তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-২৭+২৮

0
954

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:২৭
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]

ক্লাসে ভেতরে উপস্থিত হতেই সমুদ্র দৃশ্যমান হলো লম্বা চুলের অধিকারী মেহেরকে। মুহূর্তেই সমুদ্রের শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মেহেরের পরিস্থিতি দেখে তার মস্তিষ্ক কার্যকর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। অত্যধিক রাগে সাংঘাতিক কান্ড করে বসল সে। ক্রোধের বসে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেহেরের ডান গালে হঠাৎ থাপ্পড় দিয়ে বসল।

থাপ্পড়টা এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে মেহের তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে উপর আঁচড়ে পড়ল। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা বুঝে উঠতে ব্যর্থ হলো দিশানি। আকস্মিক সমুদ্রের থাপ্পড়টা দিশানিকে অত্যধিক চিন্তিত করে তুলছে। তাদের সমুদ্রের স্যার রাগী হলেও কখনো কাউকে আঘাত করে নি। কিন্তু কি এমন হলো যে আচমকা সমুদ্র মেহেরকে থাপ্পড় মারল? দিশানির মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। মুহূর্তেই সে কম্পানিত শরীর নিয়ে মেহেরের নিকট ধাবিত হলো। কিন্তু তার যাওয়ার পূর্বে সমুদ্র গিয়ে দ্রুত মেহেরকে ফ্লোর থেকে তুলল। অতঃপর মেহেরের দু হাতের বাহু সমুদ্র তার শক্ত হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করল। রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণকৃত চোখ জোড়ার কঠিন দৃষ্টিপাত মেহেরের মুখশ্রীতে ফেলল। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক তার অচঞ্চল দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইল মেহেরের সজল চোখে। মেহেরের আঘাত প্রাপ্ত গাল লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। তার চোখ মুখে ব্যথাতুর ভাবটা স্পষ্ট। ব্যথায় মলিন হওয়ার সত্বেও ছোট মেয়েটার চোখ হতে এক ফোঁটাও জল মাটিতে পড়ে নি। ব্যথার যন্ত্রণা মেহের দাঁত দাঁত চেপে ধরে নত দৃষ্টিতে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জ্বরের সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হওয়া অসুস্থ
শরীর আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছে। একরাশ দুর্বলতার আবির্ভাব ঘটেছে মেহেরের দেহে। কিন্তু মেহেরের পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারল না সমুদ্র। সমুদ্রের চোখে ক্রোধের অগ্নি ঝড়ছে। সেকেন্ড পাঁচেক পর সে মেহেরের বাহু শক্ত করে ধরে কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলে উঠল,

–তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তুমি যেন ছেলেদের সঙ্গে ঘুরাঘুরি না কর। আর তুমি? কিন্তু তুমি এখানে চুল ছেড়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ! আমি তো ভাবতাম তুমি ধার্মিক মেয়ে।

কথাগুলো বলে তপ্ত নিশ্বাস ত্যাগ করল সমুদ্র। অবশেষে দিশানির হাত থেকে মেহেরের স্কার্ফ টা সমুদ্র টান দিয়ে নিজ হাতে নিয়ে মেহেরের মাথা ডেকে দিল। ফির চিৎকার করে ভর্ৎসনা স্বরে বলতে লাগল,

–এভাবে থাকার সাহস কীভাবে পেলে তুমি?

সমুদ্রের কথার মাঝে দিশানি নিম্ন স্বরে অত্যধিক কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল,

–স্যার এখানে শুধু মাত্র আমিই ছিলাম। আর আপনি কে হন ওকে বকা দেবার।

দিশানির বলা বাক্যগুলো সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই তার রাগ দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেল। কিন্তু দিশানিকে গুরুত্ব দিল না সে। দিশানির কথায় পরিপ্রেক্ষিতে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে দাঁত দাঁত চেপে কর্কশ গলায় বলে উঠল,

–আচ্ছা মানলাম তুমি আর দিশানি এই রুমে ছিলে। তাহলে তিতাস বাইরে কী করছিল? আনসার মি?

সমুদ্রের কথাগুলো শুনে ধ্বক করে উঠল মেহেরের অন্তরাল। সমুদ্রের দেওয়া প্রথম থাপ্পড়টা তাকে যতটুকু ব্যথা দিয়েছে তার চেয়ে অত্যধিক বেশি ব্যথা দিয়েছে সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো। পরিশেষে মেহেরের চোখ যুগল হতে দু ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে ধরণীর বুকে গড়িয়ে পড়ল। পুনরায় সমুদ্র কিছু বলে উঠার পূর্বে রুমটাতে অহনার আগমন ঘটল। দ্রুত পায়ে মেহেরের নিকটবর্তী এলো অহনা। তার পিছু পিছু রুমে প্রবেশ করল তিতাস। মেহেরের নিকটবর্তী আসতেই অহনা স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। খানিক বাদে টান দিয়ে মেহেরকে সমুদ্রের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল। অতঃপর মেহেরকে নিজ বাহু ডোরে আবদ্ধ করে, সমুদ্রের উদ্দেশ্য চিৎকার করে বলল,

–তোর সাহস হয় কী করে, মেহেরের গায়ে হাত তুলার? আর ইউ ম্যাট! তুই ওকে মারলি কেন?

অহনার কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র জোর গলায় বলল,

–ও অন্যায় করেছে তাই ওকে মেরেছি। আন্ডারস্টান্ড?

অহনা সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে বলল,

–মেহের যা ইচ্ছে তাই করবে। তোর তাকে কী, হুম? তুই ওর সামনে আর কখনো আসবি না বুঝলি? আমি আন্টিকে কল করব যেন তার বিগড়ে যাওয়া ছেলেটাকে শাস্তি দিয়ে যাই। তোকে আর মেহেরের দায়িত্ব নিতে হবে না। যা আজ থেকে তুই মুক্ত। আন্টি যতদিন না আসবে ততদিন মেহের আমার কাছে থাকবে। আসলে তুই মেহেরের যোগ্য না। আজকে ভালোভাবে প্রমাণ করে দিলি।

অহনার কথা উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না সমুদ্র। তপ্ত শ্বাস ফেলে দ্রুত পদে রুম থেকে প্রস্থান করল সে। সমুদ্র যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অহনাকে ঘিরে ধরল তিতাস। অহনার উদ্দেশ্যে সন্দেহ কন্ঠে বলে উঠল,

–আপু, সমুদ্র স্যার মেহেরের কী হয় বলুন?

তিতাসের কথায় প্রত্যুত্তরে অহনা মুচকি হেসে বলে উঠল,

— কেউ হয় না।

অহনার কথার প্রেক্ষিতে তিতাস ভ্রূ যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে সন্দেহ কন্ঠে বলল,

–যদি কিছু নাই হন, তাহলে ওনার সাহস হয় কি করে মেহেরকে মারার? উনি যে এতোটা বাজে স্বভাবের তা আমি জানতাম না। এতোদিন ওনাকে স্যার হিসেবে অনেক সম্মান করতাম। কিন্তু আজ মেহেরের প্রতি ওনার ব্যবহার দেখে, বিশ্বাস করুন আপু তখন আমার শরীর শুধু থরথর করে কাঁপছিল। আজ যদি উনি আমার শিক্ষক না হতেন তাহলে ওনাকে আমি কখনোই ছেড়ে দিতাম না।

তিতাসের কথা শেষে দিশানি বলে উঠল,

–সত্যি আপু বলুন না সমুদ্র স্যার মেহেরের কি হয়?

অবশেষে বিপাকে পড়ে গেল অহনা। দৃষ্টিপাত ফেলল মেহেরের মলিন মুখশ্রীতে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মেহেরের মুখে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বলল,

–আরে সমুদ্র মেহেরের বাসার আশেপাশে থাকে। এক কথায় বলত পার মেহেরের ভাইয়ের মতো।

অহনার শেষোক্ত কথাটা বিশ্বাস করল তিতাস এবং দিশানির অবুঝ হৃদয়মন। পরিশেষে অহনা আদেশ পেয়ে তারা নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা দিল। যাওয়ার পূর্বে তারা মেহেরের সরি বলে পা ধাবিত করল। অতঃপর মেহেরকে নিয়ে ক্লাস রুম হতে প্রস্থান করল অহনা।
______________

ঘরির কাটাতে ছুঁই ছুঁই পাঁচটা। বিছানার উপর আধশোয় হয়ে বসে রয়েছে মেহের। সিআইডি অফিসার সমুদ্রের একটা থাপ্পড় খেয়ে তার অবস্থা বেগতিক। মেহেরের শুভ্র রঙের গালে রক্ত জমাট বেঁধে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। ব্যথায় তার অন্তত বিষাদ ময় হয়ে রয়েছে। অথচ অহনাকে কিছুই বুঝতে দিচ্ছি না সে। ওষুধ খেয়ে মলিন মুখশ্রীতে পলক হারিয়ে সে। সে পলকহীন নয়নে সামনে দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রয়েছে। বিছানা থেকে তার দৃশ্যমান হচ্ছে রুমটার সঙ্গে এটাস্ট করা ফাঁকা, উন্মুক্ত বেলকনি। দোতলার একদম শেষের রুমে মেহেরকে নিয়ে এসেছে অহনা। শুভ্র, স্বচ্ছ দোতলা এপাটমেন্ট অহনার। এপাটমেন্টটা ছোট হলেও বেশ আড়ম্বর পূর্ণ। এপাটমেন্টের প্রতিটি স্থান দেখে যে কেউ বলবে অত্যধিক পরিকল্পনা করে তৈরি করা হয়েছে। ড্রইং রুম ব্যতীত মোট আটটা রুম রয়েছে অহনার বাড়িতে। মেহেরেকে নির্ভীক রাখাতে অহনা তার পাশে অবস্থিত রুমটা মেহেরের জন্য ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে মেহেরের সঙ্গে খেজুরে আলাপে মত্ত অহনা। লহমায় অহনার শাশুড়ি তাকে ডাক দিলেন। আর এক মুহূর্তে অপেক্ষা করল না অহনা। মেহেরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দৌড়ে ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো সে। মুহূর্তেই অহনার দৃশ্যমান হলো কঠোর মনের অধিকারী সমুদ্রেকে। সমুদ্র মেইন ড্রোরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার শাশুড়ি মেইন ডোর খুলে দিয়ে নিজ রুমের দিকে ধাবিত হয়েছে।
পরিশেষে অহনাকে দৃশ্যমান হলো সমুদ্রের। হাল্কা পুলকিত হৃদয়ে সে বাইরে থেকে নিম্ন স্বরে বলতে লাগল,

–অহনা, মেহেরকে ডাক দে। মেহের তো অসুস্থ তাই ওকে ছেড়ে দে। ও নাহয় অন্য কোনদিন তোদের বাসায় থাকবে।

সমুদ্রের কথা অহনার মাথা গরম হয়ে উঠল। দ্রুত পায়ে সে সমুদ্রের নিকটবর্তী হলো। অতঃপর কর্কশ কন্ঠ বলে উঠল,

–মেহের অসুস্থ তাই বুঝি! যখন মেহেরকে থাপ্পড়টা মারলি তখন মনে ছিল না? দেখ আমার ভালো লাগছে না। তুই চলে যা।

অহনার কথায় সমুদ্র অনুরোধ স্বরে বলল,

–ঠিক আছে মেহেরের নিব না। কিন্তু প্লিজ ওকে একটিবারের জন্য আমার সামনে আসতে বল। প্লিজ।

সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো অহনার হৃদয় স্পর্শ করতে বাধ্য হলো। অহনা সমুদ্রকে উপেক্ষা করে বলে উঠল,

–সত্যি কথা বলতে তুই মেহেরকে ডিজাভ করিস না। আজ যা করলি ও কারণে মেয়েটাকে ব্যথা দিলি। তিতাস আর মেহেরের সম্পর্ক ভাই বোন ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তুই এখন যা তো। আমার বিরক্ত লাগছে তোকে দেখে!

কথাগুলো বলেই অহনা মেইন ডোর সমুদ্রের মুখের উপর বন্ধ করে দিল। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে নিজ এপাটমেন্টের উদ্দেশ্য।
_______
মাগরিবের আযান দিয়েছে খানিক পূর্বে। ধীরে ধীরে দিনের আলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে রাত্রির অন্ধকার। গোধূলি লগ্ন! মেহেরের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে সমুদ্র। মেহের হীনা ক্ষণে ক্ষণে সমুদ্রের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার হাতের রক্ত গ্রন্থি হতে অঝরে রক্ত টপটপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। নিজের উপর বড্ড ক্ষোভ হচ্ছে তার। সে মেহেরকে অকারণে ব্যথা দিয়েছে ! আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেতে বারবার নিজকে আঘাত করছে সে। তাও যেন তার হৃদয় গহীন শান্ত হচ্ছে না। অবশেষে নিজেকে শান্ত করতে সমুদ্র রক্ত মাখা হাতে মেহেরের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্রমশ পাগলে পরিণত হচ্ছে সমুদ্র। নিজের রুমে তার অবাধ্য মন টিকে নি। তাই বাধ্য হয়ে মেহেরের রুমে এসেছিস সে। কী আছে ওই পুচকির মধ্যে, যা সমুদ্রের হৃদয়ে ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় তাকে অশান্ততা বহমান করতে সক্ষম হয়। বর্তমানের সমুদ্রের চোখ জোড়া তীর্থের কাকের ন্যায় দীর্ঘ প্রতীক্ষায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে মেহেরকে একপলক দেখার জন্য। আজ যদি সমুদ্র যদি মেহেরকে না দেখে তাহলে নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বে সে। অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করে নিয়েছে সমুদ্রের অন্তরাল। তার হৃদয় ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। মাত্র পনেরো বছরের বাচ্চা মেয়েটা অতি স্বল্প সময়ে সমুদ্রের আটাশ বছরের মস্তিষ্ক কার্যকর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে। সমুদ্রের মস্তিষ্কও বারংবার বলে উঠছে, আজ যদি তার চোখ জোড়া মেহেরের দেখা না পায়, তাহলে রাত্রি বেলা শান্তিতে ঘুমে আচ্ছন্ন হতে পারবে না সে। তার হৃদয়মন বাজে ভাবে মেহের নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে পরেছে। এখন তার মেহেরের খুব করে প্রয়োজন। ধরণীর বুকে প্রতিটা মানুষ যেমন গ্রীষ্মকালে গরম নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত হলে তাদের শীতল হাওয়ার প্রয়োজন হয় আবার শীতকালে ঠান্ডা নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত হলে মানুষের যেমন উষ্ণ চাদরের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি বর্তমানে সমুদ্র মেহের নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত, তার এখন মেহেরকে বড্ড প্রয়োজন। অন্যথায় সমুদ্রের শরীর শীঘ্রই অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।
_________________________

রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে রয়েছে মেহের। অবশ্য গালে ব্যথা হওয়ার জন্য খেতে বেশ অসুবিধা হয়েছে তার। এতক্ষণ অহনার ছেলের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠেছিল সে। অহনার ছেলে মেহেরকে এতোটাই পছন্দ করেছে যে বাচ্চাটা মেহেরের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। খানিক পূর্বে ঘুমন্ত ছেলেকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়েছে অহনা। আয়ান অর্থাৎ অহনার ছেলে যাবার পর থেকে ক্রমশ বিষাদগ্রস্ত উঠছে মেহেরের অন্তরাল। একরাশ অভিমান জমেছে সমুদ্রের প্রতি। আজ সমুদ্রের আচরণ তাকে বেশ ব্যথিত করছে। সমুদ্র কেন বুঝে না, তার বুকেও যে বিষাদ জমেছে অগুনিত? সমুদ্রের কথা চিন্তা করতে করতে মেহের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
____
ঘরির কাটাতে ছুঁই ছুঁই বারোটা। মধ্যরাতে মেহেরের অনুভব হচ্ছে কেউ তার মুখের উপর ঝুকে আছে। লোকটার ঘনঘন ত্যাগকৃত উষ্ণ নিশ্বাশ মেহেরের মুখশ্রীতে আষ্টেপিষ্টে উপচে পড়ছে। ফলে পুরনো ঘটনার ভয়ঙ্কর অনুভূতি তাকে চেপে ধরেছে। অতিরিক্ত ভয়ে জেগে থাকা সত্ত্বেও চোখ জোড়া উন্মুক্ত করার সাহস হচ্ছে না তার। ঠিক তখনি আচমকা মেহেরের মুখ লোকটা জোরে চেপে ধরল। ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে কিন্তু লোকটার বলিষ্ঠ হাতের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠল না। হঠাৎ লোকটার উষ্ণ,,,,,,,

(চলবে)

[রিচেক দেইনি এবং গুছিয়ে লিখতে পারি নি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:২৮
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]

ঘরির কাটাতে ছুঁই ছুঁই বারোটা। মধ্যরাতে মেহেরের অনুভব হচ্ছে কেউ তার মুখের উপর ঝুকে আছে। লোকটার ঘনঘন ত্যাগকৃত উষ্ণ নিশ্বাশ মেহেরের মুখশ্রীতে আষ্টেপিষ্টে উপচে পড়ছে। ফলে পুরনো ঘটনার ভয়ঙ্কর অনুভূতি তাকে চেপে ধরেছে। অতিরিক্ত ভয়ে জেগে থাকা সত্ত্বেও চোখ জোড়া উন্মুক্ত করার সাহস হচ্ছে না তার। ঠিক তখনি আচমকা মেহেরের মুখ লোকটা জোরে চেপে ধরল। ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে কিন্তু লোকটার বলিষ্ঠ হাতের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠল না। হঠাৎ লোকটার উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে মেহেরের শরীর শিউর উঠল। খানিকের জন্য তার অনুভব হলো লোকটা সমুদ্র। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসির উৎপত্তি ঘটল তার অন্তরালে। সত্যিই কি সমুদ্র এসেছে? বিষয়টা কি আদৌ সম্ভব! মেহের চিন্তা করল হয়তো সমুদ্র কে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে সমুদ্রের মিথ্যে উপস্থিতি অনুভব হচ্ছে তার। মুহূর্তেই তার মনে হলো সমুদ্রের মিথ্যা উপস্থিতি তার অপ্রমত্ত ছলনা বৈকি অন্য কিছুই নয়। তৎক্ষণাৎ মেহের তার গালে খসখসে কোন কিছুর ছোঁয়া পেল। জ্বলে উঠল তার আঘাত প্রাপ্ত গাল। মেহেরের মস্তিষ্ক বলে উঠল লোকটার হাত অমসৃণ কিছু দিয়ে পট্টি বাঁধা অর্থাৎ ব্যান্ডেজ করা বিধায় সে স্বল্প ব্যথা পাচ্ছে। অবশেষে ভয়ের আবিষ্কার ঘটল তার হৃদয় গহীনে। তাহলে কি সত্যিই কেউ তার রুমে এসেছে? নাকি হ্যালুসিনেশন এর স্বীকার হয়েছে সে! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এতো কিছু হওয়ার পরেই মেহেরের অস্বস্তি হচ্ছে না। তার অন্তরাল বারংবার বলে উঠছে, সমুদ্র এসেছে! কিন্তু তার মস্তিষ্ক বড্ড অবাধ্য। সমুদ্রের উপস্থিতি মানতে নারাজ।

এভাবে নিরবতা সহিত মিনিট পাঁচেক পার হয়ে গেল। মেহেরের মস্তিষ্ক বলে উঠল, হয়তো সেদিন রাতের সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। অথচ তার মন কিছুতেই মানতে চাইল না। চোখ জোড়া বন্ধ রেখে নিস্তবদ্ধতা বজায় রেখে অনুভব করতে লাগল লোকটার হাতের সযত্নে ছোঁয়া। সহৃদয়ের লোকটা তার হাত বারংবার মেহেরের গালে ছোঁয়াচ্ছে। এমন অবস্থায় মেহেরের অদম্য আগ্রহ জাগল চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে লোকটার মুখ দর্শন করতে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই, মেহেরের হৃদয় অস্বাভাবিক অনুভুতির স্বীকার হলো। হঠাৎ অনুভব হলো তার মুখশ্রী উষ্ণ জলে ভিজে উঠছে। একপর্যায়ে মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছল লোকটার ব্যথাতুর মৃদু আওয়াজ। লোকটা মেহেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে,

–আই এম সরি, পুচকি। তোমার যে এতো ব্যথা লাগবে আমি বুঝতে পারি নি। বিশ্বাস করো তখন আমার মাথা একদমই ঠিক ছিলো না।

লোকটার গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে মেহেরের চমকে উঠছে। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে সে। তারমানে এতক্ষণ তার মন যা বলছিল তাই কী সত্যি! অর্থাৎ বর্তমানে তার নিকটবর্তী সমুদ্র অবস্থান করছে? সত্যিই কী সে এমন অদ্ভুত মুহূর্তের স্বীকার হয়েছে? মেহেরের বড্ড ইচ্ছে জাগল, সমুদ্রকে দেখার। কিন্তু অভিমান যেন ঝেঁকে বসল তার অন্তরে। ইচ্ছে করেই মেহের চোখ জোড়া খুলল না সে। চুপচাপ সমুদ্রের পরিস্থিতি আন্দাজ করার প্রয়াস চালাল। লহমায় ফির সমুদ্রের ভাঙা কন্ঠে বলতে লাগল,

–তুমি কী আমাকে ক্ষমা করবে না? বিশ্বাস কর পুচকি, সেই বিকেল থেকে আমার বুকটা ছটফট করছিল তোমাকে একটিবারের জন্য দেখতে। সত্যিই বলছি আজ তোমাকে না দেখলে আমি মরে যেতাম। জান পুচকি, আমার না এখন অনেক শান্তি লাগছে। তোমাকে দেখে আমার অশান্ত হৃদয় অবশেষে শান্ত হয়েছে।

সমুদ্রের মুখ হতে অনুভূতি সম্পূর্ণ বাক্যগুলো বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হচ্ছে মেহের। এত অনুভূতি সম্পূর্ণ বাক্য কী আদৌও কোন প্রেমিক পুরুষ বলতে পারে? লহমায় নাক টেনে ফির সমুদ্র বলে উঠল,

–এই পুচকি বলো না কী আছে তোমার? কিচ্ছু নেই! কিন্তু আমি যে প্রতিনিয়ত আসক্ত হয়ে পড়ছি তোমাতে। তুমি কী জান, তুমি হীনা আমি কতোটা অসহায়? এতক্ষণ উন্মাদ পাগলের ন্যায় কাতার হয়ে উঠেছিলাম তোমার কাছে আসার জন্য। তোমাকে না দেখা অবধি ধীরে ধীরে আমার নিশ্বাশ বন্ধ হয়ে আসছিল। হয়তো এখন তোমার কাছে না আসলে সকালে আমাকে এই ধরণীর বুকে খুঁজে পাওয়া যেত কি সন্দেহ!

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল সমুদ্র। সেকেন্ড পাঁচেক নিরব থেকে পুনরায় মেহেরের কানের কাছে তার মুখটা নিয়ে এলো। মেহেরের আন্দাজ করতে পারল সমুদ্র কাঁদছে। সত্যিই সমুদ্র কাঁদছে! ইচ্ছে মতো অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। বিষয়টা লক্ষ্যে করে খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে পড়ল মেহের! সমুদ্রের চোখের জল তার হৃদয় ব্যথিত করে তুলল। সমুদ্রের পরিস্থিতি দেখে ইতিমধ্যেই মেহেরের অভিমানের জমে থাকা পাহাড় ভেঙে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একরাশ নাম না জানা অনুভূতির আবির্ভাব ঘটেছে মেহেরের হৃদয়মনে। অস্থির হয়ে পড়েছে তার অন্তরালে। মেহের আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারল না। পিটপিট করে চোখ জোড়া খুলে ফেলল। তৎক্ষণাৎ তার বেলকনির হতে নির্গত মৃদু উজ্জ্বল আলোতে সমুদ্রকে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো। মুহূর্তেই তার সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বইয়ে গেল। লহমায় সমুদ্র মেহেরের কানের নিকট হতে মুখ সরিয়ে আনল। অতঃপর কিঞ্চিৎ ঝুকে দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেলল মেহেরের মুখশ্রীতে।
হঠাৎ মেহেরের কর্ণপাত হলো সমুদ্রের ফুঁপানোর আওয়াজ। সমুদ্রের ফুঁপিয়ে কাঁদছে! সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে মেহেরের মুখশ্রীতে পড়ল। নিমিষেই ভিজিয়ে দিল মেহেরের গলা। কেঁপে উঠল মেহেরের! সমুদ্রের এতোটাই কাঁদছে যে মেহেরের মুখশ্রীতে ভিজে উঠেছে। মেহের সমুদ্রকে কান্নারত অবস্থায় সহ্য করতে পারছে না। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। পরিশেষে দিশেহারা হয়ে উঠল মেহেরের। অতঃপর সমুদ্রের ঘন ঘন নিশ্বাশ ত্যাগ করতে লাগল এবং বলে উঠল,

–এই পুচকি, চোখ খুলেছ কেন, হুম? তোমার কোন অধিকার নেই আমার এই কান্নারত মুখশ্রী দেখার। কারণ তুমি বড্ড পচা। এতটুকু পুচকি হয়েও তুমি আমাকে নিয়ন্ত্রন করছ। তুমি কী জান, আজ কত বছর পর আমর চোখে অশ্রু এসেছে! সো চুপচাপ চোখ বুজে থাকো।

সমুদ্রের আদেশ পেয়েও চোখ বন্ধ করল না মেহের। অবাধ্যের মতো ঝাপসা আলোতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের মুখশ্রীতে। সমুদ্র মেহেরের অবস্থা দেখে নিজের হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো মেহেরের চোখ জোড়া। পরক্ষণেই সমুদ্র তার চোখ যুগল বন্ধ করে লম্বা, স্নিগ্ধ বাতাস টেনে নিয়ে, পুনরায় কান্নারত কন্ঠে বলল,

–পুচকি, আমি জানি না প্রেম, ভালোবাসা কি? আদৌ কি পৃথিবীর বুকে ভালোবাসা নামক সম্পর্ক বলতে কিছু আছে কি সন্দেহ হয় আমার। আমি বিশ্বাস করি ‘ভালোবাসা’একটা অক্ষর ছাড়া অন্য কিছুই নয়। বিশ্বাস কর প্রেম, ভালোবাসার কোন মূল্য নেই আমার কাছে। কারণ হয়তো একটাই আমি কোন প্রেমিক পুরুষ নই। কিন্তু আমি যে ক্ষণে ক্ষণে একটা বাজে অনুভূতিতে গ্রাস হয়ে যাচ্ছি। সেই অনুভূতিটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। আমার কাছে মাদক আসক্তির চেয়েও অধিক মারাত্মক। অনুভূতিটাতে তুমি যদি আক্রান্ত হতে তাহলে নিশ্চিত আমার পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারতে।আজ অনুভূতিটা আমাকে হারে হারে অনুভব করিয়েছে যে তুমি হীনা আমি কতোটা অসহায়। আমার শুধু মাত্র তোমাকে প্রয়োজন। এই মুহূর্তে তোমার যেমন এই শীতল পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে উষ্ণতার প্রয়োজন। আমারও ঠিকই অন্তরের অদ্ভুত অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে শুধু মাত্র তোমাকে প্রয়োজন। এই অনুভূতির নাম কি তুমি জানো? জান না। আমার যে শুধু মাত্র অনলি ওন তোমাকে প্রয়োজন। বিকস আমি যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অনুভূতি তুমি নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত।

কথাগুলো মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খুশী ব্যক্তি মনে হলো তার। একরাশ আনন্দের আবির্ভাব ঘটল তার অন্তরালে। অত্যধিক পুলকিত হয়ে উঠেছে তার হৃদয়। পরক্ষণেই তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ বিসর্জন হয়ে গালে এসে আশ্রয় নিলো। মুহূর্তেই মিশ্রিত হয়ে পড়ল সমুদ্রের অনুভুতি যুক্ত জলে সঙ্গে। সমুদ্রের এতোটা সময়ের বিসর্জিত চোখের বর্ষণ মেহেরের মুখ হতে শুকনোর পূর্বে ফির সমুদ্র গুমরে কেঁদে উঠল। লহমায় ফির ভিজিয়ে দিল মেহেরের মুখশ্রী। অতঃপর ফিসফিস করে অস্কুটস্বরে বলতে লাগল,

–সরি পুচকি। আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি আর কোনদিনই তোমাকে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট পেতে দিব না। আমি জানি আমার পুচকি সেই ছোট্ট বেলা থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে। প্লিজ ফারগিভ মি।

বলেই সমুদ্রের চোখের বর্ষণের প্রখরতা বাড়িয়ে দিল। অবিরাম বর্ষণে ভিজিয়ে দিল মেহেরের মুখশ্রী। পরিশেষে মেহের বাধ্য হয়ে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে কম্পমান কান্নারত নিম্ন কন্ঠ বলে উঠল,

–আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ। আপনি আমার কাছে সম্মানিয় ব্যক্তি। তাই প্লিজ এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদবেন না। আমার খুবই অসুবিধে হচ্ছে না। আপনি দয়া করে এই শীতে এভাবে বসে না থেকে শুয়ে পড়ুন। আপনি বললে আমি ছোফায় যেয়ে ঘুমচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।

মেহেরের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্র,,,

(চলবে)