তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-২৫+২৬

0
977

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:২৫
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]

হঠাৎ ইয়াদ তার চোখ জোড়া বড় বড় করে অস্ফুটস্বরে ব্যথ্যতুর আওয়াজ নির্গত করল। লহমায় মাথার চুল গুলো মুঠো বন্দি করে বেলকনি থেকে প্রস্হান করল। অঃপর সে দ্রত বিছানায় গিয়ে উষ্ণ চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে জারা বেলকনি হতে রুমে চলে এলো। এই পরিস্হিতে তার কি করা উচিত কিছু্ই বুঝে উঠতে পারছে না সে। শুধু মাএ ধারণা করল শীতল পরিবেশের প্রভাবে হয়তো মাথা ব্যথা করছে ইয়াদের। তাই বিষয়টা বেশি গুরুত্ব না দিয়ে জারা। বিছানার এক কণে শুয়ে পড়ল সে। আর মনে মনে ভাবতে লাগল, তার আর্মি পুরূষের ও মাথায় যন্ত্রণা হয়!
_________________________

কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। খানিক পূর্বে সূর্যি মামা তার অস্তিত্ব জানান দিতে সক্ষম হয়েছে। ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর বিদায় নিচ্ছে প্রকৃতি থেকে। ঘরির কাটাতে ছুঁই ছুঁই আটটা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল মেহের। বর্তমানে জানালার স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে একরাশ মিষ্টি আলোক রশ্মি প্রতিফলিত হয়েছে তার তৈলাক্ত মুখশ্রীতে। ফলে স্বল্প বিরক্তি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে মেহেরের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। এতে করে একপর্যায়ে মেহের আর ঘুমিয়ে থাকতে পারল না। ক্লান্তি মাখা ঘুমের সঙ্গে লড়াই পিটপিট করে নেএপল্লব উন্মক্ত করল। আজ তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে চোখ মেলা দৃষ্টি উন্মুক্ত করতে। চোখ যুগলে আঠালো ভাবটা স্পষ্ট! অতঃপর চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে সাটান হয়ে বসে পড়ল মেহের। তার মাথায় চিনচিন ব্যথা করছে। শরীরে একরাশ দুর্বলতার আগমন ঘটেছে। মনে হচ্ছে বিছানা থেকে নামলে মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে যাবে। প্রায় মিনিট পাঁচেক অতিক্রম হতে মেহের দৃষ্টিপাত ফেলল দেয়াল ঘরির কাটাতে। কতোই না দেরি করে ঘুম ভেঙেছে তার! ইশ আজকে সালাত আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। তৎক্ষণাৎ মেহেরের অন্তরালে বিষণ্ণতার আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে তীব্রভাবে তার হৃদয়মনে ব্যথা করে উঠছে। আজ অনেক দিন পর সে ভোর রাতে জাগ্রত হতে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টা মেহেরের মস্তিষ্ক ভরে ঘৃণার উৎপত্তি ঘটাতে সক্ষম হলো। পরক্ষণেই বিছানা ত্যাগ করে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে দিকে ধাবিত হলো সে। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে স্কুল ড্রেস পড়ে নিল। তার মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু মেহের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিল না। দুর্বল শরীর নিয়ে ধীর পায়ে ধাবিত হলো ড্রইং রুমের দিকে।
_____
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি বিলাস করতে ব্যস্ত সমুদ্র। আকাশ পানে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বারংবার অধরে চায়ের উষ্ণ ছোঁয়া দিচ্ছে সে। এই অভ্যাস বরাবরের মতোই তার মধ্যে বিদ্যমান। প্রতিদিন সকালে চায়ের সঙ্গে প্রকৃতি বিলাস তার রক্তের সাথে মিশে গিয়েছে। অভ্যাসটা তার হৃদয়মনে আনন্দের উৎপত্তি ঘটায়। মস্তিষ্কে ভেসে উঠে ছেলে বেলার স্মৃতি। সমুদ্রের ছোট বেলাটা গ্রামে অতিবাহিত হয়েছে। তার বয়স যখন দশ, তখন তাকে ছেলে বেলার স্মৃতি মাখা গ্রাম ত্যাগ করতে হয়। তারপর থেকেই তারা সপরিবারে শহরে এসে পড়ে। খুব একটা ছোট্ট থাকলেও সেই সুমধুর স্মৃতি গুলো তার মস্তিষ্ক থেকে বিদায় নেয় নি। এখনো বেলকনিতে সকাল বেলা এক কাপ চায়ের সঙ্গে উপস্থিত হলে তার সেই স্মৃতি গুলো চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠে। মনে পড়ে যায় ঘুম থেকে উঠে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতল সকালে কল পাড় হতে কনকনে ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে কাঁপতে কাঁপতে রান্নাঘরে যাওয়া ঘটনা। মায়ের আঁচলে মুখ মুছে উষ্ণ উনুনের তাপ পোহানো। মনে পড়ে যাই, মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলে চায়ে উষ্ণ ছোঁয়াতে জিহ্বা পুড়িয়ে ফেলার স্মৃতিচারণ মুহূর্ত। মূলত এই বিশেষ কারনে সমুদ্রের চা খুব বেশি পছন্দের। আর যাই হোক সকালটা তার চায়ের সঙ্গেই কাটাতে হবে। লহমায় মায়ের কথা মনে করে সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে।
কিন্তু পরক্ষণে রান্না ঘর হতে পানি বিন্দু বিন্দু জলের কলকল ধ্বনি তার কর্ণকুহরে পৌঁছতেই সমুদ্র সজাগ হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ বেলকনি প্রস্থান করল সে। দ্রুত পদে পা জোড়া চলমান করল ড্রইং রুমের উদ্দেশ্য।

ড্রইং রুমে উপস্থিত হতেই সমুদ্রের অন্তারালে ক্রোধ নামক অনুভূতি আবির্ভাব ঘটল। অধিক রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। আচ্ছা মতো থাপ্পড়াতে ইচ্ছে করছে মেহেরকে। মেয়েটা কতো বড় স্পর্ধা? এমন শরীর নিয়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হয়েছে! কাল সারা দিন জ্বরের ঘোরে বমি করে অস্থির ছিল। সে আজই কাজ করতে রান্নাঘরে এসেছে। সমুদ্র একপর্যায়ে রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে ব্যর্থ হলো। অবশেষে ধীরে পায়ে রান্নাঘরের এক কোণে এসে দাঁড়াল। লহমায় দাঁতে দাঁত চেপে কর্কশ গলায় ধমকের স্বরে বলে,

–এই মেয়ে সাহস তো কম না তোমার? ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই রান্নাঘরে এসে পড়েছ? আমি কী তোমাকে রান্না করতে বলেছি?

থালা বাসন পরিস্কার করতে ব্যস্ত ছিল মেহের। হঠাৎ কাজের মাঝে সমুদ্রের ভয়ঙ্কর কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সে হাত থেকে দ্রুত থালা রেখে দিয়ে সমুদ্রের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। একপলক সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলতেই তার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সে।

তৎক্ষণাৎ সমুদ্রের দৃষ্টি পড়ল মেহেরের পাণ্ডর মুখশ্রীতে। জ্বরের সঙ্গে লড়াই করে মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে! মুহূর্তেই রাগ যেন আষ্টেপিষ্টে চেপে বসল সমুদ্রের মস্তিষ্ক জুড়ে। ফির সমুদ্র মেহেরের মুখশ্রীতে কঠোর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। অতঃপর কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল,

–আর ইউ স্টুপিড! তুমি কী কিছু বুঝ না, হুম? এই যে কাল সারাদিন আমার সময় ওয়েস্ট করেও তোমার শান্তি হয় নি? কালকে তো হাত দিয়ে খাবারটাও খেতে পারলে না। আর আজকেই একটু সুস্থ হতেই রান্না ঘরে চলে এলে? আশ্চর্য!

সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো শুনে লজ্জিত হলো মেহের। ইশ, কালকে তো তার জ্ঞানই ছিল না। নিশ্চয়ই লোকটার বড্ড কষ্ট হয়েছে তার অসুস্থতার জন্য। বিষয়টা ভেবে একরাশ শীতল অনুভূতি বইয়ে গেল তার হৃদয়মনে। সমুদ্রের বকুনি তিক্ত হলেও তার হৃদয়ে অনন্দের উদ্ভাবন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। পুনরায় মেহেরের কর্ণপাত হলো সমুদ্র কন্ঠস্বর। এবার সমুদ্র মেহেরের কিছুটা নিকটবর্তী এসে বলে উঠল,

–এই মেয়ে চুপ করে আছো কেন? কান খুলে শুনে রাখো আবার যদি অসুস্থ হও তাহলে তোমাকে আমি চুপচাপ তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে আসব। আন্ডারইস্টান্ড?

সমুদ্র কথা শুনে অপরাধীর ন্যায় ফ্লোরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইল মেহের। সমুদ্র এতো বকা শুনেও তার হৃদয়ে ব্যথার আগমন ঘটল না। অনুভূতিহীন নির্বাক হয়ে রইল সে। সমুদ্রের ফির মেহেরের মলিন মুখশ্রীতে তাকিয়ে বলে উঠল,

–এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসো।

সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রত্যুত্তরে নিম্ন কন্ঠে মেহের বলে উঠল,

–এইতো নাস্তাটা সার্ভ করে তারপর নাহয়,,,

মেহেরের সম্পূর্ণ কথা সমাপ্ত করতে দিল না সমুদ্র। কথার মাঝেই দাঁতে দাঁত চেপে মেহেরের উদ্দেশ্য বলল,

–বাহ্, এতোই কাজ করতে মন চাই তোমার! চিন্তা কর না, পড়ালেখার যে অবস্থা করে রেখেছ কয়দিন বাদে তোমাকে গৃহকর্মী হিসেবে অন্যের বাড়ি কাজ করতে হবে।

সমুদ্রের বলা শেষোক্ত বাক্যটা শুনেই মেহের মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কখনোই তাকে পড়ালেখার খোটা কেউ দেই নি। বরাবর সে তার মেধা দিয়ে শিক্ষকদের মনে স্থান করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে একমাত্র সমুদ্র নামক শিক্ষক তাকে না জেনেই পড়ালেখার জন্য বাজে ভাবে কথা বলে। শুধুমাত্র একটা দিন ক্লাসে পড়া দিতে পারেনি সে।তার উপর ভিত্তি করেই সমুদ্র তাকে উপেক্ষার পাত্রীর ন্যায় আচরণ করে। খানিক মন খারাপ হলেও বিষয়টা সাদরে গ্রহণ করল মেহের। চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
(চলবে)

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:২৬
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]

হ্যায়ার ম্যাথ বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রয়েছে মেহের। অত্যধিক মনোযোগের সহকারে সূত্র মুখস্ত করতে ব্যস্ত সে। কিন্তু তার মাধুর্যপূর্ণ মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট! নিশ্চিত তার এই বিরক্তিগ্রস্ত মুখশ্রীতে একবার সমুদ্রের দৃষ্টি পড়লেই, সে স্তম্ভিত হয়ে উঠত। কারণ সমুদ্র মনে হয়, মেহেরের অন্তরালে কোন অনুভূতি নেই। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেমন দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ পেলে, তা না চাইতেও অন্যের নিকট প্রকাশ করে তার অনুভূতি প্রকাশ করে ধরণীর বুকে। কিন্তু সমুদ্রের ধারণা মেহেরে অনুভূতিহীন নির্বাক। তাই বিরক্ত নামক অনুভুতি মেহেরকে গ্রাস করতে পারে না।

বারংবার মেহেরকে ইচ্ছে মতো বিরক্ত করে যাচ্ছে দিশানি। বর্তমানে মেহেরদের ক্লাসে শিক্ষক উপস্থিত নেই। এই সুযোগে ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাসটা কোলাহল পূর্ণ স্থানে তৈরি করে ফেলছে। কিন্তু অসহায় মেহের, তার বড্ড অভিপ্রায় জাগছে পড়া বাদ দিয়ে তিতাস আর দিশানির সঙ্গে খেজুরে আলাপে যুক্ত হতে। কিন্তু সে নিরুপায়। অদম্য আগ্রহে সূত্র পড়ছে সে। কারণ তাকে যে করেই ক্লাস টেস্ট পরীক্ষায় ফাস্ট হতে হবে। টিফিনের পরে ক্লাসে হ্যায়ার ম্যাথ টিচার তাদের পরীক্ষা নিবেন। দু দিন স্কুলে উপস্থিত হতে পারে নি মেহের। ফলে পরীক্ষার বিষয়টা তার অজানা ছিল। তাই এখন যে করেই হোক তাকে আজকে পরেই পরীক্ষা দিতে হবে। লহমায় দিশানি মেহেরের পিঠে স্পর্শ করে জোর গলায় বলে উঠল,

–এই মেহের, আশ্চর্য তো তুই এতো পরছিস কেন? দেখ আমি তিতাস কেউই পিপারেস নিয়ে আসি নি। সো নো টেনশন ।

দিশানির কথা কর্ণপাত হতেই মেহের বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকাল। ভ্রূ যুগল কুঁচকে মৃদু স্বরে বলল,

–উহু! দিশু বিরক্ত করিস না আমাকে। প্লিজ।

দিশানি কিছু বলে উঠার পূর্বে তিতাস অসীম প্রফুল্লের সহিত বলে উঠল,

–দেখ মেহের চিল। এতো টেনশন নিচ্ছিস কেন? আজকে আমারও হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষা আছে। তাই আমি আজকে টিফিন বাসায় চলে যাব। তুই ও চলে যাস। পড়তে হবে না।

তিতাসের কথা শুনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল মেহেরের ঠোঁটের কোণে। তিতাসের কথার প্রত্যুত্তরে মেহের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে উঠল,

–তোরা যা করার কর। আমি কাছে পরীক্ষা দিতে অনেক ভালো লাগে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমার রেজাল্ট পেতে খুব বেশিই ভালো লাগে। চাতক পাখির মতো, আমি পরীক্ষা দেওয়ার আগে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। তাই দয়া করে আমাকে পড়তে দে ভাই।

মেহেরের বলা প্রতিটি বাক্য তিতাসের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই স্তম্ভিত হয়ে উঠল সে। দিশানি স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুটা মুহূর্ত। খানিক বাদে দিশানি মেহেরের পিঠে আস্তে করে বারি দিয়ে বলতে লাগল,

–আচ্ছা, তোকে আর বিরক্ত করব না। শুধু একটা কথা বলতে দে। হুম?

দিশানির কথার প্রত্যুত্তরে মেহের ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বলল,

-হু, বল।

তৎক্ষণাৎ অনুমতি পেয়ে দ্রুত ঠোঁট সংকুচিত করে দিশানি বলে উঠল,

–মেহের, তোর চুল গুলো দেখতে চাই। না করবি না প্লিজ। তুই তো স্কার্ফ পড়ে আসিস তাই তো দেখলাম না। শুধু একপলক দেখব। প্লিজ টিফিনের পর কমন রুমে গিয়ে দেখাবি। একবার,,,

দিশানির বাগযন্ত্র হতে নির্গত শেষোক্ত বাক্যটা মেহেরের কর্ণপাত হতেই হতভম্ব হয়ে উঠল সে। একরাশ দ্বিধা, সংকোচের উৎপত্তি ঘটল তার হৃদয় মনে। অতঃপর দিশানির মুখশ্রীতে বিহ্বল চাউনি নিক্ষেপ করে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,

–সরি দিশু। দেখ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ টিফিন করন না। শুধু মাত্র পড়াগুলো কম্পলিট করব। আর তুই বলছি কমন রুমে যাওয়া কথা! তাছাড়া কত্ত ভিড় থাকে ওখানে। আমি যাব না।

মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে দিশানি মন খারাপ করে বলে উঠল,

–আচ্ছা, তাহলে ছুটির পর?

দিশানির শেষের কথাটা শুনতেই খানিকটা চিন্তিত হয়ে উঠল মেহের। ছুটর পর তো তার জন্য সমুদ্র অপেক্ষা করবে। যদি লেট হয়ে যায় তাহলে তো তার ভাগ্যে দুঃখের শেষ নেই। বিষয়টা ভাবতেই অসীম জড়তার আবির্ভাব ঘটল। পুনরায় সে দিশানির মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলতেই সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে রাজি হয়ে গেল। চটজলদি উত্তর দিল,

–আচ্ছা ঠিক আছে তো। এখন আমাকে পড়তে দে।

মেহরের হ্যাঁ বোধক জবাব পেয়ে খুশি হয়ে পড়ল দিশানি। মেহেরকে এক কোণে বসিয়ে সে মাঝখানে বসে পড়ল। যেন তাদের আলাপে মেহরের পড়াই ডিস্টাপ না হয়।
____________
মেহরেদের ক্লাসে সমুদ্র প্রবেশ করেছে মিনিট পাঁচেক পূর্বে। ক্লাসে আসতেই তার দৃষ্টি সর্বপ্রথম পড়ছে মেহেরের মুখশ্রীতে। আজ ও মেহের তিতাসের সঙ্গে একই বান্চে বসেছে। বিষয়টা দৃশ্যমান হতেই সমুদ্র মেজাজটা বেশ বিগরে গিয়ছে। মেহেরকে সে বারণ করে দিয়েছি যেন তিতাসের সঙ্গে না থাকে। কিন্তু মেয়েটা তার কথার অবাধ্য হয়েছে। প্রথমে বিষয়টা সমুদ্রের মস্তিষ্ক গুরুত্ব দেই নি। সমুদ্র ভেবেছে, মেয়েটা যার সঙ্গে ইচ্ছে তার সঙ্গে থাকুক। তার এতে কিছুই যাই আসে না। কিন্তু ক্লাসে সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে, তার মস্তিষ্কে ততোটাই ক্রোধের আবিষ্কার ঘটছে। খানিক বাদেই আদিবা নামের মেয়েটা সমুদ্রকে ডাক দিল। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র ধীর গতিতে আদিবার নিকটবর্তী এসে দাঁড়াল। কর্কশ স্বরে আদিবাকে জিজ্ঞেসা করল,

–কিছু বলবে?

–জী স্যার।

অতঃপর আদিবা মেহেরের দিকে ইশারা দিয়ে বলে উঠল,

— দেখুন স্যার, ওই মেয়েটা অন্য টিচারের হোম ওয়ার করছে। তার চেয়ে বড় কথা আপনার লেকচারে মনোযোগ দিচ্ছে না। আশা করি আপনি এই অপরাধের বিচার করবেন।

সমুদ্র আদিবার কথা মতো মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। কিছু বলে উঠার পূর্ব আকস্মিক সমুদ্রের ফোনটা শব্দ করে উঠল। সমুদ্র মেহেরকে কিছু না বলে ক্লাস রুম থেকে প্রস্থান করল। পকেট থেকে ফোন বের করতেই তার দৃশ্যমান হলো অহনা কল করেছে। মুহূর্তেই কল রিসিভ করে শক্ত কন্ঠে বলল,

–ফোন দিয়েছিস কেন?

সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে অপর প্রান্ত হতে অহনা বলে উঠল,

–ওই শুনছিস তো, আমারা আজকে দেশে ফিরেছি। তাই আমি চাচ্ছি মেহেরকে আজকে বিকেলে ছুটির পর স্কুল থেকে আমার বাসায় নিয়ে আসব। সো তুই মানসিক ভাবে প্রস্তুত হ। তুই যদি আমাকে বারণ ও করিস তাহলেও আমি কিন্তু শুনব না। স্কুল ছুটির আগেই আমি তোদের স্কুলে উপস্থিত থাকব। আচ্ছা বাই। তোকে বিরক্ত করার জন্য সরি।

অবিরাম কথাগুলো বলেই কল কেটে দিল অহনা। সমুদ্রের প্রত্যুত্তর জানার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। অহনা বলা কথাগুলো শুনে একরাশ বিরক্তির আবির্ভাব ঘটেছে সমুদ্রের মুখশ্রীতে। অবশেষে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করে ক্লাস রুমে উপস্থিত হলো সমুদ্র। পরিশেষে আদিবার কথার পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্র শক্ত কন্ঠ মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

–স্টান্ড আপ মেহের!

হঠাৎ সমুদ্রের কন্ঠস্বর মেহেরের কর্ণপাত হতেই কেঁপে উঠল সে। মুহুর্তে বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

মেহেরের পরিস্থিতি দেখে সমুদ্র তার হাত ঘরির দিকে একপলক দৃষ্টিপাত ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

–দাঁড়িয়ে থাকো ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

মেহেরকে শাস্তি দিতে সমুদ্রের মন না চাইলেও একপর্যায়ে মস্তিষ্কের কথা শুনতে বাধ্য হলো সে। এটাই একমাত্র উপায় যা তার রাগ নিমন্ত্রণ করতে সফল হবে।
__________

স্কুল ছুটি দিয়েছে খানিক পূর্বে। পুলকিত মন নিয়ে একটা ফাঁকা রুমে এসেছে মেহের, তিতাস এবং দিশানি। সমুদ্রের দেওয়া শাস্তি সম্মুখীন হয়েও মেহের বর্তমানে বড্ড আনন্দিত। কারণ মেহেরের আজকের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। তার ধারণা মতো রেজাল্টে সে সম্পূর্ণ মার্কস পাবে। তাই আনন্দিত মনে দিশানির সঙ্গে ফাঁকা রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে সে।
___
স্কুলে ছুটির পর তন্নতন্ন করে মেহের কে খুঁজে চলছে সমুদ্র। তখন মেহেরকে শাস্তি দেওয়াতে তার অন্তরালে ক্ষোভ ও ধিক্কারের উপস্থিত ঘটেছে। মেয়েটা তো অসুস্থ ছিল। তাছাড়া এখনো মেহের সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে নি। এমন অবস্থায় তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া একদম উচিত হয়নি সমুদ্রে। এক কথাই সমুদ্র নিজ কৃতকর্মে বড্ড অনুতপ্ত। তার হৃদয় গহীন পিপাসীত হয়ে উঠেছে মেহেরকে একপলক দেখার জন্য। তাই মেহেরকে খুঁজে চলছে সে। কিছুদূর অতিক্রম করতে সমুদ্র দৃশ্যমান হয় তিতাস কে। তৎক্ষণাৎ দ্রুত পদে ক্লাস রুমটার সামনে উপস্থিত হয় সে। তিতাসের মুখশ্রীতে মনোযোগ সহকারে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্র। লহমায় তার শরীরে অত্যধিক রাগ এসে হাজির হয়। শরীরের শিরা উপশিরাতে রক্ত চলাচল দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। তিতাস তাকে দেখে কিছু বলে উঠার পূর্বে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে সে।

ক্লাসে ভেতরে উপস্থিত হতেই সমুদ্র দৃশ্যমান হলো লম্বা চুলের অধিকারী মেহেরকে। মুহূর্তেই সমুদ্রের শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মেহেরের পরিস্থিতি দেখে তার মস্তিষ্ক কার্যকর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। অত্যধিক রাগে সাংঘাতিক কান্ড করে বসল সে। ক্রোধের বসে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেহেরের ডান গালে হঠাৎ থাপ্পড় দিয়ে বসল।

থাপ্পড়টা এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে মেহের তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে উপর আঁচড়ে পড়ল।

(চলবে)

[রিচেক দেইনি।ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]