#তোমাকে_চাই ।১২।
#সাইরা_শেখ
নাওফিল কিছু না বলে উঠে আলমারির কাছে চলে যায়। প্রিয়তার উত্তেজনা নিমিষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ভেবেছিল নাওফিল খুশি হবে, কিন্তু নাওফিলের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না সে খুশি হয়েছে।
নাওফিল ফিরে এসে, খাটে বসে র’ক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ভয়ে ঢোক গিলল। নাওফিল রুক্ষকন্ঠে বলল,
– এখানে আসো।
প্রিয়তা এলো। নাওফিল প্রিয়তার হাত টেনে হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে বলল,
– গতকাল এতকিছু ঘটল তোমার সাথে। ঠিকভাবে হাটতে পারছ না, বামহাতের রাঙা ব্যান্ডেজ নিয়ে রান্না করেছ। আমি এসবের অযুহাত দিয়ে তোমার ইচ্ছার বিরোধিতা করবো না প্রিয়। তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে নিজের মর্জিমাফিক চলার, কাজ করার। আমার কেবল একটাই অনুরোধ, অন্যদের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে ভুলবে না। বাকি রইল স্বামীর কর্তব্য! নিজের প্রতি যত্নশীল এবং কাজে সাবধানতা অবলম্বন করতে না পারলে তোমার রান্নাঘরে ঢোকা নিষেধ। আমি এক কথা একাধিক বার বলা পছন্দ করিনা,দ্বিতীয়বার যেন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখবে। ওকে?
প্রিয়তা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
– কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– ঠান্ডা হোক, নষ্ট হোক, বিষ হয়ে যাক। ওদিকে গুরুত্ব না দিয়ে হাতের দিকে তাঁকাও। লাল হয়ে গেছে চামড়া। কি ফেলেছ হাতে?
– চা ঢালতে গিয়ে পড়ে গেছে।
– তুমি লেফট হ্যান্ডেড?
– না। কেন?
– তাহলে ডানহাতে পড়ল কি করে? কে ফেলেছে চা? সাবা আপু? না। সুহা নাকি?
– আশ্চর্য ওরা কেন আমার হাতে চা ফেলবে?
নাওফিল চোখ রাঙাল। প্রিয়তা চুপসে যায়। নাওফিল হাতে ফু দিতে দিতে বলল,
– আমি নির্বোধ না।বউয়ের নালিশ শুনে বোনের সাথেও তর্ক করবো না। ওসব তোমাদের ভাবি-ননদের ব্যাপার। আমি শুধু সত্য জানতে চেয়েছি। আশা করছি নেক্সট টাইম থেকে সত্য বলবে।
– সব সত্য বলতে নেই নওফিল।
– তুমি খারাপ মেয়ে নও, খারাপ বউও নও। বরের কান ভাঙানো তোমার স্বভাব না জানি আমি কিন্তু আমারও জানা উচিত আমার পরিবারে কার কার মনে তোমার জন্য বি’দ্বে’ষ ভাব আছে। আমি পরামর্শ দিতে পারবো তাদের অভিমান ভাঙানোর। সুহা খেতে পছন্দ করে, ওর পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াও।ও ডাবচিংড়ি..
– বিরিয়ানি, বিফকারি পছন্দ ওর।
নাওফিল ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকাতেই প্রিয়তা বলল,
– তুষার ভাই বলেছে।
নাওফিল প্রাউডভাব নিয়ে বলল,
– একদিনে ঘেটে ফেলেছ, এক্সিলেন্ট। তাহলে আর কি? আমাকে তো কোনো কাজেই লাগছে না। তুমি একাই যথেষ্ট সবটা সামলানোর জন্য। তাহলে দুদিনের জন্য বাড়ি ছাড়তে পারি আমি। কি বলো?
– কোথায় যাবেন?
– কাঁদের চাচা আর মৌসুমি চাচির খোজে। তুহিন ফোন করেছিল, বলছিল খোজ পেতে একদিন লাগবে।
– আচ্ছা।
– জিজ্ঞেস করবে না, একদিন লাগলে দুদিনের জন্য কেন যাবো? স্বামীর খোজখবর রাখা শেখো। নয়তো কোনদিন দেখবে সতীন এনে হাজির করেছে। তোমার যা অবস্থা, মনে হচ্ছে দ্রুত আরেকটা বউ আনতে হবে।
প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে তাঁকায়,কফিমগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
– আম্মু বলেছে, আপনি জীবনে প্রথমবার যে মেয়ের কথা তাকে বলেছেন সেটা..
নাওফিল প্রিয়তাকে দ্রুত থামিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,
– আম্মু দেখছি আমাকে বরবাদ করে ছাড়বে। বউয়েরা জাত সব এক। স্বামীর দুর্বলতার প্রতি এদের আকর্ষন বেশি। আমার আব্বু ভুগছেন, তাকে ভুগিয়ে শান্তি নেই, এবার আমাকে ভোগানোর প্লান করছে, তাও তোমার মত বউমার সাথে যৌথ পরিকল্পনা করে।
– আপনার মনে হয়না আপনি বেশি কথা বলেন?
নাওফিল চুঁমু খাওয়ার ভঙ্গিতে দু-হাত বাড়িয়ে প্রিয়তাকে কাছে ডেকে বলল,
– আসো আমার বেশি কথা বলা বন্ধ করো। কাম ফাস্ট প্রিয়।
প্রিয়তা নিমিষে দূরে সরে দাঁড়াল। পায়ে টান লাগল, মৃদু স্বরে আর্তনাদ করল ব্যাথায়। হাত ও পা আগে থেকেই অবশ হয়ে আসছিল, এবার পুরোদমে অসাড়তা বৃদ্ধি পেল। নিরুপায় হয়ে খাটের এককোণায় গাল ফুলিয়ে বসল প্রিয়তা। এরপর আর’ক্ত চেহারায় বলল,
– আপনি একজন চূড়ান্ত মাপের নির্লজ্জ পুরুষ।
.
.
নাওফিল সকালের নাশতা করেই চলে যায়। এটা নিয়ে সাবা আপুরা অয়ন ভাইদের সঙ্গে হাসিতামাশাও করে। বিয়ের পরেরদিনই বরের চলে যাওয়া ভালো ইঙ্গিত দেয় না। যদিও ওরা যা ভাবছে তা সত্য নয় তবু মনটা খারাপ হলো প্রিয়তার। কেমন বিষন্নতা ঝেঁকে বসলো। দুপুরের খাবার নিলেও প্রিয়তা খেতে পারেনি।বিকেলে নাওফিল ফোন করলে টুকটাক কথা বলে কল কেটে দেয়। সন্ধ্যার পুরোটা সময় ঘুমিয়ে কাটায়। রাতে নিচে নামল না, সাবা আপুরা আজ চলে যাবে। যাওয়ার আগে প্রিয়তাকে দেখতে চায়না সাবা। নাজনিন বেগম সব শুনে সাবাকে বকাবকি করলেন। ধমকে নানা কথা শুনিয়েও দিলেন।মা-মেয়ের মধ্যে অভিমানের সূচনা ঘটল, অথচ সেসব কিছুই জানতে পারলো না প্রিয়তা। একরাশ বিষন্নতা নিয়ে বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইল। রাত আটটা,নাজনিন বেগম ভাতের থালা নিয়ে হাজির। প্রিয়তা চোখের ওপর হাত রেখে শুয়েছিল। তাকে দেখে দ্রুত গায়ে ওরনা জড়িয়ে উঠে বসে। চেহারা মলিন হয়ে আছে প্রিয়তার। সেটা দেখে নাজনিন বললেন,
– সাবা-রা চলে গেছে। যাওয়ার আগে স্বীকার করেছে নিজের ভুলগুলো।
– ওসব কোনো ব্যাপার না আম্মু। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে এমন বলেছে। ওনার জায়গায়, অন্যকেউ থাকলে সেও এসবই বলত।
– ওর এসব বলা উচিত হয়নি।সাবা অন্যকেউ নয়, যার ব্যাপারে ও কথা বলেছে সে ওরই ছোট ভাইয়ের বউ। এটা ওর মাথায় রাখা উচিত ছিল।
প্রিয়তা খেয়াল করে নাজনিন বেগমের কথার ধাঁচের সঙ্গে নাওফিলের কথার ধরণ হুবহু এক। মা-ছেলে দুজনেরই হঠাৎ নরম হঠাৎ গরম হওয়া স্বভাব। প্রিয়তা ভাতের থালা দেখে বলল,
– আপনি কষ্ট করে এসব আনতে গেলে কেন? আমি তো একটু পর নিজেই গিয়ে খেয়ে আসতাম।
– দুপুরে বিশ্বাস করেছিলাম, খেয়েছ?
– খেতে বসেছিলাম।
– কিন্তু গলা দিয়ে ভাত নামেনি। এখনও রেখে যাবো, রাতে খাওয়া হবে না। আর আমার ছেলে ওখান থেকে ফোনের পর ফোন দিয়ে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দেবে। দেখো মেয়ে, আমার রাতের ঘুম ভীষণ মূল্যবান। নিজের স্বামীর জন্য সেটা নষ্ট করিনা সেখানে তোমার পাগল স্বামীর জন্য নষ্ট করবো? দ্রুত খেয়ে নাও। আমি তোমাকে খাইয়ে তোমার বরকে খবর পাঠিয়ে, তারপর যাবো।
প্রিয়তা শব্দ করে হেসে ফেলল। নাজনিন অবাক হয়ে বললেন,
– হাসছ কেন?
– আপনারা দুজন একই রকম।
– একদম না, তোমার বর আমাকে কপি করে।
প্রিয়তা হেসেই চলেছে। নাজনিন বেগম তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর নাওফিলের নানা গল্প বলে শোনাচ্ছেন। কথার মাঝে, খাওয়া শেষ। এরপর নাজনিন প্রিয়তাকে বললেন নাওফিলকে কল করতে। প্রিয়তা নাম্বার ডায়াল করে নাজনিনকে ফোন দিল।
নাজনিন ফোন কানে নিয়ে প্রিয়তার হাসিমুখ দেখছে। এই হাসি দেখে শুধু তার ছেলে কেন উনি নিজেও মুগ্ধ হয়েছেন। মনে মনে ভাবলেন তার ছেলের পছন্দ একদম তার মত। কল রিসিভ করেই নাওফিল গদগদকণ্ঠে বলল,
– হ্যাঁ বউ বলো। খাওয়া শেষ? কোনো সমস্যা হয়নি তো? সব ঠিক আছে? একা থাকতে পারছ? কাজের চাপ না থাকলে আমি এক্ষুনি চলে আসতাম। কি করবো বলো.. বুঝোই তো, গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নাহলে বিয়ের পরেরদিন কোন আহম্মক বউ রেখে চলে আসে। কথা বলছ না কেন? প্রিয়, শুনছ? ও বউ।
– আহাম্মক! বউ নয় আপনার মা বলছি।
ওপাশ থেকে ভীষম খেল নাওফিল, স্পষ্ট টের পেলেন নাজনিন। ছেলের কথার সুর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার ওই বদমেজাজি ছেলে বউয়ের মন ভোলানো শিখতে শুরু করেছে? যাক বাপের মত হয়নি ভেবে খুশি হলেন তিনি। কিন্তু কথোপকথন দীর্ঘায়ত করতে পারবেন বলে মনে হয়না। তাই ফোন প্রিয়তার কাছে দিয়ে প্লেট নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। প্রিয়তা ফোন কানে দিয়ে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
– কি হলো? আম্মু চলে গেল কেন?আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল তো। কি বলেছেন আপনি?
– বলদ তুমি? ফোন আম্মুর হাতে দিয়েছ কেন? আগে নিজে কথা বলে দিতে পারোনি?
– নিজে বললেও বা কি? আম্মু চাইল কথা বলতে তাই আগে আম্মুকেই দিলাম। আর একমিনিট, ফোন আগে দেওয়ার সাথে বলদ শব্দের সংযোগ কি? প্রথমদিন থেকে দেখছি ব-বর্গীয় অপমান করে চলেছেন। নিজেকে খুব শেয়ানা মনে করেন?
– খুব শেয়ানা না হলেও তোমার থেকে বেশি বুদ্ধিমান। এরপর থেকে ফোন করে আগে নিজে কথা বলবে তার পর বাকিদের ফোন দেবে। কথার যেন নড়চড় না হয়।
– আম্মুকে কি বলেছেন বলুন তো।
– যা তাকে বলার কথা নয়। যখন শোনাতে চেয়েছিলাম তখন তো শুনলে না এখন শুনে কি লাভ? ফোন রাখো।
– আচ্ছা।
– এই মেয়ে.. ফোন রেখে দেখো। আজ রাতে এসেই তোমাকে সিধে করে ফেলবো।সারাদিন পর শান্তিতে বসে একটু কথা বলছি, আর উনি ফোন কেটে দিচ্ছে।
– আপনিই তো বললেন, ফোন রাখো।
– রাখতে বললেই রেখে দেবে? বাকি যেসব বলি সেসব শুনে চলো? শুধু আমার থেকে দূরে যাওয়ার পথগুলো অনুসরণ করো। সত্যি করে বলো তো। আমার ওপর আগ্রহ নেই কেন? আমার থেকে ভালো কেউ নজরে পড়েছে?
– পড়লে?
– কিছু না, আমি আবার বউকে সন্দেহ করিনা। খুবই ভালো বর কিনা.. তবে.. আসলেই কি পড়েছে?
প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হাসছে। নাওফিল সিয়ামের সাথে কথা বলছে। তাদের কথা বলা শেষে নাওফিল পুনরায় বলল,
– পাওয়া গেছে। আমাকে যেতে হবে। রাত জাগবে না। ঘুমিয়ে পড়।
– নিজের খেয়াল রাখবেন।
– তুমিও।
চলবে…