#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২৩
গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে আনমনে কিছু ভাবছে রোজা, রাইসার বলা কথাগুলো বারবার কানে বাজছে। যদিও রোজা জানে মেয়েটা যা বলেছে সেগুলো রাগের বশে বলেছে কিন্তু সেগুলো শোনার পর থেকেই রোজার মন খুঁতখুঁত করছে। সত্যিই কি ওর জন্যেই সব হয়েছে? রাইসার এই অবস্থার জন্যে ওই দায়ী? এগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেয়েটা, আদনান ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে রোজাকে দেখছে। ও বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই মেয়েটা কেমন গুম মে’রে আছে, গাড়িতে পুরোটা সময় একটা কথাও বলেনি। আদনান যদিও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, তবে ওর মুখ দেখেই বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে! বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেছিলো, আদনান রোজাকে ঘুমানোর জন্যে তাড়া দিচ্ছিলো কিন্তু রোজার চোখে যে আজ ঘুম আসবেনা। আদনান ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো, পাশেই রোজা শুয়েছিলো। এ পাশ ওপাশ করছিলো ঠিকই কিন্তু ঘুম আসছেনা। বোনের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। এক পর্যায়ে রোজা প্রশ্ন করলো…
‘আচ্ছা আদনান, রাইসার সঙ্গে যেটা হলো তার জন্যে কি আমি কোনোভাবে দায়ী?’
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আদনান…
‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?’
‘বলো না, তোমার কি মনে হয়? একদম নিরপেক্ষ উত্তর দেবে’
‘তুমি কেনো দায়ী হবে? তার জন্যে প্রথমে দায়ী তোমার বাবা যে সব জেনেও তার মেয়েকে নিষাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে আর দ্বিতীয়ত দায়ী নিষাদ যে সংসার করবেনা জেনেও তোমার বোনকে বিয়ে করেছে’
এ উত্তর শুনে রোজা আর কিছু বললো না, আদনান পুনরায় প্রশ্ন করলো…
‘তোমায় মাথায় হঠাৎ এই কথাটা কেনো এলো? এ কথা কে বলেছে তোমাকে?’
‘ কেউ বলেনি, এমনি মনে হলো আর কি!’
‘তোমার বোন বলেছে নাকি এসব?’
রোজার নীরবতায় আদনান বুঝে গেছে রাইসাই এসব কথা ওর মাথায় ঢুকিয়েছে, মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আদনানের…
‘আই কান্ট বিলিভ দিস, কার দোষ সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তারপরও এসবের জন্যে তোমাকে দায়ী করছে?’
‘বয়স কম ওর, তার ওপর এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো। ও যা বলেছে রাগের মাথায় বলেছে ‘
‘তোমার বোন তো বয়সে এতটাও ছোটো নয় রোজা, বোঝার বয়স হয়েছে। মানলাম তোমার বাবা ওকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিল তারমানে এই নয় যে ছাড়াছাড়ি হলে সেই দোষ তোমার ঘাড়ে দেবে’
‘ আদনান, এভাবে বলো না। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারতো না আর এটা তো সত্যিই যে আমি পালিয়ে আসাতেই ওর বিয়েটা দিয়েছিলো’
‘আই নো, তোমার বোন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তারমানে এই না যে তোমার জন্যে এসব হয়েছে। তোমার বাবা যদি নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্যে ওর বিয়ে না দিতো তাহলে তো এসব কিছু হতো না। আলটিমেটলি দোষটা তাহলে কার? তোমার বাবার!’
আদনানের কথাগুলো চুপচাপ শুনলো রোজা, কারণ ও যা বলছে তা তো ভুল নয়। আজ এতকিছু বাবার দোষেই হয়েছে, ওর তো দোষ নেই তবুও মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা অনুতাপ বোধ কাজ করছে রোজার আবার এটা ভেবেও খারাপ লাগছে যে সেদিন যদি নিষাদের সঙ্গে ওর বিয়ে হতো তাহলে রাইসার সঙ্গে আজ যেটা হলো সেটা ওর সঙ্গেও হতে পারতো। রোজাকে নিরব দেখে আদনান বুঝলো মেয়েটা আবারো এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে…
‘দেখো রোজা, আমি চাইনা তুমি এসব অহেতুক বিষয় নিয়ে চিন্তা করো। তুমি দুশ্চিন্তা করলেই এই সমস্যার সমাধান হবেনা ‘
‘আমি দুশ্চিন্তা করছি না ‘
‘ওহ রিয়েলি? তাহলে এতক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করছো কিন্তু ঘুমাতে পারছো না কেনো?’
চুপ হয়ে গেলো রোজা, আদনান বুঝলো এভাবে কাজ হবেনা। মেয়েটাকে ঘুম পাড়াতে হবে, ল্যাপটপটা রেখে নিজেও রোজার পাশে শুয়ে পড়লো…
‘তোমার কাজ শেষ হয়েছে?’
‘তার থেকেও জরুরি কাজ করতে হবে আমার’
রোজাকে বুকে জড়িয়ে নিলো আদনান…
‘ ঘুমাও এখন ‘
‘ আমাকে ঘুম পাড়াতে হবেনা তোমার, তুমি আগে নিজের কাজ শেষ করো ‘
‘ চুপপপ!’
চুপ করে গেলো রোজা, এ মুহূর্তে আর কথা বাড়ালে যে আদনানের বকা শুনতে হবে সেটা বোঝা হয়ে গেছে। এমনিতেই রাইসার কথা শোনার পর থেকে ভালো লাগছেনা, তার ওপর আদনানের বকা খাওয়ার ইচ্ছে নেই ওর! রাতটা কোনরকম আধঘুম অবস্থায় কেটেছে রোজার, সকালে উঠে কাজে যাওয়ার জন্যে তৈরী হওয়ার পরপরই পেটে ব্যথা অনুভূত হয় রোজার। প্রথমে ব্যথাটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর রোজা অনুভব করে যে ওর ব্লি’ডিং হচ্ছে, যেহেতু ওর কম্প্লিকেশন আছে তাই বিষয়টা নিয়ে হেলাফেলা করা উচিত নয়! রোজা ধীরে ধীরে ডাইনিং টেবিলের কাছে এলো, আদনান তখন রান্নাঘরে ছিলো। চেয়ারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রোজা বললো…
‘আদনান আমার সঙ্গে একটু হসপিটালে যাবে?’
‘ আজকে আমি ড্রপ করে দেবো?’
‘আমি বোধহয় আজ ডিউটি করতে পারবো না, ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছি’
সঙ্গে সঙ্গে রোজার কাছে এগিয়ে এলো আদনান, রোজার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। মেয়েটা এক হাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে। ঘাবড়ে গেলো আদনান…
‘ আর ইউ ওকে?’
‘ হালকা ব্লি’ডিং হচ্ছে আমার, চেকাপ করানো দরকার’
ব্লি’ডিং এর কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে গেলো ও, বেবির থেকেও রোজার জন্যে বেশি চিন্তা হচ্ছে ওর। আদনান আর কথা বাড়ালো না, দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেলো রোজাকে। হসপিটালে এসেই রোজা সোজা চেকাপ রুমে চলে গেলো, সাধারণত ব্লি’ডিং হলে যা টেস্ট করা দরকার সেগুলো করিয়ে নিলো। আদনান বাইরে দাড়িয়ে ছিলো, হঠাৎ ডা. জোহরার সঙ্গে ওর দেখা হয়। মাঝে মাঝে আদনান হসপিটালে আসে বিধায় ওকে ডা. জোহরা ভালোভাবেই চেনে। আদনানকে দেখামাত্রই উনি প্রশ্ন করলেন…
‘ আরে আদনান, তুমি এখানে?’
‘ হ্যালো ম্যাডাম, আসলে রোজা বললো ওর ব্লি’ডিং হচ্ছে। তার জন্যে ভেতরে চেকাপ চলছে ‘
‘হোয়াট! এটা তো ভালো কথা নয়। ও কি পড়ে গেছিলো কোথাও বা আঘাত পেয়েছিলো?’
‘ না ‘
‘ তাহলে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তায় ছিলো?’
‘ইয়াহ! গত রাতে একটা বিষয় নিয়ে চিন্তায় ছিলো, সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেনি’
ডা. জোহরা কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন…
‘মেয়েটাকে কতোবার বলেছি যে এই অবস্থায় যতোটা সম্ভব চিন্তামুক্ত থাকতে হবে, এমনিতেই রিস্কি প্রেগনেন্সি তার ওপর যদি ওর শরীর ভেঙে পড়ে সেটা আরো খারাপ হবে’
ডাক্তারের কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়লো আদনানের…
‘রিস্কি প্রেগনেন্সি মানে?’
‘তারমানে রোজা তোমাকে কিছু জানায়নি!’
‘কি হয়েছে ডাক্তার? রোজার কোনো সমস্যা হয়েছে?’
যদিও রোজা বারণ করেছে তবুও ডা. জোহরার মনে হলো একজন স্বামী হিসেবে আদনানের সবটা জানা উচিত। তাই রোজার অনিচ্ছাসত্ত্বেও উনি ঠিক করলেন আদনানকে সব বলবেন!
‘তোমার সঙ্গে আমার রোজার বিষয় নিয়ে গুরুত্তপূর্ণ কিছু কথা বলার আছে, তুমি বরং আমার কেবিনে চলো’
ডাক্তারের কথা শুনে আদনানের বুকের মধ্যে ধুকধুক শুরু হয়ে গেলো, কি এমন বিষয় যা রোজা ওকে জানায়নি? ডা. জোহরা আদনানকে নিজের কেবিনে নিয়ে আসেন…
‘দেখো আদনান, আমাকে যদিও রোজা বারণ করেছিলো কিন্তু আমার মনে হয় তোমার সবটা জানা দরকার। বেবিটা শুধু ওর একার নয়, তোমারও’
‘বেবির কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘ সমস্যাটা রোজার!’
‘ রোজার?’
‘ হ্যাঁ, রোজার প্রেগনেন্সিতে কিছু কম্পলিকেশন দেখা দিয়েছে। যার ফলে ওর শরীর অনেক দুর্বল আর ওর প্রেগনেন্সিও রিস্কি বটে! আমি ধারণা করছি ওর সমস্যা দিনদিন আরো বাড়বে, আর ডেলিভারি টাইমেও রিস্ক আছে’
এই প্রেগন্যান্সির জন্যে রোজার ক্ষতি হতে পারে, এ কথা শোনামাত্রই আদনানের পৃথিবী যেনো থমকে গেলো। সন্তানের আগমন নিয়ে বড্ড আনন্দিত ছিলো সে, রোজা ও নিজেদের সন্তানকে নিয়ে ছোট্ট একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখছিলো আদনান কিন্তু এই সন্তানের জন্যে রোজাকে হারাতে হতে পারে এই কথা জানামাত্রই যেনো সব আনন্দ ফিকে হয়ে গেলো। ডা. জোহরার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ শেষে বেরোলো আদনান, এ মুহূর্তে ওর পা দুটো যেনো টলছে। এমন একটা বিষয় শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না ও, তার ওপর রোজা সবকিছু লুকিয়ে যাচ্ছিলো বুঝেও হতবাক আদনান। ওর যেনো মনে হলো ভালো চাইতে গিয়ে রোজা ওর সঙ্গে একপ্রকার ধোঁকাবাজি করেছে। চেকাপ রুম থেকে আদনান জানতে পারলো রোজা ওর কেবিনে গেছে, রোজার কেবিনে গিয়েই কণ্ঠে আদনান প্রশ্ন করলো…
‘ তুমি এখানে কেনো?’
‘কিছু দরকারী কাগজ নেওয়ার ছিলো তাই এসেছিলাম কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে? আমি খুঁজছিলাম তোমায়, ফোনও ধরলে না’
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে আদনান ভাবছে এতো বড় একটা বিষয় ও কিভাবে লুকিয়ে রাখতে পারছে? আর কেনোই বা করছে? রোজা নিজের প্রয়োজনীয় কাগজগুলো হাতে নিয়ে হাসিমুখে আদনানের কাছে এগিয়ে এলো…
‘চেকাপ করিয়ে টেস্ট করে নিয়েছি, কিছুক্ষণ পরেই রিপোর্ট চলে আসবে। আশা করি রিপোর্ট ভালোই আসবে, আমার মনে হয় স্ট্রেসের জন্যে এমন হয়েছে ‘
এবারও উত্তরস্বরূপ আদনানের নীরবতা ছাড়া কিছুই পেলো না রোজা, উল্টে আদনানের নিরব চাহনি দেখে রোজা বললো…
‘এভাবে কি দেখছো? বলছি তো চিন্তার কিছু নেই’
মিনিট দুয়েক রোজাকে দেখলো আদনান, এরপর ওর হাত ধরে বললো…
‘ চলো, বাড়ি যাবো ‘
রোজা আর কথা বাড়ালো না, দুদিনের ছুটি হসপিটাল থেকে। দুদিন বিশ্রাম শেষে শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে বাকি সিদ্ধান্ত নেবে বলে ঠিক করেছে। পুরোটা রাস্তা রোজা নানানরকম কথা বলেছে কিন্তু আদনান নিশ্চুপ হয়ে ড্রাইভ করছে, রোজা ভাবলো হয়তো চিন্তিত হওয়ায় ও এমন করছে। বাড়ি ফেরার পরও আদনানকে নিরব দেখে রোজা বললো…
‘আমি তোমাকে চেকআপের সব কথা বললাম অথচ তুমি এমন চুপচাপ কেনো? কি হলো তোমার?’
এবার আর নিরব থাকতে পারলো না আদনান, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকেই ওর ভেতরটা রাগে ফেটে যাচ্ছিলো। চোখ গরম করে রোজার দিকে তাকিয়ে আদনান প্রশ্ন করলো…
‘আমাকে তুমি সব বলেছো? আর ইউ শিওর?’
‘হ্যাঁ! আজকে যা যা হয়েছে সবই তো…’
‘আজকের নয় আমি আগের কথা বলছি, ইন ফ্যাক্ট শুরু থেকেই…তোমার কি মনে হয় তুমি আমার থেকে কিছুই গোপন করোনি?’
রোজা কিছুটা চমকালো, আদনান ওর কম্পলিকেশোনের বিষয় নিয়ে কথা বলছেনা তো?
‘ আমি কিছুই গোপন করিনি ‘
রোজা একপ্রকার পালাতে যাচ্ছিলো কিন্তু লাভ হয়নি, আদনান ওর হাত ধরে ফেলে…
‘আর লুকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই রোজা, আমি সবটাই জেনেছি কিন্তু আমাকে যে এতো বড় একটা বিষয় অন্যের মুখ থেকে শুনতে হবে সেটা আশা করিনি’
আদনানের চোখের দিকে তাকিয়েই রোজা বুঝে গেছে যে সে সব জেনে গেছে আর এই বিষয় কে জানাতে পারে তাও রোজার অজানা নয়!
‘আমার সিনিয়র তোমাকে সব বলে দিয়েছে?’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদনান…
‘ ইউ নো হোয়াট রোজা? আমি ভেবেছিলাম সবকিছু ছেড়ে চলে আসার পর তোমার আপনজন বলতে শুধু আমিই আছি, বাট আই ওয়াজ রং। তুমি আমাকে কোনদিন নিজের আপনজন বলে ভাবোনি, নাহলে এরকম একটা বিষয় আমার থেকে গোপন করার কথা চিন্তাও করতে না!’
‘ আদনান, আমি তোমাকে জানাইনি কারণ…’
রোজার হাত কিছুটা ঝাড়া দিয়েই ছাড়লো আদনান, একবুক কষ্ট নিয়ে মলিন হেসে বললো…
‘আমি আর কিছু শুনতে চাইনা, তুমি বলতে বড্ড দেরী করে ফেলেছো’
চলবে…