#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৩
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, বিধায় আজ তেমন রোগী আসেনি। যারা এসেছিলো তাদের দেখা শেষ করে একটু বিশ্রাম করতে বসলো রোজা। চেয়ারে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেয়েটা, এই বাদলা দিনে মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ি খুব মিস করছে। মায়ের কথা মনে পড়তেই ফোনটা হাতে নিয়ে মাকে ফোন করলো রোজা, কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওর মা রিসিভ করেই চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন…
‘ কেমন আছিস মা?’
‘ এইতো আছি, তোমরা ভালো আছো তো?’
‘ তোকে তোর বাবা ঐভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিলো, এরপরও কি ভালো থাকা যায় বল? মা হয়ে আমি তোকে আটকাতে পারলাম না ‘
‘ নিজেকে দোষ দিও না মা, দোষ আমার ছিলো তাই… যাই হোক, বাবা এখনও আমার ওপর খুব রেগে আছে তাইনা?’
‘ হ্যাঁ, জানিসই তো তোর বাবার রাগ কেমন ‘
‘ বিশ্বাস করো মা, আমি কোনো অন্যায় করিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার উপায় জানা নেই আমার ‘
‘ আমি তোকে বিশ্বাস করি মা, কিন্তু তোর বাবাকে কিভাবে বোঝাই বলতো। আমি চেষ্টা করছি কিন্তু তোর কথা তুললেই রাগারাগি করে বাড়ি মাথায় তুলে নেয় ‘
‘ বাবাকে আমায় নিয়ে আর কিছু বলার দরকার নেই মা, আমি চাইনা আমার জন্যে তোমাদের মধ্যে অশান্তি হোক। তাছাড়া আমার মনে হয় না বাবা আমাকে কখনো ক্ষমা করবে ‘
‘ তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না, আমি চেষ্টা করছি। তোর বাবার মাথা এখন গরম আছে তাই, রাগ কমে গেলে দেখবি নিজেই তোকে বাড়িতে আসতে বলবে ‘
মেয়েকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করলেন রোজার মা, কিন্তু নিজের বাবা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত রোজা। এতো সহজে ওর বাবা ওকে বাড়িতে ডাকবে না। মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে তাও কিছুটা হালকা অনুভব করলো রোজা, কথা শেষে ফোন টেবিলের ওপর রাখতেই ওর কেবিনে এক আগন্তকের আগমন ঘটলো! লোকটাকে দেখেই বিরক্ত বোধ হলো রোজার, ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো…
‘ আপনি এখানে কি করছেন?’
অনেকটা বিনা আমন্ত্রণের অতিথির ন্যায় রোজার কেবিনে এসে উপস্থিত হয়েছে আদনান, এসেই রোজার বিরক্তিভরা মুখটায় একনজর বুলিয়ে বাঁকা হাসলো সে…
‘ আপনি সেদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, কিন্তু আমি সেখানে ছিলাম না। তাই ভাবলাম সামনাসামনি এসেই শুনি কি বলতে এসেছিলেন ‘
‘ কোনো রুমে ঢুকতে গেলে নক করে ঢুকতে হয়, এইটুকু কমন সেন্স নেই নাকি? আর আপনি একটা ডাক্তারের কেবিনে কিভাবে হুট করে…’
রোজা পুরো কথা শেষ করার আগেই আদনান উল্টো হেঁটে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় তিনটা টোকা দিয়ে তারপর ভেতরে এলো…
‘ নক করলাম, এবার ঠিক আছে?’
আদনানের কান্ড দেখে তাজ্জব বনে গেলো রোজা…
‘ আপনি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে এখানে এসেছেন?’
‘ ইয়ার্কি করার মতো ফা’ল’তু সময় আমার নেই, তুমি আমার বাড়িতে কি এমন জরুরি কথা বলতে এসেছিলে তাই শুনতে এলাম ‘
‘ তুমি? অপরিচিত একটা মেয়েকে তুমি বলে সম্বোধন করছেন?’
‘ ইয়াহ সো? এইসব আপনি আপনি ফর্মালিটি আমার দ্বারা হবেনা, আর তুমি আমার থেকে বয়সে ছোটোই হবে। বয়সে ছোটো একটা মেয়েকে আপনি কেনো বলবো? বাই দ্যা ওয়ে, আমরা মোটেও অপরিচিত নই! তিনদিন তুমি…’
‘ দেখুন, আমার আপনার সঙ্গে কোনো কথা নেই ‘
আদনান কিছু না বলে চেয়ার টেনে বসে পড়লো…
‘ এক্সকিউজ মি! আপনি এখানে বসছেন কেনো?’
‘ দাঁড়িয়ে কথা বলাটা ভালো দেখায়না ‘
‘ আমি আপনাকে বসতে বলিনি ‘
রোজার কথায় যেনো বিশেষ পাত্তা দিলো না আদনান, কেবিনটায় এক নজর বুলিয়ে আদনান বলে বসলো…
‘ চা কফি কিছু অর্ডার করবেন না? আফটার অল আই অ্যাম ইওর গেস্ট ‘
আদনানের গা ছাড়া কথাবার্তা শুনে এবার রেগে গেলো রোজা, রাগী স্বরে বললো…
‘ দেখুন মিস্টার! এটা হসপিটাল, আপনার বাড়ি নয় আর এই কেবিনটা আপনার বাড়ির রুম নয় যে যখন ইচ্ছে হুট করে ঢুকে পড়বেন। আপনার সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই, চলে যান এখান থেকে ‘
আদনান তীক্ষ্ণ নজরে কিছুক্ষণ রোজাকে পর্যবেক্ষণ করলো, মেয়েটাকে পূর্বের তুলনায় সম্পূর্ন বিপরীত লাগছে!
‘ আমার ওখানে তিনদিন যেভাবে ছিলেন, আপনাকে তো ভেজা বিড়াল ভেবেছিলাম কিন্তু আপনার দেখছি বাঘিনীর মতো রাগ। নট ব্যাড ‘
চোখ গরম করে তাকালো রোজা, জীবনে দ্বিতীয়বার লোকটার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে ছিলো না ওর কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লোকটা নিজেই চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে!
‘ আচ্ছা, অন্য কথা বাদ দিয়ে এবার কাজের কথা বলা যাক। ক্যান উই টক নাও?’
‘ নো!’
‘ আপনি তো এখন ফ্রি আছেন, বাইরে আর রোগীও নেই। তাহলে কথা বলতে সমস্যা কোথায়?’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো রোজা, অ্যাপ্রোনটা চেয়ারে রেখে ফোন হাতে নিয়ে বললো…
‘ আপনার জন্যে আমার শান্তির জীবন তছনছ হয়ে গেছে, এতকিছুর পরও আপনার সঙ্গে বসে কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না ‘
‘ তছনছ হয়েছে মানে?’
‘ তা আপনার না জানলেও চলবে। আর হ্যাঁ নিজের গুরুত্বপূর্ন সময় আমি আপনার সঙ্গে কথা বলে নষ্ট করতে চাইনা। আর আমি আপনাকে দেখতেও চাইনা ‘
আদনান কিছু বলার সুযোগই পেলো না, তার আগেই রোজা কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো! কেবিন থেকে বেরিয়ে যেনো একটু স্বস্তি লাগছে রোজার, এদিকে রোজার আচরণ দেখে আদনান অবাক হলো বটে, ওর কথার মানেও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি তবে সাদিকের দেওয়া বর্ণনা একদম মিলে গেছে, মেয়েটা সত্যিই মা’রা’ত্ম’ক রেগে আছে!
___________________________________
এক সপ্তাহে প্রোডাক্টের সকল খুঁটিনাটি বিষয় ঘাটাঘাটি করে নিয়েছে আদনান, স্বাদের তারতম্যের জন্যে প্রোডাক্ট কম সেল হচ্ছে বিধায় এই বিষয় নিয়ে সকলের সঙ্গে মিটিংও করে নিয়েছে। মিটিং শেষে আদনান সাদিকের হাতে অ্যানালাইজ রিপোর্টের একটা কপি ধরিয়ে বললো…
‘ যাওয়ার সময় আমার বাবাকে এটা দিয়ে আসিস, আমার এখন ওই বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে নেই ‘
‘ ওকে বস!’
‘ ওহ হ্যাঁ, একটা জরুরী কথা ভুলেই গেছিলাম। একটা কাজ করিস, সামনের সপ্তাহে ডা. রোজার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখিস ‘
সাদিক কিছুটা অবাক নজরে তাকালো, আদনান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো…
‘ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?’
‘ না মানে, আপনি গাইনোকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কি করবেন?’
‘ তোর কি মনে হয়?’
সাদিক বেচারা কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে না পেরে আমতা আমতা করে বললো…
‘ ক..কিছুনা বস, আমি সময় করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখবো ‘
সাদিক বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফারহান এসে হাজির হয়, আজ হুট করেই জরুরি মিটিং ডেকেছিলো আদনান বিধায় ফারহান সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেনি। ফারহান অনেকটা রেগেই আদনানকে বললো…
‘ আমার আর বাবার অনুপস্থিতিতে তুই মিটিং করলি কিভাবে আদনান? আমাদের সবাইকে নিয়ে বসা উচিৎ ছিলো না? কোম্পানি তোর একার নয় ‘
‘ বাবা সবকিছুর দায়িত্ব আমার ওপর দিয়েছে, তাই তার অনুপস্থিতিতে মিটিং করাটা দোষের কিছু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না’
‘ ফাইন, তাহলে আমাকে কেনো জানালি না?’
‘ তোর এখানে কোনো প্রয়োজন ছিলো না ‘
রেগে আদনানের কলার চেপে ধরে ফারহান…
‘ তোর কি মনে হয় না সবকিছুতে তুই একটু বেশিই অধিকার দেখাচ্ছিস? ভুলে যাস না, আইনত তোর থেকে আমার অধিকার বেশি ‘
এনায়েত সাহেব তার বড় ছেলেকে ছোটো থেকেই একটু বেশি স্নেহ করেন কারণ আদনানকে তার বাবা নিজের কথামতো চালাতে পারতো আর আদনানও এনায়েত সাহেবকে হতাশ করতো না। সকল গুরুদায়িত্ব আদনানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টা ফারহান আগেও মানতে পারেনি আর এখনও পারেনা। আদনান নিজের কলার থেকে ফারহানের হাত সরিয়ে বললো…
‘ এতো রাগ না দেখিয়ে তোর তো খুশি হওয়া উচিত, কাজের কাজ কিছু না করেও শেষমেশ প্রফিট তোরই হবে ‘
‘ আমি কিছু না করে প্রফিট নিতে চাইনি আদনান, ইভেন এখনও চাইনা কিন্তু তোর জন্যে বাবা আমাকে কিছু করার সুযোগই দেয় না। তুই অর্ধেক দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যা, আমাকে সামলাতে দে ‘
‘ বাবা তোকে যে কাজ দিয়েছে সেগুলো আগে সম্পন্ন কর, যদি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারিস তবে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলবো এ বিষয়ে ‘
‘ করুণা করতে চাইছিস নাকি? তোর করুণা আমার দরকার নেই, আমার বাবার সঙ্গে আমিই কথা বলে নেবো ‘
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো ফারহান, পূর্বে সে অনেক শান্ত প্রকৃতির ছিলো কিন্তু দিনদিন এনায়েত সাহেব সবকিছু আদনানের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় ফারহানের মনে ইন্সিকিউরিটি তৈরি হচ্ছে! আজ বিকেলে অনেকগুলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো রোজার, তিন – চারজনের পর হুট করে আদনান কেবিনে এসে ঢুকে রোজার সামনে বসলো। জরুরি কাজের মাঝে এভাবে আদনানের আগমন মোটেও পছন্দ হলো না রোজার!
‘ আপনার কি লজ্জা নেই? সেদিন বললেন তারপর আবারো চলে এসেছেন?’
‘ শুনেছি ডাক্তাররা তার রোগীদের সঙ্গে খুবই নম্র ব্যবহার করে, কিন্তু তোমার ব্যবহার এতো রুক্ষ কেনো? অন্যদের সঙ্গে এমন করো নাকি শুধু আমার সঙ্গে?’
‘ দেখুন, আমার এখানে অনেক রোগীর সিরিয়াল আছে। আপনার ফালতু কথা শুনে তাদের দেখতে দেরি করতে চাইছি না আমি ‘
‘ বাইরে যে রোগীরা দাড়িয়ে আছে তারা ভিজিট দিয়ে এসেছে, আমিও ভিজিট দিয়ে এসেছি। তাই আমার সঙ্গে আপনার অন্তত দশ মিনিট কথা বলতেই হবে ‘
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]