তুমি বললে আজ পর্ব-৩১+৩২

0
479

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩১

.
সময়ের গতিবেগ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। হুট করেই দুঃখ সুখের মুহুর্তগুলো বেরিয়ে যায় নিজ আওতায় থেকে, হারিয়ে যায় সময়, রেখে যায় কিছু পুরোনো স্মৃতি। রিফাপুর বিয়ের প্রায় এক মাস পেরিয়েই গেছে। ব্যস্ত হয়ে পরেছে সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে। কিন্তু আমি? আমি এক অতিথি পাখির মতো নতুন বাসা বেঁধেছি নিজ ঘরে। সময়ের তাগিদে নিজেকে পরিবর্তন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি, ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার হয়েও না হওয়া তাসাফি নামক সেই মানুষটাকে। কিন্তু সারাদিন সেই মানুষটাকে ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও দিন শেষে ঠিকই তার জন্য অবুঝ মনটা পুড়ে উঠে, হু হু করে কেঁদে উঠে তাকে কাছে পাবার জন্য।

প্রায় তিন সপ্তাহের মতো তাসফি ভাইয়ের সাথে দেখা নেয় আমার, আর না আছে কোন প্রকার যোগাযোগ। আবারও উনাকে সবকিছু থেকে ব্লক করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি ওনার থেকে। রিফাপুর বিয়ের পরেই ভার্সিটি থেকে ওনার জয়েন ই-মেইল আসে। বিয়ের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে চলে যান ঢাকায়। এত বছর ছুটি কাটিয়ে আবারও লেকচার হিসেবে জয়েন ভার্সিটিতে। ওনার বিষয়ে জানার আগ্রহ না থাকলে ঠিকই আমার ওনার কথাগুলো কানে এসে পৌঁছায়।
তাসফি ভাইয়া ঢাকায় যাবার আগে আমার সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেই সুযোগটা আমি দেই নি। ভীষণ ভাবে এরিয়ে গিয়েছি ওনাকে, পড়াশোনার দোহাই দিয়ে গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। সাদিক ভাইয়ার বাসা থেকে আসার আরও একদিন পর কিয়ানা আপু সহ তাসফি ভাইয়ার বন্ধুরাও চলে যান। সেদিন রাতের পর কিয়ানা আপুর সাথেও আর কথা হয় নি আমার, শুধু চোখে চোখে তাকানো তেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মাঝামাঝি সময়। এই সময়টা রোদের তীর্যক আলো থাকার কথা থকলেও সেটা নেই। ধূসর মেঘে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিষন্ন মন নিয়ে ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার ভাবনার মাঝে তাসফি নামক মানুষটাকে আনতে না চাইলেও বারংবার এসে আঁটকে যাচ্ছে সেই মানুষটা। ওনার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি সময়ে এসে থমকে যাচ্ছে যেন।

নিজের ভাবনায় মসগুল থাকায় হুট করেই কেউ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরায় অপ্রস্তুত হয়ে চমকে উঠলাম। দু’হাতে ছিটকে সরানোর চেষ্টা করে হালকা চেচিয়ে উঠলাম ‘কে?’ বলে। আঁকড়ে ধরার মানুষটা ছাড়লো না আমায়, বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো, মুখ গুঁজে দিলো ঘাড়ে। আঁকড়ে ধরে স্পর্শগুলো অনুভব হতেই বুঝতে পারলাম মানুষটা ঠিক কে হতে পারে।

“একমাত্র এই আমি ছাড়া তোকে ছোঁয়ার কারোর সাহস নেই রুপু।”

ধীরগতিতে ওনার বলা কথায় আবারও কেঁপে উঠলাম কিছুটা। এতদিন পর ওনার একটুখানি স্পর্শে গলে যেতে লাগলাম যেন, ছেড়ে দিতে লাগলাম নিজের শরীরের ভার ওনার উপর। চোখ দুটো আস্তে করে বন্ধ করতেই, বন্ধ চোখের দৃশ্যপট হয়ে উঠলো সেদিন রাতের কিয়ানা আপুর দেখানো সেই ছবি, এবং তার বলা সেই কথাগুলো। সহ্য করতে পারলাম না আর ওনার স্পর্শ গুলো। দু’হাতে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম ওনাকে। মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলাম,

“ছাড়েন আমাকে, একদম ছুবেন না।”

ওনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে যেতেই হাসলেন উনি। কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
“বউটা আমার উপর খুব রেগে আছে বুঝি? অনেক অনেক সরি রুপু। ভার্সিটি থেকে হুট করে ইমেইল টা চলে আসলো যে, না যেয়েও কোন উপায় ছিলো না।”

বলেই একটু থামলেন। আরও কিছুটা দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন,
“অভিমানের পাল্লাটা মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে, তাই না? আবারও রাগ করে সবকিছু থেকে ব্লক করেছিস। জানিসই তো তোর এই দূরত্বটা আমি মেনে নিতে পারি না।”

এক হাতে বাহুতে রেখে অপর হাতে আমার গালে রাখতে চাইলেন। তার আগেই আবারও ছিটকে সরিয়ে দিলাম ওনাকে। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“রাগ বা অভিমান হওয়ার জন্য আগে কাছের মানুষ হতে হয়। আপনি আমার কে হন, যে আপনার প্রতি আমার রাগ বা অভিমান আসবে? একদম কাছে আসার চেষ্টা করবেন না আমার।”

দাঁড়ালাম না আর সেখানে, আর না তাকালাম তাসফি ভাইয়ের দিকে। দ্রুত পায়ে ছাঁদ ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সোজা রুমে এসে বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে বসলাম। দু’হাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এতদিন পর ওনাকে কাছে পেয়ে সামলাতে পারছি না নিজেকে, কিছুতেই আটকে রাখতে পারছি না নিজের আবেগকে।

কই? ওনার আসার কথা তো আমি জানি না, কারো থেকে তো শুনিও নি। তাহলে ওনার হঠাৎ আগমনের কারণটাই বা কি? আর এই বাসাতেই বা কি করছেন উনি? তাহলে কি ওনার বলা মতে শুধুই আমার জন্য এসেছেন? না… না, সেটা কি ভাবে হয়? ওনার জীবনে তো আমার কোন জায়গায় নেই, ওনার সবকিছু জুড়েই তো শুধু কিয়ানা নামক মানবী রয়েছে।

“ইস্! বউটা আমার এতটা রেগে আছে জানলে এতদিন কিছুতেই অপেক্ষা করাতাম না, খুব তারাতাড়িই চলে আসতাম। এবারের জন্য সরি রুপু, আর এভাবে চলে যাবো না।”

নিজের ভাবনায় ডুবে থাকায় কখন রুমে এসেছেন বুঝতেই পারি নি। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম দরজাটাও ভেতর থেকে লক করা। কথাটা বলেই পাশ ঘেঁষে বসে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে নিতে চাইলেন দু’হাতে।

“বললাম না তখন, ছুবেন না আমাকে। বারবার কেন এভাবে জড়াজড়ি করছেন? বিরক্ত লাগছে আপনার এসব নেকামি।”

অবাক হয়ে তাকালেন আমার কথায়। প্রচন্ড অবাকের রেশ ধরেই বলে উঠলেন,
“কি বলছিস তুই রুপু? আমি নেকামি করছি?”

“হ্যাঁ! করছেন। আপনার এই গায়ে পড়া স্বভাবটা বিরক্ত লাগছে আমার। সহ্য হচ্ছে না আপনাকে, চলে যান আমার সামনে থেকে।”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। বেশ কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে এক হাতে আমার গালে রাখলেন। নরম গলায় আস্তে করে বললেন,
“কি হয়েছে তোর রুপু? বল আমাকে। আমার তো জানার অধিকার আছে, না বললে আমি বুঝবো কিভাবে?”

“কোন অধিকার নেই আপনার, কিশোর অধিকার খাটাতে আসছেন আমার কাছে? এক্ষুনি বেরিয়ে যান এখান থেকে।”

থমকে গেলেন উনি। কিছুটা চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“রুপু….. কি বলছিস তুই এগুলো? কি করেছি আমি?”

“বিশ্বাস ভেঙেছেন আপনি আমার। আবারও নতুন করে জন্ম নেওয়া ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন আমার সাথে। অন্য কাউকে নিজের জীবনে জড়িয়ে আমার সাথে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে গেছেন কেন? আছে আপনার কাছে এর উত্তর?”

“তোর কাছে আমার ভালোবাসাটা ঠুনকো বলে মনে হচ্ছে? অভিনয় বলে মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসা তোর কাছে? এসব বলে কি বোঝাতে চাইছিস তুই আমাকে?”

“আপনি কি আসলেই বুঝতে পারছেন না, নাকি বুঝতে চাইছেন না? আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই বলছি।”

বলেই একটু থামলাম। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে দু’হাতে চোখ মুছে নিলাম। বললাম,
“আপনাকে আর আমার সাথে অভিনয় করতে হবে না, নিতে হবে না আর আমার দ্বায়িত্ব। মুক্তি দিলাম আপনাকে, আমার দ্বায়িত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি দিলাম আপনাকে। আপনি কিয়ানা আপুর সাথে নতুন ভাবে জীবন শুরু করেন, আপন করে নেন আপনার ভালোবাসার মানুষকে। আমি কখনোই আপনাদের মাঝে বাঁধা হয়ে আসবো না।”

“মাথা ঠিক আছে তোর? কি বলছিস এগুলো? আমাদের মাঝে কিয়ানার কথা আসছে কেন?”

“কেন আসছে, তাই না? সেটা তো আপনি খুব ভালো ভাবেই জানেন।”

একটু থেমে আবারও জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“কেন? কিয়ানা আপুকে এত বছর ধরে ভালোবাসার পর, তার সাথে রাতের পর রাত কাটানোর সময় মনে ছিলো না আপনার, কেন সে আমাদের মাঝে আসবে? ওও সরি, উনি কেন আমাদের মাঝে আসবে? আপনাদের মাঝে তো আমি এসেছি। ছিঃ ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে আমার, গত কয়েকদিনের আপনার ছোঁয়ায় রি রি করছে আমার শরীর। ঘৃণা হচ্ছে আপনার দেওয়া স্পর্শ গুলোর কথা ভেবে। আপনার চেহারা দেখতেও চাই না আমি, ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে আমার, আপনার প্রতিটি ছোঁয়ায় ভীষণ ভাবে ঘৃণা।”

“রূপা….”

চিৎকার করে উঠে বেশ জোরে থাপ্পড় দিলেন আমার গালে। বিছানায় ঝুঁকে গিয়ে গালে হাত রেখে জোরে করে কেঁদে উঠলাম। ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলাম,
“অবাক হলেন, তাই না? ভাবছেন এতকিছু কি ভাবে জেনে গেলাম? আপনার ভালোবাসার মানুষটিই জানিয়েছেন সবকিছু। সাথে আপনাদের দুজনের প্রতিটি রাতের ভালোবাসার স্বাক্ষী হিসেবে কিছু ছবিও দেখিয়েছেন।”

“অনেক বেশিই জেনে গেছিস, দেখিস এতকিছু জানার জন্য যেন আফসোস করতে না হয় তোকে।”

বলেই চুপ হয়ে গেলেন তাসফি ভাই। আধা মিনিটের মতো সময় নিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,
“কিয়ানা তোকে কি বলেছে বা কি দেখিয়েছে সেটা জানা নেই আমার। কিন্তু বিশ্বাস, সামান্যতম বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো আমার প্রতি। এতো ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে আমাকে ভালোবাসা উচিত হয় নি তোর, আমার ভালোবাসার ডাকে সারা দেওয়া তোর কিছুতেই উচিত হয় নি। আদোও কি কখনো ভালোবাসতে পেরেছিস আমায়? বিশ্বাসটা তোর ভাঙে নি রূপা, ভেঙেছে আমার। তোর প্রতি আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে প্রমানিত হলো, ভেঙে গেল আমার মন। ঠুনকো হয়ে গেল আমার পবিত্র ভালোবাসা।”

একটু থামলেন উনি। জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে বললেন,
“আর কখনোই পেতে হবে না আমার স্পর্শ, দেখতে হবে না আমার চেহারা। ভালো থাক আমার প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে। আর কখনোই আমার চেহারা তোকে আর দেখতে হবে না।”

কথাটা শেষ হতেই আর দাঁড়ালেন না উনি, আর না আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন। পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। একবার পিছন ফিরে তাকালেন না উনি। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই ছ্যাঁত করে উঠলো বুকে। কেমন জানি শুন্য অনুভূতিতে ছেয়ে গেল সমস্তকিছু। সহ্যশক্তি হারিয়ে মাথা এলিয়ে দিলাম বিছানায়, কানের সন্নিকটে এসে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো ওনার বলা শেষ কথাগুলো। তাহলে কি সত্যিই হারিয়ে ফেললাম ওনাকে, ওনার থেকে পাওয়া সুখানুভূতিকে? হু হু করে কেঁদে উঠলাম। মনে মনে আওরাতে লাগলাম ওনাকে বলতে না পারা কথাগুলো।
“ভালোবাসি তাসফি, অনেক বেশিই ভালোবাসি আপনাকে। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।”

.
বাইরের হালকা চেচামেচির আওয়াজে সদ্য ঘুমিয়ে পরা চোখ জোড়া মিটমিট করে খুলে ফেললাম। অতিরিক্ত কান্নার ফলে কখন চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এসেছে বুঝতেই পারি নি। ধীরে ধীরে আওয়াজটা যেন তীব্র হতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ডর মতো সময় অতিক্রম হতেই বুঝতে পারলাম আম্মু ও বড়মার গলা ভেসে আসছে। কিছু বুঝতে না পেরে হালকা মাথা ব্যাথার রেশ নিয়েই বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এখন হয়তো সন্ধ্যারাত।
এর মাঝেই বেশ শব্দ করে দরজা খুলে আম্মু ভেতরে ঢুকে গেল। কান্না করতে লাগলো কিছুটা শব্দ করেই। প্রচন্ড অবাক হলাম আমি। আম্মুকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আম্মু কান্না করতে করতে বলে উঠলো,

“তাসফি খুব বাজে ভাবে বাইক এক্সিডেন্ট করছে রূপা, ছেলেটা কি অবস্থায় আছে কিছু জানা নেই। আমার হসপিটালে যাচ্ছি, তুই সাবধানে থাকিস মা।”

আম্মুর কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলাম আমি। নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। হঠাৎই কানে ভেসে আসলো তাসফি ভাইয়ের বলা শেষ কথাটা।

‘আর কখনোই পেতে হবে না আমার স্পর্শ, দেখতে হবে না আমার চেহারা। ভালো থাক আমার প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে। আর কখনোই আমার চেহারা তোকে আর দেখতে হবে না।’

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩২ ( প্রথমাংশ )

.
“তোর ফুপি খুব কান্নাকাটি করছে, এতক্ষণে হয়তো হাসপাতালেও চলে গেছে। সামলাতে হবে ওকে, তুই সাবধানে থাকিস।”

আম্মুর কথাটা কর্ণপাত হলেও ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে। কয়েক সেকেন্ডর ব্যাবধানে যখন দরজার শব্দ হলো তখনই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলাম। খেয়াল হলো, আম্মু ঠিক কি বলে বেরিয়ে গেল। তাসফি ভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা খেয়াল হতেই চমকে উঠলাম আবারও। বার কয়েক শ্বাস টেনে নিলাম জোরে জোরে। পাশ থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়েই এক ছুটে বেরিয়ে এলাম রুম ছেড়ে।
বাইরে এসে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই ফট করে কেউ হাত টেনে ধরলো আমার। হঠাৎ হাত টেনে ধরার উৎস খুঁজে পিছন ফিরে তাকাতেই বড়মাকে নজরে এলো। ছটফট করে হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলে আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলেন বড়মা। বললেন,

“এভাবে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

“আ..আমাকে ছাড়েন বড়মা, ওনার কাছে যাবো আমি, তা..তাসফি ভাইয়া….”

“তুই গিয়ে কি করবি মা? আমরা যাচ্ছি তো, তুই বাসায়…. ”

“না, আমি…. আমি যাবো, ওনার কাছের যাবো আমি।”

আমার উত্তেজিত কণ্ঠে বলা কথায় চুপ হয়ে গেল বড়মা। আম্মুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলো হয়তো। বললো,
“আচ্ছা চল, ছটফট না করে সবসময় আমার সাথে থাকবি।”

সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালাম বড়মার কথার। সময় না নিয়ে দরজা খুলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে লাগলাম। পিছন থেকে আম্মুকে ভালোভাবে দরজা লাগিয়ে দিতে বলে বড়মাও দ্রুত পায়ে নিচে নামতে লাগলেন। গেইট পেরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই বড়মাও পাশে দাঁড়ালেন, ফট করে আবারও আমার হাতটা চেপে ধরলেন। কিছুটা সময় নিয়ে আম্মুও এসে দাঁড়ালো। একটা রিকশা থামিয়ে উঠার উদ্যোগ হতেই বেড়ে উঠলো বড়মার মোবাইল। স্ক্রিনে বড় বাবার নামটা দেখেই চট করে মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। রিসিভ করে সাথে সাথে বলে উঠলাম,

“হ্যালো বড় বাবা, উনি… উনি এখন কেমন আছে? কি হয়েছে ওনার, কতটা আঘাত পেয়েছেন?”

উত্তেজিত কণ্ঠে তাড়াতাড়ি কথা গুলো জানতে চাইলেও কোন জবাব দিলেন না বড় বাবা। অপর পাশে একেবারেই চুপ হয়ে গেল। আবারও বেশ কয়েকবার জানতে চাইলে ক্লান্তি মাখা কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠলেন,

“তাসফির অবস্থা খুব একটা ভালো নয় রে মা। মাথায় খুব বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছে, বেশ কয়েকবার বমিও করেছে। ডাক্তাররা ভালোভাবে কিছু বলতেও পারছে না। ঢাকায় নিয়ে যেতে হচ্ছে ওকে, এম্বুলেন্সে উঠে গেছি। তোরা আর হসপিটালে আসিস না।”

কেঁপে উঠলাম আমি, হাত থেকে মোবাইল পড়ে যেতে নিতেই ধরে ফেললো বড়মা। অপর হাতে আমার হাতের বাহু জড়িয়ে ধরলো। ফোন কানে নিয়ে কথা বলতে লাগলো বড় বাবার সাথে। কিন্তু কোন কথাই আমার কর্ণপাতে এসে পৌছালো না।

.
একের পর এক গাড়িকে পাল্লা দিয়ে শা শা করে ছুটে চলেছে গাড়িটা। গভীর রাতের সোনালী চাঁদের হালকা আলোয় চারদিকে আবছায়া হয়ে আছে। একটু পর পর অপজিটের গাড়িগুলোর আলো এসে বারি লাগছে চোখে। তবুও স্থির ভাবে তাকিয়ে আছি দূর প্রান্তে।
তাসফি ভাইয়াকে ঢাকায় নিয়ে যাবার পরেই আব্বু বাসায় চলে আসে। দুই ঘন্টার ব্যাবধানে সবকিছু ঠিকঠাক করে নেয়। ফুপি সহ আমাদের সাথে নিয়ে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। কান্নার ফলে সবার চোখে ঘুমের রেশ দেখা দিলেও আমার চোখে তার বিন্দুমাত্র নেই। থাকবেই বা কিভাবে? চোখ থেকে তো দু’ফোটা অশ্রুও বিসর্জন হয় নি। শুধু বারবার তাসফি ভাইয়ের সাথে হওয়া শেষ কথাগুলো এবং বিকেলে ওনাকে দেখা সেই চেহারাটাই ভেসে উঠছে চোখে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ওনার প্রতি হাজারো অভিযোগ, হাজারো ঘৃণা জমা পড়ে থাকলেও এখন নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। বারংবার মনের কোণে উকি দিচ্ছে ওনাকে সাথে এতটা বাজে ব্যবহার না করলেও পারতাম।

“রূপা… এই রূপা, এসে গেছি তো মা, নেমে আয় এখন।”

চট করে মাথা তুলে তাকালাম আব্বুর কথায়। ভাবনাগুলো ছুটে বেরিয়ে গেল আপন মনে। দাঁড়িয়ে থাকা আব্বুর পাশ দিয়ে পিছনে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম হসপিটালের সামনে। নিজের ভাবনায় এতটায় মসগুল ছিলাম যে , কখন হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি থেমেছে বুঝতেই পারি নি। সময় নষ্ট করলাম না, দ্রুত নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। এর মাঝে আম্মু, বড়মা ও ফুপিও নেমে গেছেন। আমি নেমে দাঁড়াতেই আমাদের ভেতরে যেতে লাগলো আব্বু।

.
ভোর রাত, একটু আগেই চারদিকে ফজরের আজানের প্রতিধ্বনি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। শুনশান নীরবতার মাঝেই চার তলায় এসে থামলাম। করিডোর পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বড় বাবা ও ফুপাকে নজরে এলো। তাদের দেখে হাউমাউ করে কান্না করে উঠলো ফুপি, এগিয়ে গিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো তাসফি ভাইয়ের কথা। কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বড় বাবা জানালেন, একটু আগেই ডাক্তার দেখেছেন, কিন্তু এখনো অবস্থান গতিবেগ জানায় নি।

মিনিট পাঁচেক পর সাদিক ভাইয়া আসতেই আবারও সবাই জানতে চাইলো তাসফি ভাইয়ার কথা। সহসায় কোন উত্তর দিতে পারলো না সাদিক ভাইয়া। কিছুটা সময় নিয়ে জানালো মাথায় নাকি বেশ বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছে, আঘাত পাওয়ার পর বেশ কয়েকবার বমি করায় ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে পরছে। আধা ঘন্টার মাঝেই অপারেশন শুরু হবে, সেটারই ব্যাবস্থা চলছে। আবারও হাউমাউ করে কান্না করে উঠলো ফুপি। আম্মু, বড়মাও কান্না করতে লাগলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে চুপ করতে বললো সাদিক ভাইয়া, ওনার কিছুা হবে না সেটাও বোঝালেন সবাইকে। এতকিছুর মাঝে আমি নীরব শ্রোতা হয়ে শুনে গেলাম তাদের কথা, দেখে গেলাম তাদের কর্মকাণ্ড।

.
করিডর থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। গায়ের শক্তি যেন সামান্যতমও বিরাজমান নেই গায়ে। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

“রূপা….”

হঠাৎ কিছুটা পরিচিত কণ্ঠস্বরে চমকে গেলাম কিছুটা। মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হলাম। কিন্তু কিয়ানা আপুকে দেখে অবাক হতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে। কিয়ানা আপুকে দেখে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই, তাসফি ভাইয়ের এই পরিস্থিতিতে ওনার তো এখানেই থাকার কথা।৷ যতই হোক, ভালোবাসার মানুষ তো।

“এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? তাসফির সাথে দেখা হয়েছে?”

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেই বলে উঠলো কিয়ানা আপু। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। ওনার দিকে তাকিয়ে দূর্বল কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠলাম,
“আমি আপনাদের মাঝে আসি নি কিয়ানা আপু, আপনার ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে আসি নি। ওনার এক্সিডেন্টের কথা শুনে আঁটকে রাখতে পারি নি নিজেকে।”

“তাসফির ভালোবাসা তো আমার জন্য কখনোই ছিলো না, সবকিছু তো তোমার জন্যই বরাদ্দ ছিলো। আমিই তো উচ্ছিষ্ট হয়ে তোমাদের মাঝে এসে পরেছি।”

চমকে উঠলাম আমি। কিয়ানা আপুর দিকে চোখ দুটো নিবদ্ধ করতেই টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কিয়ানা আপুর চোখ থেকে। অবাকের মাত্রা কিছুটা বেড়ে যেতেই আবারও বলে উঠলো,

“তুমি আমার অনেক ছোট, তবুও তোমাকে বলছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও রূপা, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

অবাকের মাত্রা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। কিছু না বুঝে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলাম কিয়ানা আপুর দিকে। বোঝার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম তার কথাগুলো। হঠাৎ ক্ষমা চাওয়ার সমীকরণ মেলাতে না পেরে বললাম,
“মানে? আপনি কেন আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন আপু?”

“কারণ সেদিন রাতে তোমাকে বলা আমার কথাগুলো সবটাই মিথ্যে ছিলো, সাজানো ছিলো আমার ও তাসফির ব্যাপারে সেই কথাগুলো। তাসফি আমাকে নয় তোমাকে ভালোবাসে, ওর জীবনে আমি বা অন্যকেউ নয়, তুমিই প্রথম ও শেষ নারী রূপা।”

থামকে গেলাম আমি। নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। গায়ের শক্তিটা নিমিষেই হারিয়ে গেল, পা দু’টো কেঁপে উঠতেই ধপ করে নিচে বসে গেলাম। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম কিয়ানা আপুর দিকে।

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩২ (শেষাংশ)

.
“তা..তাসফি ভাই শুধু আমায় ভালোবাসেন, ওনার জীবনে আমিই শেষ নারী? সেদিনের সবকিছুই মিথ্যে ছিলো? ওনার আর আপনার মাঝে কোন সম্পর্ক নেই?”

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিয়ানা আপু। আমার ফিরতি উত্তরের আসায় তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। কিয়ানা আপুর ছটফট করা চোখ দুটো দেখে ধুক করে উঠলো বুকে। তার নিস্তব্ধতায় নিমিষেই যেন আমার উত্তরটা পেয়ে গেলাম আমি। গতকাল সন্ধ্যা থেকে যে চোখ দুটোয় একফোঁটা জল বেরোয় নি, তাসফি ভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা শোনার পরও যে সার্থপর চোখ থেকে এক ফোঁটাও পানি বেরোয় নি, সেই চোখ থেকেই টপটপ করে অশ্রু বিসর্জন হতে লাগলো।

নিজেকে সামলে নিলাম কিছুটা। আস্তে করে বললাম,
“তাহলে ওই ছবি গুলো? ওই ছবিগুলোও কি মিথ্যে ছিলো?”

আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লে কিয়ানা আপু। বললো,
“হ্যাঁ! ওই ছবিগুলো মিথ্যে ছিলো, এডিট করা ছিলো। তাসফির সাথে ওমন কোন সম্পর্ক নেই আমার। নরমাল হাত ধরা ছাড়া তাসফি ওতটা কাছে আসা হয় নি আমার। বন্ধুত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো আমাদের সম্পর্ক।”

“চার বছর আগের সেই রাত? তাসফি ভাইয়ের আপনাকে ডাকা, আপনাকে ভালোবেসে কাছে ডাকা….”

“সবকিছুই তোমার জন্য ছিলো। তোমাকে কাছে পাবার জন্য, তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলো তাসফি। পাগলের মতো ছটফট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো, জ্বরের ঘোরে তোমাকে কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। ঠিক তখনই তোমার ফোন আসে, আর সেই সুযোগই আমি….”

“কেন করলেন এমনটা? কোন এত বড় মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাকে ওনার থেকে দূরে সরে দিতে চাইলেন? আমাদের সম্পর্কের মাঝে কেন এত বড় ফাটল ধরালেন?”

নিরুত্তর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ানা আপু। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না হয়তো। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না আমি। অপরাধীর বোঝাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো, গতকাল তাসফি ভাইকে বলা আমার প্রতিটা কথা যেন ফিরে আসতে লাগলো। উত্তরে ওনার বলা শেষ কথাগুলোও বারংবার উঁকি দিতে লাগলো।
দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এগিয়ে এলো কিয়ানা আপু, দু’হাতে আমাকে আগলে ধরার চেষ্টা করে বলে উঠলো,

“আমাকে ক্ষমা করে দিও রূপা। তাসফির কাছে কখনোই ক্ষমা পাবো না আমি, তুমি অত্যন্ত দিও। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না আমি, তাসফি কখনোই বলে নি এ বিষয়ে। অন্ধ হয়ে গেছিলাম, তাসফি কে নিজের করে পাবার জন্য পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। যার জন্য আজ বন্ধুত্বও হারিয়ে ফেললাম।”

দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিলাম কিয়ানা আপুকে। হালজা চেচিয়ে বলে উঠলাম,
“আপনার জন্য, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমি ওনাকে কষ্ট দিয়েছি, উনি আমাকে ভালোবাসেন সেটা জেনেও দূরে ঠেলে দিয়েছি। আপনার কথা গুলো বিশ্বাস করে ওনার ভালোবাসাকে আমি অসম্মান করেছি, ভালোবেসে ওনার করা প্রতিটি স্পর্শকে আমি ঘৃণা করেছি। কেন করলেন এমনটা কিয়ানা আপু? আমার ভালোবাসাকে আবেগ বলে কেন আখ্যায়িত করলেন? কি ক্ষতি করেছিলাম আমি?”

একটু থেমে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলাম। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললাম,

“এখন কেন বলছেন এসব? আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ নষ্ট করে এখন কেন বলছেন? এখন কেন এতটা মনুষ্যত্ব জেগে উঠলো আপনার মঝে?”

“আমি সত্যিই অনেক ভুল করেছি রূপা, তাসফিকে নিজের করে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি, সহ্য করতে পারতাম না ওর সাথে তোমাকে। এতকিছুর মাঝে যে আমাদের এত সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, সেই একটুও বিবেচনা করি নি আমি।”

বলেই একটু থামলো কিয়ানা আপু। একটু সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো,
“তাসফি তোমায় নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, সেটা কালকেই আমি বুঝে গেছি। তোমার জন্য আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করতেও দু’বার ভাবলো না। তখনই আমি বুঝে গেছি তাসফির জীবনে তুমি ঠিক কি। উপলব্ধি করেছিলাম আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার। তাসাফির এক্সিডেন্টের কথা শোনার পর অপরাধী সত্তা বাসা বেঁধেছিলো মনে। তোমাকে সত্যিটা বলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিললো।”

“উ..উনি আপনাকে কি বলেছেন? কি কথা হয়েছিলো আপনাদের মাঝে?”

“কালকে বিকেলের পর হঠাৎ করেই তাসফির কল আসে। হাসি মুখে কলটা রিসিভ করলেও তা নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জানতে চায় আমি কি বলেছিলাম তোমাকে। তাসফির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি আমি। ওর কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না বললে রেগে উঠে। চিৎকার করে বলে উঠে,
‘বুঝতে পারছিস না, নাকি বোঝার চেষ্টা করছিস না? কি বলেছিস তুই রূপা কে? কিসের সম্পর্ক আছে আমাদের মাঝে, কবে রাতের পর রাত কাটিয়েছি আমি তোর সাথে? সেগুলোর প্রমাণ হিসেবে কিসের ছবি দেখিয়েছিস তুই রূপা কে? কি হলো, কথা বলছিস না কেন? বল বলছি…’

চমকে উঠি তাসফির কথায়, উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে যাই। আমার চুপ থাকায় ও আবারও বলে উঠে,
‘আমার রুপু মিথ্যে বলে না কিয়ানা, ওর মনে সন্দেহ না ঢুকালে আমার ভালোবাসার অসম্মান কখনোই করবে না। কেন বলেছিস ওকে এসব কথা, কেন ওর মনে সন্দেহর বীজ বুনেছিস? কি সম্পর্ক আছে আমাদের মাঝে, কতটা গভীর সেই সম্পর্ক?’

‘তাসফি আমি… আমি তোকে ভালোবাসি। সেই কলেজ লাইফ থেকেই আমি তোকে ভালোবাসি….’

‘তোর মুখে ভালোবাসার কথা মানায় না কিয়ানা, অন্তত আমার ভালোবাসাকে ছোট করে তো নয়-ই। কি দেখিয়েছিস আমার বউকে সেটা বল। কি এমন দেখিয়েছিস যে তোর কথায় আমার বউ বিশ্বাস করে নিলো, ভুল বুঝলো আমাকে।’

তাসফির ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি। ফোনের অপর পাশ থেকেও বুঝতে পারলাম প্রচন্ড পরিমাণে রেগে আছে। তোমার প্রতি ওর এতটা ভালোবাসা আর বিশ্বাস দেখে কোন কিছুই আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না ওর কাছে। সেদিন তোমাকে বলা সমস্ত কথা স্বীকার করে নিলাম।
আমার কথা শেষ হতেই চুপ করে গেল তাসফি। ফোনের মাঝে ওর জোরে জোরে নিশ্বাস নেওয়ার শব্দটায় শুধু কানে ভেসে আসলো। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,
‘তোকে আমি বিশ্বাস করতাম কিয়ানা, অনেক কাছের বন্ধু মনে করতাম, কিন্তু আজকের পর থেকে তোর সাথে আমার সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও থাকলো না। আজকের দিনে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না আমার সাথে। আমার আর আমার ভালোবাসার মাঝে আসার চেষ্টাও করবি না।’

এক মুহুর্ত সময় না নিয়েই কল কেটে দিলো তাসফি। কিছু সময় পর যখন বুঝতে পারলাম কল কেটে দিয়েছে তখন আবারও ফোন দিলাম তাসফি কে, কিন্তু ঢুকলো না। বুঝতে পারলাম ব্লক করে দিয়েছে। চেষ্টা করেও ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না, ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও পেলাম আমি। তাসফির এক্সিডেন্টে কথা শুনে আর ধরে রাখতে পারি নি নিজেকে, তাসফির জন্য না হলেও তোমার জন্য ছুটে এসেছি। তোমাকে সত্যিটা বলার জন্য, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও রূপা।”

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিয়ানা আপুর দিকে তাকিয়ে। কান্নার মাত্রাটা যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে লাগলো, এই মুহুর্তে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে গেল আমার জন্য। অপরাধের মাত্রাটা শতগুণে বেড়ে যেতে লাগলো। কি ভাবে পারলাম আমি ওনাকে অবিশ্বাস করতে, ওনার ভালোবাসাকে অসম্মান করতে? এতকিছু বলার পরেও যে মানুষটা আমাকে প্রতি বিশ্বাস হারায় নি, তার প্রতি কেন বিশ্বাস রাখতে পারলাম না আমি?
অপরাধী সত্তাটা ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে উঠলো যেন, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। এগিয়ে আসলো কিয়ানা আপু, আমাকে সামলানোর চেষ্টা করতেই দু’হাতে আবারও ছাড়িয়ে নিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম,

“একদম দয়া দেখাতে আসবেন না, অনেক করেছেন আমার জন্য। অনেক বড় উপকার করেছেন আমাকে সত্যিটা বলে, কিন্তু সবকিছু শেষ হবার পর। আর কিছু করতে হবে না আপনার, কিছু করতে হবে না।”

দু’হাতে চোখের অশ্রুগুলো মোছার বৃথা চেষ্টা করলাম। নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম সেখান থেকে। টলটলে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম করিডর পেরিয়ে।

বেলা বারার সাথে সাথে হসপিটালে মানুষের আনাগোনাও বেড়ে যাচ্ছে। কারোর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম অনেকেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু কোন দিকেই পাত্তা দিলাম না। পরিবারের সবার সামনে এসে না দাঁড়াতেই সাদিক ভাইয়া এসে উপস্থিত হলো সেখানে, সাথে এলো আরও একজন ডক্টর। ভাইয়াকে দেখে গায়ে কিছুটা শক্তি জোগাড় হলো যেন, দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলাম সেখানে। কাউকে বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলাম,

“ভাইয়া উনি… উনি এখন কেমন আছেন? ঠিক আছেন তো উনি, অপারেশন ঠিক ভাবে হয়েছে তো? কি হলো কথা বলছেন না কেন? ওনার কিছু হয় নি তো?”

সবাই একই প্রশ্নের উত্তরের আসায় তাকিয়ে রইলো সাদিক ভাইয়া ও অপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে। কোন কথায় বললো না সাদিক ভাইয়া। কিছুটা সময় নীরবতায় থেকে ডাক্তারটি বলে উঠলো,

“আমরা আমাদের বেস্ট দিয়ে চেষ্টা করেছি, বাকিটা আল্লাহর হাতে। মি. তাসরিফের কন্ডিশন খুবই খারাপ ছিলো, মারাত্মক ভাবে হাতে, পায়ে ও মাথায় আঘাত পেয়েছে। এতটাও সেনসিটিভ অবস্থা হতো না, যদি বমি না হতো আর বমি হওয়ার পর জ্ঞান না হারাতো। অপারেশন তো সাকসেসফুল হয়েছে, কিন্তু ঠিক কতটা সাকসেস হয়েছে সেটা ৭২ ঘন্টা পরেই বুঝতে পারবো।”

সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলো। বড় বাবা বললো,
“তাসফি কি ঠিক আছে ডক্টর?”

“কতটা ঠিক আছে সেটা বলা মুশকিল। মাথায় যেভাবে আঘাত পেয়েছে, জ্ঞান যদি ফিরেও আসে তাহলে অতীতের কোন কিছুই হয়তো আর মনে থাকবে না, আমরা সেটাই আশঙ্কা করছি। আর যদি….”

চুপ হয়ে গেল ডাক্তারটি। মাথা ঘুরিয়ে তাকালো সাদিক ভাইয়ার দিকে। সাদিক ভাইয়া চোখ ফিরিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। ফুপা বলে উঠলো,
“যদি কি ডক্টর?”

“যদি ৭২ ঘন্টা পর, মানে তিন দিন পর এই সময়টায় সকাল আটটার মধ্যে জ্ঞান না ফিরে তাহলে আর জ্ঞান ফেরার সম্ভবনাও নেই। আমাদের আর কিছুই করার নেই, সবটাই উপর আল্লার হাতে। আল্লাহকে ডাকুন, বাকিটা তার ইচ্ছে।”

কথাগুলো শোনার পর আমার শিরদাঁড়া বেয়ে হালকা শীতল ভাব বেরিয়ে গেল। কথাগুলো মস্তিষ্কে ধারণ করতেই কিছুক্ষণের জন্য আমার মস্তিষ্কগুলো কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেল। গায়ের শক্তি নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন দায় হয়ে পড়লো আমার জন্য। গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত ক্লান্তি ঘিরে ধরলো আমাকে। হঠাৎই ঝাপসা হয়ে উঠলো চোখের সামনে। তবুও ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট সুরে বলার চেষ্টা করলাম,

“কিছু হবে না ওনার, কিছু হবে না। ওনার কিছু হলে ক্ষমা করতে পারবো না আমি নিজেকে, বাঁচতে পারবো না আমি ওনাকে ছাড়া। কিছু হবে না ওনার, কিছু না….”

.
.
চলবে…..