#তোমাকে_চাই ।০৪।
#সাইরা_শেখ
প্রিয়তা আশেপাশে তাঁকিয়ে সন্তর্পণে সালামের জবাব দিয়ে বলল,
– ভাইয়া, প্লিজ ভাবি ডেকে ঝামেলায় ফেলবেন না। দেখুন, ভাবি ডাক শুনে সবাই কিভাবে তাঁকাচ্ছে।
সিয়ামও চারপাশে তাঁকিয়ে বলল,
– ডাক শুনেই ভয় পাচ্ছেন?যখন ভাইয়ের সাথে গাড়িতে উঠে যাবেন তখন তো এমনিতেও সবাই দেখবে। ইটস নরমাল ভাবি, তারপরেও যদি কেউ কিছু বলে সেটা দেখার জন্য আমরা আছি তো।
– যাবো মানে? কোথায় যাবো?
– সেকি ভাই বলেনি? চাচিরা রান্না করে পাঠিয়েছেন। ভাই সেসব নিজে বয়ে এনেছে,আপনার সঙ্গে বসে খাবে বলে।
– আপনার ভাই এত রোম্যান্টিক?
– আগে ছিল না, এখন বোধহয় রোম্যান্টিকতা একটু একটু শিখছে। আপনি আসছেন তার জীবনে, এসবের প্রয়োজন তো পড়বেই। নয়তো আমরা ভাইপো-ভাইজি পাবো কোথ থেকে?
প্রিয়তা হাসার চেষ্টা করে বলল,
– আচ্ছা! আপনার ভাই কি আপনাদের মতই ঠোঁটকা’টা? বেশরম টাইপের।
সিয়াম নাওফিলের বলা কথাটি ধরতে পারল এবার। মেয়েটা আসলেই বোকা বা ভীতু টাইপের নয়। ভাবি হিসেবে এমন মেয়েই তো প্রেফার করে সে।নয়তো তার ভাইয়ের সঙ্গে ভাবিকে মানাবে কি করে? পরপরই প্রিয়তা বলল,
– অহনা আপুর কি খবর?
– আছে ভালোই। বিয়ের চিন্তা করছি। ওর ফাইনাল এক্সামের পর। ওহ থ্যাংকস ভাবি, অহনার বোকামির ব্যাপারটা গোপন রাখার জন্য। আমি গতকাল জেনেছি ওকে হসপিটালে আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রিয়তা ইশারায় আঙ্গুল তুলে নাওফিলকে দেখিয়ে বলল,
– ভালো তো ওই লোকটাকে বাসতো?
– না, না ভুল বোঝাবুঝি ছিল।আপনাকে আইডির কথা দেখিয়েছিল বলে ভেবেছেন ওটা ভাই। অহনা জানতো ফোনে আমিই কথা বলি। ও ভুল বোঝাবুঝি আর রাগের বশে ওমন করে ফেলেছিল।
প্রিয়তা ফোঁড়ন কে’টে বলে,
– তা আপনার ফোন, আইডি নেই? পরের ফোন দিয়ে প্রেম করতে হবে কেন?
– তা ছিল, কিন্তু প্রথমদিকে ও আসলে ভাইকেই পছন্দ করতো। আর আমি ওকে পছন্দ করতাম, তাই হালকার ওপর ঝাপসা ছলনা করে কথা বলা শুরু করি। পরে অভ্যাস হয়ে যায়,নিজের আইডিতেও যে কথা বলা যায় ভুলেই গেছিলাম। মানে এদিক-ওদিক হয়ে গেছিল আর কি।
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বলে,
– এই ব্রেইনে কাজ করলে জীবনটাও এদিক-ওদিক হয়ে যাবে। সতর্ক হন।
– মাথায় রাখবো ভাবি। তা উল্টো পথে হেটে আসলেন কেন? ভাইকে দেখেননি? নাকি তাকে দেখেই আপনি উল্টোপথে এসে…
প্রিয়তা সংকুচিত স্বরে জবাব দিল,
– পা কোমর লেগে গিয়েছিল। তাই হেটে ছাড়াচ্ছিলাম। আর কিছু না।
সিয়াম হেসে বলল,
– ওহ আচ্ছা।
কথা বলতে বলতে ওরা নাওফিলের কাছে এসে পৌঁছাল। নাওফিল চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে শার্টে গুজে রাখল। এরপর প্রিয়তার দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– পরীক্ষা কেমন হলো?
প্রিয়তা চারপাশ দেখিয়ে রাগত স্বরে বলল,
– শো-অফ করছেন? যাতে সবার নজরে পড়ি।
– তা একটু করছি। সবাইকে জানাতে হবে না কিভাবে আমাকে ফাঁদে ফেলেছো। আমি ক্ষোভ ঝারতে পারছি না, আমার হয়ে ওরা ঝারবে।
চোখমুখ কুঁচকে প্রিয়তা তিক্তস্বরে বলল,
– ভালো।
নাওফিল শার্টের হাতা গুটিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ধরে, দাঁড়িয়ে সামান্য কুর্নিশ করে প্রিয়তাকে ভেতরে ঢুকতে বলে। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ প্রিয়তা। ভাবটা এমন, কুরবানির জন্য কেনা বকরির যত্ন নিচ্ছে। মোটা তাজা করে তারপর কুরবানি দেবে। এই যত্ন নাওফিল নামক মানুষটির থেকে আশা করা যায়না। এসব সত্য নাকি প্রিয়তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা? নাওফিল খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বলল,
– কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ম্যাডাম? গাড়ি পছন্দ না হলে রিকশা নেই? ঠান্ডা হাওয়ায়, পাশাপাশি বসে, প্রকৃতির স্বাদ নিতে নিতে যাবো।
প্রিয়তা নীরসমুখে বলল,
– দরকার নেই,আজকাল আমার রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। স্বাদ ঠিক পাচ্ছি না।
প্রিয়তা গাড়িতে উঠে বসে। নাওফিল পাশের সিটে বসে দরজা লক করে।এরপর সিটবেল্ট লাগিয়ে স্টিয়ারিং’য়ে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– তবে আমার রুচি তারিফের যোগ্য।
– যা আপনি পছন্দ করেন না।
– করতাম না। এই তো কিছুক্ষণ আগে তোমাকে ভালো করে দেখার পর থেকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। তোমার রূপ আমাকে টানছে ভীষণ। বিয়ে অবধি সবুর করতে দিচ্ছে না। পরীক্ষা কবে শেষ হবে?
– নেশা করে এসেছেন? মনে হচ্ছে না একটু বেশি ফালতু কথা বলছেন, অসভ্যদের মত।
– তুমি তো জানোই আমি ভদ্র, সভ্য নই তাহলে আমার থেকে মূলত কি আশা করছ? সভ্য প্রেমিক হয়ে প্রেমের ভিক্ষা চেয়ে বেড়াবো? আজ তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি, মা খাবার পাঠিয়েছে, কথা শুনে খাবারের বক্সগুলো নিয়ে সোজা হলে যাবে।
– দ্রুত বলুন।
– বিয়ে হলেও বউয়ের অধিকার পাবে না। বাড়ির বউ হতে চাচ্ছো ভালো কথা, আমার বউ হওয়ার চেষ্টা ভুল করেও করবে না। করলে তার ফল ভালো হবে না।
গাড়ি থামলো। প্রিয়তা গাড়ি থেকে নেমে স্বল্পসরে বলে উঠল,
– আপনার মত প্রিন্স চার্মিং আমার পেছনে সর্বদা দশ বারোটা লেগেই থাকে। ঠেকা না পড়লে বিড়ালচোখী আপনাকে বিয়ে কেন? ফিরেও দেখতাম না। নিজেকে কি মনে করেন? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুদর্শন? ঠিকভাবে তো হাসতেও জানেন না। চেহারা প্যাঁচার মত থাকে, নাকটা দেখেছেন? এই খাড়া লম্বা নাক, যার তার ব্যাপরে নিজ দায়িত্বে গলাতে চলে আসে। হাইট দেখেছেন? আইফেল টাওয়ার, ব্যালেন্স ছাড়া। খালি বয়লার মুরগির মতো সাদা হয়েছেন, চেহারা-সুরতে আমার পছন্দের লিস্টের আশেপাশেও নেই।তারপরও স্যাক্রিফাইজ করছি সবার জন্য। বুঝেছেন?আর ওই খাবার নিয়ে গিয়ে নিজে খান, আমার পেট ভরে গেছে আপনার লেকচার শুনে। আহা! আমি নাকি ওনার বউ হওয়ার চেষ্টা করবো, যত্তসব।
প্রিয়তা কথাগুলো বলে চলে আসতে লাগলে পেছন থেকে চিৎকারের সহিত ধমক ভেসে আসে,
– এ্যাঁই, মেয়ে দাঁড়াও।
ধমকের জোর এতটাই বেশি যে আশেপাশের সবাই তাঁকিয়ে পড়েছে। নাওফিলের চেহারায় ক্রোধের ছাঁপ স্পষ্ট। কপালের নীলাভ শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। কান, নাকের ডগাসহ চেহারা র’ক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সে গাড়ির ব্যাকসিট থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এসে সেটা প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে রাগতস্বরে বলল,
– সোজা হলে যাবে। বক্সগুলো ফিনিশ করে পড়ায় মন দেবে। আর নিজের বাক্যপ্রয়োগে সচেতন থাকবে।
প্রতিটি বাক্যে কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। মানুষটির কন্ঠে যে ক্রোধের কম্পন তা প্রিয়তার সর্বাঙ্গে শিহরণ ধরিয়ে দিল। ভয় পেয়ে,ভীতচোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে প্রিয়তা। সেটা দেখে নাওফিল কণ্ঠের তেজ বজায় রেখে বলল,
– মনে থাকবে?
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে মাথা উপরনিচ নাড়ে, মনে থাকবে। নাওফিল এবার চেহারা স্বাভাবিক করলো। ভালো কথা কানে যায়না, দুটো ধমক খেয়েই সব কথা কানের ভেতর দিয়ে মাথায় ঢুকেছে।
মেয়েটা ওকে ভয় পায় জেনে প্রসন্ন নাওফিল। নয়তো নিজেকে আসলেই বয়লার মুরগি মনে হত। আচ্ছা ও কি সত্যি বয়লার মুরগির মত? সাতাশ বছরের জীবনে এই প্রথম এমন কিছু শুনলো সে। মেয়েটা ইচ্ছে করে ভালো ভালো পশু পাখি ছেড়ে ওকে মুরগির সাথে তুলনা করেছে। তুলনা করতে হলে, বাঘের সাথে করবে, সিংহের সাথে করবে, এসব মনে না চাইলে জিরাফ, শেয়ালের সাথে করুক, তাই বলে মুরগি? শুনলেই মনে হচ্ছে মেয়েটা ওকে মুরগি বানাচ্ছে। কিন্তু মুরগি কেন? ওর তো মোরগ হওয়ার কথা। নির্বোধ মেয়ে। মোরগ-মুরগির তফাৎও জানেনা।
.
.
হল-রুমে এসে পরনের ওরনা খাটে ছুড়ে মা’রল প্রিয়তা। দরজা বন্ধ করে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছেটাল বেশ কিছুসময় ধরে। আয়নায় নিজেকে দেখল কয়েক বার। নিজেকে ধাতস্থ করার সময় পাচ্ছে না। মানুষটার ক্রোধ আসলেই সহ্য হয়না ওর। ভীতস’ন্ত্র’স্ত হয়ে পড়ে মুহূর্তেই। প্রথমদিনের দর্শন থেকে আজ অবধি, এমন মুহূর্ত যেন না আসে সে চেষ্টাই সর্বদা করেছে সে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখো,তার ঘরের বউ করতে উঠেপড়ে লেগেছে নসিব। দুনিয়ায় এত ছেলে থাকতে মীর্জাদের বাড়ির, জনাব সাফাওয়াতের ছেলে নাওফিলকেই হতে হলো? তুষার কিংবা মৃদুল হতে পারত না? নাওফিলই কেন? প্রিয়তা মানুষটার সাথে অন্তঃকলহ মেটাবে নাকি পরিবার সামলাবে? নাকি পরীক্ষা সামলাবে?
এই লোক ইচ্ছে করে ওকে হেনস্থা করছে বোঝা যাচ্ছে। নিশ্চই টের পেয়েছে প্রিয়তা স্বেচ্ছায় ওনাকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছে।প্রিয়তার মত ভীতু মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলো কেন?রাজি হওয়ার তো কথা নয়। নাওফিল এত বাধ্যবাধকতা মেনে চলা মেয়েকে বউ করবে না। এতটুকু তো নাওফিলকে চেনে প্রিয়তা। তাহলে? সে কি সন্দেহ করছে? যদি সত্যি সত্যি প্রিয়তাকে পছন্দ করে ফেলে? নাওফিল একদম ওর মনের মত না। নাওফিল ও তার মেজাজ অসহ্যকর। সে কখনও প্রিয়তার চাওয়া পূরণ করতে পারবে না। প্রিয়তা যেমন চায় তেমন হতে পারবে না। প্রিয়তা মনে মনে অজস্রবার চেয়েছে বিয়েটা নাওফিল নিজে ভাঙুক। তাহলে পারিবারিক ঝামেলাও মিটে যাবে, বিয়েটাও করতে হবে না। কিন্তু মাত্র দুদিনে তার এত পরিবর্তন বোধগম্য হলো না। সে শো-অফ করার মত মানুষ নয়। শত রাগ থাকলেও প্রিয়তাকে সে বিপদে ফেলতে চাইবে না। প্রিয়তার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
কনফিউশনে ভরপুর একটা চলতি-ফিরতি সমস্যা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে প্রিয়তাকে। নিশ্চিত হয়ে বিয়েতে মত দেওয়া উচিত ছিল। বোঝা উচিত ছিল নাওফিল নামের সাং’ঘা’তিক মানুষ খুজে বের করা খুবই রেয়ার। গ্রামেরটাই শহরেরটা। ব্যাটা দম ফেলার সুযোগ দিচ্ছে না। ভেবেছিল নাওফিলকে শায়েস্তা করবে আর দেখো? ভার্সিটিতে লোক লাগিয়ে রেখেছে। এবার শান্তিতে কোথাও যেতেও পারবে না। যেখানেই যাবে ভাবির স্লোগান পাবে।প্রিয়তা ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ল। নিচে সিয়ামের দল চায়ের স্টলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। প্রিয়তাকে দেখামাত্র সিয়াম হাত নাড়ল, বাকিরা তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আড্ডা ও শরীর কাঁপিয়ে হাসার কার্যক্রম বন্ধ করে ভদ্র সুজন হয়ে শান্তভাবে বসলো। প্রিয়তা এসব দেখে হতাশ হয়ে রুমে ফিরে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে আওড়াল,
– এ কেমন অ’ত্যাচার? আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে খুব মজা নিচ্ছেন তাই না? একবার সুযোগ পাই, সবকিছুর শোধ তুলবো, নাওফিল দ্য ডেভিল।
চলবে…