তুমিময় মোহ পর্ব-০৭

0
43

তুমিময়_মোহ [৭]

আকাশের রং আজ পরিপূর্ণ নীল। দূরদূরান্ত থেকে পাখিদের উড়তে দেখছে জানালা থেকে সামাইরা। একা রুমে বসে সময় যেন থমকে আছে এরকমটা মনে হচ্ছে তার। তবে জোহানের কথা স্মরণ করে অজানা অব্যক্ত অনুভূতি হাতছানি দিচ্ছে। ছেলেটাকে যতটা খারাপ সে ভাবছে, সেরকমটি নয়। এক দিনে তার প্রতি এত অগাধ বিশ্বাস তাকে আরো বিব্রত করছে। জানালার পাশ থেকে সরে বড়ো আলমারির সামনে এসে পাশের ড্রেসিং টেবিলের নিকট দাঁড়ালো। নিজেকে একবার আয়নায় দেখে ফের আগের স্থানে এসে দাঁড়ালো। বেশ বিরক্ত বোধ হচ্ছে এখন। নৈঃশব্দে প্রশ্বাস নিলো।
দুইটার দিকে মিটিং শেষ করে দ্রুত একা প্রস্থান করল জোহান। উদ্দেশ্য তার সামাইরা। গাড়ি তীব্র গতিতে তাড়িয়ে পৌঁছে গেল। এর আগেই তার লোক’রা সামাইরাকে খাবার দিয়েছে দুপুরের। কেবল খাচ্ছিল, হঠাৎ জোহানের আগমনে সে হকচকিয়ে উঠে দৃষ্টি নিচু করে রাখলো।
জোহান ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসল মুখোমুখি। হেয়াল নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘এখন তিনটা। এত লেট করে খাবার খাচ্ছো কেন?’
সে দৃষ্টি নত করে শুধালো,
‘এমনি।’ বলে মুখে খাবার তুলল। জোহান অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। এরূপ অবস্থায় লজ্জাবোধে খাবার মুখে তুলতে অস্বস্থি লাগছে সামাইরার। সম্পূর্ণ খাবার গিলে নত স্বরে বলল,
‘আপনি খেয়েছেন?’
মৃদু হাসির দেখা মিলল জোহানের ঠোঁটে৷ যেন সে অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছিল এই প্রশ্নের। মিনিট কয়েক এক ভাবে অতিবাহিত হবার পর সামাইরা উত্তর না পেয়ে পুনরায় লোকমা মুখে তুলতে নিলে জোহান খপ করে হাত ধরে নিজের মুখে তুলল খাবার। আকস্মিক ঘটনায় কিঞ্চিৎ আহত নজরে তাকালো জোহানের পানে। খাবার চিবোতে চিবোতে মুচকি হাসি প্রধান করল জোহান৷ লজ্জায় দ্রুত বেগে নজর সরিয়ে নিলো। ফের লোকমা তোলার সাহস হচ্ছে না তার, যদি কেঁড়ে খেয়ে নেয় এই ভয়ে৷
‘খাচ্ছো না কেন?’ জোহানের দৃঢ় স্বরে বলা কথায় খেতে আরম্ভ করে।
সামাইরা এবার মুখে খাবার তুলে নেবার সময় বাঁধা দেয়নি জোহান। কিন্তু পরের বার দিয়েছিল। এজন্য সামাইরা মেকি রেগে প্লেট জোহানের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘আপনি খেয়ে নেন।’
জোহানের খুব হাসি পাচ্ছে। তবে সেটা ভেতরে চাপিয়ে রেখে প্লেট এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘খেয়ে নেও।’
সামাইরা ভদ্র মেয়ের মতো ফের খেতে লাগলো। জোহান এবার আর দুষ্টুমি করেনি৷ সম্পূর্ণ খাবার খাওয়ার সময় কেবল চেয়ে দেখেছে।
জোহান একবার রুম থেকে বেরিয়ে ফিরে এসেছিল একগাদা বই নিয়ে। সামাইরার যেন একাকী অনুভব না হয় এজন্য বইয়ের ব্যবস্থা করেছে।
সামাইরা ভেতরে ভেতরে খুশি হলেও তার সামনে বই স্পর্শ করে না। বরঞ্চ অপেক্ষা করে জোহানের যাবার৷ সেটি বুঝতে পেরে জোহান দরজা লক করে সিসিটিভি ক্যামেরার মনিটরের সামনে এসে বসে।
আগে থেকে এক প্যাকেট বিরিয়ানি রাখা ছিল সেখানে। একজন লোক সার্ভ করে দিয়ে চলে গেলে খেতে খেতে সামাইরাকে দেখতে থাকে। বই দেখে সামাইরার ঠোঁটে ও মুখশ্রীতে যেই খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল না। তা দেখে জোহানের ঠোঁটেও হাসির রেখা চওড়া হয়। বই খুলে একটি পড়তে লাগলো এক মনে। ডানে-বামে তাকানোর সুযোগ কই এখন তার।
_
‘আপনার কি মনে হয় ইমরান ভাইয়া বিবাহিত?’ রাধিকার নির্বাক প্রশ্ন আহিলের নিকট। আহিল আলসেমি ভেঙে হাত দু’টো উঁচু করে তুলে বলল,
‘এটাই সত্যি। আজ পার্কে বসে যে মেয়েটির সাথে কথা বলছিল শিওর বউ নয়তো গার্লফ্রেন্ড হবে।’
রাধিকার কপোলে চিন্তিত ভাজ দেখা গেল। পরমুহূর্তেই প্রশ্ন করল,
‘আপনিও কী ছিলেন সেখানে?’
‘হ্যাঁ! চরিত্র ঠিক নেই তার। আপনার সেফটির জন্য গিয়েছিলাম।’
রাধিকা কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকাল। তার কথা কেউ একজন ভাবে এটাই তার জন্য অনেক বড়ো কিছু। রাধিকা নত স্বরে বলল,
‘আপনাদের ধন্যবাদ। আমার বান্ধবীর জীবন বাঁচিয়েছেন।’
‘হেই! ধন্যবাদ দিচ্ছো কেন? জোহান সামাইরাকে ভালোবাসে। সে নিশ্চয় চাইবে না সামাইরা ভুল লোকের জীবনে যাক। ইমরান যদি ভালো লোক হতো জোহানের কোনো আপত্তি ছিল না। তবে সে সহজে সামাইরাকে ছেড়ে দিতো বলে মনে হয় না।’ লাস্টেরটুকু কাঁধ উঁচু করে বলল।
‘মানে?’
‘জোহান ত্যাগে নয়, হাসিলে বিশ্বাসী, জয়ী ছেলে।’
‘শুনেন, ভালোবাসলেই যে ভালোবাসার মানুষকে পেতেই হবে এমন নয়। কিছু ভালোবাসা দূর থেকে অপূর্ণতাও সুন্দর মানায়।’
‘দেখো, দেবদাস হবার ইচ্ছেশক্তি আমাদের জেনারেশনের ছেলেদের মধ্যে নেই। নয়তো এত পালিয়ে বিয়ে করতো না।’
‘আমি এই বিষয়ে আপনার সাথে যুক্তিতর্কে যাব না। কারণ জ্ঞান আমার শূন্যের কোঠায়। প্রেমে পড়িনি তো তাই।’
আহিল মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করল,
‘পড়বে শীঘ্রই।’
‘কী শীঘ্রই?’ ভ্রুকুটি করে জানতে চাইলো।
‘আরে তেমন কিছু না।’
রাধিকাকে বিদায় দিয়ে আহিল জোহানকে কল দিলো। তিনবার রিং হতেই রিসিভ করল সে৷
‘বল।’
‘বোতামের বিষয়টি কি করবি? এটা যে তোর সেটা তো নিশ্চিত।’
‘হ্যাঁ! আমি কোটই ফেলে দিয়েছি। ঐ মডেলের সেইম কোট নিয়েছি তবে বোতাম পরিবর্তন করে।’
‘তাহলে আমি কি আমার কোট দেখাব মিরানকে?’
‘সন্দেহ যদি অতিরিক্ত হয় ওর, তবে দেখাতে পারিস।’
‘মিরানের সাথে কথা বলি আগে।’
‘ওকে।’ উভয়ে ফোন কেটে দিল।
.
চোখের পাতা বন্ধ রেখে কপোলে দুই আঙুল বুলাচ্ছে মিরান। লামিম ও আরমান মিরানের চিন্তিত আদলের পানে চেয়ে কপোলে ভাজ ফেলে তাকিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত পরিচিত হাতেগোনা কয়েকজনের বাড়িতে বোতামের বিষয় তল্লাশি করেছে। তেমন সুরাহা মিলেনি। ঐ রকম বোতামের কোট কেউ সেবার পড়েনি। ততক্ষণে সেখানে আহিল এসে উপস্থিত হয়। পাশের চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘বোতামের আসল লোক পেলি?’
নিরাশ কণ্ঠে উত্তর দিলো মিরান,
‘নাহ!’
‘আচ্ছা আমার কোট দেখাই ওয়েট।’ বলতে বলতে পকেট থেকে ফোন বের করল। তারা সবাই আহিলের পানে উৎসুক হয়ে তাকাল। আপাতত তার কথা কেউ বলেনি। শুধু শুধু আগ বাড়িয়ে বলার কোনো কারণ দেখছে না কেউ। কোট খরিদ করার সময়ে কয়েকটি ছবি তুলেছিল। সেই ছবি বের করে জুম করে মিরানকে দেখালো। সকলে দৃঢ় চোখে তাকালো। আহিলের আত্মবিশ্বাসবোধ দেখে বেকুব যেন সবাই। ব্যঙ্গ করে আরমান জানায়,
‘যেভাবে দেখাচ্ছিস মনে হচ্ছে আমরা তোকেই সন্দেহ করছি।’
আহিল থতমত খেয়ে বিষয়টি সামলে নিয়ে হেসে বলল,
‘দেখালাম আর কি।’
মিরান মুখ খুলল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘বিষয়টা সিরিয়াস আহিল। আমি বড্ড টেনশন করছি ভাইয়াকে নিয়ে। সামাইরাকে সে ভালোবাসে। সারাদিন বারে বসে থাকে উদাস হয়ে। আব্বু-আম্মু টেনশন করে। যেন তার অতি প্রিয় বস্তু হারিয়েছে।’
‘প্রিয় বস্তু মাই ফুট!’ মনে মনে আওড়ালো আহিল। ফের আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘পেয়ে যাবি ঠিক।’
‘তোদের সাহায্য প্রয়োজন।’
‘কী করতে হবে?’ আহিল দৃঢ় গলায় জানায়।
‘সামাইরার কল লিস্ট বের করব। দেখতে চাই আদৌও ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল কি-না।’
‘এই কাজটা আমি করি।’ লামিম উৎসাহ নিয়ে বলল।
‘আচ্ছা। আহিল, আরমান তোরা কলেজে খোঁজখবর নিবি সামাইরার ক্লাসমেটদের কাছ থেকে। আমি বোতামের বিষয়টি দেখব।’
‘যতো দেখিস কাজ হবে না। ডালে-ডালে, পাতায় পাতায় বলে একটা প্রবাদ আছে না দোস্ত।’ ফের মনে মনে আওড়ালো আহিল।
_
হুমাইরা বানু তাঁদের এক পুরোনো ছবি বের করেছে। সেখানে ছোট্ট সামাইরা, সিয়াম এবং তারা দু’জন রয়েছে। ছবি এলবানটি মমতাময়ী নজরে দেখছে। তিন বছর বয়সে সামাইরাকে এসে এই বাড়িতে পেয়েছিল। নিজের মেয়ের মতো লালন-পালন করে বড়ো করেছে। মন থেকে চেয়েছিল দ্বিতীয় সন্তান যেন না আসে তার। তবে আল্লাহ তার ইচ্ছেকে গ্রহণ করেনি। উপহার সরূপ সিয়ামকে দিয়েছে তার কোল জুড়ে। সিয়ামের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে সামাইরার প্রতি দুরত্ব তৈরি হয়। ছোট্ট মেয়েটা ভাবে তার চেয়েও সিয়ামকে অধিক ভালোবাসে। মনমালিন্য সৃষ্টি হয় মা-মেয়ের মধ্যে। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে দিনকে দিন দুরত্ব বেড়ে আজ কতটা দূরে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরলেন ছবিটি। নয়ন দু’টি বন্ধ রেখে সেই রাতের কথা ভাবলেন।
সামাইরাকে অচেতন করার সময়ই পেছন থেকে হুমাইরা বানু এসে দেখে ফেলে। অচেতন সামাইরা ঢলে পড়ে ছিল তখনো জোহানের বক্ষে। হুমাইরা বানুর ভ্রুকুটি ভাবমূর্তি দেখে ঘাবড়াল না জোহান। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল,
‘মেয়েটাকে খুব ভালোবাসি। তবে এটা সামাইরার অজানা। আমি মন থেকে চাইছিলাম না এই বিয়েটা হোক। আল্লাহ যেন কোনো মিরাক্কেল দেখাক। আপন মা না হলেও মায়ের কথা ঠিক সাড়া দিয়েছে আমার মাবুদ। জানি না তুমি আমার মেয়েটাকে ভালোবাসো কি-না। তবে একজন মায়ের অনুরোধ। ওর কোনো ক্ষতি কোরো না। পরিস্থিতি শান্ত হলে মেয়েটাকে ফেরৎ দিয়ে যেও খোকা।’ গলা ধরে আসলো বাকিটুকু বলতে। জোহানের ভীষণ ভালোলাগে। এমন সাহসী মায়ের দেখা পাবে এ বাড়িতে জানা ছিল না। সে আশ্বাস দিয়ে কোমল গলায় শুধালো,
‘ইমরান তার জন্য পারফেক্ট নয়। আমি সামাইরাকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করব বলে রাখলাম। চললাম আম্মা।’ নাম্বারটি তাকে দিয়ে সামাইরাকে পাঁজরা কোলে তুলে প্রস্থান করল দ্রুত। সে পেছন থেকে শুধু চেয়ে দেখছে।
মনটা কেন জানি খুব প্রশান্ত অনুভব হচ্ছে। ম্নান হাসিও দেখা মিলল তার শুঁকনো ঠোঁটে। এ কয়দিনে জোহানের সাথে বহুবার কথা হয়েছিল তার। এই বিষয়ে সব গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে এখন অব্দি রয়েছে। ততদিন রবে যতদিন না ইমরানের ব্যাপারে সব জানা যাচ্ছে।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি