#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৩৩
#Lutful_Mehijabin
[কপি করা নিষিদ্ধ]
তৎক্ষণাৎ রুমের মধ্যে উপস্থিত হলো আকাশ। বাইরে থেকে তড়িঘড়ি এসেই সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
–ভাবির জন্য এনেছিস বুঝি? ভাবি খাইনি?
আকাশের বলা কথাগুলো শুনে রিয়ার চোখ জোড়া আপনা আপনি বৃহত্তর আকার ধারণ করে উঠল। রিয়ার বিষ্ময়কর মুখশ্রী সমুদ্রের চোখের আড়াল হলো না। মুহূর্তেই আকাশের দিতে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। সমুদ্রের চোখের ভাষা পড়তে খানিক সময় লাগল আকাশের। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। একপকল রিয়ার দিকে তাকিয়ে ফির ফিক করে হেসে উঠলো। অতঃপর পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক করতে হাসির সহিত বলল,
–ওহ সরি ,আমি তো ভেবেছিলাম তুই ভাবির জন্যে খাবার এনেছিস। আচ্ছা তুই তোর পুচকি কে খাওয়া। আমরা আসি। রিয়া কাম উইথ মি।
বলেই আকাশ রুম থেকে ধীরগতিতে প্রস্থান করল। রিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে অবাকের সহিত বাধ্য হয়ে বেরিয়ে গেল। আকাশের বলা বাক্যগুলো তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মেহেরকে নিয়ে তার অন্তরালে একরাশ প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটেছে। বিষয়টা নিয়ে সে বেশি একটা নাক গলানোর সাহস পেল না। কারণ সমুদ্র স্যারের কাজ কর্ম হাবভাব সবকিছুই তার নিকট রহস্যময় মনে হয়। তার ধারণা সমুদ্র একজন কঠোর, বদমেজাজি, হৃদয় হীন ব্যক্তি। যে কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। বিশেষ করে মেয়েদের তো সমুদ্র পাত্তা দেয় না। রিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, তার সমুদ্র স্যার কোনদিন কোন নারীর প্রেমে পড়বে না। কখনোই না, একদমই না। তার মতে সমুদ্র অনুভূতিহীন নির্বাক। যার অন্তরালে অনুভুতির জন্ম নেওয়া অসম্ভব!
_______
আকাশরা চলে যাবার পর, সমুদ্র দ্রুত বেগে দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর পরপর দুটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মেহেরের নিকট ধাবিত হলো। মেহের হতে স্বল্প দূরত্বে বজায় রেখে, কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
–দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসো।
সমুদ্রের আদেশ পাওয়া মাত্রই মেহের বিছানার উপর নতজানু হয়ে বসে পড়ল। তার কেমন যেন অস্তিত্ব হচ্ছে। সমুদ্র টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে মেহেরের হাতে দিলো। অতঃপর মেহেরের মুখশ্রীতে শক্ত দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে বলল,
–ফিনিস ইট!
মেহের খাবারগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। অসম্ভব অস্তিত্ব হচ্ছে তার সমুদ্রের সামনে খেতে। এতো দিন সে কতোবার সমুদ্রের সামনে খেয়েছে, কই তখন তো এমন অস্বাভাবিক লাগে নি! তাহলে এখন এমন অদ্ভুত অস্তিত্ব হচ্ছে কেন? মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সমুদ্র তার অচঞ্চল চোখ জোড়ার দৃঢ় দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে প্যকট থেকে ফোন বের করে মনোযোগ সহকারে স্কোল করতে লাগল।
___________
ইসতার বেগমের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে জারা। আজ জারার মন মানসিকতা একদমই ভালো নেই। বড্ড ব্যথিত হয়ে উঠেছে তার হৃদয় গহীন। হঠাৎ তার শাশুড়ি আম্মু খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। দুপুরবেলা সেন্স লেস হয়ে পড়েন তিনি। এর ফলে দুশ্চিন্তার উৎপত্তি ঘটেছে জারার হৃদয়মনে। সকাল থেকেই তার শাশুড়ি আম্মুর অভিপ্রায় জেগেছিল , বড় ছেলে সমুদ্রের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করার। অত্যধিক শখ জেগেছিল একটি বারের জন্য ছেলেটার মুখশ্রী দর্শন করার। জারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে, একদিকে তার পুরোনো বিষাক্ত অতীত পুরনায় হাজির হয়েছে। অন্যদিকে তার শাশুড়ির অসুস্থতা। মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়েছে সে। একথাই বাজে পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে।
অবিরাম ইয়াদের মোবাইলে কল করে যাচ্ছে জারা। কিন্তু ইয়াদ কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করছে না। এর ফলে অতিরিক্ত কান্না পাচ্ছে জারার। তার যে এখন ইয়াদের কন্ঠস্বর শুনা খুব প্রয়োজন! বর্তমানে তার অন্তরাল অস্থির হয়ে উঠেছে ইয়াদকে একটিবারের জন্য দেখতে। বর্ষন নামক খারাপ লোকটার স্মিতি মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলাল একমাত্র মাধ্যম যে ইয়াদ।
ইয়াদের ফোন রিসিভ না করাতে, অজান্তেই জারার চোখ যুগল থেকে দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে ধরণীর বুকে বিসর্জিত হলো। তৎক্ষণাৎ চোখের অশ্রু মুছে ফেলল সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে কল লিস্ট থেকে রাফুর নম্বরে ফোন করল। সেকেন্ড পাঁচেক পরেই তার কর্ণকুহরে পৌঁছাল রাফুর কন্ঠস্বর,
–জারা কেমন আছো?
জারা কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল,
–ভালো আপনি?
–ভালো। কিছু হয়েছে কী? হঠাৎ ফোন দিলে যে?
রাফুর প্রত্ত্যুরে জারা মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,
–ভাইয়া , আম্মু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
জারা কথাগুলো শুনে ক্রোধে ফুঁসতে লাগল রাফি। কন্ঠস্বরে রাগ স্পষ্ট রেখে বলল,
–আবার নিশ্চয়ই ইয়াদ কিছু একটা করেছে। ছেলেটা কি কখনোই মানুষ হবে না!
রাফু বলা বাকগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে উঠল জারা। সবকিছুই তার নিকট বিষাদময় লাগছে। ইয়াদ কী করেছে যার জন্য তার শাশুড়ি আম্মু অসুস্থ হতে পারে? জারা তড়িৎ বেগে রাফুকে জিজ্ঞাসা করল,
–ভাইয়া ,ইয়াদ কী করেছে?
রাফু জারা প্রশ্নের জবাবে বলে উঠলো,
–তুমি হয়তো শুনলে অবাক হবে যে আজ ইয়াদের জন্য মামি বাকশক্তি হারিয়েছে। সুস্থ স্বাভাবিক মামিটা ওর জন্যে কথা বলতে পারে না। তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছ, সমুদ্রের সঙ্গে ইয়াদের সম্পর্ক একদমই ভালো নয়। ওরা দু জন সবসময় একে অপরের থেকে আলাদা থাকে। জানো কেন?
জারা অবাকের সহিত বলল,
–কেন ভাইয়া?
–কারন সমুদ্রের ধারণা ইয়াদের পাগলামির কারনেই মামি স্টোক করেন। শুধু ওর ধারণা বললে ভুল হবে অমিও তাই জানি।
শেষোক্ত বাক্যটা কর্ণপাত হতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে জারা। সে যেন ক্রমশ কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে! জারার স্তব্ধতা লক্ষ করে রাফু শীতল কন্ঠে বলল,
— জিজ্ঞাসা করবে না কেন ইয়াদ পাগলামির করতো?
রাফুর প্রত্ত্যুরে জারা অস্ফুট স্বরে বলল,
–কেন ভাইয়া?বলুন না!
রাফু তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করল। স্বল্প সময় নিরবতা পালন করে বলল,
–কারনটা শুনলে তুমি সহ্য করতে পারবে না।
রাফুর বলা ছোট্ট বাক্যটা শুনে জারা বুকের ভেতর অস্থির হয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় বলে উঠল,
–প্লিজ ভাইয়া, বলুন না।
রাফু জারার প্রত্যুত্তরে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,
–প্রায় বছর দুয়েক আগের ঘটনা। একটা মেয়েকে অত্যধিক ভালোবাসাতো ইয়াদ। মেয়েটা কে এতোটাই ভালোবাসাত যে, ওর জন্য ইয়াদ চোখ বন্ধ করে মরতেই রাজি ছিল। কিন্তু মেয়েটা একটা বিশ্বাস ঘাতক। ও কখনোই ইয়াদকে ভালোবাসেনি। সবকিছু ওদের মধ্যে ঠিক ঠাক ছিল। হঠাৎ একদিন ইয়াদ খবর পায় মেয়েটা অন্য একজন ছেলের সঙ্গে রিলেশনে যুক্ত। সেদিন থেকেই ইয়াদ পাগলামি শুরু করে দেয়। তার কিছুদিন পর আমারা খবর পাই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকেই ইয়াদ নিজেকে শেষ করে দিতে মত্ত হয়ে পড়ে। সবার সঙ্গে ইয়াদ উন্মাদ পাগলালের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। ইয়াদের এই পাগলামি মামি সহ্য করতে পারেন নি। তাই,,
রাফুর কন্ঠস্বর হতে নির্গত বাক্যগুলো কর্ণপাত হতেই জারার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সে। তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। হৃদয় গহীন ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত, অস্থির হয়ে উঠেছে। তার গলার কোথাও একটা কান্না দলা পাকিয়ে আটকে আসছে। প্রচুর কান্না পাচ্ছে জারার। তার হৃদয় স্পন্দন তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে।প্রচন্ড অস্থির লাগছে! না চাইতেও তার বলতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ইয়াদ একমাত্র তার। তাকে ছাড়া অন্য কাউকেই ইয়াদ ভালোবাসাতে পারে না। তা হকো অতীত কিংবা বর্তমান।
_________
খাওয়া শেষ করে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে মেহের। তার এখন বমি বমি ভাব অনুভব হচ্ছে। জোর করে সমুদ্র তাকে খাইয়েছে। খাবার খানিকটা বাকি রেখেছিস সে। কিন্তু সমুদ্র তাকে এমন একটা শর্ত দেয় যে, অবশেষে পুরোটা খেতে বাধ্য হয় সে। বর্তমানে মেহের নাজেহাল পরিস্থিতি দেখে, সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখে ফুটে উঠেছে।
লহমায় আকাশের কল পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সমুদ্র। তাদের এসিপি স্যারের আগমন ঘটেছে অনুষ্ঠানে। তাই তৎক্ষণাৎ আকাশ তাকে ড্রইং রুমে উপস্থিত হতে বলেছে। সমুদ্র রুম থেকে বের হওয়া উদ্দেশ্য যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ মেহেরের নিকট চলে এলো। মেহের নতজানু হয়ে বসে রয়েছে। একরাশ লজ্জার আবির্ভাব ঘটেছে তার হৃদয় গহীনে। মুহূর্তেই সমুদ্র মেহেরের উদ্দেশ্য গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
–ভালোই তো আমাকে খাইয়ে দিতে হবে দেখে, খাবারটা সমাপ্ত করলেন আপনি। মনে রাখবেন ম্যাম, আজকে জোর করেনি আমি। বাট সময় হলে আপনি আমাকে খাইয়ে দিতে বাধ্য হবেন। আই হোপ উয়ার আন্ডারস্টান্ড!
সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই তার শান্ত হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠেছে। এতো শীতল পরিবেশেও বারংবার ঘেমে উঠছে সে! মেহের নিজের পরিস্থিতি সামালানোর পূর্বে পুনরায় সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
–লুক এ্যাট মি পুচকি!
মুহূর্তেই মেহের ভয়ে চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে ফেলল। সমুদ্রের ফির কটমট করে বলে উঠল,
–এই যে কান খুলে শুনে রাখ পুচকি, আমি কিন্তু নিজের কোন কিছুতে অন্যের দৃষ্টি একদমই পছন্দ করি না। তাই এভাবে সেজেগুজে ঘুরে বেরোবে না। আমি যদি আবার তো,,,
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৩৪
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষিদ্ধ]
–লুক এ্যাট মি পুচকি!
মুহূর্তেই মেহের ভয়ে চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে ফেলল। সমুদ্রের ফির কটমট করে বলে উঠল,
–এই যে কান খুলে শুনে রাখো পুচকি, আমি কিন্তু নিজের কোন কিছুতে অন্যের দৃষ্টি একদমই পছন্দ করি না। তাই এভাবে সেজেগুজে ঘুরে বেরোবে না। আমি যদি আবার তোমাকে বাইরে ঘুরতে দেখি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।
কথাগুলো বলেই এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করল না সমুদ্র। মুখশ্রীতে গম্ভীরতা স্পষ্ট রেখে, পা যুগল ধাবিত করল ড্রইং রুমের উদ্দেশ্যে। সমুদ্রের প্রস্থান করার পর, মেহের যেন ব্যাপক স্বস্তির মাখা নিশ্বাস ত্যাগ করল। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। মস্তিষ্ক যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! এ অনুভূতির গোপন কথা সে যদি ভুলে একবারও সমুদ্রের নিকট প্রকাশ করে, তাহলে বোধহয় সমুদ্র ভেবে বসবে এই বুঝি এক অবুঝ কিশোরীর বয়সের দোষ!
___________
পিয়াস রহমানের সামনে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে তিতাস। মেহেরকে আর একটি বারের জন্যও দেখতে পাইনি সে। তাই বিরক্তি যেন ভীষণভাবে তাকে ঘিরে ধরছে। বাবার পাশে থেকে উঠার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না।
পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে রয়েছেন শোয়াইব খান। তার নিকটবর্তী বসে রয়েছে নির্মল বর্ণের এক সুন্দরী রমণী। মেয়েটার পরনে ওয়েস্টান পোশাক। মেয়েটা বেশ লম্বা। তার চোখ জোড়া স্বল্প ধূসর বর্ণের। এক কথাই অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী নারী! অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছোট্ট বড় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মেয়েটা সক্ষম। মিষ্টি হাসি যেন মেয়েটার ঠোঁটের কোণে ঝুলে রয়েছে। তার এই সামান্য হাসিটুকু যেন কারো হৃদয় গেঁথে যাবার ক্ষমতা বহন করে। সত্যিই সে অত্যধিক সুন্দর। শোয়াইব খানের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল মেয়েটা। তৎক্ষণাৎ ড্রইং রুমে উপস্থিত হয় সমুদ্র। আকস্মিক সমুদ্রের উপস্থিতিতে মেয়েটা তার দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেলল সমুদ্রের মুখশ্রীতে। সমুদ্র তাদের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে, শোয়াইব খান মেয়েটার উদ্দেশ্যে ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে বললেন,
–সাকিলা!
সাকিলা তির্যক দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। সমুদ্র শোয়াইব খানের সামনে আসতে সাকিলা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অতঃপর মুচকি হেসে সমুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–কেমন আছেন সমুদ্র?
তৎক্ষণাৎ সমুদ্র একপলক সাকিলা দিকে তাকিয়ে ফির দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সাকিলা প্রত্যুত্তরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–গুড! হু আর ইউ?
সাকিলা কিছু বলে উঠার আগেই শোয়াইব খান বলে উঠলেন,
–ও হচ্ছে সাকিলা। তোমার মনে নেই! আমার বন্ধুর মেয়ে। সি ইজ ইউয়ার উডবি ওয়াইফ।
বলেই শোয়াইব খান আট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। শেষোক্ত বাক্যটার শুনে সমুদ্র বেশ বিরক্ত। কথাটার গুরুত্ব দিল না সে। সাকিলাকে উপেক্ষা করে শোয়াইব খানকে জিজ্ঞেস করল,
–ওহহ, বাই দ্যা ওয়ে স্যার । খেয়েছেন?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে শোয়াইব খান বলে উঠলেন,
–না। খাবার খেতে এসেছি কি! পরে খেলেও চলবে।
–ওকে স্যার।
______________
সমুদ্রের মোবাইল ফোনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মেহের। বারংবার বেজে উঠছে সমুদ্রের ফোনটা। বোধহয় সমুদ্র ভুলে রেখে গিয়েছে! এতে করে অত্যধিক অস্বস্তির স্বীকার হচ্ছে মেহের। যদি সমুদ্রের দরকারী কল হয় তাহলে? ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেও কে কল দিয়েছে তা দেখবার সাহস জুটেছে না তার হৃদয় গহীনে। কি রয়েছে ফোনটাতে? কারো ফোন দেখতে কি এতো সুন্দর হয়? ফোনটা মেহেরের নিকট বড্ড স্পেশাল। তার মনে হচ্ছে ফোনটা কোন জড়ো পদার্থ নয়, বরং তার হৃদয় গহীন বারংবার বলে হচ্ছে ফোনটাতে যেন সমুদ্রের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। হাস্যকর বিষয়! মেহের সমুদ্রের ফোনটা স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্পর্শ করলেই সমুদ্র কর্কশ ভাষা ভেসে উঠবে। কথাগুলো ভাবতেই মুচকি হাসি রেখা ফুটে উঠেছে মেহেরের ঠোঁটের কোণে। ইশ! কতো সুন্দর দেখতে ফোনটা। তৎক্ষণাৎ ফোনটা পুনরায় বেজে উঠলো। মেহের কম্পনিত হাত জোড়া দিয়ে ফোনটা তুললো। মুহূর্তেই তার বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতির উদ্ভট ঘটলো। হাত জোড়া শীতল হয়ে উঠেছে! দু হাতের সাহায্যে ধরা সত্ত্বেও তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাবার উপক্রম। মেহেরের এই পরিস্থিতি দেখলে যে কেউ বলল, মেয়েটা হয়তো ফোন ধরতেই জান না! কম্পনিত হাতে ফোনটা নিয়ে পা জোড়া ধাবিত করল সমুদ্রের নিকট যাবার উদ্দেশ্যে। সমুদ্র তাকে যা ইচ্ছে তাই বলুক, সে বের হবেই। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছে। তাই তো বিরতিহীন ভাবে বেজেই চলছে।
___________
আকাশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। তাদের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে আজকের অনুষ্ঠানে যেকোন সময় ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাবার আশঙ্কা। তাদের কাছে ইনফরমেশন এসেছে, তিন মাস ব্যাপী চলমান কেসটার মূল অপরাধী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত। এতে বেশ চিন্তির আবির্ভাব ঘটেছে সমুদ্রের অন্তরালে। চিন্তার কারনটা হয়তো স্বাভাবিক। এই বাড়ির প্রতিটি সদস্য থেকে শুরু করে তার পুচকিরও জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। যে কোন সময় তাদের উপর এট্যাক হতে পারে। বিষয়গুলো চিন্তা করতে করতে পাইচারি করছে সমুদ্র। কপালে দু আঙুল রেখে নিস্তবদ্ধতা পালন করছে সে। কিন্তু লহমায় তাদের নিস্তবদ্ধতা ভেঙে আকাশ বলে উঠল,
–সমুদ্র দেখ, আমার তো মনে হয় লোকটা যে কোন সময় আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। আমি নিশ্চিত অপরাধী বুঝে গিয়েছে যে আমাদের পুরো টিম এখানে। আমার তো ভয় হচ্ছে।
আকাশের কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র বলে উঠল,
–আমার তো মনে হয় না অপরাধী এতোটাও কান্ডজ্ঞানহীন। লোকটা ভীষণ চালাক। তারপরেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমারা যদি একটু এদিক সেদিক পা ফেলি তাহলে যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। সবাইকে ইনফরমেশন দিয়ে দে। আর হ্যাঁ শোন, তোর ভাবি, অহনা এবং অহনার ছেলের সবার সেফটির ব্যবস্থা কর। বিশেষ করে আমি তোর ভাবিকে নিয়ে কোন রিক্স নিতে চাইছি না।
সমুদ্রের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই আকাশের ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে উঠল। বারংবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি হতে লাগল ‘ভাবি’ শব্দটা। ভাবি শব্দটার তার নিকট অস্বাভাবিক লাগে। বিশেষ করে সমুদ্রের মুখ থেকে। যে লোক কিনা মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলতে পছন্দ করে না। সবসময়ই স্তব্ধ, রাগী, গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে চলাফেরা করে। সেই লোকটার মুখে মেহেরকে তার কাছে ভাবি বলে উপস্থাপন করাটা বেশ অবাকের বিষয়। আকাশে নিজেকে স্বাভাবিক করে অবাকের সহিত সমুদ্রকে জিজ্ঞেসা করল,
–এই তোর কী হয়েছে রে? তুই ভাবিকে মেনে নিয়েছিস? কয়েকদিন আগেও যাকে বয়সে ছোট বলে অপমান করতি। যাকে স্ত্রী হিসেবে মানতে তোর ইগোতে বাঁধতো আজ তাকেই কিনা তুই নিজের বউ হিসেবে মেনে নিলি। আর ইউ ওকে? রিয়েলি আই কান্ট বিলিভ!
আকাশের বলা বাক্যগুলো সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই চোখ যুগল ছোট ছোট করে ফেলল সে। তার কপালে যেন সুক্ষ্ম ভাঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আকাশে কথার প্রত্যুত্তরে চোখের গরম চাহনি নিক্ষেপ করল সমুদ্র। কিন্তু আকাশ বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে ভ্রূ যুগল কুঁচকে, ফির সমুদ্রের দিকে জিজ্ঞেসা সূচক দৃষ্টি ফেলে বলে উঠল,
–তুই কী ভাবির প্রেমে পড়েছিস?
আকাশের কথার উত্তরে সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
–কি আছে ওই পুচকিতে যে আমি ওর প্রেমে পড়ব? অসম্ভব!
কথাগুলো বলেই জড়ে জড়ে নিশ্বাশ ত্যাগ করল সমুদ্র অতঃপর চোখ জোড়া বন্ধ করে বলে উঠল,
–দেখ, আমি জানি না প্রেম ভালবাসা কী? আমি শুধু এতটুকু জানি,,,,
বাক্যগুলো সমাপ্ত করার পূর্বে আকাশের ফোন বেজে উঠল। তৎক্ষণাৎ আকাশ ফোন রিসিভ করল। অতঃপর কল কেটে সমুদ্রকে বলে উঠল,
–এসিপি স্যার ফোন দিয়েছেন। সে তোকে খুঁজছে। তোর ফোন হয়তো সাইলেন্ট করা। আজেন্ট কাজ বোধহয়। তুই যা।
লহমায় সমুদ্র দ্রুত পদে পা সংকুচিত করে, ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো। অবশেষে শোয়াইব খানের নিকটবর্তী পৌঁছয়ে সম্মানের সহিত বলে উঠল,
–স্যার কী হয়েছে, আর ইউ ওকে? কোন সমস্যা?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে শোয়াইব খান মুচকি হেসে বললেন,
–ইয়াস, আই এ্যাম ওকে। তুমি একটু সাকিলাকে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যাও তো। ওর ড্রেসটা জুস পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই ওয়াশ করার দরকার। তুমি যাও, কুয়িক। না করবে না কিন্তু। না শব্দটা আমার একদমই পছন্দ নয়।
শোয়াইব খানের মুখের উপর কোন কথা বলতে পারল না সমুদ্র। তার অন্তরাল যেন বিরক্তিতে ভর্তি হয়ে উঠেছে। অতঃপর সাকিলাকে নিয়ে ওয়াশরুমে দিকে ধাবিত হলো সে।
সমুদ্রের পিছু পিছু সাকিলা এগুতে লাগল। তার চোখে মুখে আনন্দের আভাস স্পষ্ট! বারংবার সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যাকুল প্রত্যাশা করছে সে। হঠাৎ তার মস্তিষ্কে খারাপ উদ্দেশ্যর উৎপত্তি ঘটল। লহমায় সে আচমকা সমুদ্র হাত টেনে ধরল। বাঁকা হাসির সহিত সমুদ্রের হাত স্পর্শ করে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠল,
–হেই মিস্টার সমুদ্র! আপনি এতো গম্ভীর কেন? জানেন আপনার এই গম্ভীরতাতে আপনাকে বেশ মানায়। পারফেক্ট বয়, আই লাভ ইউ।
কথাগুলো সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। সাকিলাকে কিছু বলার জন্যে অগ্নি যুক্ত চোখ জোড়া দৃষ্টি সাকিলার মুখশ্রীতে ফেলল। মুহূর্তেই কিছু বলে উঠার পূর্বে সমুদ্রের দৃশ্যমান হলো মলিন মুখশ্রীর অধিকারী তার পুচকি অর্থাৎ মেহেরকে। তার ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। চোখে মুখে ফ্যাকাসে ভাবটা প্রকাশ পাচ্ছে।
সমুদ্র গভীর দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা এমন পরিস্থিতিতেও মুচকি হেসে তার নিকট এগিয়ে আসছে। বেশ রহস্যময় হাসি! এর পেছনে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এক পাহাড় সমান অবুঝ হৃদয়ের ব্যাপক বেদনা।
(চলবে)