তুমিময় মোহ পর্ব-০১

0
56

#তুমিময়_মোহ
®সুমাইয়া মনি

১.
ছোট বেলার সে’ক্সু’য়া’লি হ্যারেজমেন্ট করতে চাওয়া সেই ব্যক্তিটি বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে সামাইরার বাবার নিকটে। ব্যাপারটা বিদঘুটে, মর্মভেদী! যখন সামাইরা বিষয়টি জানতে পারলো হতবাক সে! চোখের দৃষ্টিতে বিক্ষিপ্তভাবে মর্মান্তিক দৃশ্যটি ভেসে উঠলো। নিঃশ্বাস কান্নার প্রভাবে ভারী হয়ে এলো। চোখের কার্ণিশ উপেক্ষা করে অশ্রুবর্ষিত হচ্ছে। নেত্রপল্লব বরাবর ফেলে কান্না দমিয়ে ড্রইংরুমের দিকে অগ্রসর হলো। ঠিক তখনই মায়ের হাত টান অনুভব করে পেছন থেকে। হুমাইরা বানু কপট কণ্ঠে বললেন,
‘রেডি না হয়ে কোথায় চললি? একটু পরেই মেহমান এলো বলে।’
তিনি কথাটি চাপিয়েই চললেন বাহিরে। সামাইরার বান্ধবী রাধিকা ভেতরে প্রবেশ করল। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘হঠাৎ আন্টি জরুরী তলব দিলো যে? কী ব্যাপার?’
সামাইয়া জোর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল,
‘আয় বোস।’ পিছু পিছু এসে বিছানায় বসল রাধিকা। জানতে চাইলো,
‘এবার বল।’
‘আমার বয়স এখন বিশ। তার এখন চৌত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ হবে। আট বছর আগে ওনার কাছে সে’ক্সু’য়া’লি হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হতে যাচ্ছিলাম। আজ সেই লোকই আমায় বিয়ে করার প্রস্তাব রেখেছে।’
‘স্টপ! আমাকে বুঝিয়ে বল। এই ঘটনা কখনো শেয়ার করিস নি আমার কাছে।’
মুখ গোমড়া হয়ে এলো সামাইরার৷ নেত্রপল্লব ধীরে বন্ধ করে নিলো।
কিছু অতীত মানুষের জীবন রঙিন করে তুলে। আবার কিছু অতীত থাকে বিষের ন্যায় বিষাক্ত। সামাইরার অতীত ছিল তেমনই বিষাক্ত।
ছোট ভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত প্রাপ্ত মেহমানদের মধ্যে বাবার বন্ধুর পরিবারও নিমন্ত্রিত ছিল। তাঁদের একমাত্র ছেলে ইমরান ছিল টগবগে তরুণ যুবক। দেখতে মোটামুটি সুদর্শনের কাতারে পড়লেও চরিত্র ছিল অসুদ্ধ। কেবল শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছিল সামাইয়া। বারো বছরের সামাইরাকে দেখে কামনা-বাসনা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেল। একাকী ছলেবলে কৌশলে অবুঝ সামাইরাকে সবার অগোচরে ছাদে এনে বাজেভাবে স্পর্শ করতে লাগলো। সামাইরা বেশিকিছু না বুঝলেও এই স্পর্শ যে অসৎ ছিল তা ঢের বুঝতে পারছিল। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় বৃথা ফলস্বরূপ কান্না করতে লাগলো। ইমরান তার কামনা সম্পূর্ণ করার আগেই ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সামাইরাকে হুমকি ধামকি দিয়ে সেখান থেকে পালালো। ছোট সামাইরা সেদিনের পর থেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থতায় আক্রান্ত ছিল প্রায় তিন বছর। নিজের অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে। সেদিনের পর সব পুরুষের প্রতি তার অনিহা ছিল তীব্র থেকে তীব্রভাবে। স্কুলে, কলেজে মেয়ে বন্ধুর পাল্লা ভারী হলেও ছেলে বন্ধুর সংখ্যা ছিল শূন্য। সবে ইন্টারের পরিক্ষা শেষ হলো। এখনই বাবার বিয়ের চাপের কারণে ফের অসুস্থ অনুভব করছে তার মন ও মস্তিষ্ক। সামাইরা সম্পূর্ণ ঘটনা বলে চোখ খুলে তাকালো। নেত্রকোনায় জল চিকচিক করছে তার। সেগুলো মুছে রাধিকার পানে নজর ফেলে। সে করুণ গলায় শুধায়,
‘আগে কখনো বলিসনি কেন? কতবার আমাদের মাঝে মনমালিন্য হয়েছে আয়মান, মাহিনকে নিয়ে। তখনো বললি না। আমি তাহলে জোর করতাম না ওদের সাথে বন্ধুত্ব করতে তোকে।’
‘এসব মাথায় নেই এখন আর, বাদ দে।’
‘ঐ দিন সব বলে দিলে ভালো হতো সবাইকে। তারপর কি তোদের বাসায় আসেনি ইমরান?’ রাগি গলায় জানতে চাইলো।
‘নাহ! বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল।’
‘বুইড়ায় এখন ফিরে এসে প্রস্তাব দিচ্ছে বিয়ের তাই তো?’
‘হ্যাঁ!’ ছোট করে জবাব দিলো।
‘কোনো দরকার নেই তাকে বিয়ে করার। ছেলের অভাব পড়েনি দেশে।’
‘আমি এখন কী করব? এ বিয়ে হবেই। যে কোনো মূল্যে।’ নরম স্বরে জানালো।
‘আন্টিকে জানাবো সব।’
‘বিশ্বাস করবে না। আগে থেকেই ইমরান আব্বু – আম্মু ও সিয়ামের বিশ্বাস অর্জন করে বসে আছে। তার উপর এত বছর আগের ঘটনা। আর আমি তো আম্মুর সৎ মেয়ে। কিভাবে করবে আমাকে বিশ্বাস বল?’
রাধিকার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এলো। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে নিরুত্তর চেয়ে রইলো। জন্মের সময় নিজের মায়ের মৃ’ত্যু’র কারণ হয়ে দাঁড়ায় সে৷ বাবার দ্বিতীয় বিয়ে ফলে নতুন মায়ের ভালোবাসা পেয়েছে তা ঠিক। তবে আপন আর পর যে পার্থক্য হয় কমবেশি। তা সবারই জানা আছে। এটা সে নিজেও বুঝে।
‘ছাড়! আমায় রেডি হতে হবে।’ বলেই হতাশ হয়ে নিজেকে গোছাতে লাগলো। রাধিকা অসহায় হয়ে তাকে দেখছে। সুন্দর ভাবে শাড়ী-চুড়ি পড়ে। কপালে বিন্দুর ন্যায় ছোট্ট টিপ পড়ে, আঁখিযুগলে কাজল লেপ্টে নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পরমুহূর্তেই অশ্রু ঝড়ে টুপটাপ। রাধিকা পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বলে,
‘কান্না করিস না বান্ধবী। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।’
চোখ মুছে নিজেকে ছাড়িয়ে বাহিরে বের হলো। দু বার হুমাইরা বানু এসে ডেকে গেছেন। মেহমান এসেছে আরো মিনিট দশের আগে।
লম্বা একটি সালাম দিয়ে সোফায় বসলো সামাইরা। ইমরানের ভাই মিরান কয়েকটি ছবি তুলে তার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সেন্ড করল।
নতুন হবু ভাবি বলে কথা। সে বেশ খুশি। ইমরানের লালসার চাহনি ছিল তীব্র। যেটা না তাকিয়ে অনুভব করছে সামাইরা। অস্বস্তি লাগছে ভীষণ! আগে থেকে সামাইরাকে তাদের পছন্দ ছিল। না হবার কথাও নয়। রূপেগুনে মানানসই। মায়াবতী আদল তার। এক পলকে নজরে আসার মতো যে কারো। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে আগামী সপ্তাহে। হাতে রয়েছে ছয়দিন সময়। এত দ্রুত বিয়ে ঠিক হবার কারণ একটাই। ইমরান দু মাস বাদে আবার দেশের বাহিরে চলে যাবে। পরদিন থেকেই বিয়ের তোড়জোড় আরম্ভ হয়েগেছে। খালিদ শেখের একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। কোনো কিছুর কমতি রাখবে না। সবার সামনে নিজেকে হাসিখুশি রাখলেও। ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে সামাইরা। রাতে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসায় তার বুঝতে অসুবিধা হয় না এই নাম্বারটি কার হতে পারে। রিসিভ না করে ফোন সাইলেন্ট করে উল্টোদিকে ফিরে ঘুমিয়ে যায়। আপাতত একমাত্র নিদ্রাই তার কষ্ট দমিয়ে রাখার আসল পন্থা। পুরো তিনদিন অতিবাহিত হয়। ইমরানের কল-টেক্সট উপেক্ষা করার ফলে আজ বাড়িতে এসেছে। কাল হলুদের অনুষ্ঠান। আজ জামাই বাড়িতে এসেছে এটা সহজ ভাবে দেখছেন না হুমাইরা বানু। ইমরান সরাসরি সামাইরার সাথে কথা বলার জন্য রুমে এলো। বিছানায় শুয়ে ছিল। নক ছাড়া প্রবেশের ফলে তড়িঘড়িতে সোজা হয়ে বসল। ইমরান দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত সুরে বলল,
‘ইগনোর কেন করছিস আমায়? আমাকে ঘৃণা করিস? তোর এই তেজ, এই ঘৃণা প্রথম রাতেই শেষ করব। থাক, এখন তুই তোর মতো…।’ আরো কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে ইমরান প্রস্থান করল। সামাইরা শুধু মুখ বুঝে শুনেছে। কান্না আঁটকানোর চেষ্টা করছে। হুমাইরা বানু ভেতরে এসে মেয়েকে মনঃক্ষুণ্ন দেখেও না বলে চলে গেল। তিনি বিষয়টি তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য চাপিয়ে গেলেন।
_______
অপরাহ্ণের প্রথম ভাগ। আমেরিকার এক শহরের রাস্তায় ছাইবর্ণের গতিশীল গাড়িটি রাস্তার ধুলোবালি উঠিয়ে ছুটছে। সামনে কর্মরত ড্রাইভার সহ পেছনের সিটে দু’জন লোক। একজন মনোযোগ ফোনের পানে। অপরজন শান্ত ভঙ্গিতে বসে ছিল। মনোযোগী ব্যক্তিটির তীক্ষ্ণ নজর ফোনের উপর ব্যস্ত। সুঠাম দেহের গাম্ভীর্য ভাব তার শোভনীয় মুখশ্রীতে সুস্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড বাদে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে তার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের নিকট প্রশ্ন রাখলো জোহান আহসান,
‘আজকের মিটিংয়ের পর লাস্ট মিটিং কখন?’
রাতুল দ্রুত ফোনে সিডিউল চেক করে জানালো,
‘বিকেল চারটায়।’
‘রাতের ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফিরবো।’
‘জি, ব্যবস্থা করছি স্যার।’ তিনি ফোনের মাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন টিকিট বুক করতে। যমুনা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির মালিকের ছোট ছেলে জোহান আহসান। পড়াশোনা কমপ্লিটের পরপরই ছোট ভাই ও বাবার সঙ্গে বিজনেসে যোগদান করেন। বড়ো ভাইয়ের তিনজনের ছোট্ট পরিবার রয়েছে। বাবার ডায়াবেটিস ফলে প্রায় সময় অসুস্থতার কারণে জোহানকে কাজের ক্ষেত্রে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়। অবশ্য এতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়না। সে তার দায়িত্বে অটল!
.
তিন তলার বাড়িটি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে রংবেরঙের বাতি দিয়ে। সন্ধ্যা হবার আগেভাগেই বাতি জালানো হয়েছে। বাতির আলোয় চারদিক মাখোমাখো। সাজ সজ্জিত বাড়ি এত উচ্ছাসে, নিজেকে সে অতি তুচ্ছ মনে করছে। সবাই হলুদ দিচ্ছে। হাসিখুশি ভাবে বসে রয়েছে সামাইরা। সবার সাথে আনন্দে মেতে আছে। দেখে যেন বোঝার উপায় নেই মনে কোনো দুঃখ রয়েছে। ছেলে বাড়ি থেকে হলুদ দিতে ইমরানের ছোট ভাই মিরান ও তার বন্ধু, কাজিনরা এসেছে। মিরান আরো কয়েকটি ছবি তুলে নিলো সামাইরার। হলুদের অনুষ্ঠান শেষে হাতে মেহেদী না পড়েই সামাইরা ঘুমিয়ে যায়। সকাল সকাল মায়ের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভাঙে। আজ বিয়ে। সেজন্য এত বেলা পর্যন্ত ঘুম ভালো ভাবে দেখেন না তিনি। হোক সে তার মেয়ে। ছেলে পক্ষরা আসবে রাতে। তবুও তিনি বেশ তাড়াহুড়োর দিচ্ছেন। সামাইরাকে হালকা নাস্তা খাইয়ে দেয় রাধিকা। সামাইরা এখন সব মেনে নিয়েছে। এখন তার কষ্ট হলেও সেগুলো প্রকাশ করছে না।
রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। ভারী লেহেঙ্গা ও সাজসজ্জায় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শূন্যে তাকিয়ে আছে। যেন কোনো পুতুল দাঁড়িয়ে রয়েছে। বরযাত্রীদের গাড়ি এসেছে মিনিট পাঁচেক হলো। সবাই তাদের সঙ্গে রংতামাশায় মগ্ন। সামাইরা রাধিকাকে জোরপূর্বক নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। আপাতত সে এখন একা। ইমরানের কথা মস্তিষ্ক থেকে কোনোভাবেই ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। ধ্যানমগ্ন সে।
বড়ো নিশ্বাস ত্যাগ করতেই কানে কর্ণপাত হয় একজন পুরুষের কণ্ঠের স্বর। ছেলেপক্ষের কাউকে ভেবে তারপানে তাকানোর কোনো ইচ্ছেশক্তি নেই তার। সামনের পানেই নজর স্থির রাখলো।
‘এখানে কেন আপনি?’
ধ্যানমৌন এতটাই যে সেভাবেই বলল,
‘এমনি।’
মিনিট এক চুপ থেকে ফের শুধায়,
‘বিয়েতে মত নেই?’
প্রশ্নটি শুনেও না তাকিয়ে নিরুত্তর রইলো সামাইরা।
‘আপনি চাইলে বেলকনি থেকে সিঁড়ি বেয়ে পালাতে পারেন।’
এরূপ প্রশ্নেও সামাইরার ধ্যান ভঙ্গ হলো না। কেননা এ যাবত বহুবার রাধিকার মুখে এই বাক্যগুলো শুনে আসছে। যাবার আগেও কয়েকবার বলেছে। সামাইরা অতি শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
‘এই মুহূর্তে আব্বুর সন্মান আমার জীবনের থেকে অতি মূল্যবান মনে করছি।’
ছেলেটি কয়েক মিনিট চুপটি রইলো। ফেল গম্ভীরতা ভাব ফুটিয়ে বলল,
‘আই’ম স্যরি!’
.
.
চলবে?