#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:২৯
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]
বলেই সমুদ্রের চোখের বর্ষণের প্রখরতা বাড়িয়ে দিল। অবিরাম বর্ষণে ভিজিয়ে দিল মেহেরের মুখশ্রী। পরিশেষে মেহের বাধ্য হয়ে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে কান্নারত নিম্ন কন্ঠ বলে উঠল,
–আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ। আপনি আমার কাছে সম্মানিয় ব্যক্তি। তাই প্লিজ এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদবেন না। আমার খুবই অসুবিধে হচ্ছে না। আপনি দয়া করে এই শীতে এভাবে বসে না থেকে শুয়ে পড়ুন। আপনি বললে আমি ছোফায় যেয়ে ঘুমচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
মেহেরের বলা কথাগুলো কর্ণপাত হতেই ক্রোধের বসে সমুদ্র তার ব্যান্ডেজ কৃত হাতটা বিছানার নিকটবর্তী ট্রি টেবিলের উপর সজরে মুষ্ট্যাঘাত করল। মুহূর্তেই ব্যথায় মলিন হয়ে উঠল তার মুখশ্রী। বিষয়টা মেহের বুঝতে পেরেও কিছু বলার সাহস পেল না। এখনো অবাকের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারি নি সে। সমুদ্রের এক দিনের আকস্মিক পরিবর্তন তাকে অবাক হতে অবাকতর করে তুলেছে। স্বল্প অবাক নয় সীমাহীন অবাক তাকে আষ্টেপিষ্টে ঘিরে ফেলেছে। সমুদ্রের আচমকা বদল তার নিকট স্বপ্নের মতো লাগছে। মৃদু আলোতে মেহের তার ডাগর ডাগর চোখ দুটোর দৃষ্টি পাত নিক্ষেপ করে রয়েছে সমুদ্রের মুখশ্রীতে। সমুদ্রের এই অদ্ভুত রুপটা তার হৃদয়ে অস্তিত্ব, অস্থিরতা, অশান্ততার আগমন ঘটিয়েছে। হঠাৎ ব্যথাতুর হাতটা চাদরে আড়াল করে নিল সমুদ্র। অতঃপর দ্বিধা, সংকোচ, লজ্জা হীনা মেহেরকে আবৃত করা উষ্ণ চাদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে এক কোণে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ জোড়া বন্ধ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
–ঘুমিয়ে পড় পুচকি। ওই ছোট মস্তিষ্কের উপর চাপ দিও না প্লিজ। আমার কথাগুলো বোধগম্য করার বয়স এখনো তোমার হয় নি। সো চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।
মেহের কি করবে বুঝতে পারল না। এক কথায় দিশেহারা হয়ে পড়ল সে। পনেরো বছরের সমাপ্তি ঘটিয়ে ষোলো বছরের পা দেওয়া বাচ্চা মেয়েটা তার জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে আসছে ক্রমাগত। মেয়েটার মস্তিষ্কের বয়স খুব একটা বেশি না হলেও, তার আচার ব্যবহারে শিশু সুলভ আচরণ বহি: প্রকাশ পায় না। সবসময়ই প্রাপ্ত বয়স মহিলাদের ন্যায় জ্ঞান, বুদ্ধি – কৌশল প্রতিফলিত হয় তার মধ্যে। যে কেউ তার ব্যবহারে মুগ্ধ হতে বাধ্য। প্রতিটি কাজ সে বুদ্ধিমত্তা এবং নিপুণতার সঙ্গে সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এই মুহূর্তে মেহেরের মস্তিষ্কের কর্ম ক্ষমতা খানিকটা লোপ পেয়েছে। সমুদ্রের বলা একটি বাক্যেও তার মস্তিষ্ক বুঁজে উঠতে পারছে না। সমুদ্রের চোখের অশ্রু তাকে ব্যথিত করে তুলছে। তার মুখ হতে নির্গত প্রতিটি কথা চিন্তিত করে তুলছে মেহরকে। সমুদ্র তার কাছে ক্ষমা চাইছে, বিষয়টা পরিস্কার মেহেরের নিকট। এতটুকুতেই মেহেরের হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু পরক্ষণে সমুদ্রের বলা কিছু কথা তাকে চিন্তা গ্রস্ত করে তুলেছে। সে বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে ভেবে চলছে, সমুদ্র কেন বলল সে প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়? কেন বলল মেহেরকে শুধু মাত্র অনুভূতি নিবারণের জন্য প্রয়োজন? সত্যিই কি এই ধরণীর বুকে তুমি নামক অনুভূতি বলতে কিছু আছে? নাকি শুধু মাত্র সমুদ্র তার প্রয়োজন থেকে কথাগুলো বলল। সমুদ্র তার কৃত কর্মে অনুতপ্ত। তাই হয়তো অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু সে যে বলল, তার মেহেরকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তা আদৌ কি সম্ভব! মেহেরের ভাবনার সাগরে ব্যাঘাত ঘটাল সমুদ্র। হঠাৎ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
–চোখ বন্ধ কর পুচকি। অযথা তুমি অনুভূতিটার কথা ভেবে চলছে। আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো! বেশি চিন্তা কর না তুমি যেদিন এই অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে পারবে ঠিক সেদিন আমার কথা বিশ্বাস করতে পারবে। আই প্রে, খুব শীঘ্রই আমার পুচকিটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে অনুভূতিটাতে আক্রান্ত হয়। ইশ! নিশ্চিত সেদিন পুচকিটা আমাকে নিষ্ঠুর বলবে।
সমুদ্রের বাগযন্ত হতে নির্গত বাক্যগুলো শুনে শুকনো ঢোক গিলল মেহের। শেষোক্ত বাক্যটার মেহেরের হৃদয়ে উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত এবং অসংযত করে তুলেছে। তার বক্ষ পিন্জরের হৃদয় স্পন্দন তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করল। বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতির উৎপত্তি ঘটল। বড়ই অদ্ভুত অনুভূতি! অবশেষে মেহের লজ্জয় চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। একরাশ সংশয়, সংকোচ, দ্বিধা দেখা দিয়েছে তার অন্তরালে! সমুদ্র তার অতি নিকটবর্তী অবস্থা করছে! সমুদ্র এতোটাই কাছে যে মেহেরের ইতস্তত বোধ হচ্ছে। মুহূর্তেই সমুদ্র মলিন কন্ঠে বলল,
–ঘুমিয়ে পড়। এভাবে রাত জেগে থেকো না। আমি ঘুমোব তো। তুমি জেগে থাকলে আমি ঘুমাতে পারব না। তাই প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দেও। আমি অনেক ক্লান্ত।
মেহের খানিকটা চমকে উঠল সমুদ্রের কথা শুনে। লোকটা তো তার বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছে! তাহলে কিভাবে বুঝতে পারল যে সে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে তার ভাবনায় ডুবে রয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে ফির চোখ যুগল খিচে বন্ধ করে নিলো সে। বারংবার তার কর্ণপাত হতে লাগল সমুদ্র বলাগুলো। সে না ঘুমালে নাকি সমুদ্রও শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না।
__________
এলামের কর্কশ ধ্বনি কর্ণপাত হতেই আরামের ঘুম ভেঙে গেল জারার । তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে উঠে বসল সে। তার দৃশ্যমান হলো পাশে ইয়াদ নেই। কালকে সারাদিন বাসায় অনুপস্থিত ছিল ইয়াদ। বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছে। পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করে কোথাও ইয়াদের দেখা মিলল না। মুহূর্তেই জারা বিছানা থেকে উঠে পড়ল। নিজ ওয়াশরুম, ড্রাইং রুম এবং শাশুড়ি মায়ের রুমে ইয়াদকে খুঁজতে লাগল। আজ তার বড্ড অভিপ্রায় জাগছে ইয়াদের মুখশ্রী দর্শন করতে। কারণটা হয়তো ইয়াদের বলা একটা বাক্য। ইয়াদ কালকেও জারাকে স্মরণ করে দিয়েছিল, উপহারের কথা। আজ সকালের প্রথম প্রহরেই নাকি জারা তার উপহার পেয়ে যাবে। বলেছিল ঘুম থেকে উঠে উপহারটা পেয়ে জারা অসীম আনন্দে ভেসে উঠবে। কিন্তু সকাল হওয়া সত্বেও ইয়াদের দেখা মিলল না। তাহলে কী সে উপহারটাও পাবে না? বিষয়টা ভেবে নিজের অজান্তেই ব্যথিত হয়ে উঠল সে। এত সকালে ইয়াদ কোথায় গিয়েছে? অবশেষে জারার চোখ পড়ল ইয়াদের ব্যবহৃত বালিশের উপর। দৃশ্যমান হলো হলুদ রঙের খাম! জারা দ্রুত বালিশের উপর থেকে খামটা হাতে নিলো। তার হৃদয় স্পন্দন অযথাই স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কী ওই হলদে রঙের খামেই জারার উপহার রয়েছে? অতঃপর জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠিটা খুলে ফেলল। হাত পা অত্যধিক কাঁপছে। সামান্য একটা চিঠিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পূর্বেই শরীর অতিরিক্ত হারে কাঁপতে আরম্ভ করছে! দাঁত দিয়ে নিজ অধর চেপে ধরল জারা। একরাশ ভয়ের আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্তরালে! পরিশেষে চিঠিটাতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। সর্বপ্রথম বাক্য পড়েই চমকে উঠল সে। চিঠিটা ইয়াদ লিখছে,
–এই যে জারা, তোমাকে বলেছিলাম না তোমার জন্যে উপহার অপেক্ষা করছে। আশা করি তুমি তোমার উপহার পেয়ে গিয়েছ। ওহহ তোমাকে তো বলাই হলো না কী উপহার! শোন আমি কাল সকালের ফ্লাইটে ঢাকা যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি চার পাঁচ মাস পরে ফিরব।
বাক্যগুলো পড়তেই জারার চোখ যুগল হতে অঝরে দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে বিসর্জন হতে আরম্ভ করল। গুমরে কেঁদে উঠল সে। এই ভয়ঙ্কর উপহারের জন্যই ইয়াদ তাকে এ ঘরে দুদিন থাকতে বলেছিল! জারার অবাকের সহিত পুনরায় চিঠিটাতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল।
–জান আমি কেন তোমার থেকে দূরে চলে এলাম? থাক কথাটা এখন বলতে চাচ্ছি না। সময় হলে ঠিকই বলব। শুধু একটা কথাই তোমাকে আমি ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি। আমি তো চেয়েছিলাম সবটা নতুন করে গড়তে। চেয়েছিলাম পুরোনো সব হিসেব নিকেসের সমাপ্তি ঘটিয়ে নব্য সূচনা করতে। কিন্তু তুমি তো নিজেই চাও না নব্য সূচনা হোক। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দূরে চলে যাব তোমার থেকে অনেক দূরে। কারণ তোমার কাছে থাকলে আমি যে দহনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাব। পারব না তোমাকে অন্য কার সঙ্গে সহ্য করতে। এবার তুমি খুশী তো?
ইয়াদের চিঠিটার সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাশ ত্যাগ করতে লাগল জারা। প্রচন্ড বমি পাচ্ছে তার। তৎক্ষণাৎ চোখের পানি মুছতে মুছতে ওয়াশরুমের দিকে ধাবিত হলো সে। হঠাৎ তার অস্থির লাগছে। অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে। কী করব সে? অতীত ফিরে যাবে নাকি নতুন অনুভূতি ঘিরে বাঁচাতে আরম্ভ করবে ?
__________________
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল মেহের। দরজায় টকটক আওয়াজ মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই ধরফরিয়ে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করল সে। গা হতে উষ্ণ চাদর সরিয়ে ফেলল। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল সমুদ্রের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। সমুদ্রকে ঘুম থেকে জাগ্রত করার ইচ্ছে হলো না তার। কিন্তু পরিশেষে উপায় না পেয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল,
–এই যে শুনছেন, অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। অহনা আপু এসেছে। আমি কী দরজা খুলে দিব?
অহনা নামটা কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের ঘুম ভেঙে গেল। দ্রুত উঠে বসল সে। একপলক হাত ঘরির দিকে দৃষ্টি ফেলল সে। মুহূর্তেই তার মুখ হতে বিরক্তি’ চ ‘শব্দটা বেরিয়ে এলো। মাথার চুল মুঠো বন্ধি করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে। লহমায় মেহেরের নিদ্রা মাখা মাধুর্যপূর্ণ মুখে দৃষ্টি আকর্ষন করল সে। সেকেন্ড পাঁচেক মেহেরের মুখশ্রীতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অতঃপর পা যুগল ধাবিত করল বেলকনির উদ্দেশ্য। কিছুটা পথ অতিক্রম করে, মেহেরের উদ্দেশ্য বলল,
–আমি যে রাতে এসেছি এ কথা অহনাকে বলবে না। আর হ্যাঁ রাতের বলা কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট করে ফেল। কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। টেক কেয়ার। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। পুচকি পুচকির মতো থাকবে। আন্ডারস্টান্ড?
কথাগুলো বলেই কিছু একটা ভেবে পা জোড়া থামিয়ে ফেলল সমুদ্র। পিছন ঘুরে মেহেরের দিকে এগিয়ে এলো সমুদ্র। যাওয়া পূর্বে হুট করে মেহেরের নিকটবর্তী চলে এলো।
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৩০
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]
–আমি যে রাতে এসেছি এ কথা অহনাকে বলবে না। আর হ্যাঁ রাতের বলা কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট করে ফেল। কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। টেক কেয়ার। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। পুচকি পুচকির মতো থাকবে। আন্ডারস্টান্ড?
কথাগুলো বলেই কিছু একটা ভেবে পা জোড়া থামিয়ে ফেলল সমুদ্র। পিছন ঘুরে মেহেরের দিকে এগিয়ে এলো সমুদ্র। যাওয়া পূর্বে হুট করে মেহেরের নিকটবর্তী চলে এলো। অতঃপর মেহেরের আঘাত প্রাপ্ত গাল স্পর্শ করে কাতার কন্ঠ বলে উঠল,
–আই এম সরি পুচকি।
বাক্যটা বলেই দ্রুত রুম থেকে বেলকনিতে প্রস্থান করল সমুদ্র। ফির একপলক মেহের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলল। মেয়েটা তার হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে রয়েছে। মেহেরের এমন পরিস্থিতি দেখে সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে স্বল্প হাসির রেখা ফুটে উঠল। তৎক্ষণাৎ তার কর্ণকুহরে পৌঁছাল অহনার কন্ঠস্বর। সে আর এক মুহূর্তেও দেরি করল না। রুমটার বেলকনি ফাঁকা এবং উন্মুক্ত হওয়ার সুবাদে সমুদ্রের নিচে নামতে কোন অসুবিধা হলো না। দেয়ালে হতে মাটি স্পর্শকৃত পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পড়ল সে।
বারংবার অহনার আওয়াজ পেয়ে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করল মেহের। সমুদ্রের সরি বলার ভঙ্গিমা দৃশ্যমান হতেই, চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল সে। তার সাহস হয়নি সমুদ্রের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করার। সমুদ্রের কন্ঠস্বর হতে নির্গত ‘সরি’ শব্দটা মেহেরের শান্ত হৃদয়ে অশান্ততার আবির্ভাব ঘটিয়েছে। মস্তিষ্ক খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সমুদ্রের চলে যাওয়া তার বোধগম্য হয় নি। প্রায় মিনিট পাঁচেক স্তম্ভিত হয়ে ছিল মেহের। লহমায় ক্রমাগত অহনার কন্ঠস্বর পেয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। আশেপাশে সমুদ্রের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। অবশেষে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে, ইতস্তত সহিত বলে উঠল,
–আসলে আপু আমি ওয়াশরুমে ছিলাম তো।
মেহেরের কথা শুনে অহনা ভ্রূ যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেলল। মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে হেসে দিয়ে বলল,
–আরে অস্থির হচ্ছ কেন? আমি কী তোমাকে কিছু বলেছি!
বলেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করল অহনা। এতে করে স্বল্প ভয় পেল মেহের। বারংবার তার মনে হলো, রাতের অনাকাঙ্খিত ভাবে সমুদ্র আগমনের কথা হয়তো ধরে ফেলবে সে। কিন্তু তার চিন্তা ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিলো অহনা। বিছানার উপর একটা প্যাকেট রেখে চটজলদি মেহেরের হাত ধরে তার কাছে নিয়ে এলো। অতঃপর মেহেরের গালে স্পর্শ করে বলে উঠল,
–তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে এসো তো।
অহনার কথা শুনে অবাক হয়ে উঠল মেহের। এই শীতল পরিবেশে তাকে শাওয়ার নিতে হবে! মুহূর্তেই তার মুখশ্রী পাংশুটে বর্ণ ধারণ করে উঠল। স্বল্প মন খারাপ করে অহনাকে বলল,
–এতো সকালে শাওয়ার নিতে হবে! কেন আপু?
মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে অহনা বলে উঠল,
–ওহহ তোমাকে তো বলাই হয় নি আজকে বাসায় ছোট একটা পার্টি আয়োজন করা হয়েছে। তাই ফ্রেশ হয়ে এসো।
অনুষ্ঠানের ব্যাপারে শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়ে পড়ল মেহের। বরাবরই অনুষ্ঠান তার একদমই অপছন্দের। কারণ সাধারণ অনুষ্ঠানের পরিবেশ কোলাহল পূর্ণ। ছোট বেলা হতেই চিৎকার চেঁচামেচি, গান বাজনা পছন্দ নয় মেহেরের। কিন্তু মেহেরের বিরক্তির কারণটা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হলো অহনা। সে ভাবল মেহেরের বুঝি সমুদ্রের কথা মনে পড়ছে। তাই অহনা সান্তানা স্বরে বলে উঠল,
–ওই শয়তানটার কথা মনে পড়েছে?
মেহের তার দৃঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল অহনার মুখে। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক পর তার বোধগম্য হলো শয়তান বলতে সমুদ্রকে বুঝিয়েছে অহনা। মুহূর্তেই লজ্জয় মেহেরের গাল যুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠল। তার কর্ণপাত হতে লাগলো সমুদ্রের বলা প্রতিটি কথা। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে অহনার কথার জবাবে বলে উঠল,
–না আপু।
অহনা কিছু বুঝে উঠতে পারল না। মেহেরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠল,
–ও তোমাকে থাপ্পড় মেরেছে দেখে তুমি লজ্জা পাচ্ছ? একটা কথা মনে রেখে মেহের, সমুদ্র তোমার যোগ্য নয়। তাই ওকে ভুলে যাও।
অহনার বলা বাক্যগুলো শুনে নিমিষেই মেহেরের মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তাকে ছাড়া আদৌ থাকা সম্ভব!
–লেট হয়ে যাচ্ছে মেহের। নিরব তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। কাল অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছে তাই আর তোমার সঙ্গে দেখা করাই নি। আমি যাচ্ছি অনেক কাজ আছে। একটু পর তোমাকে নিতে আসব।
কথাগুলো বলে এক মূহুর্তও দেরি করল না অহনা। মেহের অপলক দৃষ্টিতে অহনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আর ভাবতে লাগল সমুদ্রের কথা। সমুদ্র তাকে যাবার আগে রাতের ঘটনা চিন্তা করতে নিষেধ করে দিয়েছে। কিন্তু মেহের শত চেষ্টা করেও রাতের ঘটনা মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট করতে পারছে না। কথাই আছে না নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের অদম্য আগ্রহ প্রকাশ পায়। ঠিক তেমনি মেহের অবাধ্য মস্তিষ্ক সমুদ্র কথা না চাইতেও ভেবে চলছে।
____________
মোবাইল ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে অশ্রু বিসর্জন করে চলছে সিরাত বেগম। আজ তার মেহেরের কথা বড্ড মনে পড়ছে। তাই তো মেয়েটার ছবির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে মেহেরকে এক পলক দেখার। সিরাত বেগম তীর্থের কাকের ন্যায় মেহেরের মুখশ্রী দর্শনের অপেক্ষায় রয়েছে। মেয়েটার জন্য তার হৃদয় আশঙ্কায় কাতর হয়ে উঠেছে। একটা বিশেষ কারনে অত্যধিক ভয় হচ্ছে তার। কারণ আজ তার স্বামী তার বারণ শুনে নি। মেহেরের সম্পর্কে সব তথ্যই রাফিকে বলে দিয়েছে। অবশ্য এতে করে রাফি তাদেরকে আর পর্যবেক্ষণ করছে না। মেহেরের বিয়ের খবর পেয়ে মারাত্মক খেপে গিয়েছে রাফি। এখন হয়তো রাফির হাত থেকে তার মেয়েটার নিস্তার নেই। বিষয়টা যতবার সে ভাবছে ঠিক ততোবার তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠছে। যদি রাফি সমুদ্রের কোন ক্ষতি করে দেয়? সিরাত বেগম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, রাফি মেহেরের কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু সমুদ্র ছেলেটার কী হবে? রাফির ব্যাপারে সমুদ্রেকে জানাতে যেয়েও জানাতে পারি নি। কারণ তার স্বামী স্পষ্ট নিষেধ করে দিয়েছে মেহেরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সিরাত বেগম। কী করবে সে? একদিকে স্বামীর নিষেধ অন্যদিকে মেয়েটার জীবন? তাই কোন উপায় না পেয়ে চোখের জল ফেলছেন তিনি।
_________
বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে রয়েছে জারা। বিষণ্ণতা তাকে আষ্টেপিষ্টে ঘিরে রেখেছে। আজ বই প্রেমিকা বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিষাদগ্রস্ত হৃদয় গহীন নিয়ে সে ভেবে চলছে তার বিষাক্ত অতীত। সবকিছু তো ঠিকই ছিল। তাহলে কেন বিষাদময় অতীত তার জীবনের আগমন ঘটাল। সে তো চেয়েছিল অতীত ভুলে ইয়াদের সঙ্গে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতো।
মুহূর্তেই জারার কর্ণপাত হলো তার মোবাইলের স্বল্প আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয় গহীন ধবক করে উঠল। তৎক্ষণাৎ একপলক ফোনের স্কিনে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। অস্থির হয়ে উঠল তার হৃদয় গহীন। তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল সে। বারংবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল বর্ষণ নামের গোটা গোটা অক্ষর। পরক্ষণেই তার চোখের কোণে হতে কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে গাল বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। দাঁত দাঁত চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালাল সে। একপর্যায়ে ব্যর্থ হলো। লহমায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল জারা। অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
–আমি তো আপনাকে ভুলে ভালোই ছিলাম। তাহলে কেন আবার আমার জীবনে ফিরে আসলেন আপনি? এখন থেকে যে আমি আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আপনি কেনই বা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন? বলুন না, কেন? আমি তো চেয়েছিলাম আপনার জীবনে প্রবেশ করতে। চেয়েছিলাম তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনকে ঘিরে বাঁচাতে। আপনি কথা দিয়েছিলেন, কোনদিনও আমাকে ছেড়ে যাবেন না। মনে আছে আপনার আপনি আমার সঙ্গে একদিন কথা না বললে অস্থির হয়ে যেতেন। সেই আপনিই দুটো বছর আমার সঙ্গে কথা না বলে কাটিয়ে দিলেন। আমার তো মনে হয় আপনি আমাকে কখনোই ভালোবাসেন নি। ভালোবাসালে কখনোই এই যে অতিক্রান্ত দুই বছর চার মাসে একবার হলেও খোঁজ নিতেন আপনার জেবুর কথা। আপনি জানেন একটা সময় আপনার জেবু আপনাকে ভেবেই প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা আতিবাহিত করতো? কিন্তু এখন আমি আপনাকে ভুলে গিয়েছি। জেবু ভুলে গিয়েছে তার বর্ষণকে। বর্তমান আপনার জেবু আর আপনার নেই। আমি ঘৃণা করি আপনাকে। আই হেইট ইউ বর্ষণ।
কথাগুলো বলতে বলতে একপর্যায়ে জেরে কেঁদে উঠল জারা। সে আর পারছে সহ্য করতে। ইয়াদের জন্য তার অন্তরাল অস্থির হয়ে উঠেছে। একদিকে পুরনো প্রেম বর্ষণ অন্যদিকে তার স্বামী ইয়াদ। চাইলে বর্ষণকে মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে পারছে না।
________
সোফার উপর মন মরা হয়ে বসে রয়েছে মেহের। পরেনে তার অফ হোয়াইট লং ড্রেস এবং একই রঙের স্কার্ফ ওড়ানা। কৃত্রিম কোন সাজ দেইনি মুখশ্রীতে। অথচ বেশ মাধুর্যপূর্ণ লাগছে তাকে। তার কোলে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে আয়ান। পুরো রুম ভর্তি মানুষ দিয়ে ভরপুর। এতে ভারি ইতস্তত বোধ হচ্ছে। সবার আড়ালে অবস্থান করলেও অত্যধিক অস্তিত্ব হচ্ছে তার। এমন কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ অভ্যস্ত নয় সে। অবশ্য তার কিছুটা দূরে অবস্থান করছে সমুদ্র। মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট! মেহেরকে দেখেও না চেনার ভাব করে রয়েছে সমুদ্র। অহনার স্বামী নিরব সমুদ্রকে বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করেছে। শুধু সমুদ্র নয় তার সঙ্গে আকাশ এবং তাদের পুরো টিম উপস্থিত হয়েছে। শুধু মাত্র শোয়াইব খান বাদে। সমুদ্রের উপস্থিতিত একরাশ রাগের আবির্ভাব ঘটেছে অহনার অন্তরাল। নিরবের জন্য এখনো অবধি সমুদ্রের কিছু বলতে পারে নি সে। সমুদ্রের উপস্থিতিতে অত্যধিক পুলকিত হয়ে উঠেছে মেহেরের হৃদয় গহীন। পরক্ষণেই মেহেরের দৃশ্যমান হলো আদিবার উপস্থিতি। ওয়েস্টান পোশাক পড়ে অর্ধ বয়স্ক লোকের সঙ্গে এসেছে। হয়তো এখনো পর্যন্ত আদিবা মেহেরকে লক্ষ্য করে নি।
___
আয়ানকে নিয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে ছিল মেহের। খানিক বাদে বাদে সমুদ্রের দিকে আর চোখে লক্ষ্য করেছিল সে। এমন পরিস্থিতি হঠাৎ মেহেরের দৃশ্যমান হলো তিতাস কে। মুহূর্তেই ড্রইং রুম প্রস্থান করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে।
(চলবে)