তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-১১

0
140

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ১১

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

ত্রিশার পেডিকিউর, মেনিকিউর করতে মাত্র আধ ঘন্টা লাগলেও ইন্দুর মুখের স্পেশাল গোল্ড ফেসিয়াল, পেডিকিউর, মেনিকিউর, ভ্রু প্লাগ, আপার লিপ ইত্যাদি করতে আরো দু’ ঘন্টা লেগে গেলো। ত্রিশা ভেতরে ভেতরে বেশ তাড়া অনুভব করছিলো বাসায় যাওয়ার জন্য। কারন আহনাফ অনেকগুলো হোম ওয়ার্ক দিয়েছে। সেগুলো করতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া মায়ের সাথে একটা বোঝাপড়া করতে হবে, মা কেনো ওকে না জানিয়েই সবাইকে এই জানিয়ে দিয়েছে যে, ত্রিশা বিয়েতে রাজী? এই প্রশ্ন না করা পর্যন্ত ত্রিশার শান্তি নেই। কিন্তু ইন্দুকে বলে কোনো লাভ নেই। এর আগেও একবার ইন্দুর সাথে পার্লারে এসে এভাবে ফেঁসে গিয়েছিলো। সেদিন ছিলো এস এস সি র ফিজিক্স পরীক্ষার আগের দিন দিন। পার্লার থেকে একে একে সব মানুষ বের হয়ে গেলেও ইন্দুর সাজগোজ আর শেষ হয়না। এদিকে ত্রিশার গোটা বইই রিভিশন দেওয়া বাকি! রিভিশনের অভাবে ফিজিক্স পরীক্ষাও বেশি ভালো হয় না ত্রিশার। কার্নোর ইঞ্জিন চক্র ভুল করে আসলো, সাথে তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলোও কি সব হিজিবিজি লিখেছিলো। আবছা আবছা মনে ছিলো, তার উপর ভিত্তি করেই লিখেছিলো। ভেবেছিলো এ প্লাস আর আসবে না, তারপরো কিভাবে জানি পঁচাশি মার্ক্স নিয়ে এ প্লাস পেলো।

ইন্দুর সব কাজ শেষ করে বাসায় যেতে রাত দশ টা বেজে গেলো। যাওয়ার আগে পান্না ইন্দুকে তেল দিতে দিতে বারবার বলছিলো,

” আমার পার্লারের ফেসিয়ালটা ফাটাফাটি! তোমাকে যা সুন্দর লাগছে না ইন্দু! স্কিন এক্কেবারে বেবিস্কিন হয়ে গিয়েছে! ”

কিন্তু ত্রিশা খুঁজে পাচ্ছিলো না যে, ইন্দুকে কোন এঙ্গেল থেকে সুন্দর দেখাচ্ছে!

ত্রিশারা যখন এলো তখন কনকচাপা ডাইনিংয়ে ডিনার পরিবেশনে ব্যস্ত। প্রতিদিন প্রায় বারো পদের ব্যাঞ্জনা রান্না করতে হয় তাকে। ডাইনিং এ সবাই খেতে বসেছে, জহির বাদে। সে অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। কনকচাপা ত্রিশাকে দেখে ঘাম মুছতে মুছতে ওর কাছে এলো। ত্রিশার চোখে মুখে রাগ দেখতে পেয়ে সে সুধালো,

” কি হয়েছে রে? কিছু বলবি?”

ত্রিশা থমথমে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
” এখানেই জিজ্ঞেস করবো সবার সামনে? নাকি বেডরুমে যাবা?”

কনকচাপার চোখগুলো লাল দেখালো। হয়তো কেঁদেছে! আধাকান্না হয়ে বলতে লাগলো,

” বেডরুমে তোর নানা রেস্ট নিচ্ছে, আমাকে নিতে এসেছে, তোর নানী খুবই অসুস্থ, জান যায় যায় অবস্থা। আর তোর মামারও কোনো খবর নাই কয়েক দিন যাবত। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে ”

এই বলে কনকচাপা জহিরের সাথে ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ত্রিশা আর কিছু বলতে পারলো না কনকচাপাকে।
নিশ্চয় কনকচাপা জহিরের কাছে টাকা চাচ্ছে, সেটাই বুঝা যাচ্ছে।
বিয়ের পর থেকে কনকচাপা জহিরের টাকা দিয়েই নিজের মা, বাবা, ভাই, বোন সহ তাদের সন্তানদের খরচও চালিয়েছে জহিরের টাকা নিয়ে। বিনিময়ে সে জহিরকে অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। ইচ্ছে হলেই জহির আরেকটা বিয়ে করতে পারে, ইচ্ছে হলেই জহির যেখানে সেখানে রাত কাটাতে পারে। ইচ্ছে হলেই জহির একাধিক গার্লফ্রেন্ড রাখতে পারে। ইচ্ছে হলে সে কনকচাপাকে দিয়ে তার ক্লায়েন্টদের সামনে নাচাতেও পারে। কনকচাপা যেনো জহিরের স্ত্রী নয়; বরং কয়েকটা টাকার বিনিময়ে জহিরের একটা কাঠের পুতুল!

অথচ জহিরের সাথে কনকচাপার বিয়ের আগে ব্যাপারটা এমন ছিলো না। সদ্য বিধবা, সুন্দরী কনকচাপার প্রেমে যেনো জহির হাবুডুবু খাচ্ছিলো। কিন্তু কনকচাপাই বিয়েতে রাজী হয়নি। কিন্তু অতি চালাক ও নারীলিপ্সু জহির জানতো অভাবীদের কাছে টাকাই সব। তাই কনকচাপার অর্থলিপ্সু বাপ ভাইদের হাতে তুলে দেয় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, আর ভাঙ্গা টিনশেড বাড়ির জায়গায় করে দেয় একটা ফুল বিল্ডিং একতলা দালানকোঠা। পরে বাবা ভাইয়ের জোর জবরদস্তির কাছে কনকচাপার ‘না’ টাও ‘হ্যাঁ’ তে রুপান্তরিত হয়। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে হয় সুদখোর ব্যবসায়ী জহির শেখ ও কনকচাপার।

মায়ের বেডরুমে গিয়ে ত্রিশা দেখে ওর নানা বিশাল বড় প্লেটে পোলাও কোর্মা, দই, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে গোগ্রাসে শুধু গিলছে। নিজের শয্যাশায়ী স্ত্রী কে রেখে এভাবে কেউ গিলতে পারে ভেবে ত্রিশার আর তার সাথে কথা বলার রুচি হলো না। শুধু ভাবতে লাগলো,
” উপরওয়ালা এদেরকে কিছু না দিলেও দিয়েছেন একটি করে জিহবা, যা দিয়ে এরা পৃথিবী গিলেও খেতে পারে! বিনিময়ে সম্মান থাকলো নাকি গেলো তা এদের দেখার বিষয় নয়”

মিনিট কয়েক পরেই ত্রিশার সামনে কনকচাপা আর তার বাবা গাড়ি দিয়ে হনহন করে বের হয়ে গেলো। তবে ত্রিশা গেলো না। তাছাড়া সবসময় কনকচাপা ইচ্ছে হলেই বাবার বাড়ি যেতে পারেনা, কারন ববিতার অনুমতি সবসময় পাওয়া দায়। এখন ত্রিশা বিয়েতে রাজী হয়েছে শুনে সব কিছু যেনো খুবই সহসাধ্য হয়ে গিয়েছে।
মাকে কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে ত্রিশা নিজের রুমে গিয়ে বই নিয়ে বসলো।
.
.

কয়েক রাত থেকে আহনাফ ঠিকমতো ঘুমাতেই পারছে না। এদিকে সকাল সকাল ঘুমিয়ে সকাল সকাল উঠাই তার নৈমিত্তিক অভ্যাস ছিলো। রাত দশটায় ঘুমিয়ে সে খুব ভোরে বাবার সাথে ফজরের নামাজ পড়ে ছুটতো জিম করতে। তারপর সকালের নাস্তা সেরে বাইকে করে কলেজে। কিন্তু ত্রিশার চুলদুটো তার হাতে আসার পর থেকে এ দুটির সাথে ত্রিশার কাছে আসার স্মৃতিগুলো ওকে ঘুমাতে দিচ্ছিলো না। ত্রিশার চুলদুটো তো ওর শরীরেরই কোষ! হোক না মৃত কোষ! আহনাফ ওগুলোতেই হাত বুলিয়ে ত্রিশাকে অনুভব করতে থাকে! এভাবেই তার সব নিয়মের ব্যতিক্রম হয়ে গিয়েছে। ক্লাশের শেষের বেঞ্চিতে সাদা স্কার্ফ মাথায় দিয়ে বসা সে মেয়েটাকে সে চিনতো শুধু ধন্যাঢ্য ব্যাবসায়ী জহির শেখের মেয়ে হিসেবে। ক্লাশে অন্য মেয়েদের কথার ভীড়ে সে এই নিশ্চুপ মেয়েটিকে ঠিকমতো লক্ষ্যই করতে পারেনি কোনোদিন। ক্লাশের মেয়েদের রং ঢংয়ের ভীড়ে ত্রিশা একমাত্র সাদা স্নিগ্ধ এক রুপ!

কলেজে ঢুকার পর থেকে কলেজের মেয়েদের দ্বারা রীতিমতো হ্যারেজ এর শিকার হতো আহনাফ। বেশির ভাগ মেয়েরই দাবী ছিলো সে বা তারা প্রাইভেট পড়তে চায় তার কাছে। আবার অনেক মেয়ে ফোন নাম্বার চাইতো, যাতে বাসায় ম্যাথ করার সময় কোনো সমস্যা হলে আহনাফ স্যারের কাছ থেকে সেটা পার্সোনালি বুঝে নিতে পারে। আহনাফ সরল মনে কয়েকজনকে ফোন নাম্বার ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু সেটা রাতারাতি গোটা কলেজের সব ছাত্রীর মধ্যেই ছড়িয়ে যায়। আর সেই থেকে আহনাফের ফোনে কল আসার হিড়িক লেগে যায়। কে বা কারা বিভিন্ন নাম্বার হতে সারাদিনই কল দিতে লাগলো। আর সাথে সাথে তারা আহনাফের ফেইসবুক আইডিতেও হানা দেয়৷ প্রতিদিন শত শত মেসেজ আর কল সাথে মেসেঞ্জারেও মেসেজ ও কল। ফোনে এত অত্যাচারিত হয়ে আহনাফ ফোন আর সাথে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাতে কি? কিছু মেয়েরা আহনাফের গতিবিধি পর্যন্ত লক্ষ্য করা শুরু করে। সারাদিন ওকে ফলো করে কেউ একজন, তা সে জানে। যখন তখন কে বা কারা ওর উপর চিরকুট ছুঁড়ে মারে। প্রায়ই সেগুলোতে লিখা থাকে, লাভ ইউ ডিয়ার আহনাফ বা মিস ইউ ডিয়ার আহনাফ। আবার একদিন একজন র’ক্ত দিয়ে লিখা চিঠিও ছুঁড়ে দেয়। তবে কে সেটা তা সে জানে না। আহনাফ বুঝতে পারে, যারা এমনটি করে তারা আহনাফকে যথেষ্ঠ ভয় পায়, তবুও ভয় পাওয়া স্বত্ত্বেও ওরা ওদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা বলেই এমনটি করে। ওদিকে ত্রিশাকে গোয়েন্দাগিরি করতে বলায়, সে তো সরাসরি মানা করেই দিয়েছে। আবার ত্রিশা মেয়েটা বাস্তবে এসব করতেও পারবে না। এতটা ধুরন্ধর নয় সে!

সেদিন আহনাফ খুব গভীরভাবে অনুভব করছিলো, বিয়ের বয়স তো হয়েই গিয়েছে, এখন প্রেম করেই আর কি হবে? বরং ত্রিশাকে সরাসরি সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে তার বাবা মা দ্বারা, আগে ত্রিশার এইচ এস সি পরীক্ষা পার হয়ে যাক। এসব ভাবতে ভাবতেই আহনাফের মা শায়লা এসে ছেলের ঘরের দরজায় ঠুকঠুক করলো,

আহনাফ গলা উঁচিয়ে বললো,

” ভেতরে আসো মা, ঠকঠক করার প্রয়োজন কি? ”

শায়লা ভেতরে এসেই থমথমে স্বরে সুধালো,

” ঘুমাসনি এখনো? ঘুম আসে না, ব্যাপার কি? টিভিতে তো খেলাও দেখতে পারতি? একা একা এখানে বসে আছিস কেনো? আর কি ভাবিস এতো?”

” মা, আমি বহুদিন বলেছি, আমাকে এক সাথে এত প্রশ্ন করবে না, আমি পারি না এতগুলোর উত্তর একসাথে দিতে!”

” আচ্ছা থাক! আমার প্রশ্নের উত্তর তোর দিতে হবে না, তোকে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হবেনা, আমিই বলছি”

” হ্যাঁ, বেশ বলো, আমি শুনছি”

” আমি আর তোর বাবা কি ভাবছিলাম জানিস? ”

” কি ভাবছিলে জলদি বলে ফেলো?”

” ভাবছিলাম, বিয়ের বয়স তো হলোই, বিয়ে করে বউ নিয়ে আয় এবার ঘরে”

” আচ্ছা, এই কথা?”

” না শুধু এই কথা না! কথা হলো আমাদের কাছে তোর একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে”

আহনাফ আশ্চর্য না হয়েই সুধালো,

” তাই নাকি? কে সে?”

” রাহুল তালুকদারের একমাত্র মেয়ে বিভা!”

আহনাফ হো হো করে হেসে দিলো।

(চলবে)