#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৮
ইয়াদ ইমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আজকে অন্তত দূরে সরে যেও না।
ইয়াদের ধরা হাতটা ইমা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু ইয়াদের কথা শুনে একদম শান্ত হয়ে গেলো। ইয়াদ এক টানে ইমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো, ইমা সোজা ইয়াদের বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো। আস্তে করে ইমার দুবাহু ধরে নিজের থেকে আলাদা করলো। দুগালে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে ধরতেই ইমা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইমার নিশ্বাস ভাড়ী হয়ে গেছে। অনেক সময় পরও ইয়াদের কোনো রিয়াকশন না দেখে নিভু নিভু চোখে তাকালো ইমা। চোখ মেলতেই দেখতে পেলো দুটো চোখ তাকে চাতক পাখির মতো দেখছে।
ইমা কাঁপা গলায় বললো, কী দেখছেন এভাবে ?
ঘোর লাগা গলায় উত্তর এলো, অনেক দিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছি। তোমাকে প্রথমদিন দেখার পর সেদিন রাতেই আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। মরুভূমির মাঝে তৃষ্ণায় পাগল হয়ে আমি এদিক ওদিক ছুটছিলাম পানির জন্য। তখনই তোমাকে দেখতে পাই ফুলে ফুলে রঙিন এক বাগানে। তোমাকে দেখে তৃষ্ণার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম আমি। পরক্ষণে তোমার হাতে পানি দেখে তৃষ্ণার কথা মনে পরে গেলো। অনুরোধ করতে লাগলাম তোমার কাছে একটু পানির জন্য কিন্তু তুমি বিনিময় চাইলে আমার কাছে।
ইমা অবাক হয়ে বললো, বিনিময় ?
ইয়াদ নিজের বুকের বা পাশে আঙ্গুল রেখে বললো, এখানে একটু জায়গা চেয়েছিলে আর তার বিনিময়ে মরুভূমির মাঝে সাজানো বাগানটা দিয়ে দেবে বলেছিলে।
ইমা অবাক চোখে তাকিয়ে ইয়াদের প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, তুমি তোমার কথা রেখেছো। এই বুকের বা পাশের জায়গাটার বিনিময়ে আমার মরুভূমির মতো জীবনটা সবুজ বাগান করে দিয়েছো, তুমি তোমার কথা রেখেছো।
ইয়াদ ধীরে ধীরে ইমার দিকে মুখটা এগিয়ে নিয়ে কপালে গভীর এক কিস করলো। ইমা কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইয়াদ একে একে ইমার দুচোখের পাতা, গাল, থুতনি সব জায়গায় গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগলো। ইয়াদের প্রতিটা স্পর্শ ইমা কেঁপে কেঁপে উঠছে। শক্ত করে ইয়াদের শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরে আছে। ইয়াদ কিছুটা সময় ইমার গোলাপি ঠোঁটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীর গতিতে আলতো করে ইমার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। ইমা এবার দিগুণ কেঁপে উঠে চোখ খোলে ইয়াদের দিকে তাকালো। কিন্তু ইয়াদের চোখের নেশা তাকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে দিলো না। বাধ্য হয়ে ইমা আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইয়াদ এবার গভীরভাবে ইমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ইমা ইয়াদের মাথার পেছনের চুলগুলো শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলো। একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগলো একে অপরের ভালোবাসার সাগরে। আজ তাদের মাঝে কোনো তিক্ততার ছায়াও নেই আর কোনদিন হয়তো আসবেও না।
ইয়াদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে ইমা। অনেক ঝড় ঝাপটার পর নিজের স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছে গেছে সে। ইয়াদের চোখে ঘুম নেই, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে দেখছে ঘুমন্ত পরীকে। ঘুমের মধ্যেও হাসছে মনে হচ্ছে। ইয়াদ আলতো করে ইমার কপালে কিস করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আর ইমাও ঘুমের মাঝে ইয়াদকে আঁকড়ে ধরে ঘুমাতে লাগলো। ফার্ম হাউস তাই আশেপাশে গাছপালা আর পাখির আনাগোনা একটু বেশি। ফজরের আযানের পর থেকে পাখির কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে। এখন আর লেট করলে দুজনকেই কাযা নামাজ আদায় করতে হবে, শাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়তে সময় লাগবে।
ইয়াদ ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ধীর গলায় ডাকলো, ইমা উঠো ফজরের সময় চলে যাচ্ছে আর লেট করলে কিন্তু কাযা হয়ে যাবে।
ইমা ইয়াদের কথায় পাত্তা না দিয়ে আয়েশ করে ঘুমাতে লাগলো। ইয়াদ একটু ভেবে ইমার এলোমেলো চুল ধরে একটু টান দিলো আর ইমা বড় বড় চোখে তাকালো। চুলের টান একদম সহ্য হয় না তার সেটা ইয়াদ জানে।
রাগী গলায় বললো, কী হলো বিরক্ত করছেন কেনো তখন থেকে ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, নামাজ পড়বে না ?
নামাজের কথা শুনে ইমা উঠতে গেলে নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো আর লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। কোনোরকমে পোশাক ঠিক করে এক ছোটে ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ইয়াদ ইমার কান্ড দেখে মুচকি হাঁসলো আর ইমা লাজুক হেঁসে নিজের মাথায় গাট্টা মেরে দ্রুত শাওয়ার নিতে লাগলো। শাওয়ার শেষে খেয়াল করলো কোনো পোশাক আনা হয়নি তার। এতোকিছু না ভেবে দরজা একটু ফাঁকা করে ইয়াদের কাছে চাইলো। ইয়াদ আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। ইমা চাইতেই ইয়াদ তার হাতে পোশাক ধরিয়ে দিলো। ইমা দ্রুত চেঞ্জ করে বের হতেই ইয়াদ চলে গেলো শাওয়ার নিতে। ইমা জায়নামাজ বিছিয়ে ইয়াদের জন্য ওয়েট করতে লাগলো। ইয়াদ বের হলে দুজনে এক সাথে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। নিজেদের নতুন জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলো। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে ঘুরে দাড়াতেই ইয়াদ ইমাকে কোলে তুলে নিলো।
ইমা চমকে উঠে বললো, এমন ভূতের মতো হুটহাট কোলে তুলে নেন কেনো ? ভয় পাই তো নাকি আর আপনার কষ্ট হয় না এভাবে কোলে নিতে ?
ইয়াদ ভাব নিয়ে বললো, লাস্টবার ১৬০ কেজি ওজন তুলেছিলাম আর তুমি বড়জোর ৫০ কেজি হবে। হাউ ফানি, ৫০ কেজি নিয়ে আমার কষ্ট হবে ?
ইমা আর কিছু বললো না, ইয়াদ তাকে নিয়ে আবার ছাঁদে যেতে লাগলো।
ইমা ভ্রু কুঁচকে বললো, এখন আবার ছাঁদে কী ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, আজ একসাথে সূর্যদয় দেখবো ?
আপনি এতো রোমান্টিক আগে বুঝিনি কিন্তু।
ইয়াদ চোখ টিপ মেরে বললো, কেবল তো শুরু আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে মাই লাভ।
ইমা চোখ সরিয়ে নিলো ইয়াদের থেকে। ছাঁদে গিয়ে দেখলো বৃষ্টির জন্য সব সাজানো লান্ড ভন্ড হয়ে পরে আছে।
তা দেখে ইমা হেঁসে বললো, যদি গতরাতে বৃষ্টিটা আগে নেমে যেতো আপনার এতো পরিশ্রমের পরিণাম এমন হয়ে যেতো আমি দেখার আগেই।
ইয়াদ ইমাকে নিয়ে পূর্বদিকটায় নামিয়ে দিয়ে বললো, তা যা বলেছো ?
ইমা সামনে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো আর ইয়াদ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। পূর্ব আকাশটা লাল হয়ে গেছে। একটু পরই সূর্য উঠে যাবে। ইয়াদ ইমার ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা সকাল যেনো এমন হয় আজ থেকে।
ইয়াদের কথা শুনে ইমা কিছু বললো না। সময়টা উপভোগ করতে লাগলো দুজনে। রোদ উঠে গেলে ছাঁদ থেকে নেমে এলো। কেয়ারটেকার ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। ইয়াদ গতরাতে মিথ্যা বলেছিলো এখানে কেউ নেই। কেয়ারটেকার সব কাজ শেষ করে নিজের রুমে চলে গিয়েছিলো আর দারোয়ানও। লাইটও ইয়াদ ইচ্ছে করে অফ রেখেছিলো। ইমা সব জানতে পেরে ইয়াদকে এলোপাথাড়ি কয়েকটা কিল ঘুষি লাগিয়ে দিলো। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে এলো দুজনে।
ইয়াদ ড্রাইভ করছে আর মাঝে মাঝে ইমাকে দেখছে ইমাও আড়চোখে ইয়াদের দিকে তাকাচ্ছে।
ইমা সামনে তাকিয়ে মনে মনে বললো, মাফ করবেন আমাকে, আরমান ভাইয়ার ভালোবাসার কথাটা আপনার থেকে লুকিয়ে গেছি। যে মানুষটা আমাকে কখনো সহ্য করতেই পারেনি আজ হঠাৎ করে সে এসে বলছে আমাকে নাকি ভালোবাসে। সেটা কীভাবে বিশ্বাস করে নিবো বলুন ? আর যেটা আমি নিজেই বিশ্বাস করি না সেটা আপনাকে জানিয়ে একটা তিক্ততা বাড়াতে চাই না।
ইমা,,,
ইয়াদের ডাকে ইমার ভাবনার সুতো ছিড়লো আর খানিকটা চমকে ইয়াদের দিকে তাকালো, কিছু বললেন ?
কী ভাবছো তুমি ?
কিছু না, আপনি কিছু বলছিলেন ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো,খুব তাড়াতাড়ি আমরা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি।
ইমা বিস্ফুরিত চোখে তাকিয়ে বললো, মানে ?
মানে আমরা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি হানিমুনে।
তাই জন্যই কী আপনি এমন উদ্ভট পোশাক নিয়ে এসেছেন ?
হুম আর যাওয়ার আগে আমাকে অনেক কাজ গুছিয়ে যেতে হবে, কয়েকদিন প্রচুর ব্যস্ত থাকবো। তাই গতকাল সব শপিং করে ফেলেছি। শুধু তোমার না আমার জন্যও করেছি।
সুইজারল্যান্ড যাওয়ার স্বপ্ন ইমার অনেকদিন থেকে। মুলত ঘুরাঘুরি খুব পছন্দ ইমার আর সেটা যেখানেই হোক। তবে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যের একটা ভিডিও দেখার পর। স্বপ্নটা সত্যি হবে কখনো ভাবেনি ইমা। খুশিতে ইমা হুট করে ইয়াদের গালে কিস করে দিলো। ইয়াদ অবাক চোখে ইমার দিকে তাকালে ইমা লজ্জায় বাইরের দিকে তাকালো। ইয়াদ মুচকি হেঁসে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
৫৬.
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে আরমান। আমিনুল, ছাহেরা আর কথা তাকে ছাড়তে এসেছে। ছাহেরা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। আরমানের লাস্ট মুহূর্তে এসে মনে হচ্ছে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিতে কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
আমিনুল বললো, আরমান এখনো সময় আছে ভেবে দেখ একবার।
বাবা আমি যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।
আমিনুল ঘুরে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করলো আর ছাহেরা শব্দ করেই কাঁদছে।
কথা আওয়াজ কিছুটা নিচু করে বললো, এখনো বললে না ভাইয়া তুমি কেনো যেতে চাইছো ?
আরমানও ছোট করে উত্তর দিলো, ভালোবাসা ?
কথা অবিশ্বাসের চোখে তাকালো আরমানের দিকে। আরমান কাউকে ভালোবাসে এটা যেনো কথা হজম করতে পারছে না। আর এদিকে আরমানের চোখ আসেপাশে একজনকে খুঁজছে। হ্যাঁ সেটা আর কেউ নয় ইমা। লাস্ট বারের জন্য ইমাকে আসতে বলেছিলো আরমান। আশেপাশে দেখতে না পেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। আরমানের জন্য তার জীবনে সময় কোথায় ? সময় শেষ হয়ে আসছে আরমান আর একবার পেছনে তাকিয়ে কাঁচের দরজা ঢেলে ভেতরে চলে গেলো। চাইলেও এখান থেকে আর ফেরত যেতে পারবে না। সব চেকিং হচ্ছে আরমান আবার কাঁচের দরজার ওপাড়ে তাকাতেই ইমাকে দেখতে পেলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফোটে উঠলো আরমানের। ইমার পেছন থেকে ইয়ানাকেও বের হতে দেখলো। কাঁচের দরজার ওপাড়ে আর এপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একতরফা ভালোবাসার তিনটা পরিণতি। আরমান ইমাকে ভালোবেসেছিলো একতরফা আর ইয়ানা আরমানকে। একতরফা ভালোবাসাগুলো খুব কমই পরিণতি পায়। একমাত্র রেহানের একতরফা ভালোবাসাই পরিণতি পেয়েছে। ইমা আর ইয়ানা দুজনেই আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে একজনের চোখে ভালোবাসা আর একজনের চোখে মায়া। হ্যাঁ আজ আরমানের জন্য মায়া হচ্ছে ইমার। তবে কিছু করার নেই সব শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এদিকে আরমান বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তাকিয়ে দেখছে ইমাকে। বুকটা আজ বড্ড বেশি পুড়ছে তার। ইয়ানা তো রেহানকে পাশে পেয়ে নিজের বুকের যন্ত্রণাটা কমিয়ে নেবে কিন্তু আরমানের কোনো উপায় নেই কষ্টটা একটু লাঘব করার। আরমান আর একবার বাবা-মা, বোন আর না পাওয়া ভালোবাসাকে দেখে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো। আরমান আড়ালে চলে যেতেই আজ অজানা কারণে ইমার চোখ থেকে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো। পানির বিন্দুটা হাতে নিয়ে দেখে নিজেই অবাক হলো। এদিকে ইয়ানার চোখে আজ পানি নেই কারণটা তার অজানা। এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুটা সময়।
ইয়ানা স্থির গলায় বলে উঠলো, চলো ভাবি আমাদের যেতে হবে।
ইমা ছোট করে হুম বলে হাঁটতে লাগলো সামনে। ইয়ানা আর একবার পিছনে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ইমার পিছনে যেতে লাগলে। ইমা ইয়াদকে এখানে আসার কথা বললে সে ইয়ানাকে সাথে নিয়ে আসতে বলে। সে ব্যস্ত আসতে পারবে না আর ইমাকেও একা ছাড়তে পারবে না। তাই ইয়ানাকে সাথে নিয়ে আসতে বলেছে। গাড়িতে গিয়ে বসতেই তাদের মাথার উপর দিয়ে বিকট শব্দে প্লেনটা চলে গেলো৷ দুজনেই সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়।
আরমান তাকিয়ে আছে উইন্ডো দিয়ে বাইরের দিকে, চোখ দুটো টলমল করছে নোনাজলে। আবার কবে এই দেশে, এই মাটিতে আপনজনদের কাছে ফিরে আসবে সেটা তার জানা নেই। এটাও জানে না আদৌও কোনোদিন আর আসা হবে কিনা। বুকের ভেতরটা প্রচন্ড ভাড়ী লাগছে তার। আরমান চোখ বন্ধ করে সীটে হেলান দিলো আর চোখের কোণ বেয়ে নোনাজলের ধারা গড়িয়ে গেলো। আরমানের হঠাৎ অস্বস্তি হতে লাগলো, মনে হচ্ছে তার দিকে কেউ গভীরভাবে তাকিয়ে আছে। আরমান চোখ খুলে চমকে উঠলো। চশমা চোখে একটা মেয়ে তার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে৷ আমরান প্রথমে শুধু চশমাওয়ালা চোখ দু’টোই দেখতে পেয়েছে।
আরমান চমকে উঠে বললো, Hey, what are you doing here ?
মেয়েটা সোজা হয়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, Hi myself Arisha Rayhan.
আরমান ভ্রু কুঁচকে বললো, So what,,, Why did you look at me like that ?
আরিশা হাত সরিয়ে নিয়ে চশমাটা একটু ঠিক করে নিয়ে বললো, না মানে আপনি আসার পর থেকে কেমন গোমড়া মুখে বাইরের তাকিয়ে ছিলেন, আবার দেখলাম কান্নাও করছিলেন তাই একটু কৌতূহল হয়েছিলো ?
আরমান ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটাকে গড়গড় করে বাংলা বলতে দেখে। কারণ চেহারায় অনেকটাই ফরেইনারের ছাপ আর পোশাকেও।
আরমান গম্ভীর গলায় বললো, তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন ?
আরিশা গাল ফুলিয়ে বললো, সরি।
আরমান আবার চোখ বন্ধ করে নিলো আর মেয়েটা একটু উশখুশ করে আবার বললো, আপনি কী আস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন ?
আরমান বিরক্ত গলায় বললো, না আমি আস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইটে আমেরিকা যাচ্ছি।
আরমানের উত্তরে আরিশা একটু লজ্জা পেলো, তবে পাত্তা না দিয়ে আবার বললো, না মানে আমি অস্ট্রেলিয়া থাকি তাই বলছিলাম। আপনি আস্ট্রেলিয়ায় কোথায় যাচ্ছেন ?
আরমান বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে ছোট করে উত্তর দিলো, সিডনি শহরে।
আরিশা উৎসুক গলায় বললো, ওয়াও আমিও সিডনি শহরেই থাকি, আমার জন্ম সিডনি শহরেই। বাবা একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে সেই সুবাদে সিডনিতেই থাকি আমরা। বাবা-মা দুজনেই পিউর বাঙালি আর রিলেটিভস সব বাংলাদেশে, আমি আমার দাদু বাড়ি গিয়েছিলাম।
আরমানের প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে মেয়েটার কথা কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। এতো ঘণ্টার জার্নি যদি এই মেয়ের সাথে থাকে তাহলে সে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে। সেটা ভেবে আরমানের মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। আরমান ছোট ছোট শব্দে মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কথায় কথায় যখন জানতে পারলো মেয়েটার বাবা আরমানের অফিসেরই সিনিয়র অফিসার তখন বেশ অবাক হলো। তবে মেয়েটাকে বুঝতে দিলো না। এতটুকু সময়ে আরমান এটা নোটিশ করেছে মেয়েটাকে, প্রতি পাঁচমিনিটে একবার তার চোখের চশমাটা নেড়েচেড়ে ঠিক করে নেয়।
আরামন বিরক্ত হয়ে বললো, আপনি কী এবার একটু চুপ করবেন দয়া করে ? আসলে আমার মাথাটা একটু ধরেছে।
আরিশা গোমড়া মুখে বললো, আসলে আমি বেশি সময় চুপ করে থাকতে পারি না। মনে হয় পেটটা ফোলে যাচ্ছে কথায়।
আরমানের ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজে ফাটাতে। কোনো ফ্যাসাদে পরলো সেটা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ের বকবকে সে নিজের কষ্টের কথা প্রায় ভুলেই গেছে।
৫৭.
কথা থেমে থেমে কান্না করছে আর ইশান তাকে শান্তনা দিচ্ছে।
কথা নাক টেনে বললো, ভাইয়া এভাবে কেনো চলে গেলো বলুন তো ? ভাইয়ার সাথে তেমন কথা হতো না, মেশা হয়নি তেমন করে। কিন্তু দিনে কয়েকবার সামনাসামনি হয় যেতাম আর টুকিটাকি কথাও হতো। কিন্তু বাড়িতে গেলে এখন কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। সকালে ভাইয়াকে দিয়ে আসার পর থেকে মা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।
ইশান কী বলবে বুঝতে পারছে না ? সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না আরমান হঠাৎ করে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেনো নিলো। ভার্সিটিতে তার টিচার ক্যারিয়ার বেশ ভালোই চলছিলো তাহলে হটাৎ এমন সিদ্ধান্ত ?
ইশান ভাইয়া কাউকে ভালোবাসতো।
ইশান চমকে উঠে তাকালো কথার দিকে, মানে ?
হুম ভাইয়া যাওয়ার আগে ছোট্ট উত্তরে এটাই বলে গেছে।
ইশান হিসাব মেলাতে পারছে না। তার জানামতে আরমান ভার্সিটি লাইফ থেকে পিউর সিঙ্গেল। অনেক মেয়ে তাকে প্রপোজ করলেও কখনো একসেপ্ট করেনি। ইশান শুনেছিলো বাজি ধরে কোনো মেয়েকে প্রপোজ করেছিলো কিন্তু সেটা কে তার জানা নেই।
ইশান একটু ভেবে বললো, সেটা কে কিছু বলেছে আরমান স্যার ?
কথা হতাশ গলায় উত্তর দিলো, না তবে আমার মনে হয় মা কিছু জানে। অনেকদিন ধরেই মা আর ভাইয়ার সম্পর্ক কিছু ঠিক নেই।
ইশান কথাকে বা হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, এখন এসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই আরমান স্যার তো চলেই গেছে।
কথা বিরক্ত হয়ে বললো, কী সব সময় স্যার স্যার করেন ? ভাইয়া বললেই তো হয়।
ইশান কথাকে একটু কাছে টেনে বললো, আগে স্যার ছিলো তাই স্যার বলেছি। এখন শুধু বউয়ের বড় ভাই তাই ভাইয়াই বলবো।
কথা ভ্রু কুঁচকে বললো, ঢং দেখে বাঁচি না, বিয়ের খবর নেই বউ বউ করতে এসেছে।
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, তোমার আঠার হলেই বিয়ে করে নিবো খুকী। ভাইয়াকেও বলতে হবে তোমার কথা।
কথা আর কিছু বললো না দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। তবুও কথার মন ঠিক হচ্ছে না। বারবার আরমানের কথা মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছে। আর একটা প্রশ্ন মনে ঘুরঘুর করছে মেয়েটা কে ছিলো আর কী হয়েছিলো ? যার উত্তর হয়তো আর কোনোদিন পাওয়া সম্ভব নয়। সময়ের সাথে সাথে হয়তো প্রশ্নটাও মাটি চাপা পড়ে যাবে।
৫৭.
আরমান এখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো কারণ মেয়েটা বকবক করে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরমান মনে মনে দোয়া করছে জার্নি শেষ হওয়ার আগে যেনো মেয়েটার ঘুম আর না ভাঙে। কিন্তু অনেক লম্বা জার্নি তাই দোয়াটা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আরমান একবার মেয়েটাকে স্ক্যান করে নিলো। পায়ে হোয়াইট কেডস, ব্লো জিন্স প্যান্টের সাথে ব্লো আর হোয়াইট কম্বিনেশনের একটা লং টপস আর গলায় স্কার্ফ ঝুলানো। এসব পোশাক আরমানের একদমই পছন্দ না। মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই চোখে পড়লো চশমার আড়ালে বন্ধ চোখ জোড়া, চিকন নাকের উপর চশমাটা আলগা হয়ে আছে, ঠোঁট দুটো গাড়ো গোলাপি, এতক্ষণ ননস্টপ নড়লেও এখন চুপ করে আছে। ঝুঁটি করা চুলের কিছু চুল বের হয়ে গালের উপর পড়ে আছে। ধবধবে সাদা মুখে মেক-আপের ছোঁয়া নেই। এতোটাই সাদা মেক-আপের হয়তো প্রয়োজনই পড়েনি। মর্ডাণ হলেও উশৃংখল মনে হচ্ছে না। আরমান আবার উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকালো। এখন কোন দেশের উপরে আছে তার জানা নেই তবে নিজের জন্মভূমি অনেক সময় আগেই পেছনে ফেলে এসেছে সেটা ভালো করেই জানে। আবার বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেলো আরমানের। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলো সীটে।
আপনি কী ঘুমিয়ে পড়েছেন ?
আরিশার আওয়াজ কানে আসতেই আরমানের এখন কান্না করতে ইচ্ছে করছে। এখনই তো ঘুমালো আবার ঘুম ভেঙে গেছে মানে এখন আবার আরমানের মাথা চিবিয়ে খাবে।
আরমান চোখ খুলে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো, প্রবলেম কী আপনার ?
আরিশা আবার চশমা ঠিক করে বললো, মানে ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাই ঘুম ভেঙে গেলো।
আরিশার কথা শুনে আরমান শুকনো মুখে বিষম খেলো।
চলবে,,,,