#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|২৬|
শায়লা বেগম অর্নি আর নূরকে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেলেন ওদের কাছে। অর্নিকে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখে প্রশ্ন করলেন,
–“কি হয়েছে? এভাবে হাঁটছিস কেন?”
অর্নি মেকি হেসে বললো,
–“কিছু না মা, নূর একটু পায়ে চোট পেয়েছে মেডিসিন লাগিয়ে দাও ওকে।”
কথাটা বলে অর্নি কেটে পড়তে চাইলেই শায়লা বেগম ওর হাত ধরে বললো,
–“তোর পায়ে কি হইছে?”
অর্নি কিছু বলার আগেই নূর বললো,
–“পা কেটেছে, ওকে নিয়ে সোফায় বসাও আমি মেডিসিন বক্স নিয়ে আসছি ড্রেসিং করিয়ে দিবা।”
শায়লা বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,
–“তোরা দুজনে চাইছিসটা কি বল তো? দুজনেই পায়ে ব্যাথা পেয়ে এসেছিস এসব যদি উৎসব এসে দেখে দুজনের একজনকেও আস্তো রাখবে না।”
নূর কিছু না বলে মেডিসিন বক্স আনতে গেলো। অর্নি সোফায় বসে পা টি-টেবিলের উপর তুলে বললো,
–“বলবে না তোমার ছেলেকে, তাহলেই হবে।”
–“আমার কষ্ট করে বলতে হবে না, সে এমনিতেই দেখবে। আপনি তো তার কাছেই থাকবেন।”
শায়লা বেগমের কথায় অর্নি বললো,
–“উঁহু, নূর আর আমি একসাথে থাকবো আজ।”
–“সে আমার ছেলে তোকে থাকতে দিলে তুই নূরের ঘরে থাকবি, সমস্যা কি?”
অর্নি এবার অসহায় চোখে তাকালো। ও জানে উৎসব ওকে কিছুতেই থাকতে দিবে না নূরের ঘরে৷ কিন্তু যে করেই হোক আজ থাকতে হবে। মনে মনে ঠিক করে নিলো অর্নি। নূর শায়লা বেগমের হাতে মেডিসিন বক্স দিয়ে ও নিজেও সোফায় বসলো। তারপর বা পায়ের উপর ডান পা তুলে গোড়ালিতে বরফ লাগাচ্ছে। শায়লা বেগম আলগোছে অর্নির পা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বেশ ক্ষানিকটা পা কেটেছে অর্নির। শায়লা বেগম এবার উঠে গিয়ে নূরের ব্যাথা স্থানে ঔষধ লাগিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন দুজনে একই সাথে পায়ে চোট পেলো কি করে? নূর সংক্ষেপে সবটা বললো শায়লা বেগমকে। সব শুনে শায়লা বেগম বেশ বকাবকি করলেন দুজনকেই। নূর আর অর্নি চুপ চাপ বকাগুলো হজম করছে।
ঘড়ির কাটায় রাত আট-টা বাজতেই অর্নি আর নূর একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। উৎসবের আসার সময় হয়ে গেছে। এখন কি হবে? নূর দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলো। অর্নি শায়লা বেগমকে ডেকে বললো,
–“মা, আমি নূরের সাথে থাকবো। তোমার ছেলে জিজ্ঞেস করলে বলবে ঘুমিয়ে পড়েছি আমরা, ডাকাডাকির কোনো দরকার নেই।”
–“পারবো না আমি। তোদেরটা তোরা সামলা, যাওয়ার আগে বারবার বারন করেছিলাম আমি।”
–“প্লিজ মা, তুমি না আমার লক্ষি শাশুমা? এইটুকু কথা রেখো প্লিজ।”
অর্নি শায়লা বেগমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খুড়িয়ে খুড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। শায়লা বেগম দরজা খুলে দিলো। অর্নি পেছন ফিরে একপলক উৎসবকে দেখে কাটা পা নিয়েই দৌড়ে নূরের ঘরে চলে গেলো। কাটা পা নিয়ে দৌড়ানোর ফলে পায়ে বেশ ব্যাথাও লেগেছে তবে সেটা এই মূহুর্তে গাঁয়ে মাখলো না অর্নি। উৎসব হাতে রাখা কোর্ট এবং অফিস ব্যাগটা টি-টেবিলে রেখে সোফায় বসে শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে ফেললো। টাই ঢিলে করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
–“ওরা ফিরেছে বাসায়?”
শায়লা বেগম উৎসবের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“হ্যাঁ।”
উৎসব দোতলায় তাকালো। আধা গ্লাস পানি পান করে বললো,
–“দেখছি না যে একজনকেও।”
শায়লা বেগম কি বলবেন ভেবে পেলো না। ক্ষানিক সময় নিরব থেকে বললেন,
–“নূরের ঘরে দুজনেই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।”
উৎসব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বললো,
–“এ সময়ে ঘুমোচ্ছে__”
–“ক্লান্ত ছিলো তো তাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি ডেকেছিলাম বললো খাবে না কেউ, আর যাতে ডাকাডাকি করে বিরক্ত না করি।”
ভ্রু কুঁচকালো উৎসব৷ ক্ষানিক সময় শায়লা বেগমের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পানির গ্লাসটা টি-টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো। কোর্ট আর অফিস ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো,
–“আচ্ছা, রুমে যাচ্ছি আমি।”
ছেলেকে যেতে দেখে শায়লা বেগম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ আর একটু হলেই বোধহয় ধরা পড়ে যেতো। ছেলের যা জহুরি চোখ। উৎসব কয়েক সিড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। সিড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে কপাল কুঁচকালো। দোতলার করিডোরে উঠেও দেখতে পেলো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ-গুলি নূরের ঘর অব্দি গিয়েছে৷ এবার রেলিঙে হাত রেখে নিচ দিকে ঝুঁকে গলা ছেড়ে বললো,
–“আম্মু___”
হদতন্ত হয়ে ছুটে এলেন শায়লা বেগম। ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
–“কি হয়েছে? এভাবে ডাকছিস কেন?”
–“সিড়ি আর উপরের করিডোর জুড়ে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে কেন?”
ছেলের প্রশ্নে ঘাবড়ে গেলেন শায়লা বেগম। আমতা আমতা করে বললো,
–“ক্ কই? আমি তো এক্ একটু আগেই___”
–“কিছু লুকোচ্ছো আমার থেকে?”
শুকনো ঢোক গিললেন শায়লা বেগম। ছেলের রাগ সম্পর্কে তিনি অবগত। একবার যদি জানতে পারে দুজনে আজ কি কান্ড ঘটিয়ে এসেছে তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। শায়লা বেগম বললেন,
–“আসলে__”
–“থাক, আর বলতে হবে না। আমিই দেখে নিচ্ছি।”
কথাটা বলে নিজের রুমে অফিস ব্যাগ আর কোর্ট রেখে নূরের রুমের দিকে পা বাড়ালো। শায়লা বেগমও ছুটলো ছেলের পেছনে। উৎসবের আঁচ পেয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে দুজনেই। দুজনেই বুক অব্দি কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। নূর পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমানোর ভাণ ধরছে। আর অর্নি উপুর হয়ে শুয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। এই গরমে দুজনকে কাঁথা গায়ে দিতে দেখে অবাক হলো উৎসব। প্রথমেই নূর শুয়েছে। উৎসব নূরের পায়ের কাছ থেকে কাঁথা সরিয়ে বা পা ভালোভাবে দেখে ডান পা হাতে নিতেই মৃদু চিৎকার করে উঠলো নূর৷ উৎসব পা ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতটা ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। তারপর নূরের পায়ের দিকে তাকালো। ঔষধ লাগানো আছে নূরের পায়ে। উৎসব তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
–“উঠে বস।”
নূর চুপচাপ উঠে বসলো। অর্নি তখনো চোখমুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে৷ উৎসব সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“পায়ে ব্যথা পেলি কিভাবে?”
–“প্ পড়ে গেছিলাম।”
থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–“কিভাবে?”
–“সি্ সিড়ি দিয়ে উঠতে___”
–“মিথ্যে বলছিস, ব্যাপার না। সত্যিটা ঠিক বের করে নিবো৷ ফ্লোরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ কেন?”
এবার আমতা আমতা করছে নূর। কি জবাব দিবে? নূরকে চুপ থাকতে দেখে উৎসব অর্নির উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে দিলো। দেখলো বা পা-টা ব্যান্ডেজ করা। একটানে শোয়া থেকে তুলে বসালো অর্নিকে। বাঁজখাই গলায় প্রশ্ন করলো,
–“দুজনেরই পায়ের এ অবস্থা কেন? একই সাথে দুজনে পায়ে চোট পাওয়া, এটা নিশ্চয়ই কোনো কাকতালীয় ব্যাপার না। কি আছে এর পিছনে দ্রুত বলো।”
–“কি্ কিছু নেই তো এর পেছনে, কি থা্ থাকবে? একসাথে কি দুজনের___”
–“জাস্ট শাট-আপ অর্নি। একদম মিথ্যে বলবে না। তুমি খুব ভালো করেই জানো মিথ্যে বলা পছন্দ করি না আমি।”
উৎসবের ধমকে চুপসে গেলো অর্নি৷ শায়লা বেগম এগিয়ে এলো৷ উৎসবের হাত ধরে বললো,
–“বাবা শোন না__”
উৎসব এবার মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো। বললো,
–“তুমিও মিথ্যে বলছিলে এতক্ষণ?”
–“পুরো কথাটা শোন আগে___”
–“তুমি কিচ্ছু বলবে না আম্মু, যা বলার অর্নি আর নূর বলবে।”
বলে ওদের দুজনের দিকে আবারো তাকালো। দুজনকে চুপ থাকতে দেখে জোরে ধমক দিলো উৎসব। অমনিই দুজনে গড়গড় করে সব বলে দিলো। উৎসব ধমকে উঠলো নূরকে। নূরকে থাপ্পড় দিতে হাত উঠিয়েও আবার নামিয়ে নিলো। শক্ত করে নূরের হাত চেপে ধরে বললো,
–“বড্ড সাহস বেড়েছে দুজনের তাই না? যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছিস। পাখা গজিয়েছে না? একদম গোড়া থেকে পাখা ছেটে দিবো। তারপর দেখবো উড়িস কিভাবে।”
উৎসবের এমন কথা আর ধমকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো নূর। অর্নির চোখ জলে ভরে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“ওকে ব্ বকছেন কেন? প্ল্যা্ প্ল্যান আ্ আমার ছিলো।”
উৎসব অর্নির দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললো,
–“তুমি তো কোনো কথাই বলবে না। নূরকে একা বকছি বলে ভেবে নিও না তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে।”
কথাগুলো বলে অর্নির হাত ধরে টানতে টানতে নিজেদের ঘরের দিকে নিয়ে গেলো।
–
বিছানার এক কোনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসে আছে অর্নি। উৎসব চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে অর্নির দিকে তাকালো এক পলক। তারপর ভেজা টাওয়ালটা ব্যালকোনিতে রেখে রুমে এলো। দুহাতে চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে বিছানার দিকে এগোতেই অর্নি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো। উৎসবের রাগ এখনো বিন্দু পরিমান কমেনি। চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। অর্নির সামনে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এত সাহস পেলে কোত্থেকে? কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে নিজেরা নিজেরা পাকনামি করতে চলে গেছিলে। জানানোর প্রয়োজন মনে করেছিলে একবারো?”
–“ওরা দুজন দুজনকে ভা্ ভালোবাসে__”
–“হ্যাঁ তো? সেজন্য তোমরা ওখানে চলে যাবে বিয়ের কনে ভাগানোর জন্য? আমাকে জানাতে পারতে বিষয়টা আমি দেখে নিতাম। কিন্তু না সবকিছুতে তো তোমাদের থাকা লাগবে। একটা না একটা গোলমাল তো দুজনকে পাকাতেই হবে তাই না?”
চুপ করে রইলো অর্নি। উৎসব শক্ত হাতে অর্নির গাল চেপে ধরে বললো,
–“ভালোবাসি বলে ভেবো না যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে আর আমি কিচ্ছু বলবো না। তুমি__”
চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো অর্নির। অস্ফুটস্বরে বললো,
–“লা্ লাগছে আমার___”
অর্নির গাল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো,
–“লাগুক, লাগার জন্যই ধরেছি। নেক্সট টাইম ভার্সিটি ছাড়া বাসা থেকে এক পা ও বের করবে না তুমি। এমন কি নূর আর তুমি একা একা কোথাও যেতেও পারবে না। প্রয়োজন হলে আমি নিয়ে যাবো। তাছাড়া দুজনে বাসা থেকে বের হওয়া টোটালি অফ।”
–“আপ্ আপনি এবার কি বে্ বেশি বা্ বাড়াবাড়ি করছেন না?”
রাগ হলো উৎসবের। একেই তো কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে এরকম একটা কাজ করেছে তার উপর আবার কথা বলছে৷ উৎসব একটানে অর্নিকে বিছানা থেকে উঠিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। কঠোর গলায় বললো,
–“বাড়াবাড়ি আমি করছি? আমার এইটুকু রিয়্যাক্ট তোমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে___”
পুরো কথা বলার আগেই দরজায় টোকা পড়লো৷ উৎসব অর্নিকে ছেড়ে দিয়ে লম্বা দুটো শ্বাস নিলো। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। থমথমে গলায় অর্নিকে বললো,
–“দরজা খুলো গিয়ে।”
অর্নি গুটিগুটি পায়ে দরজা খুলে দিলো। নূর দাঁড়িয়ে আছে। নূর এক পলক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অর্নিকে বললো,
–“রুমে আয়, কথা আছে।”
অর্নিও নূরের সাথে পা বাড়াতেই উৎসব বললো,
–“যা কথা বলার এখানে আমার সামনে হবে।”
নূর ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। অর্নি ইশারা করলো বলার জন্য। নূর ধীর গলায় বলতে শুরু করলেই উৎসব বললো,
–“শুনতে পাচ্ছি না আমি।”
এবার নূর ক্ষানিকটা জোরে আমতা আমতা করে বললো,
–“রুশান ফোন করেছিলো। ওদের বিয়ে নিয়ে বাসায় ঝামেলা হচ্ছে। তরীর মামা-মামী পুল্ পুলিশ নিয়ে রুশানদের বাসায় গিয়েছে৷ রুশান বি্ বিয়ের কাবিননামা দেখালে উনারা সেটিকে নাকোচ করে দেয়। জানায় ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক ওদের বিয়ে সম্পন্ন হয়নি। তাই এই বিয়ে বাতিল করা হবে।”
উৎসব চুপচাপ শুনছে সবটা। অর্নি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেন? হবে না কেন? আমর না কাজীকে এতগুলা টাকা দিলাম বিয়েটার জন্য, তারপরও হবে না কেন?”
–“কাবিননামায় সাক্ষী হিসেবে শুধু তোর আর আমার সাইন আছে অর্নি। এতে হবে না। শরিয়ত অনুযায়ী ম্যাচিউর দুজন ছেলে সাক্ষী লাগবে। ওরা কেউ বিয়েটা মানছে না, তরীকে নিয়ে যেতে চাইছে।”
অর্নি কাঁদোকাঁদো চেহারায় বললো,
–“এখন কি হবে তাহলে? আমাদের এত কষ্ট বিফলে যাবে?”
এতক্ষণে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উৎসব। ওদের দুজনের সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“বেশি বুঝলে এমনই হয়। কে বলছিলো একা একা পাকনামি করতে? তোরা দুজনেই তো বাচ্চা, ইম-ম্যাচিউর দের মতো আচরণ করিস। তাহলে বিয়ের মতো একটা সিরিয়াস ব্যাপারে সাক্ষী হিসেবে তোদের সাইন গণ্য করা হবে কেন?”
নূর আর অর্নি দুজনেই অসহায় চোখে তাকালো উৎসবের দিকে৷ অর্নি বললো,
–“তাহলে কাজী সাহেব যে টাকাগুলো নিয়ে বিয়ে দিতে রাজি হলো___”
–“দুইটাই বলদ। গিয়েছিলে না বিয়ে দেওয়ার জন্য? দিছো বিয়ে? উল্টো আরো গোলমাল পাকিয়ে আসছো।”
অর্নি আর নূর দুজনে করুন চোখে তাকালো। নূর গিয়ে উৎসবের একটা হাত ধরে বললো,
–“ভাইয়া কিছু করো না, ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।”
নূরের কথায় তাল মিলিয়ে অর্নিও বললো,
–“প্লিজ তরী আর রুশানকে আলাদা হতে দিবেন না। আমাদের জন্য হলেও এইটুকু করে দিন প্লিজ।”
উৎস কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলে,
–“শুরুতে বলছিলা? শুরুতে জানালে এরকম কোনো ঝামেলাই হতো না।”
নূর আর অর্নি মাথা নামিয়ে নিলো। উৎসব ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আচ্ছা দেখছি আমি___”
কথাটা শুনে ওদের দুজনের মুখেই হাসি ফুটে উঠলো। উৎসব ফোনে কাউকে কল করতে করতে ব্যালকোনিতে চলে গেলো।
চলবে~
#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|২৭|
তরীর মামা-মামী কিছুতেই মানতে চাচ্ছেন না রুশান আর তরীকে। রুশানের বাবা মা প্রথমে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। উৎসব বোঝাতে আর একমাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেন সম্পর্কটা। এখন ঝামেলা হচ্ছে তরীর মামা-মামী কে নিয়ে। শেষে উৎসব তরীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–“তোমার বয়স কত?”
–“স্ সতেরো।”
–“আঠারো হতে কতদিন বাকী?”
–“আড়াই মাস।”
উৎসব এবার তরীর মামা-মামীর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“বয়স আর সাক্ষীর জন্য বিয়ে বাতিল করেছিলেন না? তাহলে এইটুকুন বয়সে আপনারা ওর বিয়ে কিভাবে দিচ্ছিলেন? মেয়ে নিজের পছন্দের ছেলের সাথে পালিয়ে এসেছে আর অমনি মনে হলো মেয়ের বিয়ের বয়স হয়নি তাই না?”
তরীর মামা-মামী চুপ করে রইলেন। একজন পুলিশ বললেন,
–“আপনারা যে অভিযোগ করেছেন এই ছেলের বিরুদ্ধে সেই একই কাজ তো আপনারাও করছিলেন।”
তরীর মামা আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আসলে___”
শক্ত কন্ঠে উৎসব বললো,
–“কোনো আসলে নকলে নেই। আজ থেকে ঠিক আড়াই মাস পরে রুশান আর তরীর বিয়ে হবে৷ আর সেটা রুশানের পরিবার এবং আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিবো। আপনারা কিভাবে আটকাবেন আটকে দেখান।”
তরীর মামা তরীর হাত ধরে বললো,
–“আমাদের মেয়েকে ওর সাথে বিয়ে দিবো না।”
–“তরী যাবে না আপনাদের সাথে।”
উৎসবের কথায় একজন পুলিশ বাঁধা দিয়ে বলেন,
–“উনারা চাইলে উনাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে, এখানে আপনি বাঁধা দিতে পারবেন না।”
–“তরীকে জিজ্ঞেস করুন, ও যেতে চায় কিনা।”
উৎসবের কথায় একজন পুলিশ তরীকে এই কথা জিজ্ঞেস করলে ও সাথে সাথে নাকোচ করে দেয়। পুলিশ বলেন,
–“ও এখনো এডাল্ট হয়নি, তাই এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ও নিতে পারবে না।”
অর্নির আর নূরের রাগ হচ্ছে ভীষণ। তরীর মামা-মামী কে জাস্ট খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অর্নি এগিয়ে গিয়ে তরীর ডান হাতের উপর পিঠ এবং ঘাড়ে থেকে চুল সরিয়ে ঘাড় দেখিয়ে বললো,
–“দেখুন, উনারা কি রকম অত্যাচার করে মেয়েটাকে। উনাদের পছন্দমতো বিয়েতে রাজি না হওয়াতে মেরে এই হাল করেছে মেয়েটার।”
নূর বললো,
–“এরপরও বলবেন তরী উনাদের সাথে যাবে? না জানি এখন আবার বাসায় নিয়ে বিয়ে না করে রুশানের সাথে পালিয়ে আসার জন্য খুন করে মাটিচাপা দিয়ে দেয় ঠিক নেই। তার থেকে ভালো তরী আমাদের সাথে আমার বাসায় যাবে৷ আর আড়াই মাস পর রুশানের সাথে বিয়ে হবে ওর।”
পুলিশের লোক তরীর মুখ থেকে সবকিছু শুনলেন। নানান তর্ক-বিতর্ক এর পর উৎসব তরীকে রাখতে সক্ষম হয়। তরীর মামা-মামী আর পুলিশ চলে যান। উৎসব রুশানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“আড়াই মাস পরেই বউ করে ঘরে তুলবে, ততদিন তরী আমাদের বাসায় থাকবে।”
রুশান উৎসবকে জাপ্টে ধরে বললো,
–“থ্যাংকস ভাই, আজ আপনি না থাকলে__”
–“থ্যাংকস বলার মতো কিচ্ছু হয় নি, আসছি।”
কথাটা বলে উৎসব বেরিয়ে পড়লো রুশানদের বাসা থেকে। নূর অর্নি তরী ওরাও রুশান আর ওর বাবা মাকে বলে বেরিয়ে এলো।
উৎসব ড্রাইভ করছে, পাশেই অর্নি বসা। নূর আর তরী পেছনে বসেছে। অর্নি উৎসবের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“থ্যাংকস আপনাকে, আমাদের কথা রাখার___”
–“এখানে এসেছি, তরীকে নিয়ে যাওয়া থেকে আটকিয়েছি বলে ভেবো না যা যা করেছো তা ভুলে যাবো আমি। তোমাদের বাসা থেকে বেরোনো বন্ধ মানে বন্ধ। আর তোমার পানিশমেন্ট আমি বাসায় গিয়ে দিচ্ছি।”
–
রাতের খাবার খেয়ে অর্নি শায়লা বেগমের সাথে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। সাথে তরী আর নূরও আছে। নূরের আব্বু নিজের ঘরে চলে গিয়েছেন খাবার খেয়ে। উৎসবও নিজের রুমেই আছে। পানিশমেন্ট এর ভয়ে অর্নি ঘরে যেতে চাচ্ছে না। নূরের ফোন বাজাতে ও উঠে চলে গেলো। ফোন রুমে রেখে এসেছে। এখন নিশ্চয়ই শান্ত ফোন দিয়েছে। নয়তো এত রাতে ফোন দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। নূর উৎসবের ঘর ক্রস করার সময় উৎসব ডেকে বললো,
–“অর্নি কোথায়?”
–“ও তো নিচে আম্মু আর তরীর সাথে আড্ডা দিচ্ছে।”
এইটুকু বলেই প্রস্থান করলো নূর। দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ইতিমধ্যে দুবার ফোন বেজে কেটে গেছে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত বললো,
–“আজকাল বড্ড বেশিই ব্যস্ত মনে হচ্ছে ম্যাডামকে? আমার কথা তো স্মরণই থাকে না।”
–“তেমন কিছু না, আসলে একটু ঝামেলায় ফেঁসে গেছিলাম___”
শান্ত বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–“কিসের ঝামেলা? কিছু হয়নি তো তোমার? ওদিকে সব ঠিক আছে?”
নূর সব ঘটনা খুলে বললো শান্তকে। সব শুনে শান্ত একচোট হেসে নিলো। নূর ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“আপনি হাসছেন? জানেন কত রিস্ক নিয়ে কাজটা করেছিলাম।”
–“হ্যাঁ এত রিস্ক নিয়ে করেছো বলেই সম্পূর্ণ করতে পারোনি। তোমাদের জন্য বেচারা রুশানকে আরো আড়াই মাস অপেক্ষা করতে হবে।”
নূর কিছু বললো না। শান্ত বললো,
–“পায়ের ব্যাথা কমেছে?”
–“উহুঁ__”
–“মেডিসিন নাও আপাতত, কাল ডক্টর এর কাছে যাবে।”
এরকম ভাবেই টুকটাক কথা চলতে লাগলো দুজনের। বেশ ক্ষানিকটা সময় বাদে তরী এসে শুয়ে পড়লো৷ তরীর ঘুমে ডিস্টার্ব হবে ভেবে নূর কথা বলতে বলতে ব্যালকোনিতে চলে গেলো।
–
ঘড়ির কাটায় পাক্কা এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। শায়লা বেগম ভ্রু কুঁচকে অর্নির দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
–“মতলব কি তোর? রুমে যাচ্ছিস না কেন?”
–“মা থাকো না এখানে, দিব্যি তো গল্প করছিলাম। আরো কিছু সময় থাকি না।”
–“সাড়ে এগারোটা বাজে অর্নি। ঘুমাবি না? এমনিতেই পা কেটেছে অনেকটা। যা ঘুমিয়ে পড়।”
–“উঁহু।”
ভ্রু কুঁচকে তাকালেন শায়লা বেগম। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–“ঝগড়া করেছিস আবার দুজনে?”
অর্নি কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,
–“তোমার ছেলের রাগ কমেনি এখনো। বাসায় ফেরার সময় বলেছে পানিশমেন্ট দিবে। আমি যাবো না ঘরে।”
শায়লা বেগম মুচকি হেসে অর্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–“আমার ছেলেটা তোকে বড্ড ভালোবাসে তো। বেশি কঠিন পানিশমেন্ট দিতে পারবে না তোকে। যা ঘরে যা। উৎসব নিশ্চয়ই তোর অপেক্ষায় আছে।”
–“যাবো?”
শায়লা বেগম কিছু বলার আগেই উৎসব ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললো,
–“অর্নি কয়টা বাজে এখন? ঘরে আসছো না কেন? ঘুমাবো তো আমি, অফিস আছে সকালে।”
এর আগেও দু বার ডেকেছে উৎসব অর্নি সারা দেয়নি। শায়লা বেগম মুচকি হাসলেন ছেলের কথায়। অর্নিকে বললো,
–“ঘরে যা, তুই না গেলে ও ঘুমাবে না।”
অর্নি তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো৷ তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে উপরে নিজেদের ঘরে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করতেই উৎসব এসে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এতক্ষণ নিচে কি করছিলে? আমার ডাকে সারা দাওনি কেন?”
অর্নি ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“আপনি না ঘুমাবেন? তাহলে এখনো ঘুমাননি যে। অফিস আছে না সকালে?”
–“মজা করছো আমার সাথে? তোমাকে ছাড়া এখন ঘুম হয় না আমার। তাছাড়া তুমি পানিশমেন্ট এর কথা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি।”
শুকনো ঢোক গিললো অর্নি। উৎসব বিছানায় বসে বললো,
–“কানে ধরে উঠবস করো দশবার ফাস্ট।”
উৎসবের কথায় অর্নি থতমত খেয়ে গেলো। বোকা বোকা ভাবে প্রশ্ন করলো,
–“আমাকে ক্লাস ওয়ান টু এর বাচ্চা মনে হয়? যে পড়া পারিনি তাই এখন কানে ধরে উঠবস করতে হবে।”
–“বাচ্চাদের থেকে কোনো অংশে কম না। এখন যা বলেছি তাই করো।”
–“নাহ___”
–“পনেরো বার।”
–“দেখুন___”
–“বিশ বার। তুমি যতবার কথা বলবে ততবার পাঁচবার করে বারবে। কানে ধরে উঠবস তো তোমায় করতেই হবে।”
অর্নি কাঁদোকাঁদো ভাবে কানে ধরে বললো,
–“উঠবস না করি প্লিজ?”
–“উঁহু, চলবে না। উঠবস করতে হবে।”
অর্নি কোনো উপায় না পেয়ে কানে ধরে উঠবস করতে লাগলো। ছয়বার উঠবস করতেই উৎসব গিয়ে জড়িয়ে ধরলো অর্নিকে। বললো,
–“নেক্সট টাইম কোনো উল্টাপাল্টা করার আগে এই কানে ধরে উঠবস করার কথাটা যাতে মাথায় থাকে।”
অর্নি গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো৷ আচমকাই উৎসব অর্নিকে কোলে তুলে নিলো। অর্নি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বললো,
–“করছেনটা কি?”
–“পা কি অনেকটা কেটেছে? ব্যাথা করছে খুব তাই না?”
অর্নি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বললো,
–“বাসায় ফিরেছেন পর থেকে রেগে আছেন, চিৎকার চেঁচামেচি করছেন আমার উপর। তার উপর আবার এতক্ষণ কাটা পা নিয়ে কানে ধরে উঠবস অব্দি করালেন। আর এখন আসছেন এই কথা জিজ্ঞেস করতে?”
উৎসব অর্নির নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বললো,
–“পানিশমেন্ট দরকার ছিলো। তবুও প্রথম বার বলে অল্পতে বেঁচে গেলে। নেক্সট টাইম একদম পার পাবে না। এখন বলো ব্যথা কি এখনো অনেক আছে?”
অর্নি কিছু বললো না। উৎসব অর্নিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মেডিসিন বক্স এনে বসলো অর্নির পায়ের কাছে৷ অর্নির পায়ে হাত দিতে গেলেই অর্নি দ্রুত পা সরিয়ে বলে,
–“কি করছেন? পায়ে হাত দিচ্ছেন___”
উৎসব অর্নির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে বললো,
–“হুশশশ! একটাও কথা না। এতক্ষণ পানিশমেন্ট এর দরকার ছিলো বলে দিয়েছি। এখন বউয়ের যত্ন নেওয়া দরকার তাই নিচ্ছে। কোনো কথা হবে না।”
উৎসব ধীরে ধীরে অর্নির পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে কাটা জায়গা আবারো পরিষ্কার করে দিলো। জায়গাটায় আবারো ক্ষানিকটা রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে গেছিলো। উৎসব ভালো করে পরিষ্কার করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। বললো,
–“বেশ অনেকটা কেটেছে৷ সাবধানে হাঁটা-চলা করবে। আর পা ভালো না হওয়া অব্দি তুমি বা নূর কেউ-ই ভার্সিটি যাচ্ছো না। মাথায় থাকে যেন।”
অর্নি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো৷ উৎসব উঠে গিয়ে অর্নির পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে৷ অর্নিও পাখির ছানার মতো লেপ্টে রইলো উৎসবের বুকে। উৎসব অর্নির মাথা তুলে ঠোঁটে চুমু খেলো ক্ষানিকটা সময়ের জন্য। তারপর কপালে চুমু দিয়ে আবারো অর্নিকে জাপ্টে ধরে চোখ বন্ধ করলো।
চলবে~