তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ১০
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)
এই যান্ত্রিক ফোনের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিলো তাদের যাত্রা।একে অপর থেকে দুরত্বে থেকে পরিচয় হয়েছিল ভিন্নভাবে।তারপর দূরত্ব মিটে।দেখা হয় মুখোমুখি।সময় যেনো আরো কয়েক কদম পিছিয়ে সেই ফোনে ফোনে আলাপনের সময়ে এনে দাঁড় করালো। ক্যাম্পে ফিরেছে ঠিকই তবে স্বস্তি মিললো না। চেয়েছিলো এবার গিয়েই খুশবুর কাছে তার অস্থির চিত্তের চিত্র তুলে ধরবে।তবে নিয়তি তা ঠিক বিপরীতটাই বয়ে আনলো।দূরত্ব মেটাতে গিয়ে দূরত্ব বেড়ে উঠে।ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব অনেকটা।কি করবে এই ভেবে হাজির হয় বাড়িতে।দুপুরে এসেছে।আগামীকাল সকালে ফিরে যাবে আফতাব।আরিফ আর সে পালা বদলে ডিউটি করে।দায়িত্ব এখন আরিফের ঘাড়ে।আফতাব ফিরলে আরিফ বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাবে।
আধ ঘন্টা বিশ্রামের পর খাবার টেবিলে একত্রে বাবা মা এবং আফতাব।রফিকুজ্জামান মির্জা ছেলের মুখপানে চেয়ে বলে উঠলেন,
-“তোমার জন্য মেয়ে দেখেছি।আমার মনে হয় বিয়েটা করে ফেলা উচিত তোমার।”
খাবারটা গলায় আটকে যাওয়ার উপক্রম।কেশে উঠলো আফতাব।রুমানা মির্জা দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত বোলাতে শুরু করলেন। দুইগ্লাস পানি পান করে কিছুটা ঠিক অনুভব করে আফতাব।বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
রফিকুজ্জামান আবার বলে উঠলেন,
-“বিয়ের কথা শুনে কাশি কেনো উঠলো?”
নরম গলায় ফিরতি প্রশ্ন করলো, -“মেয়ে দেখেছো মানে?”
-“মেয়ে দেখেছি মানে তোমার জন্য পাত্রী দেখেছি।আমার পরিচিত ভালো মেয়ে।আমি চাইছি বিয়েটা শীগ্রই হোক তোমাদের।”
-“কিন্তু বাবা তোমার সাথে আমার কথা ছিলো।আমি তোমাকে বলেছি ফিরে এসে কথা বলবো।এর মাঝে কি হলো?”
আম্ভরিক ভাবমূর্তি বজায় রেখে রফিকুজ্জামান বলে উঠলেন,
-“তুমি কি আমার সাথে তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে?”
-“বাবা তুমি বুঝতে পারছো না!”
-“আমি ঠিকই বুঝছি আফতাব।তুমি তোমার পক্ষটা রাখো আমার সামনে।তারপর ভাবছি।”
আফতাব মায়ের দিকে চাইলো। করুণ মুখভঙ্গি।খাবার অর্ধেকটা রেখে হাত সরিয়ে নিলো।হঠাৎ বাবার মাথায় বিয়ের চিন্তা কে দিলো?কিভাবে আসলো?মায়ের দিকে চেয়েই বুঝে গেছে সে কিছুই জানে না।দুজনের কথায় অবাক চেয়ে সেও।সব প্ল্যানিং তার বাবারই।
-“বলো লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই।এখানে আমি আর তোমার মা-ই আছি। নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”
আফতাব বলে উঠলো সরাসরি,
-“আমি একজনকে পছন্দ করি।তুমিও ওকে চেনো। দুবার তোমার সাথে সাক্ষাৎ আর কথা দুটোই হয়েছে।”
রফিকুজ্জামান ভ্রু উঁচু করে আফতাব এর দিকে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
-“তোমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে?”
-“না বাবা! কোনো সম্পর্ক নেই।আমরা একে অপরকে চিনি মাত্র কয়েকদিন।তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
-“হ্যাঁ মেয়েটাকে দেখেছি আমি।ওকে আমার পছন্দ হয়নি।আমি যাকে পছন্দ করেছি তোমার জন্য তার সাথেই তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছি”
আকাশ ভেঙে পড়লো আফতাব এর উপর। পলকহীন নেত্রে বাবার দিকে চেয়ে আছে।যা ধারণা করেছিলো?যা পরিকল্পনা করেছিলো সবটাই যেনো পাহাড় ধসে চাপা পড়তে দেখছে চোখের সামনে।একদিকে বাবা আরেকদিকে খুশবু।কোনোদিন সাহস করেই অমান্য করতে পারবে না বাবা মাকে। খুশবুও ফেলে দেওয়ার পাত্রী নয়।
আফতাব নত গলায় বলে উঠলো,
-“বাবা তুমি খুশবুর ব্যপারে আরো একবার ভেবে দেখতে পর।আমি রিকোয়েস্ট করছি বাবা প্লিজ।”
বলে উঠে চলে গেলো আফতাব। খাবারটাও শেষ করেনি।রুমানা মির্জা স্বামীর দিকে চাইলেন।বললেন,
-“কি দরকার ছিলো এমন করার বলবেন?ছেলেটা না খেয়ে চলে গেলো।”
-“সেটা আমাদের বাপ ছেলেদের ব্যাপার।তুমি তোমার খাবার শেষ করো”
রফিকুজ্জামান এর মুখমণ্ডল গুমোট গম্ভীরতায় ঘেরা থাকে সর্বক্ষণ।সচরাচর মানুষ তাকে রাগী বলেই চেনেন।তবে তার মধ্যেও বিভিন্ন অনুভূতি কাজ করে।কখনো হাসির,দুষ্টুমির।ছেলেকে ইচ্ছেকৃত ফাঁদে ফেললেন।অথচ সে ধরতেই পারেনি।আরো করুক লুকিয়ে লুকিয়ে টিলায় বসে প্রেম।
খুশবু নামে মৃদু প্রেমে লিপ্ত, সুরের মধুর ঝংকারে আমার হৃদয় প্রতিবাদ করছে।সৈনিক হয়ে কোনোভাবেই কদম পেছানো তার চরিত্রের সাথে মানানসই হবে না।তার নিজস্ব একটা পছন্দ আছে।এটা বাবা বুঝে।বোঝা স্বত্বেও কেনো এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো? খুশবুর মাঝে অপছন্দনীয় কি দেখেছে সে?যদি তাকে অপছন্দই থাকতো কেনো তার সাথে দুই দুইবার কথা বললো।আফতাব এর কোন আপাদত এটাই ইচ্ছা প্রকাশ করছে বাবার মাথা থেকে যত দ্রুত এই চিন্তাটা যেনো নেমে যায়।কে জানে কোন মেয়েকে তার জন্য পছন্দ হয়েছে তার। ফোনটার দিকে হাত বাড়িয়েও কল মেলানো হলো না।নিজের মধ্যে অজান্তেই অপরাধবোধ এর সৃষ্টি হয়ে গেছে।সে চেনে তার বাবাকে।তার সিদ্ধান্তই এই বাড়ির শেষ সিদ্ধান্ত।এর মধ্যে আর কারো সাধ্য নেই কথা বলার।মস্তিষ্ক সায় না দিলেও মন অবাধ্য।আপনাআপনি কল চলে গেছে ব্যস্ত নগরী ঢাকায়।
মধুর কণ্ঠে “হ্যালো” শুনে মনটা আরো অস্থির হয়ে উঠে।আফতাব জবাব দিলো না।চুপ করে রইলো।ফেরার পথে তাকে বলেছিলো আজ বাড়ি যাওয়ার কথা।সেই প্রেক্ষিতেই খুশবু প্রশ্ন করে,
-“বাড়ি ফিরেছেন?”
-“হুম”
আজ আফতাব এর স্বর ভিন্ন মনে হলো।প্রাণহীন, নিস্তেজ। চট করে ধরে ফেলেছে একটা ছোট্ট ‘হুম’ শব্দে।সবসময় আদুরে গলায় খুশবু বলে ডাকা লোকটার বোধহয় মন ভালো নেই।
খুশবু প্রশ্ন করে,
-“আজ ব্যাটারি ডাউন আপনার ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জা?”
সরু হাস্য অধরে ছেয়ে গেছে।কি নাম দেবে এই কণ্ঠের?মাধুরী নাকি সম্মোহনী?যার নামেই বিশেষত্ব।তাকে নাম দেওয়া ভারী পাপ।নিজেকে উপলব্ধি করলো অন্ধ প্রেমিক হিসেবে।হিম শীতল সুরে জবাব দেয়,
-“কি সুন্দর করে ডাকেন?আজকাল নিজের নামটাও ভালো লাগে।”
-“আচ্ছা আমাকে বলুনতো আপনাকে এভাবে কথা বলা কে শিখিয়েছে?আপনি কিন্তু যেকোনো নারীকে বশ করতে পারবেন আপনার কথার মাধ্যমে”
আফতাব দ্ব্যর্থহীন অবলীলায় শুধালো, -“আপনি বশ হয়েছেন?”
থতমত খেয়ে যায় খুশবু।জবাব দেয়ার জন্য বসেই ছিলো।কিন্তু নিজের প্রশ্নের কাছে নিজেই ধরা পড়ে গেছে।উত্তর দেওয়া থেকে বিরত দেখে আলাপের সময়ের দৈর্ঘ্য আরো দীর্ঘায়িত করলো।
-“জানিতো জবাব দিবেন না।কিন্তু আমার একটা জরুরী কথা আছে।মনোযোগ দিয়ে শুনুন আর জবাব দিন”
-“কি কথা?”
-“আমাকে আপনার কেমন লাগে?…..কথা এড়াবেন না খুশবু।”
-“এড়ালাম না কথা!…..আপনাকে আমার ভালো লাগেনা।আপনি একটা বখাটে লোক।”
খুশবুর সাথে পরিচয়ের স্বল্প সময়ে অতটুকু বোধগম্য হয়েছে সে মনের কথা প্রকাশে কাঁচা।অনুধাবন করলো যে জবাব তার মুখ ফুটে আসবে না ঠিক কৌশলে এড়িয়ে যাবে। খুশবুর ঘোরানো পেঁচানো কথার অর্থোদ্ধার করে আফতাব প্রত্যুত্তরে বলে,
-“এর অর্থ ভালো লাগে।”
ঠোঁট কামড়ে খুশবু নিজের কথায় অটল থেকে বললো, -“উহু”
কানের কাছ থেকে ফোনটা দূরে সরিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ধরে আফতাব।পরপর ছেড়ে দেয়।নিজেকে প্রস্তুত করে নিজের এক আলাদা প্রকাশের ভাষায় বলে উঠলো,
-“আপনি কি আমার এই কালচে সবুজ জীবনে ভালোবাসার খুশবু ছড়াবেন?সময় দিতে পারবো না তেমন।দায়িত্ব আছে কাধে।ভারী রাইফেল তুলে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরবো আপনার কাঁধে ঠায় দিবেন?জীবনের বাকি যতটুকু সময় অবশিষ্ট আছে আসুন একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেই।আমি ধীরেধীরে মত্ত হচ্ছি আপনার প্রতি।ভীষণ রকমভাবে।”
হাত পা জমে ঠান্ডা হয়ে উঠল।শীতল হয় মস্তিষ্কও একাধারে।এমন অনুভূতির মধ্য দিয়ে এর আগেও যাওয়া হয়েছে।একই অনুভূতি মানুষ ভিন্ন।তার পরপরই মনে পড়লো গতরাতে মা আর নানীর কথা।এসব কি বলে দেবে আফতাবকে?দ্বিধা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লো তৎক্ষনাৎ।ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য হচ্ছে না।চেতনার সমুদ্রে ডুবে ডুবে যাওয়া খুশবুর কর্ণপাত হলো দ্বিতীয়বার আফতাব এর কন্ঠধ্বনি।
-“আর কিভাবে উপলব্ধি করালে বুঝবেন আমি আপনাকে ভালোবাসি?কোনো মোহ নয়,কোনো আকর্ষণ নয়।সরাসরি কাগজে কলমে সই করে নিজের করে রাখতে চাচ্ছি আপনাকে।”
__
-“বুড়ি?”
জরিনা বেগম এর মুখ ভর্তি সুপারি।এই বয়সে দাঁত দুর্বল।তবে সারাদিন সুপারি চিবুতে ভুল করেননা।বুড়ি ডাকটা শুনে টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিলেন টুপ করে। খুশবুকে ইশারায় ডাকলেন ভেতরে আসতে।
খুশবুর ভাবভঙ্গি ভিন্ন।এসেই জরিনা বেগমকে সামান্য ভেতরে ঠেলে দিয়ে বসলো পাশ ঘেষে।তীর্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,
-“সুপারি চিবুতে খুব ভালো লাগে তাইনা?”
-“হ”
চতুর হাঁসি খুশবুর মুখে।জরিনা বেগমের দিকে চেয়ে বলল,
-“সুপারিগুলো যদি ফেলে দেই কি হবে?”
টিভি থেকে নজর সরিয়ে খুশবুর দিকে ছুড়লেন।চোখে মুখে আশ্চর্য্য!কি বলে এই মেয়ে?ফেলে দিবে কেনো?এমনি প্রশ্নবিদ্ধ মুখমণ্ডল।তিনি মুখ কুচকে জবাব দেন,
-“কি শত্রুতা তোর আমার লগে?”
-“তোমার কি শত্রুতা!আমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছো কেনো?আমি এখন বিয়ে করবো না”
চোখ পাকিয়ে তাকান জরিনা বেগম।বলেন,
-“বিয়া ফরজ জিনিস।যত তাড়াতাড়ি করবি তত ভালো।”
-“আমার একটা পছন্দ আছে না?যদি তোমরা এমন কোনো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও যাকে আমার একদম ভালো লাগবে না তখন?আমি কিন্তু বিয়ে করবো না বুড়ি।মাকে বুঝিয়ে দাও।”
জরিনা বেগম জবাব দেয়,
-“শিক্ষিত ফুয়া খুঁজছি তোর জন্য বেডি।অনেক ভালো পরিবার।এক মায়ের এক পোলা”
হোক শিক্ষিত!হোক যোগ্য!তাতে খুশবুর আপাদত কিছু আসে যায় না।সে কোনভাবেই রাজি নয়।গতরাতে আফতাব এর বলা কথাগুলো এখনও কানের কাছে ড্রাম বাজাচ্ছে। উড়ু উড়ু অনুভূতি।এগুলো শীগ্রই থামবে বলে মনে হচ্ছেনা।
-“কে সেই শিক্ষিত লোক?”
“নাম জানি না।কিন্তু আমরার ঘরের কান্ধাত থাকে।ঐযে সাদা একতলা বাড়িটা আছে না টিলার লগে?ঐটা।বাপ পোলা দুইজনই আর্মি। তোরে মেলা পছন্দ করছে পোলার বাপে।বিশ্বাস না করলে জিতুরে কল দে।পোলার বাপের লগে কালকেও ওর লগে কথা হইসে”
হার্ট অ্যাটাকটা ইতিমধ্যে রাস্তায় আছে।যেকোনো মুহূর্তে এসে খুশবুর নরম হৃদপিণ্ডে এসে হানা দেবে। বুড়ি পাগল হয়ে আবোলতাবোল বকছে নাকি খুশবুর শ্রবণইন্দ্রিয়তে ত্রুটি।জরিনা বেগমের হাত থেকে সুপারির কৌটা ছিনিয়ে নেয় খুশবু। নিশ্চিত হবার জন্য আরেকবার প্রশ্ন করে,
-“পাশের বাড়ির আর্মি?ওরা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?”
জরিনা বেগম ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন,
-“নিজের বিয়ার কথা বেহায়ার মতোন জানতে চাইতাসোস।ছিঃ!”
-“চুপ করো বুড়ি।সুপারি পাবে না কিন্তু।বলো কে দিয়েছে প্রস্তাব?”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলেন জরিনা বেগম। সুপারির কৌটা উদ্ধার করতে হবে।এটা ছাড়া তার চলে না। বিরক্তির সুরে বললেন,
-“ফুয়ার বাপে প্রস্তাব দিছে।”
আরিব্বাস!ছেলের চেয়ে এক কদম এগিয়ে তার বাবা।এই কারণেই বুঝি জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিলো?ছেলের আগেই নিজে দান খেলেছেন পুত্রবধূ বানানোর জন্য খুশবুকে। খুশি হবে নাকি বিস্মিত কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।আফতাব কি জানে এই বিষয়ে?জানলে গতকাল বললো না কেনো?বিয়েতে অমত দিতে এসেছিল।জরিনা বেগমকে ব্ল্যাকমেইল করে পিছিয়ে নিতে চাইছিলো।এখানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো মোর ঘুরিয়েছে।
-“ভালো পরিবার।তুই সুখে থাকবি।কোনো ঝামেলা ছাড়া সংসার।”
আকস্মিক অনুভব করলো অভ্যন্তরে সবটা গুলিয়ে আসছে।এখনই বিদ্যুতের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফোনের কাছে যাবে।গিয়েই আফতাবকে প্রশ্নের সমুদ্রে ডুবিয়ে দেবে।
-“তোর বাপ রাজি হইলে তুইও রাজি হইয়া যাইস।আমার ঘরের লগে থাকবি সারাজীবন।আমি থাকি আর না থাকি”
খুশবু অবলীলায় বলে উঠলো,
-“কিযে বলো বুড়ি তুমি আরো হাজার বছর বাঁচবে।”
হেঁটে হেঁটে নিজের ঘর অব্দি গিয়েছে। ঠোঁটের হাসিটা অনেক চেষ্টা করেও সরাতে পারলো না।সিনেমার মতন কাকতালীয় বিষয়গুলো বাস্তব জীবনে উপভোগ করে বেশ ভালো অনুভুতির ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে বারেবারে। দরজা আটকে একদফা তার উদ্ভট কর্মকাণ্ড আর অতিরিক্ত আনন্দিত হওয়া নিয়ে ভাবতে বসেছে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে বসলো।এরকম উচ্ছ্বাসের কারণ কি?সেও তবে নির্ঘাত বখাটে লোকের অনুরাগে সাঁতরে বেড়াতে শুরু করেছে।এবারে মন মস্তিষ্কের মোকদ্দমায় হেরে গেলো মস্তিষ্ক। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানির আওয়াজ নিশ্চিত করে সবটা।
বাবা মায়ের একমাত্র পুত্রের মেজাজ তুঙ্গে। ব্যক্তিত্বের বাহিরে গিয়ে জেদ দেখাতে ইচ্ছে হয়েছিলো ফিরে আসার আগে।কিন্তু দমে গেছে।যতই হোক বাবা মা।অসম্মান করতে পারেনা।তার জীবনে যা আছে সবই তাদের অবদান।নিজেকে সামলে সাবলীলভাবেই বিদায় নিয়ে এসেছে ক্যাম্পে। আরিফও বিদায় নিলো কিছু সময় আগে।একা একা পুরো টিমকে টেকেল দিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য এসে গাছ তলায় বসতেই ফোন বাজে।ক্যামেলিয়া ফুলের নামটা ওষ্ঠের এক কোণে প্রশান্তির ছোঁয়া দিয়ে গেলো।
-“হ্যালো”
ঠোঁট কামড়ে খুশবু প্রশ্ন করে, -“বিরক্ত করলাম?”
-“না। লাঞ্চ ব্রেক চলছে।”
-“আপনি তাহলে খেয়ে নিন।পড়ে কথা বললেও চলবে।”
-“আমার চলবে না আপনি বলুন”
ইনিয়ে বিনিয়ে জানতেই হবে।আফতাব কি জানে তার বাবা এত বড়সড় একটা কান্ড ঘটিয়ে বসে আছে।উদ্দীপনা সিক্ত মন নিয়ে কল মিলিয়ে ফেললেও পরিকল্পনাহীন খুশবু।কিভাবে জানা যায়?
-“আপনার আজও মন খারাপ?” খুশবু জানতে চাইলো।
তুচ্ছ হেঁসে আফতাব জবাব দেয়, -“মন খারাপ না দুশ্চিন্তা।”
-“কেনো?”
-“সত্যিটা শুনবেন নাকি মিথ্যা?”
-“অবশ্যই সত্যিটা শুনবো। মিথ্যে বলা মহাপাপ।” আগ্রহী গলায় বলে উঠে খুশবু।
“বাবার মাথায় আমার বিয়ের ভূত চেপেছে।জানি না কি চিন্তা ঘুরছে তার মাথায়।এই দুশ্চিন্তা!সে মেয়ে দেখার জন্য হঠাৎ উতলা হয়ে পড়লো কেনো বুঝতে পারছি না।প্রথমবারের মতন বাবার কোনো মতের সাথে নিজের মত মেলাতে পারছি না।”
যেখানে খুশবুর বিষন্ন অনুভব করার কথা সেখানে এই কথাটি শুনে বেশ মজা পেলো।অর্থাৎ আফতাব এখনও কিছুই জানে না।ইচ্ছেকৃত ব্যতিক্রমী উত্তর দিলো,
-“বিয়ের বয়স হয়েছে যেহেতু বিয়ে করে নিন।”
-“আপনি করবেন বিয়ে?করলে বলুন আজই এখনই করে ফেলি।”
নম্র আওয়াজে জেদ এর আভাস পেলো খুশবু। প্রথমবারের মতন।ঠান্ডা বাতাসের ন্যায় সুর তেজী মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।
-“আপনার বাবা যেখানে বলে সেখানে বিয়ে করে নিন ক্যাপ্টেন।বাবা মায়ের বিরোধিতা করা কি ঠিক বলুন?আমার চেয়ে ভালো মেয়ে পাবেন দেখিয়েন।”
-“রাগ জিনিসটা মানুষকে ধ্বংস করে খুশবু।আমি রাগ করতে চাচ্ছি না।”
-“আপনার বাবা যদি আমাকে মেনে না নেন?তখন কি করবেন ক্যাপ্টেন সাহেব?”
-“আপনি আমাকে মেনে নিয়েছেন?”
-“আমার কথার উত্তর দিন আগে?”
আফতাব এর অস্থিরতা বাড়লো।গরম খবর ঠান্ডা হচ্ছে টেবিলের উপর থেকে। সত্যিইতো মেনে নিচ্ছে না।সরাসরি জানিয়েছে খুশবুকে তার পছন্দ নয়।
কপাল কুঁচকে জবাব দিলো, -“আমি নির্ভেজাল থাকতে পছন্দ করি খুশবু।ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলবো না।আমি আপনার কথা বাবাকে জানিয়েছি।তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।”
পুরো কথাটি বললো না আফতাব। খুশবুর হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হোক সে চায়না কোনোকালেই।অন্যদিকে খুশবু জবাব দিলো,
-“সিদ্ধান্ত বিপক্ষে আসলে বাবার কথা মেনে নিতে হবে তাইনা?”
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে আফতাব এর।বাড়িতে রাগ দমন করতে পারলেও এখানটায় পারলো না। অপ্রকাশ্যে জেদ জমিয়ে রুঢ় গলায় বলে উঠলো,
-“ফোনটা রাখছি আমি।”
পেট ফেটে হাঁসি আসছে।এই বুদ্ধি নিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি হলো কি করে তার সেটাই খুশবুর মাথায় খেললো না।হিসেব মেলাতে কাঁচা সে।কারো চতুরতা ধরতে পারলো না।যদি আসলেই কোনো কিছু না জেনে থাকে তাহলে তাকে আরো রাগানো যাবে।সিদ্ধান্ত আপাদত এটাই।
চলবে….