তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-০৬

0
20

#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৬
জনবহুল পাব্লিক প্লেসে লোকটা অনবরত কাকুতি মিনতি করেই যাচ্ছে তীব্রর সামনে। লোকটার চোখ দিয়ে পানি এখনো বের না হলেও গলা ভিজে গেছে,
অনেকে গাড়ির ভেতর থেকে তাকিয়ে দেখছে লোকটার অবস্থা। রাস্তার পাশের ফুটপাতের দোকানদার গুলো তো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে, আর হয়তো এই দারোগা টাকে মনে মনে গালী দিচ্ছে। এই রাস্তার মানুষ গুলো যেনো লোকটার বর্বরতা শাস্তির অপেক্ষাতেই ছিল।
লোকটা আশেপাশে খেয়াল না রেখে শুধু তীব্রর দিকেই তার নজর, মিনিট খানেক পর হয়তো পায়েও ধরবে। কিন্তু এগুলোতে কোনো লাভ নেই যদি তীব্রর সামনে লোকটা সুইসাইড ও করে নেয়, তীব্র ফিরেও তাকাবে না। শুধু নাম তীব্র না এর ভেতরটাও তীব্রতর কঠোর।
লোকটা প্রথমে যে অপরাধ করেছে তার ক্ষমা হয়তো পেতো, কিন্তু পরবর্তীতে যে বেয়াদবি টা করেছে, মা তুলে গালী দিয়ে শার্টের কলার চেপে ধরে চোখ রাঙিয়েছে এটা তীব্রর ইগো পারসোনালিটিতে লেগেছে মারত্মক ভাবে। ভালোমতোই বুঝা যাচ্ছে এর ক্ষমা নেই এতো সহজেই।
তীব্র নিজের মতো রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম ক্লিয়ার করছে। আশেপাশের লোকজনও বুঝতে পারল যে লোকটা এসে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে সে কোনো সাধারণ জনগণ নয়। আশেপাশে যারা প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যটি দেখেছে তাঁরা একে অপরের সাথে কানাঘুষা করছে আর ফুটপাতে অনেকেই কৌতুহল নিয়ে ভীড় করে বাকি দৃশ্য দেখছে যেনো রাস্তায় কোনো শ্যুটিং চলছে। জ্যাম ক্লিয়ার হতেই তীব্র নিজের গাড়ির দিকে যাচ্ছে, তীব্রর পেছন পেছন রিফাত আর অই দারোগা টা, লোকটার কাকুতিমিনতির প্রবলতা বেড়েই চলছে। তাতে তীব্রর লেশ মাত্র বিভাবন নেই। সিগারেট ধরিয়ে মনের গতিতে টানতে টানতে গাড়ির কাছে গেল। এমন টান টান সময় রিকশায় করে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো মিশান।সামনের দিকে তীব্রকে দেখে রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দুই হাতে বড় বড় বাজারের ব্যাগ নিয়ে তীব্র কাছে গেল।
ঠোঁটে বোকা বোকা হাসি নিয়ে তীব্রকে সালাম দিলো,
‘‘স্যার আসসালামু আলাইকুম স্যার।’’
তীব্র গাড়িতে উঠতে নিচ্ছিলো, এমন সময় ভিন্ন স্বরে সালাম শুনে পেছনে তাকালো,
মনে মনে সালামের উত্তর নিয়ে কিছু বলার আগেই মিশান বলে ফেললো,
‘‘কেমন আছেন স্যার? আমাকে চিনতে পেরেছেন? অই যে কবে যেনো আমি ব্রিজ থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম আপনি ধরে বাঁচিয়েছেন!’’
তীব্র উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে মিশানের উপর থেকে নিচ তাকিয়ে দেখলো। দুই হাতে তিনটে ব্যাগ ভর্তি বাজার করেছে।
‘‘কর্নেলের ভাগ্নি, সেন্টিখোর তাই না?
মিশান দাঁত কেলিয়ে উত্তর দিলো।’’
‘‘জি স্যার।’’
‘‘এতো ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছো
ওজন লাগছে না?’’
‘‘না স্যার আমি রিকশায় যাচ্ছিলাম, আপনাকে দেখে এগিয়ে এলাম।’’
‘‘এগুলো তো রিকশায় রেখেও আসা যেতো।’’
‘‘আসা যেতো কিন্তু যদি আমি এগুলো নিতে ভুলে যাই, কিংবা রিকশাওয়ালা এগুলো নিয়ে কেটে পড়ে তাহলে আমার আবার প্রথম থেকে বাজার করতে হবে, এদিকে আবার বাজার করার মতো টাকা আমার কাছে তো নেই ই তার উপর এগারোটার আগে বাড়িতে বাজার নিয়ে পৌঁছাতে হবে, তার জন্য আরকি।’’
‘‘মাথায় তো এই ধরণের ফিলোসফি অলওয়েজ সেট থাকে, তাহলে কাজের কাজ ভুলে যাও কেনো?’’
‘‘কি করবো স্যার আদত!’’
‘‘কি কি বাজার করেছো।’’
‘‘সব কিছুর নাম জানি না তো, সামনে যা দেখেছি দেখতে যেটা ভালো লেগেছে সেটাই দামাদামি করে কিনে এনেছি, শুধু দুই একটা সবজির নাম জানি আলু, গাঁজর, টমেটো, শসা।’’
‘‘ওহ।’’
‘‘স্যার একটা শসা খাবেন? একদম টাটকা আর কচি। আমি রাস্তা দিয়ে খেতে খেতে এসেছি, ভাববেন না এগুলো নোংরা, দোকানদার অনবরত শসার উপর পানি ছিটাচ্ছে যেনো ময়লা না পড়ে শসাতে। লোকটা কত্ত ভালো তাই না স্যার? ব্যাপারটা হাইজেনিক লেগেছে বলে বেশি করে কিনে এনেছি। মামা খুবই খুশি হবেন এতো সুন্দর পরিষ্কার টাটকা শসা দেখে।’’
‘‘ওটা পানি ছিটাচ্ছিল না, ফরমালিন ছিটাচ্ছিল যেনো শসা গুলো টাটকা দেখায়।’’
সেন্টি খেয়ে মিশান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
‘‘বলেন কি স্যার! আমি যে রাস্তায় কতগুলো শসা খেয়ে ফেলেছি এখন কি হবে আমার? পেট খারাপ হবে? নাকি পেটে ফরমালিন ব্লাস্ট হবে?’’
‘‘কিছু হবে না, ডোন্ট ওরি।’’
‘‘ওহ তাহলে আপনিও একটা শসা খান স্যার!’’
‘‘না খাবো না আমি।’’
‘‘নিন না স্যার একটা, সেদিন এতো বড় উপকার করলেন এর বিনিময়ে একটা শসা অফার করতেই পারি আপনাকে।’’
তীব্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিশানের দিকে হাত বাড়ালো, মিশান ব্যাগ থেকে একটা শসা বের করে দিলো। উপকারের বিনিময়ে মানুষ মিনিমাম চা কফি অফার করতে পারে কিন্তু এখানে শসা অফার করা হচ্ছে, ব্যাপারটা আজব হলেও ঘটনা সত্যি। তার উপর তীব্র কখনো মিশানকে ওরকম ভাবে বাঁচায়ওনি ওরকম সিচুয়েশনে মিশানকে দেখলে উল্টো আরো ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে তীব্র। মিশান নেশার ঘোরে মন মতলবি একটা কাহিনী বানিয়ে নিয়েছে আর সেটাই বিশ্বাস করা শুরু করেছে। তীব্র ব্যাপারটা ভালো মতো বুঝতে পেরেছে বলে উল্টো রিয়্যাকশন দেয় নি। রাতের বেলা রাস্তাতে মাতলামো করা, আর দিনের বেলা যার তার সামনে এসে মনমতলবি গল্প শোনানো মিশানের প্রায় সময়ের রেগুলার রুটিন হয়ে গেছে।
যার কবলে তীব্রও পড়ে মাঝেমধ্যে, সেই জন্য ওর নাম ই দিয়েছে সেন্টিখোর।
তীব্র মিশানকে চিলতে পরিমাণও পছন্দ করে না, ইচ্ছে করে পানিতে ডুবিয়ে মারতে কিন্তু পাগলের উপর রাগ ঝেড়ে হবে টা কি? সেটা ভেবেই চোখ বুজে মেনে নেয়। তার উপর কর্নেলের ভাগ্নি।
মিশান চলে যাওয়ার পর তীব্র গাড়িতে উঠতে যাবে তখন অই পুলিশিটা আবারও তীব্রর কাছে অনুনয় করতে লাগলো,
‘‘স্যার প্লিজ স্যার! আমার কৃত কর্মে জন্য দুঃখিত স্যার। আর হবে না এমনটা! স্যার প্লিজ ক্ষমা করুন !’’
‘‘ঠিক আছে ক্ষমা করতে পারি শর্ত আছে একটা, যদি পূরণ করতে পারেন তবে আমি আপনার বেয়াদবি ছেড়ে দেবো।’’
‘‘কি করতে হবে স্যার?’’
‘‘আমি শুন্যে একটা গুলি করবো, আপনি যদি সাথে সাথে বুলেট টা ফেরত আনতে পারেন আমি ছেড়ে দেবো আপনাকে প্রমিস!’’
লোকটা থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, তীব্র সানগ্লাস পড়তে পড়তে গাড়িতে উঠে বসলো। লোকটাকে ক্রস করে রিফাতও গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
‘‘রিফাত।’’
‘‘জি স্যার?’’
‘‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’’
‘‘স্যার আজকের বেলায় মুন্সিগঞ্জ হয়ে শীবচর যাওয়ার কথা ছিল।’’
‘‘প্ল্যান ক্যান্সেল।’’
‘‘তাহলে কোথায় যাবো স্যার এখন?’’
‘‘আমি রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি ডানে বামে কোন দিকে যেতে হবে গাড়ি সেদিকেই নিতে বলো।’’
‘‘ওকে স্যার।’’
তীব্র এক্সাক্ট জায়গার নাম না বলে ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছে গাড়ি কোন দিকে নিতে হবে।
কখনো ডানে কখনো বামে আবার কখনো স্ট্রেইট এভাবেই যাচ্ছে গাড়ি রিফাত আর ড্রাইভার দুজনের কেউ বুঝতে পারছে না ওরা আসলে কোথায় যাচ্ছে। এ যাত্রার গন্তব্যস্থল কেবল তীব্র আর সৃষ্টিকর্তাই জানেন। যেতে যেতে তুরাগ থানার সামনে থামলো গাড়ি, তীব্র একা একা বের হলো গাড়ি থেকে। এমন ভাবে ভেতরে প্রবেশ করল যেনো কেউ বুঝতে বা চিনতে না পারে ওকে। কিন্তু ওসিকক্ষে যেতেই ওসি তীব্রকে চিনে ফেলে, সাথে সাথে দাঁড়িয়ে স্যালুট জানালো। অনেকটা শক খাওয়ার মতো চেহারা হয়ে যায় তীব্রকে দেখে।কোনো প্রকার ইনফরমেশন না দিয়ে হুট করে আসাটা খুব অস্বাভাবিক ভাবে নিল।
বসার জন্য নিজের চেয়ার ছেড়ে দিলো, তীব্র ওসির চেয়ারে না বসে সাধারণ চেয়ারেই বসল।
থতমত খেয়ে শীঘ্রতার সাথে বলল,
‘‘স্যার প্লিজ ওখানে বসবেন না, এই চেয়ারে বসুন প্লিজ!’’
তীব্র শান্ত স্বরে বলল,
‘‘অফিসার, বি কমফোর্টেবল। আপনি আপনার জায়গায় বসুন, আমি এখানে বসাতে চেয়ার ভেঙে পড়ছে না। বড় কথা হলো কখনো নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য কাউকে দিতে নেই।’’
‘‘তা কি করে হয় স্যার, আপনি আমার সিনিয়র।’’
স্যার চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস কোনটা দেবো? নাকি সব কটাই আনাবো?
‘‘আরে অফিসার আপনি প্লিজ শান্ত হোন, আমি এখানে চা কফি খেতে আসি নি, দু মিনিটের একটা কাজে এসেছি। সিনিয়রদের সম্মান স্বরূপ এতো ফর্মালিটি পালন তখনি করবেন যখন তারা এমনিই আসে বাট আমি এখানে কাজে এসেছি সময় খুবই কম। আপনি প্লিজ বসুন। আমাকে সিনিয়র হিসেবে না দেখে কলিগ বা গেস্ট হিসেবে দেখুন।’’
ওসি খানিকটা বিভ্রান্তিকর অবস্থাতে পড়ে গেল,
‘‘স্যার তাই বলে কিচ্ছু নেবেন না?’’
‘‘অফিসার,দয়া করে স্বাভাবিক হোন।
আমার হয়তো আবার আসতে হবে এখানে, আপাততো আমাকে এই থানার এমপির সম্পর্কিত সকল তথ্য দিন, আর আপনার আগে যে ওসি ছিল এই থানার তাঁর ডিটেইলস দিন ।’’
‘‘স্যার এই সামান্য কাজের জন্য আপনি এখানে এসেছেন! আমাকে কল দিয়ে অর্ডার করতেন আমি নিজেই উপস্থিত হোতাম।’’
‘‘আমার নিজের কাজ কেনো আপনার ঘাড়ে চাপাবো? সরকার কি আমাকে ফ্রিতে টাকা দেয় মাসে মাসে? আমার কাজ আপনাকে দিয়ে করালে হয়তো আমার অলসতাকে প্রশ্রয় দেয়া হবে, কিন্তু আপনার দু পয়সা লাভ নেই।’’
‘‘স্যার দুই মিনিট বসুন আমি দিচ্ছি সব কিছু। আমাদের একজন এসআইএর সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক এই এলাকার এমপির। আমি তাকে ডাকছি।’’
‘‘হুম ডাকুন। আমাকে কি ঘন্টা খানেকের মধ্যে এমপির সাথে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’’
‘‘জি স্যার অবশ্যই, এটা আবার কি আহামরি কাজ!’’
‘‘ওকে থ্যাংক ইউ।’’
ওসি সাহেব সেই এসআইকে ডেকে পাঠালো, আর সে আসার পর তীব্র কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলো উনি উত্তর দিলো সব কিছুর। অতঃপর এমপি সাহেবকে কল দিলে সে জানালো ঢাকার বাইরে আছে। তীব্র কিছুক্ষণ মনে মনে মাথার মধ্যে কিছু একটা সেট করলো। তারপর থানা থেকে বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ পরে ফিরবে বলে।
প্রায় দুই ঘন্টা ধরে মিশান বই খাতা নিউজ পেপার নানান জিনিসের ভেতর খোঁজাখুঁজি করে যাচ্ছে কিছু একটার।নিজের ঘর পুরো এলোমেলো করে ফেলেছে। ওয়ালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় রেখেছে জিনিস টা।
ঘর থেকে বেরিয়ে তাপসিনের রুমের দিকে যায় তাপসিন রুমেই ছিল, মিশান নক করে পারমিশনের জন্য অপেক্ষা না করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সাথে সাথে রুমাল দিয়ে নাখ মুখ ছাপিয়ে ধরে।
‘‘কিরে পারফিউম মেরে ঘর পুরো বৃন্দাবন বানিয়ে দিয়েছিস কেনো?’’
তাপসিন বোকা বোকা চেহারায় উত্তর দিলো,
‘‘আসলে ঘটনা হয়েছে কি আপি পশ্চাৎ পায়ুপথ দিয়ে নিঃসরিত বায়ুর তীব্র দুর্গন্ধের কারণে পারফিউম টা রুমে স্প্রে করেছি যেনো গন্ধটা শোষণ করে নেয়।’’
মিশান চোখ গরম করে কঠিন স্বরে বলল,
‘‘ইডিয়েট!’’
গালী দিয়েই মিশান সজোরে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, পারফিউমের স্মেইল মিশানের জন্য পুরো হারাম, এলার্জি প্রবলেম।
কিছুক্ষণ পর তাপসিন মিশানের দিকে যাচ্ছে মিশান দূর থেকে দেখেই তাপসিনকে বলে উঠল,
‘‘এই খবরদার গোসল না দিয়ে আমার ধারে কাছে আসবি না।’’
‘‘না আপি দেখো আমি জামা চেঞ্জ করে এসেছি, গায়ে কোনো স্মেইল, পারফিউম ফ্লেভার কিচ্ছু নেই।’’
‘‘দূরে থাক তুই বলছি।’’
তাপসিন গতি থামিয়ে বলল,
‘‘ওকে, তাহলে বলো কোনো দরকারে গিয়েছিলে আমার রুমে?’’
‘‘না এমনিই।’’
‘‘না তুমি তো এমনি এমনি আমার চেহারা দেখতে যাও না আমার রুমে। বলো বলছি।’’
‘‘তোর যে ল্যাপটপ টা ওটা আমাকে দিতে হবে কয়েকদিনের জন্য, আমারটাই প্রবলেম হয়েছে।’’
‘‘দ্বীপ ভাইয়ার টা নাও।’’
‘‘দ্বীপের কাজ আছে, ওর টা দিয়ে। তোর তো আর কাজ নেই।’’
‘‘না মানে অনলাইনে গ্রুপ স্টাডি করতে লাগে তো।’’
মিশান জবাব না দিয়ে তাপসিনের মোবাইল টা বের করে ওর দিকে দিলো।
‘‘বাহ! এটা কখন আনলে তুমি?’’
‘‘বাইরে যাওয়ার পর কল দিয়েছিলাম এক লোক রিসিভ করে বলল, তার কাছে ফোন, তারপর দিয়ে গেল।’’
তাপসিন আশ্চর্যরকম হয়ে বলল,
‘‘এটা কি করে সম্ভব! আমি তো সেই রাত থেকে কল দিয়ে যাচ্ছি একটু আগেও কল করছিলাম কম করে হলেও এক হাজারের উপর কল দিয়েছি, প্রতিবার সুইচ অফ ছিল আর তুমি বলছ কল দিয়ে কথাও বলেছো! আবার মোবাইলও এনেছো!’’
মিশান ধমকের স্বরে বলল,
‘‘এহহ! এতো কথা কিসের? মোবাইল পেয়েছিস, এখন মুখ বন্ধ। এখন তোর ল্যাপটপ টা নিয়ে আমার রুমে রেখে আয়।’’
তাপসিন মাথায় প্রশ্ন ও চোখে ভয় নিয়ে আনমনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিয়ে চলে গেল। পুরো ব্যাপারটা রহস্যময় লাগলো। মিশানের কিছু কিছু কাজকর্ম তাপসিনের মাথার উপর দিয়ে যায়। মিশান ড্রয়িংরুমের ভেতর পায়চারী করছে, আর দাঁতে দাঁতে কুটকুট করে কিছু একটা ভাবছে।
রাত প্রায় আড়াইটা, স্থান মিরপুর-১০।
শুনশান নিরিবিলি নিস্তব্ধতায় পূর্ণ শহর।
শহর জুড়ে জনমানবের অস্তিত্বের অনুপস্থিতি।
পিচ ঢালাইয়ের রাস্তার দুই পাশে ল্যাম্পপোস্টে এখন আর আগের মতো তেলেরবাতি জ্বলে না। সোডিয়াম বাতি, এলইডি লাইটের জন্য ফুরফুরে আলোর নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে হাই ওয়ের উপর দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ বড় বড় গাড়ি যাচ্ছে দু একটা, রোড লাইট গুলো জ্বলছে ঠিকি কিন্তু কুয়াশাপূর্ণ পরিবেশ হওয়াই আলোর বিচ্ছুরণ তেমন একটা জুড়ালো হচ্ছে না।চারপাশেই মোটামুটি আলোর বিস্তৃতি কম, এর মধ্যে যদি হঠাৎ করে সারিবদ্ধভাবে বেশ কয়েকটা আলো নিভে যায়?
লেট নাইট পার্টি থেকে ফিরছিলো তুরাগপুর থানার এমপির ছেলে মারুফ।
গাড়িটা চলছেনা কোনো মতেই, বন্ধুরা সব চলে গেছে। তারওপর মোবাইলেও চার্জ নেই যে, কাউকে কল করবে।
বাধ্য হয়ে রোড ক্রস করে ওপাশে গিয়ে গাড়ি ধরে বাসার দিকে যাবে বলে ঠিক করে। ফুটওভার ব্রীজের উপর দিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় হুট করে একটা বিক্ষিপ্ত হাওয়ার মতো কিছু একটা বিচরণ করলো, আর সাথে সাথে সারিবদ্ধ আলো গুলো নিভে গেল। সেকেন্ডেই মারুফ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
রোডের উপর ফুটওভার ব্রীজের উপরও বাতি গুলো নিভে গেছে, ভালোমতো একটা ভূতুড়ে পরিবেশের ফিল আসছে।
মারুফ অনেকটা ভয় পেয়ে গেল। এর মধ্যে যেনো শুন্যে থেকে একজোড়া নীল রঙের আলোর মতো লেজার লাইট বিশেষ কিছু তীর্যকভাবে চোখে বিঁধছে, আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে এমনটা দৃশ্যমান মনে হচ্ছে। মারুফ বুঝতেও পারছে না এই মুহুর্তে আশেপাশে ও ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি এখানে আছে কিনা। চোখের মতো যা জ্বলজ্বল করছে তা কি আদৌ চোখ নাকি অন্যকিছু। এরমধ্যে দূর থেকে কেউ কিছু একটা দিয়ে ঢিল ছুঁড়েছে হয়তো যা সোজা মারুফের মাথায় আঘাত করে, অনেকটা ব্যাথাও পেলো, নিমেষেই কানের উপরিভাগ থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছে, এতে বুঝতে পারলো আশেপাশে কেউ আছে ।
একটা বিকট হেঁটে আসার আওয়াজের সাথে ভয়ংকর প্রোজ্জ্বলময় চোখ দুটো ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
ভয়ে আতংকে মারুফ বলে উঠল,
-ক্কে কেহ?’’
কোনো প্রতিউত্তর এলো না,
কাঁপা গলায় আবারো বলে উঠল,
-কেউ তো আছো, কথা বলছো না কেনো? কেহ?’’
যখন অনুভব করল মারুফের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, হাত টা মাথার সেই স্থানে রাখার আগেই কেউ ওর হাত দুটো পিঠের সাথে চেপে হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকে দিলো, এক্সট্রা কোনো আওয়াজ করার আগেই একটা বল বিশেষ কিছু মুখের ভেতর গুঁজে দিলো।
অবশ্য এখন চিৎকার আওয়াজ করেও ফায়দা নেই, হঠাৎ হঠাৎ যে বড় বড় গাড়ী গুলো যাচ্ছে তার সাথে আওয়াজ গুলো মিশে যায়। ছেলেটার কোনো কাকুতিমিনতিই এখন কাজে দিবে না, ড্রিঙ্ক করায় গায়ে তেমন শক্তিও নেই।
যে এমনটা করছে বুঝাও যাচ্ছেনা স্পষ্ট, সে মানুষ নাকি কোনো প্রেতাত্মা! চোখ দুটো বড্ড ভয়ংকর ভাবে জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারের মাঝে!

চলবে………………