তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৪২+৪৩

0
102

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৪২
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সজীবকে নিয়ে চলে যেতেই দীপ্তির কাছে দৌড়ে চলে যায় সাগর। অচেতন দীপ্তিকে টেনে তোলে। হাত পা ছেড়ে দিয়ে সাগরের বুকে লুটিয়ে পড়ে দীপ্তি। দুই হাতে আগলে নেয় সাগর। বিড়বিড় করে বলে,

—“তোমার কিচ্ছু হবে না দীপ্তি। আমি তোমার কিছু হতে দেবো না।”

তাড়াহুড়ো করে কোলে তুলে নিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। অর্পন শুধু নিরব চোখে তাকিয়ে দেখে। বাঁধা দেয় না। কারণ সাগরের অস্থিরতা অর্পন বোঝে। খুব ভালো করেই বোঝে।

—————————

নিশুতি রাত! চারিদিকে শুনশান নীরবতা। বাইরে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে বেওয়ারিশ কুকুরের কান্নার সুর। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি অনুভব করছে প্রাপ্তি। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। যদিও তার জন্য দিন আর রাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অন্ধদের আবার রাত দিন আছে নাকি? আপন মনে ভেবে তাচ্ছিল্য হাসে প্রাপ্তি। এই তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি শুধু চোখের দৃষ্টি না থাকায় জন্য নয়। এই হাসি জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রতিটা সুখের জন্য। আপন জনের ধোঁকার জন্য। কাছের মানুষের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার জন্য। সর্বোপরি, এই বিভীষিকাময় সময়ের জন্য।

ভাবনার মাঝেই নিজের পেছনে কারোর অস্তিত্ব অনুভব করে প্রাপ্তি। গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে ব্যক্তির পরিচয়। অর্পনের প্রতিটা প্রশ্বাসের সাথে পরিচিত প্রাপ্তি। তাই চিন্তা ভাবনা না করে ঠান্ডা গলায় বলে,

—“চুপ করে আছেন কেনো অফিসার?”

—“আজও বুঝে গেছো আমার উপস্থিতি!”

অর্পনের বিস্ময় সূচক প্রশ্ন শুনে প্রসস্ত হাসে প্রাপ্তি। পেছন ফিরে অর্পনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। চমৎকার হাসি দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,

—“আপনার প্রতিটা কদমের সাথে আমি পরিচিত। আর আপনার শরীরের গন্ধ, সেটা আরও বেশি পরিচিত।”

মুচকি হাসে অর্পন। বুকটা প্রশান্তিতে ফুলে উঠছে। প্রাপ্তির মুখটা এক হাতে আগলে নিয়ে বলে,

—“বাসায় কথা হয়েছে?”

—“হ্যা, জ্ঞান ফিরেছে আপির। তবে শরীর ভিষণ দুর্বল। আপি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।”

থেমে যায় প্রাপ্তি। চেহারায় ভর করে একরাশ বিষাদ। টলমল করে ওঠে দুই চোখ। প্রাপ্তি মলিন কন্ঠে ফের বলে,

—“এই দুঃসময় কখন শেষ হবে অর্পন? কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে?”

অশ্রু কণায় টইটুম্বুর হয়ে গেছে প্রাপ্তির চোখ। পলক ফেললেই তা নির্দিধায় গড়িয়ে পড়বে কপোল বেয়ে। বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে অর্পনের। এক টানে প্রাপ্তিকে নিজের বুকে নিয়ে আসে। প্রিয় মানুষের চোখে পানি দেখে নিজের শরীরের ব্যথা বেমালুম ভুলে গেছে যেনো। প্রাপ্তির মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে ভরসা দিয়ে বলে,

—“খুব তাড়াতাড়ি এই আঁধার কেটে যাবে প্রাপ্তি। নতুন ভোর খুব সন্নিকটে। সেই নতুন ভোরের আলো আমাদের জীবনের সকল আঁধার কাটিয়ে দেবে।”

কোনো জবাব দেয় না প্রাপ্তি। চুপচাপ অর্পনের বুকের সাথে লেপ্টে থাকে। প্রশান্তি লাগে এইখানটায়। এক আকাশ সমান ভালোলাগায় ছেয়ে যায় মন।

নিঃশব্দে প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নেয় অর্পন। কদম বাড়ায় বিছানার দিকে। হাঁটতে গিয়ে পায়ে চাপ লেগে ব্যথা লাগলেও সেটা মুখ বুজে সয্য করে নেয় অর্পন। এই সামান্য ব্যথা যদি প্রনয়ের সূচনা করে, তাহলে তাই হোক।
প্রাপ্তিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ে। মাথাটা পূর্বের মতোই নিজের বুকের ওপর রাখে। ছোট ছোট করে বিলি কেটে দেয় চুলে। আরাম লাগে প্রাপ্তির। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখের পাতা এক করতেই দুফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। পতিত হয় অর্পনের প্রশস্ত লোমশ বুকে। ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। দুই হাতে প্রাপ্তির মুখ আগলে ধরে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

—“কাঁদছো কেনো?”

—“আমি আপনাকে দেখতে চাই অফিসার। নিজের চোখে দেখতে চাই।”

প্রাপ্তির আকুল ভরা কন্ঠে আবেদনময়ী বাক্য শুনে বুকে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে অর্পন। এই মেয়েকে অর্পন কিভাবে বোঝাবে? তার আবেদনময়ী কন্ঠ অর্পনের বুক ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলে। ব্যথায় জর্জরিত হয় হৃদপিণ্ড। নিজের বুকের ব্যথা দূরে রেখে প্রাপ্তিকে বোঝাতে লেগে পড়ে অর্পন। হালকা হেসে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,

—“আমি তো আগেও বলেছি প্রাপ্তি। চোখে দেখার প্রয়োজন নেই। বরং চোখে দেখার চেয়ে ছুঁয়ে দেখা বেশি তৃপ্তিদায়ক। একবার গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেখো। মনের খাতায় কল্পনার কলমে ছবি আঁকো। দেখবে, এই দেখার মতো আনন্দ পৃথিবীর আর কোনো কিছুতে নেই।”

অর্পনের আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে হারিয়ে যায় প্রাপ্তি। ঘোরের মধ্যে চলে যায় মুহুর্তেই। ঘোরের রেশ ধরেই নিজের ডান হাতটা অর্পনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। সবার আগে হাতের তালু স্পর্শ করে অর্পনের সূচালো খাড়া নাক। পুরো শরীর হালকা কেঁপে ওঠে প্রাপ্তির। তবে থামে না। হাতটা এগিয়ে নিয়ে কপাল ছুঁয়ে দেয়। আজ আর কপালে ব্যন্ডেজ নেই। সেটা খুলে ফেলা হয়েছে। ধীরে ধীরে হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করে অর্পনের সিল্কি চুল। বাতাসের দাপটে হালকা দুলছে চুলগুলো। এলোমেলো হয়ে আছড়ে পড়ে প্রাপ্তির হাতে, অর্পনের কপালে। এবার কপাল থেকে হাতটা ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনে প্রাপ্তি। আঙুল গুলো স্পর্শ করে অর্পনের দুই ঠোঁট। দৃশ্যমান রুপে কেঁপে ওঠে প্রাপ্তি। কম্পন ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছেয়ে যায়। ছুঁয়ে দেখার অনুভূতিটা বড্ড প্রখর।

এদিকে অর্পনের অবস্থা বেহাল। হাসফাস লাগছে। কান গরম হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে গেছে। আধার রাতে প্রিয় মানুষের গভীর স্পর্শ অর্পনকে বেসামাল করে দিয়েছে। নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা উঁকি দিচ্ছে। এভাবে চললে আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না অর্পন।

কথাগুলো ভেবেই লাফিয়ে উঠে বসে অর্পন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাশের টেবিল থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক
করে পানি খায়। তবুও গলা ভিজছে না। বসে থেকেই হাসফাস করতে থাকে।

অর্পনকে এভাবে লাফিয়ে উঠতে দেখে প্রাপ্তিও শোয়া থেকে বসে পড়ে। চিন্তিত স্বরে বলে,

—“কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে কি?”

অর্পনের গলা কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

—“আমার খুব গরম লাগছে।”

—“কিন্তু, ফ্যান তো চলছে।”

—“তবুও গরম লাগছে। বেসামাল হয়ে যাচ্ছি আমি। মাথা কাজ করছে না।”

অর্পনের সহজ স্বীকারোক্তি শুনে লজ্জা পায় প্রাপ্তি। মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। ভেবে নেয় এভাবেই রাত পার করে দেবে। কিন্তু বিধিবাম! প্রকৃতির নিয়ম তার ভাবনার পক্ষে নয়। দুজন বিপরীত লিঙ্গ একসাথে থাকলে একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হয়। এটা প্রকৃতির চিরন্তন সত্য। পৃথিবীর কোনো মানুষ এই নিয়মের উধ্বে নয়। অর্পন আর প্রাপ্তিও পারেনি প্রকৃতির নিয়মকে ভঙ্গ করতে। ফলাফল, ঘটে যায় দুই দেহের মহা মিলন। উভয়ের ইচ্ছায় রচিত হয় প্রনয়ের এক সুমিষ্ট মিলনরাত্রির গল্প।

—————————–

দীপ্তির জ্ঞান ফেরার পর থেকে কেমন যেনো প্রাণহীন পুতুলের মতো আচরণ করছে। চুপচাপ পাথরের মতো বসে আছে শুধু। কারোর সাথে কথা বলছে না। ঘর থেকে বের হচ্ছে না। খাওয়া দাওয়া করছে না। মেয়ের এমন করুণ অবস্থা দেখে বুকটা ভার হয়ে আসে মারুফ সাহেবের।
এদিকে কামরুল সাহেবও অসুস্থ। কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। বাবার সাথে দেখা করে সময় নিয়ে মেয়ের ঘরে আসেন মারুফ সাহেব। ঘরে পা রাখতেই দেখেন সুপ্তি সোফায় খাবার নিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছে। দীপ্তি খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বড় মেয়ের দিকে এগিয়ে যান মারুফ সাহেব। দীপ্তির পাশাপাশি বসে আলতো করে মাথায় হাত রাখেন। আদুরে কন্ঠে বলেন,

—“এভাবে না খেয়ে থাকলে কিভাবে হবে আম্মু? কিছু খেয়ে নাও।”

দীপ্তির বন্ধ চোখের কোণা দিয়ে টুপটাপ পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখ খুলেই ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দেয়। চেচিয়ে বলে,

—“কেনো এসেছো এখানে?”

—“এখনও এভাবে কথা বলবি মা? বাবাকে কি ক্ষমা করে দেয়া যায় না?”

—“আমার ক্ষমা দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি যা চাও তাই তো পেয়েছো। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। নিজের সম্মান বাঁচাতে তুমি আমার ইচ্ছেকে মেরে ফেলেছো। আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে সজীবের সাথে বিয়ে দিয়েছো। তোমার দেয়া হুমকিতে আমি একটা নির্দোষ ছেলের মন ভেঙেছি। তুমি আমার থেকে সব সময় সবকিছু কেড়ে নিয়েছো বাবা। তুমি আমার মুখের হাসি কেঁড়ে নিয়েছো। আমার জীবনটা অভিশপ্ত করে তুলেছো৷ কি এমন ক্ষতি হতো তখন আমার কথা মানলে? কি এমন ক্ষতি হতো আমার পছন্দের মানুষটার সাথে বিয়ে দিলে। আমি সুখে থাকতাম। আমার জীবনটা সুন্দর হতো। কিন্তু সেটা তুমি চাওনি। আমার কষ্ট চেয়েছো তুমি। তাহলে এখন কেনো দরদ দেখাতে আসছো? বলো?”

দীপ্তির তেজি কথার বিপরীতে উত্তর খুঁজে পান না মারুফ সাহেব। নিজের করা ভুলের জন্য আজ তিনি সন্তানের চোখে ঘৃণিত। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন মারুফ সাহেব। মেয়ের দিকে তাকিয়ে আকুল ভরা কন্ঠে বলেন,

—“মা রে! আমি তো তোর ভালোই চেয়েছিলাম। সন্তানের ক্ষতি কোনো বাবা চায় না। তবুও আমার দ্বারাই সব ক্ষতি হয়েছে। আমি তোদের ভালো করতে গিয়ে অজান্তেই খারাপ করে ফেলেছি। বাবাকে ক্ষমা করে দেয়া যায় না?”

—“এতোগুলা বছরে যখন ক্ষমা করতে পারিনি। তাহলে আজ তো আরও সম্ভব নয়।”

জোর দিয়ে কথাগুলো বলেই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দীপ্তি। মারুফ সাহেব দুই হাতে মুখ চেপে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অহংকারের তাড়নায় নিজের করা কিছু ভুল সিদ্ধান্ত তার মেয়েদের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। সাজানো গোছানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। আর কিচ্ছু বাকি নেই।

—————————

সকাল সকাল থানায় চলে এসেছে অর্পন। উদ্দেশ্য, সজীবের সাথে দেখা করা। ব্যাস্ত পায়ে হেঁটে সজীবের সেলের সামনে এসে দাঁড়ায় অর্পন। সজীব দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। হাতের উন্মুক্ত জায়গায় মারের দাগ জখম হয়ে আছে। সজীবকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলবে এমন সময় ঝড়ের গতিতে দীপ্তি এসে দাঁড়ায়। অর্পন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। দীপ্তি এসেই সেলের সামনের লোহার শিক ধরে কড়া গলায় ডাকে,

—“সজীব!”

দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো সজীব। হঠাৎ পেছন থেকে দীপ্তির কন্ঠ শুনে হুট করে পেছন ফিরে তাকায়। দীপ্তির পেছন পেছন সুপ্তিও চলে এসেছে। দীপ্তিকে সজীবের সেলের সামনে দেখে পাশে দাড়িয়ে পড়ে।

সজীব ধীর পায়ে এগিয়ে আসে দীপ্তির দিকে। চোখে মুখে তার খুশির ঝলক। দীপ্তি তার সাথে দেখা করতে এসেছে।এ যেনো সজীবের কল্পনার থেকেও বেশি কিছু। কিন্তু মুহুর্তেই সজীবের হাসিখুশি মুখটা চুপসে যায় দীপ্তির কথা শুনে। দীপ্তি সেলের ভেতরে হাত বাড়িয়ে সজীবের ফতুয়ার কলার চেপে ধরে। চিৎকার করে বলে,

—“তুমি আমাকে কেনো ঠকালে সজীব? কেনো এতবড় প্রতারনা করলে? কি অপরাধ ছিলো আমার? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে তুমি আমার এতবড় ক্ষতি করলে কেনো? আমার বাচ্চাটাকে কেনো মারলে? তোমার এই ধোঁকা আমি সইতে পারছি না সজীব। আমার বুকে ব্যথা করছে। দম আটকে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমি মরে যাচ্ছি সজীব। বিশ্বাস করো, আমি মরে যাচ্ছি। এমন তিলে তিলে মৃত্যু কেনো উপহার দিলে আমাকে? একেবারে কেনো মেরে ফেললে না?”

কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে দীপ্তি। তার করুণ কন্ঠের এক একটা আর্তনাদ উপস্থিত সকলের বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অশ্রুশিক্ত করে দিচ্ছে সকলের চোখ। পাশে দাড়িয়ে সুপ্তি দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছে। তার বোনের এই করুণ পরিণতির জন্য কোনো না কোনোভাবে সে নিজেও দায়ি। এই অপরাধবোধ সুপ্তিকে পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়ে দিচ্ছে।

অর্পনের সাথে দেখা করতে এসেছিলো সাগর আর অঙ্কন। এখানে এসে দীপ্তিকে দেখে দুরত্ব বজায় রেখে দাড়িয়ে যায়। দীপ্তির আর্তনাদ সয্য করতে না পেরে পেছন ফিরে জোরে জোরে নিশ্বাস টানে সাগর। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে সাগরের। কান্না আটকে রাখায় চোখের এমন করুন দশা। সাগরের কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দেয় অঙ্কন।

একদিকে দীপ্তির কান্না যেনো বাঁধ ভেঙে গেছে। কিছুতেই থামছে না। চিৎকার করে কাঁদতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বোনকে জ্ঞান হারাতে দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে সুপ্তি। অর্পন তাড়াহুড়ো করে এসে কোলে তুলে নেয়। দীপ্তির নিথর জ্ঞানহীন দেহটা নিয়ে ব্যস্ত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

সজীবের চোখ জ্বলছে। ভিষণ জ্বলছে। দীপ্তির হাত পা ছেড়ে দেয়া নিথর দেহ দেখে বুকে ব্যথা করছে। কান্নারা গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেছে। সেলের লোহা দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলে,

—“যদি বলি এসব আমি নিজের ইচ্ছায় করিনি। তুমি কি বিশ্বাস করবে দীপ্তি? ক্ষমা করবে আমায়?”

————————–

দীপ্তির চেক-আপ করছে সাগর। পাশেই অর্পন দাড়িয়ে আছে। সুপ্তি দড়জার সামনে দাড়িয়ে বোনের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই প্রচন্ড কান্না পায়। কান্না আটকে রাখতে না পেরে দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায় সুপ্তি। থানার পেছন দিকের ফাঁকা জায়গায় এসে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। দুই হাঁটুর ওপর থুঁতনি রেখে নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দেয়। ফোঁপানোর তাড়নায় পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই চোখের সামনে একটা সাদা রুমাল দেখতে পায়। কেউ রুমাল নিয়ে সুপ্তির দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। হাতের মালিক কে দেখার জন্য পাশে ঘুরে তাকায় সুপ্তি। পাশে সামান্য দুরত্ব রেখে অঙ্কন বসে আছে। দৃষ্টি তার সামনের খোলা মাঠের দিকে। সেদিকে চোখ রেখেই বলে,

—“তাকিয়ে না থেকে রুমালটা নাও। এটা তোমার জন্যই এনেছি।”

সুপ্তির কান্না থেমে গেছে এতোক্ষণে। শুধু থেকে থেকে হিচকি দিচ্ছে। রুমালটা নিয়ে চোখ মুছে নেয়। অঙ্কন আড় চোখে তাকায় একবার। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই বলে,

—“কথায় কথায় কান্না করে কারা, জানো? দুর্বলেরা। কিন্তু তুমি তো দুর্বল নও। আমার সাথে ঝগড়া করার সময় তো বাঘিনীর রুপ ধারণ করো। তাহলে এখন নিজেকে দুর্বল প্রমান করছো কেনো?”

—“তো, আপনি কি এখন আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছেন?”

—“একদম না। ঝগড়া করা আমার স্বভাব নয়। ওটা তো তুমি করো। ঝগড়ুটে মেয়ে একটা!”

—“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।”

—“দুর্বলদের আবার মান অপমানবোধ আছে নাকি? জানতাম না তো।”

রাগে ফুঁসে উঠে সুপ্তি। অঙ্কনের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বলে,

—“আপনি আসলেই একটা অসভ্য লোক।”

—“বাহ্! উপকার করে অসভ্য উপাধি পেলাম।”

—“লাগবে না আপনার উপকার। আপনার উপকার আপনি আপনার কাছেই রাখুন।”

কথাটা বলেই হাতের রুমাল দিয়ে নাক মুছে অঙ্কনের দিকে ছুড়ে মারে সুপ্তি। হতবাক হয়ে যায় অঙ্কন। সুপ্তি এমন নোংরামি করবে সেটা অঙ্কন কল্পনাতেও ভাবেনি। রুমালটার দিকে তাকিয়ে গা গুলিয়ে আসে অঙ্কনের। নাক মুখ কুঁচকে সুপ্তির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে,

—“তুমি একটা বেয়াদব সুপ্তি।”

—“আর আপনি হলেন কলিজা কাটা ডাক্তার।”

যেতে যেতেই উঁচু গলায় কথাটা বলে মুখ ভেঙচি দিয়ে চলে যায় সুপ্তি। ঘাসের ওপর পড়ে থাকা রুমালটার দিকে করুন চোখে তাকায় অঙ্কন। এটা তার সবচেয়ে পছন্দের রুমাল। সে তো শুধু রুমালে সুপ্তির হাতের ছোঁয়া চেয়েছিলো। চোখের পানিটা ছিলো এক্সট্রা গিফট। স্মৃতি হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিতো অঙ্কন। কিন্তু এই নোংরা রুমাল এবার সে কি করবো? ভেবে চিন্তে পকেট থেকে বেশ কিছু টিস্যু বের করে। টিস্যু গুলো দিয়ে রুমালটা পেঁচিয়ে পকেটে পুরে নেয়। বাসায় গিয়ে কাজের লোককে দিয়ে ধুইয়ে নিতে হবে। ভাবতেই অবাক লাগে। হাইজিন নিয়ে সচেতন অঙ্কনকে এমন নোংরামি সয্য করতে হচ্ছে। বেচারা হতাশ। ভিষণ হতাশ।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৪৩
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

দীপ্তির জ্ঞান ফেরার পর সুপ্তির সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে অর্পন। অঙ্কন গেছে তাদের বাসায় পৌঁছে দিতে। এদিকে অর্পনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেছে সাগর। আলোচনার মূল কেন্দ্র প্রাপ্তি। চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে সাগর সিরিয়াস কন্ঠে বলে,

—“আমি একজন সিনিয়র আই স্পেশালিষ্টের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম অর্পন। প্রাপ্তির সব রিপোর্ট তাকে দেখাই। তিনি সবটা দেখে জানান, প্রাপ্তি বর্তমানে যেই স্টেজে আছে সেখানে থেকে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অল্পকিছু দিন নয়, বরং বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁকে ভুল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। যদি শুরুর দিকে চেষ্টা করতো তাহলে একটা আশা ছিলো। কিন্তু এখন আশা কম।”

—“ঠিক বুঝলাম না ভাই। প্রয়োজন পড়লে ওকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো। তাহলে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”

—“আমি যার সাথে কথা বলেছি তিনি আমেরিকার ডক্টর অর্পন। তিনি বলেছেন, প্রাপ্তির দৃষ্টি শক্তি ফেরাতে হলে ওর চোখের একটা বড় অপারেশন করাতে হবে।”

—“তো সমস্যা কোথায়? করাবো অপারেশন। যত টাকা লাগে লাগবে। আমি নিজের সবটা দিতে প্রস্তুত।”

সাগর হতাশ কন্ঠে বলে,

—“সমস্যাটা টাকা নিয়ে নয় অর্পন। এই অপারেশনে ঝুঁকি অনেক। এমন কি, প্রাপ্তি মারাও যেতে পারে।”

শেষের কথাটা শুনে চমকে ওঠে অর্পন। বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে মুহুর্তেই। প্রাপ্তিকে হারানোর কথা কল্পনাতে আনতেও বুকে ব্যথা হয় অর্পনের। সে কোনোকিছু বিনিময়ে প্রাপ্তিকে হারাতে নারাজ। সাগরের দিকে তাকিয়ে আশাহত কন্ঠে বলে,

—“আর কি কোনো উপায় নেই ভাই?”

—“উপায় একটাই। তাতে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। এখন সিদ্ধান্ত তোর। এখন বল তুই কি করতে চাইছিস?”

—“প্রাণের ঝুকি থাকলে সেখানে অপারেশন করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রয়োজন নেই পরিবর্তন আনার। ও যেমন, আমি ওকে তেমনই ভালোবাসি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমি ওর অপারেশন করাতে চাই না। এভাবেই না হয় ব্কি জীবন কাটাবো। আমার তাতে কোনো আফসোস নেই।”

সাগরও আর দ্বিমত পোষণ করে না। এতোটা ঝুঁকি নেয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এতে প্রাপ্তিকে সারাজীবন অন্ধ হয়ে থাকতে হবে, এতটুকুই।

——————————

এরই মাঝে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে সকলের জীবন বদলে গেছে। দীপ্তিও নিজেকে সামলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। তাকে পুরো দমে সাপোর্ট করে যাচ্ছে তার পরিবার। সেই সাথে সাগরের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা তো আছেই।

সজীবের কেসটাও কোর্টে উঠে গেছে। সোহেলের দেয়া সাক্ষী এবং সকল প্রমানের ভিত্তিতে সজীবের বারো বছরের জেল ধার্য করা হয়েছে। এর মাঝে রাবেয়া বেগম এবং শানের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, সকল প্রমান সজীবের বিরুদ্ধে ছিলো। তার মা এবং ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের প্রমান না থাকায় আইনগত ভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তবে হাল ছাড়েনি অর্পন। শান মাদকাসক্ত। সেই রেশ ধরে তাকে শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছে।

সজীবের শাস্তি ধার্য হওয়ার পর এতোদিনে রাবেয়া বেগম থানায় আসেন সজীবের সাথে দেখা করতে। অর্পন সেই সময় থানাতেই ছিলো। রাবেয়া বেগমকে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। অনিচ্ছার সত্বেও দেখা করার অনুমতি দেয়। অনুমতি পেয়ে সজীবের সেলের সামনে এসে দাড়ান রাবেয়া বেগম। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান সজীবের দিকে। এই কয়েকদিনেই মুখটা শুকিয়ে গেছে। চেহারায় বিষাদের ছাপ। রাবেয়া বেগমকে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সজীব। আশেপাশে কেউ নেই। সজীব কাতর কন্ঠে বলে,

—“আমি আপনার কথা রেখেছি আম্মা। এবার আপনার পালা।”

—“কিন্তু আমি তো কথা রাখবো না সজীব।”

রাবেয়া বেগমের হেয়ালি সুরে কথা। চমকে তাকায় সজীব। চোখে মুখে তার স্পষ্ট ক্রোধ ফুটে উঠেছে। সেলের লোহার শিক দুই হাতে শক্ত করে ধরে তেজি কন্ঠে সজীব বলে,

—“আপনি আমার সাথে বেইমানি করতে পারেন না আম্মা।”

—“বেইমানি তো আমার রক্তে আছে। তাহলে ইমানদারি কিভাবে দেখাই।”

সজীবের রাগ তরতর করে বেড়ে যায়। রাগে ফুঁসে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

—“যদি আমার সাথে বেইমানি করেন, খু**ন করে ফেলবো আপনাকে। আপনার কথায় আমি সমস্ত অন্যায় কাজ করেছি। নিজের মানবতাকে কবর দিয়ে পাষাণে পরিণত হয়েছি। আপনার সমস্ত অপরাধ নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছি। এমনকি, আমার দীপ্তির সাথেও প্রতারনা করেছি। জেলের অভিশপ্ত জীবন মেনে নিয়েছি। এর পরেও যদি আপনি বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। তাহলে খু**ন করে ফেলবো আপনাকে।”

রাবেয়া বেগমের ঠোঁটে তাচ্ছিল্য হাসি। তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলেন,

—“তুই নিজে জেল থেকে বের হলে তবে তো আমাকে মারবি। এখন চিৎকার করে সত্যিটা বললেও কোনো লাভ হবে না। কারণ যে বা যারা তোকে সাহায্য করবে, তাদের সবার মন থেকে তোর প্রতি বিশ্বাস উঠিয়ে দিয়েছি। সুতরাং, তোর ফাঁকা আওয়াজে আমি ভয় পাই না। যেখানে তোর বাবাই আমার কিছু করতে পারেনি। সেখানে তুই এমন কি জিনিস? এখন আমার অপরাধের জন্য শাস্তি তুই পাবি। আর আমি মুক্ত বাতাসে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবো। চিন্তা করিস না। শানকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবো দেশ ছেলে। ভালো থাকিস কেমন।”

হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে যান রাবেয়া বেগম। জেলের ভেতর থেকে ছটফট করতে থাকে সজীব। অস্থিরতায় শরীর কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর ধরফর করছে। এখন কি করবে সে? কে সাহায্য করবে তাকে?

সজীবের কাছ থেকে সরে এসে চেহারার হাসি সরিয়ে ফেলেন রাবেয়া বেগম। দুঃখী দুঃখী ভাব করে কান্নার অভিনয় করেন। অর্পনের সামনে এসে কান্নার বেগ বেড়ে যায়। আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

—“আমার ছেলেটাকে মারধর করবেন না সাহেব। ছোটো ছেলে আমার। ভুলবশত অন্যায় করে ফেলেছে। পারলে ওকে ক্ষমা করে দিবেন।”

অর্পন নির্বাক। শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে রাবেয়া বেগমের দিকে। এই ভদ্র চেহারার আড়ালে লুকিয়ে রাখা অভদ্র চেহারা চোখ এড়ায়নি অর্পনের। ঘৃণা হচ্ছে খুব। একজন মা এতটা জঘন্য হয় কিভাবে? অর্পনকে কিছু বলতে না দেখে থেমে যান রাবেয়া বেগম। বেশি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সেখান থেকে চলে যান। কথা বাড়ালে গোপন কথা বেরিয়ে আসতে পারে। সজীবের ঘাড়ে সব দোষ চাপালেও তিনি এবং শান নিরাপদ নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রস্থান করেন থানা থেকে।

রাবেয়া বেগম থানার বাইরে পা রাখতেই পাশের একজন কনস্টেবলের দিকে তাকায় অর্পন। কানের ব্লুটুথ ডিভাইস খুলতে খুলতে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“নজর রাখো এই মহিলার ওপর। তার প্রতিটা সেকেন্ডের আপডেট আমার চাই।”

কনস্টেবলকে আদেশ দিয়ে সোজা চলে যায় সজীবের কাছে। সজীবের ওপর নজর রাখতে গোপন সিসি ক্যমেরা এবং স্পিকার লাগিয়ে রেখেছে অর্পন। এতোক্ষণ ধরে সে ব্লুটুথে মা ছেলের সব কথা শুনছিলো। তবে সব কথাই সন্দেহ জনক লেগেছে অর্পনের কাছে। সত্যিটা জানতে এবার সজীবের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। বুক ফুলিয়ে সেলের তালা খুলে ভেতরে ঢোকে অর্পন। সজীব পেছন দিক ফিরে মাটিতে বসে আছে। চুপচাপ পাথরের মতো নির্জিব হয়ে। অর্পন পেছনে এসে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। দুই হাত প্যন্টের পকেটে গুজে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—” আর কত অপরাধ করবে?”

—“সবসময় চোখের দেখা সত্যি হয়না, জানো তো অফিসার!”

—“জানি বলেই তোমার কাছে এসেছি। আমি সেই সত্যিটা জানতে চাই। যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”

—“বিশ্বাস করবে কি?”

সজীব মাথা ঝুকিয়ে রেখেই জবাব দেয়। অর্পন ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফ্লোরে সজীবের মুখোমুখি হয়ে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“তুমি আমার কলিজায় আঘাত করেছো। বিশ্বাস তো তোমাকে করা সম্ভব নয়। তবুও একটা সুযোগ দিচ্ছি। যদি প্রমান করতে পারো তুমি নির্দোষ, তাহলে তোমার শাস্তি কমানো হবে।”

—“শাস্তি কমাতে চাই না আমি। বরং বাড়ালে ভালো হয়। কি করবো বাইরে গিয়ে? আমার যে আর নিজের বলতে কিছুই নেই। সব হারিয়ে নিঃস্ব আমি। আমার পাপ আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দেবে না।”

—“তাহলে অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়েছো কেনো? কি চাওয়া আছে এর পেছনে? যা তোমার মা দেয়নি। কেনো বললে সে বেইমানি করছে?”

চুপ হয়ে যায় সজীব। অশ্রুতে চোখ টইটম্বুর। চোখে মুখে স্পষ্ট বিষাদ। স্বজন হারানোর বেদনা। সব মিলিয়ে এ যেনো অন্য এক সজীব। অর্পনের প্রশ্ন শুনে চোখ মেলে তাকায় সজীব। নির্জিব, দুর্বল চোখের চাহনি। বিষাদ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

—“এসব জানতে হলে যে লম্বা কাহিনি শুনতে হবে অফিসার। সময় হবে তোমার?”

নড়েচড়ে বসে অর্পন। যদিও সে সজীবকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। তবুও সব সত্যি সে জানতে চায়। সজীবের প্রশ্নের বিপরীতে অর্পন সময় নিয়ে জবাব দেয়,

—“আমি তোমার সব কথা শুনবো।”

—“এসব আমি নিজের মাকে বাঁচাতে করেছি।”

—“তোমার মা? মানে রাবেয়া বেগম?”

—“না, তিনি আমার মা নন।”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় অর্পন। কিছুটা অবাকও হয় বটে। মনে জেঁকে বসে একরাশ কৌতূহল। কৌতূহলী কন্ঠে অর্পন প্রশ্ন করে,

—“মানে?”

একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে সজীব। নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলতে শুরু করে,

—” আমার বাবার নাম জামিল শেখ আর মায়ের নাম সুমনা বেগম। বাবা আর মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম আমি। আমার বাবার একটা মুদির দোকান ছিলো। খুব বেশি সচ্ছল না হলেও সুখের সংসার ছিলো আমাদের। ভালোই কাটছিলো জীবন। একদিন হঠাৎ করেই মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। পুরনো বান্ধবীকে পেয়ে মাও খুব খুশি হয়ে যান। তখন থেকেই আমাদের বাড়িতে তার যাতায়াত বাড়ে। একসময় বাবার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আমার বয়স তখন আট বছর। বাবা একদিন মায়ের সেই বান্ধবীকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। মা সেদিন পাথরের মতো তাকিয়ে ছিলো শুধু। কোনো কথা বলেনি। মায়ের সেই বান্ধবীই হলো রাবেয়া বেগম।
তার আগমনের পর থেকে আমাদের সুখের সংসার অসুখে পরিনত হয়। ছড়িয়ে পড়ে বিষাদ আর কষ্ট। এক বছর পর শানের জন্ম হয়। তারপর থেকে রাবেয়া বেগমের অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। তিনি আমাকে আর আমার মাকে কিছুতেই সয্য করতে পারতেন না। খুব মারধর করতেন আমাকে। তারপর একদিন বাবা এক্সিডেন্টে মারা যান। বাবার মৃত্যুটাও ধোঁয়াশা ছিলো।
এরপর থেকে রাবেয়া বেগম একদম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আমার মাকে কোথাও সরিয়ে ফেলেন। মা ভক্ত ছেলে ছিলাম আমি। মাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। মায়ের প্রতি আমার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে দিয়ে সব অন্যায় কাজ করানো শুরু করে রাবেয়া বেগম। তার ড্রা*গ**সের ব্যবসার কথা বেরিয়ে আসে তখন। আমাকে দিয়ে ড্র**গ**সের আদান প্রদানের সব কাজ করাতো। ছোট ছিলাম। বুঝতাম না। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না করেছি৷ তখন গরম খুন্তি পুড়িয়ে পায়ে চেপে ধরতো। অসুস্থ শরীরে একা ঘরে কাতরেছি। কাউকে কাছে পাইনি। মাঝ রাতে স্বপ্ন দেখে মা মা বলে চিৎকার করে কেঁদেছি। মাকে কাছে পাইনি। ছোট থেকেই অনেক ভীতু ছিলাম আমি। বড্ড বেশি দুর্বল ছিলাম। মা বিহীন আরও দুর্বল বেশি দুর্বল হয়ে যাই।
তখন আমাকে শর্ত দিতো, তার কথামতো কাজ করলে মায়ের সাথে দেখা করতে দেবে। মাকে কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। করেছি তার কাজ। এভাবে তার কথামতো কাজ করলে মায়ের সাথে প্রতিদিন দেখা করতে দিতো। তাও মাত্র দশ মিনিটের জন্য। এই দশ মিনিট মা’কে শক্ত করে জাপ্টে ধরে থাকতাম। মায়ের কোলে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কাঁদতাম। মা শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকতো।
ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। আর ওরা আমার মায়ের সাথে দুরত্ব তৈরি করলো। দেখা করার সময় কমিয়ে দিলো। কাজের একটা নির্দিষ্ট টার্গেট দিতো আমাকে। টার্গেট পুরো করতে পারলেই মায়ের সাথে দেখা করতে দিতো। তাও মাসে একবার। আর কোনো ভুল হলে সেই মাসে আর দেখা করতে দিতো না।

এভাবে বড় হতে থাকি। মায়ের অভাব পুরন করতে সৎ মাকে আম্মা বলে ডাকি। তার সব পাপ নিজের গায়ে মেখে নেই। তাকে আপন করে নেই। যাতে তার একটু মন গলে। আমার মাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। জানো অর্পন, গত পাঁচ মাসে একবারও মায়ের সাথে দেখা করতে দেয়নি। প্রতিটা কাজ তুমি ভেস্তে দিয়েছো তাই। তিনি নিজের কার্য সিদ্ধি করতে আমাকে ব্যবহার করেছেন। প্রাপ্তির এক্সিডেন আমাকে দিয়ে করান। দীপ্তিকে বিয়ে করতে তিনিই চাপ দিয়েছিলেন। জোর করে বিয়ে করিয়ে দেন, কিন্তু সুখে সংসার করতে দেন না। স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন কোনো সন্তান যেনো না আসে।

বিশ্বাস করো অর্পন, আমার বাচ্চাকে আমি মারিনি। ওটা আম্মার কাজ ছিলো। আমার নাম করে এই জঘন্য কাজ করেন তিনি। আমি জানার পর তার সাথে তুমুল ঝামেলা হয়। তখন তিনি আমার মাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। আমার দুর্বলতা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। তাই নিজের মাকে বাঁচাতে চুপ হয়ে যাই আমি। সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নেই।

তুমি আমাদের বিষয়ে সব জেনে যাওয়ার পর আম্মা বলেছিলেন, যদি পুলিশ সব জেনে যায় তাহলে সব দোষ আমার ঘাড়ে নিতে। তার নাম যেনো কোনোভাবেই না আসে। আমি যদি সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেই তাহলে তিনি আমার মাকে ছেড়ে দেবেন। মুক্ত করে দেবেন এই বন্দী জীবন থেকে। আমি সেটাও মেনে নেই। তার নাম এই অপরাধের পাতার কোথাও আসতে দেইনি। কিন্তু ওই বেইমান মহিলা বেইমানি করেছেন আমার সাথে। আমার শাস্তি হওয়ার পর এখন এসে বলছেন আমার মাকে তিনি ছাড়বেন না। জানি না মা এখন কি অবস্থায় আছে! এই পাঁচ মাসে তার সাথে ঠিক কি কি করেছে! আমি নিজের মাকে বাঁচাতে এতো অপরাধ করলাম অর্পন। কিন্তু দেখো, দিন শেষে তাকে বাঁচাতেই পারলাম না।”

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে সজীব। এটা চাপা কান্না নয়। গলা ছেড়ে বাঁধ ভাঙা কান্না। লোকে বলে পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি এতটাই নির্মমতা বয়ে আনে যে, শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষও নিজের সয্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

উপরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয় অর্পন। চোখ দুটো জ্বলছে। কয়েকটি লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে অর্পন। সজীবের দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বলে,

—“পাপ কখনো মুক্তির পথ হয়না সজীব। পাপ সবসময় ধ্বংসের পথ হয়। আমি বুঝতে পারছি তুমি নিরুপায় ছিলে। তোমার হাতে দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা ছিলো না। তোমাকে বাধ্য করা হলেও অন্যায়গুলো তুমি নিজ হাতে করেছো সজীব। সুতরাং তোমাকে নির্দোষ প্রমান করা সম্ভব নয়।”

—“আমি চাইনা নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে। আমি শুধু আমার মাকে ওই পাগল মহিলার হাত থেকে বাঁচাতে চাই। মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। আমার এই উপকারটা করো অর্পন। ওই মহিলার কার্য সিদ্ধি হয়ে গেছে। এখন সে আমার মাকে মেরে ফেলবে। আমার মাকে বাঁচাও প্লিজ। আমি আর কিচ্ছু চাই না।”

—“তুমি কি জানো তোমার মাকে কোথায় রাখা হয়েছে?”

সজীব হতাশ কন্ঠে জবাব দেয়,

—“নাহ্! মায়ের সাথে দেখা করতে যাওয়া সময় আম্মা তার লোকদের আমার সাথে পাঠাতেন। আমার চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে যেতো ওরা। তাই ঠিক কোথায় মাকে রেখেছে সেটা জানি না। প্লিজ কিছু করো অর্পন। আম্মা একটা পাগল। উনি যা খুশি করতে পারেন। তার হাত থেকে আমার মাকে বাঁচাও।”

এই পর্যায়ে চিন্তায় পড়ে যায় অর্পন। লোকেশন না জানলে তাকে উদ্ধার করবে কিভাবে? খুঁজে বের করতে করতে যদি তার কোনো ক্ষতি করে দেয়?

চলবে?