তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-৪৫+৪৬

0
1980

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৫

ইমা আমতা আমতা করে বললো, কী কথা বলুন ?

আরমান আশেপাশে তাকিয়ে বললো, এখানে না সামনের কফিশপে বসে বলি।

ইমা রিকুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কী করবে। রিকু একটু চিন্তা করে যাওয়ার ইশারা করলো।

ঠিক আছে ইমা তুই তাহলে যা, আমিও বাসায় যাচ্ছি ফোনে কথা হবে।

ইমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালে রিকু একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো। আরমান আগে আগে গেলো আর ইমা তার পিছনে গিয়ে সামনের কফিশপে ঢুকলো। একদম কর্ণারের একটা টেবিলে চলে গেলো আরমান। ইমাকে বসার জন্য চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

আরমান ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, কী খাবি বল ?

ইমা দৃষ্টি নিচে রেখে বললো, আমি কিছু খাবো না। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন আমাকে বাসায় যেতে হবে। উনি জানতে পারলে রাগ করবেন।

ইমার কথা শুনে আরমান মাথা নিচু করে মুচকি হাঁসলো আর হাসিটা বজায় রেখে বললো, ইমা ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকাটা জরুরি।

ইমা কিছু বললো না আরমান একটু থেমে বললো, তুই ভালো আছিস তো ?

ইমা এবার চোখ তুলে তাকালো আরমানের দিকে আর চোখে চোখ রেখে বললো, যতটা খারাপ দেখতে চেয়েছিলেন তার থেকে হাজার কোটি গুণ ভালো আছি ভাইয়া।

আরমান মুখটা মলিন করে বললো, আমি তোকে খারাপ থাকতে দেখতে চাইনি রে কখনো।

ইমা এবার কঠিন গলায় বললো, তার জন্যই বুঝি আমার জীবনটা তিক্ত করে তুলেছিলেন ?

আরমান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, যা করেছিলাম তার শাস্তি এখন প্রতিটা মুহূর্তে পাচ্ছি।

ইমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো আরমানের কথা শুনে আর বললো, আপনি আজ যেসব বলছেন না ? একে বলে জুতো মেরে গরু দান।

আরমান মাথা নিচু করে বললো, আজ আমি তোর কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি ইমা। আমাকে মাফ করে দে।

এই কথা শোনার পর ইমার চোখ আপনাআপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে গেলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের কানকে। মিস্টার আরমান মাহমুদ তার কাছে মাফ চাইছে ? যে কিনা কখনো তার সাথে ভালো করে দুটো কথা পর্যন্ত বলেনি। ইমা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।

আরমান আবার বললো, আমি জানি তোর সাথে একটা দুটো দিন নয়, বেশ অনেকগুলো বছর আমি অন্যায় করে গেছি দিনের পর দিন। কিন্তু বিশ্বাস কর, তুই যেদিন থেকে ঐ বাড়ি ছেড়ে এসেছিল তারপর একটা রাত আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। প্রত্যেকটা মুহূর্ত অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছি।

ইমা হা করে তাকিয়ে দেখলো আরমানের দিকে। এখন সে যেটা করছে এটা সম্পূর্ণ তার স্বভাবের বাইরে। ইমা কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বুঝতে পারছে না।

আরমান খপ করে টেবিলের উপর রাখা ইমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো আর ধরা গলায় বললো, ইমা আমাকে মাফ করে দে। আমি আর এভাবে বাঁচতে পারছি না। দিনদিন অনুশোচনার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে দিন দিন ।

ইমা হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছে। একবার আরমানের ধরা হাতের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আরমানের চোখের দিকে তাকাচ্ছে। আরমানের চোখ দুটো টলমল করছে পানিতে, এখনই বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। আরমানের চোখের ভাষা বলছে সে মিথ্যা বলছে না। কারণ মানুষের মুখের ভাষা মিথ্যা হলেও চোখের ভাষায় কখনো মিথ্যা হয় না। ইমা এবার এক দৃষ্টিতে তাকালো আরমানের ধরা হাতের দিকে। আরমান সেটা খেয়াল করে ফট করে ইমার হাত ছেড়ে দিলো।

অপরাধীর স্বরে বললো, সরি রে ভুলে গিয়েছিলাম তুই এখন আর আমাদের আগের সেই ইমা নেই। তুই এখন অন্যকারো অধিকার।

ইমা কী বলবে বুঝতে পারছে না। আরমানের এমন আচরণে সে নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

ইমা হঠাৎ বললো, আচ্ছা ভাইয়া আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন ?

আরমান ব্যস্ত গলায় বললো, হ্যাঁ বল।

ইমা আরমানের চোখে চোখ রেখে বললো, আপনার এতো ক্ষোভ কেনো ছিলো আমার প্রতি ? ভার্সিটির সবার সামনে রিজেক্ট করেছিলাম বলে ? আপনি সত্যি করে বলুন তো সেদিন আপনার মনে কোনোরকম অনুভূতি ছিলো আমার জন্য ? আপনাকে ফ্রেন্ডদের সাথে বাজি ধরতে দেখেছিলো আমার ফ্রেন্ড রিকু আর আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলো। আমিও দেখেছিলাম আপনার চোখে, আমার জন্য কোনো অনুভূতি ছিলো না। তাহলে রিজেক্ট করে কী ভুল করেছিলাম বলতে পারেন ?

আরমান মলিন চোখে তাকিয়ে বিষাদময় কণ্ঠে বললো, সেদিনের চোখের ভাষা এতো সহজে বুঝে গিয়েছিলি, তবে আজকের চোখের ভাষা কেনো বুঝলি না ইমা ?

ইমা চমকে উঠলো আরমানের কথা শুনে। কী ছিলো আরমানের ছোট একটা কথায় ইমা জানে না। তবে তার ভেতর নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ইমা তাকালো আরমানের চোখে কিন্তু আরমান চোখ সরিয়ে নিলো।

ইমা কাঁপা গলায় বললো, মানে ?

আরমান নিজের দৃষ্টি আড়াল করেই বললো, ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার মতো কষ্ট হয়তো এই পৃথিবীর সব কষ্টকে হার মানিয়ে দেবে। আমি আর পারছি না তোর চোখে ঘৃণিত অপরাধী হয়ে থাকতে।

ইমার কথা গলায় আঁটকে গেছে। বেশ অনেকটা সময় লাগলো তার, আরমানের কথা বুঝতে। যখন বুঝতে পারলো তখন কথা বলতে ভুলে গেছে৷ ইমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আরমান তাকে ভালোবাসে এটা ইমা কল্পনাও করেনি কোনোদিন। তার জন্যই বুঝি আরমানের চোখের ভাষা আজ বড্ড অচেনা লাগছিলো ইমার কাছে।

আরমান মাথা নিচু করে বললো, সামনের সপ্তাহে আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি। একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে জব হয়েছে আমার। সেটার জন্যই অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি আর কবে দেশে ফিরবো বা আদৌও কোনোদিন ফিরবো কিনা জানি না। তাই শেষবারের মতো তোর কাছে নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি।

ইমা একটার পর একটা শক খাচ্ছে। আরমান চলে যাচ্ছে সেটা শুনে আরও বেশি অবাক হলো। কারণ নিজের দেশকে আরমান খুব ভালোবাসে। স্টুডেন্ট ভালো হওয়ায় স্কলারশিপ পেয়েও যায়নি শুধু নিজের দেশ আর আপন মানুষদের থেকে দূরে যাবে না বলে। সবার সাথে জোশে পরে স্কলারশিপে ট্রাই করেছিলো তবে অনেক জোর করেও তাকে পাঠাতে পারেনি আমিনুল মাহমুদ। সেই আরমান কিনা চিরদিনের জন্য চলে যেতে চাইছে এই দেশ ছেড়ে।

ইমা ভাঙা গলায় বললো, আপনি তো বিদেশ যাওয়া পছন্দ করতেন না।

আরমান তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো, জীবনে পছন্দের জিনিসগুলো একসময় হারিয়ে যায় আর অপছন্দের জিনিসগুলো মাঝে মাঝে প্রিয় হয়ে উঠে। তোর হয়তো লেট হচ্ছে তুই চলে যা। তোর কাছে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হয়তো আমি নই। সারাজীবন তোর চোখে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। তবে বিশ্বাস কর আমি সত্যি অনুতপ্ত।

ইমা চুপ করে কিছুটা সময় বসে রইলো। আরমানও চুপ করে আছে। হঠাৎ একটা জোরা কানের দুল আরমান এগিয়ে দিলো ইমার দিকে। তা দেখে ইমা বিস্ফুরিত চোখে তাকালো আরমানের দিকে। কানের দুল জোড়া চিনতে অসুবিধা হয়নি তার। আজ থেকে প্রায় আরো পাঁচ বছর আগে ইমা আর কথাকে নিয়ে এক বৈশাখী মেলায় গিয়েছিলো আরমান। তখন আরমানের সাথে ইমার কোনো ঝামেলা ছিলো না। সেখানে ইমার পছন্দ হয়েছিলে এই কানের দুল জোড়া। আরমানকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলো কিনে দেওয়ার কিন্তু আরমান তখন বলেছিলো তোর জন্য বাজে খরচ করার টাকা নেই আমার। ইমা মন খারাপ করে আর কিছু বলেনি। আজ পাঁচ বছর পর সেই কানের দুল ইমার সামনে।

আরমান কানের দুল জোড়ার দিকে তাকিয়ে বললো, যদি মাফ করে থাকিস দুল জোড়া নিয়ে চলে যা। আর যদি না করে থাকিস তাহলে একবারের জন্যেও পিছনে ফিরে না তাকিয়ে চলে যা, ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাবি না।

ইমা আরমানের দিকে একবার অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের সামনে রাখা কানের দুল জোড়া হাতে নিয়ে নিঃশব্দে পেছনে ফিরে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সেদিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো আরমান। আরমানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, পানিটুকু মুছে সামনে তাকিয়ে দেখে ইমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আরমানের ভেতরের কান্নাটা দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজের করা কিছু কাজের উত্তর সে নিজেই খুঁজে পায় না। যেমন সেদিন ওদের চোখের আড়ালে দুল জোড়া সে কেনো কিনেছিলো আজও তার উত্তর আরমান পাইনি। আবার যখন কিনেই ছিলো তাহলে ইমাকে না দিয়ে পাঁচ পাঁচটা বছর নিজের কাছে কেনো রেখে দিয়েছিলো। এখন আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতেও চায় না সে। পেলে হয়তো বুকের ভেতরের ক্ষতটা আরো গভীর হবে। আরমান এক কাপ কফি অর্ডার করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

৫১.
তোমার না সামনে এক্সাম এখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে এভাবে ঘুরলে পরিক্ষায় বড় একটা রাজহাঁসের ডিম পাবে তুমি।

কথা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইশানের দিকে। ইশানের কথার মানে বুঝার চেষ্টা করছে সে। ইশান কী তাকে ‘হ য ব র ল’ টাইপের স্টুডেন্ট মনে করে ?

কথা চটে গিয়ে বললো, এই আপনি কী কোনো ভাবেন আমাকে। ‘হ য ব র ল’ টাইপের স্টুডেন্ট মনে করেন নাকি ?

ইশান দুষ্টুমি করে বলে উঠলো, আরে আমি তো জানি তুমি নিউটনেরও নানী।

কথা রেগে ইশানকে মারতে শুরু করলো। বেশ জমে গেছে ইশান আর কথার দুষ্টু মিষ্টি প্রেম।

ইশান আবার দুষ্টুমি করে বললো, আরে খুকি তুমি খেয়ে দেয়ে একটু শক্তি বানিয়ে এসো। তাহলে বুঝতে পারবো তুমি আমাকে মারছো নাকি কাতুকুতু দিচ্ছো।

কথা এবার দিগুণ রেগে বললো, এই এই আমাকে আপনার কোনদিক থেকে খুকি মনে হয় ?

ইশান কথার দিকে বিজ্ঞের মতো তাকিয়ে বললো, তোমার বয়স কত এখন ?

কথা বেশ অ্যাটিটিউড নিয়ে বললো, ১৭ বছর ৭ মাস ১৩ দিন।

ইশান অট্টহাসি দিয়ে বললো, এখনো ১৮ বছর হয়নি সে নাকি আবার খুকি না।

কথা রেগে ইশানের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বললো, ঠিক আছে আমি তো খুকি। আপনি বড় বড় মেয়ে খুঁজে তাদের সাথে প্রেম করুন।

ইশান উঠে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আরে আমি তো একটু মজা করছিলাম। আমার কোনো বড় মেয়ে দরকার নেই। আমার কাছে এই খুকি হাজার গুন ভালো।

আপনি এখনই,,,,,

এই ইয়ার, মেয়েটাকে দেখ কতো কালো আর বয়ফেন্ডটাকে দেখ একদম হলিউড হিরো। কী পছন্দ রে ভাই ?এই ছেলে এই মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করলো, আনবিলিভ্যাবল।

ঠিক বলেছিস, কী কালার রে ইয়ার ?

কথা কিছু বলবে তার আগেই পাশের একটা পাঁচ জনের মেয়ে গ্রুপ থেকে বলা এই কথাগুলো দুজনের কানে এলো। কথা ইশানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চলে আসতে গেলে ইশান হাত টেনে ধরে। কথা তাকিয়ে দেখে এতোক্ষণ দুষ্টুমি করা হাসিখুশি মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। ইশান কথার হাত ধরে মেয়েগুলোর সামনে নিয়ে গেলো।

ইশান রেগে বললো, কী বললেন আপনি,,,,,

কথা ইশানকে চুপ করতে বলে কথা বলে উঠলো, কী কালার আমার ? আফ্রিকার এক পিচ্চির লেখা একটা কবিতা আছে। ২০০৫ এর শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে নমিনেট করা হয়েছিলো। কবিতাটা সম্পর্কে আপনারা কেউ জানেন ?

কবিতার নাম
কালার (Color)

যখন আমি জন্ম নিলাম, আমি কালো
যখন আমি বেড়ে উঠলাম, আমি কালো।
যখন আমি সূর্যের তাপে অবস্থান করি,
আমি কালো; যখন আমি অসুস্থ, আমি কালো।
যখন আমি মৃত, আমি কালো।
আর তুমি সাদা সহচর,
যখন জন্ম নাও, তুমি গোলাপি।
যখন বেড়ে উঠ, তুমি সাদা।
যখন তুমি সূর্যের তাপে অবস্থান করো, তুমি লাল।
যখন তুমি শীতল আবহাওয়া তে থাকো, তুমি নীল।
যখন তুমি ভীত, তুমি হলুদ।
যখন তুমি অসুস্থ, তুমি সবুজ।
আর যখন তুমি মৃত, তুমি ধূসর।
আর তুমি কিনা আমাকে বল কালারড। (Colored)

এই কবিতাটার মানে যেদিন বুঝতে পারবেন সেদিন আমার মতো কাউকে কালারড বলার আগে নিজেই লজ্জা পাবেন।

কথাগুলো বলে ইশানের হাত ধরে সেখান থেকে চলে এলো কথা। ইশান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কথার দিকে।

কথা সেটা খেয়াল করে বললো, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো ? আর দশটা কালো মেয়ের মতো আমি নিজের অপমান মুখ বুজে সহ্য করি না। মুখের উপর বরাবর জবাব দিতে জানি। প্রথমে মনে হয়েছিলো আপনি লজ্জা পাবেন, তাদের আমাকে নিয়ে মজা করা দেখে। কিন্তু যখন বুঝলাম আপনি আমার সাথে আছেন আর তখন নিজের আসল রুপে ফিরে এলাম।

ইশান মুচকি হেঁসে বললো, আজ আবার তোমার প্রেমে পড়লাম নতুন করে।

কথা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আর ইশান জিজ্ঞেস করলো, এই কবিতাটা কোথা থেকে জানলে ?

কথা একটু চিন্তা করে বললো, কোথায় যেনো পড়েছিলাম এখন মনে নেই।

ইশান ওহ্ বলে কথার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো আর কথা মুগ্ধ হয়ে ইশানকে দেখছে। সত্যি ইশান কোনো হলিউড হিরোর থেকে কম যায় না।

কথা মনে মনে বললো, সত্যি আপনার সাথে আমাকে মানায় না।

ইশান কথাকে অবাক করে দিয়ে বললো, বাজে চিন্তা মাথায় আনলে মাথা কেটে সব বের করে ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দিবো বলে দিলাম।

কথা ইশানের বাহুতে ছোট একটা থাপ্পড় দিয়ে সামনের তাকালো।

৫২.
ইমা একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসলো। কফিশপের কাঁচের দেয়ালের ওপারে এখনো দেখা যাচ্ছে আরমানকে। যতক্ষণ দেখা গেলো ততক্ষণ ইমা সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। ইমার কিশোরী মন প্রথম ভালো লাগার মানে বুঝেছিলো আরমানকে দিয়ে। কিন্তু সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নেওয়ার আগেই আরমান নিজের হাতে তা ঘৃণার রুপ দিয়েছে। আজ কেনো জানি ইমার কষ্ট হচ্ছে, চাপা কষ্ট যার মানে ইমা নিজেই বুঝতে পারছে না। আরমানকে সে কতটা মাফ করতে পেরেছে সেটাও বুঝতে পারছে না। ট্যাক্সি ড্রাইভারের ডাকে ঘোর কাটে ইমার।

ম্যাম চলে এসেছি নামুন।

ইমা হকচকিয়ে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইমা দ্রুত নেমে এলো ট্যাক্সি থেকে। ভাড়া মিটিয়ে গেইটের ভেতরে যেতেই ইয়াদের গাড়ি থেকে চমকে গেলো। ইয়াদ তো এই সময় বাসায় আসার কথা নয় আজ, তাহলে ? ইমা চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে গিয়ে কলিংবেল বাজালে সার্ভেন্ট দরজা খোলে দিলো।

আপনার স্যার এসেছে ?

জী ম্যাম, তবে দেখে কেমন গম্ভীর মনে হলো আজ।

ঠিক আছে আপনি নিজের কাজ করুন।

সার্ভেন্ট ওকে ম্যাম বলে নিজের কাজে চলে গেলো। ইমা ভাবছে ইয়াদের আবার হঠাৎ কী হলো ? ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। একটা একটা সিড়ি উঠছে আর অজানা কারণে ইমার ভয় বাড়ছে। দরজার সামনে এসে একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খোলে গেলো। ইয়াদ অফিসের পোশাকে বেডের উপর শুয়ে আছে কপালে হাত রেখে। ইমা হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে ইয়াদের কাছে গিয়ে বসে মাথার চুলে হাত রাখলো। ইয়াদ কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে ইমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো।

ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আপনি এই সময়ে বাসায় কেনো ? শরীর খারাপ লাগছে আপনার ?

ইয়াদ আবার চোখ বন্ধ করে বললো, এক্সাম শেষ হয়েছে সেই কখন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে ?

ইমা থতমত খেয়ে বললো, আপনাকে তো বলেছিলাম রিকুর সাথে আজ অনেকটা সময় আড্ডা দিয়ে তারপর আসবো।

ইয়াদ আগের মতোই শান্ত গলায় বললো, কফিশপে তোমার সামনে যে ছিলো তাকে দেখে কোনো দিক থেকে আমার কাছে রিকু মনে হয়নি।

কথাটা শেষ করে গম্ভীর চোখে তাকালো ইমার দিকে। ইমা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইয়াদের কাজে মন বসছিলো না। তাই ভেবেছিলো ইমাকে বাসায় ড্রপ করে দিবে আর হলের সামনে গিয়েছিলো। ইমা বলেছিলো রিকুর সাথে আড্ডা দিবে তাই ইয়াদ ভাবলো ফুচকা স্টল বা কফিশপেই যাবে। এক্সামের জন্য ইমা ফোন নিয়ে যায়নি তাই ইয়াদ ফুচকা স্টলে না পেয়ে কফিশপে গিয়ে দেখে ইমা কোনো ছেলের সাথে বসে আছে। আর দূর থেকে মনে হচ্ছিলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে তাই চুপচাপ চলে আসে সেখান থেকে।

ইমা মাথা নিচু করে বললো, ওটা আরমান ভাইয়া ছিলো।

ইয়াদ উঠে বসে ইমার দুগাল ধরে নিজের মুখোমুখি করে বললো, আমি আশা করেছিলাম তুমি নিঃসংকোচে নিজের মনের সব কথা আমাকে বলতে পারবে। আমার ব্যর্থতা, হয়তো তোমার ততটা আস্থা আমি এখনো অর্জন করে উঠতে পারিনি।

কথাটা শেষ করে ইয়াদ বেড থেকে উঠে চলে যেতে গেলে ইমা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে ইয়াদের। ইয়াদ ঘুরে তাকায় ইমার দিকে।

চলবে,,,

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৬

কথাটা শেষ করে ইয়াদ বেড থেকে উঠে চলে যেতে গেলে ইমা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে ইয়াদের। ইয়াদ ঘুরে তাকায় ইমার দিকে।

কিছু বলবে ?

ইমা মাথা নিচু করে বললো, হুম অনেক কিছু বলার আছে আপনাকে।

ইমা ইয়াদের হাত ছেড়ে উঠে সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, সত্যি বলেছেন আপনি, আপনাকে সব বলতে ভয় পাই আমি। কারণটা কী জানেন, আপনার জীবনে আমার জায়গা কতটা সেটা আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমি। আমার গুরুত্ব কতটা আদৌও বুঝতে দিয়েছেন আমাকে কখনো ? কখনো বলেছেন আপনি আমাকে আদৌও ভালোবাসেন কিনা ?

ইয়াদ ইমার চোখে চোখ রেখে বললো, সব কিছুই কী বলতে হয় ?

ইমা মলিন গলায় বললো, কিছু কথা মুখে বলতে হয় আর আরমান ভাইয়ার ব্যাপারটা ? উনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না কোনোদিন। মণি আর আরমান ভাইয়া মিলে আমার জীবনটা বিষিয়ে তুলেছিলো।

ইমা একে একে ইয়াদকে সব খোলে বললো। যার বেশীর ভাগ ইয়াদের অজানা ছিলো। ইমা এতোটা সহ্য করেছে জীবনে, ইয়াদ সেটা কখনো ভাবেনি। আরমান তাকে ভালোবাসে এই বিষয়টা ছাড়া বাকি সব ইয়াদকে খোলে বললো ইমা। আরমান দেশ ছেড়ে যাচ্ছে সেটাও বললো।

ইয়াদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। ইমা তো ভুল কিছু বলেনি। সে ইমাকে কতটা জানতে চেয়েছে আর নিজেকেই বা কতটা জানতে দিয়েছে ইমাকে। ইমা কথাগুলো বলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।

ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, যে কোনো সম্পর্কে বিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরি, বুঝতে পেরেছেন ?

ইমা ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ইয়াদ সেদিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইয়াদ বুঝতে পারছে ভুল তারও আছে৷

৫৩.
ইয়ানা রে তোর হলো ? ছেলেটা না আবার হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেয়।

এই তো মা হয়ে গেছে, এখনই আসছি।

ইয়ানা পিংক কালার একটা শাড়ি পরে, মাথায় হিজাব পরে সিড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে লাগলো।

আরে আরে আস্তে নাম, শাড়ীতে পা বেঁধে পরে যাবি তো আবার।

ইয়ানা কোনোমতে শাশুড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো, রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে।

ইয়ানার শাশুড়ী মুচকি হেঁসে বললো, আমি তোকে রেডি হতে পাঠিয়েছিলাম নাকি যুদ্ধ করতে ?

ইয়ানা গাল ফুলিয়ে বললো, যেভাবে তাড়া দিচ্ছিলে তাতে যুদ্ধই মনে হয়েছে আমার কাছে।

রেহেনা পারভিন ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, এতো কষ্ট করে রান্না করলি। এখন যদি গিয়ে দেখিস রেহান খেয়ে নিয়েছে তাহলে ভালো লাগবে তোর ?

ইয়ানা বড় বড় চোখে তাকিয়ে খানিকটা চিৎকার করে বললো, একদম না।

রেহেনা মুচকি হেঁসে বললো, তাই জন্যই এতো তাড়া দিচ্ছিলাম ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

ইয়ানা জড়িয়ে ধরলো রেহেনাকে আর গালে কিস করে বললো, ইউ আর দ্যা বেস্ট মম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।

হয়েছে আর পাম দিতে হবে না এবার কিন্তু সত্যি লেট হয়ে যাচ্ছে তোর।

ইয়ানা ব্যস্ত হয়ে বললো, ওকে ওকে যাচ্ছি।

খাবারের বক্সটা নিয়ে ইয়ানা প্রায় দৌড় লাগালো আর চেঁচিয়ে বললো আল্লাহ হাফেজ মা। রেহেনা পারভিন ইয়ানার কান্ড দেখে মুচকি হাঁসলো। আজ রেহানকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ইয়ানা নিজের হাতে রান্না করেছে। সেটা নিয়েই হসপিটালে যাচ্ছে। তবে সব কিছুতে রেহেনা পারভিন হেল্প করেছে।কোনো মতে রান্না শেষ হতেই ইয়ানাকে পাঠিয়ে দিয়েছে রেডি হতে আর নিজের হাতে সব গুছিয়ে দিয়েছে। রেহেনা আর ইয়ানাকে দেখে শাশুড়ী বৌমা নয় বরং মা মেয়ে মনে করে সবাই। এদিকে রেহান হয়ে গেছে নিজের বাবা-মায়ের কাছে মেয়ের জামাই। যাকে বলে বৌমা হয়ে গেছে মেয়ে আর নিজের ছেলে হয়ে গেছে মেয়ের জামাই। এ নিয়ে রেহান প্রায় ঝগড়া করে নিজের বাবা-মায়ের সাথে আর ইয়ানাকে হিংসা করে। ইয়ানার জীবনে যে বাবা-মায়ের অভাব ছিলো সেটা পূরণ করে দিয়েছে এই দুজন মানুষ। রেহানের বাবা মিস্টার গালিব আহমেদ বাইরে থেকে আসলে সবসময় ইয়ানার জন্য চকলেট, আইসক্রিম, মাঝে মাঝে ফুচকাও নিয়ে আসে। ইয়ানা এখন বুঝতে পারে রেহানকে বিয়ে করে সে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। রেহানের সাথে সে জীবনের সব খুশিও পেয়ে গেছে। আর রেহানও ইয়ানাকে খুব ভালোবাসে। এখন তো ইয়ানার সারাদিনে একবার কেনো, সারা সপ্তাহে একবারও আরমানের কথা মনে পড়ে কিনা ইয়ানা জানে না। তবে একটা জিনিস খুব ভালো বুঝে গেছে। মানুষের অতীতটা তখন বেশি মনে পরে বর্তমানে যখন সে খুশি থাকে না।

ইয়ানা নিজের মনে বিড়বিড় করে বললো, কোথায় একটা পড়েছিলাম জীবনে সঠিক মানুষ পেলে শুধু প্রথম ভালোবাসা কেনো পুরো অতীতটাই ভুলা যায়। আপনাকে পেয়ে তার প্রমাণ আমি নিজেকে দিয়ে পেয়ে গিয়েছি রেহান। এখন তো আপনাকে ছাড়া নিজের একটা মুহূর্ত ভাবতে পারি না আমি। এতোটা সুখ, এতোটা ভালোবাসা সব কিছু উপেক্ষা করে মাঝে মাঝে মনের কোণে কোথাও একটা উঁকি দেয় না পাওয়ার কষ্ট। তবে সেটা বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে না আপনার ভালোবাসার সামনে।

ম্যাম,,,

ড্রাইভারের ডাকে ইয়ানার ঘোর কাটলো। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে খাবারের বক্সটা নিয়ে বের হলো গাড়ি থেকে। তারপর সোজা ভেতরে চলে গেলো। হসপিটালটা রেহানদের নিজেদের। রেহানের বাবা হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট বিভাগটা দেখে। ইয়ানা দুজনের খাবারই নিয়ে এসেছে৷ প্রথমে শশুরের কেবিনে চলে গেলো।

আসবো বাবা ?

গালিব আহমেদ চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে ইয়ানাকে দেখে বললো, আরে ইয়ানা মা যে, আয় আয় তোর আবার অনুমতি লাগে নাকি।

ইয়ানা হাসি মুখে কেবিনে ঢুকে গালিবের খাবারটা টেবিলের উপর রেখে বললো, আপনার খাবার নিয়ে এসেছিলাম বাবা।

গালিব ইয়ানার অন্যহাতে তাকিয়ে বললো, ওটা বুঝি রেহানের খাবার ?

ইয়ানা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললো, হুম।

তাড়াতাড়ি নিয়ে যা, পেটুকটা না আবার ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেয়।

ইয়ানা ব্যস্ত গলায় বললো, ঠিক আছে বাবা আপনি খান আমি আসছি।

গালিব হেঁসে বললো, হ্যাঁ যা যা।

ইয়ানা তাড়াতাড়ি রেহানের কেবিনে গিয়ে দেখে পুরো ফাঁকা। খাবারটা রেখে বাইরে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করে রেহান কোথায়। নার্স জানায় রেহান একটা আইসিইউ পেশেন্ট দেখতে গেছে, এখনই চলে আসবে। ইয়ানা আবার চুপচাপ কেবিনে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো। একটু পর দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকিয়ে দেখে রেহান ঢুকলো, গায়ে সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো আর চোখে চশমা। এই লুকে রেহানকে আরো বেশী হ্যান্ডসাম লাগে ইয়ানার কাছে।

রেহান ইয়ানাকে দেখে সারপ্রাইজড হয়ে বললো, আরে আমার ইয়াবা যে ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

ইয়ানা চোখ বড় বড় করে বললো, আবার ইয়াবা ?

রেহান এপ্রোন খুলতে খুলতে বললো, আরে মানুষ ইয়াবা দিয়ে নেশা করে আর আমার তোমাকে দেখেই নেশা হয়ে যায়। নামটাও সেইম সেইম ইয়ানা আর ইয়াবা। তাই আমার জন্য তোমার নামটা ইয়াবাই পার্ফেক্ট।

ইয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে খাবার সার্ভ করতে করতে বললো, সবসময় এতো ফানি মুড কোথায় পান বলুন তো ?

রেহান ইয়ানাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে দেখলেই আমার মুখে অটোমেটিক হাসি ফোটে উঠে।

ইয়ানা রেহানের হাত আলগা করে পেছনে ঘুরে রেহানের কাঁধের উপর দিয়ে হাত রেখে বললো, আমাকে দেখলে আপনার আর কী কী হয় ?

রেহান দুষ্টুমি করে বললো, তোমাকে দেখলে তো আমার অনেক কিছু হয় তার মধ্যে,,

থামুন আর বলতে হবে না এবার গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।

ইয়ানা এক প্রকার ঠেলে রেহানকে ওয়াশরুমে ঠুকিয়ে দিলো আর মুচকি হেঁসে খাবার সার্ভ করতে লাগলো। রেহান ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে নিজের পছন্দের খাবার দেখে চটপট বসে এক লোকমা মুখে পুড়ে দিলো। ইয়ানা অধিক আগ্রহে তাকিয়ে আছে রেহানের দিকে খাবার কেমন হয়েছে জানার জন্য।

রেহান একটু সময় নিয়ে বললো, খাবারের টেস্টটা কেমন অন্যরকম লাগছে আজ।

ইয়ানা চিন্তিত হয়ে বললো, কেনো ভালো হয়নি ?

রেহান আবার মুখে দিয়ে বললো, আরে অনেক ভালো হয়েছে কিন্তু টেস্টটা ভিন্ন।

ইয়ানা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললো, সত্যি ভালো হয়েছে তো ?

রেহান খাবার খেতে খেতে বললো, সত্যি বলছি রে বাবা, অনেক টেস্টি হয়েছে।

ইয়ানা মাথা নিচু করে মুচকি হেঁসে বললো, আজ সব রান্না আমি করেছি।

রেহান চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, হোয়াট তুমি রান্না করেছো, তুমি এতো ভালো রান্না করতে পারো তাহলে এতদিন কেনো রান্না করে খাওয়ালে না কেনো ?

এতদিন মায়ের কাছে রান্না শিখেছি ভালো করে।

এবার থেকে কিন্তু মাঝে মাঝে রান্না করে খাওয়াতে হবে বলে দিলাম।

ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, ওকে।

রেহান দাঁতে জিহ্বা কেটে বললো, এই যা নিজের পছন্দের সব খাবার দেখে তোমাকে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি, সরি ডিয়ার। তুমি লান্স করেছো ?

ইয়ানা মাথা নিচু করে বললো, না আপনি করে নিন আমি পরে করবো।

রেহান ব্যস্ত গলায় বললো, তিনটা বাজতে চললো তুমি এখনো লান্স করোনি আবার বলছো পরে করবে ?

রেহান বা হাতে ইয়ানাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো আর এক লোকমা খাবার মুখের সামনে ধরে বললো, নাও হা করো।

ইয়ানা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললো, এভাবে ?

রেহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে উঠে, এভাবে আমার কোনো প্রবলেম হচ্ছে না, তোমার কী প্রবলেম ?

ইয়ানা আর কিছু বললো না খাবারটা মুখে নিলো। সত্যি ভালো হয়েছে খাবার, ইয়ানা এতোটা ভালো আশা করেনি৷ পরে বুঝতে পারলো রেহেনা পারভিন তাকে হেল্প করেছে বলেই এতোটা ভালো করতে পেরেছে। ইয়ানাকে কোলে বসিয়ে খেতে রেহানের বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো দেখে ইয়ানা উঠে আসতে চায় কিন্তু রেহান জোর করে বসিয়ে রাখে। এভাবেই বাকি খাবারটা শেষ করে দুজনে।

৫৪.
তুই অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছিস আমাদের একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করেছিস ?

আমিনুল মাহমুদ গম্ভীর গলায় কথাটা বলে আরমানের দিকে তাকালো। ড্রয়িংরুমে পুরো পরিবার থমথমে মুখ করে বসে আছে আরমানের কথা শুনে। কথা তো বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।

ছাহেরা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, স্কলারশিপ পাওয়ার পর তোর বাবা জোর করে পাঠাতে পারলো না। তাহলে এখন কেনো যেতে চাইছিস তুই ?

আরমান শান্ত গলায় বললো, এর উত্তরটা আমার থেকে ভালো, তুমি জানো মা।

ছাহেরা অবাক হয়ে বললো, আমি জানি মানে ?

আরমান এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তোমাদের জানানো প্রয়োজন ছিলো জানালাম। আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না। সামনের সপ্তাহে আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।

আরমান হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। আমিনুল মাহমুদ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, ছাহেরা বেগম আঁচলে মুখ গুজে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো আর কথা আরমানের পিছন পিছন গেলো। ছাহেরা বেগম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে নিজের হাতে নিজেরই সাজানো সংসার ধ্বংস করে দিয়েছে। ইমা এ বাড়ি থেকে যাওয়ার পর তাদের জীবনে শুধু খারাপই হচ্ছে।

কার থেকে পালাতে চাইছো ভাইয়া ?

আরমান বেডে বসে ছিলো মাথা নিচু করে, হঠাৎ কথার আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকালো। আরমানের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, তবে রাগে নয় চাপা কষ্টে। তারও ভালো লাগছে না সবাইকে ছেড়ে যেতে, আবার এখানে থাকতেও দম বন্ধ হয়ে আসছে দিন দিন।

আরমান আবার মাথা নিচু করে বললো, কী বলছিস এসব ? ||লেখনীতে তাহমিনা তমা ||

কথা আরমনের সামনে ফ্লোরে বসে বললো, তোমার কী হয়েছে ভাইয়া, আমাকে বলবে না ?

আরমান শান্ত গলায় বললো, কী হবে কিছু না।

আমি জানি এমনই এমনই তুমি চলে যেতে চাইছো না।

ইশানকে ভালোবাসিস ?

আরমানের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে কথার বুক কেঁপে উঠলো, ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে।

আরমান কথার দিকে তাকিয়ে বললো, ভালোবাসা জিনিসটা খুব অদ্ভুত। যখন আমাদের কাছে থাকে আমরা তার গুরুত্ব দেই না কিন্তু যখন হারিয়ে ফেলি তখন জীবন মূল্যহীন মনে হয়। ইশান ভালো ছেলে, কখনো তোকে কষ্ট দিবে না। শুধু হারিয়ে যেতে দিস না, আগলে রাখিস। বড় ভাই হয়ে এসব বলছি বলে অবাক হচ্ছিস ? জীবনে অভিজ্ঞতা খুব মারাত্মক একটা জিনিস রে কথা, অনেক কিছু শিখিয়ে যায়। আমার মাথা ধরেছে তুই এখন যা।

আরমানের কথার মানেগুলো বুঝতে পারলো না, তবে ইশানের কথা জানার পরও কোনো রিয়াক্ট করলো না দেখে কথা বেশ অবাক হলো। আরমান বলতেই তার রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

৫৫.
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। ইমা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না ইয়াদের সাথে আর ইয়াদও ইমার রাগ ভাঙায়নি। ইয়াদ এমন একটা ভাব নিয়ে আছে ইমা তার সাথে কথা বলা না বলায় তার কিছু আসে যায় না। এসব দেখে ইমার অভিমান দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইয়াদ কিছু চাওয়ার আগেই সব হাতের কাছে পেয়ে যায় শুধু ইমার দেখা পায় না। সকালে সে ওয়াশরুমে থাকতেই ইমা তার ব্ল্যাক কফি, অফিসের প্রয়োজনীয় সব রেখে উধাও হয়ে যায়। আজ ইয়াদের হাতের কাছে টাই পেয়েও মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো, আমার টাই কোথায় ?

ইমা ব্রেকফাস্ট সাজাচ্ছিলো টেবিলে তাই ইয়াদের গলা স্পষ্ট শুনতে পেয়ে বিড় বিড় করে বললো, সবই তো রেখে এলাম পাচ্ছে না মানে কী। আর একটা জিনিস না পেলে একটু খোঁজে নিলে কী হয় ?

ইমার চিন্তা ভাবনার মাঝেই ইয়াদ আবার চেঁচাতে লাগলো। ইমা বিরক্ত হয়ে সার্ভেন্টকে সব সাজাতে বলে নিজে রুমের দিকে গেলো। ইমাকে রুমে ঢুকতে দেখে ইয়াদ হাতের টাই পেছনে লুকিয়ে ফেললো আর ইমা বিড়বিড় করে বের করা টাই খুঁজতে লাগলো। শেষে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে কাবার্ড থেকে নতুন আর একটা বের করতে গেলো। ইয়াদ পেছন থেকে টাই ইমার মাথার উপর দিয়ে পেটের কাছে এনে টাইয়ের দুপাশে টেনে ইমাকে নিজের কাছে আনলো।

ইমা টাই দেখে বললো, এটা কী ধরনের ফাজলামো ? টাই আপনার কাছে তবু চেঁচামেচি করছেন কেনো ?

ইয়াদ ইমাকে আর একটু কাছে টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ভালো করে ডাকলে তো আসতেই না।

ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের ভয়েস শুনে তবে নিজেকে সামলে কাঠ কাঠ গলায় বললো, কেনো আসবো ?

ইয়াদ ইমার দুবাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে টাই ইমার হাতে দিয়ে বললো, বেঁধে দাও।

ইমা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, পারবো না নিজের হাত আছে, নিজের হাতে করুন।

ইয়াদ ইমার কোমর জড়িয়ে আর একটু কাছে টেনে বললো, সত্যি পারবে না ?

ইয়াদের ভয়েস শুনে ইমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তাই কথা না বাড়িয়ে টাই বেঁধে দিতে লাগলো। ইয়াদ লম্বা বেশি হওয়ায় ইমার অসুবিধা হচ্ছে দেখে ইয়াদ ইমার কোমর জড়িয়ে একটু উঁচু করলো। ইমা শিউরে উঠলো ইয়াদের এহেন কাজে তবে কিছু বললো না, চুপচাপ টাই বেঁধে দিতে লাগলো। বাঁধা শেষে ইয়াদ আস্তে করে ইমাকে নিচে নামিয়ে দিলো।

কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো, আজ রাতে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

ইমা অবাক চোখে তাকালো ইয়াদের দিকে আর ইয়াদ টুপ করে ইমার কপালে একটা কিস করলো। ব্লেজার হাতে নিয়ে ইমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে আল্লাহ হাফেজ বলে বের হয়ে গেলো রুমে থেকে আর ইমা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো।

চলবে,,,,