#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৩
অনেক আগে আদনান ছোটো একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলো, যদিও সেখানে কখনো থাকা হয়নি। ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে আছে, আর এ মুহূর্তে রোজাকে নিয়ে যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই যেহেতু সব ছেড়ে আদনান চলে এসেছে। তাই ও ঠিক করলো রোজাকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটেই উঠবে, রাস্তার জ্যামের কারণে ওই বাসায় যেতে যেতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো। বাসার সামনে এসে আদনান রোজার হাতে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে বললো..
‘ চারতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটটা আমাদের, তুমি যাও আমি আসছি ‘
‘ এতো রাতে কোথায় যাবেন?’
‘বিনা প্রস্তুতিতে বিয়ে করে ফেললাম, এখন রাতভর বউকে না খাইয়ে রাখলে সেটা তো ভালো দেখাবে না তাইনা? আমি খাবার নিয়ে আসছি, তোমার জন্যে কিছু আনতে হবে?’
‘আপাতত আর কিছু দরকার নেই, আপনি খাবার নিয়ে আসুন তাতেই হবে’
আদনান চাবি দিয়ে খাবার আনতে গেলো, তিনতলা পেরিয়ে চারতলায় উঠতেই মানুষের হট্টগোল শুনলো রোজা। দ্রুত পায়ে চারতলায় আসতেই দেখলো উল্টোপাশের ফ্ল্যাটের লোকদের কাছ পুলিশ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কয়েকজন আবার ওপর তলা থেকে নামলো, সকলেই ফিসফিসিয়ে কিছু আলাপ করছে। রোজা বুঝলো না এই রাতের বেলা এখানে হচ্ছেটা কি! রোজাকে দেখে ওপরের সিড়ি থেকে এক মধ্য বয়স্ক মহিলা নেমে এসে জিজ্ঞাসা করলেন…
‘তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি, কার বাসায় এসেছো?’
রোজা ফ্ল্যাটের দিকে ইশারা করে বললো…
‘আমরা নতুন এখানে এসেছি, এই ফ্ল্যাটটা আমাদের’
‘ওহ আচ্ছা, যাক বাবা আমি তো ভেবেছিলাম এই ফ্ল্যাটের মালিককে জীবনেও চোখের দেখা দেখতে পাবো না। তিন বছর ধরে এই ফ্ল্যাটে তালাই ঝুলছে, মালিকের কথা কেউ আর বলতে পারেনা ‘
ভদ্র মহিলার কথা শুনে রোজা বুঝলো আদনান এখানে কখনোই আসেনি! মহিলা রোজার বিয়ের পোশাক দেখে কৌতুহলবশত প্রশ্ন করলেন…
‘ বউয়ের সাজে যে? বিয়ে করে এলে নাকি?’
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাকিরাও রোজার দিকে দেখছিলো, নতুন জায়গায় এসে হুট কোড সবার এমন চাহনি দেখে কিছুটা বিব্রত বোধ করছিলো রোজা। তবুও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। অন্যান্যদের কথায় বুঝলো রোজা এখানে নতুন তাই ওকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না, চলে গেলো। পুলিশ যেতেই রোজা জিজ্ঞাসা করলো…
‘ এতো রাতে এখানে পুলিশ কেনো এসেছিলো? বাসায় কিছু হয়েছে?’
ভদ্র মহিলাটি হা হুতাশ করে উত্তর দিলেন…
‘আর বলো না, তিনতলার ফ্ল্যাটের ছেলেটা কোন মেয়েকে নিয়ে যেনো পালিয়েছে। মেয়ের বাবা পুলিশ কেস করেছে, তার তদন্ত করতেই পুলিশ এখানে এসেছিলো। দোষ করেছে একজন আর তার জন্যে এই রাতের বেলা আমাদের সবাইকে ভোগান্তি পোহাতে হলো ‘
ওনাদের থেকেই রোজা পুরো ঘটনা শুনলো রোজা, তাছাড়া এটাও জানলো যে তারা দুজনে পাঁচতলায় থাকে। একটু পরে আদনান এসে রোজাকে বাইরে দেখে জিজ্ঞাসা করে…
‘কি হয়েছে?’
‘ কিছুনা, এমনি। ওনাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ওনারা ওপরতলায় থাকেন ‘
আদনান দুজনকে সালাম দিলো, দুজনের মাঝে একজন আদনানের সালাম নিয়ে দুজনকে একসঙ্গে দেখে হেসে বললেন…
‘ওহ! এ তাহলে তোমার স্বামী? বাহ বাহ, দেখতে তো ভীষণ সুন্দর। দুজনকে মানিয়েছে ভালো, কি বলেন পিহুর মা?’
‘হ্যাঁ ভাবী, মাশা আল্লাহ সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের। তা তোমরা বিয়ে করে সোজা এখানে এলে যে? তোমাদের মা বাবা…’
আদনান স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো…
‘আসলে আন্টি, আমরা বিয়ের পর আলাদাই থাকবো তো তাই সোজা এখানেই চলে এলাম। মা বাবার সঙ্গে গিয়েও লাভ ছিলো না, আবার এখানেই আসতে হতো ‘
‘ওহ আচ্ছা, ভালো! যাও যাও তোমরা বিশ্রাম করো। রাত হয়েছে অনেক। ভাবী, আমরাও যাই চলুন ‘
ওনারা দুজনেই নিজেদের ঘরে চলে গেলেন, আদনান রোজাও ফ্ল্যাটে ঢুকলো। ওদিকে বসার ঘরে বসে রেগে আগুন হয়ে আছেন জামাল সাহেব, পাশেই রোজার মা দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছেন কারণ এক মেয়ের সর্বনাশ ঠেকাতে গিয়ে আজ আরেক মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গেছে। রোজা পালিয়ে যাওয়ার পর হৈহৈ পড়ে গেছিলো, রোজার ছোটো বোন ওর ওপর ঠিকঠাক নজর রাখতে পারেনি বলে বাবার হাতে চ’র খেয়েছে। আত্মীয় স্বজনের কাছে নিজের মান রক্ষার জন্যে বড় মেয়ের বদলে ছোটো মেয়েকে নিষাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন জামাল সাহেব। এরপর স্পষ্ট স্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, আজ থেকে রোজার সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এ মুহূর্তে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই রোজার মায়ের, কোথায় ভেবেছিলেন যা হবে তাতে বড় মেয়ের ভালো হবে উল্টে ছোটজনের ক্ষতি হয়ে গেলো! ফ্ল্যাটের ভেতর অন্ধকার, গুমোট একটা পরিবেশ। অবশ্য, এতবছর একটা ফ্ল্যাট এমন জনশূন্যবিহীন থাকলে গুমোট ভাবটা থাকা স্বাভাবিক। আদনান ফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে দেখে নিলো লাইটের হোল্ডার কোথায়, আদনান কোত্থেকে একটা ছোটো টুল নিয়ে এলো…
‘ ফোনটা ধরো তো, লাইটটা লাগিয়ে নেই ‘
রোজা লাইটটা ধরলো, আদনান লাইট লাগিয়ে চালু দিতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো রোজা। তড়িঘড়ি করে টুল থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করলো…
‘ কি হলো!’
রোজা শাড়ি উচুঁ করে পায়ের নিচে দেখলো..
‘পায়ের নিচ দিয়ে কিছু একটা চলে গেলো মনে হলো ‘
‘ এই বদ্ধ ঘরে কি আসবে? তোমার মনের ভুল হয়তো ‘
‘আরে না সত্যি বলছি। ইঁদুর ছিলো মনে হয়’
‘আরে বাবা, এই বাসায় সব আটকা ছিলো। ইঁদুর আসবে কোথা থেকে? তুমি শান্ত হও তো’
রোজা পিটপিট করে এদিক ওদিক দেখছে, মেয়েটা যে ভয় পেয়েছে তা দেখে আদনান হাসলো! রোজা মুখ গোমড়া করে তাকালো…
‘ হাসছেন কেনো?’
‘ তোমার বিষয়ে একটা নতুন বিষয় জানলাম, তুমি ইদুর ভয় পাও! এরপর থেকে তাহলে তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে ইঁদুর ধরে আনতে হবে ‘
‘ইয়ার্কি করবেন না তো!’
‘ ওকে ফাইন! তুমি রিল্যাক্স করো, ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর খেয়ে নেবে। অনেক রাত হয়েছে ‘
‘ আমরা থাকবো কিভাবে? শুনলাম তিন বছর নাকি এই বাসা ফাঁকা ছিলো, আপনি তো এখানে আসেননি। তারমানে এখানে তো কিছুই নেই তাইনা?’
‘বেডরুম সেট করা আছে, বাকি জিনিস আস্তে আস্তে কিনে নেওয়া যাবে। আপাতত তুমি বেডরুমে যাও, ফ্রেশ হও। ওহ ওয়েট, ওই ঘরেও লাইট নেই, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি’
আদনান রোজার সঙ্গে এসে লাইট লাগিয়ে দিলো। আলো জ্বলতেই রোজা দেখলো ফ্ল্যাটটা খুব একটা বড় নয় তবে দুজন থাকার জন্যে যথেষ্ট! রোজা বেডরুমে ঢুকলো, ভেতরে একটা বেড, একটা আলমারি আছে আর ছোটো একটা টেবিল আছে। এ মুহূর্তে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে বিধায় গয়নাগাটি সব খুলে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। শাড়ির এক্সট্রা পিনগুলো খুলে একটু কমফোর্ট লাগবে এমনভাবে শাড়িটা পড়ে নিলো যদিও বেনারসিতে কমফোর্ট ফিল হওয়ার কথা না কিন্তু আজ রাতে অন্য পোশাক না থাকায় অগত্যা এটা পড়েই থাকতে হবে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে জানালাগুলো খুলে দিলো রোজা, এবার একটু শান্তি লাগছে
‘ তুমি খেয়ে নাও, আমি একটু আসছি ‘
‘ আবার কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ এই শাড়ি পরে রাতে তোমার ঘুমাতে অসুবিধা হবে, আমি দেখি যদি কোনো মল খোলা থাকে তবে তোমার জন্যে কিছু কমফোর্ট ড্রেস নিয়ে আসি ‘
‘ এতো রাতে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, কাল আনতে পারবেন ‘
রোজা ভয় পাচ্ছে বুঝে স্মিত হেসে ওর দিকে ঝুঁকলো আদনান…
‘আহ! আমার বউ আমাকে এত অনুরোধ করছে, তার অনুরোধ কি আমি ফেলতে পারি? ফাইন, আমি যাবো না ‘
রোজা গলা ঝেড়ে বললো…
‘অনুরোধ করিনি আপনার ভালোর জন্যে বলছি! আমার যা মনে হচ্ছে এই এলাকায় হয়তো আপনার তেমন আনাগোনা ছিলো না আর অচেনা একটা জায়গায় রাত বিরাতে হুটহাট বাইরে যাওয়া উচিত না ‘
‘ ওয়াও! তুমি দেখছি এখনি নিজের ওয়াইফ মুড চালু করে দিয়েছো। আমার জন্যে কতো চিন্তা’
‘ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসুন, নইলে সব আমি একাই খেয়ে নেবো। অনেক খিদে পেয়েছে’
‘ খাও, তুমি খেয়ে মোটা হয়ে গেলেও আমার সমস্যা নেই ‘
বলতে বলতে ফ্রেশ হতে গেলো আদনান, রোজা নিজের দিকে দেখলো! শুকনো বলে আদনান কথায় কথায় এভাবে টিজ করবে? রোজা ছোটো থেকেই স্লিম, আত্মীয়রা অনেককিছুই বলতো। একসময় রোজার রাগ হতো, কিন্তু বড় হওয়ার পর বুঝলো মানুষের মুখ বন্ধ করা সম্ভব নয় এর থেকে অন্যদের কথা কানে না তোলাই উত্তম! রোজা খাবার বের করে বসেছে তখনই কলিং বাজলো। এতো রাতে কে এলো? গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো তখনকার সেই ভদ্র মহিলা, উনি রোজাকে দেখেই বললেন…
‘আমাদের ঘরে আজ বিরিয়ানি রান্না করেছিলাম, তোমরা মাত্র এলে। রান্না করতে গেলে রাত পেরিয়ে যাবে, তাই ভাবলাম তোমাদের দিয়ে যাই’
‘ খাবার এনেছে আমাদের ‘
‘ তাও, রাখো। অল্পই আছে ‘
রোজা স্মিত হেসে প্লেটটা হাতে নিলো, মহিলাটি বগলদাবা করে একটা প্যাকেটও নিয়ে এসেছে। সেটা রোজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…
‘ তোমাদের আঙ্কেল দুটো শাড়ি এনেছিলো, আমার শাড়ি পরা হয় না। এগুলো তুমি রাখো ‘
‘ আন্টি, এগুলোর প্রয়োজন নেই ‘
‘ একদম নতুন শাড়ি, এখনো ভাঁজ ভাঙ্গা হয়নি। রাখো তুমি, নতুন বিয়ে হয়েছে। নতুন নতুন শাড়ি দরকার হয় ‘
‘ না, আন্টি আপনি ভুল বুঝছেন। আমি তার জন্যে বলিনি ‘
‘ বুঝেছি, আর বলতে হবেনা। এটা তোমাদের বিয়ের উপহার হিসেবে রাখো। এখন থেকে একই বাসায়ই তো থাকবো আমরা। আর হ্যাঁ, আমি সবিতা আন্টি। আমার মেয়ে আছে একটা, সায়মা ওর নাম। কোনো দরকার পড়লে ওপরে যেও কেমন?’
‘ জ্বি, ধন্যবাদ আন্টি ‘
ভদ্র মহিলা ভীষন আন্তরিক, ওনার সঙ্গে কথা বলে ভালোই লাগলো রোজার। মহিলাটি যাওয়ার পর রোজা টেবিলের এক কোনায় শাড়ির প্যাকেট রেখে চেয়ার টেনে বসলো। আদনানের আনা খাবার খাবে না বিরিয়ানি খাবে। আদনান মুখ মুছতে মুছতে এসে বসলো…
‘ কে এসেছিলো?’
‘ ওপর তলার আন্টি! আমাদের বিয়ের প্রেজেন্ট দিয়ে গেলো। বিরিয়ানি আর শাড়ী ‘
‘ রিয়েলি? এ যুগের মানুষ আবার এতো ভালো হতে শুরু করলো কবে থেকে?’
‘ সবাই খারাপ হয় নাকি? তাছাড়া আন্টির ব্যবহার ভালোই লাগলো। আমার এক পেশেন্টের শ্বাশুড়ির কথা মনে পড়লো আন্টিকে দেখে। উনি ওনার বৌমাকে নিয়ে আসতেন চেকআপের জন্যে। আমার জন্যে দুবার খাবার নিয়ে এসেছিলেন ‘
‘ ওসব ভিজিট না দেওয়ার ধান্ধা, তোমাকে খাইয়েছে আর ভিজিট দেয়নি নিশ্চয়ই?’
‘ জ্বি না! ভিজিট দিয়েছে ‘
কথার ফাঁকে রোজা খেয়ালই করেনি যে আদনান বিরিয়ানি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, রোজা বিরবিরিয়ে বললো…
‘ ধুর! ওটা তো আমি খেতে চেয়েছিলাম!’
‘ কিছু বললে?’
রোজা উত্তর না দিয়ে আদনানের আনা অন্য খাবারগুলো খেলো, রোজা এটা দেখে অবাক হলো যে আদনান একবার ওকে জিজ্ঞাসাও করলো না বিরিয়ানি খাবে কিনা? তারমানে কি আদনানের বিরিয়ানি খুব বেশী প্রিয়?
চলবে…
#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৪
খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানোর সময় বাঁধলো বিপত্তি, আদনান তো শুয়ে পড়েছে কিন্তু এতো ভারী শাড়ি নিয়ে শুতে সমস্যা হচ্ছে রোজার। তা লক্ষ্য করে আদনান বললো…
‘ সমস্যা হবে তাইনা? এজন্যেই বলেছিলাম কমফোর্ট টাইপের কিছু কিনে এনে দেই ‘
‘সমস্যা নেই, একটা রাতেরই তো ব্যাপার। আসলে এতো তাড়াহুড়ো করে সব হয়ে গেলো, নাহলে বাড়ি থেকেই ব্যাগপ্যাক করে নিয়ে আসতাম’
‘পালানোর সময় সাধারণত কেউ ব্যাগ প্যাক করে নিয়ে আসেনা, ঐরকম পরিস্থিতি থাকে না আর কি’
‘ আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘ নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বললাম, এই আমাকেই দেখো না। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম কি ভেবে আর কি কি হয়ে গেলো। বিয়ে করে ফেললাম, কোনো আয়োজন ছাড়াই ‘
রোজা আদনানের কথা শুনতে শুনতে কোনরকম শাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো, ঘরের ড্রিমলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। যদিও আদনানের একটু আলোতেও ঘুমাতে সমস্যা হয় কিন্তু রোজার জন্যে জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে। রোজা খানিকক্ষণ অন্যদিকে মুখ করে শুয়েছিলো, এরপর হুট করে আদনানের দিকে ফিরলো। আদনান সোজা হয়ে শুয়েছিলো, হঠাৎ ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় লক্ষ্য করলো রোজা ওর দিকে তাকিয়ে আছে…
‘ হোয়াট!’
‘ আপনার বিরিয়ানি প্রিয় তাইনা?’
‘ কিভাবে জানলে?’
‘খাওয়ার ধরন দেখেই বুঝেছিলাম, এতো ভালোবেসে খাচ্ছিলেন। বিরিয়ানি বোধহয় আপনি কারো সঙ্গে শেয়ার করেন না তাইনা?’
‘ইয়াহ! আই লাইক বিরিয়ানি। কেনো, তোমাকে দেইনি বলে মন খারাপ করলে নাকি?’
‘ আমি বাচ্চা নাকি যে মন খারাপ করবো?’
‘তোমার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে ‘
যারা মুখ গোমড়া করলো, এরপর কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর বললো..
‘আমি যখন ওপরে এলাম, তখন এই বাসায় পুলিশ এসেছিলো। তিন তলার এক ছেলে নাকি এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। মেয়ের বাবা পুলিশ পাঠিয়েছে এখানে’
‘ মেয়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমার ঐ চি’টা’র নিষাদের মতো কারো বিয়ে ঠিক করেছে। পালাবে না তো কি করবে?’
‘ সবার ক্ষেত্রে একরকম কেস হয় নাকি!
‘ আই নো, কিন্তু সহজে সম্পর্ক মেনে নিলেই তো ঝামেলা চুকে যেতো। কিন্তু মেয়ের বাবারা সহজে কিছু মানতেই চায়না। আশা করি সেটা তোমার থেকে ভালো কেউ জানেনা ‘
‘ থাক এসব কথা এখন, আচ্ছা আপনি যে এভাবে আমাকে নিয়ে নিজের বাড়ি না গিয়ে আলাদা একটা জায়গায় চলে এলেন আপনার বাবা মা জানে? তাদের জানিয়েছেন?’
‘ আমার কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই ‘
ভ্রু কুঁচকে নিলো রোজা! তড়িঘড়ি করে উঠে বসে প্রশ্ন করলো…
‘ তারমানে জানাননি? তারা আবার আপনাকে খুঁজতে পুলিশ পাঠাবে না তো?’
আদনান মাথার নিচে এক হাত দিয়ে শুয়ে রোজার দিকে তাকিয়ে হাসলো…
‘ তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি! আরে ডোন্ট ওরি ডিয়ার, পুলিশ টুলিশ কিছুই আসবেনা’
‘আদনান, সবকিছুতে মজা না করলে হয় না আপনার? বলুন না! আপনি বাড়িতে জানাননি? আমিও তখন কিছু না ভেবেই ওভাবে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম ‘
‘ আমাকে বিয়ে করার জন্যে আফসোস হচ্ছে?’
‘বিষয় সেটা নয়, আমি চাইনা আমার জন্যে আপনার বাড়িতে কোনো ঝামেলা হোক ‘
আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে বললো..
‘আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি, তাই আমার খোঁজ নেওয়ার মতো আপাতত কেউই নেই ‘
‘ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন মানে?’
‘ সে অনেক কথা। বাদ দাও এখন, ঘুমাও ‘
‘ আজ রাতে আমার এমনিতেও ঘুম আসবেনা, আপনি বরং বলুন কি হয়েছে। আপনার বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে?’
আদনান ভেবেছিলো রোজাকে এসব বিষয়ে বলবে না কিন্তু একদিন না একদিন বিস্তারিত সব জানাতেই হবে তাই ভাবলো আজকেই জানানো যাক, তাছাড়া রোজাও ভীষণ জোরাজুরি করছিলো বলার জন্যে। পরে ধীরে ধীরে আদনান রোজাকে সবকিছু খুলে বললো, মনোযোগ দিয়ে আদনানের সব কথা শোনার পর রোজার ভীষণ মন খারাপ হলো। রোজার উপলদ্ধি হলো যে এই মুহূর্তে আদনানের নিজের বলতে একমাত্র ও ছাড়া আর কেউই নেই। রোজা আর কথা বাড়ায়নি, আদনানের কথা শোনার পর রাতে একটুও ঘুমাতে পারেনি। ভেতরটা কেমন অস্থির লাগছিলো, নিজের বলে যাদের সঙ্গে এতগুলো বছর কাটিয়েছে তারা কিভাবে আচরণ করতে পারে? ভেবে পেলো না রোজা। সকালবেলা…রোজার ঘুম কিছুটা দেরিতেই ভেঙ্গেছিলো। উঠে দেখলো বিছানায় কয়েকটা শপিং ব্যাগ রাখা, ব্যাগগুলো ভেতর জামা। রোজা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পাল্টে নিলো, গত রাত থেকে বেনারসিতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো। তৈরি হয়ে রুম থেকে রান্নাঘরে এসেই আদনানকে রান্না করতে দেখে অবাক হলো রোজা! সকালের তুলনায় মোটামুটি ভারী নাস্তাই বানিয়েছে, বাড়িতে এক চুলা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। এখন রান্নার জন্যে প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম হাজির দেখে রোজা অনেকটা অবাক হলো…
‘ এগুলো কখন আনলেন? আর এতো তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রান্নাও বসিয়ে দিয়েছেন?’
‘ অনেক সকালেই উঠে গেছিলাম, দরকারের জিনিস যতো দ্রুত কিনে আনা যায় ততোই ভালো’
‘ বাহ! আপনি দেখি বেশ ফাস্ট, এগুলো গোছাতে গেলে আমারও অনেকটা সময় লাগতো। কিন্তু সকাল সকাল এতো রান্নার আয়োজন কিসের?’
আদনান রান্না করতে করতেই বললো…
‘ এভরিথিং ইজ ফর মাই ডিয়ার ওয়াইফ ‘
‘ বাজারে গেছিলেন? আর আমাকে ডাকেননি কেনো?’
‘ দেখলাম তুমি অনেক আরাম করে ঘুমাচ্ছো, তোমার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না তাছাড়া আমি যখন খাবার বানাতেই পারি তাহলে শুধু শুধু তোমাকে কেনো ডাকবো?’
‘ তারমানে এসেই রান্না শুরু করে দিয়েছেন? দেখি, সরুন আমি বাকি রান্না করে নেবো’
রোজা দ্রুত হাতখোপা করে আদনানকে সরিয়ে নিজে রান্নার কাজে লেগে পড়লো, রোজার জন্যে কি পোশাক আনবে ভেবে পায়নি তাই শাড়ি, কামিজ দুই ধরনেরই এনেছে কিন্তু রোজা প্রথমেই সুতির শাড়ি পরেছে। সকালবেলা মেয়েটাকে এই সাধারণ রূপেও ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে, খোঁপা একটা বেধে কোমড়ে আঁচল গুঁজে মেয়েটাকে এ মুহূর্তে পাকা গিন্নি লাগছে। হুট করেই আদনান রোজাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, একপাশে উন্মুক্ত পেটের ওপর আদনানের হাতজোড়া পড়তেই কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেনো কেঁপে উঠলো মেয়েটা!
‘ কি হলো!’
কোমড় জড়ানো অবস্থাতেই নিচু হয়ে রোজার কাধে থুতনি ঠেকিয়ে আফসোসের স্বরে আদনান বললো…
‘ উম্ম! মনে হচ্ছে আমার আরো আগে বিয়ে করা উচিৎ ছিলো, বউকে রান্না করতে দেখতে যে এতো ভালো লাগে জানা ছিলো না ‘
খুন্তি নাড়তে নাড়তে হাসলো রোজা…
‘ করে নিতেন, আপনাকে বারণ কে করেছিলো?’
‘হুমম, চাইলেই করতে পারতাম কিন্তু যা হওয়ার সেটা তো ভালোর জন্যেই হয় তাইনা? আগে বিয়ে করে নিলে আজ তোমার জায়গায় আমার বউ হিসেবে অন্য কেউ থাকতো! উফফ! তোমার জায়গায় এই মুহূর্তে অন্য কাউকে কল্পনা করা আমার পক্ষে দায়’
‘ হয়ে গেছে আপনার? তাহলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবার প্রায় রেডি হয়ে গেছে’
আদনান যেতেই চাইছিলো না, বাচ্চাদের মতো জেদ করছিলো। রোজা আদনানের এ কান্ড দেখে হতবাক, লোকটাকে এতদিন যেমন দেখে এসেছে এখন যেনো তার সম্পূর্ন বিপরীত রূপ দেখছে। রোজা বুঝে উঠতে পারছেনা আদনান কি বরাবরই এমন ছিলো নাকি বিয়ের পর হুট করে এমন হয়ে গেলো? সকালের নাস্তা শেষে দুজনে মিলে পুরো ফ্ল্যাট গুছিয়ে ফেলে। ছোটো ছোটো প্রয়োজনীয় সকল জিনিসই আদনান কিনে এনেছিলো, সেগুলোই দুজনে গুছিয়ে ফেলে। আপাতত দুজনের সংসারে যা আছে সেগুলোই যথেষ্ট! সারাদিন ধোঁয়ামোছা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে দুজনেই। বসার ঘরের একপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছিলো আদনান, আজ জীবনে প্রথমবার হয়তো এতো বাড়ির কাজ করেছে ও। রোজা একগ্লাস জুস আদনানের হাতে দিয়ে নিজেও বসলো, আদনান ঢকঢক করে পুরো গ্লাস জুস খেয়ে নিলো। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে, রোজা মুচকি হেসে বললো…
‘ আগেই বলেছিলাম, আমি একাই করে নেবো। আপনি এসব করতে গিয়ে ক্লান্ত হবেন, শুনলেন না আমার কথা। এখন কি খারাপ লাগছে?’
‘ নো, আই অ্যাম ফাইন! আসলে প্রথমবার এতকিছু করলাম তো তাই একটু…তবে আজ একটা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, এরপর থেকে তোমার সব কাজে হেল্প করতে পারবো ‘
‘ থ্যাংক ইউ! ওহ হ্যাঁ আদনান, আমার একটা ফোন দরকার। আসলে আমার ফোন সেদিন তাড়াহুড়োয় ওই পার্লারেই ফেলে এসেছিলাম’
‘ ওকে, এনে দেবো আমি। তোমার যদি কাউকে কল করার থাকে তাহলে আমার ফোন দিয়ে করতে পারো ‘
‘ না, এখন প্রয়োজন নেই ‘
হঠাৎ আদনানের কাঁধে মাথা রাখলো রোজা..
‘ একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?’
‘ হুমম ‘
‘এভাবে সব ছেড়ে চলে এসে আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? জানিনা কেনো, আমার অনেক গিল্টি ফিল হচ্ছে। মনে হচ্ছে বড় কোনো ভুল করেছি’
‘ কোনো ভুল করোনি তুমি, যা করেছো সেটা নিজের জন্যে করেছো। গিল্টি ফিল করার কিছুই নেই, আর সবসময় মনে রাখবে আমি আছি তোমার সঙ্গে। তুমি সব ছেড়ে আমাকে বিশ্বাস করে আমার হাত ধরেছো, তোমার বিশ্বাস আমি ভাঙবো না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাকে নিজের পাশে পাবে ‘
আদনানের কথায় অনেকটা মনের জোর বাড়লো রোজার, যদিও ও জানে এখন নিজের বলতে শুধূ ওরা দুজনেই একে অপরের। একসঙ্গে পথচলা যখন শুরু হয়েছে তাতে একসঙ্গে একে অপরকে বিশ্বাস করেই চলতে হবে!
______________________________
সংসার জীবনে তিন মাসের অধিক সময় অতিবাহিত করেছে আদনান ও রোজা। রোজা একটা হাসপাতালে জব পেয়েছে, যদিও গোপনে আদনানই তাতে সাহায্য করেছে কিন্তু রোজা জানেনা। সংসার – জব দুটো মোটামুটি ভালোভাবেই ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছে যদিও এখনও পুরো ব্যালেন্স করে উঠতে পারেনি তবে আদনানের তাতে কোনো আপত্তি নেই, রোজাকে যতোটা সম্ভব নিজে সাহায্য করার চেষ্টা করে। এছাড়া অ্যাপার্টমেন্টের সকলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে রোজা – আদনানের। আজ রোজার জন্মদিন, আদনান ভেবেছিলো রোজাকে নিয়ে সেলিব্রেট করবে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি কারণ রোজার আজ নাইট ডিউটি আছে। আদনান একবার বলেছিল হসপিটালেই কেক নিয়ে চলে আসবে কিন্তু রোজা মানা করে।বেচারার মন খারাপ হয়েছিলো কিন্তু কি আর করার, রোজাকে তো আর কাজে বিরক্ত করা যাবেনা। রাতে, রোজার সঙ্গে ফোনে কথা শেষে ডিনার সেরে নেয় আদনান। কিছুদিন যাবত একটা কাজে ভীষন ব্যস্ত আদনান, সেটা সম্পূর্ন হয়নি। এখনও তা নিজেই কাজ করছে। রাত নয়টার দিকে আদনানের একটা ফোন আসে, ফোনের ব্যক্তিটির সঙ্গে দেখা করার কথা হয়। আদনান আর দেরী না করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ওদিকে… রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে, এখন কিছুটা ফ্রি আছে ভেবে রোজা ল্যাপটপ অন করে দেশের খবর চালু করলো এবং আদনানকেও কল করলো কিন্তু আদনান ফোন তুললো না। কয়েকবার কল করার পরও ফোন তুললো না, আদনান কখনো এমন করেনা। বিশেষ করে রোজার ফোনের বেলায় এমন কখনোই করেনা! এরই মাঝে খবরে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে দুর্ঘটনার খবর, এদিকে আদনান ফোন ধরছেনা দেখে রোজার চিন্তা বেড়ে গেলো। যদিও এ সময় আদনান বাইরে যায়না, তবুও চিন্তা হতে শুরু করলো রোজার! খারাপ কিছু ঘটলো না তো?
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]