তোমাকে চাই পর্ব-১৩

0
83

#তোমাকে_চাই ।১৩।
#সাইরা_শেখ

সুহার জন্য ডাবচিংড়ি করেছে প্রিয়তা, মৃদুলের জন্য হাঁসের ঝোল। বাকিদের জন্য নরমালি যে খাবার হয় রেগুলার তাই।সুহা আজ কিছু না বলে চুপচাপ খেয়েছে। প্রিয়তা বুঝল, একদিনে বন্ধুত্ব করা সম্ভব নয়। সম্পর্কে সময় দিতে হবে। দুপুরে খেয়ে ছাদে এসেছিল সে। ছাদের দরজা খুলতেই মাথার ওপর পানির ঝাপটা এসে পড়ে। সঙ্গে হাসির শব্দ। প্রিয়তা সামনে তাঁকিয়ে দেখল, মিরাজ, বৃষ্টি ও সফি দাঁড়িয়ে হাসছে। সফি হাসি থামিয়ে ভালো মেয়ের মত বলল,

– সরি, আমরা ভেবেছি সুহা। তুমি তো ভিজে গেলে পুরো। কাকভেজা হয়ে গেছ। জলদি গিয়ে চেঞ্জ করে নাও নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবে। তখন আবার ভাইয়াকে সব কাজ ফেলে চলে আসতে হবে বউয়ের সেবা করতে।

প্রিয়তা নাক টেনে বলল,
– হুম। তোমার ভাইয়া তোমাদের জন্য গিফট কিনেছিল সফি, এসো সেগুলো নিয়ে যাবে।আমি বের করে রেখেছি সব।
– ভাইয়া কিনেছে? বৃষ্টি চল তো গিয়ে দেখি।
– হ্যাঁ, দ্রুত চল।

প্রিয়তাকে একপ্রকার উপেক্ষা করে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সবাই। যাওয়ার আগে বৃষ্টি প্রিয়তার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে গেল। ধাক্কায় জোর ছিল, পেছনের দরজার সাথে পিঠ ঠেকে গেল প্রিয়তার। হালকা ব্যাথা পেল পিঠে। শিরদাঁড়ার সোজা লেগেছে। কেমন অবশ হয়ে উঠল ক্ষণিকের জন্য। কয়েকমুহূর্ত পর ঠিক হতেই সে নেমে এলো নিচে। ঘরে, বিছানার ওপর বসে ওরা র‍্যাপিং পেপার খুলে গিফট দেখছে। পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাগজের টুকরো, পলিথিন। ওয়াশরুমের সামনে মাটির ফুলদানিটাও ভেঙে পড়ে আছে। মিরাজ বলল,

– সফি আপু ভুল করে ভেঙে ফেলেছে। কিছু মনে করোনি তো ভাবি..
– না। তোমরা বসো, আমি চেঞ্জ করে আসি।

কাপড় নিয়ে প্রিয়তা ওয়াশরুমে ঢুকতেই ভেঙাল সফি,
– তোমরা বসো.. যেন উনি বলবে তারপর আমরা বসবো। আমাদের ভাইয়ের ঘর, আমরা বসবো, শুবো, নাচবো, যা ইচ্ছে তাই করবো।
বৃষ্টি বলল,
– কাঁচের গ্লাসটা ফেলা উচিত ছিল, হাতেপায়ে ফুটলে ভালো লাগত।
মিরাজ উৎসুক গলায় বলল,
– আমি ফেলবো আপু?
সফি বলল,
– জিজ্ঞেস করার কি আছে? যেভাবে ইচ্ছে জ্বা’লাবি ওকে।
– আম্মু কিছু বলবে না তো?
– আমি আছি না? কিছু বললে আমি দেখবো।

প্রিয়তা থ্রিপিচ পড়ে বাইরে আসতেই বেখেয়ালে কাঁচের টুকরোর ওপর পা ফেলল। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে নিচে তাঁকাতেই দেখল ঘরের ঠিক মাঝখানে পানির গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। বৃষ্টি মেকি চিন্তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ভাবি কি হলো? ঠিক আছ?

প্রিয়তা মাথা নেড়ে জানায় সে ঠিক আছে। আসলে যে কেমন আছে তা কিভাবে প্রকাশ করবে? পা কেটে র’ক্ত বের হচ্ছে। মেঝেতে র’ক্তের ছোঁপগুলোর শুকিয়ে যাচ্ছে দেখে প্রিয়তা দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। পা ধুয়ে, ফুটে থাকা ছোট কাঁচের টুকরোটা বের করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা ওরনা ছিড়ে ফেলল, সেটা পায়ে বেঁধে চটজলদি বেড়িয়ে এলো। একটু পরেই নাওফিল ফিরবে। দ্রুত ঘর গোছাতে হবে। এভাবে দেখলে ওর খারাপ লাগবে। ব্যাথা পা নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিল প্রিয়তা। কাঁচের টুকরো তুলে ঘরের কোণে থাকা ঝুড়িতে রাখলো। এরপর ঘর মুছে শান্ত হয়ে বিছানায় বসে। সফি জিজ্ঞেস করে,
– তোমাকে কি দিয়েছে ভাইয়া?

প্রিয়তা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তিনটি বক্স বের করে দিল। একটাতে ব্রান্ডেড পার্ফিউম, ঘড়ি ও ব্রেসলেট। বৃষ্টি বলল,
– এসব দেখাচ্ছ কেন? দামি কিছু দেয়নি নাকি?
– ব্যস্ততায় দিতে ভুলে গেছে। এগুলো বিয়ের শপিংয়ের দিন দিয়েছিল। বিয়ের পর কিছু দেয়নি।

সফি প্রিয়তার হাতের দিকে তাঁকিয়ে বলল, “আংটিটা তো সুন্দর। দেখি তো..”
প্রিয়তা খুলে দেয়। সফি নিজের আঙ্গুলে আংটি পড়ে বলল,
– আমার হাতে মানিয়েছে না বৃষ্টি?
বৃষ্টি সায় দিল। প্রিয়তা বলল,
– তাহলে ওটা তুমি রাখো। আমার কাছে আরও কয়েকটা আছে, দেখবে?
বৃষ্টি বলল,
– দেখালে দেখে না কে? যদি চাও দেখাতে পারো। পরে যেন বলো না আমরা দেখতে চেয়েছি।

প্রিয়তা হেসে নিজের গহনার বাক্স বের করে দিল। সফি ও বৃষ্টি নিজেদের ইচ্ছেমত পছন্দ করে নিল। সুহাও এসে একটা নেকলেস নিয়ে যায়। সবাই চলে গেলে বিছানা ঝেরে সবকিছু ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়ে প্রিয়তা। ওদের বুঝতে দেবে না বলে স্বাভাবিক থাকলেও ব্যাথা পায়ে আবার ব্যাথা পেয়ে জ্বরজ্বর ভাব এসেছে। চোখ জ্বলছে, তাই আলো নিভিয়ে দিল।

প্রিয়তার ঘুম ভাঙে নাওফিলের ডাকে। নাওফিল এসে প্রিয়তাকে জাগিয়ে শাওয়ার নিতে ঢুকেছে ওয়াশরুমে। রাত এগারোটা, নাওফিলের এত দেরি হলো কেন আসতে? সন্ধ্যার মধ্যেই তো ফেরার কথা ছিল। পরে ভাবলো হয় তো কোনো কাজ ছিল।সবাই শুয়ে পড়েছে, কেবলমাত্র নাজনিন জেগে ছিলেন। প্রিয়তাকে রান্নাঘরে আসতে দেখে প্রশ্ন করলেন,
– শরীর খারাপ নাকি? তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। ঘুমিয়ে ছিলে বলে ডাকিনি।
– একটু আম্মু, জ্বর জ্বর লাগছে।

নাজনিন কাজ ফেলে এগিয়ে এসে প্রিয়তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
– জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বেয়াদবটা তোমাকে নিচে নামিয়ে দিল? কোনো বোধ বুদ্ধি নেই। বাপের মত হয়েছে।
– উনি জানেন না। এত রাতে এসেছে তাই খাবার গরম করতে আসলাম।আপনি এখনও জেগে আছেন কেন?
– অভ্যাস। ছেলেটা বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত কি চোখে ঘুম আসে? তুমি উপরে যাও, আমি ট্রে নিয়ে আসছি। গিয়ে শুয়ে থাকো। নড়াচড়া করো না।
– আচ্ছা।

প্রিয়তা উঠে দাঁড়াতেই নাজনিন পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
– তুষার ফুসকা এনেছিল, তোমার জন্য রেখেছিলাম কয়েকটা, ভাতের সঙ্গে নিয়ে আসবো? খাবে এখন?
প্রিয়তার চটপটে উত্তর, “হ্যাঁ, খাবো।” নাজনিন হেসে কাজে মনোযোগ দিলেন। ঘরে এসে প্রিয়তা ব্লাংকেটের নিচে ঢুকে পড়ে। নাওফিল ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,
– শরীর খারাপ নাকি ম্যাডামের?
– আম্মু বলল জ্বর।
নাওফিল সেটা শুনে দ্রত ছুটে এসে প্রিয়তার কপালে হাত রাখে,
– এত জ্বর! আমাকে আগে বলোনি কেন? ঘরে জ্বরের ঔষধ আছে? নাহ, তোমকে নিয়ে পারা গেল না। দাড়াও দেখছি মেডিসিন আছে কিনা।

নাওফিল মেডিসিনের বক্স খুজে মেডিসিন পেল না।
– আম্মুর কাছে থাকতে পারে।
নাজনিন ঘরে ঢুকে বললেন,
– আমি মেডিসিন সঙ্গে নিয়ে এসেছি। দুজন বসে আগে খেয়ে নে।
নাওফিল ভাত মেখে প্রিয়তার দিকে তাঁকাল। নাজনিন প্রিয়তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। অথচ নাওফিল ভেবেছিল কাজটা সে করবে।

খাওয়া শেষে নাজনিন চলে গেলেন। প্রিয়তাও শুয়ে পড়ে। নাওফিল বিছানার ওপর বসে বলল,
– বাড়ির কি অবস্থা?ফোনে চাচির কাছে শুনলাম, সফি বৃষ্টিরা পুরো বিকেল তোমার সাথে ছিল। পরিবর্তন আসছে?
– ওরা এখন কথা বলছে, আগে বলতো না। আস্তে আস্তে মিশে যাবে হয়তো।
– বেশ ভালো। তো জ্বর এলো কেন? পুরোনো ব্যাথায়? নাকি নতুন কান্ড বাঁধিয়েছ?
– আপনার কি আমাকে সমস্যার প্রতীক মনে হয়?
– তাছাড়া কি? এবার দ্রত বলো, কি ঘটেছে।
– আমি কি জানি?জ্বরের আসতে মন চেয়েছে,এসেছে। এখানে আমি কি করতে পারি? আমি কি তাকে ডেকে এনেছি?

নাওফিল প্রিয়তার ব্লাংকেটের মধ্যে ঢুকে গেল। প্রিয়তা খানিকটা সরে যায়। নাওফিল ভ্রু কুঁচকে বলল,
– ফ্লোরে শুতে চাও? তাহলে আস্তে নেমে যাও। সরতে সরতে পড়ে গেলে ব্যাথা পাবে। শুধু শুধু শরীরকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ বলো?
– আপনি একটু সরে গেলেই তো হয়।
– ঘর আমার, বিছানা আমার, বউ আমার। আমি কেন সরবো? আমার তো প্রবলেম হচ্ছে না কাছে আসলে। প্রবলেম তো তোমার হচ্ছে, তুমি সরো।
– অসুস্থ মানুষকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিতে লজ্জা করছে না?
– আশ্চর্য! আমি কোথায় নামাচ্ছি? আমি তো থাকতে বলছি। শুধু চাচ্ছি, দূরে দূরে না থেকে একটু কাছে এসে শোও। কিন্তু সরাসরি বললে তুমি বলতে আমি অসভ্য। কি বলতে না?

প্রিয়তা উত্তর দিল না। নাওফিল প্রিয়তাকে কাছে টেনে নিল। প্রিয়তা নড়তেই ওর পায়ের ওপর পা উঠিয়ে দিল। অকস্মাৎ ব্যাথা পা-য়ে নাওফিলের পা পড়ামাত্র প্রিয়তা ‘আহ’ করে উঠল। নাওফিলকে বলল,
– ব্যাথা পাচ্ছি নাওফিল।

নাওফিল ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আমি ওতটাও জোর দিয়ে ধরিনি প্রিয়। মিথ্যা বলোনা।
– পায়ের ওপর থেকে পা নামান, পায়ের পুরোনো ব্যাথা এখনও আছে।
নাওফিল উঠে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে প্রিয়তার পা দেখে বলল,
– আবার? তোমাকে ইচ্ছে মত মাইর দিলে শুধরাবে তুমি, প্রিয়? তোমার স্বভাব বদলাতে মা’র আবশ্যক মনে হচ্ছে। এখন-ই শুরু করি?শরীরের কোন জায়গাগুলোয় কা’টাছেড়া বাকি আছে?
প্রিয়তা এবারও নিশ্চুপ। নাওফিল বলল,
– এখনও কাঁচ ফুটে আছে। ঠিক করে ড্রেসিং করা হয়নি।
প্রিয়তার পায়ে ড্রেসিং করে নাওফিল শুয়ে বলল,
– আমার বোনদের আমি চিনি প্রিয়। কি করবো বলো? বোন তো, বড়দের ভুলে ওদের এমন অবস্থা হয়েছে। ওদের কিছু বললে ওরা আরো বাড়াবাড়ি করবে, আমি বাড়ি থাকিনা, তোমাকে দেখে রাখি কি করে? এসে ধরে তিনবার ওদের মিসবিহেভ দেখলে।যদি চাও ঝামেলা মেটানোর আগ অবধি ওবাড়িতে গিয়ে থাকো।
– কি কি জানতে পারলেন? দুদিনের কথা বলে ষোলো দিন পর ফিরলেন। এত সময় লাগল কেন? ওদের তো পেয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে?

নাওফিল হতাশ হলো, বুঝতে পারল প্রিয়তা যাবে না। সে এখানেই পড়ে থাকবে আর এসব সহ্য করবে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাওফিল ধীরগলায় বলল,
– একটা নাম জেনেছি কিন্তু পরিচিত নয়। খুজতে হবে তাকে।
– কি নাম?
– মাহিন ইকবাল।
প্রিয়তা চমকে তাঁকাল। বলল,
– ইকবাল আঙ্কেল? আমি এ নামে একজনকে চিনি। কিন্তু উনি তো দেশের বাইরে থাকতেন।
নাওফিল নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, “তুমি চেনো তাকে?”
– হ্যাঁ। দাদুর বন্ধুর ছেলে। ছোট থাকতে কয়েকবার দেখেছি তাকে। মাঝে, মেধা আপুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল বলে ওনারা আর আসেনি।
নাওফিল হেসে বলল,
– তোমার এই ইকবাল আঙ্কেলকে যে এবার দ্রুত গ্রামে ফিরতে হবে প্রিয়। তাহের চাচাদের মজুরি একবার অন্ততো, সরাসরি নিজহাতে দিক।

চলবে…