তুমি আমি দুজনে পর্ব-৪৯+৫০

0
599

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৯

রাতে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আস্তেধীরে টেবিল গোছাচ্ছে আর রাইমার সাথে গল্প করছে তুরা, ঘড়ির কাটা ঠিক রাত বারোটার সময় জানান দিচ্ছে, অথচ এখনো বাড়ির সকলে জাগ্রত।
দুপুরে আহান তুরার সঙ্গে তহমিনাকেও এ বাড়িতে এনেছিল। মূলত সে তহমিনা কেই আনার জন্যে গেছিলো। রাইমা এসেছে,ইনসাফ ও আপাতত ব্যবসার কাজ সেরে বাড়িতেই আছে। তাই একসাথে কিছু সময় কাটালে সবারই ভালো লাগবে এই উছিলাই উনাকে আনা। শুধু শুধুই তুরাকে বিব্রত করেছে ওভাবে!
তহমিনা এসে বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এখানেই ছিলো , এত রাত করে তাকে ফিরতে দেওয়ার ইচ্ছে কারোরই ছিলো না। তবে মাহিদের সকালে ভার্সিটি যেতে হয় বলে উনি ছেলেকে রেখে আর থাকতে চাইনি। দূরত্ব তো বেশি না,আসা যাওয়া তো লেগেই থাকে।

-তোদের দুজনের গল্প হলো? এবার শুতে যা। এই অবস্থায় কিন্তু রাত জাগা একেবারেই ঠিক নয় রাই

রুবি খাতুনের কথা শেষ হলে তুরা রান্নাঘরে থালা বাসন গুছিয়ে এক গ্লাসে দুধ এনে রাইমার সামনে ধরে বলল

-এটা চট করে খেয়ে ফেলো তো আপু,তারপর মা জননীর কথা মতো ফট করে শুয়ে পরবা,একদম অবাধ্য হওয়া যাবে না কিন্তু

শেষের কথাটা টেনে টেনে রসিকতার ছলে বলল,তুরার বাচনভঙ্গি দেখে রাইমাসহ উপস্থিত সকলেই হেসে ফেলল। চুমকিও গালে হাত দিয়ে বলল

-একদম অবাধ্য হওয়া যাইব না কিন্তু আফা,ইমান ভাইয়ে খুব বকা দিবো

বলেই ফিকফিক করে হেসে উঠলো।রাইমা মুখ ফোলালো ওদের কথা শুনে।এ বাড়িতে এসে থেকে ইমান দুই ঘন্টা পরপরই ফোন দেয়, বিকেলেই তো ফোন দিয়ে বলেছে ‘বড়রা যা বলবে মেনে চলবা একদম অবাধ্য হওয়া যাবে না ‘
ব্যস,তুরা পাশেই ছিলো তখন। সেই থেকে এখন অব্দি কম করেও বার দশেক এ বলে পচিয়েছে রাইমাকে

-মা,দেখেছ? দুটোই বড্ড পেকেছে। এদের দুটোরই কান ম লে দেওয়া উচিত

গাল ফুলিয়ে বলল রাইমা, তুরা হাত মুছতে মুছতে আবারও রসাত্মক গলায়ই বলল

-ওমাহ,আমরা তো শুধু বললাম অবাধ্য হওয়া যাবেনা এতে আবার পাকার কি হলো। আর তোমরা বলবে তাতে দোষ নেই আমরা শুনলেই দোষ,হুহ!

বলেই মেকি মুখ ভেঙচালো তুরা,আবারও গল্প শুরু করলো দুজন, চুমকি ও ওদের সাথে বসে থেকে গল্প করলো বেশ অনেকক্ষণ। শেষে রুবি খাতুন তাড়া দিতেই তিনজনেই ঘরের দিকে গেলো। রাত ও অনেক বেড়েছে, একটা বাজতে চলল প্রায়। রাইমার বিছানা গুছিয়ে দিলে রাইমা শুয়ে পরলো। তুরা টুনিকে খুঁজতে বারান্দার দিকে গেলে ওকে পেলো নাহ। ‘এখানেই তো থাকে টুনি,গেলো কোথায়?’ বলে এদিক ওদিক ভালো করে খুঁজতে লাগলেও পেলো না কোথাও৷ আবারও বেরিয়ে এসে নিচে বসার ঘরেও খুঁজে এলো খানিক। কিন্তু কোত্থাও টুনিকে না পেলে মাথায় একটা কথাই এলো

-ও ঘরটাতে যাইনি তো?

কপালে হাত রাখলো তুরা,বারবার মনে হচ্ছে টুনি আহানের ঘরেই আছে। এই টুনিটা প্রচন্ড বেহায়া হয়েছে! ঘুরেফিরে শুধু আহানেরই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। এতো যে বকে কথা শোনায় তাও লজ্জা হয়না ওর,,এই তো কাল ও ওকে সুরসুর করে ঘর থেকে বের করে দিলো আহান,তবুও আবারও ওর কাছেই গেছে নিশ্চয়। রয়ে সয়ে তবুও খানিক এদিক ওদিক দেখে এগিয়ে গেলো তুরা আহানের ঘরের দিকে।
দুপুরে তহমিনার সাথে আসার পর থেকে আর আহানের মুখোমুখি হয়নি। খাওয়ার সময়ে কয়েকবার চোখাচোখি হলেও তুরা বারবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
চোখ দু’টো শুধু বারবার আহানের ঘাড়ের লম্বা সেই আঁচড়ের দাগের উপরেই যাচ্ছিলো। ভেবেছিলো আজ রাইমার সাথেই ঘুমাবে তাহলে আর লোকটার মুখোমুখি হতে হবে নাহ,কিন্তু এই টুনির বাচ্চা টা সব ঘোপালা করে দিল।
মৃদু পায়ে ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে। আস্তে করে নব মুচড়ে দরজা টা খুলতেই একজোড়া তীক্ষ্ণ নজরের সাথে সামনাসামনি চোখ আটকে গেলো। ধপ করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। আহান যেনো তুরার আসার খবর টা আগেই জানতো,তাই এমন তীর্যক চাহনিতে এদিকেই চেয়ে আছে
অপ্রস্তুত হয়ে অস্থিরচিত্তে অবিন্যস্ত পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে গেলো, আহান এখনও নিশ্চুপ। চোখ মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক। তবে নিকষ কৃষ্ণ মণি দুটো স্বজ্জলিত তাকিয়ে আছে স্থির ভাবে। আহানের এহেন জলন্ত দৃষ্টিতে ভড়কে গেলেও হাতের আঙুলে ওড়না পেচাতে পেচাতে এদিক ওদিক তাকালো। খাটের হেডবোর্ডের পেছনে, বারান্দায়,সব জাগায় দেখেও পেলোনা টুনিকে।ললাটে অসংখ্য ভাঁজ পরলো তুরার গেলো কোথায় টুনিটা!
আহান তখনও স্থিরচিত্র দিয়ে তাকিয়ে তুরার দিকে,সোফায় পিঠ এলিয়ে দুহাত ছড়িয়ে বসে আছে,,ঠোঁটটা রহস্যময়ী ভাবে বাকানো,হাসছে কি রেগে আছে তা আড়চোখে তাকিয়ে ঠাওর করতে পারলো না তুরা।

-ম্ মানে,,টুনিকে দেখেছেন?

জড়তা ভেঙে জিজ্ঞাসা করলো তুরা, আহান ভ্রু যুগল নাচিয়ে না বোধক ইশারা করলো। তবে তুরার মন যেনো ক্ষান্ত হলো না৷ আবারও বলল

-টুনিকি এ ঘরে আসেনি?

ঠোঁট উলটে কাধ নাচালো আহান। তার অর্থ হয়তো না বোধক ই হবে, তবে তুরা তার মর্মার্থ বুঝলো নাহ। মনটাও খারাপ করছে ভীষণ। আবারও চারিদিকে নজর বুলালো। মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরতে নিলেই ‘ম্যাও’ করে একটা ডাক কানে আসলো। তড়িৎ চমকিত হয়ে ঘাড় ঘুরালো, আগ্রহী স্বরে আহানকে বলল

-টুনি না? টুনি ডাকলো নাহ?

-কই টুনি?

নির্লিপ্ত স্বরে বলল আহান,তুরা আরও ব্যস্ত হয়ে বলল

-আমি মাত্রই শুনলাম ওর ডাক। এখানেই আছে ও!

বলেই খাটের নিচে বাথরুমে সব জাগায় আবারও খুঁজতে লাগলো, কিন্তু কোত্থাও টুনিকে দেখলো নাহ।স্তম্ভিত হলো তুরা, আবারও মনটা ছোট হলো। সে স্পষ্ট শুনেছিল টুনির ডাক, তাহলে কি ভুল শুনলো? কোথাও গেলো ও?

-পেলে কোথাও?

তুরা ঘাড় নাড়ালো, মন খারাপ হয়ে আসলো ভীষণ। তুরাকে চমকে দিয়ে আবারও ‘ম্যাও’ বলে ডাকটা কানে আসলো। সচকিত হয়ে তাকালো তুরা আহানের দিকে, উতলা হয়ে বলল

-শুনতে পেরেছেন এবার? আমি বললাম তো টুনির ডাক আমি শুনেছি।

বলেই খুঁজতে লাগলো। এক পর্যায়ে আহানের দিকে কেমন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো, ভ্রু কুচকে ললাটে বলিরেখার ভাঁজ ফেলে এগিয়ে আসলো ওর দিকে। কেনো যানি মনে হচ্ছে টুনি এখানেই আছে, জহুরি নজরে আহানের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলে হুট করেই আহানের পায়ের কাছে টি-টেবিলের নিচ থেকে টুপ করে ঘাড় বের করে ‘ম্যাও’ বলে উঠলো টুনি। তুরা উদ্দীপিত হয়ে এক ছুটে গিয়ে টুনিকে কোলে তুলে নিলো।
আহানের দিকে বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে বলল

-আপনি ভীষণ মিথ্যুক। টুনিকে লুকিয়ে রেখে হয়রানি করছিলেন আমায় এতক্ষণ!

আহান উঠে দাড়ালো। পোলোর শার্ট টা হাত দিয়ে টান করলো। ছাই রঙা ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল

-আমি একটাও মিথ্যে বলিনি

-আচ্ছা? আমি যে কতবার জিজ্ঞাসা করলাম টুনি কি এখানে আছে, ওকে দেখেছেন বারবার ই তো নাকচ করে দিলেন। অথচ ও আপনার সামনেই ছিল,এটা কি মিথ্যা নয়?

এক হাত বের করে ভ্রু চুলকালো,স্থবির চেহারায় তুরার দিকে তাকিয়ে মন্থর গলায় বলল

-আমি কি একবার ও মুখে না বলেছি?আমিতো ভ্রু কুচকেছি। এর উত্তর না ও হতে পারে হ্যাঁ ও হতে পারে, তুমি আমায় এভাবে মিথ্যেবাদী বলতে পারো নাহ

আহানের লজিক শুনে তুরা বোকা বনে গেলো, লোকটা ইচ্ছে করে তাকে বোকা বানিয়েছে,হয়রানি করেছে ব্যাপারটা উপলব্ধি করেই তুরা খ্যাপাটে গলায় বলল

-পারি,অবশ্যই পারি। আপনি আসলেই ভীষণ মিথ্যেবাদী, অসভ্য একটা লোক, হনুমান কোথাকার

ফরফর করে বলল তুরা,বেশি উত্তেজিত হয়ে কি দিয়ে কি বলে দিলো সে হিসেব ও করলো নাহ। এবার আহান দুহাত পকেট থেকে বের করে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। ধীরে সুস্থে এক পা এক পা করে তুরার কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। পরিস্থিতি সুবিধার নাহ! হটকারিতায় তুরা যা বলে দিয়েছে তার মাশুল এবার দিতে হবে।
উপস্থিত মস্তিষ্ক এই জানান দিলেই তুরা টুনিকে দু’হাতে চেপে দরজা দিয়ে পালাতে গেলেই আহান খপ করে কোমর চেপে ধরলো তুরার, মোচড়ামুচড়ি করে ছোটার চেষ্টা করলেও ছাড় পেলো না।বেশ খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করেও লাভ হলো না বরং পেছন থেকে সাপের মতো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আহান তুরার শরীর। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আবৃত থুতনি ঠেকিয়ে তুরার কাঁধে রাখলো। হিসহিসিয়ে বলল

-দুদিন ধরে ইগনোর করছ কেনো? সমস্যা কি মেয়ে?

তুরা ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিসের মধ্যে কি বলছে লোকটা?তুরা ভেবেছিলো একটু আগে বলা কথা গুলোর জন্যে হয়তো বকবে,এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে এখন?
তুরার উত্তর না পেয়ে কোমরে মৃদু চাপ দিলো,নিজের দিকে ঘুরালো তুরাকে, টুনিকে এখনো দু’হাতে ঝাপটে ধরে রেখেছে তুরা,আহান সেসবে গ্রাহ্য না করে মাঝখানের দূরত্ব ঘুচানোর চেষ্টায় এগিয়ে এসে বলল

-এসব লুকোচুরি, পালিয়ে বেরানোর কারণ কি? দুদিন সহ্য করেছি এখন আমার জবাব চাই?

তুরা অবিন্যস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকালো। এলোমেলো ভাবে আমতা-আমতা করলো খানিক। কি উত্তর দেবে এটার!নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল

-ছাড়ুন আমাকে

-আগে উত্তর চাই!

তুরার চিবুক বুকে স্পর্শ করলো। মাথা ঝুকিয়েই ভীষণ জড়তা ভরা গলায় বলল

-ল্ লজ্জা লাগছিলো

তুরার কথা শেষ হতে দেরি আহান দু’হাতে তুরার কোমর চেপে উচু করে ধরলো। বিছানার কাছে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজে আধশোয়া হয়ে তুরার উপর উঠলে তুরা খানিক চেঁচিয়ে উঠে বলল

-কি করছেন,টুনি তো গলে যাবে আল্লাহ্

আহান বিরক্ত হলো, টুনিকে এক হাতে চিমটিয়ে ধরে সরিয়ে পাশে রেখে দুহাত তুরার দুই কাঁধের পাশে রেখে ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল

-সবসময় যদি এই টুনিকেই নিয়ে পরে থাকো তাহলে হাবা আর গোবা আসবে কি করে বলো তো?

মুহুর্তেই তুরা বিমূর্ত হয়ে গেলো, নিউইয়র্কে থাকাকালীন তুরাকে রাগাতে আহান ফোনে বাচ্চার নাম জিজ্ঞাসা করলে হাবা আর গোবা বলেছিল রেগে গিয়ে,সেটা ধরেই আহান এরূপ কথাটা বলল।
শরমে তুরার চোখ মুদে এলো,মুখ অন্যদিকে ঘুরাতে নিলে আহান থুতনি চেপে ধরে মুখ এগিয়ে নিয়ে অধর ছুঁয়ে দিলো তুরার অধরে, বেশ কিছুক্ষণ ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভাজে চেপে ধরে শব্দ করে দুটো চুমু খেলো, তুরা বেসামাল নিজেকে সামলাতে না পেরে খামচে ধরলো আহানের শার্ট, আহান মুখ তুলে তাকালো রক্তিম আভায় সজ্জিত তুরার মুখশ্রীতে, ধীমি গলায় বলল

-লজ্জা ভাঙাতে কত কিছু করলাম,এর পরেও যদি লজ্জা পাও তাহলে আর কি করতে পারি তুমিই বলে দাও?

মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে,আর কত লজ্জা দিবে লোকটা! লজ্জায় লজ্জায় তুরা মিইয়ে গেলো পুরোটা। এতটা অসভ্য কি করে হলো আহান!
তুরার গালে মুখ ডুবিয়ে দিলো আহান, নরম গালের পেলব ত্বক ঠিক কতখানি দেবে গেলো তার ধ্যান নেই। ওভাবেই মুখ লাগিয়ে আহান ধীরে ধীরে বলল

-যেমন লজ্জা লাগলে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াও ওমন পচা লজ্জার দরকার নেই। লজ্জা লাগুক আর অন্যকিছু আমার কাছেই আসবে। আমিই সারিয়ে দেবো,,ভেঙে ফেলব তোমার শরমের সকল বাধ

চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো তুরার, ভেতরের বাহিরের ঝলকানি আর শিরশিরানিতে নেত্রকোনা জমে এলো। দুহাতে সমস্ত শক্তিতে জড়িয়ে ধরল আহানের পিঠ,গলা। একই ছন্দে দুজনের হৃদস্পন্দের কাঁপুনিতে স্বর্গীয় ভালো লাগা কাজ করছে।
ওদের দুজনের দিকেই পিটপিট করে চেয়ে আছে টুনি, হয়তো কোনো কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছে নাহ। মৃদু স্বরে হাজারো প্রশ্ন আর কৌতুহল মিশিয়ে আস্তে করে ‘ম্যাও’ বলে ডেকে উঠলো।

_______

এরই মাঝে কেটে গেলো সপ্তাখানেক। আর দিন কয়েকের ভেতরেই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। তুরা হরদমে পড়াশোনা শুরু করেছে, রেজাল্ট এমন তেমন হলে আহান পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙ’বে বলেছে।
আদরের সময় আদর আর পড়ার সময় পড়া, এই কথাটা শুনে তুরার ছোট্ট মনটা ভেঙে গেছে। বারবার মনে পরছে আহানের এই কথাটা, লোকটা কত নিষ্ঠুর হলে এভাবে বলতে পারলো। দশটা না পাঁচটা না একমাত্র বউ তুরা, তাকে কি না পড়াশোনার সাথে তুলনা করবে? তবে তুরাও কম যায় না। সেও পড়বে,পড়ে দেখিয়ে দেবে সে মোটেও ভাঙাচোরা স্টুডেন্ট নাহ

সকাল করে ভার্সিটি এসেও বই খুলে বসেছে তুরা, এইকদিনে লেকচার আর শীট কালেক্ট করে সে অনুযায়ী পড়তে হবে। তাই সব ক্লাসগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে করে। পাশেই ফারিহা বসা, ওর হাতেও বই। তবে হাতে বই থাকলেও মনোযোগ অন্যদিকে, খানিক বাদে বাদেই দরজার দিকে তাকাচ্ছে।

-কাকে খুঁজছিস?

তুরার প্রশ্নে ধ্যান ভাংলো, ওর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো, ছোট জবাবে বলল

-সাদমান

-তাই তো, ও তো দেরি করেনা। আজকে তাহলে এখনও আসলো না কেনো?

-আজকে না, বল কয়েকদিন ধরেই। খেয়াল করেছিস ও মিশে না ঠিক করে?কেমন দেরি করে আসে আবার চলে যায়। ঠিকঠাক কথাবার্তাও বলেনা। জিজ্ঞাসা করলে কিছু না বলে কাটিয়ে দেয়

-হয়তো আন্টির শরীর নিয়ে একটু চিন্তিত, তুই ভাবিস না। ঠিক হয়ে যাবে

তুরার কথায় ও ভঙ্গিমা বদলালো নাহ ফারিহার। বরং আরও জোর দিয়ে ফারিহা বলল

-সেরকম টা মোটেও নাহ। ওর ভাবসাব দেখিস নি? এড়িয়ে চলতে চাই। আবার সেদিন দেখলাম একটা সঙ্গিনী ও জুটিয়েছে, বেশ আলাপ আলোচনা করে দুজনে পড়াশোনা নিয়ে

-তুই ভুল ভাবছিস ইয়ার,ও এমন কেনো..

তুরা পুরোটা শেষ করার আগেই ফারিহা চোখের ইশারায় দরজার দিকে তাকাতে বললে ও ঘুরে তাকাতেই দেখলো সাদমান ঢুকছে,পাশাপাশি একটা মেয়েও হাঁটছে। সাদমান কয়েকটা শীট মেয়েটার হাতে দিলে ও হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে সিটে বসলে সাদমান ও এসে বসলো নিজের আসনে।
তুরা আর কিছু বলল নাহ,ফারিহার দিকে তাকালে দেখল ও চুপচাপ বইয়ের দিকে তাকিয়ে, কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তুরা, দুজনই চুপ করে আছে, এভাবে একেবারেই ভালো লাগছে না ওর।
তবে সে নিয়ে মন খারাপ করার সময় পেলো না। কিছুক্ষণ পরেই ক্লাস শুরু হলো। পরপর চারটা ক্লাস শেষ করে বেরলো সকলে। তুরা আর ফারিহা নেমে আসলে ফারিহা তুরাকে বিদায় দিয়ে নিজেই আগে আগে হেঁটে চলে গেলো। তুরাও উপায়ন্তর না পেয়ে রিকশা ধরলো। আজ আহানের ফিরতে দেরি হবে,এক্সামের সব ঝামেলা সামলাতে ব্যস্ত সে।

চুপচাপ ঘাড় নামিয়ে হাঁটছিলো ফারিহা,রাস্তার বা পাশে চোখ যেতেই দেখলো সাদমান ও হাঁটছে,
হুট করেই মন খারাপের মেঘ জমলো ফারিহার বুকে। কি এমন করেছে সে যে সাদমান তাকে এড়িয়ে চলছে? সে খুব ভালো মতই লক্ষ্য করেছে সাদমান স্পষ্টত তাকেই এড়িয়ে চলে,রিমঝিম কে পড়াতে গেলেও ফারিহার সাথে কথা বলে না,যেনো অপরিচিত দুজন।
নাহ আজকে সে শুনবেই সাদমানের কি হয়েছে, এরকম ব্যবহার কেনো করছে।
রাস্তার দুপাশে তাকিয়ে এক দৌড়ে পাড় হলো। সাদমান তখনও হাঁটছে, পেছন থেকে ডাক শুনেই ঘুরে তাকালো

-এই,দাঁড়া। এভাবে রেস লাগিয়েছিস কেনো হাফ লেগে গেলো

হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ফারিহা,তবে সাদমান তেমন অভিব্যক্তি দেখালো না। চলার গতি বহমান রেখে গম্ভীর গলায় বলল

-তো দৌড়ানোর কি দরকার, রিকশা করে চলে গেলেই হয়

ফারিহার হাসি হাসি করে রাখা মুখটা চুপসে গেলো, মন খারাপের আধার নামলো। তবে এবার আর দমিয়ে রাখলো নাহ। সাদমানের হাত টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল

-কি সমস্যা তোর? এভাবে ইগনোর করছিস কেনো?

সাদমান এক হাতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল

-ইগনোর কেনো করবো। আর আমি ইগনোর করার কে

-ক্লাসে আসিস লেইটে, আসলেও কথা বলিস না ঠিকঠাক, কিছু জিজ্ঞাসা করলেও এড়িয়ে যাস।একা একাই বাড়ি ফিরে যাস।এগুলো কেমন ব্যবহার? এমন একটা ভাব করিস যেনো আমায় চিনিস ই না! নাকি নতুন বান্ধবী নিষেধ করেছে আমার সাথে মিশতে

ফারিহা থামলো। তবে সাদমানের কোনো ভাবান্তর হলো নাহ। নির্লিপ্ত ভাবে বলল

-প্রথমত রোজ রোজ আগে আগে এসে বসে আড্ডা দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আর আমার কথা কম বলা আর বেশি বলাতেও কি, আমি বলা না বলাতে কারো কোনো ফারাক হওয়ার কারণ দেখছিনা। আর যদি বান্ধবী নিষেধ করেও থাকে সেটা আমার পারসোনাল ব্যাপার।

বলেই হাঁটা ধরলো সামনের দিকে,একবার ও পেছনে ফিরে তাকালো নাহ। ফারিহা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সাদমানের এরূপ আচরণ তার ভেতরে ভীষণ ভাবে আঁচড় কাটলো। এমনটা মোটেও আশা করেনি সে!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৫০

দেখতে দেখতে দিন পনেরো দেদারসে কেটে গেলো। তুরার পরীক্ষাও শেষের দিকে। আজকের পরীক্ষা টা দিতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচে।
_টানা কয়েক ঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে বেরলো তুরা আর ফারিহা, ফাইল টা হাতে নিয়ে বেরচ্ছিল,দুজনেই বেশ ক্লান্ত। এ কয়দিনে তুরার সাথে ফারিহাও পুরোদমে পড়াশোনা করেছে,যার দরুন আশানুরূপ ভালই হয়েছে প্রতিটি এক্সাম

-সাদমান কি চলে গেছে?

-তোকে বলেছি না ওর নামটাও আমার সামনে নিবি না?

তুরা ভারি প্রশ্বাস ফেললো। আর ভাল্লাগে না এভাবে, ফারিহা আর সাদমান তুরার জীবনের নিরবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে গেছে।দুজনের সাথে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা,সম্পর্কের গভীরতায় মিশে গেছে ও,এখন ওদের দুজনকে ছাড়া কিছুই আর ভালো লাগে নাহ।
এতগুলো দিন পার হয়ে গেলো,শুরুতে সাদমানের এড়িয়ে যাওয়াতে ফারিহা বেশ মনোক্ষুণ্ণ ছিলো,বার কয়েক চেষ্টা করেছে ওকে বোঝানোর, কথা বলার কিন্তু সাদমান যেনো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে একেবারে,কিছুতেই ধরা দেয়না। অবশেষে ফারিহাও একই কাজ শুরু করলো, দুজন দুজনের সাথে কথা অব্দি বলে না কতগুলো দিন।

-আর কতদিন এমন করবি তোরা? হয়েছে টা কি সেটাই তো বুঝতে পারলাম নাহ

-তো সেটা তোর গুণধর বন্ধুকেই জিজ্ঞাসা কর গিয়ে। অনেক দেখেছি ওর ঢঙ আর নাহ। পেয়েছে টা কি,যা খুশি করুক, ওই একটা ছেমড়ি জুটাইছে না? ওই ফেচুন্নির সাথেই ঘুরুক!

বলেই দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো, তুরাও পা বাড়ালো ওর সাথে। এদের দুজনকে নিয়ে করবে টা কি!
বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেইট থেকে বেরলে সামনে তাকিয়ে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালো না ফারিহা,বরং আরও জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলো, তুরা ওকে কিছু বলবে তার আগেই সাদমান বলল

-আব,,পরীক্ষা কেমন দিলে তুরা?

চোখে মুখে বেশ জড়তা,এক হাতে ফাইলটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে,ফারিহা এগোতে নিলে তুরা হাত ধরে থামালো,তাই গতি থামালেও তাকালো না ফারিহা।

-হ্যাঁ ভালোই দিয়েছি,তোমার কেমন হলো

-ভালো

ছোট জবাব সাদমানের,মুখাবয়ব জুড়ে অস্বস্তি, আর দোমনা ভাব, বার দুয়েক ফারিহার দিকে তাকালো আড়চোখে, কিন্তু ফারিহা ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করে সাদমান বলল

-এখন কি বাড়িতেই ফিরবে?

-এসব আজাইরা পেচাল তাড়াতাড়ি শেষ কর,বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে

তুরার জবাবের আগেই খিটমিট করে বলল ফারিহা, সাদমান তাকালো কিঞ্চিৎ চোখ ঘুরিয়ে, সে চোখে স্পষ্ট দুঃখ, ক্লেশের ছাপ। কিছু একটা বলতে নিলেও বলল নাহ যেনো।এরই মাঝে আবার একটা বাইক এসে থামলো ওদের সামনে,
টি-শার্ট আর নরমাল প্যান্ট পরা বেশ লম্বা চওড়া একটা ছেলে, ওকে দেখতেই ফারিহা গাল প্রসারিত করে হাসলো, তুরার দিকে তাকিয়ে বলল

-আমি তাহলে গেলাম তুরা,সাবধানে ফিরে যাস কেমন?

বলেই কালো রঙের বাইকটাতে চড়ে বসলো, আগন্তুক ছেলেটার কাঁধে হাত রাখতেই সাঁই করে বাতাসের বেগে তাল মিলিয়ে চলে গেলো দৃষ্টি সীমানার বাহিরে।
সাদমান নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলো ফারিহার যাওয়ার পানে,খানিক চেয়ে চট করে চোখ ফিরিয়ে নিলো, তুরার দিকে তাকাতেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসলো মৃদু,তবে সেটা যে জোরপূর্বক হাসি তা চক্ষুগোচর হলো না তুরার,তবুও মুখে কিছু বলল নাহ।

-আচ্ছা তুমি আর দেরি করো না,আমিও আসি হ্যাঁ?

বলেই সৌজন্যবোধ দেখানো ভাবে হেসে পা বাড়াতে নিলে তুরা ওকে থামিয়ে বলল

-সাদমান? একটু দাঁড়াও

পা থামিয়ে তাকালো সাদমান,চোখে কিঞ্চিৎ কৌতূহল আর ঠোঁটে বিস্তর অস্বস্তি নিয়ে তাকালো। তুরা ওর দিকে চেয়ে কোনো রকম জড়তা ছাড়া স্পষ্ট করে বলল

-তোমার সাথে কিছু কথা আছে,তোমার কি সময় হবে?

-হ্যাঁ বলো না কি বলবে

সাদমান তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলল,তুরা খানিক এগিয়ে এলো। রাস্তার পাশে নিরিবিলি একটা স্থানে দাঁড়ালো। সাদমান ও সাথে আসলে তুরা বলল

-তোমার কি হয়েছে বলো তো? বেশ কিছুদিন ধরেই দেখলাম তুমি বেশ আনমনা থাকো। আমাদের সাথে ঠিক করে কথা বলো না,স্পষ্টত এড়িয়ে চলো। ফারিহা বার কয়েক বলেছে আমায়,তোমার সাথেও কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তুমি ওকে ও এড়িয়ে গেছো। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো একটু স্ট্রেসে আছো, বা আন্টির জন্য টেনসড। কিন্তু এতগুলো দিন পার হয়ে গেলো এখনতো ফারিহাও একই রকম ব্যবহার শুরু করেছে তাই আমি জোর দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হচ্ছি,আসলে কি হয়েছে তোমাদের?

সাদমান নিঃশব্দে শুনলো তুরার কথা, মুখাবয়বে বিস্ময় প্রকাশ না হলেও তুরার প্রশ্নে সে বেশ ইতস্তত বোধ করছে সেটা ওর চোখেই দৃশ্যমান। তবুও তুরা আর চুপ করে রইলো নাহ। আবারও বলল

-তোমার এহেন আচারণের কারণ টা কি জানতে পারি? নাকি ফারিহার কথায় সত্যি ধরে নেবো যে আমাদের সাথে থাকতে তোমার আর ভাল্লাগে নাহ,বিরক্ত হও তুমি?

সাদমান হকচকালো। অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকালো চট করে বলল

-না না কি বলছো,এমনটা আমি ভাবতেও পারিনা। তুমি তো জানো আমি তোমাদের ছাড়া কারো সাথে ঠিক করে কথাটাও বলতে পারিনা,আমার লাইফে মা আর ছোট বোন বাদে তোমরাই আছো,এমনটা ভুলেও নাহ।

খানিক থেমে নিজেই আবারও বলল

-আর ওই তিথি তো শুধু নোটস নেওয়ার জন্যে আমার সাথে দুদিন দেখা করেছিলো,এ বাদে ওর সাথে তেমন কিছুই না

শেষের কথাটা খানিক গলার স্বর নামিয়েই বলল।
তুরা আবারও সাবলীল স্বরে জিজ্ঞাসা করলো

-তাহলে এহেন আচারণের কারণ? আর এড়িয়ে চলাটা ফারিহার ক্ষেত্রেই বেশি করছ,তোমার ব্যবহার ও বেশ আহত,মুখে না বললেও স্পষ্ট বোঝা যায়

সাদমান মাথা ঝুকিয়ে নিলো। উত্তর দিতে যেনো অনিহার থেকে জড়তা বেশি৷ কথার মার প্যাচ ধরতে পারছে না, খানিক আমতা-আমতা করলো অস্থিরচিত্তে। তুরা ওর চেহারা টা ভালো মতো পরখ করলো,কি বুঝলো ওই জানে সাদমানের জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে বলল

-সমস্যা থাকলে থাক,উত্তর দিতে হবে নাহ। আমি কথাগুলো এভাবে বলতে চাইনি,তবে তোমাদের দুজনের হুট করেই এমন গুটিয়ে যাওয়ায় আমিও অনেক দুঃখ পাচ্ছি। ভার্সিটিতে বন্ধু বলতে তোমরা দুজনই।
থাক আজকে আসি এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেকটা।

কিছু একটা বলতে গেলেও বলল না তুরা,অদ্ভুত একটা জড়তা কাজ করলো। ফাইলটা হাতে ধরে এগোতে নিলে পেছন থেকে সাদমানের ডাকে থেমে গেলো

-তুরা?

ঘুরে দাঁড়ালো।কিঞ্চিৎ ভ্রু উচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে তাকালে সাদমান আমতা-আমতা করে বলল

-ওই ছেলে টা কে ফারিহা যার সাথে গেলো?

মুখভর্তি জড়তা ঘিরে ধরলো সাদমানকে। এইটুকু প্রশ্ন করতেই যেনো মিইয়ে যাচ্ছিলো। তুরা স্থির তাকিয়ে রইলো খানিক।

-বলেছিলো তো ওর কোনো কাজিন এসেছে। হয়তো সেই হবে

ছোট জবাব দিলো তুরা,সাদমান আর কথা বাড়ালো না। তুরাকে বিদায় দিয়ে নিজেও হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে, তুরা সাদমানের যাওয়ার পানে আহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। মাথার ভেতর তার কিছু একটা চলছে,হয়তো স্পষ্ট নাহ।তবে খুব গোজামিলে কিছু!

-বুড়ি,এখানে কি করছিস?

সুপরিচিত কণ্ঠস্বরে ঘুরে তাকালো তুরা, ফাইলটা এক হাতে চেপে এগিয়ে গেলো হাসি মুখে।

-এইতো একটু কাজ ছিলো। তুমি কি এখন বাড়ি ফিরবে ভাইয়া?

মাহিদ হাতের ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চাবিটা বের করলো। এগিয়ে যেতে যেতে বলল

-হ্যাঁ, তবে তার আগে তোকে বাড়িতে ছেড়ে আসি চল

তুরাও দ্বিমত করলো নাহ। গাড়ির দরজা খুলে বসতে বসতে বলল

-আজকে তাড়াতাড়ি ফিরছো যে?

-হ্যাঁ আজ তো লাস্ট এক্সাম,আর ডিউটি ও ছিলো না আমার।

গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তুরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, খানিক ক্ষীণমতি হয়ে বলল

-মানে আজকে কি সবারই তাড়াতাড়ি ছুটি?

মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো একবার তুরার কৌতুহলী চেহারার দিকে, গাল ছড়িয়ে হাসলো

-সরাসরি বল না,তোর বর কখন ফিরবে সেটা জানতে চাইছিস

অপ্রস্তুত হলো তুরা,বেশ লজ্জাও পেলো। যতই হোক বড় ভাইয়ের সামনে এভাবে উনার কথা জিজ্ঞাসা করতেও কেমন লাগে। তবুও কপট রাগ দেখিয়ে বলল

-মোটেও না,আমিতো এমনিতেই জিজ্ঞাসা কিরলাম

-হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তো। তোর বরের আজ ফিরতে দেরি হবে। ডিপার্টমেন্ট হেড বলে কথা,প্রফেসর সাহেবের আজ কাজ বেশি

ঠোঁট গোল করে ও বলল তুরা, তারপর চুপ করে কিছু একটা ভাবতে লাগলে মাহিদ বলল

-সমস্যা নেই,কাল থেকে ফ্রী আছে তোর বর, আঁচলে বেঁধে রাখিস মন মতো

তুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো, লজ্জায় গাল গরম হলেও রাগ দেখিয়ে মাহিদের বাহুতে দুটো চা পড় বসিয়ে দিয়ে বলল

-তুমি প্রচন্ড বাঁদর ভাইয়া,খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু

হাহা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মাহিদ। তুরাকে আর ঘাটলো নাহ। মাঝ রাস্তায় একবার গাড়ি থামিয়ে পানি কিনে আনলো তুরার জন্যে। তারপর একবারে তুরাকে বাড়িতে রেখে আবারও ফিরে আসলো।

•••

ড্রয়িং রুমে বসে চিপস খাচ্ছে আর মুভি দেখছে তুরা আর রাইমা। চুমকি ফ্লোরে বসে সবজি কাটছে আর হা করে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে।
সময়টা প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সোফাতে বসে পা দুলাচ্ছে আর টিভি দেখছে তুরা। টি-টেবিলের উপর কফি আর ড্রাই ফুড ও রাখা।
আহান ফিরেছে সন্ধ্যার দিকে এসে নাস্তা করে ঘুমিয়েছে। তুরা একবার গেছিলো সন্ধ্যার দিকে, ডাকতে চেয়েছিলো তবে কি মনে করে ডাকেনি, লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা সে,আহান যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক তুরা কিছুতেই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। আহান যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকলেও তুরার ভাব ভঙ্গিতে বেশ জড়তা। আহানকে দেখলে আগে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হত,কিন্তু এখন লজ্জা লাগে,শুধুই লজ্জা লাগে, হৃদযন্ত্রে ধুকপুক আওয়াজ হয়,মনে হয় আহানও হয়তো শুনে ফেলবে সেই শব্দ।

হঠাৎ করে দরজার বেল বেজে উঠতেই ধ্যান ভাংলো। রান্নাঘর থেকে রুবি খাতুনের গলা ভেসে এলো

-চুমকি দেখ তো মা কে এসেছে।

তুরা উঠতে গেলেও চুমকি ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই গিয়ে খুলল, দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো এক মহিলা
দেখতে মাঝ বয়সীদের চেয়েও একটু বেশিই বয়স্ক। মোটাসোটা গড়নের। ভেতরে ঢুকেই এদিকে এগিয়ে আসলো, রাইমাকে দেখে বলল

-তুমি রাইমা না?

-জ্বি হ্যাঁ

খানিক হেসে উঠলো রাইমা। মহিলা আবারও বলল

-আমাকে চিনতে পেরেছ তো? আমি ওই তিন নম্বর গলির ফ্ল্যাটেই থাকি

-হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, আপনি তো এর আগেও দুদিন এসেছিলেন আমাদের বাসায়

ভদ্রমহিলা যেনো খুশি হলো বিস্তর। সোফাতে বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে বসে খোশমেজাজে বলল

-আগে তো এদিকে আসতাম প্রায়, হাঁটুতে যা ব্যথা বেড়েছে হাঁটতে পারিনা ঠিক করে, উঠতে গেলেই চিনচিন করে ওঠে। আর বাড়ি থেকেও বেরই না তেমন। আজ কি মনে করে হাঁটতে বেরিয়েছি একটু আর সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তাই ভাবলাম এত দূর যখন এসেছিই তোমাদের সাথে দেখা করে যায়।

একদমে কথা গুলো বলল মহিলা, এর মাঝেই রান্নাঘর থেকে রুবি বেরিয়ে এলে উনাকে দেখে বলল

-আরে আপা,কেমন আছেন? এতদিন পর যে!

-এই আছি ভালো মন্দ দিয়েই। এতদিন পরেই আসলাম, কি আর করবো অসুস্থ হয়ে গেছি এখন আর সিড়ি বেয়ে চারতলা থেকে নামতে ইচ্ছে করে না আর এদিকেও আসা হয়না। আজকে এলাম তাই ভাবলাম একটু দেখা করে যাই

-যাক,ভালো করেছেন। আপনি এসেছেন খুব ভালো লাগলো। চুমকি আপার জন্য চা করে আন

রুবির কথার চুমকি মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো। রুবি এগিয়ে এসে বসতেই ভদ্রমহিলা বলল

-তা আহান বিয়ে করেছে শুনলাম। ফ্ল্যাটের এক ভাবি বলছিলো। ওর বউ কই? আহানের বউকে দেখতেই তো এলাম

রুবি সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ালো। তুরাকে দেখিয়ে বলল

-ও তুরা, আহানের বউ

মহিলা এতক্ষণে তুরার দিকে তাকালো। এসে থেকে নিজেই বকবক করে যাচ্ছিলো।
তুরাকে দেখতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালো। চুমকি চা নাস্তার ট্রে এনে সামনে রাখলে মহিলা নিজে থেকেই চায়ের কাপ তুলে নিলো।
রুবি ইশারা করলে তুরা এসে বসলো পাশে।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে আছে চুপচাপ, ভেতরে ভেতরে খুব অস্বস্তি হচ্ছে,কারণ যখন থেকে রুবি বলেছে তুরা আহানের বউ তখন থেকেই কেমন করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রাইমাকে উদ্দেশ্য করে বলল

-বাবাহ,রাইমাও তাহলে মা হতে চলেছে। বাহ বাহ,খুব ভালো লাগলো, বেঁচে থাকো

তুরা খানিক হতবাক হলো। মহিলার কথাবার্তা কেমন অদ্ভুত লাগছে। কেমন জেনো মুখের উপর সব বলে দেওয়া পাবলিক টাইপ।
অবশ্য রাইমার দৈহিক গড়নের পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা,ফুলে ওঠা পেট দেখে যে কেও ই বলে দিতে পারবে সে সন্তানসম্ভবা। সাথে অনেক গুলুমলু ও হয়েছে, তুরার তো ইচ্ছে হয় বারবার রাইমার গাল দুটো টেনে দিতে।

-তা তোমার কি খবর,বিয়ে তো হয়েছে অনেকদিন ই শুনেছি

তুরা চকিত হয়ে তাকালো, উনার কথার কি জবাব দিবে বুঝতে না পেরে এলোমেলো ঘাড় দুলালো। মহিলা তার ভারি গলায় বলল

-তাহলে তুমি সুখবর কবে দিচ্ছ? বাচ্চা নিয়ে ফেলবা তাড়াতাড়ি, আজকাল কার পুরুষের ঘরে বউ থাকতেও বাইরে ছো মারার অভ্যাস আছে, যদিও আহান মোটেও সেরকম ছেলেদের মধ্যে পরেনা। তবুও স্বামীকে নিজের হাতে রাখার ফরমুলা হলো বাচ্চা। তাইলে স্বামী সবসময় ঘরমুখো ই থাকবে।

তুরার লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে,ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যায় নয়তো এখান থেকে পালিয়ে যাই। শ্বাশুড়ি ননদের সামনে এধরণের কথা শুনে তাকাতে পারছে না মুখ তুলে৷
রুবি খাতুন অপ্রস্তুত হাসলো, এই মহিলার কথা পারার সকলেই জানে, যাকে তাকে যা তা বলে দেয়। কার বাড়ি কি হলো কার সাথে কার বিয়ে হলো কে চলে গেলো এসবের খবর রাখাই তার একমাত্র কাজ যেনো।

-তা আপনার বাড়ির সবাই কেমন আছে, সব ভালো তো?

রুবি খাতুন জিজ্ঞাসা করলো, উনিও তুরাকে আর কিছু না বলে গল্প শুরু করলো রুবির সাথে, হাফ ছেড়ে বাঁচলো তুরা। মহিলা আরও ঘন্টা খানেক গল্প করে তবে বেরলো,তবে যাওয়ার আগে তুরাকে ডেকে বলেছে

-শোনো মেয়ে, যে যাই বলুক তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে ফেলবা বুঝছ? তাহলে স্বামী আঁচলে আঁচলে থাকবে,যা বলবা শুনবে। আদর সোহাগ করতে এলে একদম বাঁধা দিও না কেমন? মনে রেখ স্বামীর এর ভালোবাসা বেশি বেশি পেতে হলে বাচ্চা দিতে হবে

তুরা শুধু ঘাড় নাড়িয়েছে প্রত্যুত্তরে, কেমন কঠিন কঠিন কথা বলে গেলো,শুরুতে লজ্জা পেলেও পরে মনে হলো একেবারেও খারাপ বলেনি মহিলা।
তবে সেসব আর বেশিক্ষণ মাথায় রাখলো না, আবারও টিভি দেখতে শুরু করলো রাইমার সাথে।

•••

থপ করে ফোনটা খাটের উপর রাখলো আহান,বেশ বিরক্ত লাগছে। তুরা মেয়েটাকে হাতের কাছে পাওয়াই যাচ্ছে না। এমনিই তো আসতে চাইনা আবার রাইমাকে পেয়ে সারাদিন ওর গলায় গলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাত এগারোটা বেজে গেছে অথচ ঘরে আসার নাম নেই। খানিক বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো, ঘর থেকে বেরিয়ে রাইমার ঘরের দিকে গেলে দরজাটা আধখোলা দেখে নক করলো দরজায়।

-কে আহান,আই ভেতরে আই

রাইমার গলা আসলো ভেতর থেকে, আহান দরজাটা পুরো খুলে ঘরে ঢুকলে দেখলো রাইমা খাটে বসে ফোন টিপছে আর তুরা পাশেই শুয়ে আছে, শুয়ে বললে ভুল হবে ও তো ঘুমিয়ে আছে। আহান ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো,তাকে অপেক্ষায় রেখে ঘুমানো হচ্ছে এখানে আরামে! ঘুমানো বের করছি।
চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে এগিয়ে গেলো সামনের বুকসেলফের দিকে,বেশ কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে একটা বই বের করলো। বইয়ের পৃষ্ঠা খুলতে খুলতে আড়চোখে তাকাল রাইমার দিকে,
ও অন্যদিকে ঘুরে ফোন টিপটে ব্যস্ত, আহান পা টিপে আস্তে করে তুরার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কোমরে সজোরে একটা চিমটি দিয়ে তড়িৎ বেগে আবারও সরে আসলো
ঘুমের মাঝে পেটের কাছে খুব জোরসে লাগায় হুড়মুড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো তুরা

-বাবাগো,মাগো আমার পেট ফুটো হয়ে গেলো গো..

তুরার আকস্মিক চিৎকারে ভড়কে গেলো রাইমা। ফোন রেখে ব্যস্ত স্বরে তুরাকে বলল

-কি হয়েছে তুরা,কি হলো চেঁচাচ্ছিস কেনো?

তুরা এখনো আহানের চিমটি দেওয়া জাগায় হাত দিয়ে ডলছে, খুব জোরেই লেগেছে,ইস ফুটো হয়ে গেলো পেট টা। আহানের ভীষণ হাসি পেলো তবুও ঠোঁট চেপে স্বাভাবিক গলায় বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল

-কি সমস্যা, এভাবে মাঝরাতে চেঁচাচ্ছ কেনো তুমি

আহানের ধমকানির স্বরে তুরা অসহায় চোখে তাকালো ওর দিকে, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল

-আমার পেটে পিঁপড়ে কামড়ে দিয়েছে, খুব জোরে কামড়েছে ফুটো হয়ে গেলো আমার পেট

বলেই ভ্যা করে কেঁদে উঠলো, তুরার কান্না দেখে রাইমা বেশ অস্থির হয়ে এগিয়ে গেলো, ওকে ধরে বলল

-কোথায় লেগেছে দেখি, থাক কাঁদিস না বোন ঠিক হয়ে যাবে, আমিতো বিছানা ঠিক করেই ঝেরেছি,পোকা তো দেখতে পেলাম নাহ

আহান এবার ওদের কথার মাঝে বলল

-ভুলভাল স্বপ্ন দেখেছে হয়তো, ওর তো অভ্যাস আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে ভূত ওর পায়ে সুরসুরি দিয়েছে, আজ আবার পিঁপড়ের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।

রাইমার হাসি পেলেও মুখ টিপে রাখলো, বেচারি কিভাবে কাঁদছে ও হাসলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। তুরাকে শান্তনা দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আহান বলল

-নিজে তো রাতভর হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করবা আবার ভুলভাল কথা বলে অন্যের ঘুমটাও হারাম করবা

তুরার ভীষণ মন খারাপ হলো, সত্যিই পিঁপড়ে কামড়েছে তাকে,এখনো ব্যাথা করছে,জায়গা পেটে না হলে তো দেখিয়ে দিতো নিশ্চিত লাল হয়ে গেছে!
খানিক মুখ ভার করে বসে ভাবলো তবে তার ঘুমানো একেবারেই সুবিধার নয়, হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করার অভ্যাসটা খুব তার, এমতাবস্থায় যদি রাইমার কোথাও লেগে যায়? ঘুমু ঘুমু চোখে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো তুরা

-আপু আমি বরং ও ঘরেই ঘুমাই,তুমি থাকো হ্যাঁ

বলেই ঢুলতে ঢুলতে বেরিয়ে গেলো। আহার ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বইটা ভাঁজ করে নিজেও বেরিয়ে গেলো
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️