#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৫.
.
‘বিষন্ন বিকেলে আসন্ন রাত
অন্ধকারে ঢাকা মোর প্রসন্ন প্রভাত।’ লাইন দু’টোর সাথে আমার জীবনের গতিধারা একইভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। গত কয়েক দিনে অধিক ভাবে বিষন্ন মনটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে আমার। বিষন্নতায় কেটে গেছে আরও পাঁচ দিন। তাসফি ভাইয়ের সেদিনের কথা শোনার পর আর একমুহূর্তের জন্যও ওনার সামনে আসি নি, কারোর সাথে ঠিকভাবে কথাও বলি নি। ফুপি কি হয়েছে জানতে চাইলেও এটা ওটা বলে কাটিয়ে দিয়েছি।
অন্ধকারাচ্ছন্ন একাকী বন্ধ রুমে অনুভূতি শুন্য হয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। অসংখ্য বার শুধু ওনার বলা, ‘তোমার প্রতি আমার সমস্ত অনুভূতির মৃত্যু হোক রুপু!’ কথাটা কানে এসে ধাক্কা লেগেছে। উনি কি কথাটা মন থেকে বলেছেন, নাকি রাগের বসে আমার প্রতি অভিমানের পাল্লাটা ভারী করে বলেছেন? জানা নেই এর উত্তর। শুধু এতটুকু জানি মানুষটা আমায় ভেঙে দিয়েছেন, খুব করে ভেঙে দিয়েছেন আমার অবুঝ মন। জানা নেই, আমার প্রতি তাসফি ভাইয়ের সুপ্ত অনুভূতি গুলো সত্যিই হারিয়ে যাবে কি-না? কিন্তু আমি এবার হারিয়ে যেতে চাই। ঠিক চার বছর আগের মতোই ওনার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাই। দমবন্ধকর পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্তি করে নিতে চাই।
ফুপির ডাকে নিজ ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম যেন। দূর্বল শরীরে উঠে দাঁড়ালাম বিছানা ছেড়ে। গত কয়েক দিনে একই ভাবে ঘরকুনো হয়ে রয়েছি। প্রয়োজন ব্যাতিত বাইরে যাই নি, খাওয়া দাওয়ার প্রতিও ব্যাপক অনিহা হয়ে উঠেছে। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে কিছু খেলেই বমি করে সবকিছু বেরিয়ে আসছে।
দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এতক্ষণে হয়তো সকলের খাওয়াও হয়ে গেছে। আমি যাই নি বলেই ফুপি এতটা ডাকাডাকি করে চলেছে। বিছানা থেকে দরজার কাছে আসলাম। হঠাৎই চারদিকে কেমন জানি ঘুড়ে উঠলো। দরজায় হাত রেখে সামলে নিলাম নিজেকে, চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম মিনিট দুয়েক। আবারও ফুপির ডাক ভেসে এলো নিচ থেকে। সামলে নিলাম নিজেকে, স্বাভাবিক হয়ে নিচে নেমে গেলাম।
.
“আমি বাসায় যাবো ফুপা, অনেক দিন তো হলো এখানে থাকলাম।”
“সে কি, হঠাৎ কেন যেতে চাও মামুনি? কিছু হয়েছে? তোমাকে দেখেও কেমন জানি লাগছে, সব ঠিক আছে তো?”
দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। এই মানুষগুলো কে মিথ্যে বলতে পারি না আমি, লুকাতে পারি না কোন কথা। ফুপিও ঠিক একইভাবে গত কয়েকদিন জিজ্ঞেস করেছে আমাকে, জানতে চেয়েছে ঠিক কি হয়েছে। কোন রকম ভাবে এড়িয়ে গেছি। ফুপার কথায় মাথা তুলে তাকালাম। আস্তে করে বললাম,
“অনেকদিন তো থাকলাম, সারাদিন বাসায় থাকতে ভালোও লাগে না। তাছাড়া পড়াশোনাও হচ্ছে না।”
“তাহলে চলো মামুনি, আজকে সবাই বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তাসফি তো এখন প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে।”
আমি কিছু বলার আগেই ফুপি বলে উঠলো,
“তোর ফুপা ঠিক কথায় বলেছে রূপা। এতদিন ছেলেটার জন্য ঠিকভাবে কাজেও মন বসাতে পারি নি। তাসফি তো এখন সুস্থ, এবার একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যেতেই পারে।
“কি ব্যাপার আম্মু, হঠাৎ কোথায় যাবার প্ল্যান হচ্ছে?”
হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, টিপটিপ করে উঠলো বুকে। তাসফি ভাইয়ের হঠাৎ আগমন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো আমার জন্য। আমার পাশের চেয়ারে বসায় আরেক দফা অবাক হলাম। এটা কি ওনার ইচ্ছাকৃত ছিলো, নাকি বেখেয়ালি হয়ে? ঠিক ধরতে পারলাম না। ফুপি বলে উঠলো,
“রূপা বাসায় চলে যেতে চাইছে, সারাদিন বাসায় থেকে ওর নাকি ভালো লাগে না। তাই আমরা বলছি বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসলে ভালো লাগবে। এই বন্ধী জীবনে আমারও ভালো লাগে না, ও তো ছেলে মানুষ।”
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, এতক্ষণে হয়তো খেয়াল করলেন আমাকে। কিছু না বলে চুপচাপ টেবিল থেকে খাবার নিতে লাগলেন নিজের প্লেটে। ওনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম ওনার কর্মকাণ্ড। এতক্ষণ দুই একবার যেটাও খেতে পেরেছি, ওনার পাশে বাসায় সেটাও মিলিয়ে গেল যেন। গ্লাস থেকে পানি খেয়ে উঠতে নিলাম টেবিল ছেড়ে। আমাকে উঠতে দেখে ফুপি বলে উঠলো,
“কি হলো? খাবার ছেড়ে উঠছিস কেন?”
“আর খাবো না ফুপি, পেট ভরে গেছে।”
ফুপা চট করে বলে উঠলো,
“পেট ভরে গেছে মানে? কিছুই তো খেলে না মামুনি। প্রতিদিন দেখছি ঠিকঠাক ভাবে খাচ্ছো না, খাবারের প্রতি অনিহা দেখাচ্ছো।”
“এখন আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না ফুপা, পরে খেয়ে নিবো নি। তোমরা চিন্তা করো না।”
বলেই উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার ছেড়ে। উঠতেই কেমন জানি চক্কর দিয়ে উঠলো মাথাটা। এক হাতে চেয়ার ধরে সামলে নিলাম নিজেকে। সেকেন্ডের মতো চোখ বন্ধ করে খুলে ফেললাম। দু’দিন থেকেই হুটহাট মাথা ঘুরে উঠছে, কিন্তু আজকে কেন জানি বেশিই বলে মনে হচ্ছে। কোনরকম ভাবে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে, কিন্তু দুই পা এগিয়ে যেতেই আর এগোতে পারলাম না। হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসলে চোখের সামনে, ঘুরতে লাগলো চারদিকে। হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করেও হাতের নাগালে কিছুই পেলাম না। ধীরে ধীরে অন্ধকার ভর করলো চোখে, নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে না পেরে লুটিয়ে পড়লাম নিচে।
.
দূর্বল শরীরে মিটমিটিয়ে চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করতেই অস্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠলো কারোর কণ্ঠস্বর। শরীরে কিঞ্চিৎ ব্যাথা নিয়ে নড়েচড়ে উঠলাম কিছুটা। চোখ দুটো আস্তে করে খুলতেই ভেসে উঠলো তাসফি ভাইয়ার চেহারা। ওনাকে এতটা কাছে দেখে ভরকে গেলাম কিছু। তড়িৎগতিতে চোখ দু’টো শব্দ করেই খুলে ফেললাম। কিন্তু না, আগের মতোই ওনার চেহারা ভেসে উঠলো। প্রচন্ড অবাক হলাম, তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিলে বাঁধা পেলাম হাতে। তাসফি ভাই শক্ত করে হাত ধরে আছেন। আরেক দফা অবাক হলাম। আধ শোয়া হয়ে বসে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম।
“আরে আরে ধীরে উঠে, এত হাইপার হওয়ার কি আছে শালিকা।”
সাদিক ভাইয়ার কণ্ঠে ফিরে তাকালাম সেদিকে। এতক্ষণে ফুপা ফুপিকেও নজরে এলো। বুঝতে পারলাম হঠাৎ জ্ঞান হারানোর ফলেই সাদিক ভাইয়ার আগমন। আবারও বললো,
“এখন কেমন লাগছে রূপা?”
“একটু ভালো লাগছে।”
“আচ্ছা! এখন যেটা বলবো ঠিকঠাক উত্তর দিবে কিন্তু।”
ভাইয়ার কথায় মাথা ঝাঁকালাম, বোঝালাম বলবো। সাদিক ভাইয়া বলে উঠলো,
“কতদিন থেকে এমন হুটহাট মাথা ঘুরে উঠছে?”
“গত কয়েকদিন থেকে।”
“এর মাঝে কি বমি হয়ছিলো?”
আবারও মাথা ঝাঁকালাম আমি। বললাম হ্যাঁ! আমার কথায় দীর্ঘ শ্বাস ফেললো ভাইয়া। একটু সময় নিয়ে বলে উঠলো,
“গত মাসে পিরিয়ড মিস গেছে?”
আচমকা প্রশ্নে চমকে উঠলাম কিছুটা, লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ এই প্রশ্নের কারণ কি। চুপ করে থাকায় সাদিক ভাইয়া বললো,
“এতটা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই রূপা। বড় ভাই নয়, এজ এ ডক্টর হিসেবে বলতে পারো। এসব বিষয়ে এতটা লজ্জা পেতে নেই।”
ভাইয়ার কথায় স্বাভাবিক হলাম কিছুটা। সত্যিই তো, এসব বিষয়ে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? মাথা ঘুরিয়ে ফুপির দিকে তাকালাম। ফুপিও বুঝালো বলার জন্য। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। সেদিন কিয়ানা আপুর বলা কথাগুলো, সাথে তাসফি ভাইয়ের এক্সিডেন্ট মিলিয়ে এত এত ঝামেলায় গত দু’ মাসে পিরিয়ড মিস হবার কথাটায় যে মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছে। আস্তে করে বললাম,
“হু! মিস গেছে, আমার তো খেয়াল ছিলো না।”
সাথে সাথে ধরে রাখা হাতটা খামচে ধরলো তাসফি ভাই, মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে। মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে, অদ্ভুত চোখে চোখ দুটো নিবদ্ধ করে রেখেছেন আমার দিকে। আমার কথা শেষ হতেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল ফুপা। ফুপির চলে গেল পিছন পিছন। উঠে দাঁড়ালো সাদিক ভাইয়া। আস্তে করে বললো,
“যেটা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই তাসফি। তবুও কালকে হসপিটালে নিয়ে ওর টেস্ট গুলো করিয়ে নিবো নি। তোরা কথা বল, আমি নিচে আছি।”
বলেই রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেল সাদিক ভাইয়া। এতক্ষণ বলা ভাইয়ার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি। কি হয়েছে আমার? আর কি-ই বা সন্দেহ করছে? সাদিক ভাইয়ার কথাগুলো যখন ভাবনায় মেলাতে ব্যস্ত তখনই আমার ভাবনার সুতো কেটে দিলেন তাসফি ভাইয়া। বললেন,
“সেদিন মেডিসিন গুলো নিয়েছিলি?”
তাকালাম ওনার দিকে। বুঝতে পারলাম না ঠিক কিসের মেডিসিনের কথা বলছেন উনি। মিনিট দুয়েক একই ভাবে তাকিয়ে থাকার পরও যখন আমার উত্তর পেল না। তখন ধমকে উঠে বললেন,
“কথা বলছিস না কেন? বেয়াদব! সেদিন মেডিসিন গুলো নিয়েছিলি কি না, বলতে পারছিস না?”
“কিক্…কিসের মেডিসিন নেওয়ার কথা বলছেন?”
জোরে করে শ্বাস টেনে নিলেন উনি, স্বাভাবিক করলেন নিজেকে। বললেন,
“রিফার বিয়ের দু’দিন আগে যে মেডিসিন গুলো তোকে দিয়েছিলাম, সেগুলো খেয়েছিলি?”
চমকে উঠলাম কিছুটা, মনে পড়লো রিফাপুর বিয়ের কয়েক দিন আগের কথা। অনেক গুলো গিফটের সাথে কিছু ওষুধও দিয়েছিলেন উনি, বলেছিলেন এখনি খেয়ে নিতে। কিন্তু তারপর কিছু একটা করার ওষুধগুলো তো আমি খাই নি। কোথায় যেন রেখেছিলাম সেটাও ঠিক মনে নেই। আস্তে করে বললাম,
“ম..মনে ছিলো না খাওয়ার কথা।”
“মনে ছিলো না…. কেন মনে ছিলো না? বাকি সবকিছু মনে ছিলো। চার বছর আগের সব কথা মনে ছিলো, তাহলে সামান্য এই মেডিসিন খাওয়ার কথা কেন মনে ছিলো না? তোর জন্য সব সমস্যা আমাকেই কেন ফেস করতে হয়? কিভাবে সামলাবো এখন আমি এই পরিস্থিতিটা?”
“কিক্… কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে বুঝতে পারছিস না? সেদিনের মেডিসিন গুলো কিসের ছিলো বুঝতে পারছিস না? বাচ্চার ব্যাপারটা বাসার সবাই কিভাবে নিবে, বুঝতে পারছিস? এই পরিস্থিতিতে সবকিছু সামলাবো কিভাবে আমি?”
“ব্…বাচ্চা মানে….”
“হ্যাঁ! বাচ্চা। আমার অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে তোর মাঝে।”
চমকে উঠলাম আমি, হাত দুটো সাথে সাথে চলে গেল পেটে। নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। ক্রমশই ছলছল করে উঠলো চোখ দু’টো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। আনন্দ অশ্রু। প্রথম বার মা হওয়ার আনন্দ।
ছলছল চোখে তাকালাম তাসফি ভাইয়ের দিকে। এতক্ষণে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন উনি। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলেন। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“এমনটা না করলেই পারতে। আমাকে আবারও কঠিন পরীক্ষার মধ্যে না ফেললেই পারতে রুপু।”
বলেই উঠে দাঁড়ালেন বিছানা ছেড়ে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন রুম ছেড়ে। উনি যেতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো চোখ থেকে। এক মুঠো সুখের দেখা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেঁকে ধরলো মনে। একদিকে মা হওয়ার তীব্র আনন্দ ও অনুভূতি, অপর দিকে তাসফি নামক মানুষটাকে আবারও কাছে পাওয়ার এক মুঠো সুখ।
.
.
চলবে…..
#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৬.
.
হঠাৎ নিচ থেকে বেশ জোরে চিৎকারের আওয়াজে অবাক হলাম। কি বলছে বুঝতে না পারলেও ফুপার আওয়াজ বেশ জোরেই ভেসে আসছে। তীব্র উত্তেজনা নিয়ে দূর্বল শরীরে নেমে দাঁড়ালাম বিছানা ছেড়ে। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই আরও স্পষ্ট হলো ফুপার কথা। নিচে নেমে আসতেই বুঝতে পারলাম এতক্ষণের চিৎকার চেচামেচি সবটাই তাসফি ভাইয়ের উপর। তার কারণটা যে আমি আর আমার এই পরিস্থিতি সেটাও এতক্ষণে ক্লিয়ার হয়ে গেল।
নিচে নেমে দাঁড়াতেই ড্রয়িং রুমে সবাইকে চোখে পড়লো। সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছেন তাসফি ভাই, ওনার সামনে দাঁড়িয়ে বিরতিহীন ভাবে বকে চলেছেন ফুপা।
“এমন একটা কাজ কিভাবে করতে পারলি তুই তাসফি? ভাইকে আমি কি জবাব দিবো? যে ভয়টার জন্য তোকে দেশের বাইরে পাঠানো হলো, ঠিক সেই ভুলটায় তুই করলি। কতটুকু বয়সই বা হয়েছে রূপার, বাচ্চা মেয়েটা তার নিজের মাঝে বেড়ে ওঠা আরেকটা বাচ্চাকে কিভাবে সামলাবে?”
একটু থামলো, জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“আর তোদের বিয়ে? তোদের বিয়েটাও তো রেজিস্ট্রি হয় নি, বাইরের কেউ তো জানে না তোদের বিয়ের কথা। ভাইয়ের কানে কথাটা গেলে কি রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারছিস? কিভাবে জানাবো আমি কথাটা….”
আমাকে দেখেই থেমে গেলেন ফুপা। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে মাথায় হাত রেখে বসে পড়লেন সোফায়। তারমানে তাসফি ভাইয়া এই পরিস্থিতির কথাই বলছিলেন? এর দায় ভার যে পুরোটাই ওনার উপরে এসে পরবে এটাও উনি জানতেন। বড় বাবা কথাটা জানার পর কিভাবে রিয়াক্ট করবে? হয়তো ফুপার থেকেও বেশি রাগারাগি করবে। ভাবতে হু হু করে কেঁদে উঠলো ভেতরটা। ফুপি এগিয়ে এলো আমার কাছে। বললো,
“এই অবস্থায় নিচে এসেছিস কেন? শরীরটা আরও খারাপ করবে তো।”
“আমি ঠিক আছি ফুপি।”
আবারও নীরবতায় ছেয়ে গেল। কেউ কিছু নলার মতো খুঁজে পেলো না হয়তো। মিনিট পাঁচেক পর সাদিক ভাইয়া বলে উঠলো,
“আপনি টেনশন নিবেন না ফুপা, বাবার সাথে আমি কথা বলছি। যা হয়েছে সেটা তো আর বদলানো যাবে না। কালকে ওর টেস্ট গুলো করে নেই, তারপর আমি বাবার সাথে কথা বলছি…”
“তুমি আগে ভাইয়ের সাথে কথা বলো বাবা, জানিয়ে দাও সবকিছু।”
সায় জানালো সাদিক ভাইয়া। বড় বাবাকে সবটা বুঝিয়ে বলবে সেটাও জানালো। আগামীকাল আমাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে বললো। সবার থেকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। একটু পর ফুপাও চলে গেল রুমে, পিছন পিছন ফুপিও চলে গেল। একইভাবে মাথা নিচু করে বসে রইলেন তাসফি ভাই। এতক্ষণে একটা কথাও মুখ ফুটে উচ্চারণ করেন নি, আর না কারোর দিকে তাকিয়েছেন।
.
দুরুদুরু বুক সিঁড়ি বেয়ে এক পা নিচে নামছি তো দু’ পা উপরে উঠছি। সন্ধ্যার আগে আব্বু ও বড় বাবা বাসায় এসে পৌঁছেছে। সকালে করা টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে সাদিক ভাইয়াও এসেছে অনেক আগেই। বসার রুমে এখন কি চলছে জানা নেই আমার, একটু পর পর ভারী কণ্ঠে ফুপার কথা ভেসে আসছে শুধু। মিনিট দশেক অতিক্রম হবার পর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে নেমে আসলাম নিচে। বসার রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই শুনতে পেলাম আব্বুর কণ্ঠ।
“ভুল যখন হয়েই গেছে, তাহলে এর একটা সমাধান তো করতেই হবে। এত ভাবা ভাবি করে তো লাভ নেই ভাই। আমি বলি কি, রেজিস্ট্রি করে ওদের বিয়েটা করে দিলেই তো হয়।”
আব্বুর কথার প্রতিত্তোরে ফুপা বলে উঠলো,
“কতটুকুই বা বয়স ওর? বাচ্চা একটা মেয়ে, এই পরিস্থিতিতে সামলাবে কিভাবে নিজেকে?”
“উনিশ পেরিয়ে বিশ বছরে পা দিবে, যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাছাড়া তাসফির একার দোষ তো নেই, রূপারও যথেষ্ট হাত আছে এতে।”
আবারও চুপ হয়ে গেল সবাই। এবার নীরবতাকে ভঙ্গ করে বড় বাবা বললেন,
“হ্যাঁ! তুই ঠিক কথায় বলেছিস। এছাড়া তো আর কোন উপায় দেখছি না। আর তাছাড়া যা হবার তো হয়েই গেছে। তার চেয়ে বরং যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের করাই ভালো।”
বুকের টিপটিপ শব্দটা ক্রমশ্যই বেড়ে যেতে লাগলো। তাসফি ভাইকে নিজের করে পাবার কথা ভাবতেই অদ্ভুত এক অনুভূতির বাসা বাঁধলো মনে। ফুপা বললেন,
“তাহলে আর কি, তোমরা যখন বলছো সেখানে আমার আর বলার কিছু নেই। তাড়াতাড়ি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করো।”
“আমি করতে পারবো না এই বিয়ে।”
চমকে উঠলাম তাসফি ভাইয়ের বলা কথায়। কম্পন সৃষ্টি হতে লাগলো হঠাৎই। বিয়ে করতে পারবেন না মানে? হঠাৎ কেন বলছে এই কথা। কথাটা ভেবে তীব্র উত্তেজনা নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ওনার দিকে। বড় বাবা বলে উঠলেন,
“বিয়ে করতে পারবি না মানে? কি বলছিস তুই তাসফি?”
“হ্যাঁ! এই বিয়েটা আমি করতে পারবো না।”
প্রচন্ড রাগে চিৎকার করে উঠলেন ফুপা। তাসফি ভাইকে বললেন,
“পারবি না মানে কি তাসফি? এতকিছুর পর এখন বলছিস বিয়ে করতে পারবি না? বাচ্চার দ্বায়িত্ব থেকে পিছে হেঁটে যেতে চাইছিস?”
“হ্যাঁ! চাইছি। কারণ বাচ্চাটা আমার একার দ্বায়িত্ব হলেও বিয়েটা নয়। তোমাদের মেয়ে কি চায় সেটা জানতে চাইছো? শুনেছো এই বিয়ে তে ওর মত আছে কি না? তোমাদের মেয়েই যখন আমার সাথে থাকতে চায় না, সেখানে বিয়ের কথাটা আসছে কেন? করতে চাই না আমি এই বিয়ে।”
“তাসফিইই… এগুলো কি বলছিস তুই? রূপা তোর সাথে থাকতে চায় না মানে? কি হলো তাসফি….”
হনহন করে বেরিয়ে গেলন উনি বসার ঘর ছেড়ে। করোর কথায় কানে নিলেন না। আঁটকে রাখা চোখের অশ্রু গুলো গড়িয়ে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে। সেদিনের কথাগুলো মনে রেখে এখনো রাগ, অভিমান পুষে রেখেছেন মনে।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওনার যাওয়ার দিকে। আমাকে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলো আব্বু। বললো কাছে আসতে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিলো আব্বু। আস্তে করে বললো,
“তাসফি এসব কি বলে গেল মা? তুই কি সত্যিই ওর সাথে থাকতে চাস না, করতে চাস না বিয়েটা? না-কি তোদের মাঝে কিছু হয়েছে মা? বল আমাকে।”
উত্তরের আসায় তাকিয়ে রইলো আব্বু। এতদিন পর আপনজনের একটুখানি ভরসাযুক্ত কথায় আর সামলাতে পারলাম না যেন। এক হাতে জড়িয়ে ধরলাম আব্বুকে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বিচলিত হয়ে গেল আব্বু। আমাকে শান্ত করার প্রয়াশ চালিয়ে বললো,
“শান্ত হ মা, কি হলো হঠাৎ? তুই কি সত্যিই চাস না বিয়েরা হোক?”
“উনি আমার প্রতি ভীষণ রেগে আছে আব্বু, ভীষণ রেগে আছে। সবটাই উনি আমার প্রতি অভিমান নিয়ে রাগ করে বলেছেন। আমি তো চাই ওনাকে, এই বিয়েটা হোক সেটা তো চাই আমি। কিন্তু উনি….”
“চিন্তা করিস না মা, বিয়েটা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন রাগ করে এতকিছু বলছে, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না আমি। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেলাম শুধু। বেশ কিছুটা সময় অতিক্রম হবার পর আব্বু, বড় বাবা, সাদিক ভাইয়া, ফুপা ফুপিরা নিজের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন বিয়ের ব্যাপারে। এতক্ষণে আমিও কিছুটা শান্ত হয়ে এলাম, আগের মতোই আব্বুকে জড়িয়ে ধরলো চুপ করে রইলাম। জানি না সামনে কি হতে চলেছে। তবে যাই হোক না কেন, তাসফি ভাইয়ের অভিমান আমাকে ভাগাতেই হবে। সেটা বিয়ের আগে হোক বা পরে। এখন তো আর আমি একা নয়, ওনার অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে আমার মাঝে। ভেবেই এক প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল মনে।
.
শব্দবিহীন পায়ে ঘরে ঢুকেই ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে বাসে থাকা তাসফি ভাই কে দেখতে পেলাম। দরজাটা আলগোছে ভিরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলাম ওনার কাছে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসে পরলাম ওনার পাশে। তাকালেন না উনি আমার দিকে, মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। আস্তে করে বললাম,
“কি হয়েছে আপনার? বিয়েটা কেন করতে চাইছেন না আপনি?”
সহসায় কিছু বললেন না উনি। কিছুটা সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে বললেন,
“মুক্তি দিতে চাই তোকে। আমার ভালোবাসা নামক দ্বায়িত্ব থেকে মুক্ত করে নিতে চাই নিজেকে।”
“প্লিজ! আমাকে ক্ষমা করে দেন তাসফি ভাইয়া। আমি সত্যিই ইচ্ছে করে কথাগুলো বলি নি আপনাকে। সেদিন রাগের বসে…. ”
“তোর রাগের বসে বলা কথাগুলো আমার ভালোবাসায় আঘাত এনেছে, বিশ্বাস ভেঙেছে আমার। চাইলেও তো সেই কথাগুলো আমি ভুলতে পারবো না।”
“আমি তো বলছি আমি ভুল করেছি। অন্য কারোর কথায় আপনাকে এভাবে অবিশ্বাস করা উচিত হয় নি আমার। প্লিজ! আগের কথাগুলো ভুলে যান তাসফি ভাই। আমাদের অনাগত সন্তান নিয়ে নতুন ভাবে সবকিছু শুরু করেন।”
মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন উনি। বললেন,
“চাইলেই কি সবকিছু ভুলে যাওয়া যায়? তুই কি পেরেছিলি গত চার বছর আমার ব্যাপারে সব ভুল ধারণাগুলো ভুলে যেতে। কিয়ানার বলা মিথ্যে কথাগুলো শোনার পর আমার প্রতি ঘৃণা করা ভুলে যেতে পেরেছিলি? কি হলো, কথা বলছিস না কেন? বল, ভুলে যেতে পেরেছিলি কি?”
“না….”
“তাহলে ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওনা আঘাত গুলো আমি কিভাবে ভুলে যাবো রূপা?”
“তাহলে আপনি কি সত্যিই এই বিয়েটা করতে চান না?”
উত্তর দিলেন না উনি। আবারও আগের মতো মাথা নিচু করলেন। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বললেন,
“না….”
টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি হলো বুকে, ক্রমশ্য চিনচিনে এক ব্যাথার সৃষ্টি হলো যেন। জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে নিলাম বার কয়েক। উঠে দাঁড়ালাম ওনার সামনে থেকে। আস্তে করে বললাম,
“আচ্ছা বেশ, বিয়েটা করতে হবে না আপনার। যার জন্য আপনাকে সবাই এতটা চাপ দিচ্ছে তাকেও আসতে হবে না। আমি সবাইকে বলে ওকে….”
শেষ করতে পারলাম না কথাটা। মুহুর্তেই সর্বশক্তি দিয়ে ঠাস করে থাপ্পড় দিলেন আমাকে। নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে গেলাম নিচে। গালের তীব্র চিনচিনে ব্যাথায় কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ। চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“কথাটা একদম মাথায় আনার চেষ্টা করবি না। তোর সাহস কি করে হলো এই কথাটা বলার? আমার সন্তানকে নিয়ে এমনটা ভাবার সাহস কিভাবে হলো তোর?”
থামলেন উনি। মাথার চুল এক হাতে খামচে ধরে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। আবারও একই ভাবে বলে উঠলেন,
“ও আমার বাচ্চা আমার অস্তিত্ব, তোর কোন রাইট নেই ওকে কিছু করার। তোর দ্বায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছি বলে এটা ভাবিস না আমার সন্তানকেও আমি ভুলে যাবো। ও আমার দ্বায়িত্ব, আমার ভালোবাসার অস্তিত্ব। কথাটা মাথায় রাখিস।”
.
.
চলবে…..
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤