#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
অন্তিম পর্ব.
.
সময়ের গতিবেগে হারিয়ে যায় জীবনের একাংশ, রেখে যায় শুধু স্মৃতি গুলো। নতুন করে প্রাপ্তির তালিকায় যুক্ত হয় জীবনের নতুন সূচনা। যেটা আঁকড়ে ধরে মানুষ বাঁচে, শুরু করে জীবনের নতুন উদ্যোগে পথচলা। কিন্তু আমি? আমি কি এর একাংশও পেয়েছি? হ্যাঁ! অতীতের সবকিছুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি, তাসফি নামক মানুষটার হাত ধরে পারি দিয়েছি জীবনের অর্ধেক পথ। যে মানুষটা নিজের সবকিছু উজার করে দিয়েছে, পাগলের মতো ভালোবেসে গেছে আমাকে। কিন্তু তাকেই আমি ভুল বুঝেছি, বারংবার দূরে ঠেলে দিয়েছি সেই মানুষটাকে।
হঠাৎ পিছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরায় ভাবনার ছেদ কাটলো। কিন্তু চমকালাম না, অবাকও হলাম না বিন্দু পরিমাণ। শুধু হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে, বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
“এতো ভাবুক হয়ে বউটা কি আমার কথায় ভাবে?”
ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম না ওনাকে। একই ভাবে সোনালি চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ হওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বলে উঠলাম,
“উহুঁ! আপনার কথা ভাবতে যাবো কেন? আমি তো আমার বজ্জাত তাসফি’র কথা ভাবছি।”
“তা বজ্জাত তাসফি’র কথা কি ভাবছিলেন?”
“আপনাকে কেন বলবো? ঘরের কথা বাইরের মানুষকে বলতে নেই।”
“ওও আচ্ছা! তাই তো। আমিও এখন আমার বউকে আদর করবো, আপনি একদম বাঁধা দিতে পারবেন না।”
বলেই হাতের বাঁধনটা শক্ত হলো ওনার। বেনি করা চুলটা সরিয়ে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলেন। ওনার স্পর্শের মাত্রা বৃদ্ধি পেতেই ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। বলে উঠলাম,
“ইস্! সবসময় এমন করেন কেন? ছাড়েন তো, কেউ চলে আসবে।”
“আপনার কথা তো শুনবো না ম্যাডাম, আমি তো আমার বউ কে আদর করছি।”
“উফ্! সবসময় এত আদর করার মুডে কেমনে থাকেন?”
“কারণ আমার আস্ত একটা আদর করার জিনিস, তাই।”
চুপ হয়ে গেলাম আমি। ওনার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারলাম না। মিনিট দুয়েক অতিক্রম হবার পর যখন আমার কোন সারা পেলেন না, তখন উনিও থেমে গেলেন। আলগা করে ছেড়ে ঘুরিয়ে নিলেন নিজের দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝা র চেষ্টা করলেন। বললেন,
“কি হয়েছে?”
“আমাকে এতটা ভালোবাসেন কেন তাসফি?”
ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম। সহসায় কিছু না বলে একই ভাবে তাকিয়ে রইলেন। এক হাতে কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন, ঘুচিয়ে দিলেন মাঝের দূরত্ব। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“কারণ, যতটা ভালোবাসলে আমার থেকে দূরে যাবার কথা কল্পনা করতে পারবে না, ঠিক তার থেকেও বেশি ভালোবাসবো।”
“আপনার এত ভালোবাসার সত্যিই কি প্রাপ্য আমি? বিরক্ত লাগে না আমাকে?
চেপে ধরলেন নিজের সাথে। আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁয়ে দিলেন আমার কাপালে। বললেন,
“তোমাকে সারাজীবন, সারাটাক্ষন, সারাটা সময় ভালোবেসেও এই জনমে আমার সাধ মিটবে না রুপু। পরকালেও শুধু তোমাকেই ভালোবাসে চাই।”
সহসায় একদল নোনাজল এসে ভীর জমালো চোখের কোণে। ভারী হয়ে উঠলো গলা। ছলছল করে উঠলো চোখ দু’টো, টপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভেজা গলায় বলে উঠলাম,
“আপনার ভালোবাসা আপনাকে দিতে পারলাম না তাসফি। আপনার ভালোবাসার জিনিসটা দিতে পারলাম না আপনাকে, আমাদের সন্তানকে….”
“তুমিই তো আমার ভালোবাসা রুপু, তোমাকে পাবার পর আর কোন ভালোবাসায় আমার প্রয়োজন নেই।”
ওনার কথাটা কানে আসলেও মস্তিষ্কে ধারণ করলাম না। শুধু বিচরণ করতে লাগলো ওনার বলা আগের কিছু কথা। ‘তোর জন্য আমার বাচ্চার কোন ক্ষতি হোক, সেটা আমি মেনে নিবো না।’ ‘তোর জন্য আমার বাচ্চার যেন কিছু না হয়।’ পারলাম না…. পারলাম না আমি ওনার এই কথা গুলোর ধারণা ভুল প্রমানিত করতে, পারলাম না আমি আমাদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে। কথাগুলো ভাবতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বললাম,
“আমার জন্য আমাদের সন্তানের ক্ষতি হলো তাসফি, আমার জন্য ও পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলো না। বিশ্বাস করো তাসফি, এমনটা আমি চাই নি, ইচ্ছে করে ওর কোন ক্ষতি চাই নি। বারবার…. বারবার করে সাদিক ভাইয়া কে বলেছিলাম ওকে বাঁচাতে, কিন্তু ভাইয়া আমার কোন কথায় শোনে নি, আমার জন্য আমাদের সন্তানকে….”
“রুপু, রুপু….শান্ত হও! কেন দোষারোপ করছো নিজেকে? সেদিন তোমার কোন হাত ছিলো না৷ অতিরিক্ত ব্লাড লসের কারণে ওকে বাঁচানো যায় নি, এতে তোমার কোন দোষ নেই।”
“আমার জন্য…. শুধুমাত্র আমার জন্যই ওকে বাঁচাতে পারে নি তাসফি।”
“ডাক্তাররা তো আর কম চেষ্টা করে নি, কিন্তু ওকে পাওয়ার ভাগ্যটা হয়তো আমাদের ছিলো না। তোমার কোন দোষ নেই রুপু।”
“আমি মা হয়ে ওকে সামলাতে পারলাম না তাসফি, আপনার সন্তানকে আপনার কাছে দিতে পারলাম না…..”
“একদম চুপ, আর একটাও কথা নয়। অনেক হয়েছে…..”
কিছু বলতে চাইলে আবারও চুপ করিয়ে দিলেন। জড়িয়ে ধরলেন নিজের সাথে, শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে গেলেন আমাকে। শরীরের পুরোটা ভর ছেড়ে দিলাম ওনার উপর, জোরে জোরে শ্বাস টেনে আপন মনে কেঁদে গেলাম। আলগোছে কোলে তুলে নিলেন, আবছায়া অন্ধকারাচ্ছন্নে ঘেরা বারান্দা থেকে রুমে নিয়ে আসলেন।
এগুলো নতুন কিছু নয়। বিগত ছয় থেকে সাত মাস এগুলোই হয়ে আসছে। হ্যাঁ! আমাদের সন্তানকে হারানোর প্রায় সাত মাস কেটে গেছে। পরিবারের সবাই ভুলে গেলেও আমি ভুলে যেতে পারি নি, মুছে দিতে পারি নি সেই দিনটার কথা। ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও ওনার বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। ‘তোর জন্য আমার বাচ্চার কোন ক্ষতি হোক, সেটা আমি মেনে নিবো না।’
কথাটা মন ও মস্তিষ্কে এসে জমা হলে জেগে উঠে এক অপরাধী সত্তা। মা হয়ে আমি আগলে রাখতে পারলাম না আমাদের সন্তানকে। এই মানুষটাকে ছাড়া তো আমি নিজেকেই সামলাতে পারি না, সেখানে আমাদের সন্তানের এত বড় দ্বায়িত্বটা কিভাবে নিতে গেলাম আমি?
.
সেদিন অপারেশন থিয়েটারে সাদিক ভাইয়াকে কথাটা বলার পর সহসায় কোন জবাব দেয় না ভাইয়া। দূর্বল হাতে ভাইয়ার হাত ধরে আবারও বলতেই ভাইয়া বলে উঠে,
“নিজেকে শান্ত করো রূপা। আমরা তো চেষ্টা করছি। প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে, তোমাকে ইমারজেন্সি ব্লাড দিতে পারলেও বেবির ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়, হয়তো ইতিমধ্যে বেবিটা আর….. তবুও আমরা চেষ্টা করছি।”
বলেই একটু থামলো। জোরে নিশ্বাস টেনে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো,
“নিজের কথাটা না ভাবলেও তাসফি’র কথাটা একবার ভাবো। ছেলেটা কি পরিমাণ পাগলামি শুরু করেছে, যা বলার বাহিরে। তোমার কিছু হলে ও কিছুতেই ঠিক থাকবে না। নিজেকে শক্ত করো, তোমার মনের জোর আমাদের জন্য অনেক কিছু।”
মাথায় হাত বুলিয়ে সরে গেল ভাইয়া। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না, গলা দিয়ে কোন কথায় যেন বেরুলো না। চোখ দিয়ে সমামে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু। কিছুটা সময় পর শুধু একটা কথায় কানে আসলো, ‘ ইট’স্ নট সাকসেস।’ ঠিক তখনই চোখের সামনে আঁধার নেমে আসলো।
.
চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে’ই আবিষ্কার করেছিলাম। এক হাতে স্যালাইন চললেও অপর হাতটা তাসফি ভাইয়ের হাতের শক্ত বাঁধনে বেঁধে ছিলো। একটু নড়েচড়ে উঠতেই ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন উনি। স্পষ্ট দেখেছিলাম ওনার চোখে কিছু হারানোর ভয়। অস্পষ্ট সুরে বাচ্চার কথা জানতে চাইলেও সহসায় কোন উত্তর দিতে পারেন নি উনি। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন কিছু একটা। আমি আস্তে করে বলে উঠি,
“আমার জন্য…. আমার জন্য আমাদের বেবিটা পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলো না তাসফি। আপনি আমায় ক্ষমা করবেন না, একদম না….”
চোখের কোণ বেয়ে পড়তে থাকা পানির ফোঁটাগুলো মুছে দেন। আলতো করে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলেন,
“আমার শুধু তোমাকে চাই, আর কাউকে না, কিচ্ছু না। তোমাকে ভালো রাখতে বাচ্চার কথায় তোমাকে মানাতাম। আমার সবটা জুড়ে শুধু তুমি, চাই না আর কিছু। তুমি বললে আজ থেকে অনেক ভালোবাসবো, অনেক বেশিই, তবুও আমার থেকে দূরে যাবার কথা ভাববে না, কষ্ট দিয়ে দূরে ঠেলে দিবে না আমাকে।”
ওনার বলা কথাগুলো শোনার পর আর কোন কথায় বলি নি আমি, সাহসটাও করে উঠি নি। কি-ই বা বলতাম? যে মানুষটা আমাকে এতটা ভালোবাসে তাকে তো বাবা হওয়ার সুখ টাই দিতে পারলাম না। আর না পেরেছিলাম নিজের সন্তানকে দেখতে। শুধু জেনেছিলাম ফুটফুটে এক ছেলে হয়েছিলো আমাদের। যে ছেলে কে ছুয়ে দেখার ভাগে আমার ছিলো না।
সেদিনের পরও ওনার সামনে এই বিষয় নিয়ে কোন কথা উঠায় নি। কিন্তু সময় যতই চলে যেতে লাগলো, ঠিক ততই যেন ভেতর ভেতর ভেঙে যেতে লাগলাম। নাম না জানা এক অপরাধী সত্তা জাগ্রত হতে লাগলো। বারংবার ভেঙে পড়লেও আমাকে সামলে গেছেন বরাবরের মতো, আগলে রেখেছেন নিজের সাথে।
.
“এ্যাই রুপু….”
বেড়িয়ে এলাম নিজের করা ভাবনা থেকে। গত সাত মাসে এগুলো শুধুই স্মৃতি, তবুও যেন সেই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি নি।
বিছানায় বসে আলতো ভাবে জড়িয়ে রাখলেও বেশ শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছি ওনাকে। ফ্রেশ হবার জন্য যেতে চাইলেও ওনার কোন কথায় যেন আমি কানে নিলাম না। উনি আবারও ডেকে উঠলেন। বললেন,
“রুপু, এখন তো ছাড়। আমি….. ”
“আমার বেবি চাই তাসফি। আমি আবারও মা হতে চাই, আপনাকে বাবা হবার আনন্দ দিতে চাই।”
হতাশার নিশ্বাস ছাড়লেন উনি। আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’ গালে হাত রাখলেন। বললেন,
“প্রতিদিন-ই তো এই কথাটা বলো, আর আমার উত্তরটাও তো সেই একই হয়। তাহলে বলো কেন?”
“প্লিজ! তাসফি, আর বাঁধা দিবেন না। সাত মাস তো কম নয়, অনেক বেশিই সময়। তাহলে সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যাটা তুমি। তুমি এখনো বাচ্চা নেবার জন্য রেড়ি নও। তোমাকে নিয়ে আর কোন রিক্স নিতে পারবো না রুপু।”
“আমি একদম ঠিক আছি, সুস্থ আছি। প্লিজ! তাসফি, আমার কথাটা একটু শোনো। এবার সব কথা মেনে চলবো তোমার, একদম অবাধ্য হবো না।”
“রুপু তুই কিন্তু….”
“প্লিজ! তাসফি প্লিজ! আমি আর তোমার অবাধ্য হবো না।”
জোরে করে নিশ্বাস ছাড়লেন উনি। এতদিন পর আমার করা জেদের কাছে হাল ছেড়ে দিলেন। বলে উঠলেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তো ছাড়।”
ওনার সম্মতি পেয়ে মুহুর্তেই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। অজান্তেই জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“থ্যাঙ্কিউ! থ্যাঙ্কিউ, তুমি বললে আজ থেকেই আমরা….”
“রুপু!”
কথার মাঝেই ডেকে উঠলেন উনি, থামিয়ে দিলেন আমাকে। বলে উঠলেন,
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুই খাবার রেডি কর, জলদি।”
বলেই ছাড়িয়ে নিলেন আমাকে। কিছু বলার জন্য উদ্যোগ হতেই আবারও থামিয়ে দিলেন। আমিও আর বাঁধা দিলাম না ওনাকে। ওনার কথা অনুযায়ী ছেড়ে দিলাম, খাবার রেডি করতে নিচে নেমে গেলাম।
এই কয়েক মাসে এভাবেই আমাদের দু’জনের ছোট সংসার চলছে। আমি কিছুটা সুস্থ হবার পরেই সবাই চলে গিয়েছে, তাসফি একা হাতে সামলে গিয়েছে আমাকে। কয়েকবার বগুড়া থেকে ঘুরে আসলেও কখনোই থাকতে দেন নি, দূরে থাকতে দেন নি আমাকে। আমাকে নিজের সাথেই নিয়ে ফিরে এসেছেন। পড়াশোনার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রেখে বাচ্চার কথা ভুলে থাকবো ভেবে এখানকার কলেজে ট্রান্সফার করে নিয়ে এসেছে। তবুও নিজের থেকে দূরে রাখেন নি। এতদিন এত শত বলে কয়েও ওনাকে রাজি করাতে পারি নি বাচ্চা নেওনার জন্য। বারংবার আমাকে বুঝিয়ে গেছেন আমি প্রস্তুত নয় বাচ্চা নেবার জন্য, আমাকে নিয়ে নতুন ভাবে রিক্স নিতে রাজি নয়। আজকে হঠাৎ এভাবে আমাকে চমকে দিয়ে রাজি হয়ে যাবেন, সেটা ভেবেই ব্যাপক খুশি লাগছে। এবার হয়তো ছেলেকে হারানোর কষ্টটা একটু হলেও ভুলে থাকতে পারবো।
.
প্রায় তিন মাস ধরে চেষ্টা করার পরও যখন কনসিভ করতে পারছিলাম না, তখন মা হওয়ার আসা টাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেঙে পড়েছিলাম আবারও নতুন ভাবে। কিন্তু তাসফি…. তাসফি হারে নি, ভেঙে পড়ে নি মোটেও। প্রতিনিয়ত আশ্বাস দিয়ে গেছেন আমাকে।
গত মাসে আবারও পিরিয়ড মিস হওয়ায় ও শরীর দূর্বলতার কারণে গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান আমাকে। সন্দেহর তালিকায় প্রেগন্যান্সির টেস্ট করায় ডক্টর। ডক্টর সন্দেহ করলেও কেন জানি মনে হচ্ছে এবারও হেরে যাবো আমি, মা ডাক থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবো।
হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধারায় চমকে উঠলাম আমি। প্রতিবার ওনার হুটহাট জড়িয়ে ধরায় চমকে না উঠলেও আজকে ব্যাপকভাবে চমকে উঠলাম। কারণটা টেস্টের রিপোর্ট। টেস্টের রিপোর্ট আনতেই গিয়েছিলেন উনি, প্রতিবারের মতো এবার আমি যেতে চাইলে বারণ করে দেন উনি, একা গিয়েই আনবেন সেটাও জানিয়ে দেন। জানি না কি আছে রিপোর্টে, হঠাৎই বুকের টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। রাগের কারণ না থাকলেও রাগ দেখালাম ওনাকে। বললাম,
“কতদিন বলছি বাসায় আসলে কলিং বেল দিবেন, এভাবে চোরের মতো লুকিয়ে বাসায় ঢুকেন কেন? আসেন ভালো কথা, এভাবে ভয় দেখান কেন?”
“কারণ এভাবে হুটহাট আপনাকে চমকে দিয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”
“আর আমার? আমার ভয় লাগে না বুঝি?”
“তা আজকে হঠাৎ ভয় পেলি কেন?”
“কারণটা কি আপনার অজানা?”
সহসায় কিছু বললেন না উনি। ঘুরিয়ে নিলেন আমাকে নিজের দিকে। চোখে মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে আনলেন। বললেন,
“উহুঁ! তবুও জানতে চাই।”
“রিপোর্টে এবারও নেগেটিভ আসছে, তাই না?”
বলতেই একদল নোনাজল এসে ভীর জমালো চোখে। চোখের কার্ণিশ বেড়ে অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ার আগেই জড়িয়ে ধরলেন, শক্ত করে আঁটকে নিলেন নিজের সাথে। আমি বুঝে গেলাম, এবার হয় নি। শক্ত করলাম নিজেকে, কিছু বলার আগেই উনি আস্তে করে বলে উঠলেন,
“উই আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস্ রুপু।”
চমকে উঠলাম আমি। কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। আমি কি ঠিক শুনলাম? না-কি সারাক্ষণ একটা কথা ভাবতে ভাবতে ভুল শুনলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে করে বলে উঠলাম,
“মাম্…মানে? আপনি কি….. ”
“আমরা আবারও মা বাবা হতে চলেছি রুপু, তোমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তুমি কনসিভ করেছো।”
শরীরের কাঁপুনির মাত্রাটা বৃদ্ধি পেল হঠাৎই, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না ওনাকে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সবকিছুই যেন মুহুর্তেই স্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। উনি সময় দিলেন আমাকে। বেশ কিছু সময় অতিক্রম হবার পর ছেড়ে দিলেন। চোখের পানিগুলো মুছিয়ে দিলেন। বলে উঠলেন,
“অনেক হয়েছে, আর নয়। আজকে থেকে আর একদম কান্না নয়।”
মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম একদম কাঁদবো না। কিন্তু চোখের অশ্রু গুলো যেন বাঁধা মানলো না। উনি আবারও মুছিয়ে দিলেন। বললেন,
“আবার কাঁদছো কেন? একদম অনিয়ম করলে চলবে না, এখন থেকে সবসময় আমার কথা শুনে চলবে।”
“হুম!”
মাথা ঝাঁকিয়ে সেভাবেই ফুপিয়ে কেঁদে গেলাম। উনি হয়তো এবার বিরক্ত হলেন কিছুটা। গলায় গম্ভীরতা ফুটিয়ে এনে আবারও বললেন,
“রুপু, কান্না থামাতে বললাম না? আমি কিন্তু এবার রেগে যাবো।”
আবারও একইভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে গেলাম। কাঁদো কাঁদো গলায় কিছু বলার উদ্যোগ হতেই উনি নিজের ঠোঁটের স্পর্শে মিলিয়ে দিলেন আমার ঠোঁট। সহসায় কান্না থেমে গেল, দু’হাতে খা’মচে ধরলাম ওনাকে।
.
মা হবার অনুভূতিটা যে ঠিক কি, সেটা গত সাত দিন আগে টের পেয়েছি এক ফুটফুটে মেয়ের মা হয়ে। ছোট ছোট হাত পা নিয়ে ছোট পরী টাকে যখন প্রথমবার কোলে নিয়েছি তখন উপলব্ধি করেছি মা হওয়া ঠিক কতটা সুখের। সাময়িক সেই কষ্ট গুলো নিমিষেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলো যেন।
আগের চেয়েও ব্যাপক সাবধানে রেখেছে সবাই, এক মুহুর্তের জন্যও কিছু করতে দেয় নি আমাকে। আর এসবের পিছনে তাসফি ভাইয়ের হাতটায় বেশি ছিলো। সারাসময় ফুপি সামলে রাখলেও ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার পর প্রায় প্রতিটা মিনিট আমাকে সময় দিয়েছেন উনি।
আজ সাত দিন পর মেয়েকে কোলে নিয়ে তাসফির হাত ধরে বাসায় আসি। অদ্ভুত এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হই। পরিবারের সবাই ভীষণ খুশি, তাদের নাতনিকে পেয়ে। রিমি আপু ও রিফা আপুর ছেলে হবার পর এটাই তাদের প্রথম নাতনি, তাই হয়তো আনন্দটা একটু বেশিই। আকিকা না করলেও তাসফির নামের সাথে মিল রেখে তামায়া নাম রেখেছি আমি। সবাই এই নামেই ডাকে ওকে। মেয়ের আগমনে বাসায় এক উৎসব মুখর পরিবেশর সৃষ্টি হয়েছে। ফুপিরা সহ রিমি আপু, রিফাপু, সাহিল ভাইয়া, সাগর ভাইয়া সহ রাহাতরাও এসেছে।
সারাটা সন্ধ্যা থেকে কিছুটা রাত পর পর্যন্ত সবার সাথে সময় কাটিয়ে চলে শরীর আর সায় দিলো না বসে থাকার। সোফার সাথে শরীর মিলেছে দেওয়ায় সবার আড্ডার আসর ভঙ্গ করে আমাকে বললো রুমে যেতে, গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে। এতক্ষণে তাসফিও হয়তো পুরোপুরি ভাবে লক্ষ লরলো আমাকে। একই ভাবে বললো রুমে যাবার জন্য। মেয়েকে নিতে চাইলেই আম্মু বললো, উপরে যেতে, একটু পর দিয়ে আসছে। আমি আর বারণ করলাম না। আড্ডার আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, চলে আসলাম রুমে।
কিছুটা সময় পর আম্মুর সাথে তাসফি ভাইও রুমে আসলেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে আম্মু বললো ওকে খাওয়াতে। ওকে কোলে নিয়ে খাওয়াতে লাগলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করলো রাতে আমার সাথে থাকতে হবে কি, একা বাবুকে সামলাতে পারবো কিনা? মাথা তুলে তাকালাম তাসফির দিকে। ওনার করুন মুখের চাহনিতে ব্যাপক হাসি পেল। তবুও দমিয়ে রাখলাম নিজেকে। আম্মুকে বললাম, পারবো ওকে সামলাতে , থাকতে হবে না। কোন সমস্যা হলে ডেকে নিবো। কথা বারালো না আম্মু, সাবধানে থাকতে বলে বেড়িয়ে গেল রুম ছেড়ে।
মেয়েকে খাওয়ানোর মাঝেই ঘুমিয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারও তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে এলো। হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় কেটে গেল মাত্র ভারী হওয়া ঘুমটা। ব্যাপক বিরক্ত হলে বললাম,
“কি করছেন? ছাড়েন তো, ওপাশে যান। ঘুমাবো আমি।”
প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না উনি। আগের চেয়েও অধিক ভাবে জড়িয়ে নিলেন। আবারও বললাম,
“উফ্! কি হলো? ছাড়েন তো….”
“কতদিন পর আমার রুপুসোনা কে একটু কাছে পেলাম, ছেড়ে দিবো কিভাবে?”
“কতদিন পর মানে? এই কদিন তো হসপিটালেই আমার সাথে রোগী হলে ছিলেন, আপনার জন্য কি আমায় কম লজ্জায় পড়তে হয়েছে? নার্সরা কি কি ভাবতো?”
“তাদের ভাবনা দিয়ে তো আর আমার কাজ নাই, আমার কাজ আমার বউকে দিয়ে।”
ওনার কথায় হালকা হাসলাম আমি। এই মানুষটা আসলেই একটা বজ্জাত, খচ্চর। সবসময় নিজের মর্জিতে চলে। গলায় গম্ভীরতা এনে ছেড়ে দিতে বললাম ওনাকে। ছাড়লেন না উনি, আগের ন্যায় অধিক জড়িয়ে ধরার প্রয়াস চালিয়ে গেলেন, গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলেন। হাসিটা চওড়া হলো আমার। ওনাকে ছেড়ে দেবার কথা বললেও তো চাই না ছেড়ে দিক, এভাবেই বেঁধে রাখুক নিজের সাথে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিক।
“রুপু!”
আস্তে করে ডেকে উঠলেন। আমিও ওনার ডাকে সারা দিলাম। ছোট করে ‘হু!’ বলতেই উনি বললেন,
“তুমি বললে আজ থেকে আমাদের ছোট সংসার শুরু হোক রুপু। তুমি, আমি আর আমাদের ছোট তামায়া কে নিয়ে।”
জবাব দিলাম না। মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম তাসফির দিকে। ওনার বুকে মুখ গুঁজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। বুঝিয়ে দিলাম মুখ ফুটে না বলা কথাগুলো। কিছুটা সময় নিয়ে উনি আবারও ডেকে উঠলেন।
“রুপুসোনা!”
“হু!”
“গোধূলি মেঘ জমেছে নামা সাঝের মায়ায়,
আধার নামা রাতে।
চাঁদ মাখা আলোয়ে জমেছে,
শিশির পাতায় পাতায়।
তুমি বললে আজ নামাবো তারায় সুখ,
তুমি বললে আজ নামবে তৃপ্তসুখ।”
.
.
সমাপ্ত……!