তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-৩৮

0
22

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৩৮
লেখিকা- রিয়া খান

কুয়েতে থাকা প্রতিটা দিন রাত আমার কাছে দমবন্ধকারী লাগছিলো।মনে হতো ওখানকার হাওয়াতে অক্সিজেন নেই।

প্রথম প্রথম খুবই কষ্ট হচ্ছিলো, সব সময় চিন্তায় থাকতাম নিশানের কি হলো না হলো। ঝলক সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো আমাকে ফোনের ওপাশ থেকে স্বাভাবিক রাখার।

যেখানে আমি ঝলকের সাথে অকারণে ফোনে কথা বলতাম না, সেখানে ঝলকের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো। বেশির ভাগ সময় এরকম হয়েছে ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে সেখানে আমি, ঝলক, নিশান তিনজন একসাথে কথা বলতাম।
মাঝেমাঝে ভিডিও কল দিয়ে দেখতাম ওরা একসাথে কোথাও ঘুরছে।
নিশানের জীবনে মিশানের অভাবটা ঝলক কখনোই বুঝতে দেয় নি। ঠিক আমার মতো করেই আগলে রাখছিলো ঝলক। আমার মন খারাপ থাকলেও ঝলক কখনো নিশানের মন খারাপ হতে দিতো না। যখনি দেখতাম নিশান হাসিখুশি আছে, আর সেটা দেখেই আমার মন ভালো হয়ে যেতো।

দ্বীপ প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে, ওর ব্যস্ততা অনেক বেশি ছিলো, সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো নিশানকে সময় দেয়ার। নিশানের একাকীত্ব অনুভব যেনো না হয় সেদিকে নজর রাখার। কিন্তু এতে দ্বীপের উপর বেশি চাপ পড়ে যেতো, আমরা সরকারী চাকুরীজীবী যারা আছি তাদের কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে।আমাদের একদিন নাইট ডিউটি থাকলে পরের দিন দিনে।
কিন্তু ওদের কোনো সময়সীমা ছিলো না, যে যতো খাটবে ততোই উন্নতি করতে পারবে।

দ্বীপকে আমি বার বার বলতাম যেনো নিশানের পিছু সময় দেয়ার জন্য নিজের কাজের ক্ষতি না করে, নিজের উপর জুলুম না করে।কারণ নিশানকে হাসিখুশি রাখার জন্য অলরেডি ঝলক ছিলোই।

এমনও দেখতাম ঝলক নিশানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময় না পেলে নিশানকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই ঘুরাতো।

ওদের একসাথে দেখে আমার খুশিও লাগতো, আবার আফসোসও লাগতো।যদি সেই সময়টাতে আমিও ওদের সাথে এই আনন্দের ভাগীদার হোতাম!

যাই হোক,ভালোমন্দ মিলিয়ে আমার দিনকাল মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিলো।খুব একটা খারাপ যাচ্ছিলো না।

কুয়েতে যাওয়ার আগের দিন দুজন দুজনের প্রতি অতি মাত্রায় আবেগ প্রকাশ করলেও সব সময় আমাদের মাঝে এই ভালোবাসাবাসি টপিক নিয়ে কথা হতো না।

আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের পরিমাণ ছিলো অফুরন্ত। ভুল বোঝাবুঝি, মনের অমিল,মন বিষণ্ণতা, অভিযোগের বোঝা, এসব জিনিস আমাদের সিলেবাসেই ছিলো না।

আমরা কখনো কারো সামনে গভীর আবেগ প্রকাশ না করলেও জানতাম একে অপরকে কতোটা ভালোবাসি, বুঝি!

কথার মাঝে একে অপরকে ভালোবাসার টপিক টা চালানো আমার কাছে খুবই লজ্জাজনক ছিলো, এই ব্যাপারে আমি ঝলকের সামনে খুবই লজ্জা পেতাম। আমার থেকে বেশি লজ্জা পেতো ঝলক। ও আমার থেকেও লাজুক স্বভাবের ছিলো। তাই এই সব টপিক আমরা এভোয়েড করে চলতাম।

টাইম পাস করার জন্য যখন আজাইরা প্যাচাঁলের আশ্রয় নিতে হতো তখন আমরা অই আর সাধারণ প্রেমিক প্রেমিকার মতো মধু মেশানো প্রেমময় কথাতে মগ্ন হোতাম না।

আমাদেত আজাইরা প্যাঁচাল টপিক ছিলো,কোন দেশে যুদ্ধ, বিদ্রোহ,দুর্ভিক্ষ লাগলো। কিভাবে লাগলো যুদ্ধ,কোন দেশ পজিটিভ সাইড,কোন দেশ নেগেটিভ সাইড, সেখান থেকে কি পরিণতি হতে পারে, কিভাবে থামবে,দুর্ভিক্ষ কিভাবে কাটিয়ে তুলবে,এসব আলোচনা চলতো। ঘন্টার পর ঘন্টা এসব কথায় চলতো আমাদের, আমাদের কথার টপিকে মিশান ঢুকলে ও বিরক্ত হয়ে যেতো আমাদের দুজনের উপর।

প্রেমময় কথাবার্তা না হলেও, ঝলক ছিলো সর্বোচ্চ লেভেলের কেয়ারিং। এতোটা ভালো করে বুঝতো ও আমাকে, আমিও এতোটা বুঝতাম না ওকে।ভুল করলে যতোটা শাসন করতো ততোটা ততোটাই সঠিক পথ দেখাতো। আমিও যেমন আমার তরফ থেকে ওকে নিজের মতো করে ভালোবেসেছি।
ঝলকও তেমন নিজের মতো করে ভালোবেসেছে আমায় ।

আমরা দুজনেই কখনো সাধারণ প্রেমিক প্রেমিকার মতো ছিলাম না।
তবুও আমাদের জীবনে কোনো সমস্যা আসেনি, সব ঠিকঠাক প্রবাহমান নদীর স্রোতের বেগের মতো চলছিলো।

বছর কেটে যখন আমার ছুটির সময় এলো, আমি ক্যালেন্ডার দেখে রোজ দিন গুনতাম কবে বাংলাদেশে ফিরবো, সময় যেনো।যাচ্ছিলোই না, তবুও সময় গুলো হজম করতে হচ্ছিলো আমার। এতোটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম প্রত্যেকের জন্য শেষের দিকে ঘুমাতে পারছিলাম না। কত স্বপ দেখতাম সেসময় জেগে জেগে।
আমি কি ঠিক করেছিলাম জানেন? দেশে ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ঝলকের কাছে চলে যাবো আর ওকে জড়িয়ে ধরবো।
কদিন যাওয়ার পর ঠিক করলাম আমি যে ছুটি পাচ্ছি সেটা ঝলককে জানাবো না, সোজা দেশে ফিরে ক্যান্টনমেন্টে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, আর ঝলক যতোই বারণ করুক আমি সেদিন ওর কথা সবাইকে বলে দেবো,মামা মিমিকেও বলবো আমি সোলমেট হিসেবে ঝলককে চাই।
নিশানের সাথে প্ল্যানটা শেয়ার করি,নিশানকে বলি যেনো ঝলক কিচ্ছুটি জানবে তো দূর টেরও যেনো না পায়।
নিশান আমার কথায় সমর্থন জানায়।

ওদিকে ঝলক আমার আগেই জানতো আমি বাংলাদেশে ফিরছি, আমি ওকে কিছু মুখ ফুটে বলিনি বলে ও আমাকে জিজ্ঞেসও করেনি,কারণ ঝলক তো কনফার্ম ছিলো আমি দেশে আসছি।ও দেখতে চেয়েছিলো আমি এক্সাক্টলি কি করবো।

দেশে ফেরার ব্যাপার নিয়ে ঝলকের সাথে কিছু শেয়ার না করার জন্য ঝলকের জন্য সুবিধা হয়ে যায় , কারণ আমার মতো ঝলকেরও প্ল্যান করে। আমি দেশে ফেরার পর ওর পরিবারের সাথে আমাকে দেখা করাবে, আমার কথা তাদেরকে বলবে,মিশন শেষে যখন পার্মানেন্ট দেশে ফিরবো তখন আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দেবে । ঝলকের এই প্ল্যান শেয়ার করেছিলো নিশান আর দ্বীপের সাথে। আমাদের দুজনের প্ল্যান যখন ওদের কাছে সীমাবদ্ধ থাকে তখন ওরা আবার চালাকি করে ঝলকের প্ল্যান আমাকে বলে না, আমার প্ল্যান ঝলককে বলে না।ওরা চেয়েছিলো আমাদের কর্মকান্ডে আমরা নিজেরাই সারপ্রাইজ হয়ে যাবো।

একরাশ স্বপ্ন মস্তিষ্কে বহন করে দিন পার করছিলাম। লাস্ট মোমেন্টে আমি এতোটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম যে বার বার ঝলকের সাথে কথা বলতে গিয়ে যেনো মুখ ফসকে বলে দেই ওকে সব। নিজেকে আটকানোটা একটা বড় রকমের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। সব কিছু ঠিকঠাক করার জন্য আমি মাথায় বুদ্ধি আঁটি কিছু একটা নিয়ে ঝলকের সাথে ঝগড়া করে সেই ছুতোয় দেশে ফেরার আগে ওর সাথে কথা বলবো না, এতে এতোদিনের গড়া প্ল্যানটাও ঠিক থাকবে।

কিন্তু এটা আরেকটা যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো নিজের সাথে!কি নিয়ে ঝগড়া করবো টপিক খুঁজে পাচ্ছিলাম না , মাথা পুরো বিভ্রান্তিকর স্টেজে চলে যাচ্ছিলো। কখনো ওর সাথে ঝগড়া হয় নি,আর আমার কারো সাথে ঝগড়া করার অভ্যেসও নেই। ব্যাপারটা তাই এতো কঠিন লাগছিলো।আমি এমনও করেছিলাম ইউটিব,গুগলে সার্চ করেছি” লাইফ( পার্টনার /প্রেমিকের) সাথে ঝগড়া করার দুর্দান্ত টিপস /”প্রিয়জনের সাথে সহজ উপায়ে কঠিন ঝগড়ার টিপস)

বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন টিপস দেখে উল্টা পাল্টা কি এক্সকিউজ দিয়ে যেনো একদিন ঝগড়া করার চেষ্টাও করলাম, কিন্তু ঝগড়া করতে পারছিলাম না কারণ ওপাশ থেকে ঝলক বুঝেই গেছিলো এই কাজটা আমি ইচ্ছে করে করছি,ও আমার কান্ড দেখে মজা নিচ্ছিলো। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর ঝলক আমাকে ঝগড়া করার সুযোগ করে দেয়। আমার সাথে তাল মিলিয়ে ছোটোখাটো ঝগড়া লাগায়, আমি রাগের অভিনয় করে উল্টাপাল্টা বকে কথা বলা বাদ দিই । সেদিন একটা জিনিস চিন্তা করে দেখছিলাম, লাইফ পার্টনার বেশি ভালো হলেও সমস্যা, জীবনে ঝগড়ারও প্রয়োজন আছে।এতোগুলো বছর জীবন এক নিয়মে চলছিলো নিরামিষ গতিতে।ঝগড়াটা মিছেমিছি হলেও আমরা দুজনেই একে অপরের অজান্তে বেশ মজাই পেয়েছিলাম।
কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারিনি আমার ঝলকের সাথে সেদিনই শেষ কথা হবে!

প্ল্যান মতো দিন গুলো পার করে দেশে এলাম, এয়ারপোর্টে মিমি, দ্বীপ, তাপসিন, নিশান আসে, মামা আসে না । মিমিকে জিজ্ঞেস করলে মিমি বলে মামার কাজ পড়ে গেছে বলে আসতে পারেনি।ব্যাপারটা আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিই।
ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ভাব বিনিময় হওয়ার পর মিমিকে বলি আমার ক্যান্টনমেন্টে কাজ আছে সেখানে যেতে হবে, সেদিন আমার সাথে শুধু নিশান যায়। মিমি, তাপসিন বাড়ি চলে যায় আমার জিনিসপত্র নিয়ে।দ্বীপ আমার সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ওর অফিসে কাজ ছিলো বলে চলে যায়।

যাওয়ার পথে নিশানকে আমি বলি,
-ঝলকের কি খোঁজখবর নিয়েছিলিস?ও কি এখন ক্যান্টনমেন্টে আছে?
-জানি না আপি,ভাইয়া তোমার সাথে সাথে কি আমার সাথেও কথা বলা বাদ দিলো নাকি বুঝলাম না। আমার সাথে গত বেশ কয়েকদিন ধরে কথা হচ্ছে না ভাইয়ার সাথে।অনলাইনেও আসেনি, ফোন দিলে কখনো সুইচড অফ,কখনো বিজি, আবার রিসিভ করলে কথা বুঝা যাচ্ছে না আর এখন পার্মানেন্টলিই অফ দেখাচ্ছে। ভাইয়ার মোবাইলটা মেবি নষ্ট হয়ে গেছে।
-নষ্ট হলে তাই কি,ঠিক করতে এতো সময় লাগে? আর ওর তো টাকার টানাপোড়নও নেই, মোবাইল নতুন একটাও কিনতে পারতো।
-হতে পারে সময় পায় নি কেনার জন্য। ভাইয়া ইদানীং অনেক ব্যস্ত থাকে, আমাকে বলেছে, “নিশান কিছুদিন কষ্ট করে থাকো আমি তোমাকে সময় দিতে পারছি না, কাজের অনেক চাপ। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আমরা আবার ঘুরাফেরা করবো আগের মতো।ভাইয়া সময় দিতে পারছে না বলে তুমি কষ্ট নিও না প্লিজ!আমাকে ফোনে না পেলেও কষ্ট নিও না।তোমার আপিও যদি আমার খোঁজ করে, বলো যে, সব ঠিক আছে,আর যদি আমাকে কল দিয়ে না পায় কখনো, বলো ভাইয়া একটু ব্যস্ত ফ্রি হলেই কথা বলবে,আমি কিন্তু ওর সাথে রাগ করিনি।”

নিশানের সাথে কথা বলতে বলতে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছাই আমি। ভেতরে ঢুকে খেলাম একটা ধাক্কা! ভেতর যেনো পুরোটাই ফাঁকা বলা চলে, হাতে গোনা কয়েকজন লোক দেখছিলাম ! তবুও আমি তোয়াক্কা না করে ঝলকের অফিস রুমে যাই, সেখানে ঝলক নেই!
ইউনিটের একটা কাকও যেনো নেই।
এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগলাম।

হঠাৎ শুনতে পেলাম ক্যান্টনমেন্ট স্টেডিয়ামের দিকে থেকে শব্দ আসছিলো অনেক,ভাবলাম কোনো পারফরমেন্স চলছে ওখানে,হতে পারে ঝলককে অই খানেই পাবো।সেটা ভেবেই ওদিকটাই গেলাম আর গিয়ে দেখলাম একদল সেনা মাঠের মাঝে একটা লাশের খাটে রাখা মৃত লাশ লাল সবুজের পতাকা দিয়ে ঢাকা অবস্থায় রেখে স্যালুট করে সম্মাননা জানিয়ে আসমানে শুন্যে ফায়ারিং করছে।প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরক্ষণেই সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। যা আমার মনেও না, দিলেও না। মনে একটাবারও কু ডেকে বলেনি আমার জীবনে এতো ঘন অন্ধকার নেমে আসছে।

কিছুক্ষণের জন্য আমি মেনে নিতে পারছিলাম না বাস্তবতাটাকে।নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম লাশটা মেজর ঝলকের, ওটা আমার ঝলকের না!
আমি সেদিন কাঁদিনি, ঝলকের সেই উক্তি গুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করছিলাম,”Everything was normal. Everything is normal. Everything will normal.!

আমার কলিজাটা ছিঁড়ে আসছিলো, গায়ে একফোঁটা শক্তি পাচ্ছিলাম না দাঁড়িয়ে থাকার। কিন্তু আমি কাঁদছিলাম না।সর্বোচ্চ চেষ্টা করি নিজেকে কন্ট্রোল করার।কোনোভাবেই যখন পেরে উঠছিলাম না নিজের সাথে তখন নিজেকে বুঝাই ওটা আমার ঝলক না, হয়তো অন্য কোনো ঝলক কিন্তু আমার ঝলক না।
আমি মুখ ছাপিয়ে ধরে নিজেকে বুঝাই।দূর থেকেই ওর লাশটা ফ্রিজিং গাড়িতে নিয়ে যাওয়া দেখি।আমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোরস্তানে গিয়ে অপেক্ষা করি।আমি জানতাম ওর কবর কোন গোরস্তানে হবে।
সেখানে দাঁড়িয়ে ঝলকের সেই পুরোনো উক্তিগুলো মনে পড়ছিলো।
একদিন আমাকে কি বলেছিলো জানেন?
গোরস্তানটা দেখিয়ে বলেছিলো
“দেখো আমি মরে গেলে আমাকে এই গোরস্তানটাতেই কবর দেবে, যদি কখনো অগোচরে হারিয়ে যাই তবে নিশ্চিন্তে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থেকো, তোমার ঝলক এখানেই মাটি চাপা পড়ে থাকবে। আমি মরে গেলে তোমার জন্য একটা শান্ত্বনা কি জানো মিশান? তোমার ভালোবাসার মানুষটা তোমার হয়েই পৃথিবী থেকে চলে গেছে, অন্যকারো ছায়া তাঁর উপর পড়েনি। আমি জানি, আমি চলে গেলে তোমার জীবনে কতোটা অন্ধকার নেমে আসবে, যে অন্ধকারে তুমি কোথায় হারিয়ে যাবে তাঁর ঠিক নেই,তাই চাইবো আমাদের মৃত্যুটা যেনো একসাথেই হয়, কিংবা তুমি আগে মরে যাও আমি পরে মরবো,কিন্তু আমি আগে মরতে চাই না, অন্ততো তোমার জন্য!”

ঝলকের সেই মৃত্যুময় কথাগুলো খুব মনে পড়ছিলো।ভাবা যায়,যার মৃত্যুর কথা আমি ভুলেও চিন্তা করিনি সেই কিনা এভাবে চলে যাবে?বছরের পর বছর আমি নিশানের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, আগে যদি জানতাম আমার এই দিন দেখতে হবে তবে ঝলকের মৃত্যু মেনে নেয়ার প্রস্তুতিটাও নিতাম।
আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম,আমার মনে হচ্ছিলো ঝলকের আত্মা আমার চারপাশ দিয়ে ঘুরাফেরা করছে,আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি চেষ্টা করেও পারছিলাম না ওকে অনুভব করতে। আমার পাশে নিশান থেকে পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারছিলো না ও কি করবে,আমার মতো শক তো নিজেও খেয়েছে,কাঁদবে তো দূর ও আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো আমার এখন কি হবে? আমি কি চিৎকার করে কাঁদবো নাকি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো? ঝলকের মৃত্যু মেনে না নিতে পেরে আমার কোনো ক্ষতি হবে না তো?এসব ভেবে ও ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে চিন্তিতো হয়ে তাকিয়েছিলো।আমি সেখানে দাঁড়িয়ে এতোকিছু চিন্তা করার পরেও নিজেকে মানাতে পারছিলাম না ঝলক নেই।

ঝলকের কথামতোই অই গোরস্তানটাতে ওকে দাফন করা হলো, চোখের সামনে মানুষটাকে সযত্নে কবরে শুইয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। আমি প্রতিটা ধাপ পরোখ করে দেখছি সেই দূর থেকেই।
আমি সেই সময়ের জন্য হয়ে গিয়েছলাম একজন অনুভূতি শুন্য মানুষ। যার ভেতরে সুখ দুঃখের ডেফিনেশন করাটা কষ্টসাধ্য।

ঝলকের আলো নিভিয়ে মিনিটেই আমার জীবনে অন্ধকার ছেয়ে নেয়।নিজেকে নির্জীব জড়বস্তুও মনে হচ্ছিলো। আরো মনে হচ্ছিলো চারপাশের হাওয়া পাথরের রূপ নিয়ে আমাকে চাপ দিচ্ছে আর শ্বাসপ্রশ্বাস আটকে চেপে আসছে আমার ভেতর।

আমি ছিলাম সেই সময় ঝলকের সাথে কাটানো অতীতটাতে।

কারো সাথে কথা বলছিলাম না, একদম নিশ্চুপ ছিলাম। রাতে দেয়ালে হেলান দিয়েও যখন ঝলকের ঘোরে আমি অন্যমনস্ক, চারপাশটাতে অন্ধকার দেখে মনে পড়লো,আমার ঝলকটাও এমন একটা অন্ধকার ছোট্ট ঘরে শুয়ে আছে।
ওর কেমন লাগছে? আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে, তখন কান্না না করলেও আমি অনুভব করছিলাম আমার কান্না করাটা খুব জরুরী নাহলে ভেতরটা শান্ত হবে না, কিন্তু কান্না পাছিলো না, ভেতরে যন্ত্রণা হচ্ছিলো অমায়িক, মনে হচ্ছিলো আমার ভেতরে সালফিউরিক এসিড ঢেলে দিয়েছে কিংবা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ! ইচ্ছে করছিলো কোনো এক জনশুন্য এলাকায় পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে সজোরে চিৎকার করে ভেতরটাকে হাল্কা করি।

আমার কেমন একটা অসহ্য যন্ত্রণা যেনো হচ্ছিলো যা বলে প্রকাশ করতে পারছি না, আমার অই যন্ত্রণা গুলো কেবলই আমি অনুভব করতে পারি কিন্তু বুঝাতে পারিনা কাউকে।

দেশে থাকা কালীন আমি সবার সামনে স্বাভাবিক অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলাম কারণ আমার ভেতরের যন্ত্রণা আমি তো প্রকাশ করতে পারছিলাম না। যে নিশানকে নিয়ে আমার ভাবনা গুলো সীমাবদ্ধ ছিলো, ঝলক মরে যাওয়ার পর যেনো আমি নিশানের সাথেও ঠিক মতো কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।নিশান কখনো আমাকে নিয়ে এতোটা চিন্তা করেনি, যতোটা চিন্তায় পড়েছিলো ঝলক মারা যাওয়ার পর।ও ঘাবড়ে যাচ্ছিলো আমি কেনো এখনো কাঁদছি না সেটা ভেবে, ও বুঝতে পারছিলো আমার কতোটা কষ্ট হচ্ছিলো।নিশান দ্বীপ সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো আমাকে হাসিখুশি রাখার,ওদের কিছু বুঝতে না দেয়ার জন্য আমি ওদের সাথেও অভিনয় চালিয়ে যেতাম।

রাতে ঘুমাতে পারতাম না, চোখ বন্ধ করলেই ঝলকের স্মৃতি, ওর গলার আওয়াজ ওর হাসির আওয়াজ।জানে ওর হাসিটা অনেক সুন্দর ছিলো তিনটে দাঁত হাল্কা কোঁকড়া ছিলো অই দাঁত গুলোর কারণেই হাসিটা এতো মনকাড়া ছিলো।
সব আমার মগজে চেপে বসেছিলো।সেখান থেকেই আমার রাতের দুঃস্বপ্ন গুলো প্রখর রূপ নিতে থাকে রাতের পর রাত।

আমার জীবনটাতে ওখান থেকেই কালো অন্ধকার নেমে আসে।কুয়েতে যাওয়ার পর আরো ভেঙে পড়ি।একদিকে ঝলককে হারানোর যন্ত্রণা আরেকদিকে নিশানকে হারানোর ভয়।ঝলকের মৃত্যুটা আমাকে আরো বেশি দুর্বল করে দেয় নিশানের ব্যাপারে। সব মিলিয়ে আমি অকুলান হয়ে এসব ভুলে থাকার জন্য নেশার আশ্রয় নেই, রেড ওয়াইনের মাঝে ডুবে থেকে যন্ত্রণা ভুলে থাকতাম রাতে। দিনের বেলা কাজের চাপে যন্ত্রণা গুলো যাও চুপসে থাকে রাতের বেলা সেগুলো উন্মুক্ত হয়ে কঠিন যন্ত্রণার দেয়।

ঝলককে ভুলার জন্য মদ ছাড়া আমি আর কিছু পাই নি। কি করবো বলুন?ওকে ভুলার মতো একটা কারণও আমার কাছে নেই। ও কার কাছে কেমন ছিলো আমি জানি না তবে আমার কাছে ও একটা কষ্টিপাথরের মতো ছিলো যার স্পর্শে স্বর্ণ খাটি হয়,আর ঝলকের সঙ্গে থেকে মানুষ সৎ হয়।

আজও আমি ঝলককে ভুলতে পারিনি। এতোগুলো বছরের স্মৃতি কি করে ভুলবো স্যার বলবেন?

আমি পারছি না রোজ রাতে হারানোর যন্ত্রণা গুলোকে সহ্য করতে।
বিশ্বাস করুন আমার পরিবারকে হারিয়ে আমি এতোটা নিঃশ্ব হই নি, বছর দুয়েকের মধ্যেই আমার ভেতর শান্ত হয়ে যায় কারণ মামা মিমি এতো আদর দিয়েছে যে পরিবার হারানোর যন্ত্রণা লাঘব হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু ঝলক আর নিশান আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর আমি একদম নিরাশ হয়ে পড়েছি।
আমার জন্মটাই হেরে যাওয়ার জন্য।
একটা প্রবাদ আছে না স্যার?
We fall,we fail,We break but then we rise,we heal,we overcome.

আমার জীবনে এই Overcome শব্দটার কোনো প্রয়োগ নেই, এর অস্তিত্ব বা কার্যকারীতা আমার জীবনে আসে নি।

আমি তো নিঃশ্ব কাঙালিনী!

কথাগুলো বলতে বলতে শেষ পর্যায় এসে মিশান কান্না করতে করতে ঝলকের মৃত্যুর কথা বলছিলো, তীব্র মিশানের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-একটা প্রশ্ন করবো মিশান?
-বলুন?
-ঝলকের পরিবারের সাথে কি পরে দেখা করেছিলে?
-যার জন্য করবো সেই তো নেই। আর ওর পরিবারের কাউকে তো আমি চিনি না, কোথায় থাকে তাঁরা, তাও জানি না। খোঁজ ই নেই নি আমি।নিয়ে কি লাভ ঝলক তো নেই!যদি ঝলক তাদেরকে আমার কথা বলতো তাহলে তাঁরা কোনো না কোনো ভাবে আমার খোঁজ করতো।তাই আর আমি নিজে থেকে কিছু করিনি।
-আমি তো তোমাকে আমার পরিবারের সামনে নিই নি দীপ্তির কারণে।
ছোটো বেলা থেকেই মায়ের আশা ছিলো দীপ্তি আমার বউ হবে, বড় হওয়ার পর মা ওকে তাঁর ছেলের বউ হিসেবেই দেখে, শুধু মা না বাবা তৃপ্তি সবাই চাইতো আমি দীপ্তিকে বিয়ে করি।
তাই আমি তোমার কথা ওদের সামনে বলার সাহস পাই নি।আমার পরিবারের সবাই আমাকে দেখে ভয় পায় ঠিক,কিন্তু মনে মনে আমিও কিছু ক্ষেত্রে ওদের ভয় পাই কারণ ওরা কষ্ট পাবে। হয়তো সময় চাইলে তীব্রর বউ দীপ্তিই হয়ো কিন্তু সেটা হয়নি!
আর তোমাকে কখনো বলিনি এই কারণে, তুমি তো সব সময় আমার উপর রেগে থাকো, যদি কখনো আমার উপর রাগ করে আমার পরিবারের সামনে গিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলে দাও,সবাই অনেক কষ্ট পাবে ওরা।আমার নিজের মুখে শুনলে যতোটা আঘাত পাবে তার চেয়ে বেশি আঘাত পাবে তোমার মুখে শুনলে।
কিন্তু ঝলক কেনো তোমাকে এতো বছরেও পরিবারের সামনে নেয় নি এটাই বুঝতে পারছি না।
-জানি না, আমিও কখনো আগ্রহ প্রকাশ করিনি ওর পরিবার সম্পর্কে জানার জন্য।
আগ্রহ প্রকাশ না করার যথেষ্ট কারণ আছে।আমার না কেনো যেনো মনে হতো ঝলকের বাবা মা নেই, আবার মাঝে মাঝে মনে হতো ও ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান। যদিও ঝলক কখনো প্রকাশ করেনি।তবে আমার কেনো জানি এমন মনে হতো তাই ভাবতাম, বার বার ওকে জিজ্ঞেস করে মনে কষ্ট না দিয়ে বসি।

-এরকম কেনো মনে হতো?
-কি জানি, আপনা আপনিই এমন ধারণা হচ্ছিলো।
-আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন করবো?
-করুন।
– নিশানের মার্ডার হওয়ার পর তুমি ক্রিমিনালদের ধরে ধরে যেভাবে পানিশমেন্ট দিয়েছো।ধরো ঝলককেও যদি কেউ মারে? আইমিন ওর যদি উল্লেখ্য মৃত্যু না হয়ে মার্ডার করা হয়, তাহলে কি তুমি তাকে বা তাদেরও মারবে?

মিশান তীব্রর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-ঝলকের মার্ডার হয়েছে?

তীব্র একটু বিব্রতকর ভাবে উত্তর দিলো,
-আরে বাবা আমি কখন বললাম ঝলকের মার্ডার হয়েছে? আমি বলেছি ধরো যদি মার্ডার হয়।
মিশান লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো
-জানি নাহ! এই মৃত্যু মৃত্যু খেলা আর খেলতে পারছি না আমি। মানুষ মারার লীলা খেলায় মত্ত এ জীবন এখন বিস্বাদ রূপ নিয়েছে। কখন কি করতে হবে সেটা আমার মাথায় এখন আর খেলে না।আমার জীবনে সব হারিয়েও যদি ঝলক আর নিশান থাকতো আমার জীবনটা অনেক সুন্দর গোছানো থাকতো। জীবনটা হেরে গিয়ে মদের সাথে বন্ধুত্ব করতো না।

কথার মাঝে থেমে গিয়ে বোতলে চুমুক দিয়ে মিশান তীব্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-আচ্ছা স্যার ঝলকের কি মার্ডার হয়েছে?সেটা আমি জানলাম না কেনো?আপনি কি জানেন কে মেরেছে?
-কি ক্কি সব ব বলছো! তুমিই তো বললে ঝলক হেলিকপ্টার ক্র‍্যাশ করে মারা গেছে,এটা মার্ডার কি করে!আমি তো তোমাকে এ এমনিই প্রশ্ন টা করেছিলাম।মিশান তোমার নেশা চড়ে গেছে অনেক বাড়ি যাও এখন!উল্টাপাল্টা বলা শুরু করেছো।
কথাটা বলেই তীব্র একটু তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো, চলে যাবে বলে।
মিশান বসে থেকেই তীব্রর দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বললো,
-স্যার!
সাড়া না দিয়ে উত্তরে তীব্র বললো,
-বাড়ি যাও মিশান।
-ঝলকের যদি সত্যিই মার্ডার হয় না, তাহলে ওর খুনিকে বা খুনিদের নিশানের খুনিদের চেয়েও নৃশংস ভাবে মারবো, মনে রাখবেন,তার জন্য আমার কারো হেল্পও লাগবে না।ঝলক আমার সোলমেট, আমার জীবনের একটা অংশ, আমি নিশানের মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ঝলকের না,তাই নিশানের মৃত্যুর থেকে ঝলকের মৃত্যু বেশি আঘাত করেছে আমাকে।

-আমার কাজ আছে, তুমি বাড়ি গেলে যাও না গেলে থাকো এখানেই। আল্লাহ হাফেজ।

মিশানের কথার প্রসঙ্গ এড়িয়ে তীব্র চলে গেলো, মিশান সেই এক জায়গাতেই বসে রইলো।লাস্ট মোমেন্টে তীব্রর ব্যবহার টা মিশানের চোখে অন্য রকম লাগলেও তোয়াক্কা করলো না। ঝলকের কথা খুব গভীর ভাবে মনে পড়ে গেছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ড্রিঙ্ক করে যাচ্ছে।

(চলবে)