#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৯+২০
পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে হসপিটাল বেডে আবিষ্কার করলো রোজা, সামনেই ডা. জোহরা ও নার্স দাড়িয়ে আছে। দুজনে কোনো এক বিষয় নিয়ে আলাপ করছে, রোজা মাথা চেপে ধরে আস্তে আস্তে উঠে বসলো। ডা. জোহরা জিজ্ঞাসা করলেন…
‘এখন কেমন লাগছে?’
‘ ভালো, আমি কি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম?’
‘ ইয়াহ! পরে গিয়ে মাথায় আঁচড়ও লেগেছে। ভালো তো মাথাটা টেবিলের কোণায় লাগেনি, তাহলে আরেক অঘটন ঘটতো’
রোজা কপালের এক কোণে হাত দিয়ে বুঝলো ছোটো ব্যান্ডেজ লাগানো। ও নিজেও ভেবে পাচ্ছেনা এভাবে অজ্ঞান কেনো হয়ে গেলো, আগে তো কখনো এমন হয়নি…
‘আমার মনে হচ্ছে ফুল বডি চেকাপ করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন, কোনো সমস্যা ছাড়া তো এমন হওয়ার কথা না’
‘সে তো করতেই হবে। দেখেছো কতোটা অসুস্থ তুমি! আজই তো বলেছিলাম যত্ন নেওয়ার কথা, এখন তো আরো দ্বিগুণ যত্ন নিতে হবে’
‘কি হয়েছে ম্যাডাম?’
‘নিজেই দেখো’
রোজা প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেছিলো, পরে ডাক্তারের হাত থেকে রিপোর্ট নিয়ে চেক করলো। প্রেগনেন্সির জন্যে ব্লা’ড টেস্ট করা হয়েছে এবং রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। টেস্টের রিপোর্ট দেখার পরই হাতটা কেঁপে উঠলো রোজার, এ মুহূর্তের জন্যে মেয়েটা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মুহূর্তের মধ্যে বাম হাতটা পেটের ওপর রেখে স্মিত হাসলো রোজা, ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন…
‘প্রেগনেন্সির চার সপ্তাহ চলছে তোমার, একটুও
বুঝতে পারোনি?’
‘ আসলে কিছুদিন যাবত দুর্বল বোধ করছিলাম কিন্তু আমার শরীরে হিমোগ্লোবিন কম তাই ভেবেছিলাম এটাই দুর্বলতার কারণ। আমরা এখনো বেবিপ্ল্যান করিনি তাই আর এই বিষয়টা মাথায় আসেনি’
‘আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। তবে যা হওয়ার ভালোর জন্যেই হয়। কনগ্রাচুলেশন রোজা, কিন্তু তোমার শরীর অনেক দুর্বল। আজ হসপিটালের ভেতর জ্ঞান হারিয়েছিলে বলে কিছু হয়নি, এ ঘটনা যদি রাস্তায় বা অন্য কোথাও ঘটতো তবে কি হতো? ঠিকমতো রেস্ট করতে হবে এখন’
‘ জ্বি! কিন্তু আমাদের মিটিংয়ের কি হলো?’
‘আমরা করে নিয়েছি, তোমাকে পরে সব ডিটেইলস জানিয়ে দেওয়া হবে। এখন তুমি আরেকটু রেস্ট করো’
অতিরিক্ত দুর্বলতার জন্যে ডা. জোহরা স্যালাইন দিয়েছে রোজাকে। সেটা শেষ না হওয়া অব্দি উঠতে পারবেনা। রোজা আর না শুয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসে রইলো। যদিও বাচ্চার জন্যে এখনি প্রস্তুত ছিলো না কিন্তু খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দ লাগছে রোজার, একবার ভাবলো আদনানকে ফোন করে জানানো যাক। পরে ভাবলো সরাসরি বলার থেকে সারপ্রাইজ দিলে ভালো হবে, আদনান নিজেও বেবির জন্যে অপেক্ষা করছিলো। এ খবর শুনলে সে নিশ্চয়ই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে! সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শপিং মলে গেছিলো রোজা, আদনানকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য একটা ছোট্ট প্ল্যান করেছে। শপিং মল থেকে বাসায় না গিয়ে আদনানের অফিসে এসেছে, এ সময় রোজাকে এখানে দেখে আদনান কিছুটা অবাক হলো। রোজা কখনও ওর অফিসে আসেনি!
‘বাসায় না গিয়ে আজ এখানে কেনো?’
রোজা কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে এসে আদনানের কোলে বসে পড়লো, ওর গলা জড়িয়ে আহ্লাদী স্বরে বললো…
‘উম্ম! এমনি, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো’
সাধারণত রোজা যখন কোনো বিষয় নিয়ে খুব খুশি থাকে তখন আদনানের সঙ্গে এমন করে…
‘রিয়েলি? কারণটা কি?’
‘এরজন্যও আবার কারণ লাগবে? কেনো!আমাকে দেখে খুশি হওনি?’
‘অফ কোর্স আই অ্যাম হ্যাপি ডিয়ার!পারলে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা আমার চোখের সামনে বসিয়ে রাখতাম, কিন্তু তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো? দুপুরে খাওনি কিছু?’
‘খেয়েছি তো’
‘নিশ্চয়ই অল্প খেয়েছো, তোমার এই অল্প অল্প খাওয়ার বাজে অভ্যাসটা যে কবে যাবে। এমনিতেই তো এতো স্লিম তুমি, আবার কি আর স্লিম হয়ে হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার শখ জেগেছে?’
আদনান শাসনের স্বরেই কথাগুলো বলছিলো, মেয়েটার খাদ্যাভ্যাস দেখে বেচারা নিজেও চিন্তিত। এদিকে ধমক শুনেও রোজা মিটিমিটি হাসছে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো আদনান…
‘ হাসির কী বললাম?’
‘ কিছুনা, এমনি! তুমি শাসন করছো দেখে মজা পেলাম ‘
‘তোমার আজকে কি হয়েছে বলোতো? হাসি থামাতেই পারছো না আবার হাসপাতাল থেকে ফিরেই এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছো?’
‘ বিকজ আই অ্যাম হ্যাপী টুডে! এই দেখো আমি এটা কি নিয়ে এসেছি’
রোজা আদনানের কোল থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাতে থাকা প্যাকেটটা থেকে ছোটো একটা জুতোর বক্স বের করলো। বক্সটা খুলে আদনানকে দেখালো, ভেতরে নিউবর্ন বেবীদের জুতো! ল্যাভেন্ডার রংয়ের জুতোটা দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে…
‘এটা কেমন হয়েছে?’
‘কিউট! কোনো বেবিকে গিফট করবে নাকি? এক মিনিট তুমি কিনতে গেলে কেনো? আমাকে কল করলেই পারতে আমি কিনে নিয়ে চলে যেতাম’
‘ভবিষ্যতে তুমিই তো কিনবে, কিন্তু প্রথম জোড়া না হয় আমিই কিনলাম’
‘মানে?’
‘ মানেটা নিজেই বের করার চেষ্টা করো’
‘ রহস্য তৈরি করছো কেনো? বলো না’
‘ আমি বলবো না, নিজেই মাথা খাটিয়ে বের করো’
রোজা চাইলেই বলতে পারলো কিন্তু আদনানকে রহস্যের মধ্যে ফেলে একটু মজা নিতে চাইলো, এদিকে আদনান ভেবে পাচ্ছেনা রোজা কি বললো। ডিনার শেষে ব্রাশ করছিলো আদনান, এখনও রোজার রহস্যের সমাধান করতে পারেনি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই দ্রুত মুখটা ধুয়ে রোজার কাছে এলো, উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো…
‘হেই! তুমি প্রেগনেন্ট?’
রোজা ল্যাপটপে কিছু করছিলো, আদনানের কথা শুনে নিজের কাজ করতে করতেই মুচকি হেসে বললো…
‘কি মনে হয়?’
রোজার কথার সুর শুনেই আদনানের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ওর ধারণাই সঠিক! আদনান কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেনো অন্যকিছুই ভাবতে পারছিলো না। কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে পায়চারি করলো, এরপর রোজার ল্যাপটপটা ধপ করে বন্ধ করে বললো…
‘তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো বলোতো? এতো সিরিয়াস একটা ব্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে মজা না করতে পারলে তুমি? এটা ঠিক করলে না। আর আগে বলোনি কেনো এ কথা?’
‘আমি নিজেই তো আজ জানলাম, চিন্তার কারণ নেই। সব ঠিক আছে, ডাক্তার বলেছে এক মাস হয়েছে’
‘রিয়েলি! তারমানে বেবির আসতে এখনও অনেক সময় লাগবে, আরো আট মাস তাইনা?’
‘তোমার এক্সসাইটমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে পারলে মনে হচ্ছে এখুনি বেবি বের করে নিয়ে আসতে!’
আদনান একগাল হেসে রোজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো…
‘আই অ্যাম সো হ্যাপি রোজা! থ্যাংক ইউ!’
বিয়ের পরপরই আদনানের বেবির শখ জেগেছিলো কিন্তু রোজা এখনও বেবির জন্যে তৈরি ছিলো না বলে ওকে আর জোর করেনি কিন্তু এখন বাবা হওয়ার এই অপ্রত্যাশিত খবরটি শোনার পর যেনো একটু বেশিই আনন্দ হচ্ছে। না চাইতেই পাওয়া জিনিসের আনন্দই অন্যরকম!
_______________________________
অন্যান্য মাসে দু তিনবার করে এলেও এবার তিন মাস পর এসেছেন মোস্তফা সাহেব, আসার সময় কিছু ফলও নিয়ে এসেছেন। সেদিনের পর আদনান ওনার অপেক্ষাতেই ছিলেন, কিন্তু উনি আজ এতদিন পর এলেন। মোস্তফা সাহেব ফ্রুট বাস্কেট আদনানের ডেস্কের ওপর রেখে বললেন…
‘সবসময় খালি হাতে আসাটা ভালো দেখায়না, তাই আজ কিছু নিয়ে এলাম। আমার জানা নেই তোমার প্রিয় ফল কোনটা, তাই এখানে কয়েক ধরনের এনেছি’
ফ্রুট বাস্কেটের ফলগুলোর দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে আদনান বললো…
‘মনে হচ্ছে আপনার টাকাগুলো পানিতে গেছে, কারণ আমার প্রিয় ফল এখানে নেই’
‘ ওহ আচ্ছা, তোমার প্রিয় ফল কোনটা?’
‘ এসব আলোচনার থেকেও গুরুতর একটা বিষয়ে আলোচনা আমাদের বাকি রয়ে গেছে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে লাস্ট টাইম যখন এসেছিলেন তখন কি বলেছিলেন?’
আদনান এখনো নিজের প্রশ্নে অটল আছে বুঝে মোস্তফা সাহেব ভাবলেন এখন আর নিজের পরিচয় গোপন করে লাভ নেই। তাছাড়া আদনানকে নিজের পরিচয় জানানোর জন্য উনিও এতদিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, অবশেষে সেটা এসেছে।
‘হ্যাঁ, মনে আছে আমার। আমি আজ সেই সম্পর্কে কথা বলতেই এখানে এসেছি। আমি এখন যে বিষয়ে কথা বলবো সেটা গ্রহণ করা না করা সম্পূর্ণ তোমার ওপর নির্ভর করবে’
আদনান অতি আগ্রহ নিয়ে শোনার অপেক্ষায় আছে, মোস্তফা সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন…
‘ তুমি নিশ্চয়ই জানো যে পরিবারে তুমি বড় হয়েছো সেটা তোমার নিজের পরিবার নয়, তোমাকে দত্তক নেওয়া হয়েছিলো?’
এ কথা শুনে আদনান বেশ অবাক হলো কারণ খুব কম মানুষই আছে যারা এ কথা জানে আর এনায়েত সাহেব কখনও আদনানকে পালক ছেলে বলে অন্যের কাছে পরিচয় দেননি…
‘সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?’
‘ তুমি যে পরিবারে গেছো সেই পরিবার থেকে শুরু করে তোমার বড় হওয়া এবং এই অব্দি সবকিছুই খোঁজ রেখেছি আমি। কাছে থেকে বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি তবে দূর থেকে তোমার খোঁজ রাখার চেষ্টা করেছি’
” বাবা ” শব্দটি শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেনো থমকে গেলো আদনান, পরক্ষণেই বললো…
‘কি বলতে চাইছেন আপনি? আপনি আমার বাবা নন, আমার বাবা এনায়েত সিদ্দিকী’
‘উনি তোমার পালক বাবা’
‘ তো? আপনি বলতে চাইছেন আপনি আমার আসল বাবা?’
লোকটির মৌনতা জানান দিচ্ছে আদনান যা বলছে সেটা সঠিক কিন্তু আদনান যে বিষয়টা মানতে পারছেনা। বিষয়টা কেমন নাটকীয় মনে হচ্ছে ওর!
‘দেখুন, আমি জানিনা আপনি কি চান বা কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন। অযথা এসব কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না’
‘তিন বছর বয়সে তোমাকে ওই অনাথ আশ্রমে আমি রেখে এসেছিলাম। তোমাকে ওখানে রেখে আসার দু – তিন সপ্তাহ পরেই তোমার বর্তমান বাবা মা তোমাকে দত্তক নিয়েছিলো’
আদনান স্থির নজরে মোস্তফা সাহেবকে দেখছে, ওনার কথাগুলো শুনে আদনান বিশ্বাস করতে পারছেনা আবার উনি যেভাবে বিস্তারিত সব বলছে তাতে অবিশ্বাস করারও উপায় নেই!
‘ আমি জানি এতো বছর পর আমার হয়তো তোমার সামনে আসা ঠিক হয়নি কিন্তু এতদিন পরে তোমাকে কাছ থেকে দেখতে পাবো এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।নিজেকে আটকাতে পারিনি আমি’
‘বাবা হয়ে নিজের ছেলেকে অনাথ আশ্রমে ফেলে গেছিলেন, এতবছর পর আবার সেই কথাই আমাকে বলতে এসেছেন? সিম্প্যাথি নিতে চাইছেন?’
‘ না আদনান, আমার তোমার প্রতি কোনো চাওয়া নেই। আমি শুধু চাই তুমি জানো কে তোমার আসল বাবা। তোমার মা আর আমি কলেজ লাইফে বিয়ে করেছিলাম, বিয়ের পর থেকে আমাদের সংসারে অশান্তি ছিলো। একসময় তোমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমাদের সংসার ভেঙে যায়। আমি একা তোমাকে পালতে পারছিলাম না আর আমার তেমন আর্থিক অবস্থাও ছিলো না। তোমার ভালো একটা ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি…’
কথাগুলো বলতে গিয়ে মোস্তফা সাহেব যে কতোবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন তার ইয়োত্তা নেই, আদনান এসব শুনে যেনো স্তব্ধ হয়ে গেছে। সারাজীবন ও ভেবে এসেছে ওর আসল মা বাবা হয়তো বেঁচে নেই, ও অনাথ। কিন্তু ত্রিশের কোটায় এসে যে নিজের আসল বাবার মুখোমুখি হয়ে এসব কথা জানবে তা কল্পনাও করেনি! সব শোনার পর নিজের প্রতি নিজেরই কেমন সহানুভূতি জাগছে, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদনান…
‘আমার মা আমার কথা ভাবেনি, সে সংসার ছেড়ে চলে গেলো। এরপর আপনিও আমাকে পালতে পারবেন না এই অজুহাতে আমাকে অনাথ আশ্রমে ফেলে এসে নিজের দায় সেরেছেন। এ থেকে কি বোঝা যায়? আপনারা পুতুল খেলার সংসার করেছেন, এন্ড আই ওয়াজ আনওয়ান্টেড!’
‘আদনান, আমার জায়গায় তুমি থাকলে হয়তো সেই পরিস্থিতিতে…’
আদনান রাগী কন্ঠে বললো…
‘আমি আর যাই করতাম, অন্তত জীবিত থাকা অবস্থায় আমার সন্তানকে অনাথ আশ্রমে ফেলে আসতাম না! আমার বাবা আমাকে এতো উইক হতে শেখাননি!’
জন্মদাতা পিতা জীবিত থাকা সত্ত্বেও অন্যের ঘরে পালক হিসেবে বড় হওয়ার থেকে বড় যন্ত্রণার কিছু আর হয়তো নেই। পিতার কাছেই নিজের অনাথ আশ্রমে যাওয়ার কারণ ও কাহিনী শোনার পর মোস্তফা সাহেবের প্রতি কেমন তিক্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো আদনানের মনে। মা বাবা এমন স্বার্থপর হয় কিভাবে? মোস্তফা সাহেব জানেন বাবা হিসেবে উনি ব্যর্থ হয়েছেন, আর সব জানার পর আদনানের কাছে এর থেকে ভালো আচরণ পাবেননা তা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন! কিছু বলার মুখ ওনার আর নেই।
‘বাবা হিসেবে আমাকে মেনে নেওয়া তোমার জন্যে সহজ হবেনা আমি জানি, তবুও…’
ডেস্কে কুনুই ঠেকিয়ে এক হাতে কপাল চেপে ধরেছে আদনান, হুট করেই মাথা যন্ত্রণা করছে। এসবের জন্যে তো ও প্রস্তুত ছিলো না…
‘দেখুন, আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। আমি বরাবর ভেবে এসেছিলাম আমার মা বাবা হয়তো জীবিত নেই, কিন্তু আপনারা যে নিজেদের শান্তির কথা ভেবে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন এমন কিছু আমি কল্পনাও করিনি’
‘ তুমি ওই বাড়িতে যেভাবে বড় হয়েছো সেভাবে আমি তোমায় বড় করতে পারতাম না আদনান’
চোখ তুলে তাকালো আদনান, তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো…
‘আপনি শুধু আরাম আয়েশ দেখলেন, অথচ একটা পালক ছেলে পালক মা বাবার কাছে কিভাবে বড় হয় সে খবর কি জানেন? ও বাড়িতে থাকার সুবাদে আমাকে কি কি করতে হয়েছে, কতটা ত্যাগ করতে হয়েছে ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া অ্যাবাউট দ্যাট। আমি নিশ্চিত নিজের বাবার কাছে থাকলে আয়েশ না করতে পারলেও অন্তত নিজের মতো করে বাঁচতে পারতাম’
‘ আদনান…’
‘আমি এখনো সম্মান করেই বলছি চলে যান এখান থেকে ‘
‘ আমার কথাটা একটু…’
এবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ডেস্কের ওপর বারি দিলো আদনান, ক্রোধিত কন্ঠে বললো…
‘আই সেইড লিভ! আর কখনও আমার কাছে বাবার দাবি নিয়ে আসবেন না। এতো বছর সেভাবেই ছিলেন সেভাবেই থাকুন!’
মোস্তফা সাহেব এই ভয়টাই পেয়েছিলেন, উনি জানেন শুধু আদনান কেনো ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এ বিষয়টা মেনে নিতো না। উনি বুঝলেন এখন এখানে ওনার উপস্থিতি আদনানের কাছে বিরক্তির কারণ ছাড়া আর কিছুই হবেনা। উঠে দাঁড়ালেন মোস্তফা সাহেব…
‘বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ জানি, তবুও একটা আর্জি থাকবে তোমার কাছে। আমি যে তোমার আসল বাবা সেটা অন্তত মেনে নেওয়ার চেষ্টা করো, তোমার কাছে শুধু এইটুকুই চাওয়া আমার’
উত্তর দিলো না আদনান, মোস্তফা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলেন। আজকের পর হয়তো ছেলের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবেনা কিন্তু মনে মনে এইটুকু ভেবে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে যে অন্তত ছেলেকে তার বাবার আসল পরিচয় জানাতে পেরেছে! আদনান অনেকক্ষণ কপাল চেপে ধরে বসেছিলো, বিষয়গুলো যেনো এখনো মেনে নিতে পারছেনা। টেবিলের উপর থাকা ফ্রুট বাস্কেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো, না চাইতেও ওর চোখে পানি চলে এসেছে। একসময় ফোঁপাতে শুরু করলো আদনান, নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। জন্মদাতা পিতা ফেলে গেছিলো, পালক পিতার কাছে সে ছিলো নিজের স্বার্থ হাসিলের যন্ত্র। নিজের অস্তিত্বের ওপরই রাগ হচ্ছে আদনানের।ওদিকে…প্রেগনেন্সির প্রায় চার মাস চলছে রোজার, ইতিমধ্যে নিজের ভেতরে কিছু সমস্যা ফেস করছে ও। বেবির কথা ভেবে চিন্তা হওয়ায় কিছু টেস্ট করে ও, সেগুলো দেখার পর থেকেই চিন্তিত রোজা। ডা. জোহরাকে রিপোর্টগুলো একবার দেখিয়ে নিলো। রিপোর্ট দেখার পর ডা. জোহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন…
‘টেস্টের রিপোর্ট তেমন ভালো আসেনি, কম্প্লিকেশন আছে। রিপোর্ট যা দেখছি তাতে তোমার বডি বেবি ধারণ করার জন্যে প্রস্তুত নয়’
‘কিন্তু ম্যাডাম, আমি তেমন গুরুতর কোনো সমস্যা বোধ করছিনা এখনও’
‘এখন যা সামান্য আছে সেগুলো আরো বাড়বে, প্রেগনেন্সির পর থেকেই তোমার হাই ব্লাড প্রেসার হয়েছে যা অনেক ক্ষতিকর। এছাড়াও আরো সমস্যা আছে, রিপোর্ট নিজেও দেখছো’
‘হ্যাঁ আমি দেখেছি, কিন্তু আমি বেবি রাখতে চাই’
‘ কিন্তু রোজা, এটা তোমার জন্যে লাইফ থ্রেট হতে পারে। তোমার মনে নেই? প্রায় তোমার মতোই এমন কিছু সমস্যা নিয়ে এক পেসেন্ট এসেছিলো কয়েকমাস আগে? সিজারের পর প্রেসার হাই হয়ে গেলো, ওনাকে কিন্তু বাঁচানো যায়নি’
‘আমি জানি! সবই ভেবে দেখেছি আমি কোনটি কিছু সমস্যার জন্যে আমার কনসিভ করার চান্স অনেক কম ছিলো, তবুও সৃষ্টিকর্তা আমাকে মা হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন সেটা আমি কিভাবে অগ্রাহ্য করবো?’
‘আমার মনে হয় তোমার একার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হবেনা, এ ব্যাপারে তোমার হাসবেন্ডের সঙ্গে কথা বলো। বেবিটা অ্যাবোর্ট করে…’
‘না ম্যাডাম! নিজের কথা ভেবে বেবিটা অ্যাবোর্ট করার পর যদি চিরতরে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই, একজন নারী হিসেবে সেটা আমার ব্যর্থতা হবে’
‘এটা অনেক রিস্ক হয়ে যাবে রোজা, ভেবে দেখো’
‘ মা হতে গেলে কমবেশি রিস্ক তো সবাই নেয় তাইনা? আপনিও তো একজন মা, বেবিকে সুস্থভাবে দুনিয়ায় আনার মতো রিস্ক আপনিও তো নিয়েছেন ‘
রোজার সঙ্গে যুক্তি তর্কে পেরে উঠলেন না ডা. জোহরা, আর একজন মা হিসেবে এইটুকু ভালোভাবেই জানেন যে নিজের ভালোর কথা ভেবে একজন মা কখনো নিজের সন্তানের ক্ষতি করতে চাননা। একজন ডাক্তার হিসেবে রোজা জানে কোন বিষয়ে কতোটা রিস্ক আছে, ওর ভয় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিজের সন্তানের সুরক্ষা সবার আগে। তাই নিজের ক্ষতি হবে জেনেও বাচ্চাটাকে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটা!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]