপতে থাকে। শরীরের শেষ শক্তিটুকুও যেনো ফুরিয়ে এসেছে। পা ভেঙে ফ্লোরেই বসে পড়ে সে। অশ্রুশিক্ত নয়নে সজীবের দিকে তাকায় দীপ্তি। ভাঙা কন্ঠে বলে,

—“কিন্তু কেনো? আমার এতবড় ক্ষতি কেনো করলে?”

—“কারণ তোমাকে আমি বিয়ে করেছিলাম প্রতিশোধ নিতে। তোমার বোন সহ, পুরো পরিবারকে শাস্তি দিতে। তোমার সাথে সুখে সংসার করতে নয়। এই সবকিছুই আমার প্রতিশোধের অংশ ছিলো।”

—“এর মানে! নয় বছরের সংসার, ভালোবাসার কথা, ওই সবকিছু মিথ্যে ছিলো?”

সজীবের সহজ স্বীকারোক্তি,

—“হ্যা! সব মিথ্যে ছিলো।”

—“তাহলে আমি কেনো বুঝতে পারলাম না? এতোদিন ধরে চলা মিথ্যে নাটক আমি কেনো ধরতে পারিনি? বিয়ের পর থেকে তোমার দেয়া ভালোবাসা, তোমার করা যত্নগুলো আমার কাছে মিথ্যে লাগেনি কেনো? যতবার তুমি আমার কাছে এসেছো, তোমার চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছি। কামনা দেখিনি কেনো? এতো এতো মিথ্যের কোনোটাই আমি ধরতে পারলাম না! কিভাবে?”

ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সজীব। দীপ্তির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে উল্টো দিক হয়ে দাড়িয়ে আছে। দুই হাত পকেটে গুজে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে ঘরের দেয়ালের দিকে। যেনো এখানে যা কিছু হচ্ছে, তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। দীপ্তি চোখের পানি মুছে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে,

—“আমাকে এতবড় ধোঁকা কেনো দিলে সজীব? কি অপরাধ ছিলো আমার? আমার বাচ্চাটার কি অপরাধ ছিলো? ও তো তোমারও সন্তান ছিলো। নিজের সন্তানকে খুন করতে বুক কাঁপলো না তোমার? এতোটা পাষাণ হয়ে গেছো তুমি?”

সজীব নির্বিকার। কোনো কথা নেই মুখে। দীপ্তি দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়ায়। দুই হাতে চোখ মুছে সজীবের দিকে আঙুল তাক করে বলে,

—“তোমাকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না সজীব। কোনো দিন না। তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। তোমার সব অপকর্ম আমি অর্পনকে বলে দেবো। আমার সন্তানের খুনিকে আমি ছেড়ে দেবো না।”

কথাগুলো বলেই উল্টো দিকে হাঁটা দেয় দীপ্তি। কিন্তু বেশিদূর আগাতে পারে না। দুই কদম যেতেই ঘাড়ে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে। পেছন ফিরে দেখে সজীব হাত দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্ঞান হারিয়ে সজীবের বুকেই ঢলে পড়ে।

অজ্ঞান দীপ্তিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সজীব। বুকের সাথে চেপে ধরে দীপ্তির জ্ঞানহীন মুখের দিকে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,

—“তোমাকে তো যেতে দেয়া যাবে না জান। যদি এখানে না আসতে তাহলে আমি কিছুই করতাম না। কিন্তু তুমি নিজে থেকে আমার কাছে এসেছো। এবার যে তোমার যাওয়ার রাস্তা বন্ধ।”

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৪০
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

অর্পনের বুকে মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় মগ্ন প্রাপ্তি। ভরসার জায়গা পেয়ে, দিন দুনিয়াই যেনো ভুলে গেছে। নিশ্চিন্তে শরীরের সকল ক্লান্তি দূর করছে যেনো। প্রাপ্তি ঘুমানোর পর থেকে অর্পন আর চোখের পাতা এক করেনি। সেই থেকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে। অর্পনের মনে এক আকাশ সমান তৃপ্তি মেলে এই মেয়েকে দেখে। বক্ষস্থল জুড়ে শীতলতা ছেয়ে যায়।

দেখাদেখির মাঝেই প্রাপ্তিকে আরও একটু কাছে টেনে নেয় অর্পন। বুকের সাথে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কপালে গভীর চুমু দেয়। ঘুমে বিভোর প্রাপ্তি কিছুই টের পেলো না। বরং নড়েচড়ে মাথাটা অর্পনের বুকের সাথে আরও দৃঢ় ভাবে গেঁথে দিলো। আচ্ছা, এই যে অর্পন প্রাপ্তিকে চুমু খেলো! প্রাপ্তি যদি জেগে থাকতো, তখন কি করতো? লজ্জা পেতো কি? মুখের রঙ নিশ্চয়ই লাল রঙ ধারণ করতো। তখন কি লজ্জা থেকে বাঁচতে অর্পনের বুকেই মুখ লুকাতো? আনমনে হাসে অর্পন। নিজের মনের ভাবনাগুলো যেনো চোখের সামনে দৃশ্যমান রুপে ভেসে উঠছে। এই অনুভূতিটা ভিষণ সুন্দর।

অর্পনের ভাবনার মাঝেই দড়জায় কেউ খটখট আওয়াজ করে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে অর্পন। দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করে,

—“কে?”

—“ভাইয়া! আমি অঙ্কন। একটু জরুরি দরকার ছিলো। ভেতরে আসবো?”

—“আয়!”

দড়জার খটখট আওয়াজ এবং অর্পনের কথা শুনে ঘুম ভেঙে যায় প্রাপ্তির। অর্পনের থেকে এক হাত দূরে সরে গিয়ে বসে থাকে। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে, কি হয়েছে। অনুমতি পেয়ে সাথে সাথে দড়জা খুলে চলে আসে অঙ্কন। তার চোখ মুখে চিন্তার আভাস। ছোট্ট একটা দম নিয়ে বলে,

—“দীপ্তি আপুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাই।”

অঙ্কনের কথা শুনে চমকে ওঠে প্রাপ্তি। হঠাৎ দীপ্তি নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে অঙ্কনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“কি হয়েছে? আপি কোথায় গেছে? কি নিয়ে কথা হচ্ছে?”

অঙ্কন কোনো জবাব দেয় না। বরং আহত চোখে তাকায় অর্পনের দিকে। দীপ্তির বিষয়টা অর্পন আগে থেকেই জানে। তাই আর তাকে বিস্তারিত ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই। তবে এই মুহুর্তে দীপ্তিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে অর্পনের। বোকা মেয়েটা আবার নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেনি তো? এভাবে চুপচাপ বসে থাকার কোনো মানেই হয় না। ঝটপট উঠে দাঁড়ায় অর্পন। ফ্লোরে পা রাখতেই পায়ের ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায়। আঘাত গুলো এখনো তাজা। চারদিন ধরে ওষুধ নেয়াতে ব্যথা একটু কমেছে। তবে পুরোপুরি নয়। নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পাশের দেয়ালে হাত রেখে দাঁড়ায় অর্পন। পা ফেলতে পারলেও হাটতে বেজায় কষ্ট হবে।

অঙ্কন এগিয়ে এসে ধরতে লাগলে হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয় অর্পন। একটু খানিক দাঁড়াতেই হাঁপিয়ে গেছে। দম নিয়ে নিয়ে বলে,

—“সাগর ভাই কোথায়?”

—“সে দীপ্তি আপুকেই খুঁজতে বেরিয়েছে।”

—“ফোন করে সুপ্তিদের বাসায় যেতে বল। আমিও যাচ্ছি।”

কথাগুলো বলেই প্রাপ্তির এক হাত ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে থাকে। প্রাপ্তি যেনো নির্বাক কোনো পুতুল। কোনো ঘটনাই সে বুঝতে পারছে না। চারিদিকের সবকিছু অদ্ভুত লাগছে। এতোদিন সন্দেহ হলেও আজ সেই সন্দেহ সত্যি বলে মনে হচ্ছে। মনে অদম্য কৌতুহল নিয়ে প্রাপ্তি প্রশ্ন করে,

—“এসব কি হচ্ছে অফিসার? আপি কোথায় গেছে? কি হয়েছে? আপনি কি কিছু বলবেন?”

—“তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আজ পাবে প্রাপ্তি। শুধু একটু অপেক্ষা করো।”

————————-

প্রাপ্তিদের বাসার ড্রয়িংরুমে জমায়েত হয়েছে সকলে। অর্পনের বাবা মাও এসেছে। সেই সাথে এসেছেন দিদার সাহেবও। সবার শেষে অর্পন আসে প্রাপ্তিকে নিয়ে। নির্বাক প্রাপ্তি চুপচাপ গিয়ে সুপ্তির সাথে বসে। অর্পনের হাতে একটা ফাইল। সেটা দিদার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

—“এখানে সজীবের বিরুদ্ধে সব প্রমান আছে স্যার। আশা করি তাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিতে, এই প্রমানগুলোই যথেষ্ট।”

দিদার সাহেব বিনাবাক্যে ফাইলটা হাতে তুলে নেন। নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন ফাইলের সকল কাগজপত্র। ফাইলের ভেতরে একটা মেমোরিকার্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। উপস্থিত সকলে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। দীপ্তির জন্য সকলের চিন্তা হচ্ছে।

হাতের ফাইলটা নেড়েচেড়ে দেখে সামনের টেবিলে রেখে দেন দিদার সাহেব। পাশ থেকে কামরুল সাহেব চিন্তিত স্বরে বলেন,

—“আমার নাতনির কোনো খোঁজ পেলে দাদু ভাই? ও ঠিক আছে তো?”

কামরুল সাহেবের কথা শেষ হতেই তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে অর্পন। পায়ে ব্যথা লাগলেও কোনো পরোয়া করে না। বৃদ্ধের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অভয় দিয়ে বলে,

—“ভরসা রাখুন দাদু। আপুকে আমরা ঠিক খুঁজে বের করবো।”

—“তোমার কি মনে হয়? দীপ্তিকে আটকে রাখা হয়েছে?”

দিদার সাহেবের প্রশ্ন শুনে উঠে দাঁড়ায় অর্পন। সময় নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে সোফায় গিয়ে বসে। মাথাটা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে বলে,

—“সন্দেহ নয়। আমি শতভাগ নিশ্চিত এসব সজীবের কাজ। দীপ্তি আপু তার কাছেই আছে। এজন্যই চাইছি, প্রমানগুলো আপনি নিজ দায়িত্বে জজ সাহেবের কাছে পৌঁছে দিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি সজীবকে জেলের চারদেয়ালের মধ্যে দেখতে চাই।”

এই পর্যায়ে ধৈর্যচ্যুত হয় প্রাপ্তি। এই বিষয়ে সম্পুর্ন অজ্ঞ হওয়ায় কারোর কোনো কথাই সে বুঝতে পারছে না। শেষে আর চিন্তা করতে না পেরে চেচিয়ে ওঠে প্রাপ্তি।

—“কেউ কি বলবে, কি হয়েছে? দাদাভাইকে জেলে দেয়া হবে কেনো? আর বড় আপিই বা কোথায়? আমি কিছু বুঝতে পারছি না কেনো? অফিসার, আপনি তো বলেছিলেন আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবেন। তাহলে বলছেন না কেনো?”

পাশ থেকে সুপ্তি হাত চেপে ধরে নিজের বোনের। শান্ত করতে চায় প্রাপ্তিকে। কিন্তু শান্ত করতে পারছে না। প্রাপ্তির চিৎকার চেচামেচি শুনে সোজা হয়ে বসে অর্পন। ছোট্ট একটা দম নিয়ে বলে,

—“কারণ, তোমার দাদাভাই একজন অপরাধী। ড্রা**গ**সে**র ব্যবসা এবং নারী পা***চা***র চক্রের সাথে জড়িত।”

প্রাপ্তির মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। নিজের কানকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। একরাশ বিস্ময় নিয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে,

—“এসব কি বলছেন? এটা সম্ভব নয়।”

—“এটাই সত্যি প্রাপ্তি। সে একজন ক্রিমিনাল। আর শুধু ক্রিমিনালই নয়। একজন ধোঁকাবাজও বটে। আজ থেকে ছয় বছর আগে তোমার এক্সিডেন সেই করিয়েছিলো। তোমাকে ভুল চিকিৎসা দিয়ে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। এটাই তার আসল চেহারা।”

প্রাপ্তির চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়তে থাকে। উপস্থিত সকলেই নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। এই বিষয়টা প্রাপ্তিকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না কেনো? কেউ কেনো প্রতিবাদ করছে না? কেনো বলছে না যে সজীব খারাপ মানুষ নয়। তবে কি অর্পনের কথাই সত্যি? সজীব এসবকিছুর জন্য দায়ি? যাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেছে, সেই মানুষটা একটা ধোঁকাবাজ। এতো বড় ধাক্কাটা মেনে নিতে পারছে না প্রাপ্তি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখ থেকে গড়তে থাকা অশ্রু কণার গতি বৃদ্ধি পায়। টুপটাপ করে কপোল বেয়ে গড়িয়ে হাতের ওপর পড়তে থাকে। কথা বলার শক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছে প্রাপ্তি। বহু কষ্টে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

—“কিন্তু দাদাভাই এমন কেনো করবে? আমার সাথে তার কি শত্রুতা?”

—“শত্রুতা অনেক পুরনো প্রাপ্তি। অনেক বেশি পুরনো।”

—“মানে?”

প্রাপ্তির কৌতুহলী প্রশ্ন। অর্পন রয়ে সয়ে জবাব দেয়,

—“শান নামক কাউকে চেনো তুমি?”

অর্পনের প্রশ্ন শুনে ভাবনায় পড়ে যায় প্রাপ্তি। বুঝতে পারে না অর্পন ঠিক কার কথা বলছে। মস্তিষ্কে জোর দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে এই নামের কাউকে সে চেনে কি না। কিন্তু ফলাফল শূন্য। মনে করতে না পেরে জবাব দেয়,

—“কে শান? আমি তো এই নামের কাউকে চিনি না।”

—“তুমি চেনো প্রাপ্তি। মনে করার চেষ্টা করো। হয়তো তোমার স্কুলের বন্ধু হবে।”

প্রাপ্তি ফের মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে করতে ব্যর্থ হয়। আশাহত কন্ঠে জবাব দেয়,

—“আমি সত্যিই এই নামের কাউকে চিনি না। কে সে? আর এসবের সাথে তার কি সম্পর্ক?”

এদিকে শানের নাম শুনে মুখমন্ডলের রঙ বদলে যায় সুপ্তির। হৃৎস্পন্দন বেগতিক হারে লাফাতে থাকে। ভয়ে হাত পা জমে যায়। সুপ্তির চেহারার এই আকস্মিক পরিবর্তন আর কেউ লক্ষ্য না করলেও অঙ্কন ঠিকই লক্ষ্য করেছে। তবে কিছু বলে সুপ্তিকে অপ্রস্তুত করতে চায় না। সময় দেয় নিজেকে সামলে নেয়ার। ঘাড় ঘুরিয়ে অর্পনের দিয়ে তাকাতে গিয়ে নজর পড়ে মারুফ সাহেবের দিকে। তার চেহারার রঙও পাল্টে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন। অঙ্কনের ভাবনা কাটে অর্পনের আওয়াজে। প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে অর্পন বলে,

—“আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের কথা। তখন তুমি স্কুলে পড়তে। ক্লাস সেভেন অথবা এইটে পড়তে। তখন শান নামক একটা ছেলে তোমার পিছনে পড়ে ছিলো। মনে পড়ে?”

অর্পনের বর্ণনা শুনে ফের ভাবনায় পড়ে যায় প্রাপ্তি। বর্ণনার সাথে অতীতের কিছু মুহুর্ত মিলে যায়। চট করে মনে পড়ে যায় পুরনো স্মৃতি। মনে পড়ার ভঙ্গিতে প্রাপ্তি বলে,

—“হ্যা, মনে পড়েছে। শায়ন নাম ছিলো ছেলেটার। সবাই ছোট করে শান বলে ডাকতো। ছেলেটা বেশ কিছুদিন ধরে আমার পেছনে লেগে ছিলো। বখাটেদের সাথে মেলামেশা ছিলো ছেলেটার। আমি বেশ কয়েকবার বারন করেছিলাম, কিন্তু মানতো না। একদিন অনেক বাজে ব্যবহার করি৷ তারপর থেকে আর দেখিনি ছেলেটাকে। কিন্তু সেটাতো অনেক আগের কথা। আমি ভুলেই গেছিলাম তাকে। কিন্তু এতো পুরনো কথা আপনি তুলছেন কেনো?”

—“দরকার আছে তাই তুলছি। তুমি কি জানো, সেদিনের পর থেকে ছেলেটা আর তোমার সামনে আসেনি কেনো?”

—“না, আমি কিভাবে জানবো?”

—“তুমি না জানলেও, তোমার বাবা ঠিকই জানে। বাকিটা না হয় তার মুখ থেকেই শোনো।”

কথাটা বলেই মারুফ সাহেবের দিকে তাকায় অর্পন। মুহুর্তেই উপস্থিত সকলের নজর যায় মারুফ সাহেবের দিকে। এতে যেনো অস্বস্তি বাড়ে মারুফ সাহেবের। মুখটা পাংশুটে হয়ে যায়। শুকনো গলায় একবার ঢোক গিলে বলেন,

—“আমি চাইনি এই বিষয়ে প্রাপ্তি কিছু জানুক। তবে পরিস্থিতি এখন অনুকূলে নেই। তাই বলতেই হচ্ছে। ওই ছেলেটাকে আমি দেখেছিলাম প্রাপ্তির পিছু পিছু আসতে। বেশ কয়েকবার ছেলেটাকে পাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথেও দেখেছি। নেশা করে পাড়ার মোড়ে মাতলামি করতো। এমন ছেলের সাথে আমার মেয়ের নাম জড়ালে আমার সম্মানহানি হবে। তাই ছেলেটাকে ধরে বকেছিলাম। তাকে যদি প্রাপ্তির আশেপাশে দেখি তাহলে মেরে পা ভেঙে ফেলবো, এটা বলে ভয় দেখাই। কিন্তু ছেলেটা ভিষণ বেয়াদব ছিলো। আমার কথাই মানছিলো না। আমার নাম্বার জোগাড় করেছিলো কিভাবে যেনো। ফোন দিয়ে নির্লজ্জর মতো প্রাপ্তিকে চাইতো। তাই একদিন রেগে…………. ”

এটুকু বলেই থেমে যান তিনি। চোখ মেলে তাকান সুপ্তির দিকে। মেয়েটা ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। মাথা নিচু করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। বাকিটা বলতে গলা কাঁপছে মারুফ সাহেবের। আজ নিজের ভুলের জন্য নিজের সন্তান বিপদে। বাকি কাহিনি টুকু বললে সুপ্তি তো বিপদে পড়ে যাবে। কাজটা বুঝেই করুক বা না বুঝে করুক। এই ঘটনার সাথে তো প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত মেয়েটা।

এদিকে মারুফ সাহেবকে থেমে যেতে দেখে অস্থির হয়ে যায় প্রাপ্তি। বাকিটুকু জানতে মন আনচার করছে। কি হয়েছিলো শানের সাথে? কেনো শান সেদিনের পর থেকে আর প্রাপ্তির সামনে আসেনি? কোথায় চলে গেছে সে? তার বাবাই বা কি করেছে ছেলেটার সাথে?

চলবে?