#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব-৫৫
চোখে মুখে চরম অস্বস্তি নিয়ে খাটের এক কোণায় বসে আছে তুরা, নেভি ব্লু রঙের শাড়িটার আঁচল হাতের আঙুলে পেঁচিয়ে যাচ্ছে অনবরত। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এগারোটা বেজে ছাব্বিশ মিনিট, পুরো ঘরটাতে ফুলের গন্ধে মো মো করছে। পাশেই বউ সেজে বসে আছে প্রিয়তা নামের মেয়েটা। প্রিয়তা ফুয়াদের বউ। দেখতে খুব বড় মনে হয়না, ছোট খাটো গোলগাল মায়াবী চেহারা। বেশ মানাবে ফুয়াদ ভাইয়ার পাশে।
-উফ,এই ভাইয়ারা সবাই কোথায় গেল, আমাকে দুই মিনিট বলে বসিয়ে সব উধাও। ভাবি তুমি নতুন ভাবির পাশে বসো আমি দেখে আসি একটু
বলেই উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল রুহি। তুরা প্রত্যুত্তর করল নাহ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পাশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে। এই শীতল পরিবেশের আবহাওয়া তেও ঘামছে মৃদু, আর হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিচ্ছে বারংবার। চেহারায় কেমন অস্থিতিশীল ভাব। তুরা বুঝতে পারছে ওর ব্যাপারটা। এগিয়ে গিয়ে কাছাকাছি বসল, কাঁধের উপর হাত রেখে বলল
-মন খারাপ করছে? কিছু লাগবে তোমার?
মেয়েটা ঘনঘন মাথা নাড়াল। তুরা আবারও বলল
-পানি খাবে?
আবারও না সূচক ঘাড় নাড়াল মেয়েটা। কিন্তু তুরা সেদিকে না দেখে গ্লাস থেকে পানি ঢেলে ওর সামনে ধরলেই ফট করে নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের পানি শেষ করে ফেলল। তুরা আবারও ওর কাছে বসে বলল
-এত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি ভয় পাচ্ছ কেনো?
মেয়েটা আড়চোখে একবার তাকাল তুরার দিকে তারপর আবার মাথা ঝুকিয়ে নিল। তুরা ওর গালে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে ঘোমটা টা একটু সরিয়ে দিল
-এখন ঘরে কেও আসবে নাহ। তুমি এভাবে থাক তাহলে একটু বেটার লাগবে। আর আমি তুরা,ফুয়াদ ভাইয়ের ভাবি হই। তোমার বোনের মতই আমি। কোনো প্রবলেম হলে আমাকে নিঃসংকোচে বলবে, কোনো জড়তা রাখবে না কেমন?
মেয়েটা হালকা হেসে ঘাড় কাত করল। এবার যেন একটু সহজ হলো। তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার বিয়ে হয়েছে কত বছর?
-বছর নাহ, এগারো মাস একুশ দিন হলো
হালকা হেসে বলল তুরা, মেয়েটি কিছু একটা ভেবে আবারও জিজ্ঞাসা করল
-আপনি কি আহান ভাইয়ের বউ?
সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়াল তুরা। প্রিয়তা এবার আরও জড়তা কাটিয়ে তুরার দিকে ঘুরে বলল
-হ্যাঁ উনি বলেছিল ফোনে আপনাদের কথা।
-আচ্ছা? কি বলেছে?
-এই যে আহান ভাই আর উনি প্রায় সমবয়সী, ওই ভাইয়া প্রফেসর আর..
-ভাবি ফুয়াদ ভাই এখনি চলে আসবে। খালা তোমাকে ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল
প্রিয়তার কথার মাঝেই তনু এসে পরায় ও চুপ করে গেল, তুরা আসছে বলে তনুকে যেতে বলে প্রিয়তার হাত ধরে বলল
-তুমি ভয় পেয়ো না হ্যাঁ? ফুয়াদ ভাই এখনি চলে আসবে। আর শোনো বড় বোন হিসেবে একটা কথা বলছি, এ বাড়ির প্রতিটি মানুষই অসম্ভব ভালো। ফুফ আম্মা একটু কড়া করে কথা বললেও উনার মন আরও ভালো। তুমি শুধু একটু উনার পছন্দ মতো থাকবে,উনি তোমাকে মাথায় করে রাখবে। এ বাড়িতে কখনো তোমার কোনো অসুবিধা হবে না বুঝলে
মেয়েটা এবার স্পষ্ট হেসে ঘাড় কাত করল। ওকে ঘরে বসিয়ে বেরিয়ে এল তুরা।
বউ নিয়ে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। এসে খাওয়া রেস্ট সেড়ে বউ ঘরে এনে সব গোছগাছ করতেই অনেকটা রাত হয়ে গেছে। এখন বাড়ি ঘর প্রায় ঠান্ডা।
তুরা গিয়ে মিনুর সাথে দেখা করে এলো। উনি এখনো ঘরে বসে জিনিস গোছগাছ করছে। তুরা সাহায্য করতে গেলে জোর করে বের করে দিল বলে ‘বাবুর কি দরকার সেটা দেখ,আমাকে সাহায্য করতে হবে নাহ,আর শুয়ে পরো তাড়াতাড়ি আজ অনেক ধকল গেছে ‘
তুরাও বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়িয়ে চলে এসেছে। কিন্তু চলে তো এসেছে এখন যাবে কি করে! আজকে বিকেলে ফুয়াদ ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির ঘটনা টা মনে পরে গেল ওর
~খাওয়া দাওয়া শেষে তুরা একাই ঘুরছিল বাড়িটাতে, সৌজন্যের খাতিরে অনেকের সাথে পরিচয় ও করেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে যখন ও চলে আসছিল এক মাঝবয়েসী মহিলা ডাকল পেছন থেকে
-তোমার নাম কি?
-তাকওয়াতুল তুরা
-তুমি তো ছেলে পক্ষের তাই তো?
-জ্বি
-আমার নাম রাহেলা বানু। আমি প্রিয়তার বড় ভাবির ননদের শাশুড়ী
তুরা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইল খানিক। ও তো এখনো ফুয়াদ ভাইয়ের বউ টাকেই ঠিকঠাক দেখতে পারল নাহ। আর এ কোন ভাবির ননদের শাশুড়ী আসল। তবুও মেকি হেসে ঠোঁট গোল করে ও বলল।
-আচ্ছা সে যাই হোক। তোমার বাবা আসেনি? তাদের তো দেখছি না?
-জ্বি না বাবা মা আসেনি
-তাহলে আমাকে তোমার নাম্বার দাও তো
ভদ্রমহিলার এরূপ কথায় বেশ ভড়কে গেল তুরা। এ আবার কেমন মহিলা! দুটো কথা বলেই নাম্বার কেন চাচ্ছে। আমতা-আমতা করে বলল
-আমার নাম্বার কেন?
-শোনো আমি ওত ভনিতা করেকথা বলব না। যা বলার সরাসরি বলছি। তোমাকে দেখে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার বোনের ছেলের জন্য অনেকদিন ধরেই মেয়ে খুঁজছে। তাই তোমাকে ওর জন্য চাইতাম। বাবা মা যখন আসেনি তোমাকেই বলছি, আমার বোনের ছেলে খুব ভালো জাগায় চাকরি করে তুমি খুব ভালো থাকবে
আগামাথা না শুনেই মহিলা হড়বড় করে বলে দিল। তুরার চোখ কপালে, এখন ভাবছে আহান ভুল বলেনি। এই বিয়ে বাড়িতে আসা মহিলা গুলো চলমান শাদি ডট কম হয়। দেখেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিল! তবুও বিস্ময় দমিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল
-দেখুন বাবা মা তো আসেনি তবে আমার স্বামী এসেছে। আপনি চাইলে তার সাথে কথা বলে দেখতে পারেন
হাসি হাসি মুখ করে বলল তুরা। তুরার কথা শুনে মহিলা খানিক মোটা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল। বার কয়েক পলক ঝাপটে বলল
-এই মেয়ে,কি যা তা বলছ। স্বামীর সাথে কথা বলব মানে?
-হ্যাঁ, বাবা মায়ের পরে স্বামী ই তো গার্জেন হয় তাই না?
-তুমি বিবাহিত?
-হ্যাঁ, একদম নির্ভেজাল টাইপ বিবাহিত
তুরার রম্য করে বলা কথায় মহিলার যেন বিশ্বাস হচ্ছে নাহ। নিশ্চয়ই তার সাথে হেয়ালি করছে মেয়েটা! তিনি জোর গলায় বলল
-কই তোমার বর,ডাকো তাহলে।না দেখলে বিশ্বাস করব না
তুরা মেকি অবাক হওয়ার ভান ধরল। চোখ কুচকে বলল
-সেকি,আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না! ওকে এক মিনিট
বলেই এদিক ওদিক তাকালে অদূরেই আহানকে দেখতে পেল। ভীড়ের মধ্যে কিছু খুঁজছে যেন। তুরা এক হাত উচিয়ে আহানকে ইশারা করে ডাকল। আহান ওর দিকে আসতে লাগলে তুরা আরও দ্বিগুণ ঢং করে বলল
-ওই দেখুন আসছেন উনি। আমাকেই খুঁজছিলেন এতক্ষন। আসলে এই উনিটা এত দুষ্টু হয়েছে না আমাকে না দেখে দুই মিনিট ও থাকতে পারেনা। সারাদিন বউ বউ করে বেড়ায়। আমিও কিছু বলিনা এত সুইট,কিউট,কুচুপুচু,সনুমনু চকলেট, অরেঞ্জ,রেড ভেলভেট ফ্লেভার পেস্ট্রি কেক টাইপ জামাই থাকলে তাকে কিছু বলা যায় বলুন! ওকে দেখলেই তো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে যা সুস্বাদু না উনিই!
একেবারে হাত নাড়িয়ে ঢং করে বলল তুরা।মহিলা চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে তুরার দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কথার আগামাথা তো কিছু বোঝেই নি বরং মাথায় গোলমাল হয়ে গেছে তুরার কথা শুনে। তুরার দম ফাটা হাসি পাচ্ছে কিন্তু জোর করে আটকে আরও কিছু বলতে যাবে তখনই আহান একদম কাছাকাছি এলে তুরা আহানের কাছে এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-ওগো শুনছেন,দেখুন না এই ইনি হলো ভাবির ভাবির ননদের শাশুড়ী। ইনি তার বোনের ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চান,আপনি বলুন তো এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি
বলেই আহানের দিকে তাকাতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। এই রে এবার বারাবাড়ি রকমের হয়ে গেল! আহান প্রথমে সৌজন্যতা নিয়ে থাকলেও এখন চোখ মুখ শক্ত করে আছে। মহিলা আহানের এরূপ রূপ দেখে হয়তো ভড়কে গেছে তড়িঘড়ি করে সরে যেতে যেতে বলল
-কি যানি বাপু, এত বাচ্চা একটা মেয়েই যখন বিয়ে করেছে একটু কাছে কাছে রাখলেই পারে। শুধু শুধু এতগুলো সময় নষ্ট হলো আমার
বলেই মোটা শরীর নিয়ে হেলতে দুলতে চলে গেলেই আহান তুরার হাত চেপে ধরল। আশেপাশে তাকিয়ে তুরার কাছে এসে বলল
-তুমি বড্ড ফাজিল হয়ে গেছ তুরা, খুব জ্বালাচ্ছ আমাকে। বাসায় চলো তারপর দেখাচ্ছি আমি কোন ফ্লেভারের পেস্ট্রি কেক টাইপ
~
ভাবতে ভাবতেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল তুরা। একটু আগেই আহানকে দেখেছিল বউয়ের বাড়ি থেকে আনা জিনিস গুলো বিহান আর আরমানকে সাথে নিয়ে এক এক করে ভেতরে এনে রাখছেন। এখন তো সবাই ঘরে চলে গেছে কাজ সেরে উনি কোথায় তাহলে?
আস্তে করে দরজাটা আলগা করে দেখল আহান খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছে কপালের উপর এক হাত রেখে। তুরা খুব সাবধানে সন্তপর্ণে পা ফেলে ভেতরে এল যাতে আহান টের না পাই। ক্লান্ত আছে ঘুমিয়ে যাবে। আস্তে করে পাশের আলনার উপর থেকে সুতির শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরল। মিনিট দশেক ব্যায় করে গোসল করে শাড়ি পালটে বেরলে দেখল আহান একই ভাবে শুয়ে আছে। তুরা তোয়ালে টা হাত থেকে রেখে দাঁড়িয়ে পরল চুপচাপ।
লোকটা ঘুমিয়ে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, বুকের ভেতর দুরুদুরু কম্পন শুরু হয়েছে, কেন যানি আহানকে আজও ভীষণ ভয় লাগে তুরার, ওর কাছাকাছি থাকলে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জেঁকে ধরে ওকে। তার উপর তিখন যেভাবে বলল
-কি হলো ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি কি উঠে আসতে পারব না?
প্রচন্ড শীতল কণ্ঠে গায়ে কাটা দিয়ে উঠল তুরার। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। পেছনে ঘুরে তাকাতে দেখল দরজার ছিটকিনি তুলে দেওয়া। সে তো লাগাইনি,তার মানে আহানই উঠে লাগিয়েছে দরজা টা!
-এখানে আসতে বলছি,আমি উঠে গেলে ভালো হবে না তোমার জন্য
তুরা ভদ্র মেয়ের মতো এগিয়ে গিয়ে বসল আহানের পাশে। ভয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। আহান চোখ থেকে হাত নামিয়ে উঠে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসল, তুরার ভীতসন্ত্রস্ত মুখের দিকে খানিক নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে এক টানে তুরাকে বুকের উপর নিয়ে বলল
-এভাবে পালিয়ে বেড়ালে আমি কোন ফ্লেভারের এটা কি করে বোঝাব বলো তো
-আ আপনি কেন কোনো ফ্লেভারের হবেন,ফ্লেভার তো আইসক্রিম, কেকের হয় মানুষের নাহ
-নাহ,,মানুষের ও হয়। আমার বউ যখন বলেছে অবশ্যই হয়
তুরা মাথা নামিয়ে নিল। এখন নিজের পাকনামির উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে। কেন যে তখন ওই মহিলাকে জব্দ করতে ওসব বলতে গেলো।
আহান তুরার ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে মুখটা ভীষণ কাছে আনল, তুরার পাপড়ির ন্যায় পেলব ঠোঁটে পুরু অধরযুগল ঘষে দিতেই ঘুঙিয়ে উঠল তুরা, আহানকে সরিয়ে দিতে গেলে ও আরও চেপে ধরল, ঠোঁটের পাশটাতে ঠোঁট লাগিয়ে নেশাগ্রস্ত গলায় বলল
-বড্ড জ্বালাচ্ছ আমাকে তুমি ইদানীং। তোমার দূরে দূরে থাকা যে আমি সহ্য করতে পারিনা যেনেও আমাকে তড়পাচ্ছ। এর মাশুল দিতে হবে তো!
বলেই এক ঝটকায় পাশে শুইয়ে দিয়ে গলার মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিল। তুরার ঘাড়ে কামড়ে ধরেই এক হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে দিল।
••••
বিকট শব্দে ফোন বাজায় হুড়মুড়িয়ে উঠল সাদমান। পড়তে পড়তে টেবিলেই ঘুমিয়ে পরেছিল,তার উপর আচমকা হুড়মুড়িয়ে ওঠায় ঘাড়ে ভীষণ টান লাগল।
খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ফোন হাতে নেওয়ার আগেই কেটে গেল।
কিন্তু অনতিবিলম্বে আবারও শব্দ করে বেজে উঠল,সাদমান বিরক্ত হলো খুব এত রাতে আবার কেও ফোন দেয়!
স্ক্রীন না দেখেই কানে ধরে ঘুমে ঢুলু ঢুলু গলায় বলল
-হ্যালো কে
-“তোমার অবিন্যস্ত রূপের খামখেয়ালি হাসিতে আমার আমার দিন কাটে
আমার বেপরোয়া, বেহায়া অনুভূতিরা দিগবিদিক ভুলে তোমার পানে ছোটে!
এত নির্মল, রূপসীর হাসি আমি কোথায় পাব
তোমার অস্তিত্ব ভরা শহর ছেড়ে আমি কোথায় যাব!”
চট করে সাদমানের ঘুমের রেশ ছুটে গেল। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আবারও কানে ধরল। ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা-আমতা করে বলল
-ক্ কে,মানে কি
-আমি,মানে যাকে নিয়ে কবিতা লেখে তুমি অপ্রকাশিত কবি হয়ে গেছ সেই আমি বাছা
ফারিহার এহেন কথায় সাদমান অপ্রতিভ হলো, তবুও গলা ঝেরে কড়া কণ্ঠে বলল
-হোয়াট! এত রাতে কেন ফোন দিয়েছিস তুই? আর কি যা তা শোনাচ্ছিস
-ওমাহ, ওমনেই যা তা হয়ে গেল নাহ? তুই ই তো লিখেছিস এসব যা তা
-আজেবাজে বকিস না তো ফোন রাখ
ফারিহা তবুও দমল নাহ। ক্ষেপাটে গলায় বলল
-দেখ ভদ্দরলোকের ছা, একদম পার্ট নিবি না হ্যাঁ, তুই লিখিস নি? বল এই কবিতা টা তুই ই লিখিস নি?
-তুই আমার ডায়েরি পড়েছিস? কতটা ম্যানারলেস হলে মানুষ কারো পারমিশন ছাড়া তার পারসোনাল জিনিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে পারে
-একশ বার করব, শুধু ঘাটাঘাটি কেন ঘেটে ঘ করে মানুষটা শুদ্দ গিলে ফেলব তোর কি বে!
-হুহ,,মুখের কি ভাষা
-কি করব জনেমান,তোমার মতো কবিতা লিখতে পারিনা তো। তুমি কবিতা শোনাবে আর আমি মুখের ভাষা,,ওয়াহহ একদম রাব নে বানাদি টাইপ হবে
-শাট আপ, আমি কবিতা লিখি আর উপন্যাস লিখি, তোকে অন্তত শোনাব নাহ
-ওমাহ,আমার জন্যেই তো লিখেছিস, আমাকে শোনাবি না তো কাকে শোনাবি
-তোকে কে বলল আমি তোর জন্যে লিখেছি,আর রাত বিরেতে ফোন দিয়ে জালাবি নাহ তো,বাই
-এই এই খবরদার,ফোন ভুলেও কাটবি নাহ। এক তো আমার বান্ধবী টা বিয়ে খেতে গেছে। ও নিজেই বর সামলাতে ব্যস্ত বলে ওকে ফোন করতে পারছি নাহ,তুই ফোন কাটবি তো বাড়ি চলে আসব কিন্তু
সাদমান বিরক্ত হলো।টেবিল থেকে উঠে খাটে এসে শুয়ে চটা গলায় বলল
-আচ্ছা জ্বালা তো,কয়দিন তো ভালই ভাব দেখাই ঘুরলি আবার ছ্যাছড়ামো শুরু করেছিস কেন তুই?
-তখন তো জানতাম নাহ তুই আমার বিরহে কবি হয়ে বেড়াচ্ছিস
-দেখ ফালতু বকবি না একদম,তোকে কে বলেছে আমি তোর জন্যে কবি হয়ে বেড়াচ্ছি? আমার ইচ্ছে করেছে আমি লিখেছি এর সাথে তোর কোনো কানেকশন নেই
ফারিহা হাসল। অন্ধকারে হাসিটা দেখাও গেল নাহ,আর নাইবা কোনো শব্দ হলো। কৌতুহলী গলায় বলল
-তাহলে তোর কবিতার পৃষ্ঠায় আমার কানে দেওয়া শুকনো ফুলটা কি করছে বল তো। এটাও কি অস্বীকার করবি?
সাদমান আরও অপ্রস্তুত হলো।খানিক চুপ করে থেকে জড়তা ভরা গলায় বলল
-ফুল কি তোর বাপের গাছের নাকি,ওটা আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি
-তুরা দুটো কাঠগোলাপ এনেছিল ওর বাড়ির বাগান থেকে, দুটো ফুলের পাপড়ির উপর নাম লিখে একটা ওর কানে আরেকটা আমার কানে দিয়েছিল। ক্লাস শেষে ওটা আর আমি খুঁজে পাইনি,,এখন কি বলবি পারবি তোর রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ফুলটাতে আমার নামটা কি করে লেখা?
সাদমান বাকরুদ্ধ হলো,এর কোনো জবাব তার মাথায় এলো নাহ। খানিক ফোস ফোস করে নিশ্বাস ছেড়ে কান থেকে নামিয়ে ধপ করে ফোনটা কেটে দিল। এর উত্তর আসলেই জানা নেই ওর,,ও কেন ফুলটা রেখেছে ডায়েরির ভাজে,, কি উত্তর দেবে ও? আর কেনই বা চুরি করে ওর কান থেকে ফুলটা নিয়ে লুকিয়ে এনেছে তারই বা কি কারণ দেখাবে!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৫৬
-কি হলো, মুখটা এমন করে রেখেছ কেনো? কথা বলবেনা? হয়েছে টা কি তোমার,সারা রাস্তা এমন করে আছ
বলেই হাত ধরতে গেলে এক ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আরও সরে গেল তুরা। আহান বিবশ ভঙ্গিমায় তাকাল তুরার দিকে, কিন্তু সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।সারাটা রাস্তায় মুখ ফুলিয়ে রেখেছে,একটা কথা অব্দি বলেনি। সকাল সাতটার বাসে রওয়ানা দিয়েছে ওরা,,আসতে দিতে কেও চাইনি কিন্তু আহানের কথার কাছে হাড় মানতে হয়েছে। তবে তার যুক্তিটাও অহেতুক নয়,ভার্সিটি খুলেছে অথচ তার পরীক্ষার খাতা দেখা হয়নি। বারবার কল আসছে তাই তার থাকার ইচ্ছে থাকলেও আপাতত সেটা সম্ভব নয়।
কিন্তু এ কথাটা তার এই বউটাকে কি করে বোঝাবে, গাল ফুলিয়ে একেবারে প্যানকেক করে রেখেছে। আহানের ইচ্ছে করছে ওই গালেই প্রচন্ড জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাকে মনের মাঝেই দাহ করে চুপচাপ তাকিয়ে রইল ঘাড় কাত করে।
প্রায় সাত ঘন্টার পথ পারি দিয়ে দুপুর দুইটা নাগাদ এসে পৌঁছাল। মাহিদ গাড়ি থেকে নেমে ওদের বিদায় জানিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। বাড়ির গাড়িটা আগে থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছে, আহান আর তুরা সেটাতে করে বাড়ির দিকে গেল।
-সমস্যা কি,এবার কিন্তু মার খাবে তুমি তাকাও এদিকে!
চাপা স্বরে ধমকে উঠল আহান। তুরা সামনে ড্রাইভারের দিকে তাকাল। সে গাড়ি চালানোতে ব্যস্ত। তবুও তার সামনে এমন না করলেই নয়!
আড়চোখে একবার আহানের দিকে তাকিয়ে আবারও মুখ ফিরিয়ে নিলো। কথা নেই,কোনো কথা নেই এর সাথে। মানুষটা কত বড় খারাপ নিষ্ঠুর।খাগড়াছড়িতে গেল অথচ কোথাও না ঘুড়েই চলে আসতে হলো। এই দুঃখ তুরা কোথাই রাখবে। বলা নেই কওয়া নেই সাত সকালে তুলে দিয়ে বলে রেডি হও বাড়ি যাব। তার সাথে কি কথা বলা যায়! আপনারাই বলুন?
-তোমাকে এদিকে তাকাতে বলেছি
এবার দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল আহান। তুরা শুকনো ঢক গিলে তাকাল ওর দিকে। এক হাত বাড়িয়ে তুরার কোমর চেপে ধরে বলল
-আরেকবার অন্যদিকে মুখ ফিরালে আমি তোমাকে এই ড্রাইভারের সামনেই চুমু দিয়ে দেব বলে দিলাম
চাপা স্বরে ধমকে বলল কথাটা। তুরা হতবিহ্বল হয়ে আহানের দিকে তাকিয়ে রইল৷ চোখ মুখ কঠোরতার সাথে শক্ত করে রেখেছে। মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছে তুরা কত বড় অন্যায় করে ফেলেছে। আজব, এই লোকটা কি পাগল? ড্রাইভারের সামনে চুমু দিলে কি অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে সে একা পরবে নাকি সে ইনভিসিবল হয়ে আছে? বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আহান আবারও ওকে ধরলে তুরা আঙুল তুলে চাপা স্বরে বলল
-খবরদার,আরেকবার যদি হম্বিতম্বি করেছেন তো আমি সোজা মামনীর বাড়ি চলে যাব। আমি খুব রেগে আছি,আমার সাথে ধমকা ধমকি করবেন না বলে দিলাম
-কেন রেগে আছ তুমি। আর রেগে থাকলে কথা কেন বলবে নাহ। আমার দিকে তাকিয়ে থাক
-কেন আপনার কি দুটো শিং গজিয়েছে যে তাকিয়ে থাকতে হবে
-না গজালেও তাকাতে হবে, আই আম ইউর হাসব্যান্ড
-কোন হাসব্যান্ড, কিসের হাসব্যান্ড। মানি নাহ আমি কাওকে মানি নাহ। আপনি একটা নিষ্ঠুর,রসকসহীন মানুষ। আমি রেগে আছি চুপ করে থাকুন
-হ্যাঁ তো রেগে থাকলে কথা কেন বলছ নাহ। এসব আমি একদম মেনে নেব না। ঠ্যাং খোরা করে দেব,ভুলে যাবে না আই আম ইউর টিচার!
-তো টিচার হয়ে স্টুডেন্ট এর সাথে লুতুপুতু করতে লজ্জা করে না আপনার?
-হোয়াট! লুতুপ.. মানে? সেটা আবার কি।এসব কি ধরনের জঘন্য ভাষা শিখেছ তুমি?
-ঠিকই বলেছি,সরুন সরুন একদম চিপকে থাকবেন না আমার সাথে
বলেই আহানকে বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে ড্রাইভার হুট করেই পেছনে ফিরে তাকায়। হয়তো দুজনের ফিসফাস ঝগড়া শুনেই তাকিয়েছে।
ড্রাইভারকে আকস্মিক এভাবে তাকাতে দেখে দুজনই ভড়কে গেল। তুরা সামান্য মেকি হাসলে ড্রাইভার ও হেসে সামনে তাকিয়ে গাড়ি মোড় ঘুরালো। দুই মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেল। আহান আর কিছু বলেনি বাড়ি আসা অব্দি। গাড়ি থেকে নেমেই তুরা দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে সকলের সাথে দেখা করে কথাবার্তা বলে তুরা ঘরে গেল। খাগড়াছড়ির তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা অনেকই বেশি। উপরে উঠে রাইমার ঘরে ঢুকল। রাইমাকে ইমান এসে নিয়ে গেছে তুরা খাগড়াছড়ি যাওয়ার পরদিনই। ঘরে ঢুকেই একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরল। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে চুল গুলোও ঠিক করে না মুছে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। দীর্ঘ সময়ের জার্নি আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে ক্লান্ত শরীরে মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘুম নেমে এলো।
•••
ভার্সিটি থেকে খানিক দূরেই, স্টুডেন্ট ক্যাফে নামের কফিশপ। রুফটপে দুজন,তিনজন করে চেয়ার পেতে বসার জায়গা আর তার মাঝে বর্গাকৃতির টেবিল। আশেপাশে লোকজন গিজগিজ করছে।
এর মাঝে সাদমান এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে, চোখ মুখ শক্ত করে। মুখাবয়ব দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটাতে সে চরম বিরক্ত অথবা রাগান্বিত।
টেবিলের সামনের ছেলেটা টিস্যু হাতে নিয়ে হাতটা মুছে দিতেই গর্জে উঠল মৃদু স্বরে
-ফারিহা?
সাদমানের ডাকে কফিতে চুমুক দিতে দিতে তাকাল ফারিহা। সাদমান এগিয়ে এলো ভ্রু কুচকে এক পলক তাকাল ফারিহার সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। আবারও গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল
-তুই এখানে কি করছিস?
-কফিশপে মানুষ যা করে,কফি খাচ্ছি
বলেই স্ট্র তে চুমুক দিল দায়সারা ভাবে। সাদমান কাঠ কাঠ মুখে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কফি খেতে খেতে সামনের ছেলেটাকে দেখিয়ে ফারিহা বলল
-ওকে চিনিস তো? পলাশ,,আমাদের ক্লাসেরই
সাদমান চোখ ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালে ছেলেটা সহবত সুলভ হাই বললেও সাদমান উত্তর দিল নাহ। চোখ গেল টেবিলের উপরে রাখা ফারিহার হাতের কাছাকাছি পলাশের হাতের দিকে। আচমকা মেজাজ খারাপ হয়ে গেল,তবুও আশপাশের লোক সমাবেশ দেখে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল
-এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কফি খাবি?
উত্তর করলনা সাদমান। এর মাঝেই পলাশ নামের ছেলেটির ফোন বেজে উঠলে ও সরে যেতেই সাদমান ধপ করে বসল ফারিহার সামনের চেয়ারে। ফর্সা মুখে লালাভ বর্ণ পরেছে। তা রাগে কি রোদে বুঝতে পারল নাহ ফারিহা। অনেক
অবুঝের মত করেই বলল
-কি হয়েছে, এমন টোম্যাটো লুক দিয়েছিস ক্যান
বলেই আবারও স্ট্রতে চুমুক দিতে গেলে সাদমান এক ঝটকায় কেড়ে নিলো কোল্ড কফির ঠান্ডা গ্লাসটা। মুখাবয়ব কঠোর করে বলল
-ওই ছেলেটার সাথে কেন এসেছিস তুই?
-আমি ওর সাথে কেন আসব আমিতো একাই এসেছি
চোখে মুখে উপচে পরা গাম্ভীর্য আরও দ্বিগুণ হলো।চাপা স্বরে ভরাট গলায় বলল
-ডোন্ট লাই টু মি। আমি নিজে দেখেছি তুই ছেলেটার সাথেই সিড়ি দিয়ে উঠছিলি
-হ্যাঁ তো আসার সময় ওর সাথে দেখা হলো। একই ক্লাসে তো পড়ি দেখা হলে কি না চেনার ভান করে চলে যাব। ও বলল এখানেই আসছে তাই এলাম।এখন এখানে আমার কি করার আছে আজব,দে আমার কফি দে
বলেই গ্লাসটা এগিয়ে নিতে গেলে সাদমান ওর হাত চেপে ধরে বলল
-তাহলে একসাথে বসেছিস কেন? নাকি একই ক্লাসে পড়ে বলে একসাথে বসতেই হবে এমন নিয়ম হয়েছে
ফারিহা ভড়কে গেল সাদমানের এরূপ জেরা করায়। ও ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বলল
-আশেপাশে দেখত। রুফটপে একটা মাত্রই বসার জায়গা ফাঁকা ছিল। তাই ও বসার জন্য রিকুয়েষ্ট করল। আমি কি বলব না তুমি বসো নাহ,, আমার পাশে বসলে অনিষ্ট হয়ে যাবে
সাদমানের মেজাজ দ্বিগুণ চড়াও হলো ফারিহার হেয়ালিপনা কথাবার্তায়। খানিকটা এগিয়ে এসে বলল
-ওই ছেলে তোর হাত কেন ধরছিল? বাইরে আসিস এসব করার জন্যে? কফি খাওয়ার নামে হাতি ধরাধরি করতে বেড়য়েছিস তুই?
-আরে এভাবে বলছিস কেন। আমার হাতে লেগে কাপ থেকে হাতে পরে গেছিল ও শুধু টিস্যু দিয়ে মুছে দিয়েছে এতে ধরাধরির কি আছে।
-স্টপ ইট, মুখটা বন্ধ রাখ। বাপ তোরে মাথায় তুলে রেখেছে বলে যা খুশি করে বেড়াবি? তুই একা কেন বেড়িয়েছিস? এত কফি খাওয়ার শখ বাড়িতে নিজে করে খেতে পারিস নাহ?
-আমার ইচ্ছে করেছে তাই এখানে এসেছি। এতে কারো কোনো প্রবলেম হতে পারে বলে তো জানা ছিল নাহ
-জানা লাগবে না তোর ওঠ,এখানে আর এক মিনিট থাকলে তোর কপালে দুঃখ আছে
বলেই সাদমান উঠে ফারিহার হাত ধরে টানতে টানতে সিড়ির দিকে নিয়ে এল
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস তুই?কফির বিল টা তো দিতে দে
-ফরমালিটি দেখাতে যাকে এনেছিস, সেই দিয়ে দেবে তোর কফির বিল
বলে সিড়ি বেয়ে নেমে ফারিহার হাত ধরে রাস্তা পার করে এগিয়ে গেল ডান দিকের রাস্তায়। দ্রুতপায়ে হাঁটছে সাথে ফারিহাকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
নিঃশব্দে মৃদু হাসল ফারিহা,এটাই তো চেয়েছিল ও। বিকেল বেলা ঘটা করে কফি খেতে এসেছেই তো সাদমানকে জ্বালাতে। একা একাই আসছিল ফারিহা,যখন দেখল সাদমান তাকে খেয়াল করেছে তখন কফিশপের দিকে এল, ওকে একা এখানে আসতে দেখলে সাদমান নিশ্চয় পেছনে আসবে সেই ভেবেই এসেছিল।
কিন্তু মাঝে পলাশ নামের ছেলেটা এসে মেঘ না চাইতেই জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ফারিহা ইচ্ছে করেই সাদমানকে দেখিয়ে দেখিয়ে ছেলেটার সাথে এত ন্যাকামি করছিল যাতে সাদমানের হিংসে হয়।
আর হলোও তাই, হুট করেই একরাশ ভালো লাগা ঘিরে ধরল ফারিহাকে,সাদমান কখনও এর আগে এভাবে অধিকার দেখিয়ে কথা বলেনি,আর নাইবা হাতটা ধরেছে এভাবে। সাদমানের অজান্তেই আলতো করে ধরে রাখা হাতটার আঙুলেই ছুঁয়ে দিল ওর হাত!
•••
ঘুম ভেঙে উঠে বসে দেখে আশপাশ জুড়ে অন্ধকার নেমেছে। চোখ মুখ ডলে উঠে বসে দেওয়াল ঘড়িতে তাকালে দেখল সাড়ে সাতটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে তুরা? অথচ কেও ডাকেও নি?
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। নিচে আপাতত কেও নেই। মা দিদুন যে যার ঘরে। বাবা এখনো আসেনি। চুমকি হেলেদুলে এটা ওটা করছে আর টিভি দেখছে। তুরা নামতেই ওকে দেখে বলল
-আরে ভাবি, যাক আপনার ঘুম ভাঙলো। আমিতো ভাবলাম শেষে ঢাক ঢোল আনতে হবে
বিরক্তিতে ভ্রু জড়ো করল তুরা। একে তো ক্ষুধাও পেটে চো চো করছে তার উপর চুমকির এসব আজগুবি কথাবার্তা।
-মা আর দিদুন কোথায়?
-মা রান্নাবান্না সেরে ঘরে গেছে। আর দিদুন তো ঘরেই। বের হয়না খুব একটা পায়ে অনেক ব্যথা তো
বলেই আবারও টিভি দেখায় ব্যস্ত হলো। তুরা রান্নাঘর থেকে ভাত বেড়ে এনে চুমকির সাথে টিভি দেখতে দেখতে খেলো। ভাত খাওয়ার পরেও বেশ ঘন্টা খানেক সময় ধরে ওর সাথে টিভি দেখে হুট করেই আহানের কথা মনে পরলে বলল
-উনি কোথায় চুমকি? দুপুরে খেয়েছিলেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল চুমকি। মাথা চুলকে বলল
-কে ভাইজানের কথা কন? সেও এসে গোসল করেই ঘুমিয়েছিল, সন্ধ্যার একটু আগেই খেয়েছেন। ঘরে যাওয়ার সময় বলেছেন আজ যেন তাকে কেও বিরক্ত না করে অনেক কাজ আছে নাকি
বলে আবারও টিভি দেখায় ব্যস্ত হলো। তুরা খানিক ঝিম ধরে বসে রইল। আহানের অনেকগুলো খাতা দেখা বাকি,হয়তো সেই কাজই করছে। আর সে যখন বসেছে শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবে তো নাহ।
তুরা উঠে রান্নাঘরে গেল। সন্ধ্যায় খেলে রাতে আর কিছুতেই ভাত খায়না আহান। মাস্টার টা খাওয়া নিয়ে একটু বেশিই স্ট্রিক্ট। কিন্তু রাত ও তো হয়েছে, এভাবে না খেয়ে থাকবে! তাই কফি আর স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিয়ে উপরে গেল তুরা।
টি-টেবিলের উপর খাতার স্তুপ জমা করে রেখেছে। আহান সোফাতে বসে এক এক করে পৃষ্ঠা উলটাচ্ছে আর সাইন দিচ্ছে মাঝে মধ্যে আন্ডারলাইন ও করছে। দরজাটা ঠেলে দিয়ে তুরা এসে বসল আহানের পাশে।
-খেয়ে নিন
খাবারের ট্রে রাখতে রাখতে বলল। আহান খাতায় মুখ গুঁজে আছে,আশেপাশে কেও আছে সে খেয়াল তার নেই। তুরা খানিক চুপ করে থেকে আবারও বলল
-খাবারটা খেয়ে নিন। অনেক রাত হয়েছে তো
-হু?
তুরা বিরক্ত হলো এবার। বিরক্তি ভরা তীক্ষ্ণ গলায় বলল
-আপনি কি কানে শুনতে পাচ্ছেন না? বলছি খেয়ে নিতে, নিশ্চয় ক্ষুধা পেয়েছে?
আহান কলম থামিয়ে তাকাল তুরার দিকে। কিছুক্ষণ ওভাবে দেখে আবারও খাতা দেখা আরম্ভ করল। ব্যস্ত গলায় বলল
-আমি এখন ব্যস্ত খাওয়ার সময় নেই
-খেতে পাঁচ মিনিট ও লাগবে নাহ। আমি বানিয়েছি,খেতেই হবে
-বললাম তো ব্যস্ত আছি। খাইয়ে দিলে দাও না তো নিয়ে যাও
তুরা ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল। লোকটা খুব জাঁদরেল হচ্ছে দিনদিন। যা বলে সেটাই করতে হবে। কিন্তু পতি পরমেশ্বরকে তো খাইয়েও রাখতে পারছে নাহ, স্যান্ডউইচ টা তুলে আহানের মুখের সামনে ধরে বলল
-দেখুন খাইয়ে দিচ্ছি বলে ভাববেন না গলে গেছি,আমি এখনো রেগেই আছি
আহান উত্তর করল নাহ। মুখ ঘুরিয়ে স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ রাখল। খাওয়ার মাঝেই আহান ইচ্ছাকৃত ভাবে তুরার আঙুলে সজোরে একটা কামড় বসিয়ে দিতেই আর্তনাদ করে উঠল তুরা
-আল্লাহ্ গোওও আমার আঙুল খেয়ে ফেলল রাক্ষসটা। এই জন্যেই মানুষের ভালো করতে হয়না। জাঁদরেল কোথাকার
বলেই উঠে যেতে নিলে আহান তুরার হাত চেপে ধরে হাতের অবশিষ্ট টুকুও খেয়ে বলল
-স্বামীর মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নাও কেমন নিষ্ঠুর বউ তুমি। তবে আমি কিন্তু তোমায় অভুক্ত রাখব না
বলে খানিক এগিয়ে এসে তুরার গাল চেপে ঠাস করে দুটো চুমু দিয়ে আবারও বলল
-তুমি নিষ্ঠুর হলেও তো আমি নিষ্ঠুর হতে পারিনা। তুমি চাইলে আরও দেব, দেই?
তুরা ঝামটা মেরে সরে এসে প্লেট নিয়ে বেরিয়ে আসল। ঘরের বাইরে আসতে গালে হাত দিয়ে লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেলো।
-বেহায়া লোক
বলেই দৌড়ে চলে গেল।
~
ছুটিগুলো ফুরিয়ে গেল খুব দ্রুত। ফের ব্যস্ততায় আবিষ্ট হল জীবন। ইয়ার ফাইনালের ছুটি শেষ হয়েছে দিন দুয়েক আগেই। খাগড়াছড়িতে থাকার কারণে দুইদিন অলরেডি মিস হয়েছে। আজ থেকে আবারও একই নিয়মে শুরু হবে তুরার পড়াশোনা।
সকাল করে রেডি হয়ে বেরোলো। নাস্তা সেরে একাই বেড়িয়ে আসল। আহানের আজ ক্লাস নেই,ভার্সিটিতে গেলেও দেরিতে যাবে। কিন্তু সকাল নয়টা নাগাদই তুরার ক্লাসে আছে।
আহান তুরাকে রেখে আসতে চেয়েছিল কিন্তু কাল সারারাত ধরে বসে খাতা দেখেছে সে,একে তো ক্লান্ত শরীর তার উপর সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরে ঘুমিয়েছে বলে তুরা আর ডাকেনি। নিজেই বেরিয়ে পরলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে
আকাশটা নিত্যদিনের মতই স্বচ্ছ, রোদের তীক্ষ্ণতা থাকলেও খুব একটা গরম অনুভূত হচ্ছে নাহ। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়,শীত আসব আসব করছে। কখনো গরমে ঘাম ঝরছে আবারও কখনো শীতলতায় মগ্ন হচ্ছে পরিবেশ।
রিকশাতে বসে থাকা অবস্থায় ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। ফোন দেওয়া মানুষটার নাম্বার দেখে কপাল জড়ো হলো তুরার, এইতো বেরোনোর আগেও তো কথা হলো ফারিহার সাথে, আবারও ফোন দিল যে!
-হ্যালো?
-তুই কোথায়?
খানিক চেঁচিয়ে বলল ফারিহা। কণ্ঠস্বর বেশ উত্তেজিত শোনাচ্ছে। ভ্রু কুঞ্চন করে বলল
-রিকশাতেই, কলেজের মোড়ের কাছাকাছিই। আর পাঁচ মিনিট লাগবে হয়তো, কেনো?
-দোস্ত আজকে আসার দরকার নেই এদিকে তো..
-কি করছিস পাগল নাকি
বলেই ফোন কেড়ে নিল সাদমান। খট করে লাইনচ্যুত করল কল। ফারিহা বোকা বোকা মুখ করে বলল
-কিন্তু এদিকে যে কাহিনি ঘটে গেছে!
-তো ওকে রাস্তার মাঝে কেন বলছিস, এখন নিষেধ করলেও তো ও আসবেই। ফোনে বলে সবটা বোঝাতে পারবি তুই? বরং আরও হাইপার হবে আগে থেকে।
কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলেই রিকশা থেকে নামল তুরা, ভাড়া চুকিয়ে হাঁটা ধরল ক্লাসের দিকে। দোতালার সিড়ি বেয়ে উঠতেই অনেকের সম্মুখীন হলো যারা আড়চোখে দেখছিল তুরাকে। ওদের এহেন চাহনির অর্থ বুঝল না তুরা। মাথাভর্তি কৌতুহল নিয়েই এগিয়ে গেল ক্লাসের দিকে।
ক্লাসে ঢুকতেই কতগুলো বিদ্রুপ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভরা চাহনি দেখতে পেল যারা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকেই দেখছে। কোনো কিছুই বোধগম্য হলো না তুরার। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখল ফারিহা আর সাদমান ভীষণ চিন্তিত মুখে বসে আছে,সচরাচর ওদের এই চেহারা দেখা যায় নাহ। তুরা এগিয়ে গিয়ে ওদের পাশে বসতেই শুনতে পেল পাশ থেকে কিছু অপ্রীতিকর কথা,যা অতিমাত্রায় জঘন্য। শুনেই গা গুলিয়ে এল তুরার, সকলে যেন তার দিকেই তাক করে গল্পগুজব করছে, মুখভর্তি শ্লেষাত্মক হাসি তাদের ।
-কি হয়েছে ফারু? সকলে কি নিয়ে এমন মাতামাতি করছে?
ফারিহা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর কানে আসতে থমকে গেল তুরা, ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্ফোরিত নজরে তাকাল ছেলেটির দিকে। আজ অব্দি এ ধরনের কথা তাকে কেও বলনেই কল্পনাতেও আসেনি তুরার।
কোনো দিক না ভেবে উঠে গিয়ে ছেলেটার গালে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে থা’প্পড় দিয়ে বসে। প্রচন্ড রাগ আর অপমানে শরীর কাঁপছে তার।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#Humu_❤️