#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ০৬
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
দুই হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছে সুপ্তি। একরাশ বিরক্তি এসে ভর করেছে তার চোখে মুখে। চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তিকর কন্ঠে সুপ্তি বলে,
—“এই শুনুন! আপনার সাথে বকবক করে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমি এখানে আমার আপির খোঁজে এসেছি। যদি আপনি এখানকার ডক্টর হয়েই থাকেন তাহলে আমার আপিকে খুঁজতে সাহায্য করুন। একজন ডক্টর হিসেবে এটা তো আপনার কর্তব্য তাই না।”
অঙ্কনের ডান হাতে ফাইল, বাম হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার সামনে দাড়ানো সুপ্তির দিকে। সুপ্তির কথা শেষ হতেই ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে অঙ্কন বলে,
—“নাম কি তোমার আপির?”
—“প্রাপ্তি! প্রাপ্তি বিনতে রহমান।”
প্রাপ্তি নামটা শুনতেই ভ্রু কুঁচকে যায় অঙ্কনের। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সুপ্তির দিকে। কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলে,
—“আমার সাথে এসো।”
বলেই উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে অঙ্কন। সুপ্তিও কথা না বাড়িয়ে অঙ্কনের পেছন পেছন ছোটে। দোতলায় এসেই সুপ্তির নজরে পড়ে অর্পন। দিক বেদিক ভূলে দৌড়ে সামনে চলে যায় সুপ্তি। এদিকে সুপ্তিকে এভাবে হঠাৎ দৌড়াতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অঙ্কন। পা জোড়া থেমে যায় সেখানেই। ভ্রু কুঁচকে দেখতে থাকে সুপ্তিকে।
সুপ্তি দৌড়ে সোজা অর্পন সামনে এসে দাড়ায়। ডান হাতে চশমা ঠেলে ঠিক করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
—“আমার আপি কোথায় স্যার? কি হয়েছে আপির?”
অর্পন কেবিনের সামনে চেয়ারে বসে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো। এমন সময় সুপ্তিকে এভাবে এসে হাঁপাতে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ফোনটা কেটে পকেটে রেখে বলে,
—“শান্ত হও! কিছু হয়নি তোমার বোনের।”
—“কিছু না হলে তাকে হসপিটালে কেনো এনেছেন?”
—“কিছু হয়নি বলতে গুরুতর কিছু হয়নি। ডক্টর দেখছে, ডোন্ট ওয়ারি।”
সুপ্তির ছটফটানি কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো। কিছুতেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারছে না। কান্নারা গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আছে। অস্বস্তিতে হাসফাস করতে থাকে সুপ্তি। এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় সজীব। সুপ্তিকে দেখে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসে। সুপ্তির হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ব্যাস্ত কন্ঠে বলে,
—“প্রাপ্তি কোথায় ছুটকি?”
সজীবকে দেখে যেনো স্বস্তি ফিরে পায় সুপ্তি। ভরসা যোগ্য মানুষকে কাছে পেয়ে এবার যেনো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সজীবকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সুপ্তি। কান্নার জোরে কথাই মুখ থেকে বের হচ্ছে না। সজীব অসহায়ের মতো সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিবে সেটাই বুঝতে পারছে না। এলোমেলো দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে প্রাপ্তিকে খুজতে থাকে। সজীবের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে অর্পন বলে,
—“মিস প্রাপ্তি আপনার সামনের কেবিনে আছে। আর চিন্তা করবেন না তেমন গুরুতর কিছু হয়নি। ডক্টর ট্রিটমেন্ট করছে তার।”
অর্পনের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সজীব। প্রশ্নবোধক কন্ঠে বলে,
—“আপনি কে?”
—“এস আই মাহবুব অর্পন খান। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। আর প্রাপ্তিকে আমিই হসপিটালে নিয়ে এসেছি।”
অর্পনের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা কন্ঠে সজীব বলে,
—“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ অফিসার। আপনি জানেন না আপনি আমার কত বড় উপকার করলেন। প্রাপ্তির কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না।”
সজীবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে অর্পন। প্রাপ্তির প্রতি সজীবের এতো ভালোবাসা কোনো কারণে সে মানতে পারছে না। নিজের ভাবনা দেখে নিজেই অবাক অর্পন। সজীবকে সে কেনো সয্য করতে পারছে না। নিজেই মনে মনে বলে, “আমি কি কোনো কারণে জেলাস ফিল করছি? কিন্তু কেনো?” এই কেনোর কোনো উত্তর জানা নেই অর্পনের। মন শুধু এটাই বলছে, সজীব প্রাপ্তির কাছের কেউ না হোক। প্রাপ্তির ভালোবাসার ভাগ যেনো অন্য কেউ না পায়। দম আটকে আসছে অর্পনের। প্রাপ্তির প্রতি সজীবের এতো কেয়ার দেখে মন বলছে প্রাপ্তি সজীবের বিশেষ কেউ। কিন্তু কি সম্পর্ক দুজনের? অর্পন কিভাবে জানবে যে এই ছেলেটা প্রাপ্তির কি হয়? সুপ্তিকে জিজ্ঞেস করবে কি? কিন্তু জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে? নাহ্ সেটা ভালো দেখায় না। এমন শক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষের এমন ছেলেমানুষী সাজে না। নিজের মনের সাথে ঠিক বেঠিকের যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অর্পন।
অর্পনের ভাবনার মাঝেই খট করে কেবিনের দড়জা খুলে যায়। ডক্টর যে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে সেটা বুঝতে আর কারো বাকি নেই।
—“চল ছুটকি!”
এটুকু বলেই তড়িঘড়ি করে কেবিনের ভেতরে চলে যায় সজীব। সজীবের পেছন পেছন সুপ্তিও ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কিন্তু অর্পনের কথায় থেমে যায়। অর্পন সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“সুপ্তি এক মিনিট দাঁড়াও!”
—“জ্বি।”
একটা শুকনো কাশি দিয়ে পকেটে হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়ায় অর্পন। নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগছে প্রশ্নটা করতে। কন্ঠ নিচে নামিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে অর্পন বলে,
—“আচ্ছা, এই ছেলেটা কে?”
—“আমার দাদাভাই।”
একটু এগিয়ে আসে অর্পন। আবারো ছোট্ট করে একটা কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নেয়। তারপর ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
—“আর, মিস প্রাপ্তির কি হন উনি?”
ভ্রু কুঁচকে যায় সুপ্তির। অর্পনের কথা সুপ্তির কাছে বেমানান লাগছে। একজন পুলিশ অফিসার এমন আবোল তাবোল কথা বলতে পারে সেটা সুপ্তির জানা ছিলো না। ভ্রু কুঁচকে রেখে সুপ্তি জিজ্ঞেস করে,
—“মানে?”
—“মানে, তোমার সম্পর্কে দাদাভাই হয়। কিন্তু মিস প্রাপ্তির কি হয়?”
—“মাথায় সমস্যা আছে নাকি আপনার? কি বলছেন এসব?”
অর্পন ইতস্তত করে বলে,
—“কেনো?”
—“কারণ সে আমার দাদাভাই হলে আপিরও দাদাভাই হবে। তাই নয় কি?”
সুপ্তির কথা শুনে অপ্রুস্তুত হাসে অর্পন। ডান হাত মাথার পেছনে নিয়ে মাথা চুলকে বিড়বিড় করে বলে, “আসলেই তো, এসব কি বলছি আমি!”
অঙ্কন পেছনে দাড়িয়ে চুপচাপ সবকিছু দেখে যাচ্ছে। তার ভাইয়ের আচরণ অঙ্কনের কাছে ঠিক সুবিধার লাগছে না। কিছু একটা রহস্য তো আছেই। অঙ্কন জহুরি নজরে তাকিয়ে নিজের ভাইয়ের মন বোঝার চেষ্টা করছে। এদিকে সুপ্তি অর্পনকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত বোধ করছে। বোনকে দেখার জন্য মনের ভেতর আকুপাকু করছে। শেষে অধৈর্য হয়ে বলে,
—“স্যার আমি ভেতরে যাবো?”
সুপ্তির আওয়াজ শুনে দুই ভাইয়ের ভাবনার ছেদ ঘটে। নড়েচড়ে দাড়িয়ে অর্পন বলে,
—“হুম চলো।”
অর্পনের অনুমতি পেতেই দৌড়ে ভেতরে চলে যায় সুপ্তি। পেছন পেছন ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অর্পন আর অঙ্কন। রুমের ভেতরে ঢুকে সুপ্তির নজর যায় প্রাপ্তির দিকে। হসপিটালের ছোট্ট বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে প্রাপ্তি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ করা। বোনের এমন ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে চোখ দুটো ছলছল করছে সুপ্তির। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় প্রাপ্তির কাছে। কাছে বসে বোনের হাত ধরে পাশে তাকাতেই ডক্টরকে দেখে থমকে যায় সুপ্তি। চোখ দুটো স্থীর হয়ে যায় অপর পাশে দাড়ানো ডক্টরকে দেখে। এটা কি সত্যি, নাকি চোখের ভূল! সুপ্তি কি ঠিক দেখছে? ভাবনায় পড়ে যায় সুপ্তি।
ডক্টর হাতের ফাইলটা রেখে সামনে তাকায়। সজীবের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—“আপনি পেসেন্টের কি হন?”
—“আমি সজীব মাহমুদ। প্রাপ্তির দাদাভাই। কি হয়েছে প্রাপ্তির? চিন্তার কিছু নেই তো ডক্টর?”
পকেটে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ডক্টর সাগর। কন্ঠে যথেষ্ট গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলে,
—“তেমন গুরুতর কিছু হয়নি। শরীরের কিছু জায়গায় আঘাত পেয়েছে শুধু। হাটুর আঘাতটা একটু বেশি তাই কয়েকদিন সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। আর ওষুধগুলো সময় মতো নিলেই কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।”
ডক্টরের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সজীব। প্রাপ্তির চিন্তায় দম যেনো আটকে ছিলো। এখন প্রশান্তি লাগছে। প্রাপ্তির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“অসংখ্য ধন্যবাদ ডক্টর। আমার মাথা থেকে অনেক বড় চিন্তার পাহাড় নামিয়ে দিলেন। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।”
—“এটা আমার ডিউটি। ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই। ওনার দিকে একটু বেশি খেয়াল রাখবেন। তাছাড়া পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হলে আমাকে একবার ইনফর্ম করে দেবেন।”
—“জ্বি ডক্টর। বাই দা ওয়ে, আপনার নাম?”
—“ডক্টর সাগর এহসান।”
ডক্টরের নাম শুনে এবার থমকে যায় প্রাপ্তিও। স্থীর হয়ে যায় পুরো শরীর। সে কি ঠিক শুনেছে? সাগর এহসান নামটা কানে বারে বারে প্রতিফলিত হচ্ছে প্রাপ্তির। সুপ্তির ধরে রাখা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে প্রাপ্তি। বোনের অবস্থা বুঝতে পেরে প্রাপ্তির হাতের ওপর নিজের দুই হাতই রাখে সুপ্তি। হাত চেপে ধরে ইশারায় কিছু একটা বোঝায়। বোনের ইশারা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যায় প্রাপ্তি। বিনা বাক্য ব্যায় করে চুপচাপ বসে থাকে।
পেছন থেকে অর্পন এগিয়ে এসে সাগরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“প্রাপ্তির সাথে কি আমি কথা বলতে পারি?”
অর্পনের কথা শুনে ঘুরে তাকায় সাগর। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই অর্পন এগিয়ে আসে। অর্পনকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় সুপ্তি। অর্পনকে বসার জায়গা করে দিয়ে প্রাপ্তির মাথার কাছে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। অর্পন প্রাপ্তির পাশে রাখা ছোট্ট টুলে বসে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় প্রাপ্তির দিকে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
—“এখন কেমন ফিল করছেন মিস প্রাপ্তি?”
—“আগের থেকে অনেকটা ভালো, অফিসার।”
—“তাহলে এখন বলুন, কে বা কারা আপনাকে কি*ড*ন্যা*প করতে চাইছিলো? আপনি কি তাদের চেনেন?”
—“না! তাদের কাউকে আমি চিনি না। এমনকি আমাকে কি*ড*ন্যা*প করতে কেনো চাইছিলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
অর্পন আর প্রাপ্তির কথা শুনে চমকে ওঠে সজীব। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
—“এসব কি বলছিস প্রাপ্তি? কি*ড*ন্যা*প মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। সজীবের এতো ছটফটানি অর্পনের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। হাত দিয়ে সজীবকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“আপনার যত প্রশ্ন আছে সব বাসায় গিয়ে করবেন। মাঝখানে কথা না বললে খুশি হবো। আপনার বোনের সাথে কথা বলে আমাকে আবার থানায় যেতে হবে। অনেক সময় ধরে এখানে দাড়িয়ে আছি ভি*ক্টি*মে*র সাথে কথা বলার জন্য। আশা করি বুঝতে পারছেন।”
অর্পনের কথা শুনে থেমে যায় সজীব। বাড়তি আর কোনো কথা বাড়ায় না। সজীব চুপ হয়ে যেতেই অর্পন প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
—“আপনার কি কারো সাথে কোনো ঝামেলা আছে? বা কারো সাথে কোনো শত্রুতা?
—“না অফিসার। কারো সাথে কোনো ঝামেলা নেই আমার। আমি কখনো কারো কোনো ক্ষতি করিনি, তাহলে আমার শত্রু আসবে কোথা থেকে?”
—“মনে করার চেষ্টা করুন। হতে পারে নিজের অজান্তেই কারো সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন। কোনো পুরনো শত্রুও হতে পারে।”
কিছুক্ষণ ভাবে প্রাপ্তি। তারপর অধৈর্য হয়ে উত্তর দেয়,
—“আমার এমন কারো কথা মনে পড়ছে না অফিসার।”
ভাবনায় পড়ে যায় অর্পন। চোখ বন্ধ করে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করতে করতে সবকিছু মাথায় নতুন করে সাজাতে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খোলে। প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে বলে,
—“শুনুন মিস প্রাপ্তি। আমি যেটা আন্দাজ করছি সেটা যদি সঠিক হয় তাহলে আপনার প্রাণের সং*শ*য় আছে। হতে পারে এরা সেই লোক যারা ইভা নামের মেয়েটাকে খু*ন করেছে। যেহেতু আপনি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাই ওরা ভাবছে আপনি ওদের দেখে ফেলেছেন। তাই ওরা আপনার পেছনে পড়েছে। আমার ধারণা হয়তো ওরা জানে না যে আপনি চোখে দেখতে পান না। সেজন্য আপনাকে রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার বিপদ ঠিক কতটা? অনেক সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে।”
অর্পন আর প্রাপ্তির কথার মাঝে সবাই নির্বিকার। মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে সবাই সবকিছু। তবে এখানে উপস্থিত সবাই স্বাভাবিক থাকলেও একজন ব্যক্তি স্বাভাবিক নেই। এই এসি রুমে দাড়িয়েও কুলকুল করে ঘামছে সুপ্তি। চোখে মুখে তার ভয়ের আভাস। থেকে থেকে শুকনো ঢোক গিলছে। তবে সুপ্তিকে অন্য কেউ খেয়াল না করলেও অঙ্কন ঠিকই খেয়াল করেছে। এই ঠান্ডা রুমে সুপ্তির ঘামের কোনো লজিক অঙ্কন খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ করে মাথায় এলো, “মেয়েটা কি অসুস্থ?” কথাটা মাথায় আসতেই কাল বিলম্ব না করে এগিয়ে আসে অঙ্কন। সুপ্তির থেকে দুই হাত দূরে দাঁড়িয়ে চিন্তিত স্বরে বলে,
—“হেই চাশমিশ! আর ইউ ওকে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোমার?”
হঠাৎ করে পাশ থেকে কারো কথা শুনে চমকে ওঠে সুপ্তি। আতঙ্কিত চোখে একবার তাকায় অঙ্কনের দিকে। তারপর চারিদিকে তাকাতেই দেখে সবাই সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। সবার দৃষ্টি নিজের দিকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সুপ্তি। এদিকে প্রাপ্তির ভ্রু কুঁচকে যায়। চিন্তিত স্বরে বলে,
—“কে কথা বললো এই মাত্র? আর কার কি হয়েছে? সুপ্তি, ঠিক আছিস তুই?”
বোনের চিন্তিত মুখ দেখে পাশে বসে হাতে হাত রাখে সুপ্তি। অভয় দিয়ে বলে,
—“আমি ঠিক আছি আপি। এখানে আসার সময় অনেক দৌড়েছি তাই একটু ক্লান্ত লাগছে। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।”
সজীব এগিয়ে এসে সুপ্তির কপালে হাত রেখে জ্বর চেক করে। বোন আর দাদাভাইয়ের কেয়ার দেখে হেসে ফেলে সুপ্তি। সজীবের হাত ধরে বলে,
—“আমি ঠিক আছি দাদাভাই। তুমি এটা বলো, আপিকে বাসায় নিয়ে যাবে কখন?”
সুপ্তির কথা শুনে সজীব ঘুরে তাকায় সাগরের দিকে। জিজ্ঞাসা কন্ঠে বলে,
—“ডক্টর, আমার বোনকে কি বাসায় নিয়ে যেতে পারি? এখানে থাকার চেয়ে বাসায় ওর বেশি টেক কেয়ার হবে। তাছাড়া বাবা, মা, দাদু কেউই এখনো কিছু জানে না। আমি তাদের কিছু জানাতেও চাইছি না। প্রাপ্তিকে বাসায় নিয়ে গিয়ে তারপর জানাবো।”
—“জ্বি নিয়ে যেতে পারেন কোনো সমস্যা নেই।”
সাগরের সম্মতি পেয়ে সজীব বলে,
—“তাহলে আমি সব ফর্মালিটি পূরণ করে তারপর আসছি। ছুটকি, তুই প্রাপ্তির কাছেই থাকিস।”
কথাগুলো বলেই সজীব বাহিরে চলে যায়। অর্পন এখনো বসে আছে প্রাপ্তির পাশে। নজর তার প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তির শরীরে এতো আঘাত দেখে অর্পনের বুকে বড্ড ব্যথা করছে। কে জানে মেয়েটা কি জাদু করেছে যার জন্য অর্পন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি প্রাপ্তির দিকে রেখেই অর্পন ধীর কন্ঠে বলে,
—“নিজের খেয়াল রাখবেন মিস প্রাপ্তি। আর, কখনো কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।”
অর্পনের কন্ঠ শুনে নড়েচড়ে বসে প্রাপ্তি। ইতস্তত কন্ঠে বলে,
—“আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ। যতটুকু আন্দাজ করতে পারছি তাতে মনে হয় আপনি বয়সে আমার বড় হবেন। তাই আপনি ডাকটা বেমানান লাগছে। আমাকে তুমি করে সম্বোধন করলে বেশি খুশি হবো।”
মাথা নিচু করে ফেলে অর্পন। ঠোটের কোণে তার মৃদু হাসি। তবে হাসিটা সবার দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখা। মুখের ভঙ্গি আবার স্বাভাবিক করে মাথা তুলে তাকায় অর্পন। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
—“অনুমতি দিচ্ছো?”
—“জ্বি, দিলাম।”
—“বেশ! গ্রহণ করলাম।”
চলবে?