তুলির সংসার পর্ব-০৩

0
35

#তুলির_সংসার
পর্ব-৩

আরে মাছের মাথাটা শুভ্রর প্লেটে দাওনা,
তুলির বাবার ধমকে তাড়াতাড়ি উঠে কাতলা মাছের বিশাল মাথাটা শুভ্রর প্লেটে তুলে দিলেন নিলুফার বেগম।

বাবা শুভ্র মাছের কাটা বেছে খেতে পারবে না…
তুই বসে আছিস কেনো। তুই বেছে দেয়, শুভ্র খাবে।

তুলির কিছু শুচিবায়ু রোগ আছে, অন্য কারো পাতের খাবার খাওয়া বা কারো এটো প্লেট ধোয়া এগুলো ও করতে পারে না। কিন্তু বাবার ধমকে শুভ্রর প্লেট থেকে মাথাটা নিয়ে সুন্দর করে ভেঙ্গে বেছে শুভ্রকে দিলো। এটো হাতে টেবিলে বসে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য মুগ্ধ চোখে দেখলেন জামান সাহেব।

এই নাও তোমার পান।

নিলুফার,
কই যাও

কেনো আমাকে তোমার কি দরকার

বসো একটু কথা বলি

তোমার আবার আমার সাথে কথা বলার সময় আছে নাকি..?
অফিসের পর নিজের ভাই বোনদের সাথে ফোনে আমার বদনাম করা আর দাড়োয়ানের সাথে বসে বসে দাবা খেলা।
এ ছাড়াতো তোমার অন্য কোনো কাজ নেই।

এমন করে বলছো কেনো। রাগ করোনা। আমার ভাই বোনেরা আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে, তাই বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নেয়ার জন্যে আমাকে ফোন দেয়।

হ্যা তুমিতো সবজান্তা শমশের সাহেব সবাইকে পরামর্শ দিয়ে বেরাও, নিজের ঘরের খবর রাখো কিছু?

আমার ঘরের জন্যেতো তুমিই আছো।
তুমি শুধু শুধু রাগ করছো, আমিতো তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম। তুমি যখন এতো তাড়াহুড়ো
করে তুলির বিয়েটা করালে, আর সবার মতো আমারও ভয় হচ্ছিলো। কিন্তু আজ তুলি আর শুভ্রকে এক সাথে দেখে আমার সব ভয় কেটে গেছে। শুভ্রর চোখে মুখে তুলির প্রতি ভালবাসা। ছেলেটা এতো সরল। ওর ভেতরটা কাঁচের মতো পরিষ্কার। আমরা হাজার চাইলেও শুভ্রর থেকে ভালো ছেলে তুলির জন্যে পেতাম না।

জীবনে প্রথম স্বামীর মুখে নিজের কোনো কাজের তারিফ শুনলেন নিলুফার। আর তাই অনেকক্ষন বাকরুদ্ধ হয়ে বসেই রইলেন। তবে তুলির প্রতি শুভ্রর ভালবাসা নিলুফারেরও চোখ এড়ায়নি।

তুলির যে রাজ রানীর কপাল এটা উনি আগেই জানতেন।এমন রুপবতী মেয়ে যেদিন তার অভাবের সংসারে জন্মালো সেদিনই উনি বুঝেছিলেন।
তাইতো যেদিন উপরতলার ভাবী মন্ত্রী সাহেবের ছেলের প্রস্তাবটা আনলেন সাথে সাথে উনি রাজী হয়ে গিয়েছিলেন।

#
রাজ রানীর কপাল না ছাই
বাবা মা তোয়া সবার মুখেই এক কথা
রাজ রানী হতেতো আমি চাইনি
ভালবাসার মানুষের সাথে জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম। ভালবাসার মানুষ সাথে থাকলে কুড়ে ঘরও প্রাসাদ বলেই মনে হয়।

খাওয়া দাওয়ার পর ছাদে চলে এসেছে শুভ্র সেখানেই তুলির মা, ওকে দিয়ে শুভ্রর চা পাঠিয়ে দিয়েছেন

তুলির হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলো শুভ্র,
পাশে রেলিংয়ের উপর রেখে খুব সুন্দর করে হাসলো।

তুলি বুঝতে পারেনা যেকোনো কথাই এই ছেলেটা হাসি দিয়ে শুরু করে কেনো। সে মনে হয় জানে তার হাসি সুন্দর। সামনের মানুষ সেই হাসি দেখলেই একধরনের মায়া জালে আটকে যাবে। আর সে যা বলবে তাই মুগ্ধ হয়ে শুনবে। তুলি ডিসাইড করেছে শুভ্রর এই ট্রিকে কিছুতেই পা দিবেনা। এখন থেকে শুভ্র যা বলবে ও মেজাজ খারাপ করে শুনবে।

আসলে ব্যাপরটা কি তুলি, প্রথমত আপনি কুড়ে ঘরকে কোনো ভাবেই প্রাসাদ বলতে পারবেন না। কারণ সেটা টেকনিকালি রং।

আর দ্বিতীয়ত ভালবাসা বোধটা পুরোই হরমোনাল একটা ব্যাপার। আমাদের যখন মনে হয় কাউকে ভালো লাগছে সেটা আসলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র এবং হরমোনের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন।
যা মানুষের ন্যাচারাল থিংকিং ক্যাপাবিলিটি স্টপ করে দেয়। একবার ভালবাসার মানুষকে কাছে পেলে। হরমোনাল রিয়্যাকশনটা কমতে শুরু করে তখন ন্যাচারাল থিংকিং নরমাল হতে থাকে। দেন রিয়েলাইজেশন হয় যে কুড়ে ঘর কুড়ে ঘরই, প্রাসাদ নয়।

এগুলো আমার কথা না আমেরিকার রাটগার্ট ইউনিভার্সিটিতে এটার উপর একটা রিসার্চ হয়েছে। আমি সেই রিসার্চের কথাই বললাম…

রিসার্চটা খুব ইন্টারেস্টিং এখানে খুব সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে, প্রথম পরিচয় থেকে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত এই পুরো জার্নিটায় মানুষের শরীরের মস্তিষ্ক, নার্ভাস সিস্টেম এবং হরমোন সব এক সাথে কিভাবে টিম ওয়ার্ক করে যাকে আমরা মানুষরা তীব্র প্রেম বলে ভুল করি।

বুকের ভেতর ধুকপুকানি থেকে শুরু করে, চোখে পানি আসা, অস্থির অস্থির লাগা। এগুলো সবই একটা আরেকটার সাথে রিলেটেড।

তারমানে আপনার ধারনা আমার ভালবাসা,
ভালবাসা না শুধুই হরমোনাল আকর্ষন
ছিঃ শুভ্র

আপনি শুধু শুধু আমার উপর রাগ করছেন তুলি

আমি নিজে থেকে কিছু বলিনি রিসার্চ টা শেয়ার করলাম শুধু, এটা সত্যি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
প্লিজ আপনি কষ্ট পাবেন না

তুলি কষ্ট পেয়েছে বেশ ভালো রকম কষ্ট পেয়েছে, শুধু শুভ্রর কথায় কষ্ট পেয়েছে তা নয়। আজ সকালে অনেক আশা নিয়ে যে জন্যে এ বাড়িতে এসেছিলো তাতে কোন লাভ হয়নি। তুলির কথা শুনে জহির টলমলে অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু খুব শান্ত সুরে ধীরে ধীরে বলেছিলো।
‘আপনার ধারনা ভুল। কেনো আপনার এমন ধারনা হয়েছে আমি জানিনা। আমি আপনাকে কখনো কোনো ভুল ইশারা দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত।’

তাহলে আপনি কাঁদছেন কেনো।

কারণ আমার মনে হচ্ছে আমারই কোনো ভুলে হয়তো আপনার এমন ধারনা হয়েছে। আজ যেখানে বিয়ের পরের দিন জামাই বাবাজির সাথে আপনার আনন্দে থাকার কথা উল্টো আপনি এসে আমাকে এমন কথা জিজ্ঞেস করছেন। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। আপনি যা বলছেন, আপনার পরিবারের এতো অনুগ্রহের পরেও আমি যদি সে কাজ করি তাহলে আমি তো মিরজাফরের থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যাবো। একথা জানলে লোকে আর বিশ্বাস ঘাতকদের মিরজাফর বলে গালি দিবেনা, জহিরুল আলম বলে গালি দিবে।

তোয়া হুটহাট রেগে গেলেও তুলিকে খুব একটা রাগতে কেউ দেখেইনি বলা যায়। জহিরের কথা শুনে তুলির মনে হচ্ছে কেউ ওর মাথার ভেতরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

আপনি শুধু শুধু এতোদিন যাবত চাকরি খুজছেন আপনারতো অভিনয় করা উচিত। আমার ধারনা ছিলো হূমায়ুন ফরিদী স্যার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আপনার অভিনয় দেখার পর মনে হচ্ছে সেটা ভুল। উনি বেচে থাকলে আপনার অভিনয় দেখে মূর্ছা যেতেন।

জহির একই রকম শান্ত থেকে বললো, আপনি অভিনয় মনে করেন আর সত্যি, আজকের পর আপনি এ বিষয়ে কিছু বললে আমি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য হবো।

আপনি জানেন আমি আপনাকে ভালবাসি, আপনি চলে গেলে আমি কষ্ট পাবো আর এজন্যেই আমার দূর্বলতা জেনে আমাকে চলে যাবার ভয় দেখাচ্ছেন।শুনুন ভালবাসা যেমন মানুষকে দূর্বল বানায় তেমনি ভালবাসায় আঘাত পেয়ে মানুষ শক্ত নিষ্ঠুরও হয়ে যায়।
রাগে তুলি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
কাউকে ভালবেসে অস্বিকার করা যেমন কাপুরুষতা অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকাটাও অপমানের। তবে সেসব বোঝার মতো জ্ঞান আপনার নেই।

তুলির কথাতেই হয়তো কষ্ট পেয়ে চলে যায় জহির। কাউকে কিছুই বলেনি শুধু দাড়োয়ানের কাছে বলে গেছে চিরদিনের জন্যে সুবর্নপুর ফিরে যাচ্ছে।

সেই থেকে তোয়া ভেউ ভেউ করে কাঁদছে।
গাড়িতে এসে বসার পর শুভ্র বলে উঠলো। তুলি চলুন আমরা সুবর্নপুরে যাই।
হয়েছে আপনাকে আর মহৎ হতে হবেনা আমি ঐ লোকের মুখও দেখতে চাইনা। ভালবাসে স্বীকার করার,
যার সাহস নাই আজ থেকে তাকে আমি ঘৃনা করি।

আপনার জন্যে না, সুবর্নপুর আমি যেতে চাচ্ছিলাম জহির মামার সাথে দেখা করার জন্যে। আই থিংক হি ইজ এ ভেরী ইন্টারেস্টিং পারসন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেনো আপনারা দুই রুপবতী বোন গ্রামের এতো সাধারন বেকার একজন যুবকের প্রেমে ডুবে মানে তলিয়ে গেলেন।

চলবে…