#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
প্রাপ্তিকে অপারেশনের জন্য রেডি করানো হয়েছে। মারুফ সাহেব আর দিলারা বেগম প্রাপ্তির দুই হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। নানান কথা বলে প্রাপ্তিকে সাহস দিচ্ছেন। মূলত তারা জানেন না যে, এই অপারেশনে প্রাপ্তির মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। প্রাপ্তি জানতে দেয়নি তাদের। সেই মুহূর্তে সাগর আর অঙ্কন সেখানে উপস্থিত হয়। সুপ্তি সকলের অগোচরে ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। সাগর প্রাপ্তির সামনে এসে দাঁড়িয়ে হেঁসে বলে,
—“ভয় লাগছে?”
মাথা ডানে বামে নেড়ে না বোঝায় প্রাপ্তি। তবে তার ভেতরের অবস্থা ভিন্ন। সত্যি তো এটাই, প্রাপ্তি ভয় পাচ্ছে। ভিষণ ভয় পাচ্ছে। যদি অপারেশন সাকসেসফুল না হয়। যদি অপারেশন চলাকালীন সময়েই তার অন্তিম কাল ঘনিয়ে আসে। তখন কি হবে? অর্পনকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে যেতে হবে। ভালোবাসার পরিসমাপ্তি ঘটবে। আচ্ছা অর্পন কি করবে তখন? তার মৃত্যু সয্য করতে পারবে কি? ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে প্রাপ্তির। নিজের জন্য নয়। বরং অর্পনের জন্য।
প্রাপ্তির ভাবনার ছেদ ঘটে নার্সের আওয়াজ শুনে। নার্স নমনীয় কন্ঠে বলে,
—“ম্যাম অপারেশনের সময় হয়ে গেছে। চলুন আমার সাথে।”
চুপচাপ নার্সের সাথে পা বাড়ায় প্রাপ্তি। দু কদম এগিয়েই থেমে যায়। সামনের দিকে তাকিয়েই সাগরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“আমার একটা কাজ করে দিতে পারবেন ভাইয়া?”
—“কি কাজ?”
সাগরের কৌতুহলী প্রশ্ন। প্রাপ্তি তার হাতের মুঠো থেকে একটা কাগজ বের করে দেয়। সাগর সেটা হাতে নিতেই প্রাপ্তব বলে,
—“এটা অর্পনকে দেবেন প্লিজ। ব্যাস এটুকুই।”
নার্সের তাগাদায় বেশি দেরি করতে পারে না প্রাপ্তি। সেই মুহূর্তে অপারেশন থিয়েটারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
——
প্রাপ্তির অপারেশন শুরু হয়েছে। দুরুদুরু মন নিয়ে দড়জার বাইরে দাড়িয়ে আছে সবাই। ভয়ে, আতঙ্কে সকালের হাল বেহাল। তবে সবচাইতে বেশি ভয়ে আছে সাগর। তার এতো বছরের ডাক্তারি জীবনে আজ প্রথম সে ভয় পাচ্ছে। অর্পনকে না জানিয়ে এতো বড় একটা কাজ করেছে সে। প্রাপ্তির আকুল ভরা অনুরোধ ফেলতে পারেনি সাগর। তাই অর্পনের অজান্তেই অপারেশনের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কিন্তু ভয় হচ্ছে। যদি অপারেশন সাকসেসফুল না হয়। যদি প্রাপ্তির সাথে খারাপ কিছু হয়? তাহলে অর্পনকে কি জবাব দেবে সে?
সাগরের ভয় আরও এক ধাপ বেড়ে যায় অর্পনকে আসতে দেখে। ছন্নছাড়া, এলোমেলো চেহারা নিয়ে হাজির হয় অর্পন। এসেই উন্মাদ দের মতো আচরণ শুরু করে। পেছন পেছন আসেন সুভাষ সাহেব এবং সন্ধ্যা বেগম। অর্পন এসেই উন্মাদের মতো করে বলে,
—“প্রাপ্তি কোথায়? প্রাপ্তি? আমার প্রাপ্তি কোথায়?”
কথা বলতে বলতেই অর্পনের নজর পড়ে মাথায় ওপর জ্বলতে থাকা লাল লাইটের ওপর। মানে অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। রাগ ভয় সব মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি হয় অর্পনে। তড়িৎ গতিতে দড়জার কাছে গিয়ে এলোপাতাড়ি ধাক্কাতে থাকে। চিৎকার করে বলে,
—“দড়জা খুলুন। ডক্টর দড়জা খুলুন প্লিজ। আমি প্রাপ্তির অপারেশন করাতে চাই না। প্লিজ দড়জা খুলুন। প্রাপ্তি, এটা ঠিক করছো না। কেউ দড়জা খুলুন।”
অর্পনকে পাগলের মতো চিৎকার করতে দেখে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে সাগর। টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে এসে বলে,
—“থেমে যা অর্পন। অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। এখন কোনোকিছু আটকানো সম্ভব নয়।”
শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যায় করে সাগরের থেকে নিজেকে ছাড়ায় অর্পন। সাগরের কলার চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে বলে,
—“এসব তুমি করেছো তাই না ভাই? কোন সাহসে এটা করলে? কার অনুমতিতে অপারেশন করাচ্ছো তুমি?”
—“অর্পন আমার কথা শোন।”
—“কি শুনবো? তুমি আমার জানে হাত দিয়েছো ভাই। কেনো করলে এমন? যদি প্রাপ্তির কিছু হয়ে যায়, আমি তোমাকে খুন করে ফেলবো!”
চিৎকার করে বলতে বলতেই সাগরের নাক বরাবর ঘুসি মারে অর্পন। ছিটকে নিচে পড়ে যায় সাগর। ভয়ে চমকে ওঠে উপস্থিত সবাই। সুভাষ সাহেব দ্রুত এসে ছেলেকে আটকান। মারুফ সাহেব সাগরকে টেনে তুলে চেয়ারে বসান। সকলেই পাথর হয়ে গেছে যেনো। উপস্থিত ঘটনা সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অর্পন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হঠাৎ খেয়াল করে ফ্লোরে একটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে। সাগরের পকেট থেকে পড়ে গেছে হয়তো। কাগজটা তুলে ভাজ খুলে মেলে ধরে অর্পন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাঁকা লাইনে লেখা কিছু বাক্য,
অফিসার,
আমি জানি না আমার ভাগ্যে কি আছে। আমি এটাও জানি না আজ আমার শেষ পরিণতি কি হবে। যদি আজ আমি জিতে যাই তাহলে আপনার সাথে আমার সুন্দর একটা জীবনের সূচনা হবে। যেখানে থাকবে না কোনো অক্ষমতা। থাকবে না কোনো আক্ষেপ। থাকবে না কোনো অন্ধকার। একটা সুস্থ, সুন্দর, রঙিন জীবন হবে আমাদের। কিন্তু আজ যদি আমি হেরে যাই, তাহলে সারাজীবনের জন্য আপনার থেকে দূরে চলে যাবো। এতোটা দূরে যে চাইলেও আর ফিরে আসতে পারবো না। আমাদের সুখের সংসারের স্বপ্ন অসমাপ্তই থেকে যাবে। আমি জানি এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। এতে এলোমেলো হয়ে যেতে পারে আমাদের দু’জনেরই জীবন। কিন্তু কি করবো বলুন? আপনাকে দেখার ইচ্ছা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। এই সাধ না মেটা পর্যন্ত আমি যে কাঙালের মতো বসে থাকবো। তাই ঝুঁকিটা নিতেই হলো। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে চোখ মেলে প্রথমে আপনাকেই দেখতে চাই। আপনি থাকবেন তো আমার অপেক্ষায়?
আপনার প্রাপ্তি!
কাগজটা বুকে জড়িয়ে বসে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে অর্পন। একদম ছোট বাচ্চার মতো করে কাঁদতে থাকে। অসহায় ব্যথিত হৃদয় থেকে শুধু অস্পষ্ট ব্যথাযুক্ত আওয়াজ বের হয়। কোনো অর্থপূর্ণ বাক্য বের হয় না। সকলে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। হতভম্ব হয়ে গেছে যেনো সবাই।
———–
টানা তিন ঘন্টা সময় ধরে অপারেশন চলছে। এখনও কেউ অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়নি। অঙ্কন ভেতরেই আছে। হসপিটালের বারান্দায় রাখা সারি সারি চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে অর্পন। একদম অনুভুতিহীন পাথরের মতো।
ভয় বাড়ে সাগরের। তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এখনও কেউ বের হচ্ছে না কেনো? কোনো সমস্যা হয়নি তো? প্রাপ্তির কথা শুনে কি ভুল করে ফেললো সাগর? এই ভুলের মাশুল কি অর্পনকে দিতে হবে সারাজীবন?
—“কার অনুমতি নিয়েছিলে ভাই? আমার স্ত্রীর অপারেশন করাতে আমার অনুমতি অনিবার্য। তাহলে কে দিলো অনুমতি?”
সাগরের ভাবনার ছেদ ঘটে অর্পনের অসহায় কন্ঠ শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অর্পনের দিকে। অর্পনের চোখে একরাশ ভয় জড়ানো। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়। অপরাধ জাগে সাগরের মনে। মাথা নিচু করে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
—“তোর সিগনেচার নকল করেছিলাম। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।”
তাচ্ছিল্য হাসে অর্পন। বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস। এরই মাঝে অপারেশন থিয়েটারের লাইট বন্ধ হয়ে যায়। দুরুদুরু মন নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অর্পন। সকালের উৎসুক চাহনি দরজার দিকে। সবার আগে বেরিয়ে আসে অঙ্কন। তার চেহারা ক্লান্ত।
অঙ্কনকে দেখেই তড়িৎ গতিতে ঝাপিয়ে পড়ে অর্পন। দুই হাতে বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,
—“প্রাপ্তি কেমন আছে অঙ্কন? ও ঠিক আছে তো? কোনো সমস্যা হয়নি তো? যদি ওর দৃষ্টি শক্তি ফিরে না আসে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমার ওকে সুস্থ অবস্থায় চাই। ও ভালো আছে তো?”
চরম মাত্রায় ঝাঁকুনি খেয়েও হেসে ফেলে অঙ্কন। হাসতে হাসতে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। অঙ্কনের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে চমকে ওঠে অর্পন। হাসি আর কান্না একসাথে কেনো? কোনো মানেই বুঝতে পারছে না কেউ। অর্পন ভয়ার্ত গলায় বলে,
—“পাগলের মতো একসাথে হাসছিস, আবার কাঁদছিস কেনো? তবে কি…….?”
মুহুর্তেই অর্পনকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে অঙ্কন। চোখে পানি নিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
—“অপারেশন সাকসেসফুল ভাই। ভাবি একদম ঠিক আছে। সে এখন সুস্থ হয়ে যাবে ভাই।”
অর্পনের চোখ থেকেও অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে। উপস্থিত সকলের একই অবস্থা। এটা দুঃখের অশ্রু নয়। সুখের অশ্রু।
—————————
চব্বিশ ঘণ্টা পর প্রাপ্তির চোখের ব্যন্ডেজ খোলা হয়। ব্যন্ডেজ খুলে দিচ্ছে সাগর। সাথে সাহায্য করছে অঙ্কন। সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছাড়িয়ে ফেলে সাগর। শেষ পর্যায়ে চোখের ওপর রাখা তুলো দুটো আলতো হাতে সরিয়ে দেয়। উন্মুক্ত হয় প্রাপ্তির বন্ধ চোখ জোড়া। সাগর নমনীয় কন্ঠে বলে,
—“আস্তে আস্তে চোখ খোলো প্রাপ্তি।”
প্রাপ্তি চোখ খোলে না। বরং চোখের পাতা বন্ধ রেখেই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে কাউকে খুঁজতে থাকে। বুঝতে পেরে হাতটা আলতো করে নিজের হাতে পুরে নেয় অর্পন। মুচকি হাসে প্রাপ্তি। ধীরে ধীরে চোখের কপাট খোলে। প্রথমে সামনে সব ঝাপসা দেখতে পায়। তবে আগের মতো অন্ধকার ভাব নেই। আস্তে আস্তে ঝাপসা দৃশ্য স্পষ্ট হতে থাকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অর্পনের সুদর্শন মুখ। টলমল চোখে ক্লান্ত চাহিনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে তার ব্যথাতুর হাসি।
অর্পনের মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে প্রাপ্তি। দৃষ্টি সরেনা অন্য কোনো দিকে। সাগর কিছু একটা ইশারা করতেই সকালে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
সেদিকে খেয়াল নেই প্রাপ্তির। সে মন প্রাণ ভরে দেখতে থাকে অর্পনকে। এই মুখটা দেখার জন্যই তো তার এতো ত্যাগ স্বীকার। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় অর্পনের ক্লান্ত বিষন্ন মুখ। ঠিক একই অনুভূতি। যা এতোদিন অর্পনকে ছুয়ে দিলে অনুভব হতো। খুশিতে কান্না করে ফেলে প্রাপ্তি। দুই হাত মেলে দিয়ে বলে,
—“একবার জড়িয়ে ধরবেন অফিসার? আমার বুকে খুব ব্যথা করছে।”
সময় ব্যায় করে না অর্পন। সাথে সাথে প্রাপ্তিকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। পাগলের মতো চুমু খায় প্রাপ্তির পুরো মুখ জুড়ে। অর্পনের বুকের উথালপাতাল হৃৎস্পন্দনের গতি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে প্রাপ্তি। কান্না করতে করতে হেঁসে ফেলে সে। অর্পনকে টেনে সামনে এসে দুই হাত দিয়ে মুখ আগলে ধরে। কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দেয়। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে প্রাপ্তি বলে,
—“এতোদিন আমার মনে অনেক আফসোস ছিলো অফিসার। আপনাকে দেখতে না পারার আফসোস। মনে ভরপুর আক্ষেপ ছিলো। আপনাকে দেখতে চাওয়ার আক্ষেপ। আপনাকে ভালোবাসি কি না যখন দাদু জিজ্ঞেস করে, তখন আফসোস করে বলেছিলাম “তারে আমি চোখে দেখিনি” দাদু। ভালোবাসি কি না কিভাবে বুঝবো? আজ বলছি। ভালোবাসি অফিসার। এই আমি আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি।”
মুহুর্তেই প্রাপ্তিকে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয় অর্পন। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জাপ্টে ধরে। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। চাপে ব্যথা লাগলেও কিছু বলে না প্রাপ্তি। নিজের কোমল দুই হাতে সেও অর্পনকে আঁকড়ে ধরে। খুশিতে আকুল ভরা কন্ঠে বলে,
—“দেখেছো হে পৃথিবীর! তারে আমি চোখে দেখেছি। এই নিজের চোখে দেখেছি। তোমাকে সাক্ষী রাখলাম। আমার না দেখা প্রেমের সাক্ষী। মনে রাখবে তো?”
ভালোবাসার জন্য চোখে দেখা অনিবার্য নয়। চোখে না দেখেও ভালোবাসা যায়। তার জন্য দরকার সুন্দর একটা মন, আর সেই মনে প্রেম নামক অনুভূতি। যা প্রাপ্তি প্রমান করে দিয়েছে। ভালোবাসা সুন্দর। অত্যন্ত সুন্দর!
সমাপ্ত!