তুমি শুধু আমারই হও পর্ব-১৮+১৯

0
418

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|১৮|

উৎসব আর অর্নব মুখোমুখি বসে আছে। পাশেই এক কোনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অর্নি। ওর পাশে নূর আর রুশানও আছে। উৎসব নড়েচড়ে বসে ঠিক করে নিলো নিজেকে। তারপর গলা ঝেড়ে অর্নবের চোখের দিকে তাকিয়েই বললো,
–“আমি অর্নিকে ভালোবাসি।”

অর্নব চমকালো না। ও দেখেই আন্দাজ করতে পারছিলো এরকম কিছুই হবে। অর্নি একবার আড়চোখে নিজের ভাই আর উৎসবের দিকে তাকিয়ে মাথা আবার নিচু করে নিলো৷ অর্নব বললো,
–“হ্যাঁ তারপর? আমি কি করতে পারি এখন?”

–“আপনি নিহালের সাথে অর্নির বিয়েটা ভেঙে দিন। জাস্ট এনগেজমেন্ট হয়েছে বিয়ে না। আর বিয়ে হলেও আমার সমস্যা ছিলো না। আমার অর্নি হলেই হলো।”

অর্নি চমকে তাকালো উৎসবের দিকে। লোকটা অকপটে ওর ভাইয়ের সামনে বসে ওকে বিয়ে করার কথা বলে যাচ্ছে৷ একটু ঘাবড়াচ্ছেও না। অর্নব ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“তোমার কথায় আমি আমার বোনের বিয়ে ভাঙবো কেন?”

এবার উৎসব সরাসরি দৃষ্টি তাক করলো অর্নির দিকে। অর্নি ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ উৎসব অর্নির চোখের দিকে তাকিয়েই অর্নবকে বললো,
–“আমার কথায় ভাঙতে হবে না। আপনার বোনের কথা ভেবেই বিয়েটা ভেঙে দিন। অর্নিও আমাকে ভালোবাসে।”

এবার অর্নব চমকালো। একটু না বেশ অনেকটাই চমকেছে অর্নব। অর্নব অর্নির দিকে তাকাতেই অর্নি দ্রুত মাথা নিচু করে নিলো। রুশানের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। রুশান অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“চিন্তা করিস না, ভালোই হবে দেখিস।”

অর্নি তবুও শান্ত হতে পারলো না৷ হাত পা রীতিমতো কাঁপছে ওর। এবার ওর ভাইয়ের উত্তর কি আসে এই ভেবে চিন্তা হচ্ছে ভীষণ নূর রুশান অর্নি উৎসব সকলেরই। অর্নব ধীর পায়ে অর্নির দিকে এগিয়ে গেলো। অর্নি সাথে সাথেই মাথা নিচু করে নেয়। গম্ভীর কন্ঠে অর্নিকে বললো,
–“তাকা আমার দিকে।”

অর্নি তাকালো না৷ মাথা নিচু করেই রইলো। অর্নব ধমকের স্বরে বললো,
–“তাকাতে বললাম না আমার দিকে?”

কেঁপে উঠলো অর্নি। আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকালো অর্নবের দিকে৷ অর্নবের চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। অর্নব থমথমে গলায় উৎসবকে ইশারায় দেখিয়ে অর্নিকে প্রশ্ন করলো,
–“ভালোবাসিস ওকে?”

অর্নির গলা শুকিয়ে আসছে। যদি হ্যাঁ বলে তাহলে অর্নবের রিয়্যাকশন কেমন হবে কে জানে। অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“ভাইয়া___”

–“এক কথায় উত্তর দিবি, হ্যাঁ কি না? ভালোবাসিস উৎসবকে?”

অর্নি নূর আর রুশানের দিকে তাকালো। ওরা দুজনেই ইশারায় হ্যাঁ বলতে বলছে। অর্নি একপলক উৎসবের দিকেও তাকালো। উৎসব ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্নি একটা লম্বা শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর মাথা উপর-নীচ ঝাঁকালো৷ যার অর্থ অর্নি উৎসবকে ভালোবাসে। অর্নির জবাবে উৎসবের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। নূর আর রুশানও বেজায় খুশি। আচমকায় অর্নির গালে ঠাস করে চ/ড় বসালেন মিসেস অদিতি৷ অর্নব সহ সকলেই চমকে উঠলো। এতগুলো বছরে যে কখনো সামান্য ফুলের টোকা লাগতে দেয়নি আর আজ সে কিনা মারলো? অর্নি গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে৷ মিসেস অদিতি অর্নি হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
–“বেয়াদব মেয়ে, কাল নিহালের সঙ্গে তোর এনগেজমেন্ট হলো আর আজ তুই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসার কথা বলছিস৷ লজ্জা করছে না তোর।”

কথাগুলো বলে মিসেস অদিতি আবারো চ/ড় মারতে উদ্যত হলেই অর্নব অর্নিকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। তারপর বলে,
–“আম্মু মারছো কেন ওকে? পাগল হলে নাকি? একদম হাত তুলবা না ওর গায়ে।”

মিসেস অদিতি রাগী স্বরে বললো,
–“এখন নিহাল ওরা যদি জানে তোর বোনের কর্মকাণ্ড আমি মুখ দেখাবো কি করে আমার ভাইকে?”

অর্নব গম্ভীর স্বরে বললো,
–“অর্নি আহামরি এমন কোনো অন্যায় করেনি যে তুমি মামা-মামীকে মুখ দেখাতে পারবে না৷ ভালোবাসা কোনো অন্যায় না৷ বরং আমরা ভুল করেছি ওর মতামত না নিয়ে৷ ওর কোনো পছন্দ আছে কিনা এটা জিজ্ঞেস না করে আমরা ভুল করেছি।”

–“তোর আস্কারা পেয়ে পেয়ে ও এমন হয়েছে। একটাবারও আমাদের মান সম্মানের কথা ভাবলো না বেয়াদব মেয়ে। কথায় আছে না, পর কখনো আপন হয় না। এখন সেটা সত্যিই মনে হচ্ছে আমার। ও যদি আমার নিজের___”

এইটুকু বলেই মিসেস অদিতি নিজের মুখ দুহাতে চেপে ধরলেন। বেশ উত্তেজিত আর রেগে থাকার কারনে কথাগুলো বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। এখন উনি নিজেই ভয় পাচ্ছেন অর্নির কথা ভেবে৷ মায়ের মুখে এরকম কথা শুনে অর্নি চমকে তাকালো। সাথে অবাক হলো সেখানে উপস্থিত নূর রুশান আর উৎসবও। অর্নব মিসেস অদিতিকে ধমকের স্বরে বললেন,
–“আম্মু এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? তোমার আইডিয়া আছে তুমি কিসব বলছো?”।

অর্নি অর্নবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মিসেস অদিতির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মিসেস অদিতির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
–“আম্মু, ও আম্মু একটু আগে এসব কি বলছিলে তুমি? থেমে গেলে কেন? পুরো কথা শেষ করো। আম্ আমি তোমাদের মেয়ে নই? তুমি আমার নিজের আম্মু না? ভাইয়া আমার নিজের ভাই না? ও আম্মু চুপ করে আছো কেন তুমি? বলো না। আচ্ছা এটা বলো, এতক্ষণ যা যা বলেছো সব মিথ্যে। আমি তোমার নিজের মেয়ে, আমাকে তুমি নিজের গর্ভে ধারণ করেছে তাই না আম্মু? এটাই তো সত্যি বলো না। বলো না চুপ করে আছো কেন?”

মিসেস অদিতি আঁচলে মুখ চেপে ধরে ডুঁকরে কেঁদে দিলো। এতেই অর্নির যা বোঝার বুঝে গিয়েছে ও। এতদিন ও যাকে নিজের আম্মু ভাই ভেবেছে তারা কেউ ওর নিজের না? কথাটা ভাবতেই ধপ করে ফ্লোরে বসে শব্দ করে কেঁদে দিলো। অর্নব একসাইডে গিয়ে দেয়ালে এক হাত রেখে মাথা নিচু করে আছে। ওর চোখে জল টলমল করছে। নূর আর রুশান এগিয়ে গিয়ে বসলো ওর কাছে। রুশান বললো,
–“আরেহ দোস্ত কান্না করিস কেন? আন্টি কি একবারো বলেছে নাকি তুই উনার নিজের মেয়ে না? রাগের মাথায় কিসব বলছে আন্টি নিজেই জানে না।”

নূরও রুশানের কথায় তাল মিলিয়ে বললো,
–“রুশান ঠিক বলেছে অর্নি৷ আন্টি তো এরকম কিছু বলেনি। তুই বেশিই ভাবছিস।”

অর্নি কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
–“মিথ্যে সান্তনায় ভুলাতে পারবি না আজ৷ আম্মু কি কি বলেছে তা তোরা খুব ভালো করেই জানিস।”

এবার উৎসব এগিয়ে এলো৷ অর্নিকে টেনে তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“বাচ্চাদের মতো কি কান্নাকাটি শুরু করলে বলো তো? কিচ্ছু হয়নি অর্নি, তুমি উনারই মেয়ে। রাগ জেদ থেকে কথাটা বলে ফেলেছে।”

অর্নি সরে এলো উৎসবের কাছে থেকে। বললো,
–“ছোট বাচ্চা না আমি উৎসব ভাই। আম্মু কি বলেছে আর কি বোঝাতে চেয়েছে তা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছি।”

উৎসব প্রত্যুত্তরে কি বলবে জানা নেই ওর। এখানে কারোরই জানা নেই। মিসেস অদিতির কথা থেকে এটা স্পষ্ট অর্নি উনার নিজের মেয়ে না। এতদিন বুকে আগলে মানুষ করেছে অর্নিকে। আজ একটা রাগ জেদের বসে বেখেয়ালি ভাবে কথাটা বলে ফেলেছে যেটা এতগুলো বছর অর্নির কাছ থেকে আড়ালে রেখেছিলেন উনি আর অর্নব। কথাটা বলার পর এখন উনি নিজেও কাঁদছে, মেয়েটাকে যে বড্ড বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেললেন। অর্নি এলোমেলো পায়ে অর্নবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। অর্নবের হাত ধরে বললো,
–“ভাইয়া? আমি তোমার নিজের বোন নই না? আম্ আমি___”

অর্নি আর কিছু বলার আগেই অর্নব বোনকে জাপ্টে ধরলো বুকে। বললো,
–“কে বলছে তুই আমার বোন না? তুই আমার বোন ছিলিস আর থাকবি। এক মায়ের পেটে না হলে কি বোন হয় না?”

অর্নি কিছু না বলে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। পেছন পেছন নূর ওরা সকলেই গেলো বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পরও অর্নি দরজা খোলেনি। জানালো একা থাকতে চায় কিছু সময়। তাই কেউ আর বিরক্ত করেনি।

একটা রেস্টুরেন্টে নিহাল আর উৎসব মুখোমুখি বসে আছে। উৎসবই ডেকেছে নিহালকে। উৎসব দুজনের জন্য কফি অর্ডার দেয়। কিছুক্ষণ বাদে ওয়েটার এসে কফি দিয়ে যায়। কফির মগ হাতে তুলে নিয়ে উৎসব বললো,
–“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।”

নিহাল কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
–“আমি জানি আপনি কি বলতে ডেকেছেন আমায়। অর্নব আমায় সব জানিয়েছে।”

এরপর দুজনেই বেশ কিছুটা সময় নিরব থাকলো। নিরবতা ভেঙে নিহাল বললো,
–“কথাটা যদি আগেই জানাতেন তাহলে এতকিছু হতোই না আজ। না ফুপিমণি রাগে উত্তেজিত হয়ে অর্নিকে ওভাবে হার্ট করতো।”

–“আপনার আর অর্নির এনগেজমেন্ট এর কথা আপনাদের এনগেজমেন্ট এর দিন রাতেই জানতে পারি___”

এরপর উৎসব একে একে সবটা বলতে শুরু করলো নিহালকে। অর্নির সাথে ওর পরিচয় হওয়া থেকে এখন অব্দি সবটা মনোযোগ দিয়ে শোনে নিহাল। সব শুনে এটাই দাঁড়াচ্ছে অর্নিও ভালোবাসে উৎসবকে। অর্নব আর মিসেস অদিতিকে কষ্ট দিতে চায় না বলে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিলো এই বিয়েতে৷ নিহাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“থ্যাংকস আপনাকে সবটা জানানোর জন্য। নয়তো আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তখন তিনটে জীবনে নড়বড়ে হয়ে যেত। আপনি অর্নি দুজনেই কষ্ট পেতেন, সাথে হয়তো আমিও কষ্ট পেতাম ক্ষানিকটা। একটা সময় হয়তো অর্নি মানিয়ে নিতো আমার সাথে। কিন্তু মন থেকে কখনোই ভালো থাকতে পারতো না। অর্নির জন্য আপনিই পারফেক্ট।”

উৎসব মৃদু হাসলো। ও ভাবেনি নিহাল এত সহজেই সবটা মেনে নিবে। নিহাল আবারো বললো,
–“আমি চাই অর্নি ভালো থাকুক৷ সেটা যদি আপনার সাথে হয় তাহলে তাই হবে। বাসায় আমি কথা বলছি। আপনার অর্নি আপনারই থাকবে।”

দুদিন পর। নিহাল বাসার সবাইকে মানিয়ে নিয়েছে। অর্নি এ দুদিন ঘর থেকে বের হয়নি তেমন একটা। মিসেস অদিতি মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার অপরাধবোধে অর্নির সামনে যায়নি আর। অর্নবই রুমে খাবার নিয়ে খাইয়ে দিতো অর্নিকে। অর্নি শুধু অর্নবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। অর্নব মুচকি হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।

সন্ধ্যা নাগাদ। অর্নি বিছানায় জানালার পাশে বসে বই পড়ছে৷ এমন সময় দরজায় কড়াঘাতের শব্দ হলো। অর্নি বই পরতে পরতেই বললো,
–“এসো ভাইয়া।”

গুটিগুটি পায়ে ভিতরে ঢুকলো মিসেস অদিতি। অর্নি বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিসেস অদিতিকে দেখে বই নামিয়ে রাখলো। এই দুদিন অর্নবই এসেছে রুমে। মিসেস অদিতি আসেন নি। তাই অর্নি ভেবেছিলো এখনো অর্নব এসেছে। মাকে দেখে অর্নির চোখ জলে ভরে উঠলো। মিসেস অদিতি অর্নির পাশে গিয়ে বসে অর্নির হাত নিজের হাতে নিলেন। বললেন,
–“আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না রে মা? ক্ষমা করবি না আমায়?”

অর্নি গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বললো,
–“তুমি ক্ষমা চাচ্ছো কেন আম্মু? তুমি তো ঠিকই বলেছিলে। আমি তোমার নিজের মেয়ে হলে অবশ্যই তোমাদের মান সম্মানের কথা চিন্তা করতাম। পর তো কখনো আপন হয় না। আমি আরো সারাজীবন ঋণী থাকবো তোমার কাছে। গর্ভে না ধরেও এতগুলো বছর আমাকে এত যত্নে আগলে রাখার জন্য।”

মিসেস অদিতি চোখের জল ফেলে বললেন,
–“গর্ভে না ধরলে কি মা হওয়া যায় না? আমি কি তোর মা হতে পারিনি?”

–“জ্ঞান হওয়ার পর তো এটাই জানতাম আম্মু। তুমি আমার আম্মু অর্নব ভাইয়া আমার নিজের ভাই। কিন্তু এখন তো অন্যটা জানলাম আম্মু। আমি তোমাদের কেউ না। কেউ না আমি তোমাদের।”

মিসেস অদিতি মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন। পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। অর্নি মায়ের সান্নিধ্যে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। মিসেস অদিতি অর্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
–“কে বলে তুই আমাদের কেউ না? তুই তো আমার আর অর্নবের প্রান ভোমরা রে মা। তুই আমার মেয়ে। অর্নব তোর নিজের ভাই। আগে যেমন ছিলি সামনেও তেমন থাকবি। তুই যে আমাদের কাছে কি সেটা তুই জানিস না? অর্নব তোকে চোখে হারায় জানিস না তুই? তোর একটু কিছু হলে আমরা পাগল হয়ে যাই, তুই এসব জানিস না? তারপরো কিভাবে বলিস তুই কেউ না আমাদের? রক্তের সম্পর্কই কি সব অর্নি? হতে পারে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। তোকে গর্ভে ধরিনি আমি। কিন্তু মাতৃস্নেহে বড় করেছি। নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছি। তুই আমাদের সবকিছু মা। আ’ম স্যরি রে আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনি।”

অর্নি কিছু বললো না। মিসেস অদিতির বলা সবগুলো কথা সত্যি। অর্নবের আর মিসেস অদিতির চোখের মণি অর্নি। ওকে ছাড়া এ দুজন মানুষ কিচ্ছু বোঝে না। অর্নি ওর মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে শক্ত করে। মিসেস অদিতি অর্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অর্নিকে ছেড়ে দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“আর একদম কান্নাকাটি নয়। আমার মেয়ের চোখের পানি আমি একদম দেখতে চাই না।”

অর্নি আবারো মিসেস অদিতিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসি আম্মু।”

মিসেস অদিতি মুচকি হেসে বললেন,
–“সে তো আমিও আমার মেয়েকে এত্তগুলা ভালোবাসি। এখন বোস তো এখানে। আমি যাই তোর জন্য সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে আসছি আমি।”

মিসেস অদিতি অর্নির কপালে চুমু খেয়ে চলে গেলেন মেয়ের পছন্দমতো নাস্তা বানাতে। মিনিট পনেরো বাদে অর্নিকে ডাকলেন। অর্নিও বাধ্য মেয়ের মতো রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মিসেস অদিতি অর্নিকে সোফায় বসিয়ে অর্নির পাশে বসলো। তারপর নিজ হাতে পাস্তা খাইয়ে দিতে লাগলেন৷ এমন সময় অর্নব এলো অফিস থেকে৷ বাসায় ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসলো অর্নব৷ যাক মান-অভিমানের পালা মিটলো তাহলে। অর্নব অফিস ব্যাগটা সোফায় রেখে অর্নির পাশে ধপ করে বসে পড়লো। গোমড়া মুখে বললো,
–“ভালোই তো, এখন মা-মেয়ে মিলে গেছো এদিকে আমার কথা কারো মনেই নেই।”

অর্নি ফিক করে হেসে দিলো অর্নবের কথায়। মিসেস অদিতি মুচকি হেসে অর্নবকেও খাইয়ে দিলেন। অর্নব বোনের গালে হাত রেখে বললো,
–“তুই এভাবেই সবসময় হাসি খুশি থাকবি অর্নি। তোর হাসি মুখটাই আমরা দেখতে চাই সবসময়।”

অর্নি আলতো হেসে একপাশ থেকে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। অর্নব অর্নির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“বাই দ্যা ওয়ে, উৎসবের সাথে কথা হইছে তোর? ও কিন্তু নিহালের সাথে কথা বলেছে। নিহালও বুঝেছে ব্যাপারটা। ও এই বিয়েতে না করে দিয়েছে আর সবাইকে ও-ই বুঝিয়েছে।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“এত কিছু কখন হলো?”

অর্নব অর্নির গাল টেনে দিয়ে বললো,
–“আপনি যখন নিজেকে ঘর-বন্দী করে রেখেছিলেন তখন। কেন উৎসব কিছু বলেনি তোকে?”

অর্নি গোমড়া মুখে বললো,
–“নাহ, মনে হয় না উৎসব ভাই এত সহজেই কথা বলবেন আমার সাথে। উৎসব ভাই আমায় অন্যকারো হতে দিবে না তাই বিয়ে ভাঙার দরকার ছিলো বিয়ে ভেঙেছে।”

অর্নব বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
–“পাগলী একটা, মন খারাপ করিস না। উৎসব ভালোবাসে তো তোকে। দেখবি বেশিদিন রাগ পুষে থাকতে পারবে না।”

চলবে~

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|১৯|

একটা ছবি বুকে আকড়ে ধরে বসে আছে অর্নি। ছবিটা অর্নির আসল মা-বাবার। দু মাসের অর্নিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্নির মা। আর পাশে দাঁড়িয়েই অর্নির বাবা অর্নির মাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অর্নি যখন ওর আসল বাবা-মায়ের কথা জানতে চায় মিসেস অদিতি তখন এই ছবিটা অর্নির হাতে দিয়ে বলেছিলো এই ছবির মানুষ দুটোই ওর মা বাবা। অর্নির মা আর মিসেস অদিতি ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অর্নির বাবার কোনো ভাই বোন ছিলো না। অর্নির জন্মের আগেই অর্নির দাদা-দাদু মারা যান।

অর্নির বাবা-মা মিসেস অদিতির বাসায় বেড়াতে আসেন। সেদিনই খবর আসে অর্নির নানু মারা যায়৷ পাগলের মতো কান্না করতে থাকেন অর্নির মা। তখনই গাড়ি নিয়ে ছুটে যায় অর্নির নানুবাড়ি। মিসেস অদিতি অর্নির মায়ের এমন অবস্থা দেখে ছোট্ট অর্নিকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। আধ ঘন্টা বাদেই খবর আসে অর্নির বাবা মা পথিমধ্যে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যান। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মিসেস অদিতি। আল্লাহ হয়তো চেয়েছিলেন দুই মাসের বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই তো মিসেস অদিতি অর্নিকে নিজের কাছের রেখে দিয়েছিলেন। অর্নির দাদু বাড়ির কেউ না থাকায় অর্নিকে নিয়ে ওর মামা বাড়ি যায় মিসেস অদিতি। অর্নির নানা-নানু বেঁচে না থাকায় ওর মামারা কেউ-ই অর্নিকে নিজেদের কাছে রাখতে চায়নি।

সেই থেকেই অর্নি মিসেস অদিতির কাছে। অর্নবের বয়স তখন নয় বছর। দুই মাসের বাচ্চা মেয়েটাকে খুব সযত্নে বড় করেছেন তিনি। গর্ভে ধারণ না করেও মাতৃস্নেহে বড় করে তুলেছেন। অর্নির জন্যই পরবর্তীতে আর কোনো সন্তান নেননি তিনি। অর্নিকে কখনো বুঝতে দেয়নি ওরা অর্নির আসল মা-বাবা ভাই না। তিনজনেই বেশ আদর যত্নে মানুষ করেছে মেয়েকে। অর্নির যখন আট বছর বয়স তখন অর্নবের বাবা মারা যান। দুই সন্তানকে বুকে আগলে মিসেস অদিতিই মানুষ করেছেন।

মিসেস অদিতির মুখ থেকে এসব শুনে বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসেছিলো অর্নি। তারপর আচমকাই মিসেস অদিতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়৷ তিনি অর্নিকে শান্ত করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। আর অর্নি বসে ভাবতে থাকে ওর নিয়তির কথা। ওর নিজের মামারা ওকে রাখতে চায়নি সেখানে মিসেস অদিতির সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক না থাকা স্বত্তেও তিনি এতগুলো বছর আগলে রেখেছেন৷ নিজে আর কোনো সন্তানও নেয়নি। এমন মানুষও দুনিয়াতে আছে মিসেস অদিতি অর্নব আর বাবাকে না দেখলে বুঝতোই না অর্নি।

অর্নি ছবিটা বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। তারপর চোখের পানি মুছে বললো,
–“আমার লাইফে একটাই সত্যি আর সেটা হলো আম্মু আর ভাইয়াই আমার সবকিছু৷ এই দুজন মানুষই আমার নিজের। আম্মুই আমার নিজের মা।”

কথাগুলো বলে হেঁচকি তুলে কাঁদলো অর্নি। ফোনের রিংটোনে অর্নি চোখের পানি মুছে ফোন হাতে নিলো। নূরের ফোন। অর্নি নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করলো,
–“হ্যাঁ নূর, বল।”

–“কাঁদছিলি তুই?”

চমকালো অর্নি। মা আর ভাইয়ের পরে লাইফে বন্ধু পাইছে দুইটা যারা কিনা ওর থেকেও বেশি ভালো বুঝে অর্নিকে। এদের থেকে কিচ্ছু লুকানো যায় না। অর্নি হেসে বললো,
–“আরেহ না, কাঁদবো কেন?”

–“দেখ অর্নি মিথ্যে বলবি না। আমি তোর কন্ঠ শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুই কাঁদছিলি এতক্ষণ, কি হয়েছে বল?”

অর্নি সবটা বললো নূরকে। জানালো ওর আসল বাবা মায়ের কথা। সব শুনে নূর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“অতীতের কথা ভাবিস না। আল্লাহ আংকেল আন্টিকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন তাতে কি? তোকে তো আর এতিম হতে দেয়নি৷ আন্টির মতো মা আর অর্নব ভাইয়ার মতো ভাই পাইছিস এটা কি কম?”

নূরের কথায় অর্নি হাসলো। বললো,
–“আম্মু আর ভাইয়াকে আমি আমার লাইফে সব থেকে বেশি ভালোবাসি।”

–“আর আমার ভাইয়াকে? আমার ভাইয়াকে তাহলে কি ভালোবাসিস না তুই?”

আচমকা নূরের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো অর্নি। তারপর বললো,
–“এখানে তো আমার আম্মু আর ভাইয়াকে নিয়ে কথা হচ্ছিলো নূর। মাঝখানে তুই উৎসব ভাইকে টানিস কেন?”

–“বল না নিজের মুখে, ভালোবাসিস না ভাইয়াকে? খুব তো লুকোচুরি হলো। আর কত লুকাবি? আর এখন তো সব ঠিক আছে। সবাই সবটা জানে। তাহলে এরপরও তো আর লুকানোর কিছু দেখছি না আমি।”

অর্নি গোমড়া মুখে বললো,
–“কোথায় সব ঠিক আছে? সেদিন যে উৎসব ভাই আমাদের বাড়ি থেকে গেলো। নিহাল ভাইয়ের সাথে কথা বলে বিয়েটাও ক্যান্সেল করলো। এরপরে একবারও উৎসব ভাই কথা বলেছে আমার সাথে? বলেনি তো। তাহলে সব ঠিক থাকলো কিভাবে?”

–“গাধী, ভাইয়া যে তোর উপর রেগে আছে এটাও বুঝিস না? ভাইয়া গিয়ে সবার কাছে তোকে ভালোবাসার কথাটা বলে যে বিয়েটা ভাঙলো এটা যদি তুই এনগেজমেন্ট এর আগেই করতি তাহলে তো আর এতকিছু হতো না৷ তুই আগে থেকেই নেগেটিভ ধারণা পুষে রেখেছিলি মনে। তাহলে আমার ভাইয়া এখন রেগে থাকবে না তো কি করবে?”

অর্নি রিনরিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
–“কোথায় আছে উৎসব ভাই?”

–“কথা বলবি?”

একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো অর্নিকে। আমতা আমতা করে বললো,
–“হুম, উৎসব ভাইয়ার কাছে একটু ফোনটা নিয়ে___”

–“বাট স্যরি দোস্ত। আমি তো পারবো না। তুই বাসায় এসে তারপর রাগ ভাঙাবি ভাইয়ার। বাসায় চলে আয়। ভাইয়া বাসায়ই আছে।”

–“যেটা ফোনে পসিবল ওটা বাসায় গিয়ে করতে হবে কেন?”

–“ভাইয়া কিন্তু প্রচুউউউউর ক্ষেপে আছে তোর উপর। আচ্ছা তুই যেহেতু আসতে পারবি না তাহলে আর কি করার? ওদিকে তুই বাড়িতে বসে থাক৷ এদিকে আমার ভাইয়ের রাগটা তোর উপর দিন দিন আরো বাড়ুক।”

কথাটা বলেই খট করে লাইন কেটে দিলো নূর। অর্নি অসহায় ভাবে বিছানায় বসে আছে। বাসায় যাবে কি যাবে না? নাকি ফোন করবে? পরমূহুর্তেই মনে পড়লো উৎসবের নাম্বারটাও নেই অর্নির কাছে৷ এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না অর্নি।

অর্নি গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে৷ মিসেস অদিতি কিচেনে কিছু একটা করছিলেন। অর্নি মিসেস অদিতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো,
–“আম্মু একটু নূরদের বাসায় যাই?”

মিসেস অদিতি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–“একটু বাদেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এসময় ওদের বাড়িতে কেন? কাল সকালে যাস।”

–“এখনই যেতে হবে আম্মু যাই প্লিজ?”

মিসেস অদিতি মুচকি হাসলেন মেয়ের মুখভঙ্গি দেখে। অর্নির গালে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
–“উৎসব রেগে আছে বুঝি? আর তার রাগ ভাঙাতেই বুঝি আমার মেয়ে ও বাড়িতে যেতে চাইছে?”

অর্নি লজ্জা পেলো ক্ষানিকটা। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,
–“তুমি বুঝলে কি করে উৎসব ভাই রেগে আছে?”

–“অর্নব বলেছে।”

অর্নি ক্ষানিকটা সময় চুপ থাকলো। তারপর আবার বললো,
–“তাহলে আমি যাই এখন? যাবো?”

মিসেস অদিতি মুচকি হেসে বললেন,
–“আচ্ছা যা, সাবধানে কিন্তু হ্যাঁ? আর একা ফিরবি না কিন্তু। আসার আগে অর্নবকে ফোন করবি ও গিয়ে নিয়ে আসবে।”

অর্নি সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। মিনিট দশেকের মাথায় নূরদের বাসায় পৌঁছে গেলো। কলিংবেল চাপতেই শায়লা বেগম দরজা খুলে দিলেন। অর্নিকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
–“আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে? এই অসময়ে আপনার পায়ের ধুলো পড়লো যে আমার বাড়িতে?”

অর্নি ভিতরে ঢুকে বললো,
–“আমি বুঝি আগে আসতাম না।”

–“আসতি কিন্তু এমন অসময়ে না।”

–“এখন থেকে যখন ইচ্ছে হবে আসবো। নূর কোথায় আছে সেটা বলো।”

শায়লা বেগম অর্নিকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, –“নূর তো শুধু বাহানা। কেন এসেছিস বুঝি না আমি? তা আমার ছেলেকে ছাড়া থাকতে আর ইচ্ছে করছে না বুঝি?”

অর্নি লজ্জা পেয়ে বললো,
–“আন্টি তুমিও___”

শায়লা বেগম হাসতে হাসতেই বললেন,
–“বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। দাঁড়া খুব শীঘ্রই তোকে পার্মানেন্ট ভাবে এ বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি আমি।”

অর্নি লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। সাথে উৎসবের উপর ক্ষানিকটা রাগও হলো। এই ছেলের জন্য মিসেস অদিতি আর শায়লা বেগমও ওর লেগপুল করতে ছাড়ছে না। কি লজ্জায় বিষয়। ইশ্। শায়লা বেগম হেসে বললো,
–“আপনি যার কাছে এসেছেন সে নিজের ঘরেই আছে। তবে আপনার উপর রেগে আছে কিন্তু। গিয়ে দেখেন পারেন কিনা তার রাগ ভাঙাতে।”

অর্নি অসহায় চোখে তাকালো। শায়লা বেগম হেসে বললো,
–“আচ্ছা আচ্ছা, আর বলছি না। তুই যা।”

অর্নি কথা না বাড়িয়ে উপরে চলে গেলো। উৎসবের ঘর ক্রশ করার সময় উৎসবের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। দরজাটা এমনিতেই ভিরানো, লক করা নেই। অর্নি দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিলো। দেখলো উৎসব রুমের কোত্থাও নেই। অর্নি পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে। রুমের চারদিকটা ঘুরেফিরে দেখছি অর্নি। উৎসব ছেলে হয়েও কি সুন্দর নিজের ঘর পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে আর ওদিকে অর্নির ঘর এখনো মিসেস অদিতি গুছায়।

ব্যালকোনি থেকে রুমে আসতেই উৎসবের চোখ আটকায় অর্নির উপর। কালো রঙের শর্ট কূর্তি পড়েছে। উৎসব পলকহীন দেখছে অর্নিকে। অর্নির চোখ উৎসবের উপর পড়তেই অর্নি দরজার দিকে ছুট লাগায়। উৎসব গম্ভীর স্বরে বললো,
–“ঘরের বাইরে যাতে পা না পড়ে।”

উৎসবের এমন শান্ত গলায় কথা বলা শুনে অর্নির পিলে চমকে গেলো। এত শান্ত আছে উৎসব। তারমানে এটা নিশ্চয়ই ঝড় আসার পূর্বাভাস। উৎসব ক্ষানিকটা এগিয়ে বললো,
–“এদিকে ঘুরো।”

অর্নি রোবটের মতো উৎসবের কথা মেনে নিয়ে উৎসবের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। উৎসব বললো,
–“এখানে কি করছো?”

–“না মানে__”

–“সোজাসাপটা ভাবে বলো। কি করছিলে এখানে?”

অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“কিছু না তো, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।”

কথাটা বলতেই উৎসব দাঁতে দাঁত চিপে বললো,
–“যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি আমি?”

অর্নি দু দিকে মাথা নাড়ালো৷ যার অর্থ উৎসব ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়নি৷ উৎসব আরো দু কদম এগিয়ে এসে বললো,
–“তাহলে যাচ্ছিলে কেন?”

কথাটা বলে অর্নির দিকে এগোতে লাগললো। অর্নি ভয় পেয়ে রুমের অন্যদিকে সরে গেলো। উৎসব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আবার অর্নির দিকে ঘুরে বললো,
–“সমস্যা কি?”

–“সমস্যা আমার না তো। সমস্যা তো আপনার।”

উৎসব ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“হোয়াট? আমার সমস্যা?”

–“হ্যাঁ আপনারই তো সমস্যা৷ আপনার যদি সমস্যা না হয়ে থাকে তাহলে কথা বলছেন না কেন আমার সাথে? এভাবে গম্ভীর স্বরে কেউ কথা বলে?”

উৎসব বললো,
–“কেন কথা বলবো? আর যদিও বা বলি তাহলে এরকম গম্ভীর স্বরেই কথা বলবো।”

–“নাহ, এভাবে গম্ভীরস্বরে না। একটু হেসে মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন না?”

উৎসব এগিয়ে গিয়ে অর্নিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। বললো,
–“হেসে আর মিষ্টি করে কথা বলার মতো কোন কাজটা করেছো তুমি?”

অর্নি চুপ হয়ে গেলো। মথা নিচু করে নিলো। উৎসব অর্নির দিকে আরো কিছুটা ঝুঁকে বললো,
–“কে তুমি? তোমার সাথে আমার মিষ্টি করে কথা কেন বলতে হবে?”

অর্নি চোখ তুলে তাকালো। চোখদুটো জলে টইটম্বুর হয়ে আছে। লোকটাকে মনে হয় বড্ড বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে অর্নি। মনে মনে কথাটা ভাবলো। ধরা গলায় বললো,
–“আপনি না আমায় ভালোবাসেন?”

উৎসব অর্নির কথার জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,
–“তুমি ভালোবাসো আমায়? একবারো ভালোবাসি বলেছো? ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে তো এনগেজমেন্ট করে নিয়েছিলে। একবারো বাসায় জানানোর চেষ্টা করেছিলে? করোনি। তাহলে তো ধরে নেওয়া যায় তুমি আমাকে ভালোবাসো না৷ আর ভালোবাসো না বলেই এনগেজমেন্ট করতে রাজি হয়েছিলে। তাহলে যে আমায় ভালোবাসে না তার সাথে কোন স্বরে কথা বলবো আমি?”

অর্নি বিড়বিড় করে বললো,
–“ভাইয়ার সামনে না বললাম?”

–“সেটাতো তোমার ভাই প্রশ্ন করেছে তাই ছোট্ট করে ‘হুম’ বলেছো। আমায় ভালোবাসি বলেছো একবারো?”

–“বলতে হবে কেন উৎসব ভাই? আপনি বোঝেন না? ”

উৎসবের এবার রাগ হলো প্রচুর। এমনিতেই অর্নির উপর চটে আছে তার উপর আবার ভাই ডেকে মাথাটা বিগড়ে দিলো। অর্নিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ওর সামনে থেকে। তারপর বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বললো,
–“না বুঝি না আমি। আমাকে মুখে ভালোবাসি বলতে হবে। নয়তো কোনোদিনও বুঝবো না আমি।”

অর্নি ধীর পায়ে উৎসবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বললো,
–“উৎসব ভা___”

উৎসব চোখ রাঙিয়ে তাকালো। অর্নি সাথে সাথেই চুপ হয়ে যায়। অর্নির মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। একটা শুকনো ঢুক গিলে বলে,
–“আচ্ছা ভাই বলছি না।”

উৎসবের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। অন্যদিকে ঘুরে লম্বা করে কয়েকটা শ্বাস নিলো। তারপর বললো,
–“হ্যাঁ বলো__”

–“আপনি আমার উপর রাগ করে থাকবেন না প্লিজ। আপনার নিরবতা কষ্ট দেয় আমাকে।”

–“যতদিন না ভালোবাসি বলবে নিজ মুখে ততদিন আমার নিরবতা তোমাকে কষ্টই দিবে।”

অর্নি অসহায় চোখে তাকালো উৎসবের দিকে। উৎসব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পড়লো। অর্নি পেছন পেছন ওখানেও গেলো। উৎসবকে টেনে তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অর্নির কাজে উৎসব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। প্রথমে অবাক হলেও পরে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো। উৎসব নিজেও অর্নিকে একদম মিশিয়ে নিলো নিজের বুকের মাঝে।

চলবে~