#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব :৫৭
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
দুপুর শেষ হয়ে বিকেল গড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তিন এ গিয়ে ঠেকেছে। চৈত্র মাস হওয়ার সুবাদে উষ্ণতায় ভরে উঠেছে পরিবেশ। বিশেষ করে শহরের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি গৃহিনীদের অবস্থা নাজেহাল! রান্না ঘর অবস্থান করছে মেহের। সেই দুপুর থেকেই একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে কর্ম অর্পিত দুই বোনের উপর। জারার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। সেও মেহেরের সঙ্গে রান্নার কাজে ব্যস্ত। ইয়াদ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে সেই দুপুরে। তার বেরিয়ে যাবার মিনিট বিশের মধ্যে সমুদ্রের অতিশয় বৃহৎ ফ্লাটে অতিথির আগমন ঘটে। সমুদ্রের দুই ফুপু তাদের সন্তানদের নিয়ে হাজির হয়েছেন। এরমধ্যে অবশ্য রাফু আসেনি। রাফুর বোনরা এবং মা এসেছে। বর্তমানের তাদের আয়োজনে একের পর এক কাজে ব্যস্ত মেহের। ছোট মেহেরের কর্মের নিপুণতা দেখেই হতবম্ব জারা। তার ছোট বোন যে এতো বড় হয়ে গিয়েছে তার সত্যিই জারার অজানা!
মেহের মনোযোগ সহকারে কাজ করছে। ইতোমধ্যে তার শরীর ঘেমে একাকার! তার শুভ্র বর্ণের ললাট বিন্দু বিন্দু জল দ্বারা সিক্ত হয়ে উঠেছে। দুপুরে শাওয়ার নেওয়ার সময় পাই নি। সমুদ্র তার উপর ক্ষুণ্ণ হয়ে তখন তাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। মেহের অতিথি আপ্যায়ন এতোটা বিভোর যে সমুদ্রের খোঁজ নেওয়ার সময়ই পাই নি। শাশুড়ি মাকে ছেলের রুমে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে কর্মে মত্ত সে। অবশ্য নিশ্চিন্তে বললে ভুল হবে। সমুদ্রের কথাগুলো বারংবার মেহেরের কর্ণকুহুরে প্রতিধ্বনি তুলছে। এক অজানা সংশয় জাগ্রত হয়েছে তার অন্তরালে! উদাসীন মনে সে ভেবে চলছে কিভাবে লোকটার অভিমান ভাঙাবে? কীভাবে সমুদ্রের যাবতীয় সব বেদনা প্রশমন করবেন।
হঠাৎ মেহের কে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলো জারা। যে মেয়েটা কে দিন কয়েক পূর্বেও সে কোলে নিয়েছে আজ সেই মেয়েটা তার বড় জা! বয়সে অধিক ছোট হলেও মেয়েটাকে আজ তার নিকট এক পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। লহমায় মেহেরের মুখশীতে দুশ্চিন্তার উপস্থিতি আন্দাজ করতে সক্ষম হলো জারা। তৎক্ষণাৎ মেহের উদ্দেশ্যে আদর মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— কি হয়েছে আমর পাঁকা বুড়িটার? এভাবে উদাস হয়ে কী ভেবে চলছে অনবরত?
গ্যাসের আগুনে উত্তপ্ত পাত্রের বুদবুদফাটা বাষ্পে কি দেখে যেন পলক হারিয়েছে মেহের। মন মরা হয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে ছিল অস্পষ্ট ধোঁয়াতে। আচমকা জারার কথা শুনে মেহেরের ধ্যান ফিরলো। ভদ্র মেয়ের মতো জারার মুখে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে উঠলো,
— ভালো লাগছে না আপু।
— কেন?
— আমি উনাকে নিজের অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। উনি ভীষণ অভিমান করছেন আমার উপর। রেগে আগুন হয়ে রয়েছেন।
মেহেরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলল,
— কেন রে? কি হয়েছে? ভাইয়া বকেছে তোকে?
জারার কথার প্রত্যুত্তরে মেহের ম্লান কন্ঠে বলল,
— তুমি হাসছো আপু!
— কি এমন কর্ম করেছিস তুই, যে আমার ভাসুর মহাশয় রেগে আছেন?
আকস্মিক মেহেরের চোখ যুগল সজল হয়ে উঠলো। ঠোঁট ওল্টে দুপুরে সমুদ্রের কৃত ব্যবহার সম্পর্কে জারাকে পরিষ্কার খুলে বলল। সমুদ্রের অভিযোগ মাখা বাক্যে গুলো উপস্থাপন করেই কেঁদে দিলো সে।
মেহেরের সম্পূর্ণ বক্তব্য শুনেই জারা স্তম্ভিত, বিষ্ময়িত হয়ে পড়লো। সে পূর্ব হতেই ধারণা করেছিল সমুদ্র মেহেরের প্রতি দুর্বল। কিন্ত তাই বলে তার ভাবনার থেকে শত দুর্বল তা দিবা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি সে। সবটা কর্ণপাত করে জারার মস্তিষ্ক বলে উঠলো, তার পাঁকা বুড়িটা একদমই ঠিক করেনি সমুদ্রের সঙ্গে। তার উপর একবার ও খোঁজ নেই নি লোকটার। এতে করে সমুদ্রের অভিমান পাহাড় আকার ধারণ করেছে নিশ্চয়ই। জারা কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে মেহেরের উদ্দেশ্যে বলল,
— কান্না করিস না। আমি যা বলব তাই করতে হবে তোকে। দেখবি ভাইয়ার রাগ একদম হাওয়া হয়ে যাবে। নাও, প্রমিজ কর করবি।
মেহেরের ক্রন্দনরত অবস্থায় উত্তর দিলো,
— তুমি যা করতে বলবে আমি তাই করব আপু, প্রমিজ।
__________
আসরের আযান দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। মেহেরের উপর ভীষণ অভিমান করে রয়েছে সমুদ্র। মেয়েটা তাকে সত্যিই বুঝলো না! এখন অবধি মেহেরের দেখা নেই। সেই দুপুরে ক্রন্দনরত অবস্থায় ঘর থেকে প্রস্থান করেছে মেহের। এর মধ্যে একবারও সমুদ্রের খোঁজ নিতে আসে নি। অতিথি এসেছে তো কী হয়েছে, মেয়েটা কী খুব ব্যস্ত? না ইচ্ছে করে তার ঘরে উপস্থিত হতে চাইছে না। দুপুর বেলা ইসরাত বেগম সমুদ্র কে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মায়ের জোর জবরদস্তির ফলে খেতে বাধ্য হলেও, শার্ট চেঞ্জ করতে কারো হেল্প নেই নি সমুদ্র! মেহের উপর অভিমান, অভিযোগ এবং ক্রোধের বসে নিজেই শাওয়ার নিয়েছে। যার সুবাদে তার ব্যান্ডেজ সিক্ত হয়ে উঠেছে রক্তের স্রোতে!
বর্তমানে দুর্বল দেহ নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্র। তার দৃষ্টি নীলাভ, স্বচ্ছ ওই আকাশ পানে। গভীর মনোযোগ সহকারে কোন কিছু ভেবে চলছে সমুদ্র। নিজের উপর বিরক্ত সে। ক্রোধ যেন তার শরীর হতে চিরন্তন বিদায় নিতে নারাজ! মেয়েটা কে ভর্ৎসনা করেও তার হৃদয় অশান্ত! অভিমান অভিযোগ বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। এতো কিছু করেও ক্ষান্ত হয় নি সমুদ্র। আজ প্রকৃতির ইন্দ্রজাল বড্ড বিষাদ ময় তার আঁখিতে। বিশেষ করে মেহেরকে একপলক দেখার জন্য তার নয়ন জোড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। অভিমানে অভিভূত হয়ে উঠেছে তার অন্তরাল!
____________
অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত মেহের। ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভে নিযুক্ত জারা। সমুদ্রের ফুপুরা আয়েশ ভঙ্গিতে বসে দুই বউকে একের পর এক কাজে আদেশ করছেন। সমুদ্রের বড় ফুপু আলেকা অর্ধ বয়স্ক বিধবা নারী। তার স্বামী মৃত্যু বরণ করেছেন বছর পনেরো পূর্বে। তার কোন সন্তান নেই। অন্যদিকে ছোট ফুপু মালেকার তিন সন্তান। রাফু, ইতি এবং সারা। ইতি এবং সারা দুইজন সমবয়সী।
— বউ তোমরা খেতে বসো।
হঠাৎ সমুদ্রের বড় ফুপু আলেকার কথা শুনে জারা মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলল। মেয়েটা পানি পর্যন্ত মুখে তুলে নি। অতিথি আপ্যায়ন কাজ করে গিয়েছে অবিরাম! জারা বারংবার মেহের কে কাজ করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু মেহের অবাধ্য মেয়ের ন্যায় কাজ সমাপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষান্ত হয় নি। এসব চিন্তা করতেই তার হৃদয়ে একরাশ ক্রোধের আবির্ভাব ঘটলো। তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করে স্বল্প জোড় গলায় মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— মেহের তুই কিন্ত কিছু খাস নি। এখন ভদ্র মেয়ের মতো খেতে বস। ফুপুর পাশে বসে পড়। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
জারার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করা হলো না মেহেরের। তার পূর্বে ছোট ফুফু মালেকা ফোঁড়ন কেটে জারাকে বলে উঠলো,
— এই আবার কেমন কথা ছোট বউ। বড় বউকে নাম ধরে ডাকছো? তার উপর তুই বলে সম্বোধন করছো?
নিমিষেই জারার মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো। মেহের পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে। এই মুহূর্তে তার কেমন প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত ভেবে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে!
মায়ের কথা শুনে ইতির ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো। আলেকা বেগম নিশ্চুপ ভঙ্গিতে খেতে লাগলেন। সারা মোবাইল ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেহেরের মুখ পানে দৃষ্টিপাত ফেলল। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
— এতটুকু পিচ্চি মেয়েকে ভাবি বলা আদৌ সম্ভব আম্মু? হাউ ফানি !
সারার কথার প্রেক্ষিতে ইতি কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
— সারা! মেহের তোর বড় ভাবি। বয়সে ছোট হলেও তুই ভাবিকে সম্মান করতে বাধ্য।
তৎক্ষণাৎ আরক্তিম হয়ে উঠল সারা। মেহের দিকে এক পলক তিক্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— আমি পারব না এই থ্যাড ক্লাস মেয়ে কে ভাবি বলে ডাকতে।
বাক্যেটা সমাপ্ত করে দ্রুত পদে প্রস্থান করলো সারা। আসার পর থেকেই মেয়েটা বারংবার মেহেরের সঙ্গে বাজে ব্যবহার লিপ্ত হচ্ছে। বিয়েতে উপস্থিত ছিল না সারা। তাই সমুদ্রের বউকে দেখার সৌভাগ্য হয় নি তার।
সারা ব্যবহার উপর ভিত্তি করে আলেকা বেগম বললেন,
— তোমারা কিছু মনে করো না সারার কথাই। আর হ্যাঁ জারা সবসময়ই মনে রাখবে মেহের তোমার শুধু ছোট বোন নয় ও তোমার একমাত্র বড় জা। ওকে সম্মান করবে।
জারা কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। আলেকা বেগম ফির বলে উঠলেন,
— তোমার সঙ্গে কিছু দরকারি কথা রয়েছে বড় বউমা। জানি এই পরিস্থিতিতে বলা অনুচিত। তবুও বলল। কিন্তু আজ নয় কাল সমুদ্রের সামনে।
————
ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছঁই বারো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় কুঁকড় উঠলো মেহের। শুভ্র রঙের শাড়িতে অত্যন্ত অপূর্ব লাগছে মেহের কে। নব্য স্বপ্নের উৎপত্তি ঘটেছে তার অন্তরালে! ইশ, মারাত্মক সুন্দর লাগছে তাকে। সে হয়তো ধারনা করতে সক্ষম হচ্ছে না পৃথিবীর কোন এক পুরুষ তার এই রূপে উন্মাদ হতে বাধ্য। নিজের এমন পরিস্থিতি মোটেও কামনা করেনি মেহের। জারার কথা মতো বাধ্য মেয়ের শাড়ি পড়েছে মেহের। উদ্ভুত অনুভূতির আবির্ভাব ঘটেছে তার হৃদয় মনে। জারা মেহের কে সুসজ্জিত করার পর থেকেই লক্ষ করছে মেকআপ হীনা মেয়েটার মুখশ্রীতে রক্তিম আভা বিদ্যমান। মেয়ের যে ভীষণ দ্বিধাদন্দে ভুগেছে তা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জারার দৃষ্টি পলক হারিয়েছে মেহের মুখ পানে।
— আপু এই ভাবেই কি উনার সামনে যেতে হবে? না গেলে হবে না।
হঠাৎ মেহেরের কম্পনিত কন্ঠস্বর জারার কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই অতীতের স্মৃতিচারণ হতে বেরিয়ে এলো জারা। মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্য করলো জারা। মেয়েটা অত্যধিক বিব্রত বোধ করছে। তৎক্ষণাৎ ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাসির রেখা ঝুলিয়ে জারা বলল,
— এই মেয়ে বল তো তুই কোন ধাতুর তৈরি? আমি বুঝি না সামান্য শাড়ি পড়ে ভাইয়ার সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছিস তুই! সামাজিক হতে শিখ। তুই জানিস ভার্সিটির যাবতীয় সকল অনুষ্ঠানে আমি শাড়ি পড়ে উপস্থিত হই। আর তুই?
জারার কথার প্রত্যুত্তরে মেহের নিম্ন কন্ঠে ভদ্রতার সহিত বলল,
— আপু পর পুরুষের তীর্যক দৃষ্টি আমার শরীরে তীরের ন্যায় বিঁধে। আমার অস্বস্তি হয়। সৃষ্টিকর্তা নারীর পর্দা হীনা চলাফেরা বড্ড অপছন্দ করেন।
মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে জারা ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলো,
— তাই বলে ভাইয়া সামনে যাবি না?
— উনি যদি বকা দেন।
মেহেরের জবাবে জারা চোখ যুগল ক্ষুদ্র আকার ধারণ করে ভাব বিলাসীন হয়ে বলল,
— আমি তিনশ পাছেন্ট শিউর বকা দিবে না। কিন্তু,,
মেহের উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কিন্তু কী আপু?
মেহেরের প্রশ্নের উত্তরে জারা কাতার কন্ঠে বলল,
— বাদ দে, কিছুই না। আমার ভীষণ চিন্তা হয় তোর জন্যে। তোর বয়স অনেক কম। এ বয়সে তোকে সংসার করতে দেখে আমার প্রচন্ড কান্না পাই। আমি বুঝি না এতো জলদি মামি কেন তোকে রণক্ষেত্রে নামিয়ে দিল? আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে ব্যর্থ তুই এতো বড় হয়ে গেলি! জানিস এখানে এসে আমার হৃদয় সীমাহীন পুলকিত। ভাইয়ার আচরণে আমি মুগ্ধ! ভাইয়া তোকে এই কয়েক দিনে অত্যধিক ভালোবাসেন।
অধির মনোযোগ সহকারে জারার বক্তব্য শুনলো মেহের। কথাগুলো যেন তাকে দ্বিগুণ অস্বস্তিতে ফেলল। ভীষণ ইতস্তত বোধ করল মেহের।
জারা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ফির বলল,
— যাইহোক, বিশ্বাস কর তোকে এসব বলতে মোটেও অস্তিত্ব হচ্ছে না। আই উইশ, খুব শীঘ্রই বড় হবি তুই।
________
অন্ধকার আচ্ছন্ন চারপাশ। বর্তমানে সমুদ্র কক্ষে অবস্থান করছে মেহের। বিছানা নতজানু হয় বসে, নির্বাক হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। মিনিট পাঁচেক পূর্বে জারা তাকে সমুদ্রের কক্ষ রেখে গিয়েছে। সমুদ্র ক্রোধের ইতি টানার উদ্দেশ্যে মেহের আজ সুসজ্জিত হয়েছে। হৃদয়ে একরাশ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জারার কথা অনুযায়ী সমুদ্রের কক্ষে উপস্থিত হয়েছে! লোকটা কী তাকে দেখে পুনরায় গর্জে উঠবে? বাক্যেটা বারংবার মেহেরের কর্ণকুহুরে প্রতিধ্বনি তুলছে। ভয়, সংকোচ, দ্বিধার প্ররোচনা তে ইতোমধ্যে কাঁপতে আরম্ভ করেছে মেহের। যার সুবাদে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চামকাচ্ছে তার অন্তরে! সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমা চাইবে সমুদ্রের নিকটবর্তী।
—
অবশেষে অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো। দরজা চাপানোর মৃদু আওয়াজ কর্ণপাত হতেই কেঁপে উঠলো মেহের।
রাত এগারো নাগাদ ফ্লাট থেকে বেরিয়েছিল সমুদ্র। অসুস্থ শরীর নিয়ে এতক্ষণ ছাদে প্রকৃতি বিলাস করতে মত্ত ছিলো সে। মেহেরের সঙ্গে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছিল তার। তাকে দেখে দুর্বোধ্য রহস্য বিসর্জিত করেছে মেহের। কথা বলার প্রচেষ্টা করলেও সমুদ্র উপেক্ষা করেছে তাকে। বর্তমানে অন্ধকার কক্ষে উপস্থিত হতেই খানিকটা বিরক্ত হলো সমুদ্র। বিছানার উপর মেহেরের অবস্থান পরিলক্ষিত করে তার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
মেহেরের অবস্থান গুরুত্ব না দিয়ে অন্ধকারের সমাপ্তি ঘটালো সমুদ্র। মুহূর্তে লাইট অন করতেই সম্পূর্ণ কক্ষ আলোকিত হয়ে উঠল। পকেটে মুঠোফোন রেখে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত ফেললো সমুদ্র। তৎক্ষণাৎ তার হৃদয় গহীন ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অসংযত হয়ে গেল। মেহের গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো সে। সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করলো মেহের কে। মেয়েটা গাল অশ্রু সিক্ত হয়ে। মুখশ্রী জুড়ে রক্তিম ভাব স্পষ্ট! তৎক্ষণাৎ শুকনো ঢোক গিলল সমুদ্র। হঠাৎ মেহেরের উদ্দেশ্যে মৃদু এবং কঠোর কন্ঠ বলে উঠলো,
— এভাবে বউ সেজে বসে রয়েছে কেন? বলেছি না পুচকি পুচকির মতো থাকবে। বড় হওয়ার শখ জেগেছে?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে মেহের ক্রন্দন রত কন্ঠে বলে উঠল,
— আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আর কখনও আপনার কথার অবাধ্য হবো না।
বলেই ডুকরে কেঁদে ফেলল মেহের।
সমুদ্র মৃদু হাসলো। অতঃপর ধীর পদে মেহেরের নিকটবর্তী হাজির হয়ে, গম্ভীর এবং ফিসফিস কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমার বাচ্চার মা হওয়ার শখ হয়েছে বুঝি! ওকে ফাইন।
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব :৫৮
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ।]
ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই নয়। প্রগাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল সমুদ্র। খানিক যাবত এক মেয়েলী কন্ঠস্বর বারংবার তাকে ডেকে চলছে! অথচ লোকটা জাগ্রত হতে নারাজ। কাল গভীর রাত্রি অবধি অতন্দ্রি থাকার ফলে অবসন্ন দেহ বিছানার কোমল পরশ ত্যাগ করতে অসম্মত পোষণ করছে। একরাশ সূর্যের আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে তার মুখশ্রীতে। শুধু দেহ নয়, নয়ন জোড়া ও উন্মুক্ত হতে নারাজ! দীর্ঘ তিন মাস পর অবশেষে প্রশান্তিময় নিদ্রায় মগ্ন হতে সফল হয়েছে সমুদ্র। রাত্রি বেলা বারংবার মেহেরকে সংকোচে ফেলেও ক্ষান্ত হয়নি সে। মেয়েটার লালাভ গাল যুগল বোধহয় সমুদ্রের পছন্দের শীর্ষ তালিকায় স্থান নিয়েছে!
ঘুমের মাঝেই নড়েচড়ে উঠেছে সমুদ্র। কিৎক্ষণ পূর্বেও কোমল স্বর যেন পক্ষান্তরে রুক্ষ হয়ে উঠেছে! কর্কশ কন্ঠে অনবরত বলছে,
— সমুদ্র! উঠছো না কেন?
নিদ্রারত অবস্থায় বিরক্তেতে সমুদ্রের ভ্রূ যুগল কুঁচকে এসছে। আশ্চর্যে বিষয় হলো তার ঠোঁটের এক কোণে মৃদু হাসির বলি রেখা স্পষ্ট! সমুদ্র ঘুম মাখা আদুরে কন্ঠে বলে,
— পুচকি, আর একটু ঘুমাতে দেও তো,,
মুহূর্তেই মেয়েলী কন্ঠস্বর প্রখর হতে প্রখরত হয়ে উঠলো। মেয়েটার গলার জোর বাড়িয়ে বলল,
— সমুদ্র, হেই সমুদ্র!তোমার সঙ্গে ইমপটেন্ট কথা আছে।
তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তোমার পুচকি বউ নই। আমি সরা।
শেষোক্ত বাক্যেটা কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই ধরফরিয়ে উঠে বসলো সমুদ্র। সদ্য জাগ্রত হওয়ার সত্বেও তার মুখশ্রীতে কঠোরতা স্পষ্ট ফুটে উঠলো! অত্যধিক ভয়ঙ্কর চাহনি নিক্ষেপ করল সামনে অবস্থিত সারার মুখশ্রীতে। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে সারাহকে বলল,
— এই মেয়ে! আমার রুমে আসার অনুমতি কে দিয়েছে তোকে? স্টুপিড।
সমুদ্রের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই সারার চোখ যুগল সজল হয়ে উঠলো। সে ম্লান কন্ঠ বলল,
— সমুদ্র!
— ডোন্ট কল মি সমুদ্র, বিয়াদপ! ভাইয়া বলবি নয়তো আমার চোখের সামনে আসবি না।
সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে সারার ক্রন্দনরত কন্ঠ বলল,
— আচ্ছা, তুমি কেন আমাকে সহ্য করতে পার না। তোমার কী মনে নেই মামা মৃত্যুর আগে আমার আর তোমার বিয়ের কথা বলেছিলেন। আজ যদি মামা বেঁচে থাকতেন তাহলে মেহেরের জায়গাই আমি থাকতাম। এই ঘরটা ও আমার থাকতো। তুমি ও শুধু মাত্র আমার থাকতে।
এবার যেন সমুদ্রের অন্তরে ক্রোধের উৎপত্তি ঘটলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ত্যাগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। ফুসতে ফুসতে বলল,
— থাপ্পড় খেতে চাস? আমি তোর স্পর্ধা দেখে হতবাক! তুই বোধহয় ভুলে গিয়েছিস যে কার সঙ্গে কথা বলছিস। ভয় পাস না তাই তো?
সারা কেঁপে উঠলো! ছোট্ট বেলা থেকেই সমুদ্রকে ভীষণ ভয় পাই সারা। আজও ব্যতিক্রম কিছু পরিলক্ষিত হয় নি। যার ফলস্বরূপ ওড়নার আঁচল মুঠো বন্ধি করে চোখ যুগল বন্ধ করে ফেলল সে। সমুদ্র ফির তিক্ত কন্ঠে বলল,
— এই তোকে আমার রুমে কে পাঠিয়েছে?
সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে সারা কম্পনিত কন্ঠে বলল,
— তোমার বউ।
মুহূর্তেই খানিকটা ক্ষান্ত হলো সমুদ্র। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে চোখ যুগল বন্ধ করে, স্নিগ্ধ বায়ু টেনে নিলো। অতঃপর শক্ত গলায় বলল,
— এক সেকেন্ডের মধ্যে রুম থেকে বেরিয়ে যা। গেইট আইট।
তৎক্ষণাৎ ক্রন্দনরত অবস্থায় সমুদ্রের কক্ষ হতে প্রস্থান করলো সারা। যাওয়ার পূর্বে দাঁত দাঁত চেপে বলল,
— দেখো সমুদ্র! তোমার বউ যেন আবার বড় হয়ে উড়াল না দেই। এতো ছোট বউ কোনোদিন তোমাকে সুখ দিতে পারবে না।
সারা কক্ষ হতে বিদায় নিতেই আনন্দময় শয্যা ত্যাগ করলো সমুদ্র। বিছানা থেকে উঠে চিৎকার করে ডাক দিলো মেহের কে।
— মেহের, মেহের! পাঁচ সেকেন্ড এর মধ্য রুমে আসো।
লহমায় দরজার আড়াল হতে বেরিয়ে এলো মেহের। এতক্ষন সে দরজার বাইরে ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলো। কিৎক্ষণ পূর্বে সমুদ্রের চিৎকার শুনে কক্ষে নিকটবর্তী উপস্থিত হয়েছে সে। যার সুবাদে সমুদ্র এবং সারার প্রত্যেক বাক্য তার কর্ণকুহুরে প্রতিধ্বনি তুলছে! ইতোমধ্যে একরাশ ভয়ের আবির্ভাব ঘটেছে মেহেরের অন্তরে।
মেহেরকে দৃশ্যমান হতেই সমুদ্রের শরীরের শিরা উপশিরা ক্রোধে বশে টগবগ করে উঠেছে! ক্রোধ যেন পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন ভয়ঙ্কর অবস্থায় স্থানান্তরিত হয়েছে। অতিরিক্ত ক্রোধ সমুদ্রের হাত পা থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করছে! মুহূর্তেই সমুদ্র মুঠোফোন হাতে করে দ্রুত পদে মেহেরের নিকটবর্তী উপস্থিত হলো। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে প্রয়াসে হাতে অবস্থানকৃত মুঠোফোন শক্ত করে চেপে ধরলো। অতঃপর মেহের ভীত আঁখি যুগলে দৃঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে, আকস্মিক তিক্ত কন্ঠ বলে উঠল,
— এই মেয়ে, দিন দিন অবুঝে পরিনত হচ্ছো! সারা কে আমার ঘরে কী তুমি পাঠিয়েছো?
মেহের স্বল্প কেঁপে উঠলো। মাথা নিচু করে বাকহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অজানা আতঙ্কে মেহের বাকযন্ত্র হতে টু শব্দ নির্গতর করতে সক্ষম হলো না।
মেহেরের শান্ত পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সমুদ্র চিৎকার করে বলল,
— হেই স্টুপিড, আনসার মি!
সমুদ্রের চিৎকার কর্ণপাত হতেই চোখ যুগল খিঁচে বুজে ফেলল মেহের। অতঃপর ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে মিনমিন করে বলল,
— আসলে, আমি ব্যস্ত ছিলাম। তাই আপুকে,,,
মেহেরের শেষোক্ত বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তার কর্ণকুহুরে প্রতিধ্বনি তুলল কাঁচ চূর্ণ বিচূর্ণ শব্দ! তৎক্ষণাৎ চোখ যুগল উন্মুক্ত করে ভেঙে পড়া বস্তুত উপর দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করল। ইশ! বিচ্ছিরি ভাবে ভেঙে গিয়েছে সমুদ্রের মুঠোফোন! ক্রোধের বশে সমুদ্র নিজ মুঠোফোন সজোরে মাটিতে নিক্ষেপ করেছে। পরিস্থিতি পরখ করে, নিমিষেই মেহেরের চোখ যুগল হতে কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
সমুদ্র তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে প্রস্থান করল। যাওয়ার পূর্বে মেহেরকে আদেশ স্বরে বলল,
— ফাজিল, আর যদি পাকামি করেছে! আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।
মেহের সজল নয়নে তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের যাবার পানে। লোকটা পুনরায় তাকে বুঝলো! মেহের ধীর পদে বিছানার গিয়ে নতজানু হয়ে বসল। অতঃপর দু হাতের বন্ধনে মুখশ্রী আবৃত করে ক্রন্দনে ভেঙে পড়ল। বারংবার তার মস্তিষ্কের ভেসে উঠলো সারার বলা প্রতিটি বাক্য। যার ফলস্বরূপ ঈর্ষার আবির্ভাব ঘটল! তার হৃদয় গহীনে হানা দিল একরাশ অভিমান। লোকটার হৃদয় সত্যিই ভীষণ পাষাণভার! অযৌক্তিক কারণে লোকটা তাকে ভর্ৎসনা করল? সমুদ্র কেন বুঝে না, মেহেরের হৃদয়ে যে মেঘ জমে অগুনিত!
_______
প্রভাতের প্রথম প্রহর হতেই ব্যস্ত জারা। ছোট ফুফু শাশুড়ি তাকে পিঠা তৈরি করতে আদেশ করছেন। মেহেরকে এসব ঝামেলায় যুক্ত করেন নি সে। আজ নাকি নতুন অতিথির আগমন ঘটবে। তার বাবার বাড়ির লোকজন আসবে। এমনকি মেহেরের মা বাবাও আসবেন। ছোট ফুপু শাশুড়ি বারংবার জারাকে হুকুম দিচ্ছেন যেন অতি দ্রুত রান্নার সমাপ্তি ঘটায়। তার ছেলে রাফু খুব শীঘ্রই উপস্থিত হবে। রাত্রির অন্তিম প্রহরে সমুদ্রের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে রাফু। তথ্যটা জানতে পেরে অত্যধিক আনন্দিত জারা। অনেক দিন বাদে ফির রাফুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হতে চলল।
_______
— স্যার, মিস্টার রাফি চৌধুরী শহর ছেড়ে পালিয়েছে। দুঃখিত, আমারা ওকে আ্যরেস্ট করতে সক্ষম হয় নি।
— নো প্রবলেম, মিস্টার শাফি। আপনি সময় নিন। আই থিংক রাফি এই শহরেই কোথাও না কোথাও পড়ে আছে। চিন্তা করবেন না ওকে আ্যরেস্ট করার না অবধি আমি ঢাকায় ফিরব না।
কথাগুলো বলেই মুচকি হেসে উঠলো ইয়াদ। আজ তার আনন্দের দিন। তার বিশ্বাসঘাতকের পতন খুবই সান্নিধ্যে! ইয়াদের এতোদিনের পরিশ্রম সার্থক। আজ সে রাফি চৌধুরী অর্থাৎ রাফুর সমস্ত অজাক কুকাজের তথ্য সংগ্রহ করতে সফল হয়েছে। ছেলেটাকে যত সহজ সরল বলে ধারণা করছিল ইয়াদ। সে যেন এক সাধারণ যুবক নয় বরং মাফিয়া। রাফুর বৃহৎ এক টিম বিদ্যমান! অপরাধ জগতে বেশ নামকরা তার ছোট ফুফুর একমাত্র ছেলে। বিষয়টা সম্বন্ধে অবগত হতেই ঘৃণায় ইয়াদ বিষয়ে উঠেছে! তার ছোট ভাই যে এতো জঘন্য অপরাধ লিপ্ত তা তার অজানা। রাফুর সঙ্গে অতিবাহিত স্মৃতি স্মরণ করতে অতীতের ডুব দিল সমুদ্র। এই অবস্থায় শাফির কন্ঠস্বর তার কানে পৌঁছাতে অক্ষম।
ইন্সপেক্টর শাফি ইয়াদের প্রত্যুত্তর না পেয়ে অতঃপর খানিকটা জোর গলায় বলল,
— স্যার,, ভাবির কথা চিন্তা করছেন!
মুহূর্তেই ইয়াদ স্বাভাবিক হলো। তৎক্ষণাৎ জারার মুখশ্রীতে প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল তার মস্তিষ্কে! ইয়াদ গুকনো ঢোক চেপে বলল,
— মিস্টার শাফি, আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
ইন্সপেক্টর শাফি মৃদু হেসে বলল,
— ওকে স্যার।
শাফি তৎক্ষণাৎ ইয়াদের কক্ষ হতে প্রস্থান করল। শাফি যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল ইয়াদ। অতঃপর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা টেনে পকেটে হতে মুঠোফোন বের করল। উদ্দেশ্যে জেবুর কন্ঠস্বর একটি বারের জন্যে কর্ণপাত করে, অন্তর প্রশান্তিময় করা।
_____
ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই দুই। প্রভাত গড়িয়ে দ্বি প্রহরে ঠেকেছে। চার দেয়ালের অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় হাঁফিয়ে উঠেছে সমুদ্র। খানিক পূর্বে ইসরাত বেগম কে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে মেহের। কিন্তু নিজে স্ব শরীরে একটি বারের জন্যও সমুদ্রের নিকটবর্তী উপস্থিত হয় নি। নিজের ত্রুটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে সমুদ্র। মেহের বোধহয় তার উপর অভিমান করেছে। ইতোমধ্যে কয়েক বার মেহেরকে সান্নিধ্যে পাবার প্রয়াস করছে সমুদ্র। বার পাঁচেক রান্না ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। কিন্তু প্রত্যেক বার অসহায় ন্যায় তাকে ফিরতে হয়েছে।
মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেলকনিতে প্রবেশ করছে সমুদ্র। মেহেরের এক পলক দর্শন পেতে সমুদ্রের আঁখি যুগল মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। তার সহ্য করতে পারছে সে। অবশেষে গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে নিজ কক্ষ ত্যাগ করল। সর্বপ্রথম সমুদ্র চোরের ন্যায় উপস্থিত হলো পাক ঘরে। কিন্তু আফসোস মেহেরের সন্ধান মিলল না। জারার উপস্থিত দৃশ্যমান হতেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল সমুদ্র। অতঃপর মলিন কন্ঠে বলল,
— জারা, মেহের কোথায়? ওকে যে দেখছি না।
আকস্মিক সমুদ্রের কন্ঠস্বর পেয়ে আতকে উঠলো জারা। পশ্চাৎ মুখী হয়ে নিজ কর্মে ব্যস্ত ছিল সে। অবশ্য সমুদ্রের হঠাৎ উপস্থিত তার নিকট মোটেও বিষ্ময়ক নয়। নিমিষেই জারার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। অতঃপর সমুদ্রের মুখ পানে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে, নিম্ন কন্ঠে বলল,
— মেহের তো ইতি আপুর সঙ্গে ছাদে গিয়েছে। মেঘলা আকাশ তাই আপু ছাদে যাবার জন্যে জোর করছিল। অবশেষে বাধ্য হয়ে মেহের তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছ।
সমুদ্র জারার প্রত্যুত্তর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
— মেহের লাঞ্চ করছে ?
— জী ভাইয়া জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। কেন ভাইয়া?
— না তেমন কিছু নয়। ধন্যবাদ।
আর এক মুহূর্তেও অপেক্ষা করল না। দ্রুত পদে রান্নাঘর প্রস্থান করে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আচমকা সমুদ্রের থেকে ‘ধন্যবাদ’ প্রত্যাশা করে নি জারা। বিষয়টা লক্ষ্যে করেই অট্টস্বরে হাসিতে ফেটে পড়ল।
______
স্তব্ধ প্রকৃতি। বৈশাখ হওয়ার পূর্বেই কালবৈশাখীর আগমন! প্রকৃতির এই ঘটনা যেন বিরল। আকাশের বুকে বারংবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবহাওয়া পূর্বাভাস হতে জানা গিয়েছে আজ ব্যাপক বর্ষণ হবে আজ। অনাকাঙ্খিত বর্ষণ! ধরণীর হৃদয় চিরে মৃদু গর্জন ভেসে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে ছাদ ত্যাগ করতে নারাজ মেহের। আজ সর্বপ্রথম ছাদ দর্শন করছে সে। প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ মেহেরকে মুগ্ধ করে তুলছে। তার বড্ড অভিপ্রায় জেগেছে বর্ষণের পরশে দেহ শীতল করার। ইতোমধ্যে ইতি বিদায় নিয়েছে ছাদ থেকে। অবশ্য নিজ আগ্রহে প্রস্থান করেনি সে, বরং সমুদ্রের চোখের ভাষার মেহেরকে না জানিয়ে প্রস্থান করেছে। ইতির গমন সম্বন্ধে মেহেরের অজানা। সে দৃঢ় দৃষ্টিতে আকাশ পানে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছে।
নিত্যদিনের ন্যায় মাথা ওড়ানা দ্বারা আবৃত রেখেছে মেহের। শুভ্র রয়ের লং ফ্রোগ পরিহিত অবস্থায় ভীষণ মোহনীয় লাগছে মেহেরকে। সমুদ্রের খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহেরের মুখ পানে! অথচ মেহের বিষয়টা উপলব্ধি করতে অক্ষম।
মিনিট পাঁচেক নিরবতা পালন করলো সমুদ্র। ইতোমধ্যে কয়েক ফোঁটা বর্ষণ বিসর্জিত হলো ধরণীর বুকে! সমুদ্রের তৎক্ষণাৎ মেহেরের নিকটবর্তী এসে দাঁড়াল। অতঃপর ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,
— কি হয়েছে পুচকি? মন খারাপ বুঝি!
সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে, পূর্বের ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো মেহের। সমুদ্রের ফির বলল,
— বৃষ্টি পড়ছে, ঘরে চলো।
মেহের গম্ভীর মুখে প্রত্যুত্তর দিলো,
— আমি যাব না।
সমুদ্র আর এক মুহূর্তে ও অপেক্ষা করলো না। অতঃপর দ্রুত খপ করে মেহেরের হাত ধরে বলল,
— সরি তো বউ।
সমুদ্রের কথা শুনে অদ্ভুত অনুভূতি বয়য়ে গেল মেহেরের অন্তরালে! তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া বুজে, একরাশ সাহস যুটিয়ে বলে উঠলো,
— ছাড়ু্ন, আমি যাব না।
মুহূর্তেই সমুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পরিশেষে ভ্রূ যুগল কুঁচকে সে বলে উঠলো,
— যাবেন না তাই তো? ওকে নো প্রবলেম, আমার আবার বাচ্চাদের কোলে নিতে কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া আগে থেকেই অভ্যস্ত হওয়াই বেটার!
(চলবে)
[ রিচেক দেইনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]