#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন
পর্ব ২৬
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
দেখতে দেখতে এইচ এস সি পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। বায়োলজি আর ম্যাথ পরীক্ষা গুলো শুধু বাকি আছে। ত্রিশার সবগুলো পরীক্ষাই জবরদস্ত ভালো হয়েছে।
আহনাফ প্রতিদিন ওকে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিয়েছে আবার বাড়ি তেও পৌঁছে দিয়েছে পরীক্ষা শেষে।
ক্লাশের সবাই ওদের জমজমাট রসায়ন দেখে কেউ কেউ হেসেছে আবার কেউ কেউ জ্বলেছে। কিন্তু জ্বললেই কি? পরীক্ষা শেষেই তো ওদের বিয়ে। ওদের জুটিকে শুভকামনা জানানো ছাড়া আর উপায় কি?
.
.
একদিন কাকডাকা ভোরে, ঠিক ভোর ছয়টায়, থমথমে মুখে রাত্রি আর স্নিগ্ধা ত্রিশাদের বাসায় এলো। দুজনের মুখেই রাজ্যের ভীতি, দুজনেই হাপাচ্ছিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে রাত্রি বললো,
” ত্রিশা রে! সর্বনাশ! আহনাফ স্যার প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সাথে জড়িত, জানিস? ”
ত্রিশার চক্ষু চড়কগাছ! হতবুদ্ধি হয়ে গেলো সে!
কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
” ঠাট্টা করসিছ কেনো রে বান্ধবী তাও এত সকাল সকাল? জানিস না ঠাট্টা করা আমি ভালোবাসি না!”
রাত্রি ত্রিশার ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
” না রে ইয়ার, ঠাট্টা না, সত্যিই রে..”
ত্রিশা রুক্ষ স্বরে বললো,
” অসম্ভব! কোনো ক্রমেই সে এসব করতে পারেনা। তার মতো সৎ মানুষ!… অসম্ভব!”
ত্রিশা একথা বলতেই, স্নিগ্ধা নিজের স্মার্টফোনে ওদের ব্যাচের গ্রুপচ্যাটে ঢুকলো।
আর সেটা ওপেন করে দেখালো,
“তোর তো আবার ফোন নেই, বিশ্বাস না হলে দেখ, স্যার স্টুডেন্টদের গ্রুপে এড হয়েছে, পার কোয়েশ্চেন পাঁচ লাখ করে ডিমান্ড করেছে। স্যারের কি এতই টাকার দরকার পড়লো?এটা স্যারের রিয়েল আইডি, দেখ!”
ত্রিশা সত্যিই দেখতে পেলো আহনাফ স্যারের আইডি থেকেই এসব প্রশ্ন বিক্রির অফার দেওয়া হয়েছে।
এভাবে লিখা হয়েছে, ” অল স্টুডেন্টস, আসছে ম্যাথ এক্সামের প্রশ্নপত্র পার্ট ওয়ান ও টু এর সেট মাত্র পাঁচ লাখ টাকা প্রদানের মাধ্যমেই পেয়ে যাবে তোমরা! একদম অথেনটিক প্রশ্ন, কোনো হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই!”
আর অনেক ছাত্র- ছাত্রীই সে অফার এক্সেপ্ট করেছে। নিজেদের কন্টাক্ট নাম্বার দিচ্ছে।
আবার অনেকেই বলছে, ” স্যার কিছু খাইছেন নাকি? পাবলিকলি, কোশ্চেন পেপার বিক্রি করছেন, ধরা খাইলে কি হবে জানেন?”
আরো নানা জনে নানা কথা বলছে। কম জনই ক্রিটিসাইজ করছে, তবে বেশির ভাগই থ্রেট দিচ্ছে!
“পাবলিকলি কোয়েশ্চেন পেপার বিক্রি! এত বড় কলিজা আপনার! আপনি না বিসিএস ক্যাডার? ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে কি বিসিএস ক্যাডার হইছিলেন? আপনি তো ক্যাডার না হে*ডার!”
অথবা,
” ন্যায়ের প্রতীকের এ কি অন্যায়! দেশের আইন কই গেলো? আপনাকে পুলিশে দিবো, স্ক্রিনশট নিলাম”
অথবা,
” সারা বছর কষ্ট করে পড়লাম, আর আপনি এসেছেন কোয়েশ্চেন নিয়ে? নিজের বউকে প্রশ্ন দেন গিয়া! তাইতো বলি? ”
শেষে অনেকেই লিখেছে, “আসছি আমরা আপনার বাসায়, সাহস থাকলে পাবলিকলি বিক্রি করে দেখান তো প্রশ্ন!”
অনেকেই লিখেছে,
” জাতীর বিবেক কোথায়, এ জন্যই কি দেশ স্বাধীন করেছে ছাত্ররা?”
এসব দেখেই ত্রিশার মাথা ঘুরে গেলো।
মায়ের ফোন এনে সাথে সাথেই সে আহনাফকে কলের উপর কল দিতে লাগলো। আধঘন্টা হয়ে গেলো। বাসার কেউ ই কল রিসিভ করছে না।
না শায়লা, না আশফিক, না অহনা!
ত্রিশা যেনো তার চেতনা হারালো। নিশ্চয় অনেক বড় বিপদে পড়েছে তারা। দ্রুতপায়ে আহনাফদের বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে কথা বলা ছাড়া এই সকালে আর উপায় নাই।
ত্রিশার মা আর দুই ভাই তখনো ঘুমাচ্ছে, তাই তাদেরকে না ডেকেই হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য ত্রিশা ছুটলো আহনাফের বাড়িতে।
রাস্তায় যেনো পুর্বপরিকল্পনা মোতাবেক অপেক্ষা করছিলো বিভা! হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজের গাড়ির সামনে। আহনাফদের বাড়ির সামনের চৌরাস্তার মোড়ে এলেই বিভা ডেকে বলে উঠলো,
” কি রে ত্রিশা! হলো টা কি? এত সকালে কোথায় দৌড়াচ্ছিস রে? থামরে থাম! কথা ছিলো!”
ত্রিশা বিভাকে উপেক্ষা করেই দৌড়াতে থাকলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আহনাফদের বাড়ির সামনে এসে গেলো।
বাড়ির মধ্যে ঢুকার কোনো উপায় পেলো না।
অন্ততপক্ষে পাঁচশ মানুষ সে বাড়ির সামনে। গোটা প্রবেশপথ রোধ করা। গ্রুপে ক্লাশের অন্ততপক্ষে দুইশ ছাত্র ছাত্রী এড ছিলো। তাদের বেশির ভাগই এসেছে গার্ডিয়ান নিয়ে।
বেশির ভাগই আহনাফের মেসেজ দেখেছে। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো স্টুডেন্ট। তারা স্যারের এই বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি।
তাই তারা সরাসরি আহনাফের বাড়িতে হানা দিয়েছে, সাথে পুলিশ আর গার্ডিয়ান। ছাত্র ছাত্রীরা ও তাদের গার্ডিয়ানরাও বাড়ি ঘর ভাং চুর করেছে, তান্ডব চালিয়েছে।
সারা বাড়ি তল্লাশি হচ্ছে। আহনাফের ফোন সহ বাড়ির সকল গেজেট জব্দ করা হয়েছে। আহনাফকে আটকে রাখা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদও চলছে, যদি কোথাও একটা প্রশ্নপত্রও পাওয়া যায়, তবেই আহনাফকে আর কেউই বাঁচাতে পারবে না! আর প্রশ্নপত্র পাওয়া না পাওয়া গেলেও শাস্তি, অনলাইনে ছাত্রদেরকে অনৈতিক কাজে উস্কে দেওয়ার জন্য।
শায়লা, আশফিক আর অহনা তিন জনেই জড়াজড়ি কাঁদছে। শায়লা ত্রিশাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
” আমার ছেলে এসব করেনি ত্রিশা, বিশ্বাস করো, এগুলো ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! ”
ত্রিশাও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
” আমি জানি মা, সে এসব করেনি”
যে এত বছর নিজেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদ করেছে, সে করবে প্রশ্নপত্র ফাঁস! অসম্ভব।
হঠাৎই কিছু একটা মনে হতেই ত্রিশা ছুটলো আবার ঐ চৌরাস্তার মোড়ে পানে।
সেখানে বিভা তখনো অপেক্ষা করছিলো ওর গাড়ি নিয়ে। ওর সাথে আরোহীও দাঁড়িয়ে ছিলো।
ত্রিশা চেঁচিয়ে বিভাকে বলে উঠলো,
” এই বিভা, এসব তোর কারসাজি না বল? তুই ই আহনাফকে ফাঁসিয়েছিস, তুই ই আমি জানি! তুই ছাড়া আর কেউই না”
বিভা প্রাণ খুলে “হা হা” করে হাসতে লাগলো।
তারপর মেরুদন্ড শীতল করা এক কন্ঠে বললো,
” আহনাফের ঘরের কিচেনে একটা ছোট্টো কৌটার মতো মধ্যে আমি আসছে গনিত পরীক্ষার একটা প্রশ্ন রেখে এসেছি, একেবারে অরিজিনাল প্রশ্ন! আমি ফোন করে বলে দিবো, আর কিছুক্ষণের মধ্যে তল্লাশি চালাতে চালাতে ওটা তারা পেয়েই যাবে”
এটা শুনে ত্রিশা বিভাকে একটা কষে থাপ্পড় মারলো।
বিভা মাটিতে লুটিয়ে পড়েও হাসতে লাগলো।
হাসতে হাসতে বললো,
” তাহলে তুই বুঝেই গেছিস যে, আহনাফের ফোন হতে ওসব আমিই করেছিলাম, বাসায় প্রতিদিন ফোন রেখে বাইরে যেতে ওকে কে বলেছিলো? প্রতিদিন তোরে বাইকে করে একবার হলে নিয়ে যায় আরেকবার নিয়ে আসে। তবে ভয় নেই, আমি যেমন ওসব করেছিলাম, এখন আবার সব ঠিকও করে দিতে পারি। তুই শুধু আমার শর্তে রাজী হয়ে যা! ”
ত্রিশা একথা শুনে বিভাকে তুলে আরেকটা থাপ্পড় মারতেই উদ্যত হলো।
” আহনাফের ফোন চুরি করে ওর আইডি থেকে তুই এসব করেছিস, এখন আবার আমাকে শর্ত দিস হারামী ?”
ত্রিশার শরীরে যেনো রাজ্যের শক্তি এসে গেলো, সে বিভার চুলের মুঠি নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে এনে ওকে টানতে টানতে সামনে নিয়ে যেতে শুরু করলো,
” দাঁড়া তোকে এসব করার মজা দেখাচ্ছি”
এসব দেখে গুন্ডি আরোহী এসে ত্রিশাকে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে ফেলে দিলো। ত্রিশার হাত থেকে বিভা ছুঁটে গেলো।
সে তার রিবন্ডিং করা চুলগুলো ঠিক করতে লাগলো, আর কাপড়ে লেগে যাওয়া ধূলো ঝাড়তে লাগলো, যেনো ওর কিছুই হয়নি।
ওদিকে আরোহী ত্রিশাকে বললো,
” আমি ভেবেছিলাম, তুই এসব মারামারি পারিস না, এখন তো দেখি তুই ফিমেল ডব্লিও ডব্লিও ডব্লিও তেও চান্স পাবি, এত জোর তোর ? হা! হা! হা! এবার তোর জোর কমাচ্ছি! ”
ত্রিশা হাঁপাতে বললো,
” বাজে বকিস না, আরোহী, এসব তোদের প্ল্যান, আহনাফকে ফাঁসিয়ে তোরা কি পাবি বল?”
বিভা আর আরোহী হেসে উঠলো,
” আহনাফকে ফাঁসিয়ে আমরা আহনাফকেই পাবো, ও স্যরি দুজন নয়, যেকোনো একজন, আমি আর না হয় আরোহী, কিন্তু তুই পাবি না, ইটস আ গেইম জানু!”
ত্রিশা চটে গিয়ে বললো,
” ছি:তোরা সাইকো ছাড়া আর কিছুনা! আহনাফ তোদের কোনোকালেও ভালোবাসবে না, আহনাফ শুধু আমাকেই ভালোবাসে। এভাবে জোর খাটিয়ে হেনস্তা করে ভালোবাসা অর্জন করা যায় না রে, ভালোবাসা পুরোপুরি মনের ব্যাপার! ”
বিভা তখনি নিজের ফোনে কাকে যেনো রিং করলো, আর ত্রিশাকে বললো,
” এই কল রিসিভ হলেই আমি বলে দিবো যে, কোথায় কোয়েশ্চেন টা পাবে, ওখানে আমার লোক ঠিক করা আছে, তার আগে তুই বলে দে যে, তুই আর কোনোদিন আহনাফের ছায়াও ডিঙ্গোবি না!”
আরোহি বলে উঠলো,
” বল, বলবি না, তুই জানিস না, এখন যদি আহনাফের ঘরে প্রশ্ন পেয়ে যায়, তবে ওকে তো রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা দিবেই, সাথে পাবলিক ওকে আর ওর পরিবারকে আস্ত খেয়ে ফেলবে”
বিভা বলে উঠলো,
” হারি আপ ত্রিশা, হারি আপ , তুই রাজী হয়ে যা, যে তুই আর কোনোদিন আহনাফের সামনে যাবি না, তাহলে আমরা এখনি ওকে ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করবো! রাইট নাউ!”
ত্রিশা দেখলো যে, কয়েকজন ছাত্র বড় বড় লা’ঠিসোটা হাতে আহনাফকে মা’রতে যাচ্ছে।
আরোহী হাসতে হাসতে বললো,
” দেখছিস, মানুষ কেমন ক্ষ্যাপছে, তুই ভালোয় ভালোয় রাজী হয়ে যা রে!”
ত্রিশা কাঁদো কাঁদো স্বরে বিভা আর আরোহী কে এই বললো,
” আমি আর কোনোদিন আহনাফের সামনেও যাবো না, ওর ছায়াও মাড়াবো না কোনোদিন, কথা দিলাম!”
( চলবে)