#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৫৩
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই রাত আটটা। ভীষণ শান্ত পরিবেশ! এশারের আযানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলছে চারপাশে। ১২১ নম্বর কেবিনে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন মেহের। বিকালে যখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তখন অচেতন অবস্থায় তাকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়! কিয়ৎক্ষণ যাবত ঘুমের মধ্যে অস্তিত্ব বোধ করছে মেহের। অনুভব হচ্ছে কেউ গভীর দৃষ্টিতে তার মুখশ্রীতে অপলক দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে! যার সুবাদে খানিক যাবত চোখ যুগল উন্মুক্ত করার প্রয়াসে স্বল্প নড়ে চড়ে উঠছে সে।
অদম্য প্রয়াসে একপর্যায়ে চোখ যুগল পিটপিট করে উন্মুক্ত করলো সে। ঝাপসা, অস্পষ্ট দৃষ্টি প্ররখ করে নিজেকে আবিষ্কার করলো এক শুভ্র, স্বচ্ছ ঘরে। মিনিটের মধ্যেই তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠল সমুদ্র নামক মানবের মুখশ্রী! লোকটা কোথায়, কেমন আছে, সুস্থ হয়েছে তো? প্রশ্নগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে মেহেরের অন্তরালে! ইতিমধ্যেই হৃদয় গহীন ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত এবং অসংযত হয়ে উঠেছে। সমুদ্রকে একটি বার দেখার সাধে সে পুনরায় উন্মাদ হয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে উঠে বসলো সে। দুর্বল শরীর নিয়ে বেড থেকে নামার প্রয়াস চাললো অনবরত! জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে বির বির করে অসহায় বিপন্নের ন্যায় বলতে লাগলো,
— এই যে শুনছেন! আপনি কোথায়? একটু সামনে আসবেন প্লিজ। আমি শুধু একটিবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে যে।
মেহেরের চিৎকার শুনে মুহূর্তেই করিডোর হতে ছুটে এলেন শোয়াইব খান। মেয়ের এমন উন্মাদের ন্যায় আচরণ তাকে ভীষণ ব্যতীত করে তুললো। দ্রুত নার্সকে ইনফরম করলেন সে। অতঃপর মেয়ের নিকটবর্তী হাজির হলেন। মেয়েটার হাত জোড়া থরথর করে কাঁপছে। শুধু তাই হয় অশ্রুকণা তার গাল যুগল সিক্ত করে তুলছে অবিরাম!
পরিশেষে শোয়াইব খান মেহেরের হাত জোড়া আঁকড়ে ধরলেন। মেয়েকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,
— কী হয়েছে আমর আম্মুটার? শান্ত হও মা!
মেহেরের নিশ্চুপ হয়ে রইলো। শোয়াইব খান পুনরায় বললেনপ,
— কি হয়েছে মা বাবাকে বলো? বাবা সমাধান করে দিব তো?
— বলো আম্মু কী হয়েছে তোমার? বাবা সমাধান করে দিব, প্রমিজ! কিন্তু তুমি শান্ত হও।
মেহের শান্ত না হয়ে শোয়াইব খানের সুটের হাতার দিকাটা খাঁমচে ধরলো। অতঃপর উন্মাদের ন্যায় বলল,
— উনি কোথায় একটু বলবেন। আমি উনাকে দেখতে চাই। আমাকে দয়া করে উনার কাছে নিয়ে চলুন।
মেয়ের আবদার সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অনুমান করেছিলেন শোয়াইব খান। সত্যিই তার মেয়েটা সমুদ্র হীনা পাগল প্রায়! বড়জোর চার কি পাঁচ ঘন্টা সমুদ্র চোখের আড়াল হওয়াতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। তাহলে কি করে প্রতি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা,দিন এবং মাসের পর মাস অতিবাহিত করবে সমুদ্রকে ছেড়ে!
— আহা! কাঁদে না সোনা। এভাবে কাঁদলে কি করে চলবে! চলো আমি তোমাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
কথাগুলো শুনেই মেহের কিছুটা শান্ত হলো। শোয়াইব খান অনিচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও মেয়ের আবদারের কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন। বুকের উপর পাথর চেপে মেয়ের হাত যুগল আগলে ধরে সমুদ্রের কেবিনের দিকে ধাবিত হলেন।
___
অপারেশন থিয়েটার থেকে সমুদ্র কেবিন নং ২১৩ এ নিয়ে আসা হয়েছে ঘন্টা চারেক পূর্বে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে সমুদ্র অচেতন হয়ে পড়েছিল। তেমন একটা অঘটন ঘটে নি তার সঙ্গে। জামাল সাহেবের নিক্ষিপ্ত গুলিটা অল্পের জন্য তার পিঠের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নি। হাতের বাহুতে আঘাত হেনেছে। গুলিটা বের হয়নি বিধায় সমুদ্রকে ইমার্জেন্সি এ নেওয়া হয়েছিল।
সমুদ্রের জ্ঞান ফিরেছে ঘন্টা খানিক পূর্বে। চেতন হয়েই সর্বপ্রথম মেহেরকে দেখার অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে সমুদ্র। কিন্তু মেহের দুর্বল শরীর সমন্ধে জ্ঞাত হতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। অতঃপর নার্স এসে স্বল্প ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে গিয়েছে। সেই সুবাদে বর্তমানে সমুদ্র ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার চোখে মুখে মলিন ভাব স্পষ্ট!
__
খানিকের মধ্যেই মেহেরের সহিত সমুদ্রের কেবিনে প্রবেশ করলেন শোয়াইব খান। ভেতর প্রবেশ করে সমুদ্রের বেড বরাবর ইশারা করে মেহের কে বলে উঠলেন,
— দেখো মামুনি সমুদ্র ঠিক আছে! তোমার চিন্তার কোন বিষয় নেই। নিশ্চিন্তে থাকো।
সমুদ্রের নিথর দেহ লক্ষ্য মান হতেই এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না মেহের। শোয়াইব খানের হাতের বাঁধন ত্যাগ করে কুন্ঠিত পদে ধাবিত হলো সমুদ্রের নিকটবর্তী।
ইশ, এখন প্রশান্তির প্রাদুর্ভাব ঘটছে মেহেরের হৃদয় মনে। সমুদ্র চোখ জোড়া বন্ধ করে রয়েছে। তার পুরো শরীর নেতিয়ে পড়ছে খানিকটা! আঘাত প্রাপ্ত স্থান ব্যান্ডেজ দিয়ে আবৃত করা। সাদা, শুভ্র রংয়ের ব্যান্ডেজে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ স্পষ্ট! সমুদ্রের এহেন দশা পরিলক্ষিত করতে গভীর ভাবে মত্ত মেহের। সমুদ্রকে দৃশ্যমান হতেই মেহেরের চোখ জোড়া হতে বর্ষণের প্রখরতা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েটা নিমিষেই অবুঝের ন্যায় নাকের জল চোখের জল মিশ্রিত করে ফেলছে। মিনিট খানিক সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে চক্ষু তৃষ্ণার মিটিয়ে তড়িৎ বেগে ছুটে এলো সমুদ্রের একদম নিকটবর্তী চলো এলো মেহের। অতঃপর উন্মাদের ন্যায় ঝাপটে ধরলো সমুদ্র হাত। পরিস্থিতি মেহেরকে এক দুর্বোধ্য অবস্থা এনে দাঁড় করিয়েছে। যেই মেয়ে সমুদ্রের দিকে ঠিক মতো লক্ষ্য করে ভয় পাই। যার হাত ছোঁয়ার বিচিত্র দৃশ্য সে কল্পনাতেও আঁকে নি। সে মেহের আজ বিনা দ্বিধা, সংকোচ হীন সমুদ্র হাত ছুঁয়েছে!
সমুদ্রর হাত আঁকড়ে ধরে তার মুখশ্রীতে খানিক ঝুঁকে অশ্রুকণা বিসর্জনের সহিত মেহের বিরবির করে বলে উঠলো,
— আপনি ভীষণ পচা! আমার একটু খোঁজ খবর ও নেন নি।
মেহেরের অভিমান মিশ্রিত বাক্য সমুদ্রের কর্ণকুহুরে পৌঁছনো মাত্রই তার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলো। মুহূর্তেই চোখ বন্ধ অবস্থায় সমুদ্রের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে। বিষয়টা পরিলক্ষিত করলো না। সে তার মার্জি অনুযায়ী ক্রন্দন রত অবস্থায় মিনমিন কন্ঠে বলতে লাগলো,
— একটু কথা বলবেন আমার সঙ্গে? আমার যে বড্ড অভিপ্রায় জেগেছে আপনার কন্ঠস্বর কর্ণপাত করতে। আমার যে ভালো লাগছে না। অস্থির লাগে ভীষণ!
তৎক্ষণাৎ মেহেরের নেত্র হতে বিসর্জিত কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্যে টপ করে সমুদ্রের মুখের উপর বর্ষিত হলো। যার সুবাদে সমুদ্রের নিদ্রা খানিক হাল্কা হয়ে এলো। লহমায় চোখ যুগল পিটপিট করে উন্মুক্ত করলো সমুদ্র। মেহেরের অশ্রু সিক্ত মুখশ্রী লক্ষ্য করতেই তার হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠলো নিমিষেই। ঘুমের রেশ না কাটিয়েই মেহেরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্র মলিন কন্ঠে বলে উঠল,
— কী হয়েছে পুচকি! আমার পুচকিটা কাঁদছে কেন?
সমুদ্রের কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সজাগ হলো মেহের। অতঃপর অশ্রু সিক্ত নয়নে সমুদ্র দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল। সেকেন্ড পাঁচেক ঠোঁট কামড়ে ক্রন্দন থামানোর প্রয়াস চাললো।
— ইশ! এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? ভয় পেয়েছো বুঝি?
সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে প্রাণ খুলে কেঁদে দিলো মেহের। চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে বলল,
— আপনার যদি কিছু হয়ে যেতো? তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচাতাম? আপনি কী খুব ব্যথা পেয়েছেন? দেখুন না কতো রক্ত ঝড়েছে আপনার শরীর থেকে। আমার ওড়না দেখুন, দাগ লাগে রয়েছে! আমির যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
মেহেরের বাকযন্ত্র হতে নির্গত বাক্যগুলো শুনে সমুদ্র হৃদয়ে প্রশান্তির প্রাদুর্ভাব ঘটলো। মুহূর্তেই মেহেরের কোমল হাতে স্বল্প বল প্রয়োগ করে স্পর্শ করলো সমুদ্র। অতঃপর মুচকি হেসে বলে উঠলো,
— আমাকে ছেড়ে বুঝি থাকতে পারবে না তুমি?
— না। এক মুহূর্তও অতিবাহিত করতে পারব না। আপনি কেন বুঝেন না আপনাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
— যদি আমি মারা যেতাম। বাই চান্স গুলিটা আমার বক্ষ পিন্জর ছেদ করে ফেলতো! তাহলে?
সমুদ্রের কথা ঝটপট উত্তর দিলো মেহের। ক্রন্দনের বেগ বৃদ্ধি করে বলে উঠল,
— আমিও মারা যেতাম। হয়তো স্টোক করে নতুবা আপনার সখে। কিন্তু এমন কথা বলবেন না প্লিজ!
তৎক্ষণাৎ মেহেরের অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠলো! সমুদ্রের বাঁধন থেকে হাত ছাড়িয়ে মুখ ঢেকে গুমোট ধ্বনিতে কেঁদে উঠলো সে। সমুদ্র পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উঠে বসার প্রয়াস চাললো। একপর্যায়ে খানিকটা হেলান দিয়ে বসতে সক্ষম হলো সে। অবশেষে মেহেরের মুখ হতে হাত সরিয়ে বলে উঠল,
— এভাবে কাঁদতে নেই পুচকি! এতো অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে না। তোমাকে তো স্টোং হতে হবে। তুমি তো জানোই না তোমার বর এর আগেও তিন বার গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। ভবিষ্যতে আবার ও হতে পারে। এ যে আমার পুচকির স্বামীর জীবনের সঙ্গে অতপ্রত ভাবে জড়িত।
মেহের ছলছল নয়নে সমুদ্রের দিকে তাকালো। অতি নিম্ন কন্ঠস্বর! লোকটা অসুস্থ অথচ ফাজলামি করছে! বিষয়টা ভেবেই মেহেরের শরীর রাগে গিরগির করে উঠলো। মেয়েটা যে কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেলছে তা খেয়াল করেও সমুদ্র তার অনুভূতি নিয়ে ছলনায় মত্ত! মেহেরের কোন আওয়াজ এলো না। কান্না বেগ কমিয়ে ফির নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো। বিষয়টা পরিলক্ষিত করে অনুতপ্ত হলো সমুদ্র! সে যে নিজের অজান্তেই তার পুচকিটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! সমুদ্র মেহেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে নিম্ন গলায় বলল,
— আম সরি পুচকি! চোখের জল মুছো। আমি আর এমন কথা কখনো বলব না। তুমি তো বুঝতে পারছো না আমার আনন্দের অনুভূতি। আমার পুচকি যে আমার জন্যে কাঁদছে তা আমার নিকট কতোটা সৌভাগ্য ময় তা তুমি ধারণা ও করতে পারবে না! ভীষণ আনন্দে আমার মস্তিষ্কের কার্যকর ক্ষমতা লোপ পেয়েছে।
সমুদ্রের মুঠো বন্ধন হতে হাত ছাড়িয়ে মেহের কিঞ্চিৎ ক্রোধ, অভিযোগ এবং একরাশ অভিযোগের সহিত বলে উঠলো,
— আপনি কে হারিয়ে যেতে হবে না। দরকার পড়লে আমিই হারিয়ে যাব। সত্যিই বলছি আপনি কিন্ত অত্যধিক পচা। আমাকে বুঝেন না!
মেহেরের কথা শুনে মুচকি হাসির সহিত সমুদ্র বলতে লাগলো,
— আপনাকে কোথাও যেতে হবে না ম্যাম। আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিব। আপনি শুধু আমার। আমার ব্যবহৃত কোন কিছুতে অন্যের হস্তক্ষেপ আমার অপছন্দ। সো নো টেনশন!
সমুদ্র কথার ভিত্তিতে কপাট রাগ দেখিয়ে মুখ ফিরে অন্য দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মেহের। মেয়েটার অভিমান ময় পরিস্থিতি দেখে সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। মূলত শোয়াইব খানের উপস্থিতি লক্ষ্য করে মেহেরের সঙ্গে অদ্ভুত আচরণে লিপ্ত হয়েছিল সে। তার মেয়ে যে সমুদ্র হীনা থাকতে পারবে না বিষয়টা স্পষ্ট শোয়াইব খানের মস্তিষ্কে প্রমাণ সরুপ দেখিয়ে দিলো সমুদ্র। মেয়ে এবং জামাতার অভিমান মূলক বার্তা আদান প্রদান সহ্য করতে পারেন নি তিনি। পরিশেষে ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে কেবিনের দরজার পার্শ্ববতী হতে প্রস্থান করেছেন। এমনকি যাওয়া পূর্বে চোখের ভাষায় সমুদ্রকে শাসিয়ে গিয়েছেন তিনি। শোয়াইব খান প্রস্থান হতেই বার কয়েক স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। অতঃপর মেহেরের অভিমান ভাঙার উদ্দেশ্যে তীর্যক হাসি দিয়ে মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। হঠাৎ মেহেরের মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলো,
— ইশ! তোমার হাব ভাব সুবিধা জনক নয়। তুমি কী এখন আবার আমার ওয়াইফে ট্যান্সাফার হলে? টাস্ট মি পুচকি, পুরো বউ বউ লাগছে তোমাকে।
সমুদ্রের কথাগুলো শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো সে। মেহের লজ্জায় নুইয়ে পড়ার পূর্বে সমুদ্র ফির বলে উঠলো,
— এভাবে হুটহাট লজ্জা পাবেন না ম্যাম। আপনি শুধু ভুলে যান আপনার স্বামীর ও ভিন্ন এক রূপ বিদ্যমান! আমাকে এভাবে কাতার করার অধিকার আপনার নেই। ইতিমধ্যে হাতে ভীষণ ব্যথা অনুভব হচ্ছে। এখন দয়া করে আমার বুকে ব্যাথা তৈরি করবেন না।
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৫৪
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
সমুদ্র এবং মেহেরের প্রেমালাপ এ ব্যঘাত ঘটেছে কিৎক্ষণ পূর্বে। ভীষণ প্রশান্তি ময় সময় অতিবাহিত করছিল তারা! হঠাৎ তাদের মধ্যে উপস্থিত ঘটে আকাশের। অসময়ে তার আগমন মেহের এবং সমুদ্রের নিকট অন্তত অপ্রত্যাশিত! সমুদ্রের ব্যথাতুর মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট! অন্যদিকে মেহের অযথাই লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে
পড়েছে। যার সুবাদে আকাশের উপস্থিতি লক্ষ্য করে মাথা নিচু করে ফেলেছে।
সমুদ্র এবং মেহেরের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে আকাশ মুচকি হেসে চলছে অনবরত! আকাশের তীর্যক হাসির পিছনে যেন একরাশ রহস্য স্পষ্ট! আকস্মিক সে তীর্যক কন্ঠ বলল,
— সরি রে দোস্ত! আমি আসলে বুঝতে পারি নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স আসবেন তোকে খাওয়াতে তাই আর কি আমি মেহের থুক্কু ভাবিকে নিতে এলাম। ভাবি তো এখন অবধি লান্স করেনি। তাছাড়া আমাকে এসিপি স্যার আদেশ করছেন ভাবিকে নিয়ে যাবার জন্যে।
আকাশের কথা প্রভাবে গম্ভীর্য ফুটে উঠেছে সমুদ্রের মুখশ্রীতে। মেহের আকাশের কথার প্রেক্ষিতে অবাকের সহিত বলে উঠলো,
— উনি তো অসুস্থ! এই পরিস্থিতিতে উনাকে খাবার খাওয়ানো যাবে কী? আমার ধারণা অনুযায়ী কমপক্ষে দু দিন স্যালাইন চলবে।
মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে আকাশ নিজ বত্রিশ দাঁত বের করে বলে উঠলো,
— তোমার উনি আমাদের মতো দুর্বল না। এমন পরিস্থিতিতে সমুদ্র অভ্যস্ত। দেখো আমি সিউর, কালকে ও হসপিটালে থাকবে না। আমি হলে মিনিমাম তিনদিন হসপিটালে ভর্তি থাকতাম। জানি না তোমার উনি কোন ধাতু দিয়ে তৈরি! তোমার উনিকে সহজে অসুস্থতা কাবু করতে পারে না।
আকাশকে এহেন কান্ডে লজ্জায় রঞ্জিত হয়ে গিয়েছে মেহের। সমুদ্র পূর্বের ন্যায় থতমত মুখ করে বসে ছিলো। আচমকা নিরবতা ভেঙে সে আহত গলায় বলল,
— কিন্তু এবার মনে হচ্ছে আমাকে আরো বেশ কয়েকটি দিন হসপিটালে থাকতে হবে।
সমুদ্র কথা শুনে আকাশ ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলো,
— কেন?
আকাশের প্রত্যুত্তর দেওয়ার পূর্বে মেহেরের মুখ পানে দৃষ্টিপাত ফেলল সমুদ্র। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মিহি কন্ঠে বলল,
— এবার যে হাতে ব্যাথার চেয়ে বক্ষ পিঞ্জরে ব্যাথা দ্বিগুণ। বিশ্বাস কর ভাই, বুকের ভেতর ভীষণ চিন চিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে!
— এই তুই কি বুকে ব্যথা পেয়েছিস? ডক্টরকে বলেছিস তো?
— হুম। ডক্টর উপলব্ধি করতে পারে। অথচ ওষুধ দেই না। আজ দিয়েছিল কিন্তু তোর জন্য ওষুধ কাজ করছে না। ইডিয়েট!
সমুদ্রের বলা বাক্য গুলোর অর্থ বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো আকাশের। সমুদ্র এখনও অবধি মেহেরের মুখ পানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে! আকাশ সমুদ্রের পরিস্থিতি দেখে অবাকের শেষ সীমান্তে। বর্তমানে আকাশের সন্দেহ হচ্ছে তার সামনে বসে থাকা আহত সমুদ্রকে। লোকটা কি আদৌও তার বন্ধু সমুদ্র নাকি ছন্দ বেশি মানব! অবশেষে অবাকের রেশ কাটিয়ে আকাশ বলে উঠলো,
— তুই ঠিক আছিস ! তোর এতো পরিবর্তন কেমনে কি ভাই? তোর কথাগুলো হজম করতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
আকাশের কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্র বিরক্তি প্রকাশের সহিত বলল,
— বাই দা ওয়ে। যা মেহেরকে খাইয়ে নিয়ে আয়। দেখ, জাস্ট ছ ঘন্টার মেয়েটা শরীরের কী অবস্থা করে ফেলেছে। না জানি আমি মারা গেলে কি হতো?
অন্যদিকে চোখ যুগল বুঁজে সমুদ্রের বলা বাক্য গুলোর অর্থ বোঝার প্রয়াস চালাচ্ছিল মেহের। হঠাৎ সমুদ্র মুখে মৃত্যুর কথা শুনে চোখ জোড়া খুলে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সমুদ্র অচঞ্চল আঁখিতে! তখন অবধি মেহেরে মত্ত ছিল সমুদ্রের দুর্বল,ব্যথাতুর, তীর্যক চাহনি। মেয়েটা কে কষ্ট দিতে বোধহয় বেশ আনন্দ পাচ্ছে সমুদ্র। মেহেরের ছলছল দৃষ্টি উপেক্ষা করে সমুদ্র বলে উঠলো,
— আকাশ ওকে নিয়ে যা। আমার খুব খিদে পেয়েছে। ওকে খাইয়ে আমাকে একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দে।
তৎক্ষণাৎ বেড হতে নেমে দ্রুত পদে প্রস্হান করলো মেহের। আকাশ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে সমুদ্র চোখের ইশারায় তাকে কেবিন হতে প্রস্হান করার আদেশ দিল।
______
করিডোরে বসে মেহেরের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন শোয়াইব খান। ছয়ের অধিক আইটেম মেয়ের জন্য অডার করে নিয়ে এসেছেন নামিদামি রেস্টুরেন্ট থেকে। দ্রুত পদে শোয়াইব খানের নিকটবর্তী হাজির হলো মেহের। অতঃপর মাথা নিচু করে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় বসে পড়লো তার নিকটে।
মেহেরের আচমকা উপস্থিতিতে পুলকিত শোয়াইব খানের হৃদয়। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা স্পষ্ট! কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি পরখ করলে তার মেয়ের চোখ জোড়া জলে টলমল করছে! বিষয়টা তার নিকট খানিক ব্যথাতুর। মেহেরের এমন পরিস্থিতি দেখে তিনি বলে উঠলেন,
— কি হয়েছে মা? তোমার চোখে জল কেন?
— আমাকে কিছু খেতে দিবেন। একটু জলদি দেবেন। আমি খেয়ে দেয়ে ওনার কাছে যাব।
মেহের নিসংকোচে আবেদন তুলনাহীন ব্যথিত করে তুললো শোয়াইব খানকে। লহমায় তিনি এক প্যাকেট বিরিয়ানি প্লেটে সার্ভ করলেন। সঙ্গে অন্য সব আইটেম সাভ করলেন। পকেট থেকে জীবন নাশক হ্যান্ড সেনিটাইযার বের করে হাত পরিস্কার করে, অতঃপর মেহেরের মুখের সামনে এক লোকমা খাবার তুলে বললেন,
— হা করো মা। আজ নাহয় আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। আমার শেষ ইচ্ছা বা আমার অনুরোধ মনে করে খাবে?
শোয়াইব খানের কথা শুনে মেহেরের হৃদয় গহীনে উল্লাসে অজস্র বন্যা বইতে আরম্ভ করল। তাকে সিরাত বেগম ব্যতীত কেউ খাইয়ে দেয় নি। আনন্দের সহিত শোয়াইব খানের হাতে খেয়ে উঠলো মেহের।
_______
ঘড়ির কাঁটা দশের নিকট পৌঁছিয়েছে খানিক পূর্বে। মেহের খেতে যাওয়া পরে চোখ জোড়া বন্ধ করে ছিলো সমুদ্র। কখন যে তার চোখ নিদ্রা নেমে এসেছে তা তার অজানা।
খানিকক্ষণ যাবত সমুদ্র মাথায় আলতোভাবে চুলগুলো হাতড়িয়ে দিচ্ছে কোন এক মানব। তার চোখ জোড়া সহল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। এমন আদুরে ছোঁয়া পেয়ে স্বল্প কেঁপে উঠছে সমুদ্র। তার নড়েচড়ে উঠার ফলে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি হঠাৎ ভাঙা গলায় বলল,
— আই এম সরি ভাইয়া! আমাকে ক্ষমা করে দেও।
কাঙ্খিত ব্যক্তির কন্ঠস্বর পেয়ে সমুদ্রের নিদ্রা হারিয়ে গিয়েছে ওই দূর দিগন্তে! বরাবর তার ঘুম অতিরিক্ত হাল্কা। সাধারণত স্বল্প পরিসরে শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। আজ ও ব্যাতিক্রম হয় নি। ভাঙা কম্পমান মলিন কন্ঠস্বর পেয়ে সমুদ্র চোখ জোড়া ধীর গতিতে উন্মুক্ত করল। তার মুখের নিকটবর্তী খানিকটা ঝুকে থাকা ব্যক্তিকে দৃশ্যমান হতেই তার ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুঁচকে এলো। চোখের সামনে ইয়াদের মুখশ্রী তার নিকট বেশ বিষ্ময়কর! ছেলেটা আসলেই তার ভাই ইয়াদ নাকি তার ভ্রম!
সমুদ্রের উন্মুক্ত চোখের সন্দেহ জনক দৃষ্টি ইয়াদকে বেশ অনুতপ্ত করে তুলল। সমুদ্রের চুলের মাঝে হাত স্থির রেখে নরম গলায় বলল,
— কেমন আছিস ভাইয়া? জানিস আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম যখন আকাশ ভাইয়া বলে ছিলো তোর গুলি লেগেছে! গাড়িতে পথ যতো অতিক্রম হয়েছে আমার অস্থিরতা ততো বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইয়াদের কথার প্রত্যুত্তরে নিরব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র। তার উত্তর না পেয়ে ইয়াদ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
— ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ। আমি তোকে মাকে এবং জারাকে অতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। সত্যি রে ভাই আজ মা আমার জন্য বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তুই জানিস না ভাই আমি প্রতারণায় স্বীকার! শুধু প্রতারণা নয় আজ আমি ভালো করেই অনুভব করতে পারছি , মিথ্যা কখনোই মানুষকে শান্তি দিতে পারেনা। ছোট একটা মিথ্যা মানুষকে ক্রমশ অশান্তির পথে ঠেলে দেয়। মিথ্যাবাদী কখনোই আনন্দে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। মিথ্যার যখন প্রথম সূচনা হয় তখন মনে হয়, ইশ মিথ্যা কথাই বুঝি আমাদের আনন্দ দেয়। কিন্তু না সময় যতো অতিক্রম হতে থাকে ওই ছোট মিথ্যা বানীটা ততোই ঘনত্ব বিস্তার করতে থাকে। সময়ের তালে তালে ছোট মিথ্যার আকার এতোটা বিস্তার হয় যে তা পাহাড়ের ন্যায় সুউচ্চ হয়ে উঠে। দিন শেষে ওই মিথ্যা বানী আমাদের সুখ কেড়ে ন্যায়।
কথাগুলো বলেই শুকনো ঢোক গিললো ইয়াদ। ফির সহজ চোখে বলে উঠলো,
— সামান্য সুখে জন্য খুবই ক্ষুদ্র একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম আমি। বিশ্বাস কর, ওই মিথ্যা বানী আমাকে তিন বছর স্বর্গ সুখে ডুবিয়ে রেখেছিল। অতঃপর মিথ্যের কৃত্রিম আনন্দের মেয়াদ শেষ হতেই তা আমাকে নরকের দিকে ধাবিত করছে। আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে অবিরাম। অতি ক্ষুদ্র পরিসরের মিথ্যে আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে তার প্রখর তাপে। সেই ছোট একটা পাপ আমার জীবনে বৃহত্তর পাপের আগমন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।
ইয়াদের কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না সমুদ্র। সে শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে ইয়াদের মুখ পানে।
— ভাইয়া আমাকে মাফ করে দে আমি তোর সঙ্গে কতো গুলো দিন কথা বলি নি। তোকে বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছে।
ইয়াদের কথা শুনে ধীরে উঠে বসলো সমুদ্র। অতঃপর ইয়াদকে কোন কথা বলতে না দিয়ে তাকে এক হাতে আবদ্ধ করে জড়িয়ে ধরলো। ম্লান গলায় বলল,
— তুই যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস এতেই আমি আনন্দিত। এখন বল তুই ঠিক আছিস তো? তোর সঙ্গে কে ছলনা করেছে আমি জানতে চাই ।
সমুদ্রের বাহুতে মাথা রেখে ইয়াদ বলল,
— এসব নিয়ে চিন্তা করিস ভাইয়া। এখন সবকিছু ঠিকঠাক। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।
— আনসার মি ইয়াদ? কী হয়েছে বল?
সমুদ্রের দাঁত দাঁত চাপা ধমক খেয়ে কিঞ্চিৎ ভয় পেলো ইয়াদ। পৃথিবীতে একমাত্র সমুদ্র নামক মানব কে ভয় পাই সে। ছোট বেলা থেকেই সমুদ্র বেশ গম্ভীর প্রকৃতির। হাসতে অন্তত অপছন্দ করে সমুদ্র। সমুদ্রের হাসি যেন এক মূল্যবান রত্ন! ভাইয়ের এ অদ্ভুত স্বভাবের জন্য ইয়ার বরাবর ই তাকে ভয় পাই।
— ভাইয়া রাগিস না। আই এম ওকে। তুই নিশ্চিত থাক। বাসায় চল সবকিছু খুলে বলব। আমার জেবু আমাকে ক্ষমা করে দিলেই আমার আর কোন কষ্ট থাকবে না।
ইয়াদের মুখে জেবু নামটা অপরিচিত লাগলো সমুদ্রের। তাই তৎক্ষণাৎ সে বলল,
— হু ইস জেবু?
— মেহেরের বোন জারা।
জারাকে চিন্তে সময় লাগলো না সমুদ্রের। বিষয়টা যে একান্ত জারা এবং ইয়াদের ব্যাক্তিগত, তাই সে কথা আর এগুলো না।
— ওকে বাই দা ওয়ে। লান্চ করেছিস।
— না ভাইয়া। মেহের কোথায়? ও কোথায় গিয়েছে। তোর কলিগ আকাশ ভাইয়া বলল মেহের নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
— হুম। মেয়েটা অতিরিক্ত আবেগ প্রবণ। ওর জ্ঞান ফিরার পর আকাশকে বলেছি, ওকে লান্চ করিয়ে নিয়ে আসতে। দ্যান আমি খাব।
লহমায় কেবিনে উপস্থিত হলো মেহের এবং আকাশ। মেহেরের হাতে একটা টিফিন বক্স বিদ্যমান। খানিক পূর্বে শোয়াইব খান তাকে খাইয়ে দিয়েছিল। অতঃপর সমুদ্রের জন্য উপযুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে মেহেরের। কারন সমুদ্রের লাঞ্চের জন্য আকাশ তার উপযুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে নি। সমুদ্রের জন্য থাই সুপ তৈরি করেছিল আকাশ। কিন্তু সুপের মধ্যে সমুদ্রের এলার্জি হয় এমন উপাদানের উপস্থিত ছিলো। তাই মেহের সমুদ্রের জন্য খাবার তৈরি করতে শোয়াইব খানের বাড়িতে গিয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে সমুদ্র কে অত্যধিক সময় মেহেরের অপেক্ষা করতে হয়েছে।
সমুদ্রের নিকটবর্তী ইয়াদকে আবিষ্কার করে অসীম অবাক হলো মেহের। বিয়ের পর এই প্রথম ইয়াদকে দেখেও তাকে চিন্তে বিন্দু পরিমান অসুবিধা হয় তার। কিন্তু আশেপাশে জারার উপস্থিত না পেয়ে স্বল্প ক্ষুণ্ন হলো মেহের। মাথা নিচু করে ইয়াদের সামনে এসে বলে উঠলো,
— আসসালামু আলাইকুম জিজু। কেমন আছেন?
মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে ইয়াদ মুচকি হাসির সহিত বলল,
— আমার পিচ্চি শালিকা আমাকে চিনতে পেরেছে তাহলে! তা কেমন আছো তুমি? পড়াশোনার কি খবর?
— ভালো ভাইয়া।
ইয়াদ এবং মেহেরের কথার মধ্যে ব্যঘাত ঘটালো আকাশ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— পরে কথা বলো ইয়াদ। অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে। সমুদ্রকে খাওয়াতে হবে। আজ আর নার্স আসবে না।
ইতিপূর্বে ইয়াদ এবং আকাশের সাক্ষাৎকার হয়েছে বিধায় তারা পুনরায় আর একে অন্যের সমাচার জিজ্ঞাস করেনি। সমুদ্রের খাওয়ার কথা ভেবেই ইয়াদ তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,
— মেহের আমার কাছে হটপট টা দেও। আমি ভাইয়াকে খাইয়ে দিচ্ছি।
ইয়াদের কথার প্রেক্ষিতে বক্সটা এগিয়ে দিলো মেহের। কারন সমুদ্রের খাইয়ে দেবার অভিপ্রায় থাকলেও বর্তমানে নিরুপায় সে। সমুদ্রের জন্য সুপ তৈরি করতে গিয়ে ছুড়ির আঘাতে তার ডান হাতের আঙ্গুল স্বল্প কেটে গিয়েছে।
মেহেরের হাত থেকে হটপট টা নিয়ে ঢাকনা খুললো ইয়াদ। সমুদ্রের বেডের পাশে বসে বলে উঠলো,
— ভাইয়া মুখ খুল। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
ইয়াদের কথা সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই তার চোখে মুখে গম্ভীর ভাব দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেলো। একপলক খাবারের দিকে তাকিয়ে, মেহেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মেহেরের মুখ পানে।
সমুদ্রের আহত দৃষ্টির ভাষা পড়তে বিন্দু পরিমান অসুবিধা হলো না মেহেরের। লোকটা যে ইয়াদের হাতে খেতে নারাজ বিষয়টা খুব সহজেই মেহের বুঝতে সক্ষম হলো।
— ভাইয়া এভাবে মুখ শক্ত করে থাকবি না। আমার ছোট বেলার কথা স্মরণ হয়। প্লিজ হা করো।
ইয়াদের বলা বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠলো। আকস্মিক গম্ভীর কণ্ঠে সে বলে উঠলো,
— আমি খাব না।
সমুদ্রের কথাই ফোড়ন কেটে আকাশ তীর্যক হাসির সহিত বলল,
— ইয়াদ তুমি সরো। আমি নাহয় মেহের ওকে খাইয়ে দিচ্ছি।
আকাশের কথার প্রেক্ষিতে ইয়াদ ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে উত্তর দিলো,
— মেহের তো ছোট মানুষ। ও এসব পারবে না। তাছাড়া ভাইয়া ওর হাতে খাবে কি সন্দেহ! তুমি তাহলে খাইয়ে দেও ভাইয়া।
ইয়াদের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করতে সমুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তার মুখশ্রীতে রাগের বলি রেখা ফুটে উঠলো। মুহুর্তেই সে দাঁতে দাঁত চেপে রুক্ষ কন্ঠ বলল,
— তোদের কাউকেই আমাকে খাইয়ে দিতে হবে না স্টুপিড! নাও গেট আউট ফরম হেরায়।
সমুদ্রের ধমক খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ইয়াদ। হঠাৎ সমুদ্রের ক্রোধের কারণ তার বোধগম্য হচ্ছে না। তার ধারণা মতো সমুদ্র মেহেরকে সহ্য করতে পারে না। তৎক্ষণাৎ আকাশ নিম্ন কন্ঠে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— কুল সমুদ্র! এতো রাগিস না। এখন তুই অসুস্থ একটু প্রাণচাঞ্চল্য থাকার প্রচেষ্টা কর। আমারা যাচ্ছি।
ইয়াদের মস্তিষ্ক কার্যকর ক্ষমতা লোপ পেয়ে বসেছে! তৎক্ষণাৎ আকাশ তাকে ইশারা করে বেরিয়ে আসতে বললো। অবশেষে দ্রুত পদে প্রস্থান করলো সে সমুদ্রের কেবিন থেকে। যাওয়ার পূর্বে মেহেরকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
— ভাইয়া কে খাইয়ে দেও। আমি লাঞ্চ করে আসছি।
____
ইয়াদের যাওয়া পর নিসংকোচে সমুদ্রের পাশ্ববর্তী গিয়ে বসলো মেহের। খানিক ভয় কাজ করছে তার অন্তরালে!
— কাউকে জোড় করে আমাকে খাইয়ে দিতে হবে না। খাবার দেও আমি বা হাত দিয়ে খেতে পারবো।
সমুদ্রের কন্ঠস্বরে অভিমান স্পষ্ট! মেহের বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। অতঃপর চামচে করে সুপ উঠিয়ে সমুদ্রের মুখের নিকটবর্তী এনে নরম বলল,
— রাগ করবেন না প্লিজ।
মেহেরের নরম কন্ঠ কর্ণপাত হতে সমুদ্রের অভিমান হাওয়ায় ভেসে গেলো। তৎক্ষণাৎ এক চামচ সুপ মুখে দিতেই তার চোখে মুখে পুনরায় ক্রোধের উদ্ভাবন ঘটলো। মুহুর্তেই ভর্ৎসনা স্বরে মেহের কে বলল,
— ফাজিল! আমাকে বোকা ভেবেছো? সুপ তৈরি করতে বাসায় গিয়েছিলে তুমি?
মেহের মাথা নিচু করে নিরবে বসে রইল।
— বিয়াদপ মেয়ে। আমাকে যন্ত্রনা দিতে তোমার খুব ভালো লাগে বুঝি? আমি খাবো না।
সমুদ্রের বকা শুনে মেহেরের অন্তরাল বিষিয়ে উঠলো। সজল হয়ে উঠলো তার চোখ যুগল। পরিশেষে কান্না মাখা কন্ঠে মেহের বলে উঠলো,
— প্লিজ খেয়ে নিন। আই এম সরি। না খেলে আপনি সুস্থ হবেন কি করে?
অতঃপর ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে খাবার সমাপ্ত করলো। সমুদ্র কে খাবার খাইয়ে হটপট নিয়ে উঠে প্রস্থান করার প্রয়াস পা জোড়া ধাবিত করলো মেহের।
মেহেরকে চলে যেতে দেখে সমুদ্র নিম্ন কন্ঠে বলল,
— হেই পুচকি, হয়ার আর ইউ গোয়িং ?
— আপনি তো চলে যেতে বলেছিলেন খানিক পূর্বে।
লহমায় বা হাত জোড় প্রসারিত করলো সমুদ্র। মেহেরের হাত খোপ করে ধরে বলতে লাগলো,
— আপনি কি বুঝেন না, আমার এই ২৭ বছরের জীবন আপনি তুচ্ছ করে ফেলেছেন প্রেয়সি। আপনি চোখের আড়াল হলে যে আমার হৃদয় গহীন ঝড় রাত্রির উত্তাল উদ্যম সমুদ্রের ন্যায় হয়ে উঠে। আপনাকে একটি বার দেখার জন্যে আমার আঁখি জোড়া মরিয়া হয়ে উঠে বারংবার! তীর্থের কাকের ন্যায় আপনাকে দেখার প্রতিক্ষায় প্রতি সেকেন্ড অপেক্ষা মত্ত থাকি আমি। আমার নিদ্রা ছিনিয়ে আপনি প্রশান্তিতে থাকেন কীভাবে? আপনার অন্ততরের ভেতর কী আত্মগ্লানির সৃষ্টি হয় না? কাউকে তুমি নামক অনুভূতিতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে আপনার লজ্জা অনুভব হয় না। আমার হৃদয় হরণ করে আপনি সুখে থাকবেন তা হবে না, ম্যাম। আপনাকে যে শাস্তি পেতে হবে। সীমাহীন শান্তি। যে শাস্তির সূচনা রয়েছে কিন্তু কোন অন্ত নেই।
(চলবে)
[রিচেক দেই নি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ]